আমার বন্ধু Saad, প্রায়ই বিকালে ওর সাথে আড্ডা দিই। তো বরাবরের মতোই ওইদিনও আমরা আড্ডা দিচ্ছিলাম, একেক টপিক থেকে একেক টপিকে আলোচনার মোর নিচ্ছিল।
এমন সময়ই আমাদের কথার মাঝখানে এক অচেনা আগন্তুকের হঠাৎ আগমন। আমাদের কাছে এসে সাদকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞাস করলো, ‘আপনি সাদ সাহেব?’এই সুট-টাই পরা লোককে দেখে কিছুক্ষণ থ’মেরে বসে থেকে একটু সময় নিয়ে ও বলল— ‘হ্যাঁ, আমি সাদ।’ লোকটি বলল আপনার সাথে একটু কথা আছে। আমরা দু’জনে সম্মতি দিলাম কথা বলার জন্য।
আলাপচারিতায় জানা গেল এই আগন্তুকের নাম Mahi. সে সাদের সাথে একটি চুক্তি করতে চায়। তার মূল কথা ছিল এরকম—
সাদ সাহেব আমি আপনার সম্পর্কে মোটামুটি ভাবে জানি, এমনকি আপনার বাসাও চিনি। তো, আপনার সাথে আমি একটি চুক্তি করতে চাই। চুক্তিটা হলো এরকম আমি আপনাকে প্রতিদিন নিয়ম করে 1 লক্ষ টাকা করে দেবো মোট ৩০ দিন, আর আপনি আমাকে এর বিনিময়ে প্রথম দিন 1 পয়সা দিবেন। তার কথা শুনে সাদের চক্ষু তো চড়কগাছ, বলে কি এ! মাত্র 1 পয়সা? আগন্তুক মাহি বলল, হ্যাঁ মাত্র 1 পয়সা।
আপনি প্রথম দিন যে 1 লক্ষ টাকা পাবেন তার পরিবর্তে আমাকে 1 পয়সা দেবেন এবং প্রতিদিন তার দ্বিগুণ মানে ২য় দিন আবার 1 লক্ষ টাকার বিনিময়ে আমাকে 2 পয়সা। আবার ৩য় দিন 1 লক্ষের বিপরীতে 4 পয়সা, তারপরদিন 8, 16, 32, 64 পয়সা করে দেবেন।
সাদ তো কোনোরকম কোনো কিছু না ভেবেই গদগদ হয়ে চুক্তিতে সম্মতি দিয়ে সই করে নিল। ভাবল এই অভাবনীয় সুন্দর সুযোগ কোনোভাবেই হারানো কোনো বুদ্ধিমানের পক্ষে উচিত না।
এর ফাঁকেই লোকটি বলল- তবে চুক্তি অনুযায়ী আপনি ১ মাসের আগে চুক্তি থেকে সরে যেতে বা চুক্তিটি কোনোক্রমেই ভাঙ্গতে পারবেন না। আর হ্যাঁ কালকে আপনার 1 পয়সা রেডি রাখবেন, আমি 1 লক্ষ নিয়ে চলে আসব।
এই বলে সেই অচেনা সেই ব্যাক্তিটি উঠে চলে গেল। আমি তখনই সাদকে কিছুটা সতর্ক করে দিলাম, বললাম, তুমি হয়তো কোনো মারপ্যাঁচে পড়তে যাচ্ছো। তোমার ছিয়াশি বিলিয়ন নিউরনে ঠাসা মাথাটাকে একটু কাজে লাগিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহন কইরো। কে শোনে আমার কথা, এমন সুন্দর টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব পেয়ে? যা-হোক, আমার বন্ধুর পরের কাহিনী আপনাদেরকে আমি বলছি…!
তো, পরদিন সকাল সকাল সাদের ঘরের দরজা কে যেন নক করলো। দরজা খুলেই দেখতে পেল গতকাল পরিচিত হওয়া সেই মাহি। তার হাতে কড়কড়ে নতুন নোটে 1 লক্ষ টাকার একটা বান্ডিল। এটা সাদের হাতে দিলো। । ও জিজ্ঞাসা করলো, নকল বা জাল নোট না তো?
লোকটা বলল, না, এ নিয়ে আপনাকে টেনশন করতে হবে না। আমার 1 পয়সা দেন, আমি চলে যাচ্ছি। টেবিল থেকে নিয়ে লোকটাকে পয়সা দিয়ে দরজাটি বন্ধ করে দিলো। রুমে এসে দেখলো, ঠিক আসল টাকা। কোনো ভেজাল নেই, একটা টাকাও কম নেই। ও ভাবছে এটা স্বপ্ন না তো? নিজেকে চিমটি কেটে শিওর হলো, ও প্রথমে ভাবলো যে ওই লোকটা ডাকাত নয় তো?
এখন চিনে গিয়ে রাতে এসে আবার বাসায় আক্রমণ করবে না তো?
এই নানারকম চিন্তা-ভাবনা করে সাদ ওইদিনটি দুশ্চিন্তায় কোনো রকমে কোনো অঘটন ছাড়াই পার করলো।
তারপর দিন আবার সেই একই সময়ে লোকটি হাজির ওর দরজায়। আবার 1 লক্ষ টাকা দিয়ে নিজের 2 পয়সা মানিব্যাগে পুড়ে রাখলো। আর যাবার সময় বলে গেল, কালকে হাতের কাছে ৪ পয়সা রেখে দেবেন। সাদ বললো, ওকে, সমস্যা নেই।
পরের দিন 1 লক্ষের বিনিময়ে সাদের খরচ হলো মাত্র 4 পয়সা, তার পরদিন 8 পয়সা। এদিকে সাদ তো মহাখুশি, সে ভাবলো লোকটা কী বোকা!
মাত্র কয়েক পয়সার বিনিময়ে সে তাকে লক্ষ লক্ষ টাকার মালিক বানিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। সাদের কাছে এই চুক্তিটি খুবই লাভজনক মনে হচ্ছে। এখন তার কাছ সেই অপরিচিত লোকটিকে ভালোই লাগছে, কোনোরকম সন্দেহ করছে না।
এভাবে ৫ম দিন লোকটি তাকে মোট দিল 5 লক্ষ টাকা, আর তার বিনিময়ে সাদের দিতে হয়েছে মাত্র (1 + 2 + 4 + 8 + 16) = 32 পয়সা।
তার চোখ ছলছল করে উঠলো এত টাকা পেয়ে। লোকটি কত্ত মূর্খ, যে কিনা মাত্র কয়েকটি পয়সার জন্য অন্যকে লাখ লাখ টাকা দিয়ে যাচ্ছে!
এভাবে ১০ম দিন মাহি পেল মাত্র 5 টাকা 12 পয়সা, কিন্তু তার বিনিময়ে সাদ কি টোটাল 10 লক্ষ টাকা পায় নি?
খুশিমতো সাদ টাকা দিয়ে যাচ্ছে লোকটিকে— এরকম ১১তম দিনে 1 লক্ষের বিপরীতে 10 টাকা 24 পয়সা, 12 তম দিনে 20 টাকা 48 পয়সা, ১৩তম দিনে 40 টাকা 96 পয়সা, ১৪ তম দিনে 81 টাকা 92 পয়সা।
১৫ তম দিনে সাদ পেলো কড়কড়ে টাকার ১৫ তম লক্ষ টাকার বান্ডিলটা, আর সেই আগন্তুক পেল 164 টাকা 84 পয়সা। সাদ একটু একটু করে খেয়াল করলো যে প্রতিদিন মাহির টাকার পরিমান বিরাট আকারে বেড়ে যাচ্ছে, যদিও তা ১ লক্ষের পরিমানে খুবই সামান্য।
তবুও তার আনন্দ বেশি দিন টিকলো না। এখন থেকে মাহিকে মাত্র কয়েক পয়সা বা গুটি কয়েক টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যাচ্ছে না, শত শত টাকা করে বেড়ে যাচ্ছে প্রতিদিন।
১৬তম দিনে আগন্তুকের টাকার পরিমানটা ছিল 327 টাকা 68 পয়সা, ১৭তম দিনে 655 টাকা 36 পয়সা, ১৮ তম দিনে ১ লক্ষ টাকার বিনিময়ে 1310 টাকা 72 পয়সা। ১৯তম দিনে 2621 টাকা 44 পয়সা, ২০তম দিনে আবারো 1 লক্ষের বিনিময়ে 5242 টাকা 88 পয়সা।
এখন আর সাদের কাছে চুক্তিটা লাভজনক মনে হচ্ছে না, কারন এখন তাকে আগের থেকেও বেশি পরিমানে টাকা দিতে হচ্ছে। তবে মাহিকে এ পর্যন্ত মোট দিতে হয়েছে 5242 টাকা 88 পয়সা। কিন্তু অপর দিকে নিজে যে 20 লক্ষ টাকা পেয়েছে তা তো অস্বীকার করতে পারছে না।
তবুও সে দেখলো যে তার লাভের পরিমানটা দিন দিন কমেই যাচ্ছে। ২১তম দিনে আবারো 1 লক্ষ টাকার বিপরীতে তাকে খরচ করতে হলো 10,485 টাকা 76 পয়সা, ২২তম দিনে ১লক্ষের বিনিময়ে 20,971 টাকা 52 পয়সা, ২৩তম দিনে ১ লক্ষের বিনিময়ে 41,943 টাকা 04 পয়সা, ২৪তম দিনে 83,886 টাকা 08 পয়সা, ২৫তম দিনে আরও ১ লক্ষের বিনিময়ে 1,67,772 টাকা 16 পয়সা খোয়াতে হলো।
হঠাৎ করেই সাদের চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ দেখা গেল। কিন্তু কেন? তাহলে পরবর্তী কয়েকটি দিনের হিসাব দেখে নেওয়া যাক।
২৬তম দিনে সাদ 1 লক্ষের বিনিময়ে মাহিকে দিতে হলো 3,35,544 টাকা 32 পয়সা, ২৭তম দিনে তা গিয়ে দাড়াল 6,71,088 টাকা 64 পয়সায়।
এখন আমার সেই নির্বোধ বন্ধু সাদ তার নিজের বোকামি বুঝতে পারলো, এখন তাকে থামতে হচ্ছে। প্রতিদিন প্রকান্ড পরিমানে অর্থের পরিমান বেড়েই যাচ্ছে। কিন্তু চুক্তি তো ছিল ১ মাসের, কোনো ভাবেই ৩০ দিন পূর্ণ হবার আগে সে পিছিয়ে যেতে পারবে না।
তো, ২৮ তম দিনে সেই অচেনা লোককে 1 লক্ষ টাকার বিনিময়ে দিতে হলো 13,42,177 টাকা 28 পয়সা। বাকি ২ দিনের টাকা দিতে গিয়ে সাদের অবস্থা পুরোই করুণ, ওকে সব টাকা-পয়সা খোয়াতে হলো।
২৯তম দিনে এর পরিমানটা দাড়ালো 26,84,354 টাকা 56 পয়সা, আর সর্বশেষ দিনে সাদকে ১ লক্ষের পরিবর্তে মাহিকে দিতে হলো 53,68,709 টাকা 12 পয়সা। আগন্তুক তার শেষ কিস্তি নিয়ে চলে গেলো।
এতগুলো টাকা চলে যাবে তা সাদ কল্পনাও করতে পারেনি। আমি সাদকে বললাম, দেখেছো তোমাকে ওই আগন্তুক কীভাবে বোকা বানিয়ে চলে গেল!
তুমি ৩০ দিনে টোটাল পেয়েছো ৩০ লক্ষ টাকা। আর হিসেব করে দেখা গেল মাহি নামের সেই অচেনা লোকটি তোমার থেকে নিয়ে গেল 1,07,37,418 টাকা 23 পয়সা। মানে প্রায় ১ কোটি সাড়ে সাত লক্ষ টাকার মতো। ভেবে দেখেছো মাহি এত বড় অঙ্কের টাকা নিয়ে গেল, তা কিন্তু শুরু হয়েছিল মাত্র ১ পয়সা থেকে !?! সবই গনিতের ভেলকি…!
সাদ আমার কথা শুনে মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলো। আজ যদি অঙ্কে একটু জ্ঞান থাকত, তাহলে ও হয়তো এই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে পারত।
যদি মাহি সাদকে প্রতিদিন 3 লক্ষ টাকা করেও দিত, তাহলে কি সাদের ক্ষতি হতো..? অথবা মাহির..?
দেখুন, এই চুক্তিটি যদি আর মাত্র ৫ দিন বাড়িয়ে দেওয়া হতো; তাহলে মাহি কত টাকা পেত? আর সাদের অবস্থা কী হতো কল্পনা করতে পারছেন...?
***[বি.দ্র: উপরের এই কাহিনীটি সম্পূর্ণ বাস্তব, কাকতালীয়ভাবে কাল্পনিক কারো সাথে মিলে গেল এর দায়ভার কোনো ভাবেই আমার উপর বর্তাবে না কিন্তু...!
Writer: Poluk Hasan Sami
Tags:
Mathematics