ঘ্রাণশক্তি ও সুগন্ধ, প্রজনন, বিবর্তন

প্রজনন ও বিবর্তন


সাহিত্যের রচয়িতা পুরুষ হলেও দেখা যায় তাতে— কাননের ফুলের ন্যায়— নারীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে নানান উপকথা, সৌন্দর্য, উপ্যাখ্যান। নারীদের নাসিকা তুলনামূলকভাবে পুরুষের চেয়ে সুক্ষ্ম হলেও দেখা যায় যে, পুরুষরাই নারীর সুগন্ধিতে সবসময়ের মত আত্মহারা, আত্মভোলা। কিন্তু এর পেছনে বিজ্ঞানটা কি? চলুন জেনে নেয়া যাক।

কুকুরদের নাসিকা শক্তি নিয়ে নিশ্চয় নতুন কিছু বলা লাগবে না। আমরা সবাই তাদের ঘ্রাণ শক্তির ব্যাপারে জানলেও এটা অনেকে জানি না যে, তারা মেটিং সিজনে যার তার সাথে প্রজননে যায় না। বরং তারা কয়েক মাইল দুরত্ব থেকে স্ত্রী কুকুরের মূত্রের গন্ধ পেয়ে ছুটে আসে ( sex attractant pheromones)। শুধু তাই না। তাকে কেন্দ্র করে হানাহানি হবে, প্রতিযোগিতা হবে। মোট কথা কুকুরদের প্রজননে জন্য ঘ্রাণ জিনিসটাই মূখ্য দায়িত্ব পালন করে। তবে ভয় পাবার কারণ নেই। আমি পুরুষদের কুকুরের সাথে তুলনা করছি না।

আমরা এরকমভাবে আরো কতগুলো ম্যামালদের উদাহরণ থেকে দেখতে পাবো যে, যে সকল প্রাণীদের মেটিং সিজন আছে, তারা নানানরকম ইঙ্গিত দেয়, আর যেসকল প্রাণীদের সারা বছর ডিম্বস্ফোটন হয় তারা অন্যরকম ব্যবহার দেখায়। যেমন বাবুনরা কিন্তু গন্ধের মাধ্যমে নারীদের ডিম্বস্ফোটনের সময় বুঝে না। বরং তারা চোখ দিয়ে তাকালেই বোঝে যে, নারী বাবুন এখন তার এস্ট্রাসে আছে। তাদের যোনির অংশ প্রস্ফুটিত হয়ে থাকে। শিম্পাঞ্জিরাও এরকম লক্ষণ প্রদর্শন করে। তাদের যোনির আশেপাশে গোলাপি ছাপ ও মোটা রেখা দেখা যায় যখন তাদের ডিম্বস্ফোটন হয়।

কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে? মানুষ প্রজাতি কি করে বোঝে যে নারী এখন ডিম্বস্ফোটনে আছে? গন্ধের মাধ্যমে? চোখ দিয়ে দেখে দেখে? অন্য মাধ্যমে? আমাদের একটা ধারণা কাজ করে যে, সেক্স করলেই বুঝি প্রেগন্যান্ট হয়ে যায় নারী। কিন্তু প্রেগন্যান্ট হওয়া সাধনার বিষয়, কারণ নারীরা মাসে একটাই গ্যামেট সৃষ্টি করে। এবং তা কখন ওভারি থেকে বের হবে তা নিশ্চিত বলা না গেলেও অনুমান করা যায় যে, তা ঋতুস্রাবের ১০-১৬ দিন আগে হয়ে থাকে। সফল ফার্টিলাইজেশনের জন্য মাসে মাত্র— মাত্র — ১২-২৪ ঘন্টা সময় পাওয়া যায়( fertility window)। এজন্য স্পার্ম কমপিটিশন নিয়ে বিজ্ঞানীরা বেশ কৌতুহলী কারণ স্পার্ম যোনিপথের প্রান্তে ৫-৬ দিন জীবিত থাকতে পারে।

আগে ধারণা করা হতো যে, নারীদের ডিম্বস্ফোটন সম্পর্কে বাহির থেকে বোঝার কোনো উপায় হয়তো আছে, হয়তো নেই। আর বিজ্ঞান যেহেতু শেষ সত্যে বিশ্বাস করে না তাই বিজ্ঞান আগেই কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। বলেছে, " গবেষণা চলমান "। এই গবেষণাকে আমরা " The scent of symmetry " বলতে পারি। ডেভিড বাসস তার পুস্তক " The evolution of desire " এ এই নামেই উল্লেখ করেছেন। গবেষণা তার করা না। সে অনেকগুলো গবেষণার তুলনা ও বিশ্লেষণ করেছেন। এই গবেষণার মূল বিষয় ছিলো, " মানব পুরুষ কি কোনোভাবে বুঝতে পারে যে, নারীর কখন ডিম্বস্ফোটন হচ্ছে? "

বিশেষ ব্যবস্থায়, দিকনির্দেশনায়, নিয়ন্ত্রিত ডায়েটে নেয়া কয়েকদিন ব্যাপী ( তবে প্রস্তুতি কয়েক মাসের) এসকল গবেষণায় দেখা যায় যে, নারীরা যখন তাদের ফার্টিলিটি উইন্ডো বা ডিম্বস্ফোটনের কাছাকাছি থাকে, তখন তার পরিহিত জামাকাপড়ে লেগে থাকা প্রাকৃতিক গন্ধে পুরুষরা বেশি টান অনুভব করে। এরকম আরো অনেকগুলো গবেষণা হয়েছে। সদ্য নেয়া এক গবেষণা আরেকটু কাছে থেকে দেখে আসা যাক। 

এই গবেষণায়, ২৮ জন নারীর— যাদের গড় বয়স ছিলো ২০ এর আশেপাশে— দেহের প্রাকৃতিক গন্ধ যাচাই করে ৫৭ জন পুরুষ। দেহের গন্ধ সংগ্রহ করার আগে নারীদের হরমান মাত্রা মেপে নেয়া হয়। বিশেষ করে oestrediol ও progesterone এর মাত্রা যা ডিম্বস্ফোটন ও মেনসট্রাল সাইকেলের সাথে সম্পর্কিত। ফলাফলে দেখা যায়, যে সকল নারীদের সেই গবেষণার সময় oestrediol এর মাত্রা বেশ ও progesterone এর মাত্রা কম ছিলো, পুরুষরা তাদের দেয়া সেমপেলে বেশি সুগন্ধ পেয়েছে। এর আরেক মানে এই যে, যারা ডিম্বস্ফোটনের একদম নিকটে তাদের দেহ থেকে বেশি মোহিনী প্রাকৃতিক ঘ্রাণ পাওয়া যায়। তবে এটা নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে। আরে চলবে।

নারীরা ডিম্বস্ফোটনের কাছাকাছি সময়ে শুধু সুন্দর ঘ্রাণই দেয় না ( আসলে ঘামের কোনো গন্ধ নেই, ব্যাকটেরিয়ার এর কারণ দুর্গন্ধ হয়) বরং দেখতেও বেশি কামিনী, রূপবতী ও পদ্মাবতী লাগে। ব্যবহারের মধ্যে বেশি উৎফুল্লতা ও শৌখিনতা লক্ষণীয় যা যেকোনো পুরুষকে আকৃষ্ট করে। আধুনিক যুগে আর্টিফিশিয়াল সুগন্ধির ও ডিওডোরেন্টর ব্যবহারে ঘ্রাণ তার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। এই সুযোগে কেমিস্টরা নারী ও পুরুষদের আলাদা আলাদা সেন্ট বানাতে শুরু করলে দেখা যায় যে, আসলেই তা একজন নারী ও পুরুষকে আকর্ষণীয় করে তোলে! পার্ফিউম আধুনিক যুগে সবার হাতে হাতে থাকলেও তা কয়েক হাজার বছর আগে উচ্চবিত্ত নারীরাই ব্যবহার করতো।

তাহলে আমরা বুঝতে পারছি যে, নারীদের দেহের ঘ্রাণের সাথে, তার লাবণ্যের সাথে বিবর্তনের সম্পর্ক কোথায়! যদি ধরতে না পেরে থাকি তাহলে আরো স্পষ্ট করে বলে দেই। এর সম্পর্ক পিতৃত্বের সাথে। বিবাহে ভালোবাসা, আদর, সন্দেহ ও ঈর্ষা দিয়ে নারীদের শাসনে রাখতে চেয়েছে পুরুষ, যেনো সে প্রতারিত না হয়। এক্ষেত্রেও পুরুষদের সেই অরণ্যে অচেতন মনে সচেতন থাকতে হয়েছে যে, নারীর ডিম্বস্ফোটন কবে হতে পারে। সেই সময়ের মধ্যে সে যদি তার সঙ্গীকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে বা নিজের বীর্য দিয়ে প্রেগন্যান্ট করতে পারো তাহলেই সমাধান হয়ে গেলো।

আমার জাস্ট ফ্রেন্ডকে আসলেই মাসের কিছু সময় বেশি আকর্ষণীয় লাগতো। সুগন্ধের বিষয়টা তো বলা সম্ভব না, তবে সে সময় তার ত্বক স্পর্শ করতে মন চেতো। এবং তার ব্যবহারেও সে কয়েকদিন বেশ উৎফুল্লতা থাকতো। এই আরকি। সামনে আরো লিখবো। ধন্যবাদ। 

কেউ যদি বিস্তারিত জানতে চান তাহলে নিচের লিংকগুলো পড়তে পারেনঃ-
https://www.theguardian.com/commentisfree/2015/jun/05/smell-evolution-and-the-sex-brain-why-were-monogamous-and-use-perfume
https://www.google.com/amp/s/www.insider.com/womens-scent-more-attractive-to-men-at-certain-points-in-reproductive-cycle-2018-9%3famp
https://www.whattoexpect.com/getting-pregnant/fertility/five-ways-to-tell-you-are-ovulating.aspx
https://royalsocietypublishing.org/doi/10.1098/rspb.2018.1520 ( সদ্য গবেষণা ) 
https://academic.oup.com/beheco/article/15/4/579/205993 ( সদ্য গবেষণা এবং সুন্দর করে বিস্তারিত লেখা)
https://www.yourhormones.info/hormones/oestradiol/

Writer: Md Ariful islam

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form