ইতিহাসাচার্য যদুনাথ সরকার : জন্মদিনে শ্রদ্ধা



১৮৭০ সালের আজকের দিনে বর্তমান বাংলাদেশের বৃহত্তর রাজশাহী জেলায় আচার্য যদুনাথ সরকার জন্মগ্রহণ করেন। বিপুল কর্মমুখর জীবনে তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন। অধ্যাপনার পাশাপাশি ইতিহাস গবেষণায় আজীবন নিয়োজিত ছিলেন। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার কথা পরিকল্পনা করেও মধ্যযুগকে বেছে নিয়েছিলেন ইতিহাস গবেষণার বিষয় হিসেবে। মুঘলদের প্রশাসন ও পতন এবং আওরঙ্গজেব ও শিবাজীর বিষয়ে তাঁর গবেষণাকর্ম ভারতের ইতিহাস গবেষণায় অতুলনীয় কাজ হিসেবে স্বীকৃত। 

আচার্য যদুনাথের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ ষষ্ঠ মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের জীবন ইতিহাস খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশ করা। এটি তাঁর সবচেয়ে প্রশংসিত ও আলোচিত কাজও বটে। ১৯১৯ সালে 'History of Aurangzib' এর চতুর্থ খণ্ড প্রকাশিত হলে ঐতিহাসিক Beveridge গ্রন্থের সমালোচনায় লিখেছিলেন, Jadunath Sarkar may be called Primus in Indis as the user of Persian authorities for the history of India. He might also be styled as the Bengali Gibbon. . . The account of Aurangzib in the 3rd and 4th volumes is exceptionally good. 

বেভারিজ ১৯২২ সালে আচার্য্য যদুনাথকে Bengali Gibbon আখ্যা দিয়েছিলেন; আর মহারাষ্ট্রীয় ঐতিহাসিক রাওবাহাদুর সরদেশাই উনিশশো আটান্ন খ্রিস্টাব্দে তাঁকে Gibbon of India অভিধায় অভিনন্দিত করেছিলেন। Decline and Fall of the Roman Empire (১৭৭৬ - ১৭৮৯) এর রচয়িতা ইংরেজ ঐতিহাসিক Edward Gibbon এর সাথে Fall of the Mughal Empire (১৯৩২ - ১৯৫০) এর রচয়িতা ভারতীয় ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারের মধ্যে তুলনা কতটা সার্থক তা বিবেচ্য বিষয়। দুজনের দেশ, কাল, সময় ও সমাজ আলাদা। তবুও 'ভারতীয় গিবন' হিসেবে আখ্যায়িত হওয়া তাঁর মহান কীর্তির একটি উজ্জ্বল স্বীকৃতি বলা যায়।

ইতিহাসের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ ও ইতিহাসচর্চায় উৎসাহ তিনি লাভ করেছিলেন তাঁর পিতার কাছ থেকে। "আমার জীবনের তন্ত্র" নামক প্রবন্ধে সেই পিতৃঋণ স্বীকার করে লিখেছেন, "যাঁকে দেখে আমি নিজ জীবনের ধ্রুব লক্ষ্য স্থির করতে পেরেছি, তিনি আমার পিতা, স্বর্গীয় রাজকুমার সরকার....... ইতিহাস ছিল তাঁর প্রিয় পাঠ্য। তিনি আমার বালক চিত্তে ইতিহাসের নেশা জাগিয়ে দেন। আমাকে প্রথমে প্লুটার্কের লেখা প্রাচীন গ্রীক ও রোমান মহাপুরুষদের জীবনী পড়ান। সেই থেকে এবং পরে ইউরোপীয় ইতিহাস পড়ে আমার যেন চোখ খুলে গেল; আমার তরুণ হৃদয়ে অঙ্কিত হ'ল কী করলে কোনো জাতি বড় হয়, কী করলে ব্যক্তিগত জীবনকে সত্য সত্যই সার্থক করা যায়।"

ইতিহাস রচনায় আচার্য্য যদুনাথ বৈজ্ঞানিক পন্থা অবলম্বনের পক্ষে মত পোষণ করতেন। তিনি বলতেন,   "যদি সত্য নির্ধারিত না হইল, যদি অতীতের একটা মনগড়া ছবি খাড়া করি অথবা আংশিক ছবি আঁকিয়াই খান্ত হই, তবে তো কল্পনার জগতেই থাকিলাম। তারপর যে বিষয়ে যাহাই লিখি বা বিশ্বাস করি তাহা বালুকার ভিত্তির উপর তেতলা বাড়ি নির্মাণের চেষ্টা মাত্র।"

যদুনাথ মনে করতেন, সাল-তারিখের ঘেরাটোপের বাইরেও ইতিহাসের একটি ব্যাপক রূপ আছে যা কাব্যধর্মী। তাঁর কথায়, "ইতিহাসকে যে আর্যগন ইতিকাব্য নাম দেন, সেটা বিদ্রূপের বিষয় নহে, এই নামের মধ্যে একটি নিগূঢ় মানব-সত্য নিহিত আছে।" তাঁর ব্যাখ্যায়, "ঐতিহাসিকের পক্ষেও কল্পনাশক্তির আবশ্যক। সত্যের ভিত্তিতে স্থাপিত সহস্র সহস্র ক্ষুদ্র তথ্যের সমাবেশের ফলে গঠিত, সংযত নিয়ন্ত্রিত কল্পনার সাহায্যে অগ্রসর, কবির মহান গঠনশক্তিতে রচিত, ভাষা ও ভাবের সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যে পুটপাক ঔষধের মত যে ইতিকাব্য, তাহাই প্রকৃত ইতিহাস নামের যোগ্য।" যদুনাথের জীবনব্যাপী প্রয়াস ছিল ইতিহাস চর্চার গতিপ্রকৃতি বিষয়ে গবেষকের মনে ধারণা তৈরি করা। তিনি এক সুবিপুল ও সম্মৃদ্ধ তথ্য ভাণ্ডার গড়ে তোলার বিষয়ে জোর দিয়েছিলেন। যাতে করে পরবর্তীতে তা নতুন গবেষকদের গবেষণায় কাজে লাগে। এক্ষেত্রে তিনি জার্মান ঐতিহাসিক লিওপোন্ড ভন র‍্যাঙ্কের  অনুগামী ছিলেন। র‍্যাঙ্কের ইতিহাস চর্চায় তথ্যানুগতা ও সত্যানুসন্ধানে পরিশ্রমী বিশ্লেষণমূলক আলোচনা তাঁকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিল। ইতিহাস দর্শন ও গবেষণার প্রণালীর দিক থেকে তাই তাঁকে "ভারতীয় র‍্যাঙ্কে" বলা যেতে পারে। 

আচার্য্য যদুনাথের মধ্যে ইতিহাস রচনার দু'টি দিক বিশ্লেষণাত্নক বিজ্ঞানধর্মী ও কাহিনী নির্ভরতার অনবদ্য সমন্বয় সাধিত হয়েছিল। ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা তাঁর লেখা ইতিহাসকে কাষ্ঠশুষ্কতার পরিবর্তে প্রাঞ্জল ও সুখপাঠ্য করেছে। যদুনাথের মতে, লেখা হওয়া উচিত প্রাঞ্জল ও সংহত, সব তথ্য একত্রে সন্নিবিষ্ট করা সম্ভব নয়, লেখকের উচিত নিরপেক্ষভাবে তথ্য নির্বাচন। ইংরেজি রচনার মতো বাংলা ভাষাতেও তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য এই প্রসাদগুণ ও ভাষাসৌকর্য। তাঁর প্রথম গবেষক ছাত্র কালিকারঞ্জন কানুনগো জানিয়েছেন, ইংরেজি ভাষায় যদুনাথের প্রিয় লেখক ছিলেন মেকলে এবং ঐতিহাসিক জে. আর. গ্রীন, যাঁর Short History of the English People গ্রন্থের অংশবিশেষ যদুনাথ ইংরেজিতে ঐ ঐতিহাসিক পরিচ্ছেদ রচনার আগে একবার উচ্চস্বরে পাঠ করতেন। মনের ক্লান্তি দূর করতে তিনি আশ্রয় খুঁজে নিতেন কালিদাস ও রবীন্দ্রনাথের রচনার মাঝে। কালিদাস তাঁর কন্ঠস্থ হয়ে গিয়েছিল। মুক্ত কন্ঠে মহাকবি কালিদাসের সংস্কৃত কাব্য তিনি আবৃত্তি করে যেতেন। সংস্কৃত সাহিত্যের প্রতি তাঁর বিশেষ অনুরাগ ও অগাধ পান্ডিত্য এতে প্রকাশিত হতো। 

আচার্য্য যদুনাথ ছিলেন সত্যবদ্ধ ঐতিহাসিক। তিনি নিজের কাজকে সাধনার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। ইতিহাসের সত্যানুসন্ধান ও তথ্যের বিশ্লেষণে নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে প্রায় প্রবাদপ্রতিম করে তুলেছে। দৃঢ় প্রত্যয়ী এই ঐতিহাসিকের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিল এই চেতনা--- "সত্য প্রিয় হউক, আর অপ্রিয় হউক সাধারণের গৃহীত হউক আর প্রচলিত মতের বিরোধী হউক, তাহা ভাবিব না। আমার স্বদেশ গৌরবকে আঘাত করুক বা না করুক, তাহাতে ভ্রুক্ষেপ করিব না। সত্য প্রচার করিবার জন্য সমাজে বা বন্ধুবর্গের মধ্যে উৎসাহ ও গঞ্জনা সহিতে হয়; সহিব কিন্তু তবুও সত্যকে খুঁজিব, বুঝিব, গ্রহণ করিব।" এই সত্যানুসন্ধানের ফলাফল তাঁর জীবনব্যাপী গবেষণার স্বর্ণ ফসল। 

প্রায় ঋষিতুল্য ব্যক্তিত্বের উচ্চতায় অধিষ্ঠিত কঠোর পরিশ্রমী ও নিয়মানুবর্তি মানুষ যদুনাথ সরকার জীবনে অনেক নির্মম শোক সহ্য করেছেন। দুই জামাই, দুই পুত্র, কনিষ্ঠ কন্যা, ভাইপো এবং নাতি--- একে একে তাঁর কাছ থেকে চিরবিদায় নেয়। কিন্তু এতো শোক তাপেও তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ নির্বিকার। হৃদয়ের আবেগ বাইরে প্রকাশ করা ছিল তাঁর স্বভাব বিরুদ্ধ। সর্বাবস্থায় নির্বিকার ও অবিচলিত থাকা মানুষটিকে তাই কেউ সহানুভূতি জানাতেও সাহস করতো না। কোনো শোক সংবাদ শুনে কেউ তাঁকে সমবেদনা জ্ঞাপন করতে গিয়ে দেখতে পেত, কাজের ঘরে তিনি আপন মনে কাজ করে কিংবা বই পড়ে চলেছেন। 

ইতিহাসে যদুনাথের স্থান নির্ণয় করা বেশ দূরহ। অধ্যাপক দীপেশ চক্রবর্তী তাঁর গবেষণায় বলতে চেয়েছেন, "ইতিহাসবিদ স্যার সরকার উনিশ শতকের শেষভাগে ও বিংশ শতকে জনপ্রিয় হওয়া ইতিহাস উৎসাহের ফসল। অসংখ্য ইতিহাস গবেষক ও স্বশিক্ষিত, অপেশাদার ঐতিহাসিক তৈরি করেছিল শতাব্দীর এই ভাগ।" ব্রিটিশ ভারতের শিক্ষা মাধ্যমে ভারতীয় ইতিহাস ছিল অনেকটাই ব্রাত্য। হয়তো এই কারণটি তাঁকে ইতিহাসবিদ হয়ে উঠতে প্রেরণা যুগিয়েছিল। জাতীয়তাবাদী চেতনা তাঁর কাজে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। যদুনাথকে প্রেরিত এক পত্রে বন্ধু রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, "আমাদের দেশে যে কয়জন সাধকের প্রতি আমার গভীরতম শ্রদ্ধা আছে, আপনি তাহাদের মধ্যে একজন।" কবিগুরুর লেখা এই একটি বাক্যে যদুনাথের শ্রেষ্ঠতম মূল্যায়ন করা হয়েছে বলা যায়। 

জন্মের সার্ধ-শতবর্ষ পেরিয়ে এসেছেন স্যার যদুনাথ। তাঁর সার্ধ-শতবর্ষে কোনো প্রকার উদযাপন চোখে পড়েনি। তিনি যে আজ সত্যিই বিস্মৃতপ্রায় তা বোধগম্য হলো। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের সময়ে এদেশের শ্রেষ্ট দশ মেধাজীবীদের মধ্যে স্যার যদুনাথকে গণ্য করা হতো। আর আজ তিনি প্রায় আলোচনার বাইরে। এর দায় আমাদেরই। অবশ্য পদ্ধতিতন্ত্রের নিগড়ে গড়া মানুষটি চিরদিনই নিভৃতচারী ছিলেন। 

আজ জন্মদিনে তাঁকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই। 

১০ ডিসেম্বর, ১৮৭০


তথ্যসূত্র: 

* যদুনাথ সরকার রচনা সম্ভার (এম.সি. সরকার)।

* ঐতিহাসিক আচার্য্য যদুনাথ সরকার - কালিকারঞ্জন কানুনগো।

* আচার্য্য যদুনাথ সরকার - নীহাররঞ্জন রায়।

* স্যার যদুনাথের সান্নিধ্য, গ্রন্থাগারে - দীপেশ চক্রবর্তী।

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form