প্ল্যানচেটের ইতিবৃত্ত


আমাদের মধ্যে কমবেশী সবার মাথাতেই আত্মা নিয়ে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খায়।আসলেই কী আত্মা আছে? আত্মা কোথায় থাকে? তাদের কী আলাদা কোন জগত আছে? নাকি আমাদের আশেপাশেই ঘোরাঘুরি করে? আমরা কী তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি?

এসব প্রশ্নই মাথায় এসেছিল ফ্রান্সের পয়তাল্লিশ বছর বয়সী একজন মানুষের। তার নাম অ্যালান কারডেক।তিনি স্পিরিচুয়াল জিনিস নিয়ে গবেষণা করতে ভালোবাসতেন। এক রাতে তিনি ও তাঁর স্ত্রী মিলে এক বিশেষ পদ্ধতির সাহায্য নিয়ে আত্মার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হন।(এমনটা দাবি করেন)
আর এই 'বিশেষ পদ্ধতি' কে বলা হয় প্লানচেট (Planchette)!

প্লানচেট জিনিসটা কী?
এটা হলো দলগতভাবে আত্মার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করার একটা পদ্ধতি।ফরাসির তত্ত্ব বিশেষজ্ঞ 'এফ এস প্ল্যাঁশেত' আত্মার সঙ্গে জীবিত মানুষের যোগাযোগ ঘটানোর ব্যাপারে প্রচেষ্টা করেছিলেন। তাই তার নামের সঙ্গে মিলিয়ে এর নাম রাখা হয়েছে প্ল্যানচেট।
প্ল্যানচেট শব্দটি বর্তমান রূপ। এনসিয়েন্ট যুগে এর নাম ছিলো রিয়েল ডিমোনিক বা শয়তানের পূজারী।

প্লানচেটের কতগুলো ধাপ আছে।যেমন:
1.Channeling (আত্মাকে খুব কাছে নিয়ে আসা)
2. Interchangeable (আত্মার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা)
3. Clairaudience(আত্মার কথা শুনতে পারা) 4. Clairgustance (আত্মার আসল স্বাদ নেয়া)
5. Clairsentience (আত্মাকে ফিল করা 6.Clairvoyance (আত্নাকে দেখতে পারা)

একটা গল্প দিয়ে 'প্লানচেট' জিনিসটাকে বোঝা যাক।
রাফি আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। সে ঠিক করেছে তার সদ্যপ্রয়াত চাচা মরহুম রফিক সাহেবের আত্মার সাথে সে যোগাযোগ করবে।তাই সে তার তিনজন বেষ্টফ্রেন্ডকে নিয়ে বিখ্যাত স্পিরিচুয়ালিস্ট মতিন মিয়ার শরণাপন্ন হলো। বলা হয় বাঘা বাঘা আত্মারা তার নির্দেশে নাকানি-চুবানি খায়!
মতিন মিয়া তাদের নিয়ে একটা বদ্ধ অন্ধকার ঘরে গেল।ঘরে কয়েকটা মোমবাতি জ্বালানো। আর একটা গোল টেবিলের চারদিকে পাঁচটা চেয়ার।সবাই চেয়ারগুলোতে বসলো।টেবিলের উপর একটা বোর্ড রাখা আছে। বোর্ডটার নাম 'ওইজা বোর্ড' (Ouija Board)। ওইজা বোর্ড হলো এমন একটা বোর্ড যার উপর ইংরেজি বর্ণমালা(A-Z),ডিজিট (0-9) আর 'YES-NO' টাইপের উত্তরবিশিস্ট কতগুলো শব্দ লেখা থাকে। (বলা হয় 'ওইজা বোর্ড' নাকি নিজেই তার নাম 'ওইজা বোর্ড' রেখেছে)। 

মতিন মিয়া সবাইকে ওইজা বোর্ডের উপর রাখা 'প্লানচেট' এর উপর হাত রাখতে বললো।'প্লানচেট' হলো একটা কাঠের তৈরী বস্তু যার সামনের দিকটা সরু আর পেছনের দিকটা "লাভ" শেইপের।এর গায়ে এটা ছোট ছিদ্র রয়েছে নিচে কি আছে তা দেখার জন্য ।এর ছিদ্রটি বোর্ডের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে বিভিন্ন ইনফরমেশন দেয়।
সবাই 'প্লানচেট' এর উপর হাত রাখল। এবার মতিন মিয়া সবাইকে চোখ বন্ধ করতে বললো এবং যাবতীয় সকল চিন্তা মাথা থেকে বের করে দিতে বললো। সবাই তাই করল।
চারিদিক শান্ত। একটু বেশীই শান্ত। হঠাৎ রাফি অস্ফুট স্বরে বলে উঠল," এই ঘরে কি কোন আত্মা আছে?"
আশ্চর্যজনকভাবে প্লানচেটের ছিদ্রটি 'YES' এর ঘরে চলে গেল!!অর্থাৎ এই ঘরে আত্মা আছে।
দেরী না করে পরের প্রশ্নটি করল রাফি।
"কী নাম তোমার?"
এবার প্লানচেটের ছিদ্রটি প্রথমে R এর ঘরে গেল।এরপর গেল O এর ঘরে। তারপর একে একে F,I এবং Q এর ঘরে গেল। অর্থাৎ ঘরে উপস্থিত আত্মার নাম ROFIQ। আরেহ!! এতো রাফির চাচা!!
রাফি প্রশ্ন করা থামালো না। তার পরের প্রশ্ন,"তুমি কীভাবে মারা গেলে?"
প্লানচেট তার জায়গা পরিবর্তন করে জবাব দিল 'FIRE'। অর্থাৎ তিনি আগুনে পুড়ে মারা গেছেন।
আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে আত্মাটি সব প্রশ্নেরই সঠিক জবাব দিতে পেরেছে।অর্থাৎ রাফিকে এটা বিশ্বাস করতেই হবে যে এটাই তার মৃত চাচার আত্মা!

এবার গল্পে একটু টুইস্ট নিয়ে আসা যাক!
রাফির বন্ধু নাফি অত্যন্ত চালাক এবং BCB'র মেম্বার।সে এরকম একটা ভৌতিক আর সেনসিটিভ ইভেন্টে নিষেধ সত্ত্বেও চোখটা একটু খুলে রেখেছিল!সে দেখেছে প্লানচেটটি অর্থাৎ যেখানে রাফি এবং অন্যান্য সবাই হাত রেখেছিল সেটি কখনোই 'YES' এর ঘরে যায়নি।এমনকি সেটি ROFIQ ও নির্দেশ করেনি। FIRE ও দেখায়নি!!
তাহলে চোখ বন্ধ রেখে রাফি আত্মার সাথে কমিউনিকেট করতে পারলেও চোখ খোলা রেখে নাফি কেন তা পারল না??
এবার জানা যাক এর পেছনের সাইন্সটা কী...
এর পেছনের সাইন্সটা হলো মানব মস্তিষ্কের ‘ইডিয়মোটর ইফেক্ট’।

এটা হচ্ছে সেই অবস্থা যখন ‘অটোসাজেশান’ ক্ষমতার প্রভাবে আমাদের অবচেতন মন বিভিন্ন নির্দেশ গ্রহণ করতে শুরু করে এবং সেই কমান্ড অনুযায়ী অবচেতন মন শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে মুভমেন্ট করতে নির্দেশ দেয়। এই নড়াচড়া অবচেতন মনের নির্দেশে হয় তাই এটা একদমই অনৈচ্ছিক।
রাফি যখন চোখ বন্ধ রেখে তার চাচাকে প্রশ্ন করলো তখন রাফির অবচেতন মনের ইচ্ছা ছিল যে সব কিছুর যেন একটা পজিটিভ উত্তর পায়। আর এক্ষেত্রে এক্সাক্টলি তাই ঘটেছে! এর কারণ রাফির চোখ যখন খোলা ছিল তখন সে জানত কোথায় YES কোথায় ROFIQ শব্দগুলো আছে। ফলে তার অবচেতন মন তথ্য পাঠালো সব উত্তর যেন ‘হ্যাঁ বা আশানুরূপ’ হয়। অর্থাৎ, রাফির অবচেতন মন চেয়েছিল সে দেখতে চায় সঠিক ফলাফল এবং হলোও তাই। অবচেতন মনের তথ্য পেয়ে রাফির মস্তিষ্কের বাম পাশের একটি অংশে যে ইফেক্ট তৈরি হলো সেটাই ‘ইডিয়মোটর ইফেক্ট'।
ইডিয়মোটর ইফেক্টের ফলে রাফির শিরা ধমনি গুলো সেভাবে নড়তে লাগল যেভাবে তার মন চেয়েছিল এবং তার হাত নড়তে থাকল।
যেহেতু বেষ্টফ্রেন্ডরা তার সাথে ছিল তাই তারা সবাই তাকে বিশ্বাস করত। কিন্তু তাদের উপর এই ইফেক্ট কাজ করবে না। এটা কাজ করবে শুধু রাফির উপরে।
আর যেহেতু নাফির মস্তিষ্কে ইডিয়মোটর ইফেক্ট কাজ করেনি তাই সে বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করেছে।

(ইডিয়মোটর ইফেক্ট প্রথম ব্যাখ্যা করেন মাইকেল ফ্যারাডে।এজন্য তাকে "সাইন্টিফিক ওঝা" ডাকলেও ভুল হবে না!)
আর যদি কেউ সত্যিই চায় আত্মার অস্তিত্ব জানতে তাহলে তার উচিত এসব ধাপ্পাবাজ পথ অবলম্বন না করে হাইটেক প্রযুক্তির সাহায্যে নেয়া। কয়েকটার নাম দিচ্ছি,

¤ EVP (Electronic voice phenomenon)- রেন্ডম নয়েজ ডিটেক্ট করার জন্য।

¤ HMDC (Hi-tech Motion Detector Camera)-এটা মোশন ডিটেক্ট করার জন্য।

এছাড়াও থার্মাল ইমেজিং স্কোপস,ইনফ্রারেড থার্মাল ডিরেক্টর ইত্যাদি অনেক কিছুই আছে।
(অনেক বিখ্যাত ব্যাক্তি প্লানচেট করতেন। এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর আব্রাহাম লিংকন উল্লেখযোগ্য।রবিঠাকুরের প্রিয় মিডিয়াম নাকি ছিল উমাদেবী। উমাদেবীর উপর ভর করেই আত্মারা আসত তার কাছে। রবি ঠাকুর লিখে গেছেন আত্মাদের অনেক কথা। ২০০৪ সালে চট্টগ্রামে ‘আত্মিক অনুসন্ধান সমিতি’ গঠিত হয়, এর প্রসিডেন্টের ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক অলক দেওয়ারী। পরে তিনি আত্মহত্যা করেন।)

লিখাঃ সানজিদ আরমান বিশাল

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form