(গান পর্যালোচনা) গানঃ তোমাকে, ব্যান্ডঃ আর্টসেল, এলবামঃ অনিকেত প্রান্তর



আর্টসেল এর সফট গানের মুষ্টিমেয় লিস্টের গান "তোমাকে " ,
আচ্ছা আমরা সচরাচর এই লিরিক্স শুনে কি ভাববো?
এই "তুমি" তো আমাদের প্রেয়সী,রক্ত মাংসের মানুষ কিংবা কল্পনা ।
আসুন,একটু আলাদাভাবে ভাবা শুরু করা যাক ।
প্রথমেই বলে রাখি ,একান্ত ব্যক্তিগত মতামত, আর সবার উপর শ্রদ্ধা রেখেই ভাষার ব্যবহার করেছি ।

''তোমাকে আলো ভেবে চোখ চেয়ে থেকেছি আঁধারে।"
জীবনের সব সবটুকু আলোর যখন পতন ঘটে তখন আমরা কাকে খুঁজি?
হ্যাঁ, তাঁকেই খুঁজি ।
তাঁর অনেক নাম ,
কেউ ডাকে আল্লাহ,
কেউ ঈশ্বর,
কেউ ভগবান,
কেউ এলোহিম,
কেউ যীশু,
আবার কেউ আরশিনগর এর পড়শী ।
তিনিই আমাদের আরাধ্য।
আঁধার হলো আমাদের জীবনের ব্যর্থতা, দুঃখ কষ্ট সব ধরনের না চাওয়া জিনিস গুলো।
যেগুলো আমাদের ঢেকে রাখে নীরবে।
এসবের ভেতরে একটু আলো হিসেবে দেখার আকাঙ্খা জাগে সেই তাঁকেই ,
তাঁকে মানস চোখে দেখা যায় নাহ,
তাঁকে দেখার আকাঙ্ক্ষা নিয়েই আঁধারে থেকে অপেক্ষা,
এক সময় আমাদের উপর তার প্রেমময় দৃষ্টির জন্য ।
আধাঁরে চেয়ে থাকা কেবল তাঁরই আলোর অপেক্ষায়।

"নীরব থেকে ডেকেছি আমার একা নির্জনে"
ঈশ্বর অন্তর্যামী , তাঁকে ডাকতে কোলাহলের ভেতর ঘোষণা দিতে হয় না যে " হে ঈশ্বর ,আমায় আকাশ করে দাও "....
তিনি তো বলেন নি যে ,তাঁকে আমাদের ডাকতে হবে সবাইকে দেখিয়ে।
তাঁকে ডাকতে হয় নিভৃতে , যখন নির্জনতায় কেবল তারই কোলাহল এ মুখরিত হয়ে যায় আমাদের জীবন ।
তাই আমরাও তাঁকে ডাকি নিভৃতে, একান্ত নিজের মতো করে , তাঁকে ডাকি আমাদের জীবন কে আলোকিত করতে ।
কিসের আলো?
যে আলোয় সব বেদনা পালিয়ে যায়

"স্বপ্নগুলো হারিয়ে ফেলে, চেয়েছি ফিরে তোমার আলোতে"
এখন তো সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে লাইনের অর্থ, আলোকে সৃষ্টিকর্তার করুণা, ভালোবাসার রূপ হিসেবে বলা হয়েছে ।
জীবনের কয়টা স্বপ্ন পূরণ হয় আমাদের?
যখন স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়, আমরা তো তাঁর কাছেই প্রার্থনা করি " আমার স্বপ্ন সত্যি করে দাও,আমাকে পথ দেখাও '।
তার আলোতেই আবার চেয়ে থাকি,নতুন স্বপ্নে বুক বাঁধি।

"তোমাকে যখনই চেয়েছি সত্তার অন্তরালে সংগোপনে, তখনই জেনেছি আলো হয়ে আছো তুমি আমার আঁধারে"
এবার এর ভাবার্থ বোঝা সহজ মনে হচ্ছে না একদম?
সত্তার অন্তরালে সংগোপনে তাঁকে ডাকা,
আর নীরব থেকে একান্ত নির্জনে ডাকা অনেক টা এক মনে হচ্ছে নাহ?
আবার একদম প্রথম লাইনের
" তোমাকে আলো ভেবে চোখ চেয়ে থেকেছি আঁধারে"
এর প্রায় একই অর্থ মনে হচ্ছে তাই না?
আসলে একই,
তবে পার্থক্য এটাই যে ,প্রথমটায় আমরা আঁধারে হাতড়ে ফিরে তার অস্তিত্ব খুঁজেছি, তার হস্তক্ষেপ কামনা করে এসেছি।
এবার এসে জানতে পেরেছি তিনি সবটা সময় সাথেই ছিলেন ,তাঁর অস্তিত্ব সর্বদা আমাদের সাথেই ছিল, আমাদের না দেখতে পাওয়া পথে এগিয়ে দিয়েছেন,আমাদের সমস্ত চলার পথেই তার প্রভাব বিস্তার করে ছিল।
তাঁকে যখন সদ্য নিভে যাওয়া এক চিলতে আলোর মতো আধাঁরে খুঁজেছি,
তিনি সেখানেই ছিলেন ,আমরা চিনে নিতে পারিনি ।
তিনি সবখানে থাকেন , যাকে সংস্কৃতে বলে সর্বভূতেষু ।

"আর যখনই ভেবেছি বাঁধবো সীমা চারপাশে তোমাকে ঘিরে, তখনই ফেলেছি হারিয়ে তোমাকে আপন আঁধারে।"
এবার একটু জটিলতায় আসলাম, আমি নিজেও বেশ কয়েক ভাবে ভেবেও কুলকিনারা করতে পারিনি।
তাঁর চারদিকে সীমার বেষ্টনী তো সম্ভব নয়, এর অর্থ এই হতে পারে যে স্রষ্টার প্রত্যক্ষ অস্তিত্বের সংশয়তা ।
ভেবে দেখুন তো , মাঝে মধ্যে কি মনে হয় না যে ঈশ্বর আল্লাহ ভগবান নেই?
ভেবে দেখুন তো যখন এমন মনে হয় তখন জীবনটা কেমন লক্ষ্যহীন লাগে,
যেন আঁধার থেকে বের করে আনার কেউ নেই,
যেন পথের হদিস দেবার কেউ নেই ,
যেন জীবনের কোনো মানেই নেই,
এক নিষ্প্রাণ আঁধার আবার ঘিরে ধরে আমাদের, চারিদিকে কেবল আধাঁরের অস্তিত্ব ।
আমাদের এই সংশয়তা আমাদের বাধ্য করে স্রষ্টাকে আরও বিশদভাবে জানতে,
কিন্তু তিনি তো আমাদের জ্ঞানের অনেক উর্ধ্বে তাই তাঁর অস্তিত্ব নিয়ে আমরা ভেবে পাইনা ,
আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতায় হারিয়ে ফেলি তাঁকে আমাদের মনের গহীনে ।
আমাদের সীমিত জ্ঞানের ভেতর যখন তাকে চিনতে চাই,আবদ্ধ করতে চাই আমাদের সত্তায় তখনই তাঁকে আবার হারিয়ে ফেলি।
তার কথা ভাবতে ভাবতে কখন তাঁকে হারিয়ে ফেলেছি তার ঠিক হিসেব নেই।

"যেখানে স্বর্গ ভাসে, তোমার আমার আকাশ সেখানে অন্য রঙে আঁকা আয়নায় মৃত জলছবি
সেই ছবিতে, অন্ধ কবি আমি এক হাতড়ে ফিরি আলোর সিড়ি।"
এখানে এই মৃত জলছবি আসলে ঈশ্বরের সমগ্র সৃষ্টি জগৎ, শিল্পী যেমন নিজের ইচ্ছে মতন ছবিতে রঙের প্রলেপ দেন ,আল্লাহর ইচ্ছাতেই আমাদের মহাবিশ্বের সমগ্র অস্তিত্ব। রঙের একেক প্রলেপ এ আমাদের অস্তিত্ব ,আমাদের চারপাশের অস্তিত্ব, আর সেই ছবির ভেতর ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রণে ছুটে চলে যাই আমরা ।
এই আমার কাছে "তোমাকে" গান । যতটুকু না ব্যক্তিকেন্দ্রিক গান,তার চেয়ে প্রার্থনামূলক গান ।
সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত মতামত হিসেবে নেয়ার আরেকবার অনুরোধ জানাচ্ছি।
ধন্যবাদ

আরুশ আনিন্দ্য

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form