১.
ভাষা, ধর্ম, শিল্পকলার মতো সৃজনশীল জিনিসগুলো একান্তভাবে হোমো সেপিয়েন্সদের ট্রেডমার্ক। বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের কারণ এই ভাষা হয়ে উঠে আমাদের ভূষণ। এই ভাষার, ধর্মের উৎপত্তির পেছনে আমাদের বিরাট মস্তিষ্কই যদি দায়ি থাকে, তবে অন্য কোনো প্রাণী বিরাট মস্তিষ্কের অধিকারী হলে তারাও কি ভাষা বা ধর্ম আবিষ্কার করবে?
আজ থেকে ১.৮ মিলিয়ন বছরের আশেপাশে আফ্রিকায় দেখা মিলে হমো ইরেক্টাসের ( Homo erectus) এবং বিলুপ্ত হয়ে যায় আজ থেকে প্রায় ৩০০ হাজার বছর আগে। এবং এরাই হয়তো প্রথম হোমো যারা আফ্রিকা মহাদেশ থেকে বের হয়ে যাত্রা করে দক্ষিণ ইউরোপ, চায়না, ইন্দোনেশিয়া সহ অসংখ্য দ্বীপে। এবং এটা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই যে, তারা নৌকা বানাতে পারতো, সুক্ষ্ম অস্ত্র বানাতে পারতো এবং খাবার রান্না করতে জানতো। তাদের মস্তিষ্কের ফসিলও এটাই ইঙ্গিত করে যে, তারা খুব সম্ভবত ভোকাল ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করতো।
তারা যে ধরণের ভাষা ব্যবহার করতো তা হয়তো বেশি সীমাবদ্ধ ভাষা ছিলো বটে কিন্তু তা " ভাষা " ছিলো। এছাড়াও তারা দুপায়ে হাটতো, অসাধারণ শিকারী ছিলো এবং বিরাট মস্তিষ্কের ( ৯৫০ সিসি, মানে প্রায় নারী স্যাপিয়েন্সের মস্তিষ্কর সমান) অধিকারী ছিলো। তাদের ভোকাল এপার্টাসগুলো হয়তো বর্তমানের গরিলার চেয়ে বেশি উন্নত ছিলো না, তবে তা সংক্ষিপ্ত ও সীমিত শব্দে কথা বলার জন্য যথেষ্ট। এছাড়াও তাদের নানান শিল্পকলা, নৌকা বানানোর পারদর্শিতা, মহাসমুদ্র পারি দেয়া, সিম্বলের ব্যবহার এটাই ইঙ্গিত করে যে তারা যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন হোমো/ প্রাইমেট ছিলো। এখান থেকে খুব সহজেই আমরা বলতে পারি যে, প্রাচীন এক ভাষায় হমো ইরেক্টাসরা ৮০০ হাজার বছর আগেই আবিষ্কার করেছে এবং নিয়েন্দারথেল ও স্যাপিয়েন্সেরা ভাষা মুখর পরিবেশেই বিবর্তিত হয়েছে।
২.
উত্তর স্পেনের Sima de los Huesos নামক স্থানের এক গুহা, আমাদের জানা মতে প্রাচীনতম কোল্ড কেস। কোল্ড কেস মানে এই নিদর্শন, একরাশ ভায়োলেন্ট মৃত্যুর শিকার হওয়া লাশের ভান্ডার। এ স্থানে ২৮ টা দেহের ফসিল পাওয়া গিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত যে, এগুলো ৪৩০ হাজার বছর আগের এবং এগুলো আমাদের কাজিন নিয়ান্ডার্থলের ব্যতীত আর কারো না। হাড়ের মধ্যে এত ভয়ানক ফ্রেকচার এটাই সাজেস্ট করে যে, এরা ভায়োলেন্ট মৃত্যুর শিকার। তবে সবগুলোই একশ্রেণিতে ফেললে ভুল হবে। এর মধ্যে অনেকে হয়তো অন্যভাবে, যেমন প্রাণীর হাতে শিকার হয়ে বা আছাড় খেয়ে মারা গিয়েছে।
এখন মজার প্রশ্ন এই যে, এতগুলো মৃতদেহ এক জায়গায় কি করে এলো? ঠিক এখানেই আমরা ধর্মীয় অনুভূতির ও লাশ কবর দেয়ার আবেগের উৎপত্তিতে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। মানুষ ব্যতীত হাতি, শিম্পাঞ্জি ও নানান প্রজাতির পাখিরাও তাদের প্রিয়জন, সঙ্গী ও আত্মীয়দের মৃতদেহ সৎকার করে এবং সময় অসময়ে সে স্থান পুনরায় ঘুরে আসে। কিন্তু কেনো?
এই অনুভূতির উৎপত্তিকে আমরা চার ভাগে ভাগ করতে পারি৷ প্রথমত, মৃতদেহ থেকে গ্যাস তৈরি হয়। এবং একটা মৃতদেহ পচতে শুরু করলে তা হয়ে উঠে ব্যকটেরিয়া, পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গের নিবাস যা জীবিত মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য বেশ বিপদজনক। এজন্যই কেনো পিঁপড়া মারা গেলে, তাকে অন্যান্য পিঁপড়ারা হয় দ্রুত খেয়ে ফেলে, না হলে বাহিরে টেনে নিয়ে যেয়ে ফেলে বা পুঁতে রাখে। এই কর্মকাণ্ডের সাথে পিঁপড়ার কোনো আবেগ জড়িত নেই।
দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে, মৃত্যুকে বুঝতে পারা এবং আবেগের সঞ্চালন হওয়া। যখন কেনো প্রাণী যথেষ্ট বিবর্তিত হয়ে এটা বুঝতে যে, মৃত্যুই একটি প্রাণীর শেষ পরিণতি, তখনই তাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে শুরু করে আবেগ। এখানে একটু সুস্পষ্ট করতে চাই বিষয়টা। শিম্পাঞ্জিরা কারো মৃত্যুতে ব্যথিত হলেও এটা বলা যাবে না যে, তারা নিজেরা মৃত্যুকে ভয় পায়। তারা স্রেফ এটা বুঝতে পারে যে, কারো মৃত্যু ঘটলে সে নিথর হয়ে যায়। কিন্তু এটা যে তারও পরিণতি, মৃত্যু যে সকলের জন্য অনিবার্য, তা সে ধরতে পারে না।
তৃতীয়তে আসে, মৃত্যুকে সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পারা এবং তাকে একসেন্সে অস্বীকার করার চেষ্টা করা। স্যাপিয়েন্স, নিয়ান্ডারথাল সহ আরো নিকট আত্মীয়রা হয়তো এই স্তরে উপনীত হয়েছে। এই স্তরে এসেই আমরা ও নিয়ান্ডারথালেরা সচেতন মনে কবর দিতে শুরু করলাম। তবে মৃত্যু তখনো এত বড় এক রহস্য ছিলো যে, তাকে কেন্দ্র করে নানানরকম আনুষ্ঠানিকতা গড়ে উঠতে সময় নেয় নি। অদ্ভুত রকমের ধর্ম ও প্রেকটিস এ সময়ে ছিলো বটে।
এরপর আসে চতুর্থ ধাপ। এটা একান্ত মানুষের এলাকা। মানুষের কালচার বিকশিত হতে থাকলে সে তার ক্ষুদ্র জগত থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। মৃত্যুর এই রহস্যের সাথে ধর্মের সংযোগে গড়ে উঠে পরলোকে বিশ্বাস। অপরিচিত কোনো ব্যক্তির মৃত্যুতে আমরা ব্যথিত হই এজন্য যে, তা আমাদের বারবার মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। নিজের জন্যই আমরা নিজেরা হাহাকার করতে থাকি।
* [ এটা স্রেফ একটা এডুকেটেড হাইপোথিসিস। অন্য কোনো প্রাণীর চেতন আছে নাকি না, থাকে সেটা কিরকম এগুলো নিয়ে আমরা কিছু জানি না। আমরা এটাও জানি না অন্যমানুষের চেতনের সাথে আমাদের সাবজেক্টিভির কতটুকু মিল। তাই মৃত্যু আবিষ্কারের বিষয়টা একটা এডুকেটেড হাইপোথিসিস মাত্র। এটাকেই শেষ জ্ঞান হিসেবে না নিলেই ভালো হয়। ]
এখন স্পেনে এই গোরস্থান আমাদের কিসের ইঙ্গিত দেয়? এই গোরস্থান এটারই ইঙ্গিত দেয় যে, নিয়ান্ডারথালেরা সচেতন মনে কবর দিতো। আরো কয়েকটা উদাহরণ দেয়া যাক। ফ্রান্সের La Chapelle aux Saints এর এক গুহায়, ১৯০৮ সালে একটি কংকাল পাওয়া যায়, যার বয়স ৫০ হাজার বছর। এটিও নিয়ান্ডারথালের ফসিল। এটা দেখে বিশেষজ্ঞরা দৃঢ় মতামত দিয়েছেন যে, এটা সচেতন মনে কবর দেয়ার নিদর্শন।
এরকম আরো অনেক উদাহরণ আছে। যেমন ধরুন মাদরিদে পাওয়া একটি শিশু নিয়ান্ডারথালের ফসিল, ( একে নাম দেয়া হয়েছে Loyoza child) যার বয়স ৩৮-৪২ হাজার পুরোনো। এই গুহায় কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে আগুনের ব্যবহার সুস্পষ্ট এবং মৃতদেহের আশেপাশে অনেক ধরনের প্রাণীর হাড় সজ্জিত থাকার বিষয়টা আসলেই কৌতুহল সৃষ্টি করে। একইভাবে, ইরাকে পাওয়া যাওয়া ৬০-৭০ হাজার বছরের পুরোনো ফসিল আমাদের একই ঘটনা বলে— তারা সচেতন মনে কবর দিতো!
সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে এটাও জানা জরুরী যে, সব লাশ কবর দেয়া হতো না। অনেক নিয়ান্ডারথালেরা মৃতদেহের হাড় দিয়ে নিজেদের পাথরের অস্ত্র শান দিতো এবংকি কিছুকিছু মৃতদেহ খেয়ে ফেলতো। বেলজিয়ামে পাওয়া প্রমাণ তাই ইঙ্গিত করে। তবে এটা আমরা এখান থেকে সহজেই বলতে পারি যে, একরকম প্রাচীন ও ধোঁয়াটে ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ান্ডারথালদের মধ্যে সুস্পষ্ট ছিলো। তারা লাশ কবর দেয়ার আবেগের বিবর্তনের তৃতীয় ধাপ পর্যন্ত আসতে পেরেছিলো বৈকি!
৩.
উনবিংশ শতাব্দীর আমেরিকান বিজ্ঞানী সেমুয়েল মর্টনকে ( ১৭৯৯ - ১৮৫১) বলা হয় বৈজ্ঞানিক বর্ণবাদের জনক। সে মানবজাতিকে পাচ বর্ণ বা সম্প্রদায়ে বিভক্ত করেন। তার এই বিভক্তিকরণের ভিত্তি ছিলো মস্তিষ্কের আকৃতি। এই পদ্ধতিতে সে সাদাদের বা caucasian দের দিয়েছেন প্রথম স্থান ও কালোদের বা Ethiopian দের শেষের স্থান। আর যেহেতু তিনি ছিলেন সৃষ্টিবাদী, সেজন্য এই পার্থক্যের মূলে তিনি দায়ি করেছন পাঁচ ধারার মানব সৃষ্টির গল্পকে। জেনে রাখা ভালো, race আর subspecies/ ecotypes কথা দুটো প্রায় একই অর্থ বহন করে।
তবে আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের কি বলে? স্যাপিয়েন্সের উৎপত্তি আফ্রিকায় আজ থেকে ৩০০ হাজার বছর আগে হলেও আমরা আফ্রিকা ত্যাগ করতে শুরু করি আনুমানিক ১০০ হাজার বছর আগে থেকে। এখানেই মজার বিষয় শুরু হয়। যদিও আমরা ৩০-১০০ হাজার বছরের মধ্যে নানান সময়ে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চায়না সহ নানান দেশে যাই, কিন্তু তারপর থেকেই আবার কয়েক হাজার বছর জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই।
কলম্বাস যদি ১৪৯২ সালে আমেরিকা আবিষ্কার না করতো বা ধরুন কোনো কারণে কয়েক মিলিয়ন বছর ধরে আমরা বিচ্ছিন্নই থেকে যেতাম, তাহলে দেখা যেতো আমরা ভিন্ন কোনো প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছি। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে আমিরিকা আবিষ্কার হয়েছে। তাই আমরা সবাই মানুষ বা Homo sapiens এর অন্তর্ভুক্তই রয়ে গিয়েছি। তবে এত হাজার ধরে আলাদা থাকার ফলে আমাদের অতি সামান্য বিবর্তন হয়েছে। আরো সুস্পষ্ট করে বললে জেনেটিক ডাইভার্জেন্স হয়েছে। এর ফলে জাতিগতভাবে মানুষের পার্থক্য এত সুস্পষ্ট। এক জাতির মানুষ এজন্য একটু বেশি শক্তিশালী, বর্ণিল ও বুদ্ধিমান, আর অন্যান্য জাতি সামান্য দুর্বল ও ভিন্ন রঙের। তবে স্বস্তির বিষয় এসকল পার্থক্য অতি সামান্য। তাই আমরা বলতেই পারি যে, চামড়ার নিচে আমরা সবাই সমান।
সকল জীববিজ্ঞানী এই মত পোষণ করেন যে, মানুষ প্রজাতিকে সাবস্পিসিসে ভাগ করার প্রয়োজন নেই। শিম্পাঞ্জি, গরিলাদের বেশ কয়েকটি সাবস্পিসিস আছে তবে মানুষের নেই, যদিও জাতিগত সামান্য পার্থক্য আছে।
৪.
মানুষের ভাষা ও কালচার আবিষ্কার হওয়ার পর থেকে মানুষের এক নতুন সমস্যা দেখা দিলো। এই সমস্যা হচ্ছে কুসংস্কারে বিশ্বাস করে, সে পদ্ধতিতে জীবনধারণ করা। এবং এসকল কুসংস্কার দীর্ঘ সময়ের প্রবাহে মানুষের জেনেটিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম। ধরুণ, কোনো এক কুসংস্কার প্রচলিত হতে শুরু করলো যে, বিশেষ বিশেষ শারীরিক সৌন্দর্য সম্পন্ন নারী পুরুষদের সাথে প্রজনন গেলে ছেলে মেয়ে অন্ধ হয়ে জন্মাবে।
আবার ধরুন, বেশ প্রভাবশালী কোনো ফ্যাশন কয়েক যুগ ধরে প্রচলিত থাকলো। এতে দেখা যাবে কয়েক প্রজন্মের মধ্যে জেনেটিক ডাইভার্জেন্স দেখা যাবে। অনেক কালচারে উচু গলার নারীদের বেশি সম্মান ও মর্যাদা দেয়া হয়। চায়নার কিছু এলাকায় ছোটকাল থেকে নারীদের পায়ের বৃদ্ধি রুদ্ধ করে দেয়া হত। ইউরোপেও নারীরা কোমড় চাপানোর জন্য নানান পোশাক পড়তো। এর পেছনে কোনো জিনগত কারণ নেই। তবে কালচারের এই পরিবর্তন মানুষের জেনেটিক্সের উপর সময়ের সাথে সাথে বেশ ভালোই প্রভাব ফেলে।
--------------- --------------- --------------- --------------- --------------
রেফারেন্সঃ-
১)
https:// www.google.com/ amp/s/ amp.theguardian. com/science/ 2018/feb/20/ homo-erectus-may -have-been-a-sa ilor-and-able-t o-speak
https:// www.google.com/ amp/s/aeon.co/ amp/essays/ tools-and-voyage s-suggest-that- homo-erectus-in vented-language
https:// www.google.com/ url?sa=t&source= web&rct=j&url=h ttps%3A%2F%2Fco gnitivearchaeol ogyblog.files.w ordpress.com%2F 2017%2F04%2Fwyn n-t-1998-did-ho mo-erectus-spea k-cambridge-arc haeological-jou rnal-8-78-81.pd f&ved=2ahUKEwia jvC19-7sAhWd8HM BHfxCAo8QFjAIeg QICBAB&usg=AOvV aw00dqxRJzggH7g 2MtPxhF1S
২)
https:// www.discovermaga zine.com/ planet-earth/ when-did-ancient -humans-begin-t o-understand-de ath
https:// www.google.com/ amp/s/ api.nationalgeog raphic.com/ distribution/ public/amp/news/ 2013/12/ 131216-la-chapel le-neanderthal- burials-graves
https:// www.newscientist .com/article/ mg23230934-800-c ave-fires-and-r hino-skull-used -in-neanderthal -burial-rituals /
https:// www.newscientist .com/article/ 2233918-70000-ye ar-old-remains- suggest-neander thals-buried-th eir-dead/
https:// www.google.com/ amp/s/ www.haaretz.com/ amp/archaeology/ did-neanderthals -believe-in-god -1.5473681
https:// www.nature.com/ articles/ d41586-018-06004 -0
৩)
https:// www.nationalgeog raphic.com/ magazine/2018/ 04/ race-genetics-sc ience-africa/
https:// www.facinghistor y.org/ holocaust-and-hu man-behavior/ chapter-2/ science-race
https:// www.smithsonianm ag.com/ science-nature/ disturbing-resil ience-scientifi c-racism-180972 243/
৪)
https:// en.m.wikipedia.o rg/wiki/ Dual_inheritance _theory
https:// www.pnas.org/ content/107/ Supplement_2/ 8985
ভাষা, ধর্ম, শিল্পকলার মতো সৃজনশীল জিনিসগুলো একান্তভাবে হোমো সেপিয়েন্সদের ট্রেডমার্ক। বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের কারণ এই ভাষা হয়ে উঠে আমাদের ভূষণ। এই ভাষার, ধর্মের উৎপত্তির পেছনে আমাদের বিরাট মস্তিষ্কই যদি দায়ি থাকে, তবে অন্য কোনো প্রাণী বিরাট মস্তিষ্কের অধিকারী হলে তারাও কি ভাষা বা ধর্ম আবিষ্কার করবে?
আজ থেকে ১.৮ মিলিয়ন বছরের আশেপাশে আফ্রিকায় দেখা মিলে হমো ইরেক্টাসের ( Homo erectus) এবং বিলুপ্ত হয়ে যায় আজ থেকে প্রায় ৩০০ হাজার বছর আগে। এবং এরাই হয়তো প্রথম হোমো যারা আফ্রিকা মহাদেশ থেকে বের হয়ে যাত্রা করে দক্ষিণ ইউরোপ, চায়না, ইন্দোনেশিয়া সহ অসংখ্য দ্বীপে। এবং এটা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই যে, তারা নৌকা বানাতে পারতো, সুক্ষ্ম অস্ত্র বানাতে পারতো এবং খাবার রান্না করতে জানতো। তাদের মস্তিষ্কের ফসিলও এটাই ইঙ্গিত করে যে, তারা খুব সম্ভবত ভোকাল ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করতো।
তারা যে ধরণের ভাষা ব্যবহার করতো তা হয়তো বেশি সীমাবদ্ধ ভাষা ছিলো বটে কিন্তু তা " ভাষা " ছিলো। এছাড়াও তারা দুপায়ে হাটতো, অসাধারণ শিকারী ছিলো এবং বিরাট মস্তিষ্কের ( ৯৫০ সিসি, মানে প্রায় নারী স্যাপিয়েন্সের মস্তিষ্কর সমান) অধিকারী ছিলো। তাদের ভোকাল এপার্টাসগুলো হয়তো বর্তমানের গরিলার চেয়ে বেশি উন্নত ছিলো না, তবে তা সংক্ষিপ্ত ও সীমিত শব্দে কথা বলার জন্য যথেষ্ট। এছাড়াও তাদের নানান শিল্পকলা, নৌকা বানানোর পারদর্শিতা, মহাসমুদ্র পারি দেয়া, সিম্বলের ব্যবহার এটাই ইঙ্গিত করে যে তারা যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন হোমো/ প্রাইমেট ছিলো। এখান থেকে খুব সহজেই আমরা বলতে পারি যে, প্রাচীন এক ভাষায় হমো ইরেক্টাসরা ৮০০ হাজার বছর আগেই আবিষ্কার করেছে এবং নিয়েন্দারথেল ও স্যাপিয়েন্সেরা ভাষা মুখর পরিবেশেই বিবর্তিত হয়েছে।
২.
উত্তর স্পেনের Sima de los Huesos নামক স্থানের এক গুহা, আমাদের জানা মতে প্রাচীনতম কোল্ড কেস। কোল্ড কেস মানে এই নিদর্শন, একরাশ ভায়োলেন্ট মৃত্যুর শিকার হওয়া লাশের ভান্ডার। এ স্থানে ২৮ টা দেহের ফসিল পাওয়া গিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত যে, এগুলো ৪৩০ হাজার বছর আগের এবং এগুলো আমাদের কাজিন নিয়ান্ডার্থলের
এখন মজার প্রশ্ন এই যে, এতগুলো মৃতদেহ এক জায়গায় কি করে এলো? ঠিক এখানেই আমরা ধর্মীয় অনুভূতির ও লাশ কবর দেয়ার আবেগের উৎপত্তিতে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। মানুষ ব্যতীত হাতি, শিম্পাঞ্জি ও নানান প্রজাতির পাখিরাও তাদের প্রিয়জন, সঙ্গী ও আত্মীয়দের মৃতদেহ সৎকার করে এবং সময় অসময়ে সে স্থান পুনরায় ঘুরে আসে। কিন্তু কেনো?
এই অনুভূতির উৎপত্তিকে আমরা চার ভাগে ভাগ করতে পারি৷ প্রথমত, মৃতদেহ থেকে গ্যাস তৈরি হয়। এবং একটা মৃতদেহ পচতে শুরু করলে তা হয়ে উঠে ব্যকটেরিয়া, পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গের নিবাস যা জীবিত মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য বেশ বিপদজনক। এজন্যই কেনো পিঁপড়া মারা গেলে, তাকে অন্যান্য পিঁপড়ারা হয় দ্রুত খেয়ে ফেলে, না হলে বাহিরে টেনে নিয়ে যেয়ে ফেলে বা পুঁতে রাখে। এই কর্মকাণ্ডের সাথে পিঁপড়ার কোনো আবেগ জড়িত নেই।
দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে, মৃত্যুকে বুঝতে পারা এবং আবেগের সঞ্চালন হওয়া। যখন কেনো প্রাণী যথেষ্ট বিবর্তিত হয়ে এটা বুঝতে যে, মৃত্যুই একটি প্রাণীর শেষ পরিণতি, তখনই তাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে শুরু করে আবেগ। এখানে একটু সুস্পষ্ট করতে চাই বিষয়টা। শিম্পাঞ্জিরা কারো মৃত্যুতে ব্যথিত হলেও এটা বলা যাবে না যে, তারা নিজেরা মৃত্যুকে ভয় পায়। তারা স্রেফ এটা বুঝতে পারে যে, কারো মৃত্যু ঘটলে সে নিথর হয়ে যায়। কিন্তু এটা যে তারও পরিণতি, মৃত্যু যে সকলের জন্য অনিবার্য, তা সে ধরতে পারে না।
তৃতীয়তে আসে, মৃত্যুকে সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পারা এবং তাকে একসেন্সে অস্বীকার করার চেষ্টা করা। স্যাপিয়েন্স, নিয়ান্ডারথাল সহ আরো নিকট আত্মীয়রা হয়তো এই স্তরে উপনীত হয়েছে। এই স্তরে এসেই আমরা ও নিয়ান্ডারথালেরা
এরপর আসে চতুর্থ ধাপ। এটা একান্ত মানুষের এলাকা। মানুষের কালচার বিকশিত হতে থাকলে সে তার ক্ষুদ্র জগত থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। মৃত্যুর এই রহস্যের সাথে ধর্মের সংযোগে গড়ে উঠে পরলোকে বিশ্বাস। অপরিচিত কোনো ব্যক্তির মৃত্যুতে আমরা ব্যথিত হই এজন্য যে, তা আমাদের বারবার মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। নিজের জন্যই আমরা নিজেরা হাহাকার করতে থাকি।
* [ এটা স্রেফ একটা এডুকেটেড হাইপোথিসিস। অন্য কোনো প্রাণীর চেতন আছে নাকি না, থাকে সেটা কিরকম এগুলো নিয়ে আমরা কিছু জানি না। আমরা এটাও জানি না অন্যমানুষের চেতনের সাথে আমাদের সাবজেক্টিভির কতটুকু মিল। তাই মৃত্যু আবিষ্কারের বিষয়টা একটা এডুকেটেড হাইপোথিসিস মাত্র। এটাকেই শেষ জ্ঞান হিসেবে না নিলেই ভালো হয়। ]
এখন স্পেনে এই গোরস্থান আমাদের কিসের ইঙ্গিত দেয়? এই গোরস্থান এটারই ইঙ্গিত দেয় যে, নিয়ান্ডারথালেরা
এরকম আরো অনেক উদাহরণ আছে। যেমন ধরুন মাদরিদে পাওয়া একটি শিশু নিয়ান্ডারথালের ফসিল, ( একে নাম দেয়া হয়েছে Loyoza child) যার বয়স ৩৮-৪২ হাজার পুরোনো। এই গুহায় কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে আগুনের ব্যবহার সুস্পষ্ট এবং মৃতদেহের আশেপাশে অনেক ধরনের প্রাণীর হাড় সজ্জিত থাকার বিষয়টা আসলেই কৌতুহল সৃষ্টি করে। একইভাবে, ইরাকে পাওয়া যাওয়া ৬০-৭০ হাজার বছরের পুরোনো ফসিল আমাদের একই ঘটনা বলে— তারা সচেতন মনে কবর দিতো!
সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে এটাও জানা জরুরী যে, সব লাশ কবর দেয়া হতো না। অনেক নিয়ান্ডারথালেরা
৩.
উনবিংশ শতাব্দীর আমেরিকান বিজ্ঞানী সেমুয়েল মর্টনকে ( ১৭৯৯ - ১৮৫১) বলা হয় বৈজ্ঞানিক বর্ণবাদের জনক। সে মানবজাতিকে পাচ বর্ণ বা সম্প্রদায়ে বিভক্ত করেন। তার এই বিভক্তিকরণের ভিত্তি ছিলো মস্তিষ্কের আকৃতি। এই পদ্ধতিতে সে সাদাদের বা caucasian দের দিয়েছেন প্রথম স্থান ও কালোদের বা Ethiopian দের শেষের স্থান। আর যেহেতু তিনি ছিলেন সৃষ্টিবাদী, সেজন্য এই পার্থক্যের মূলে তিনি দায়ি করেছন পাঁচ ধারার মানব সৃষ্টির গল্পকে। জেনে রাখা ভালো, race আর subspecies/ ecotypes কথা দুটো প্রায় একই অর্থ বহন করে।
তবে আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের কি বলে? স্যাপিয়েন্সের উৎপত্তি আফ্রিকায় আজ থেকে ৩০০ হাজার বছর আগে হলেও আমরা আফ্রিকা ত্যাগ করতে শুরু করি আনুমানিক ১০০ হাজার বছর আগে থেকে। এখানেই মজার বিষয় শুরু হয়। যদিও আমরা ৩০-১০০ হাজার বছরের মধ্যে নানান সময়ে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চায়না সহ নানান দেশে যাই, কিন্তু তারপর থেকেই আবার কয়েক হাজার বছর জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই।
কলম্বাস যদি ১৪৯২ সালে আমেরিকা আবিষ্কার না করতো বা ধরুন কোনো কারণে কয়েক মিলিয়ন বছর ধরে আমরা বিচ্ছিন্নই থেকে যেতাম, তাহলে দেখা যেতো আমরা ভিন্ন কোনো প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছি। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে আমিরিকা আবিষ্কার হয়েছে। তাই আমরা সবাই মানুষ বা Homo sapiens এর অন্তর্ভুক্তই রয়ে গিয়েছি। তবে এত হাজার ধরে আলাদা থাকার ফলে আমাদের অতি সামান্য বিবর্তন হয়েছে। আরো সুস্পষ্ট করে বললে জেনেটিক ডাইভার্জেন্স হয়েছে। এর ফলে জাতিগতভাবে মানুষের পার্থক্য এত সুস্পষ্ট। এক জাতির মানুষ এজন্য একটু বেশি শক্তিশালী, বর্ণিল ও বুদ্ধিমান, আর অন্যান্য জাতি সামান্য দুর্বল ও ভিন্ন রঙের। তবে স্বস্তির বিষয় এসকল পার্থক্য অতি সামান্য। তাই আমরা বলতেই পারি যে, চামড়ার নিচে আমরা সবাই সমান।
সকল জীববিজ্ঞানী এই মত পোষণ করেন যে, মানুষ প্রজাতিকে সাবস্পিসিসে ভাগ করার প্রয়োজন নেই। শিম্পাঞ্জি, গরিলাদের বেশ কয়েকটি সাবস্পিসিস আছে তবে মানুষের নেই, যদিও জাতিগত সামান্য পার্থক্য আছে।
৪.
মানুষের ভাষা ও কালচার আবিষ্কার হওয়ার পর থেকে মানুষের এক নতুন সমস্যা দেখা দিলো। এই সমস্যা হচ্ছে কুসংস্কারে বিশ্বাস করে, সে পদ্ধতিতে জীবনধারণ করা। এবং এসকল কুসংস্কার দীর্ঘ সময়ের প্রবাহে মানুষের জেনেটিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম। ধরুণ, কোনো এক কুসংস্কার প্রচলিত হতে শুরু করলো যে, বিশেষ বিশেষ শারীরিক সৌন্দর্য সম্পন্ন নারী পুরুষদের সাথে প্রজনন গেলে ছেলে মেয়ে অন্ধ হয়ে জন্মাবে।
আবার ধরুন, বেশ প্রভাবশালী কোনো ফ্যাশন কয়েক যুগ ধরে প্রচলিত থাকলো। এতে দেখা যাবে কয়েক প্রজন্মের মধ্যে জেনেটিক ডাইভার্জেন্স দেখা যাবে। অনেক কালচারে উচু গলার নারীদের বেশি সম্মান ও মর্যাদা দেয়া হয়। চায়নার কিছু এলাকায় ছোটকাল থেকে নারীদের পায়ের বৃদ্ধি রুদ্ধ করে দেয়া হত। ইউরোপেও নারীরা কোমড় চাপানোর জন্য নানান পোশাক পড়তো। এর পেছনে কোনো জিনগত কারণ নেই। তবে কালচারের এই পরিবর্তন মানুষের জেনেটিক্সের উপর সময়ের সাথে সাথে বেশ ভালোই প্রভাব ফেলে।
---------------
রেফারেন্সঃ-
১)
https://
https://
https://
২)
https://
https://
https://
https://
https://
https://
৩)
https://
https://
https://
৪)
https://
https://
Writer: Md Ariful islam