ভারতশিল্পে ভগিনী নিবেদিতা



জন্মসূত্রে আইরিশ হলেও তাঁর কর্মভূমি ছিল এই ভারতবর্ষ। তাঁর গুরু স্বামী বিবেকানন্দের কথায় ভারতের প্রতি নিবেদিত তিনি। তাই তাঁর নাম ভারত ভগিনী নিবেদিতা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাঁকে লোকমাতা বলে বন্দনা করেছেন। শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথের অনুপ্রেরণা রূপে কাজ করেছেন। অবন ঠাকুর নিজেই বলেছেন, তাঁর আঁকা বঙ্গমাতা ছবিটি ভারতমাতা রূপে প্রচারিত হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে নিবেদিতার অনুপ্রেরণা। আধুনিক যুগে ভারত শিল্পের অন্যতম এক রূপকার শিল্পাচার্য নন্দলাল বসুর শিল্পসৃষ্টির প্রথমদিকে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন নিবেদিতা। শুধু এদেশের মানুষকে নয়, তিনি ভালোবেসেছিলেন এদেশের ঐতিহ্য, ইতিহাস, পুরাকীর্তি ও শিল্পকলাকে। তাঁর রচিত গ্রন্থ ও চিঠিপত্র পাঠ করলে বোঝা যায় ভারতশিল্পের প্রতি নিবেদিতার সুগভীর মমত্ববোধ ছিল। তিনি ভালোবাসতেন ভারতের ইতিহাসকে, পুরাকীর্তিকে। পুরাইতিহাসের চর্চা ও পুরাকীর্তির যথাযথ সংরক্ষণের জন্য তিনি তাঁর সাধ্যমতো চেষ্টা করে গেছেন আমৃত্যু। আচার্য যদুনাথ সরকারের লেখা পড়ে জানা যায়, নিবেদিতা তাঁর ঐতিহাসিক গবেষণামূলক কাজের প্রতি খুব উৎসাহী ছিলেন। ভারতের ইতিহাস উদ্ধারের চেষ্টায় তিনি খুব আনন্দিত হতেন। ইতিহাস চর্চা বিষয়ক আলোচনায় নিবেদিতার আগ্রহ ছিল অপরিসীম। ভারতের অতীত ও ঐতিহ্যের চিন্তায় তিনি মগ্ন থাকতেন।

স্বামী বিবেকানন্দের অনুপ্রেরণায় নিবেদিতা ভারত ইতিহাস ও শিল্পের চর্চায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এ বিষয়ে প্রথম পাঠ তিনি স্বামীজীর কাছ থেকে পান। স্বামীজীর উৎসাহে ও নিজের আগ্রহে নিবেদিতা এ বিষয়ক চর্চায় নিয়োজিত হন। "স্বামীজীকে যেরূপ দেখিয়াছি" -গ্রন্থে নিবেদিতা বিবেকানন্দের ইতিহাস ও পুরাকীর্তি সম্পর্কে গভীর আগ্রহের বলেছেন। প্রাচীন মন্দির, স্তূপ ও মধ্যযুগের সৌধাদি দেখে গুরুর প্রতিক্রিয়ার কথা বলতে গিয়ে তিনি এসব ব্যাপারে নিজের মতামত প্রকাশ করেছেন। "স্বামীজীকে যেরূপ দেখিয়াছি" ও "স্বামীজীর সহিত হিমালয়ে" -গ্রন্থে উত্তর ভারতের বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথা সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করেছেন। এ থেকে তাঁর ইতিহাস উৎসাহের প্রাথমিক পর্বের কথা জানা যায়। স্বামীজীর কাছ থেকে নিবেদিতা ইতিহাস দৃষ্টি ও শিল্প চেতনা লাভ করেন। পরবর্তীতে এর প্রয়োগ অজন্তা ও ইলোরা সহ বহুক্ষেত্রে দেখতে পাওয়া যায়। 

নিবেদিতা ১৯০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে অজন্তা দর্শন করেন। অজন্তায় তাঁর অভিজ্ঞতা বিষয়ে The Ancient Abbey of Ajanta -নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এই সুদীর্ঘ প্রবন্ধটি 'দ্য মর্ডান রিভিউ' পত্রিকায় ১৯১০ সালে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধে ভারতীয় ভাস্কর্যে গ্রিক, গান্ধার প্রভাব এবং অজন্তার চিত্র, স্থাপত্য ও শিল্পকীর্তি সম্পর্কে মনোগ্রাহী আলোচনা করা হয়। এই প্রবন্ধটি পাঠ করলে এক বিদেশিনী মহিলার ভারতশিল্প সম্পর্কে জ্ঞান ও সুগভীর মমত্ববোধ দেখে বিস্মিত হতে হয়। এই প্রবন্ধে নিবেদিতা খুব সুন্দর ভাবে অজন্তার গুহাচিত্র ও ভাষ্কর্যের শৈল্পিক সৌন্দর্য এবং পুরাকীর্তির মূল্যায়নের কথা ব্যাখ্যা করেছেন। অজন্তা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, "এই অপূর্ব সৌধের জটিলতায়, চিন, গান্ধার, পারস্য এবং সিলনের উপাদান ভারতের প্রতিটি অংশের স্পর্শের সঙ্গে মিশে গিয়েছে।"

অজন্তা দেখে ফিরে এসে কলকাতায় বসে ১৯১০ সালের ৩১শে মার্চ তারিখে তিনি র‍্যাটক্লিফ দম্পতিকে লেখা একটি চিঠিতে লেখেন, "অজন্তার বিষয়ে তোমাকে আমি কিছু বলিনি তার কারণ মনে হয়নি যে, তুমি ও-সম্পর্কে কিছু জানতে চাও। আমি দুঃখিত। পরম সুন্দর তা---সুপ্রাচীন সংঘারাম-জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়---পার্বত্য নদীর উপরে ঝুঁকে-থাকা গিরিখাঁজের উপরে তৈরি। নীল-ধূসর পাথরে নির্মিত সার-সার খিলান ও সমদূরবর্তী স্তম্ভশ্রেণী। প্রথম দেখে তাই মনে হয়েছিল---হিউয়েন সঙ-এরও নিশ্চয়ই তাই। ঘনিষ্ঠতর পর্যবেক্ষণে বোঝা যায়, এটি ধারাবাহিকভাবে বৌদ্ধধর্মী---ইলোরা যেমন যুগসন্ধির সৃষ্টি, এটি তা নয়। সুতরাং এ হল এক বিচিত্র প্রাচীন ও বিস্ময়জনক অক্সফোর্ড-চরিত্রের। একে ভালোবেসে ফেলেছি। তারপর এ হল শিল্প-ইতিহাসের নিদর্শনসমৃদ্ধ। এই বিষয়ে মিসেস হেরিংহামের বোধ অসামান্য--- তাই এক্ষেত্রে ওর শরণই শ্রেয়। কিন্তু একটা কথা বলব, যে মহান কালপর্ব সম্বন্ধে ওর আকর্ষণ, তার আগেই ওখানে প্রাচীনতর ভবনগুলিতে পুরাতন ফ্রা আঞ্জেলিকো ধরনের শিল্পীগোষ্ঠীর রচনা ছিল, যা অতীব সুন্দর ও মর্মস্পর্শী। সমস্ত জিনিসটি যেন ভারতের সান মারকো কনভেন্ট। মিসেস হেরিংহাম হয়ত অজন্তা সম্বন্ধে একটি নতুন সচিত্র বই বার করবেন। তাতে এই ঐতিহাসিক অংশ দেওয়ার পরিকল্পনা যদি থাকে, এবং যদি তিনি আমাকে তা লিখতে বলেন, তাহলে আমি খুবই আনন্দিত হব।" অজন্তা সম্পর্কে ভগিনী নিবেদিতার এই চিঠি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অজন্তা সম্পর্কে তাঁর প্রবন্ধ ও চিঠিপত্রগুলো পড়লে মনে হয়, গুহাচিত্রের শিল্পসৌন্দর্য ও ভাস্কর্যের গঠনশৈলীর বিষয়ে নিবেদিতার পান্ডিত্য অসাধারণ ছিল। 

১৯০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে নিবেদিতা প্রথম ইলোরায় যান। অবশ্য ১৯০৩ সালের আগে থাকতেই তিনি অজন্তা ও ইলোরা সম্পর্কে জানতেন। ইলোরাকে বাঙালীদের কাছে পরিচিত করানোর জন্যে অন্যতম প্রধান উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন ভগিনী নিবেদিতা ও ই বি হ্যাভেল। হ্যাভেল ছিলেন গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ। এছাড়া এতে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর অনেক অবদান ছিল। ইলোরা দর্শন করে ফিরে এসে ১৯১০ সালের মার্চে 'দ্য স্টেটসম্যান' এর প্রাক্তন সম্পাদক এস. কে. র‍্যাটক্লিফ-কে লেখা চিঠিতে ইলোরা সম্পর্কে নিবেদিতা লিখেছিলেন, 'এ হল যুগসন্ধির সৃষ্টি।' ইলোরায় হিন্দু, জৈন ও বৌদ্ধ গুহাগুলোর পাশাপাশি অবস্থান নিবেদিতাকে মুগ্ধ করেছিল। তিনি এতে প্রাচীন ভারতের শিল্প সমন্বয়ের রূপ দেখতে পেতেন।

একই সময়ে ই বি হ্যাভেলকে লেখা চিঠিতে তিনি লেখেন, "সুকুমার লাহিত্য এবং শরীরসংস্থানের সৌন্দর্য ইলোরা বা এলিফ্যান্টার মতো আর কোথাও দেখা যায় না।" ভারতবর্ষের বৌদ্ধ শিল্প বিষয়ক গ্রন্থে জার্মান শিল্প-বিশেষজ্ঞ এলবার্ট গ্রুন্ডেল মন্তব্য করেছিলেন, হিন্দুরা যথার্থ ভাস্কর্য গড়ে তুলতে অসমর্থ ছিল। তাঁর এই মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানান ভগিনী নিবেদিতা। তিনি ইলোরার ভাস্কর্যগুলোর কথা উদাহরণস্বরূপ পেশ করেছিলেন। অজন্তা ও ইলোরা ভ্রমণে নিবেদিতার সঙ্গী ছিলেন স্যার জগদীশচন্দ্র বসু ও তাঁর স্ত্রী লেডি অবলা বসু। তাঁদের লেখায় এর উল্লেখ পাওয়া যায়। এ সময়ে নিবেদিতার ইলোরা পরিদর্শন ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তাঁর আগ্রহ ও উৎসাহই ছিল সবচেয়ে বেশি। 

মূলত নিবেদিতা ও শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথের উদ্যোগে অজন্তার ছবি কপি করার জন্য কলকাতা থেকে সেখানে পাঠানো হয়েছিল নন্দলাল বসু, অসিতকুমার হালদার, ভেঙ্কটাপ্পা প্রমুখ চিত্রকরদের। এ সময়ে শিল্পীদের উৎসাহ যুগিয়ে গেছেন নিবেদিতা। তাঁদের থাকা-খাওয়া ও কাজের অগ্রগতির বিষয়ে তিনি চিন্তিত থাকতেন। নিজের সাধ্যমত সাহায্য করার চেষ্টা করতেন। শিল্পীরা ভারতশিল্পের প্রতি তাঁর এই মমত্ববোধ দেখে অবাক হয়ে যেতো। 

উত্তর ভারতের মুঘল সৌধগুলো বিশেষ করে আগ্রার তাজমহলের অসামান্য স্থাপত্য সৌন্দর্য নিবেদিতার লেখায় প্রাণময় হয়ে ফুটে উঠতো। তিনি তাঁর লেখায় তাজমহলের সাথে অন্যান্য মুঘল স্থাপত্য নিদর্শন যেমন সিকান্দ্রায় অবস্থিত মহামতি আকবরের সমাধিসৌধের স্থাপত্যকলার তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। কাশ্মীরের প্রাচীন ভগ্ন মন্দির স্থাপত্য দেখে তিনি এর নির্মাণশৈলী সম্পর্কে বলতে পারতেন। স্থাপত্য গঠনরীতি ও এর শৈল্পিক ব্যাখ্যায় নিবেদিতার দক্ষতা ছিল প্রসংশনীয়। বুদ্ধগয়ার মহাবোধি মন্দির ও বুদ্ধের বজ্রাসনে খোদিত চক্রের শিল্পমূল্য তাঁর লেখায় আগ্রহব্যাঞ্জক বর্ণনায় উঠে আসতো। দক্ষিন ভারতের প্রাচীন মন্দিরগুলো এক্ষেত্রে তাঁর আগ্রহের অন্যতম কারণ ছিল। তিনি এদের দ্রাবিড়ীয় স্থাপত্যকৌশল ও মূর্তিনির্মাণ শিল্পের বিশ্লেষণমূলক আলোচনা করতেন। 

উত্তর ভারতের প্রাচীন মন্দির, স্তূপ, মুঘল সৌধাদি কিংবা দাক্ষিণাত্যের মন্দির, অজন্তা ও ইলোরার গুহাচিত্র ও ভাস্কর্যের মধ্যে নিবেদিতা ভারতশিল্পের অনুসন্ধান করতেন। তাঁর ইতিহাস নিষ্ঠ ও শিল্প সচেতন বর্ণনায় এসব যেন জীবন্ত হয়ে উঠতো। 

ভগিনী নিবেদিতা সম্পর্কে স্যার যদুনাথ লিখেছেন, "তিনি (নিবেদিতা) বার বার বলিতেন যে প্রাচীন ভারতের হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্দির ও মূর্তিতে, আসবাব ও অলঙ্কারে যে কারুকার্য্য করা হইত তাহা এত ভাল হইয়াছে এই কারণে যে কারিগরগণ নিজ নিজ কার্য্যকে দেব-উপাসনার একটি প্রণালী বলিয়া মনে করিত, নিজ নিজ কাজ ভাল হউক, অপর শিল্পীর কাজকে ছাড়াইয়া উঠুক এই বলিয়া একটা অদম্য আগ্রহ ও উৎসাহ তাহাদের মনে থাকিত, সুতরাং গা ঢিলা দিয়া, ফাঁকি দিয়া মেকী মাল চালাইয়া প্রতারণা করা তখন ঘটিত না।" এই কথাগুলো বলার সময় নিশ্চয়ই নিবেদিতার মনে অজন্তা ও ইলোরার প্রাচীন শিল্পাদর্শ প্রভাব বিস্তার করেছিল। 

লোকমাতা নিবেদিতা, সন্ন্যাসিনী নিবেদিতা, শিক্ষা ও সেবাব্রতী নিবেদিতা -ভারতশিল্পের একনিষ্ঠ সমঝদার ছিলেন তা আমরা তাঁর রচিত গ্রন্থ ও চিঠিপত্র পড়ে বুঝতে পারি। এ ব্যাপারে তিনি আমাদের পথ নির্দেশ করে গেছেন। তাই ভারতশিল্পের ইতিহাসে ভগিনী নিবেদিতার অবদানের কথা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। আজ তাঁর জন্ম দিবসে (২৮শে অক্টোবর, ১৮৬৭) সশ্রদ্ধ প্রণাম সহ একথা বলতে পারি। 


তথ্যসূত্র: 

* অজন্তা - ভগিনী নিবেদিতা, আনন্দ পাবলিশার্স।

* ইলোরা: প্রত্ন ও শিল্প - প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, পত্রলেখা।

* ভগিনী নিবেদিতা - যদুনাথ সরকার, সূচীপত্র।

* বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ (পঞ্চম খণ্ড) - শঙ্করীপ্রসাদ বসু, মন্ডল। 

* স্বামীজীকে যেরূপ দেখিয়াছি - ভগিনী নিবেদিতা, উদ্বোধন। 

* ভগিনী নিবেদিতা - প্রব্রাজিকা মুক্তিপ্রাণা, উদ্বোধন।

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form