শিমু আপা…
শারমিন সুলতানা…
আজ থেকে বিশ বছর আগে…
আমার বয়স তখন ছয় বা সাত..
ঠিক মনে নেই…
আমি খুব একটা মিশুক বাচ্চা ছিলাম না… সমবয়েসি আর সব বাচ্চাদের সাথে সহজে মিশতে পারতাম না.. শিমু আপারা থাকত আমাদের থেকে দুই বাড়ি পরে.. বয়েসে তিনি আমার… চার পাচ বছরের বড় হবেন। সাংঘাতিক ডানপিটে ছিলেন.. আমাকে খুব আদর করতেন.. কেনো কে জানে… আমাকে হাতে ধরে সাইকেলে চড়া শিখিয়েছেন.. সাতার শিখিয়েছেন… আপা খুব ভালো সাতার পারতেন.. ওই বয়েসে এক দমে নদির এপার থেকে ওপারে চলে যেতেন… আমি ভালো পারতাম না… এই নিয়ে আপা সারাক্ষণ আমাকে বকতেন… কি চমৎকার ছিলো সেই দিনগুলো…
আমাদের খেলার একটা গোপন জায়গা ছিলো...আমাদের বাড়ি থেকে খুব বেশি দুরে না.. বাড়ির পেছন থেকে দুইশো গজ গেলেই একটা বড় বাশ ঝাড়.. বাশ ঝাড়ের পর তিনদিক থেকে পুকুরে ঘেরা একটা জায়গা.. মাঝখানে ছোট্ট একটা ঘাসের বন.. সেটাই আমাদের গোপন আড্ডা….ওখানে মানুষ খুব একটা যায় না… জায়গাটার নাকি দোষ আছে। কি দোষ এখন আর মনে নেই...গ্রামের মানুষের মনে নানা রকম কুসংস্কার কাজ করে... যে কোনো কিছুর দোষ খুজে পেতে তাদের জুড়ি নেই.. পাড়ার আর সব বাচ্চারা এই জায়গার কাছে ঘেষে না… কিন্তু শিমু আপার অতো ভয় ডর নেই.. উনার সাথে থেকে থেকে আমিও ডাকাবুকো হয়ে গেছি… ভুতপ্রেতে ভয় পাই না… রোজ দুপুরে ইশকুল থেকে ফিরে দুটো কিছু মুখে পুরেই দে ছুট… এক দৌড়ে আমাদের গোপন ডেরায়.. আপা বেশির ভাগ দিন আমার জন্যে আগে থেকেই অপেক্ষা করত… সেখানেই হেসে খেলে আমাদের বিকেল ফুরিয়ে যেতো..
… এভাবে লুকিয়ে দেখা করার বুদ্ধিটা শিমু আপার… তিনিই বলেছিলেন আমরা সবার সামনে মেলামেশা করতে পারব না… কি নাকি সমস্যা আছে.. ওই ছোট বয়েসে আমি অতশত বুঝতাম না… আমার লুকিয়ে থাকতে ভালোই লাগত… চোখ রাঙানোর কেউ নেই… ধমক দেয়ার কেউ নেই… কেউ আমাকে খোচাবে না… আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে না… ওই জায়গাটা যেনো ছিলো আমাদের নিজস্ব একটা জগত… বাইরের দুনিয়া থেকে আলাদা.. বাইরের কারুর ওখানে প্রবেশ অধিকার নেই… না ওইটুকু বয়েসে মাথায় এতো ভারি ভারি চিন্তা আসতো না… তবে ব্যাপারটা অমনই ছিলো…
সেদিন শিমু আপা ঘুড়ি নিয়ে এসেছে... ঘুড়ি উড়ানোর মারাত্মক নেশা ছিলো আম... বাবা কেনো যেনো এই একটা কাজ একেবারেই পছন্দ করত না… ঘুড়ি উড়াতে হতো বাবা’কে লুকিয়ে… আর তাছাড়া পাড়ার বদ ছেলেরা আমাদের ঘুড়ি উড়ানো দেখে খুব খ্যাপাতো... দপুরের খাওয়া শেষ করেই আমি ছুট লাগিয়েছি পুকুর ধারে… গিয়ে দেখি আপা ইতিমধ্যে ঘুড়ি আকাশে তুলে ফেলেছে… ভারি রাগ হলো আমার… আপা কিভাবে আমাকে ছাড়া শুরু করল… গাল ফুলিয়ে আপাকে দিলাম এক ধাক্কা… আপা কিন্তু আমার দিকে ফিরেও তাকালো না… এক হাতে নাটাই ধরে আরেক হাতে আমার বেনি ধরে দিলো এক টান…
“দেরি করে এলি কেনো?”
দেরি করে এলি কেনো… দেরি করে এলি কেনো…
আমি এখনো মাঝে মাঝে এই লাইনটার প্রতিধ্বনি শুনতে পাই… বাইরে কোথাও নয়… শব্দটা হয় আমার মাথার ভেতরে… মস্তিষ্কের রন্ধ্রে রন্ধ্রে… খুলির দেয়ালে বারবার ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে… পরিনত হয় আর্তচিতকারে… দেরি করে এলি কেনো… দেরি করে এলি কেনো…
পড়েছিলাম সময়ের সাথে সাথে স্মৃতিগুলো নাকি ঝাপসা হয়ে আসে… সবার আগে মুছে যায় রঙ… হ্যাঁ পাত্রপাত্রিগুলো তখনো ঠিক থাকে… ঘটনাক্রম তাল হারায় না… কিন্তু রঙগুলো আবছা হয়ে আসে… প্রিয়জনের পড়নে সেদিন কি রঙের কাপড় ছিলো আর ঠাহর হয় না… অথবা ভালোবাসার মানুষটির হাতের লাল গোলাপগুলো কেমন কালচে হয়ে আসে… কিন্তু আমি… আজ বিশ বছর পরেও সব পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি… কি ঝকঝকে নীল আকাশ ছিলো সেদিন… কোথাও এক টুকরো রোদ নেই… আকাশটা যেন বিশাল কাঁচের ছাউনি… সেই ছাউনি গলে সোনালি রদ্দুর গলে গলে পড়ছে… ভিজিয়ে দিচ্ছে আমাদের… নীল সমুদ্রে সোনালি ঢেউয়ে চড়ে আমাদের লালটুক্টুক ঘুড়িটা উড়ছে উড়ছে উড়ছে…
… কখন বিকেল ফুরিয়ে গেল… কখন সোনালি রোদ্দুর বিদায় নিলো… কখন লালচে মেঘের কাঁধে ঘর দিয়ে সন্ধ্যে নামল… আমি জানি না… হঠাত শুনি পেছনে বাজখাই কন্ঠ… ফিরে তাকিয়ে দেখি বাবার অগ্নিমুর্তি… সারা পাড়া খুঁজে অবশেষে এখানে হাজির হয়েছে… আমার হাত থেকে নাটাই খসে পড়ল… বুক ধড়াস করে উঠল… আমি কি খুব বেশি দেরি করে ফেলেছি??... বাবা কি খুব বেশি খেপে গেছে??... আজ বুঝি আর রক্ষে নেই… ঘুড়ির নেশায় আমি সময় জ্ঞান সব ভুলতে বসেছিলাম… শিমু আপাও দেখি অপরাধির মতো মুখ মাটিতে নামিয়ে নিয়েছে… বাবার চোখের ঠাণ্ডা আগুনের সামনে শীতের শিমুল পাতার মতো স্পর্শে কুকড়ে যাচ্ছে… আমি চমকে উঠলাম… বাবা কি আজকে শিমু আপাকেও বকবে নাকি!!... আমার জন্যে কি আজ আপা বকা খাবে!!... নাহ, খোদা রক্ষে করল… বাবা তার গলায় সবটুকু শীতলতা নিংড়ে দিয়ে আপাকে চলে যেতে বলল… আপা ঘাড় গোজ করে পরাজিত সৈনিকের মতো বাড়ির পথ ধরল… আমি তাকিয়ে তার চলে যাওয়া দেখুলাম… কয়েক মুহুর্ত পরেই সন্ধ্যার আবছা আঁধার ওর শরীরটাকে গিলে নিলো… বাবা এবার নজড় ফেরালো আমার দিকে… ঠাস… বাবার হাতটা কখন কোনদিক থেকে উড়ে এলো আর কিভাবে আমার গালের হাড্ডি মাংস সব এক নিমিষে মিশিয়ে দিলো আমি বলতে পারব না… শুধু মনে হচ্ছিল গালের বুঝি চামড়া খুলে পড়ে গেছে… বাবা আমাকে কাঁধে ধরে মাটির উপর দিয়ে প্রায় ভাসিয়ে নিয়ে চলল…
বাড়ি ফিরেছি… হাত মুখ ধুয়েছি… এখন পড়তে বসব… কিন্তু আমার মন অন্য কোনোখানে… আমার মন পড়ে আছে পুকুর পাড়ে… কারন ফেরার সময় ঘুড়ি নাটাই সাথে আনা হয়নি… বাবা’কে দেখেই তো নাটাই পড়ে গেছিলো হাত থেকে… আমার লাল ঘুড়ি তখনো আকাশে নাও বাইছে… ফিরে যাবার সময় আপাও নাটাই তুলে নেয়নি… আমার ঘুড়ি নাটাই এতিমের মতো শুয়ে শুয়ে কাঁদছে… আমি এই সময় কিভাবে পড়ার টেবিলে মন দেই…?
সে রাতে আমার জ্বর এলো… ভীষণ জ্বর… চিন্তা চেতনা সব লণ্ডভণ্ড করে দেয়ার মতো জ্বর… জ্বরের ঘোরে দেখছি আমি ঘুড়ি হয়ে গেছি… ঘুড়ি হয়ে আকাশে উড়ছি… আকাশে উড়তে উড়তে যোজন যোজন মাইল দূরে চলে যাচ্ছি… তারপর হঠাত আমার সুতো ছিড়ে গেল… দমকা বাতাসে আমি উড়ে যাচ্ছি… কোথায় যাচ্ছি… কতো দূরে… জানি না… তারপর হঠাত বাতাস চলে গেলো… আমি পড়ে যাচ্ছি… পড়ে যাচ্ছি আকাশ থেকে… ভারি পাথরের টুকরোর মতো আমি ঝুপ করে পড়লাম পুকুরের মাঝখানে… আমি পাগলের মতো হাত পা ছুড়ছি… প্রানপনে ভেসে উঠার চেষ্টা করছি… কিন্তু দুটো নিষ্ঠুর হাত আমাকে বজ্রকঠিন মুষ্টিতে ধরে রাখে… কিছুতেই পালাতে দেয় না… একফোঁটা বাতাসের জন্যে আমার বুকটা আকুলিবিকুলি করতে থাকে… আমি বুঝতে পারি আমার মুক্তি নেই… এই অন্ধকার পুকুরের নিচেই আমাকে বাকি জীবন কাটাতে হবে…
তিনদিনের দিন আমার জ্বর নেমে যায়… সেদিন জানতে পারি শিমু আপাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না… সেই সন্ধ্যায় আপা বাড়ি ফিরে যায়নি… গত তিনদিনে কেউ ওকে কোথাও দেখেনি… পরের দিন বিকেলে পুকুরে একটা লাশ ভেসে উঠল… আমি দেখতে যাইনি… কি দরকার…
শ্রাবণী কাঁদছে।
ডক্টর জিয়াউল হকের সিগারেটের তৃষ্ণা পেয়েছে। তিনি কয়েকদিন হলো সিগারেট ছেড়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন। খুব একটা সফল হচ্ছেন না। রাত বিরেতে হঠাত হঠাত সিগারেটের তেষ্টা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। খুব অস্থির লাগে তখন।
জিয়া রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন। মাথার উপর সিলিং ফ্যান ঘুরছে, তারপরেও কেমন ঘেমে গেছেন। রুমালটা ভাঁজ করে আবার পকেটে রেখে দিলেন জিয়া। তারপর বললেন, “আমি আপনার গ্রামের মানুষদের সাথে কথা বলেছি। প্রথমে শিমুকে চেনে এমন কাউকে পাচ্ছিলাম না। তারপর আপনাদের স্কুলে গিয়ে খোঁজ নেই। স্কুলের রেজিস্ট্রি খাতায় শারমিন সুলতানা নামে একজনকে খুঁজে পাওয়া যায়। বন্ধুরা তাকে শিমু বলে ডাকতো। স্কুলের পুরোনো একজন টিচারের কাছ থেকে এসব জানতে পারি। স্যার আরো জানান, শিমুর মৃত্যুর পর কোনো থানা পুলিশ ময়নাতদন্ত এসব কিছু হয়নি। পুকুরটাকে ঘিড়ে এমনিতেই গ্রামের মানুষের নানা রকম কুসংস্কার ছিলো। শিমুর লাশ ভেসে উঠার পর তাদের ধারণা আরো পোক্ত হয়। শিমুর মৃত্যুর কয়েক মাস পর ওর পরিবার টাঙাইল ছেড়ে চলে যায়। এখন তারা কোথায় আছে কেউ বলতে পারে না।”
জিয়া টেবিল থেকে পানির গ্লাস তুলে ঢকঢক করে অর্ধেকটা পানি গিলে ফেললেন। শ্রাবণী কিছু বলছে না। তবে ওর কান্নার দমক নিভে এসেছে। দৃষ্টি অবনত। জিয়া আবার বলতে শুরু করলেন, “শারমিনের মৃত্যুটা রহস্য হয়েই ছিলো। গ্রামের মানুষ রহস্য পছন্দ করে না। তারা ব্যাখ্যা দাঁড়া করায় খারাপ জিন শিমুকে পুকুরে ডুবিয়ে মেরেছে। কিন্তু শ্রাবণী… আপনি জানেন সেটা সত্যি নয়… আপনি জানেন কিভাবে শিমুর মৃত্যু হয়… কারন সেই সন্ধ্যায় আপনি বাসায় থাকতে পারেননি… ঘুড়ির দুশ্চিন্তায় আপনি বাসার মানুষের চোখ লুকিয়ে আবার ফিরে গিয়েছিলেন পুকুর পাড়ে… তাই না?”
শ্রাবণী মাথা ঝাঁকায়।।
“গিয়ে আপনি কি দেখলেন?”
“আমি… আমি বলতে পারব না…”
“চেষ্টা করুন শ্রাবণী…”
“না প্লিজ না… আমি পারব না…”
“সত্যিটা আপনি জানেন শ্রাবণী… আপনি যতক্ষণ না সেটা স্বীকার করে নেবেন, আপনার ভয় আপনাকে মুক্তি দেবে না। আপনি বন্দি হয়ে থাকবেন সেই পুকুর তলায়। অথবা সেই হোটেল ঘরের অন্ধকার বাথরুমে। অথবা নিজের শোবার ঘরে। সত্যটা মেনে না নেয়া পর্যন্ত আপনার মুক্তি নেই। আপনি বলুন শ্রাবণী। আর ভয় পাবেন না। আপনি বলুন।”
“আমি… আমি দেখলাম… আমি দেখলাম শিমু আপা ঘাসের উপর শুয়ে আছে… আর ওর উপর… ওর উপর… আমার… আমার বাবা… বাবা’র হাত দুটো… হাত দুটো আপার শরীরে কিলবিল করছে… কিলবিল করছে… যেনো.. যেনো দুটো খুনে অজগর সাপ… আপাকে কামড়ে খুবলে খাচ্ছে… আমি … আমি… শিমু আপা… দেরি করে এলি কেনো… আপা বলছে… দেরি করে এলি কেনো… আমি নড়তে পারছিলাম না… চোখ ফিরিয়ে নিতে পারছিলাম না… আমি যেন পাথর হয়ে গেছি… দেরি করে এলি কেন… আপার প্রশ্নটা আমার মাথার ভেতর ঘুরছে ঘুরছে ঘুরছে…
শ্রাবণী দুই হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে উঠে… “আমি আমার বাবাকে ভীষণ ভালোবাসি… ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি… ভীষন ভালোবাসি… আমার মা’ খুব ছোট থাকতে মারা গেছে… বাবাই আমার সব… বাবাই আমার পৃথিবী… সেই বাবা…”
জিয়াউল হক খুব সাবধানে একটা দির্ঘশ্বাস গোপন করে ফেললেন। এখানে তার কাজ শেষ হয়েছে। শ্রাবণীকে তিনি তার সত্যে পৌছে দিতে পেরেছেন। এর বেশি আর কিছু তার করার নেই।
সেই সন্ধ্যায় শিমু আবার কেনো পুকুর পারে ফিরে গিয়েছিলো কে জানে। হয়তোবা শ্রাবনীর মতো সেও ফেলে যাওয়া ঘুড়ির মায়া কাটাতে পারেনি। এই সময় শ্রাবণীর বাবা আবুল কায়সার শিমুর পিছু নেন। ঘটনাক্রমে কিছুক্ষণ পরে শ্রাবণীও আবার পুকুর পারে উপস্থিত হয়। সেখানে সে যা দেখে স্বাভাবিকভাবেই তা বাচ্চা মেয়েটার ভেতরটা তোলপাড় করে দিয়ে যায়। শ্রাবণির সবচেয়ে প্রিয় মানুষ তার বাবা। সে কিছুতেই তার চোখে দেখা সত্যকে মেনে নিতে পারে না। বরং এই স্মৃতিকে সে মনের গহীন কোনে নিজের অজান্তেই পাথারচাপা দেয়।
শিমুর মৃত্যুর পর এই বিষয় নিয়ে তেমন কোনো থানা পুলিশ হয়নি। আবুল কায়সার টাঙাইলের প্রভাবশালী মানুষ। শিমুর পরিবারের সাথে জমিজমা নিয়ে তার কিছু ঝামেলা চলছিল। মেয়ে মারা যাবার কয়েক মাস পরে শিমুর পরিবার ওই গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। শিমুদের বাড়িটি আবুল কায়সার সাহেব দখল করে নেন। বর্তমানে সেখানে একটি পাচতলা দালান দাড়িয়ে আছে। ডক্টর জিয়া একবছর আগে প্রথম যখন কায়সার সাহেবকে শিমুর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তখন তিনি বেমালুম সব অস্বিকার করেন। রুগির বাবাকে অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। জিয়া ধরে নেন শিমু একটি কাল্পনিক চরিত্র। এবং সেই অনুযায়ীই শ্রাবনীর চিকিৎসা চলতে থাকে। এখানেই ভুলটা হয়েছিলো। শ্রাবণীর অসুখটা আবার ফিরে আসার পর জিয়া টাঙাইল গিয়ে ভালো মতো খোঁজ নেন। এবার সত্য বেরিয়ে আসে। আবুল কায়সার সাহেবের বিরুদ্ধে এতোদিন পর আইনি কোনো পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব না। ঘটনার একমাত্র সাক্ষী শ্রাবণী- যে কিনা নিজেই মানসিক ভাবে অসুস্থ। শিমু বিচার পাবে না। তার মৃত্যুটা একটা দুর্ঘটনা হিসেবেই মানুষের মন থেকে বিস্মৃত হবে। পৃথিবী যেমন চলছিলো তেমনি চলবে। কোথাও কোনো ছন্দপতন হবে না।
জিয়া আরেকটি দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে ফেললেন।
*
ঘড়ির কাটা রাত বারোটার ঘর ছুইছুই।
রুইয়ের মুড়িঘন্টটা অসাধারণ হয়েছে। শ্রাবণীর রান্নার হাত অসম্ভব ভালো। স্বাদে জিয়াউল হকের চোখ বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। খাওয়া শেষে শ্রাবণী পান বানিয়ে আনলো। জিয়া অনেক দিন হলো পান খান না, তার তেমন অভ্যাস নেই। আজকে খেলেন। এমন চমৎকার খানাপিনার পর শখ করে একটা পান খাওয়া যেতেই পারে।
শ্রাবণী বলল, “স্যার,... আচ্ছা আমার আপনাকে স্যার ডাকতে ভালো লাগছে না। চাচা বলে ডাকি? আর আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন।”
জিয়া স্মিত হেসে মাথা নাড়লেন।
শ্রাবণী বলল, “আজ আমার বাসায় থেকে যান চাচা। এতো রাতে আর বাসায় ফিরে কি করবেন?”
শ্রাবণী খারাপ বলেনি। আর মেয়েটাকে আজ রাতে খালি বাসায় রেখে যাওয়া ঠিক হবে না। ওর আশেপাশে আজ মানুষ থাকা প্রয়োজন। প্রিয় কোনো মানুষ, নির্ভরতার মানুষ। কিন্তু জিয়ার আর এখানে এক মুহুর্ত মন টিকছে না। তার বাইরে বেরুতে ইচ্ছে করছে। মন চাইছে রাতের রাস্তায় একা একা কিছুক্ষন হাঁটেন। আজ কত তারিখ? আকাশ কি চাঁদ পাওয়া যাবে? ছাত্র বয়েসে প্রতিটি পুর্নিমার রাতে তারা বন্ধুরা রাস্তায় নেমে যেতেন। কতোদিন ওভাবে হাঁটা হয় না। কোথায় আছে এখন সেসব বন্ধুরা?
জিয়া মাথা নাড়লেন। নাহ, তার বয়েস পঞ্চাশ ছুইছুই। এটা চাঁদনি রাতে হিমু সাজার বয়েস না। এটা রাত গভীর হলে পাতলা চাদরে গা ঢেকে ঘুমিয়ে পড়ার বয়েস। তিনি শ্রাবণীকে গাড়ি ডাকতে বললেন। বনশ্রি থেকে তার বাসা অনেক দূর।
জিয়া যখন দরোজার কাছে পৌঁছে গেছেন তখন শ্রাবণী পেছন থেকে ডাকল, “আচ্ছা চাচা… আমি কিন্তু আপনাকে একটা জিনিস দেখাতে চেয়েছিলাম।।”
“কি জিনিস?” জিয়া ফিরে তাকালেন।
“একজনের সাথে আপনার পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছিলাম”
“কার সাথে…?” জিয়া কিছুটা অনিশ্চিত ভাবে বলেন।
“ওই যে… যে আমার সঙে সঙে থাকে…”
“এখন কোথায় সে?”
“বাসার ছাদে। সে আপনার জন্যে অপেক্ষা করে আছে।”
“শ্রাবণী, বাসার ছাদে কেউ অপেক্ষা করে নেই। পুরোটাই তোমার অসুস্থ মস্তিষ্কের কল্পনা।”
“আপনি আমার সাথে আসুন। ছাদে গেলেই আপনি দেখতে পাবেন। আপনি কি আসবেন?”
জিয়া শিতল চোখে দির্ঘ একটি মুহুর্ত মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “চলো, দেখছি।”
(সমাপ্ত)
Writer: Ashif Abdul (Studied Finance at University of Dhaka)