“আপনাকে কিডন্যাপ করা হল ডক্টর। এভাবে রাস্তা থেকে তুলে আনায় রাগ করেছেন?”
সাইকিয়াট্রিস্ট জিয়াউল হক তার কিডন্যাপারের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন, কিছু বললেন না। তার অপহরণকারী তরুণীটি দীঘল কালো চুল ঝাঁকিয়ে বলল, “কি করব বলুন তো? আপনি যা ব্যাস্ত মানুষ! এমনিতে দেখা করতে চাইলে একমাস আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেয়া লাগে। আমার হাতে এতো সময় নেই।”
“আপনার জন্যে আমি সময় করতে পারতাম,” চোখ থেকে চশমা খুলে মুছতে মুছতে বললেন ডক্টর জিয়া, “আসলে আপনি আমাকে হঠাত চমকে দিতে চাইছিলেন। দেখতে চাইছিলেন আমি কিভাবে রিয়্যাক্ট করি।”
“আপনি মানুষটা বেশি বুদ্ধিমান।” ঠোঁট উলটে বলল তরুণীটি, “বেশি বুদ্ধিমান মানুষের সাথে কথা বলে আরাম পাওয়া যায় না, কিছু বলার আগেই তারা সবকিছু অনুমান করে ফেলে।”
“হা হা হা,” সত্যি সত্যি হেসে ফেললেন জিয়া, “কি করব বলুন, সাইকিয়াট্রিস্ট মানুষ, মানুষের মনের কথা বুঝে ফেলাটা আমার পেশার একটা অংশ।”
“আমাকে তুমি করে বলুন তো, নিজের থেকে বিশ বছরের বড় কারো মুখ থেকে আপনি শুনতে ভালো লাগে না।” হাত নেড়ে বলল জিয়ার অপহরণকারী।
“বেশ, তুমি করেই বলছি।” জিয়া মাথা নাড়লেন, চশমাটা আবার ফিরে গেছে তার নাকের উপর। “আচ্ছা, শ্রাবণী, আমরা এখন যাচ্ছি কোথায়?”
তারা এই মুহুর্তে বসে আছে একটা লাল রঙের এলিয়নের ব্যাক সিটে। সামনে গম্ভির মুখো ড্রাইভার স্টিয়ারিং ধরে নিবির মনোযোগে সামনে তাকিয়ে আছে। পেছনে কি কথাবার্তা চলছে সেদিকে যেনো তার কোনো খেয়ালই নেই। এই ড্রাইভার একটু আগে জিয়াউল হককে নিউ মার্কেটের গেটের সামনে থেকে তুলে এনেছে। জিয়া নিউ মার্কেট গিয়েছিলেন ভালো কম্বলের খোঁজে। শীত আসছে সামনে, এখন না কিনে রাখলে পরে দাম বেড়ে যাবে। ষণ্ডা মার্কা ড্রাইভারটি তাকে যখন প্রায় জোর করেই এলিয়নের ব্যাকসিটে নিয়ে তুলল তখন বেশ একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। এখন দিনকাল ভালো না। তবে পাশের সিটে শ্রাবণীকে দেখতে পেয়ে সব আশঙ্কা দূর হয়েছে।
গাড়ি চলতে শুরু করেছে। বাইরে সন্ধ্যার লালিমা মুছে গিয়ে রাত নামছে নগরির বুকে। কৃষ্ণকালো রাত নয়, নিয়নের আচে ঝলসানো রাত। শ্রাবণী খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আনমনে বলল, “আমরা যাচ্ছি আমার বাসায়। আজ আপনাকে আমার জীবনের শেষ ভয়ের গল্পটা বলব। গল্প শেষ হলে আপনি আমার সাথে ভাত খাবেন। আপনার জন্যে মুগের ডাল দিয়ে রুইয়ের মুড়িঘণ্ট করেছি। আপনার পছন্দের খাবার। আমি ভালো রাঁধতে পারি না। তবুও চেষ্টা করেছি যতটুকু ভালো করা যায়। খাওয়া শেষ হলে আপনার ছুটি। আপনি চলে যেতে পারেন। অথবা রাত বেশি হলে থেকেও যেতে পারেন, আপনার জন্যে আলাদা একটা গেস্ট রুম গুছিয়ে রাখা হয়েছে।”
জিয়া লম্বা করে শ্বাস নিলেন, কিছু বললেন না। আজকের রাতটার জন্যে তিনি প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। তবুও আরেকটু সময় পেলে, আরেকটু অগ্রিম ইশারা থাকলে হয়তো ভালো হতো।
শ্রাবণী জানলা থেকে ফিরে তাকিয়ে বলল, “জিজ্ঞেস করবেন না আমি কিভাবে জানি আপনার প্রিয় খাবার রুইয়ের মুড়িঘণ্ট?”
“উত্তরটা আমার জানা” ছোট্ট করে বললেন জিয়া।
“আচ্ছা, সব সাইকিয়াট্রিস্ট কি আপনার মতো পাকা অভিনেতা হয়? ভিতরে ভিতরে অবাক, ভয়, রাগ, মন খারাপ যাই থাকুক বাইরে কিছু প্রকাশ করে না?”
জবাবে আবার মুচকি হাসলেন জিয়া। এই প্রশ্নটা উনার পরিচিত। আগেও শ্রাবণী তাকে এই প্রশ্ন করেছে, এখন আর ওর সেটা মনে নেই।
শ্রাবণীদের বাসা বনশ্রীতে। আশ্চর্যজনক ভাবে আজ বৃহস্পতিবার রাতে রাস্তায় তেমন একটা জ্যাম নেই। অল্প সময়েই তাদের গাড়ি গন্তব্যে পোঁছে গেল। শ্রাবণী থাকে একটা পাঁচতলা বাড়ির তৃতীয় তলায়। তিনরুমের মাঝারি একটা ফ্ল্যাট, আলাদা করে চোখে পড়ার মতো কোনো আসবাব বা সাজসজ্জা নেই। তবে সব মিলিয়ে একটা ছিমছাম গোছানো ভাব আছে। জিয়া একবার বলে দিতে পারেন এখানে শ্রাবণী একা থাকে।
“আপনি বসুন, চাইলে সোফায় পা তুলে বসতে পারেন। আমি চা করে আনি, আপনি তো আবার কফি খান না।”
জিয়ার এই মুহুর্তে চা খাবার তেমন ইচ্ছা নেই, তবে শ্রাবণী মেয়েটাকে বারণ করে কোনো লাভ নেই।
তিনি সোফায় পা ভাজ করে বসে চারপাশে চোখ বুলালেন। ঘরের কোথাও কোনো ছবি নেই, এটা একটা লক্ষ করার মতো বিষয়। এই রকম একটা বাসা্র দেয়ালে স্বামি-স্ত্রির একক বা যুগল দুই একটা ছবি থাকা বাঞ্ছনীয়।
চা’টা খেতে ভালো হয়েছে। শ্রাবণী জিয়ার হাতে একটা ঢাউস কাপ ধরিয়ে দিয়েছে। এতো বড় কাপে চুমুক দেয়া একটু সমস্যা। জিয়ার ইচ্ছে করছে কাপ থেকে পিরিচে ঢেলে নিতে।
শ্রাবণী তার সামনে কফির মগ নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। কফির মগ থেকে ধুয়া উড়ছে। মেয়েটা দুই হাতে’ উত্তপ্ত মগটাকে ধরে রেখেছে, ওর হাতে কি ছ্যাকা লাগছে না? জিয়া নিজের ঢাউস মগে ফু দিয়ে বললেন, “আপনার গল্প শুরু করুন।”
“কোথা থেকে শুরু করব বুঝতে পারছি না…” শ্রাবণী আঙুলের নখ খুটছে, “আপনাকে মোবাইলে যখন বলেছিলাম তখন সবকিছু আপনা থেকেই গড়গড় করে বেরিয়ে আসছিলো। এখন সামনা সামনি কেমন যেন…”
“আচ্ছা আমি তবে কিছু প্রশ্ন করি”, জিয়া ঝুঁকে এসে বললেন, “আপনারা বান্দরবান ঘুরতে গিয়েছলেন ঠিক কতো দিন আগে?”
“এই তো, তিন বছরের মতো হবে।”
“তখন আপনারা এই বাসাতেই ছিলেন?”
“হু…”
“আপনার শিমু আপা আপনাদের উপরের তলায় থাকতো?”
“হ্যাঁ… আমাদের ঠিক উপরে… উনাদের ফ্ল্যাট থেকে আমাদের এখানে ধুপধাপ শব্দ শোনা যেতো।”
“আচ্ছা,” জিয়া তার সোফায় হেলান দিয়ে বসলেন, “আপনার শিমু আপাকে কোথায় কবর দেয়া হয়েছিল?”
শ্রাবণী এবার যেনো চমকে উঠে, “কবর!”
“হ্যাঁ, বলেছিলেন ক্যান্সারে ভুগে মৃত্যু হয় উনার। মৃত্যুর পর উনাকে কোথায় কবর দেয়া হয়?” জিয়া তার ঢাউস মগে লম্বা চুমুক দিলেন। কাপের আয়তনের কারণে জিনিসটা ঠোঁটের কাছে আনতে বেশ কায়দা করতে হয়। চুমুক দিতে হয় সাবধানে। জিয়া মজা পাচ্ছেন না, এতো সাবধানতা অবলম্বন করে চা খাওয়া যায় নাকি। চা খেতে হয় আনমনে।
“বনানি...গোরস্থানে…” ভেঙে ভেঙে বলল শ্রাবণী।
“আচ্ছা, শিমুর জানাজা আপনি উপস্থিত ছিলেন?”
“হু।।” ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকায় শ্রাবণী।
“উনার হাসবেন্ডের নাম কি ছিলো?” চট করে জিজ্ঞাসা করলেন জিয়া।
আবার চমকে উঠল শ্রাবণী। “...কায়সার… পুরো নাম মনে পড়ছে না… আবুল কায়সার খুব সম্ভবত”, থেমে থেমে বলল ও।
“আচ্ছা উনাদের বিয়েটে ভেঙে গিয়েছিলো কেনো?”
“ভাইয়া প্রায়ই আপার গায়ে হাত তুলতো। উনার ড্রিংক করার অভ্যাস ছিলো। হয়তো অন্যান্য মেয়েদের সাথেও সম্পর্ক ছিলো। এসব নিয়ে কথা বলতে গেলেই আপাকে মারধোর করতো। আর আপার বাচ্চা হচ্ছিলো না, বিয়ের পর প্রায় তিন বছর চলে গিয়েছিলো। এসব নিয়েই ঝামেলা।”
“আচ্ছা আপনার গল্পটা বলুন এবার, আপনার তৃতীয় ভয়ের ঘটনা”
শ্রাবণী এক লম্বা দম নিলো। তারপর বলতে শুরু করল।
“আপনাকে আগের দিন বলেছিলাম আমার সাথে কিছু একটা থাকে। অশুভ কিছু। ওর অস্তিত্ব শুধু যে আমি টের পাই, তা না। এই বাসায় কেউ একটু দির্ঘ সময় কাটালেই ওকে দেখতে পায়। বা অদ্ভুত কিছু টের পায়।
ব্যাপারটা শুরু হয় বছর খানেক আগে। রাতের বেলা… বোধ হয় রাত তিনটা বাজে… আমি খুব ঘড়ি দেখি… হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো। কিন্তু আমি চোখ মেলে তাকাতে পারছিলাম না। না… আমার বোবায় ধরার অসুখ নেই। তখন আমি সম্পুর্ন জেগে আছি, হাত পায়ের আঙুল নাড়াতে পারছি। কিন্তু… কিন্তু চোখ খুলতে ভয় লাগছে। কারন আমি জানি চোখ মেললেই আমি দেখব… দেখব অন্ধকার ঘরে একটা মেয়ে... ঝুকে পড়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে আছে। মেয়েটা আমার এতো কাছে…. হয়তো জাস্ট কয়েক ইঞ্চি তফাৎ…. ওর নিঃশ্বাস এসে পড়ছে আমার মুখে…মেয়েটির মাথায় ঘন কালো চুল ঝুলে পড়ে আমার মুখ
ছুইছুই করছে। আমি জানি না আমি কিভাবে এসব বলছি। আমি যেন চোখ বন্ধ করেও সব দেখতে পাচ্ছি.. ভয়ে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে…
আমি জানি আপনি কি ভাবছেন। ভাবছেন আমি ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখেছি। ব্যাপারটা তা না। আমি যখন সব সাহস একত্র করে চোখ খুললাম… দেখলাম, আমার সামনে কেউ নেই। ঘর অন্ধকার। এতো অন্ধকারে ঘরে কেউ ঘাপটি মেরে থাকলে দেখার কথা না। আমি বেডসাইড ল্যাম্প জ্বালালাম। ল্যাম্পের আবছা নীল আলো যেন হুলের মতো বিধল আমার চোখে। ঘর খালি। কেউ নেই।
বাকি রাত আমি বিছানায় কাঠ হয়ে বসে রইলাম। আর চোখ বুজার সাহস হলো না। ভীষণ বাথরুম পেয়েছিলো, কিন্তু খাট ছেড়ে উঠার সাহস নেই।
পরের দিন সকালে রোদের আচে আবার সব স্বাভাবিক হয়ে এলো। মনে হলো হয়তো সত্যি স্বপ্ন দেখেছি। নিজেই নিজের বোকামিতে একাএকা হাসলাম। তবে সেদিন রাতে ঘুমোবার আগে বেডসাইড ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে রাখলাম। এমনিতে ঘরে আলো থাকলে আমি ঘুমাতে পারি না। কিন্তু সেই রাতে মনে হচ্ছিলো ঘর সম্পুর্ন অন্ধকার হয়ে গেলে আমি বুঝি দম আটকেই মারা যাব।
সেইরাতে আর কিছুই হলো না। আমি নিশ্চিত হলাম পুরোটা আমার কল্পনা ছিলো। পরের এক সপ্তাহ ভালোই কেটে গেলো। আমি হয়তো ভুলেই গিয়েছিলাম সেই রাতের কথা। তবে মনের ভেতর একটা খচখচ থেকেই গিয়েছিল। তারপর আবার এক গভীর রাতে আবার আমার ঘুম ভেঙে গেলো। আমি চোখ না মেলেই বুঝলাম কেউ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ একজন… চুপিসারে আমার খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছে… একেবারে গা ঘেষে… হয়তো এখনি আমাকে স্পর্শ করবে… ভয়ংকর কিছুর আশংকায় আমার শরীর কাটা দিয়ে উঠল। আমি কি চোখ মেলে তাকাব…? তাকিয়ে যদি ভয়ংকর কিছু দেখি? যদি দেখি সত্যি সত্যি একটা মেয়ে আমার উপর ঝুকে আছে…? কি করব আমি? ওহ আল্লাহ কি করব?? ওই অনুভুতির কথা বলে বুঝানো যাবে না। স্রোতের মত ঠান্ডা ভয় আমার শরিরের শিরায় উপশিরায় ছড়িয়ে পড়ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। হাত পা নড়ছে না। কিন্তু আমি জানি আমাকে চোখ মেলে তাকাতে হবে। আমি না তাকানো পর্যন্ত এর শেষ হবে না।
আমি চোখ মেললাম।
ঘর অন্ধকার…
কিন্তু… স্পষ্ট মনে আছে আমি সাইড ল্যাম্প জ্বালিয়ে ঘুমিয়েছি।
আমি উঠে বসে ল্যাম্পের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম।
আমার হাত ঠান্ডা কিছু একটা স্পর্শ করল।
আর… আর… বিকট শব্দ করে একটা কিছু দৌড়ে সরে গেল বিছানার কাছ থেকে।
গলা ফাটিয়ে চিতকার দিয়ে উঠলাম। কিন্তু কোনো শব্দ বেড়ুলো না। আমি পাগলের মতো হাতড়ে হাতড়ে ঘরের লাইট জ্বালালাম। ফ্লুরেসেন্ট আলোয় ঘর ভেসে গেল। ঘরে আমি ছাড়া দ্বিতীয় কেউ নেই।
কিন্তু সাইডটেবলে যেখানে ল্যাম্পটা থাকার কথা ছিলো সেখানে সেটা নেই। ল্যাম্পটা মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে, গুড়ো কাচ ছড়িয়ে আছে চারপাশে।
পরের ঘটনা ঠিক দুই দিন পরে…
একই ভাবে রাতের বেলা জেগে উঠলাম… যেনো ভেতর থেকে কেউ জোর করে জাগিয়ে দিলো। কেউ যেনো মাথার ভেতর চিতকার করছিলো, জেগে উঠো… ও এসেছে… এক্ষুনি জেগে উঠো.. ও ভয়ংকর কিছু করতে যাচ্ছে… খুব.. খুব ভয়ংকর কিছু…
আমি জানি ও আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। নিশ্চুপে আমাকে দেখছে। আমার একেবারে কাছে। আমি ওর নিঃশ্বাস টের পাচ্ছি। ওর শরীর থেকে নিঃসৃত উত্তাপ অনুভব করতে পারছি। এতো কাছে। আমার শরীরের প্রতিটি কোষ চরম আতংকে চিতকার করছে। কিন্তু আমার একটা আঙুল তোলার ক্ষমতা নেই।
আমি চোখ মেললাম।
এবং দেখতে পেলাম আবছা একটা অবয়ব ছিটকে ঘরের বাইরে চলে গেল। এবং ঘরে একটা চাপা দুর্গন্ধ। যেনো খাটের নিচে কেউ পচা মাংস রেখে দিয়েছে। আমার নাড়ি উল্টে এলো। বাতি জ্বালিয়ে আমি বাথরুমে গেলাম। হড়হড় করে বমি হয়ে গেল। শরিরের সবকটা রোম তখনো দাড়িয়ে আছে। আমি অনেক্ষণ ধরে মুখে পানির ঝাপটা দিলাম। মাথায় পানি ঢাললাম। কিন্তু কিছুতেই শরীর থেকে অসুচি ভাব যাচ্ছে না। খারাপ একটা কিছু যেনো আমাকে স্পর্শ করে গেছে। আমি যতোই চেষ্টা করি, আমার চামড়া থেকে সেই ছোয়া যাচ্ছে না। সেই স্পর্শ যেনো আমার চামড়া ভেদ করে হাড্ডি মাংসে ছড়িয়ে গেছে।
ঘরে ফিরে এলাম। খারাপ গন্ধটা তখনো ছিলো। কেনো যেনো মনে হচ্ছিলো গন্ধটা আমার পরিচিত। কিন্তু মনে করতে পারছিলাম না আগে কোথায় পেয়েছি। সারারাত বিছানায় বসে বসে কাদলাম। কি যে অসহায় লাগছিলো! একটু পরপর চমকে উঠছিলাম। কি করব কোথায় যাবো কিচ্ছু বুঝতে পারছিলাম না। এভাবে করেই রাত কেটে গেলো।
ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে গন্ধটা কমে গেলো। আমি সারা ঘর খুজলাম কোথাও কোনো ইদুর মরে পরে আছে কিনা। সেরকম কিচ্ছু পেলাম না।
পরের রাতে আবার গন্ধটা ফিরে এলো। সেই সাথে সেই অস্বস্তিকর অনুভুতি।
সে এসেছে।
আমার খুব কাছে।
তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে।
আমি আর চোখ মেললাম না। আমি আর ভয়ংকর কিছু দেখতে চাই না। চোখ মেলার সাহস আমার আর নেই। যে এসেছে আসুক। যা খুশি করুক। চাইলে আমাকে মেরে ফেলুক। আমার কিচ্ছু করার নেই। কারন আমি মনে করতে পেরেছি গন্ধটা কেনো পরিচিত লাগছিলো। কারণ গত বছর বান্দরবানের সেই হোটেলের বাথরুমে যখন আটকা পড়েছিলাম… সেখানে এই গন্ধ ছিলো।
পরের দিন বাসার কেয়ারটেকারকে দিয়ে এলাকার মসজিদ থেকে ইমাম সাহেবকে ডেকে আনলাম। ইমাম আমার কথা মন দিয়ে শুনলেন। কতটুকু বিশ্বাস করলেন কে জানে। তবে দুয়া পড়ে এদিক সেদিক ফু দিয়ে গেলেন। সেই রাতটা শান্তিতে ঘুমালাম।
কিন্তু এক সপ্তাহ পরে আবার গন্ধটা ফিরে এলো। সেই সাথে মৃদু হাঁটা চলার শব্দ। কাপড়ের হালকা খসখস শব্দ। তারপর একদিন সকালে ঘুম ভেঙে দেখতে পেলাম আমার বিছানায় ঠিক মাথার কাছে মেঝেতে ভেজা পায়ের ছাপ।
বাবাকে বললাম গ্রাম থেকে আমার সাথে এসে থাকতে। বাবা প্রথমে এসে ঘরে গন্ধ ফন্ধ কিছু পেলেন না। আমিও বুকে কিছুটা সাহস পেলাম। হয়তো একা ছিলাম বলেই এতো সমস্যা। সাথে কেউ থাকলে হয়তো আর সমস্যা হবে না। বাবা যতোদিন ছিলেন সত্যি কোনো সমস্যা হয়নি। গন্ধটাও যেনো ফিকে হয়ে এসেছিলো। আমিও নিশ্চিত হলাম সবটাই আমার মনের ভুল ছিলো।
ব্যবসার প্রয়োজনে বাবাকে আবার টাঙাইলে ফিরতে হলো। বাবা ফিরে যাবে আগে একটা কাজের লোক ঠিক করে রেখে গেলো। মেয়েটার নাম রেনু। বয়েস কম, কাজটাজ খুব একটা পারতো না। সেটা সমস্যা না, আমাকে সঙ দেয়াই ওর আসল কাজ। রাতে আমার ঘরেই ঘুমাবে।
রেনুর সাথে ঘুমানোর প্রথম রাতে আবিষ্কার করলাম, মেয়েটা মহা বাচাল। তার উনিশ বছরের জীবনে সে দেখেনি এমন কিছু নাই। তার গ্রামের বারো বছরের কিশোর থেকে শুরু করে ষাট বছরের বৃদ্ধ পর্যন্ত প্রত্যেকটি পুরুষ তার প্রেমে পড়ে আছে। তাদের কে কখন কিভাবে তাকে উত্যাক্ত করতো এই হচ্ছে রেনুর গল্পের বিষয় বস্তু। এবং এই গল্প সে খুব আগ্রহ নিয়ে শুনাতো। আর চোখমুখ এমন বড়বড় করে রসিয়ে রসিয়ে গল্প করতো, সে এক দেখার মত জিনিস। আমার প্রথম প্রথম শুনতে মজাই লাগতো। তবে তৃতীয় দিনের মাথায় বিরক্ত হয়ে গেলাম। তবে ওকে থামালাম না। তবুও ঘরের মধ্যে দ্বিতীয় আরেকটা প্রান আছে, যে কথাবার্তা বলে তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। ওর বকর বকর শুনতে শুনতে ঘুমানোটা প্রত্যেক দিনের অভ্যাস হয়ে গেলো।
একরাতে কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। উঠে বসে দেখি রেনু কাঁদছে। কেনো কাঁদছে কিছুতেই বলল না। দেখলাম ওর পায়জামা ভিজে গেছে। এতো বড় একটা মেয়ের ঘুমের মধ্যে পায়জামা ভিজিয়ে ফেলা অবশ্যই স্বাভাবিক কোনো ব্যাপার না। রেনু কি সেই লজ্জাতেই কাঁদছিল? নাকি কিছু দেখে ভয় পেয়েছে? অসম্ভব ভয়ে কাপড় নষ্ট করে ফেলেছে। অজানা সেই অস্বস্তিটা আমাকে আবার ঘিরে ধরে। পরের দিন সকালে রেনু মুখ গোজ করে ঘরের কাজ করে যায়। রাতে কি হয়েছিলো জিজ্ঞেস করলে কেমন শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়। যেনো আমার কথা বুঝতে পারছে না। আমি আর বেশি ঘাটালাম না। এই বয়েসি গ্রামের একটা মেয়ের কান্নাকাটি করার মতো অনেক গোপন কারন থাকতে পারে। আমার তাতে নাক না গলালেও চলে।
পরের রাতে আবার কান্নার আওয়াজ। রেনু বিছানায় উপুড় হয়ে কাদছে। আমি ওপর থেকে ওকে ডাকলাম। মেয়েটা সাড়া দিল না। তবে কান্না থামিয়ে ফোপাঁতে থাকল। আমি টেনশনে পড়ে গেলাম। এই কি নতুন ঝামেলায় পড়া গেল!
এভাবেই চলল সপ্তাহখানেক। তারপর এক ভোর বেলা উঠে দেখি রেনু নেই। নেই মানে নেই। বাড়ির দরোজা জানালা ভেতর থেকে বন্ধ। রেনুর জামাকাপড় সব আছে, শুধু মেয়েটা নেই। যেনো বাতাসে মিলিয়ে গেছে। পেছনে রেখে গেছে মাংস পচা দুর্গন্ধ। নাড়ি উল্টে যাওয়ার মতো।
আমাকে অবাক করে দিয়ে রেনুর উধাও হয়ে যাওয়া নিয়ে খুব বেশি ঝামেলা হল না। মেয়েটা এতিম ছিলো। ওর খোজ করার মতো তেমন কোনো মানুষ ছিলো না। বাবা থানায় একটা জেনারেল ডাইরি করে রাখলেন। যার মুল বক্তব্য বাসার কাজের বুয়া জিনিসপত্র চুরি করে পালিয়েছে। গ্রামের দুই একজন মানুষ একটু কথা তুলেছিলো, বাবা সব টাকা পয়সা দিয়ে ম্যানেজ করে ফেললেন। আমার বাবা টাঙাইলের একজন ক্ষমতাবান মানুষ। কোনো সমস্যাই তার জন্যে বড় সমস্যা না।
ক্ষতি হলো আমার। ঘরের দুর্গন্ধ পুর্নমাত্রায় ফিরে এলো। এবার আগের চেয়েও বেশি। সেই সাথে রাতে বিছানার পাশে কারো উপস্থিতি। মনে হচ্ছিলো পাগল হয়ে যাব। বাসা ছেড়ে কিছুদিন টাঙাইলে গিয়ে থেকে এলাম। কিছুদিন এলোমেলো এখানে সেখানে ঘুরাঘুরি করলাম। কিন্তু বাড়ি ফেরার পর সব আবার আগের মতো। সিদ্ধান্ত নিলাম বাসাটা ছেড়ে দেব। হয়তো এই বাসাতেই সমস্যা। আর সেদিন রাতেই তাকে দেখতে পেলাম…."
"কাকে…?" ডক্টর জিয়া একটু নড়েচড়ে বসলেন।
"সেদিন রাতেও ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো। বাথরুমে গিয়ে চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিচ্ছি। সেই সময় আয়নায় তাকে দেখতে পেলাম। আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।"
"কাকে দেখলেন? আপনার শিমু আপা?"
"না। এক পলকের জন্যই দেখেছি। ঘুরে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। আমার পেছনে যে দাঁড়িয়েছিল… সে আমিই। আমার হুবহু কার্বনকপি।"
"হুমম…" জিয়াউল হক চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে দুইহাতের আঙুলের মাথাগুলো একসাথে মেলালেন। তারপর আঙুলের উপর থুতনি ঠেকিয়ে বললেন, "শ্রাবণী, আপনার গল্প শুনলাম। সত্যি বলতে, আমি ফ্যাসিনেটেড। এবং সেই সাথে কিছুটা হতাশ। হতাশার কারনটা পরে বলছি। কিন্তু তার আগে আপনার সাথে কিছু বিষয় শেয়ার করি।"
শ্রাবণী তার হাতের মগ নামিয়ে রাখে। এই পুরোটা সময় সে একবারও মগে ঠোঁট ছোয়ায়নি। গরম মগ ধরে রেখে তার দুই হাতের তালু লাল হয়ে গেছে। শ্রাবণী দুই হাত মুঠি বদ্ধ করে ফেলে, যেন আভাসে বুঝাতে চাইছে সে তৈরি।
জিয়া বলতে শুরু করেন, "আপনি বলেছেন শিমু আপারা আপনার উপরের তলায় থাকতো। আমি আপনার উপরের তলার ভাড়াটিয়ার সাথে কথা বলেছি। তারা আমাকে জানিয়েছে তারা ওই ফ্ল্যাটে গত সাত বছর ধরে আছে। ইনফ্যাক্ট আমি আপনার বাড়িওয়ালা এবং কেয়ারটেকারের সাথেও কথা বলেছি। তারা দুইজনেই আমাকে জানিয়েছে শিমু নামে কেউ কখনো এই বিল্ডিংএ ছিলো না।"
শ্রাবণী শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে, কোনো রা করে না। জিয়া বলে যান, "শিমু'র হাসব্যান্ডের নাম জিজ্ঞেস করায় আপনি বলেছিলেন আবুল কায়সার। এই নামে আপনি আরেকজন মানুষকে চিনেন। আবুল কায়সার আপনার বাবা'র নাম।"
শ্রাবণী কিছু না বলে কপাল চেপে ধরে। যেনো তার মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে।
"শ্রাবণী, আপনি কি বুঝতে পারছেন আমার কথা? আপনার কি কিছুই মনে পড়ছে না? আজ থেকে এক বছর আগে আপনার বাবা আপনাকে নিয়ে আমার চেম্বারে আসেন। আপনি তখন ভীষণ অসুস্থ। আপনার এই গল্পগুলি আমি আগেও শুনেছি। আপনি ছিলেন আমার প্রাইম পেশেন্ট। ছয়মাস ধরে একটু একটু করে আমি আপনার মনের জট খোলার চেষ্টা করেছি। এবং অবশেষে আমরা সফল হই। আপনি নিজেই আপনার রহস্যের সমাধান খুঁজে পান। দেখতে দেখতে আপনি আবার সুস্থ হয়ে উঠেন। সম্পুর্ন সুস্থ।
কিন্তু এখন আপনার অসুখ আবার নতুন করে ফিরে এসেছে। যার অর্থ, আমি আসলে আপনার ভয়ের প্রকৃত উৎস খুঁজে পাইনি। কিছু সত্য এখনো আড়ালেই থেকে গেছে। অসুস্থতার বীজ এখনো আপনার মনে বাসা বেঁধে আছে। যাই হোক, আসুন এবার আমি আপনাকে একটা গল্প শুনাই। আপনার নিজেরই গল্প। আশা করি গল্প শেষ হলে আপনার সব কিছু আবার মনে পড়বে।
“বছর তিনেক আগে আপনি বান্দরবান ঘুরতে গিয়েছিলেন। আপনি একা ছিলেন না। তবে শিমু নামে কেউ আপনার সাথে ছিলো না। আপনার সফর সঙ্গি ছিলো একজন পুরুষ। এই মানুষটির সাথে আপনার সোশ্যাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পরিচয়। আপনার স্বামী ব্যাবসার প্রয়োজনে বছরের বেশির ভাগ সময় দেশের বাইরে থাকতেন। বাড়িতে আপনি একা। স্বামির অনুপস্থিতিতে এই অনলাইনের ভদ্রলোকটির সাথে আপনার একরকম সম্পর্ক গড়ে উঠে। আপনারা সিদ্ধান্ত নেন বান্দরবানে ঘুরতে যাবেন। কয়েকদিন দুজন একান্তে কাটাবেন।
কিন্তু বান্দরবানে হোটেলে উঠার পর আপনার মত পরিবর্তন হয়। আপনি তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে অস্বীকৃতি জানান। এবং সেই মুহুর্তে ঢাকায় ফিরে আসতে চান। সেই মুহুর্তে আপনার সফরসঙ্গী মানুষটি হঠাত ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। আপনি বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করলে সে আপনাকে আঘাত করে, এবং জোরপুর্বক…
মানুষটি আপনাকে আহত অবস্থায় হোটেলের বাথরুমে আটকে রাখে। আপনি সেই অন্ধকার বাথরুমেই সারা রাত বন্দি ছিলেন। পরেরদিন হোটেলের ম্যানেজের এসে বাথরুম খুলে আপনাকে উদ্ধার করে। আপনি তখন ভয়ানক অসুস্থ, কাউকে চিনতে পারছেন না। ম্যানেজার ঢাকায় খবর দিলে আপনার বাবা এসে আপনাকে নিয়ে যান।
ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে আপনার স্বামী আপনাকে ডিভোর্স দেয়। আপনি তখন হাসপাতালে। ঘটনার সময় আপনি কনসিভ করেছিলেন। আপনার মিসক্যারেজ হয়ে যায়। আপনি হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে আসলেন ঠিকই। কিন্তু বাড়ি ফেরার কয়েকদিন পর থেকেই আপনার মস্তিষ্ক বিকৃতি দেখা দেয়। আপনি পুরো ঘটনাটা মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না। এটা আপনার জন্যে একটা অসম্ভব দুঃসহ স্মৃতি। যেকোনো মূল্যে আপনি একে ভুলে যেতে চান। মানুষের মন বড় অদ্ভুত। আপনি নিজের মনে পুরো ঘটনাটিকে নতুন রুপে সাজালেন। আপনি ভুলে গেলেন সেই মানুষটির কথা। তার পরিবর্তে আপনি বিশ্বাস করতে শুরু করলেন যে আপনি বান্দরবান গিয়েছিলেন শিমু নামে আপনার এক প্রতিবেশীর সাথে। হোটেলের সম্পুর্ন ঘটনাকে আপনি একটা আধিভৌতিক ব্যাখ্যা দিলেন। আপনি নিজেকে প্রবোধ দিলেন কেউ আপনাকে ধর্ষণ করেনি, বরং আপনার ভয়াবহ স্মৃতির পেছনে প্যারানরমাল কিছুর হাত আছে। সত্যকে আপনি নিজের মতো করে সহজ করে নিলেন।
কিন্তু সত্য আপনার পিছু ছাড়ল না। সে আপনার ভেতরে থেকে গেল লুকানো ক্যান্সারের মতো। আপনি এখনো অশুভ কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করেন। ঘরের মধ্যে খারাপ গন্ধ পান। মনে হয় ঘুমের সময় কেউ আপনার দিকে তাকিয়ে থাকে। এগুলো আসলে আর কিছুই নয়, আপনার রিপ্রেসড মেমোরির ম্যানিফেস্টেশন।
”
এটুকু বলে জিয়া একটু বিরতি দিলেন। তার কাপের চা শেষ হয়ে গিয়েছে। খালি কাপটা নামিয়ে রাখতে রাখতে তিনি ভাবলেন আরেক কাপ হলে মন্দ হতো না। চা-টা বেশ ভালো ছিলো। শ্রাবণী স্থাণুর মতো বসে আছে। শুধু তার চোখ দুটো আর্দ্র হয়ে আসছে। ভেজা চোখ ছাড়া শরীরের আর কোথাও প্রানের স্পন্দন নেই। জিয়া ওকে ধাতস্থ হবার সময় দিলেন। তিনি লক্ষ করেছেন শ্রাবণীর অশ্রুসিক্ত চোখ জোড়ার পেছনে এক অব্যাক্ত চাঞ্চল্য খেলা করছে। ওর মনের ছেড়া সুতোগুলো একেএকে জোড়া লেগে যাচ্ছে। যেন এক বিশাল জিগস পাজলের হারিয়ে যাওয়া টুকরোগুলো আবার খাপে খাপে বসে যাচ্ছে, আর পুরো চিত্রটা ওর চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে আসছে।
শ্রাবণীর চোখ থেকে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে। শ্রাবণী একটা দির্ঘশ্বাস নেয়, যেন ঘুমন্ত সাগরের বুকে ঢেউ জাগে। অশ্রু ফোঁটা দুটো শ্রাবণীকে ছেড়ে যায় না। ওর চিবুকে ঝুলে থাকে বেহায়া প্রেমিকের মতো। কি অপুর্ব একটি দৃশ্য। জিয়া মুগ্ধ হয়ে ভাবেন, মেয়েটা আসলেও সুন্দর।
সাইকিয়াট্রিস্ট গলা খাকড়ি দিয়ে আবার শুরু করেন, “আমি আপনার স্বামির সাথে কথা বলেছি। আপনার বাবার সাথেও কথা বলেছি। তারা সবাই আমাকে নিশ্চিত করেছে শিমু নামে কাউকে তারা চেনে না। এমন কারো অস্তিত্ব নেই। শিমু আসলে আপনার ভেতরের অবদমিত ভীতির প্রতিরুপ, যার বসবাস আপনার মনে। বাস্তবে এমন কেউ কখনো ছিলো না। অন্তত আমি তাই ভেবেছিলাম। আর সেটাই ছিলো আমার ভুল।
আপনার অসুখটা আবার ফিরে এসেছে। অর্থাৎ আমরা আপনার সমস্যার গোঁড়ায় পৌছতে পারিনি। আপনার সমস্যার মূল লুকিয়ে আছে আরো গভীরে। রহস্যের কিছুটা এখনো বাকি রয়ে গেছে। তাই আপনি মাসখানেক আগে যখন আমার সাথে অনলাইনে যোগাযোগ করলেন, তখন আমি আবার আপনার কেস ফাইলটা পড়েছি। আপনার বাবার সাথে আবার কথা বলেছি। তিনি নতুন কিছু জানাতে পারেননি, আগের কথাগুলোই পুনরাবৃত্তি করে গেছেন। তারপর আমি টাঙাইলে আপনার গ্রামের বাড়িতে গিয়েছি, যেখানে আপনার শৈশব কেটেছিলো। আপনার বাড়ির মানুষদের সাথে কথা বলেছি। আশেপাশের মানুষদের সাথেও কথা হয়েছে। আমার ধারণা অবশেষে আমি আপনার রহস্য ভেদ করতে পেরেছি।
আমি জানি আপনার জীবনের তৃতীয় ভয়ের ঘটনাটা কি। কিন্তু আমি চাই আপনি নিজের মুখে ঘটনাটি খুলে বলুন। কারন আপনার ভয়কে আপনার মোকাবিলা করতে হবে। নিজেকে কল্পনার দেয়াল তুলে আপনি আড়াল করে রাখতে পারবেন না। সত্যের মুখোমুখি আপনাকে হতে হবেই।
শ্রাবণী… আপনি কি আমাকে আপনার তৃতীয় গল্পটি বলবেন? আজ থেকে বিশ বছর আগে... সত্যিই কি দেখেছিলেন আপনি?”
শ্রাবণী চোখ মুছে নেয়। তার প্রান শূন্য চেহারায় একটা প্রত্যয়ের ছায়া ফুটে উঠে…
রাত তখন প্রায় এগারোটা।। শ্রাবণী তার গল্প শুরু করে।
(চলবে)....
Writer: Ashif Abdul (Studied Finance at University of Dhaka)