একজন সাইকিয়াট্রিস্ট ও তিনটি ভীতিকর ঘটনা (দ্বিতীয় রাত্রি)


(দ্বিতীয় রাত্রি)
--------------------
জেগে আছেন?
বলেছিলাম আমার লাইফের তিনটি ভয়ের ঘটনা শোনাব আপনাকে, মনে আছে? আজ দ্বিতীয় ঘটনাটা বলছি। এতো রাতে গল্প শুনে ভয় পাবেন না তো? গল্পটা কিন্তু বেশ ভয়ের।
কি ভাবছেন? এতোদিন কোথায় ছিলাম? প্রথম আপনার সাথে যোগাযোগ করেছিলাম সে তো প্রায় মাসখানেক আগে, তারপর কোথায় ডুব দিলাম?
কোথাও ডুবে যাইনি। আমি আমার জগতেই ছিলাম। তবে আপনি একটা মাস খুব ব্যাস্ত ছিলেন। ক্লাস, সেমিনার, রিসার্চ নিয়ে দম ফেলার সময় ছিলো না আপনার। তাই আর রাত বিরেতে বিরক্ত করতে মন চায়নি। আমি কিভাবে জানি আপনি ব্যাস্ত? সেটা তো বলব না। আপনি বুদ্ধিমান মানুষ, নিজে ভেবে বের করুন।
আচ্ছা, রাত বেশি হয়ে যাচ্ছে, গল্প শুরু করি।

এই ঘটনা বছর খানেক আগের, উমম, এই ধরুন তিন চার বছর হবে। সঠিক মনে করতে পারছি না। আমরা বান্দরবান গিয়েছি। আমরা বলতে আমি আর শিমু আপা। শিমু আপার কথা মনে আছে? আগেরদিন বলেছিলাম ওর কথা…ওই যে পুকুরের পারে খেলতে গিয়ে বাচ্চার লাশ কুড়িয়ে পেয়েছিলো যে... হ্যাঁ ওই আপাই। আমার তখন বিয়ে হয়েছে। হাসব্যান্ডকে নিয়ে বনশ্রি থাকি। দুইজনের টোনাটুনির সংসার। শিমু আপা আমাদের বাসার উপরের ফ্ল্যাটে থাকতেন। উনার ডিভোর্স হয়ে গেছে বছরখানেক হল। আপার কোনো বাচ্চাকাচ্চা ছিলো না। ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার সেটাও একটা কারণ। ডিভোর্সের পর আপা একাই থাকতেন। আমার বর ব্যাবসার কাজে বছরের বেশিরভাগ সময় দেশের বাইরে কাটাতো। বাসায় আমি একা। আপা প্রায় দিনই আমাদের ফ্ল্যাটে চলে আসতেন। সারাদিন গল্প সল্প করে রাতে বিদায় নিতেন। মাঝেসাঝে রাতেও থেকে যেতেন। আপার ভীষণ ঘুরে বেড়নোর বাতিক ছিলো। আর উনার একমাত্র সফর সঙ্গী ছিলাম আমি। হুটহাট, এই হয়তো রাঙ্গামাটি চলে গেলাম, তার পরের দিনেই বান্দরবান। তারপর কক্সবাজার। আমরা কখন কোথায় যাচ্ছি তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। আমার হাসব্যান্ড এতো উড়নচণ্ডী আচরণ পছন্দ করতো না। কিন্তু আমি তাতে কখনোই খুব একটা কেয়ার করিনি।
কোথায় যেনো ছিলাম…? ও হ্যাঁ, সেবার আমরা বান্দরবান গিয়েছি, বান্দরবানের আলিকদম… গিয়েছেন কখনো? আলির গুহা, শিলবুনিয়া ঝর্না, ডিম পাহাড়.. সব মিলিয়ে বেশ সুন্দর জায়গা। আলিকদম নিয়ে চমৎকার একটা মিথ চালু আছে, জানেন? হযরত আলি একদিন বান্দরবনের মাতামুহুরি নদীর পাশে এক গহীন বনে আশ্রয় নেন। সেখানে তিনি কিছুদিন বিশ্রামের জন্যে খুঁজে নেন একটি গুহা। সেই থেকে বান্দরবনের গহীন সেই বনটির নামকরন করা হলো আলিকদম, এবং তার বিশ্রামের জন্যে যে গুহাটি তিনি বেছে নিয়েছিলেন তার নাম হলো আলির গুহা। স্থানীয় হোটেল ম্যানেজারের মুখ থেকে এই মিথ শুনেছিলাম। ভদ্রলোকের সাথে আমাদের বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল। আমার উপর বোধ হয় উনার আলাদা মায়া জন্মে গিয়েছিলো। আমাকে বলেছিলেন আমার মুখটা নাকি উনার মেঝো মেয়ের মতো।
যাই হোক, গল্পে ফিরে আসি। আচ্ছা এইযে আমি কথা বলতে বলতে বারবার মুল গল্প থেকে সরে যাই, এতে কি আপনি বিরক্ত হচ্ছেন? হলেও কিছু করার নাই। কিছু কিছু স্বভাব মানুষ হাজার চেষ্টা করেও বদলাতে পারে না। তো যা বলছিলাম… দিনের শেষ স্পট দেখতে আমরা গিয়েছি ডিম পাহাড়ে। বেশ উঁচু একটা পাহাড়। পায়ে হেটে উঠা বেশ কষ্ট। আমার আর শিমু আপা দুইজনেরই জিভ বেরিয়ে গিয়েছিলো। পাহাড়ের উপর পুরোনো একটা ভাঙ্গা মন্দির আছে সেখানে, ভেতরে একটা বিষ্ণুর মুর্তি… মন্দিরটার নাম ভুলে গেছি। আমরা যখন গিয়ে পৌঁছেছি তখন সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। মন্দির ছাড়া পাহাড়ের উপর দেখার আর বিশেষ কিছু নেই। সিদ্ধান্ত হলো এখানে কিছুক্ষণ জিড়িয়ে আজকের মত হোটেলে ফিরে যাবো।
পাহাড়ে খুব হুটহাট সন্ধ্যা নামে। এই হয়তো দেখবেন চারপাশে কি সুন্দর বিকেলের নরম আলো। তার পাঁচ মিনিট পরেই ঝুপ করে ঘুটঘুট্টি অন্ধকার।
হ্যাঁ, আমার এখনো ঠিক মনে পড়ে। আশপাশটা বেশ নির্জন ছিলো। এতো নিস্তব্ধ সন্ধ্যা আমি আর কখনো দেখিনি। কোথাও একটা পাখি ডাকছে না। একটু বাতাস বইছে না। ঘাস পাতার উপর দিয়ে কিছু সড়সড় করে হেঁটে যাচ্ছে না। পাহাড়ে গেলে বুঝবেন, সেখানে সারাক্ষণ কিছু না কিছু শব্দ হচ্ছে। তাই হঠাত করে সবকিছু নীরব হয়ে গেলে ওই নীরবতাই বড় বেশি করে কানে বাজে। আমি কান পেতে দাঁড়িয়েছিলাম যেকোনো একটা পরিচিত শব্দের জন্যে। কিন্তু আমাদের নিজেদের হাঁটাচলা আর নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ নেই। ব্যাপারটা শিমু আপাও টের পেয়েছিল। তার চোখেমুখেও কেমন একটা চাপা অস্বস্তি ভর করেছে। একটু দূরে একটা ভাঙা পাথরের উপর গিয়ে বসে পড়ল সে। পাহাড়ে উঠে হাঁপিয়ে গিয়েছিলো হয়তো। আমি একা একা এলোমেলো হাঁটছিলাম।
পায়ের নিচে কিছু একটা পড়লো। তাকিয়ে দেখি… কি বলব… একটা পেয়ারা। অদ্ভুত ব্যাপার না? এই পাহাড়ের চুড়োয় পেয়ারা কোত্থেকে আসবে? এই অঞ্চলে পেয়ারা পাওয়া যায় না। বাইরের কেউ এসে ফেলে গেছে? আমি পেয়ারাটা হাতে তুলে নিলাম, কেন জানি না। পথে কুড়িয়ে পাওয়া কিছু হাতে নেয়ার অভ্যাস আমার একেবারেই নেই। তারপরেও কেনো যে… অতি নিরীহ চেহারার একটা পেয়ারা। একটু পুরোনো হয়ে গেছে, গায়ে কালো দাগ বসে গেছে। জিনিসটা দুই একবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেই আমার কৌতুহল মরে গেলো। আমি ফলটা দূরে ছুড়ে ফেলে আবার শিমু আপার কাছে ফিরে গেলাম। আঁধার ঘনিয়ে আসছে, হোটেলে ফিরতে হবে।
ফেরার পথে খুব শরীর খারাপ করলো। গাড়িতেই দুইবার বমি হয়ে গেল। সেই সাথে ভীষণ মাথা ব্যাথা। যখন হোটেলে পৌছলাম ততোক্ষ্ণে আমি যেন প্রায় বেহুঁশ। আবারো বমি আসছে। জামা কাপড় ছাড়ার সুযোগ পেলাম না। রুমে ঢুকেই ছুটে গেলাম বাথরুমে। বেসিনের উপর হড়হড় করে বমি করে দিলাম। গলা থেকে হলুদ পানি ছাড়া আর কিছুই বেরুলো না। আয়নার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। এ কাকে দেখছি! আমার চোখ দুটে ছোট হয়ে কোটরে বসে গেছে। বাইরে বের হবার সময় খুব যত্ন করে চোখে কাজল দিয়ে গিয়েছিলাম। চোখের পানিতে সেই কাজল ধুয়ে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। সারা মুখে বিবর্ন ক্লন্তির ছাপ। মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে এ কি হয়ে গেল আমার? আজকে সকালেও তো সুস্থ ছিলাম। এই কয়েক ঘন্টায় যেন বয়েস বেড়ে গেছে দশ বছর। মাথাটা ভীষণ যন্ত্রণা করছে। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। আমি বেসিনের ট্যাপ ছেড়ে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিলাম। শীতল পানির স্পর্শে শরীর শিউরে উঠল। সময় নিয়ে কুলি করলাম। কিন্তু মুখ থেকে বমির তিতকুটে স্বাদটা যাচ্ছে না। বরং মুখের অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে, কেমন যেনো গা গুলাচ্ছে। আমার কি জ্বর আসছে? নাকি ফুড পয়জনিং…?
বেসিন থেকে বাথরুমের দরোজাটা খুব বেশি হলে তিন কদম দূরে। এই সামান্য ব্যবধানকে আমার কাছে অসম্ভব একটা দুরত্ব মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই জীবনে হয়তো আর দরোজা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারব না। আমি দুই হাতে বেসিনে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। গায়ে একবিন্দু শক্তি নেই। মনে হচ্ছে বেসিন ছেড়ে দিলেই বুঝি পড়ে যাবো। কিন্তু কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যায়?
মনকে শক্ত করলাম। নিজেকে কড়া ধমক দিলাম… শ্রাবণী, তোমার কিচ্ছু হয়নি। তোমার মতো শক্ত মেয়ে সামান্য মাথা ব্যাথায় এতো কাবু হয়ে গেলে চলবে? তুমি এখন সোজা হেঁটে গিয়ে বাথরুম থেকে বের হবে। তারপর জামাকাপড় ছেড়ে বাতি নিভিয়ে লম্বা একটা ঘুম দেবে। মন চাইলে শিমু আপাকে বলবে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। বলতে হবে না, তোমার চেহারা দেখলে আপা নিজে থেকেই কোলে নিয়ে চুল টেনে দেবে। ব্যাগে একপাতা সেডিল আছে, দরকার মনে করলে একটা পিল খেয়ে নিলেই হবে। তারপর লম্বা ঘুম। সকালে চোখ মেলে দেখবে তুমি একদম ফ্রেশ।
বেসিন ছেড়ে দিয়ে দরোজার দিকে পা বাড়ালাম। পা টলমল করে উঠল, হাঁটুর নিচ থেকে বাকি পা মনে হচ্ছে যেনো রবারের তৈরি, শরীরের ভার নিতে চাইছে না একদম। দেয়াল ধরে ধরে সাবধানে এগুলাম। এইমাত্র তিন কদম ব্যাবধান যেনো আমার জীবনের সবচেয়ে দির্ঘ দুরত্বে রুপ নিলো। আমি পায়ের আঙুল দিয়ে মেঝে খামচে ধরে ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগিয়ে যাচ্ছি। প্রতিটা পদক্ষেপের সাথে মনে হচ্ছে মাথার ভিতর একটা কিছু ছিড়ে যাচ্ছে। ঘরটা রীতিমতো দুলছে, কালবোশেখীতে আটকা পড়া ডিঙির মতো। দরোজার কাছে যখন পৌঁছেছি তখন ঘামে আমার জামা ভিজে গেছে। বড় বড় শ্বাস নিচ্ছি, যেনো এক মাইল দৌড়ে এসেছি। গলা শুকিয়ে আসছে খুব, এখনি এক গ্লাস পানি না পেলে মনে হচ্ছে আর বাঁচবো না। কাঁপা হাতে বাথরুমের ছিটকিনি ধরলাম। আমার ঘামে পিচ্ছিল আঙুল ফসকে বারবার বেড়িয়ে যাচ্ছিলো ছিটকিনির ছোট্ট দন্ডটা। জিনিসটা যেনো আমার সাথে এক অদ্ভুত রসিকতা করছে। কিছুতেই বেড়িয়ে আসতে চাইছে না ছিদ্র থেকে। জামায় হাত মুছে আবার চেপে ধরলাম দন্ডটা। আমার মধ্যে একটা মড়িয়া ভাব চলে এসেছে। ভেঙেই ফেলব এবার ছিটকিনি। অবশেষে বেয়াড়া দণ্ডটা হার মানলো। কিচকিচ শব্দ করে ছিদ্র থকে বের হয়ে এলো। আমি বুকের ভেতর আটকে রাখা একটা নিঃশ্বাস আস্তে করে ছেড়ে দিলাম। এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল আমার মুখে। কপালের ঘাম মুছে দরোজায় আলতো ধাক্কা দিলাম।
দরোজা নড়ছে না।
আমি ভালো করে দেখলাম, আর কোনো ছিটকিনি আছে? কই নেই তো। তাহলে?
আমি আবার ধাক্কা দিলাম। উঁহু, পাল্লা একচুল নড়ছে না।
কি হচ্ছে এসব?
আমি এবার পাগলের মত ধাক্কা দিলাম দরোজায়।
দুই হাতে দরোজার হাতল ধরে ঝাঁকালাম…
কিচ্ছু না… দরোজাটা যেন পাথরের তৈরি, স্রেফ গ্যাট হয়ে বসে রইল। কোনো একটা শক্তি যেনো বজ্রমুষ্টিতে ওপাশ থেকে বাথরুমের দরোজা ঠেলে রেখেছে।
আমি এবার হাঁটু ভেঙে মেঝেতে বসে পড়লাম। বসে পড়লাম না বলে হয়তো পড়ে গেলাম বলাই ভালো। আমার শরীর আর নিতে পারছিলো না। চোখের দৃষ্টি ক্রমেই আরো ঝাপসা হয়ে আসছে। পিপাসায় বুক শুকিয়ে এসেছে। দম নিতেও কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার বুকের উপর ভারি একটা পাথর চেপে বসছে। পাথরটা ক্রমে আমার বুকের হাড়পাজরা ভেঙেচুরে আরো ভেতরে সেধিয়ে যাচ্ছে। আমি বোধ হয় আর বাঁচবো না। এই দূর পাহাড়ে এক হোটেলের নোংড়া বাথরুমে শুয়ে আমার মৃত্যু হবে। আমার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। কি করব বুঝতে পারছি না। খুব কান্না পাচ্ছে। ভয় লাগছে। কিসের ভয়? আমি জানি না।
আচ্ছা শিমু আপা কোথায়? আমি এতক্ষণ বাথরুমে আছি-আপা খেয়াল করছে না? আপা কি আমাকে খুঁজতে আসবে না? অথবা আপা কি খেয়াল করবে না ওপাশ থেকে কেউ দরোজা আটকে রেখেছে?
আমি বাথরুমের দরোজায় থাবা দিলাম। আমার দুর্বল হাতের আঘাতে তেমন কোনো শব্দ হলো না। এই আওয়াজ কি আপার কান পর্যন্ত পৌঁছবে? আপাকে ডাকার চেষ্টা করলাম। কিন্তু গলার ভেতর কে যেন কাঠের গুঁড়ো গুজে দিয়েছে। বেমক্কা কাশি উঠলো… কাশির চোটে কলিজাটা যেন ছিড়ে যাবে। ভীষণ যন্ত্রনা হচ্ছে। বুকের উপর পাথরটা আরো চেপে বসছে। যেন ফুসফুসটা কেউ দুই হাতে খামচে ধরেছে। আমি আর পারছি না।
চোখে স্রেফ অন্ধকার দেখছি।
দরোজায় থাবা দেয়ার জন্যে আরেকবার হাত তুললাম। আমার দুর্বল হাত দরোজা পর্যন্ত পৌঁছল না। তার আগেই বাতাস থেকে খসে পড়ল।
জানি না কতক্ষণ বাথরুমের মেঝেতে পরে ছিলাম। আমার সময় জ্ঞান লুপ্ত হয়েছে অনেক আগেই।
ক্যাচক্যাচ শব্দে চোখ মেললাম।
তাকিয়ে দেখি বাথরুমের দরোজা খুলে যাচ্ছে। পাল্লার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে শিমু আপা। আপার বিস্ফারিত চোখের দৃষ্টি আমার উপর নিবদ্ধ।
ওই দৃষ্টি আমি আমার জীবনে ভুলব না।
অন্ধকার রাজপথে হেডলাইটের আলোয় ধরা খাওয়া পাহাড়ি ছাগলের চোখ দেখেছেন কখনো? গাড়িটা পিষে ফেলার ঠিক আগ মুহুর্তে ওর চোখের দৃষ্টি কেমন হয়…? কেমন যুগপৎ আতংক আর বিস্ময় মাখা থাকে ওই চোখে…? শিমু আপার চোখেও আমি সেই একই দৃষ্টি দেখেছি।
আপা স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে রইলেন এক মুহুর্ত। তারপর একটা চাপা আর্তনাদ ছেড়ে ছুটে পালিয়ে গেলেন।
আমি সম্ভবত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। এরপর কি হয়েছে আমার কিছু মনে নেই। বাকিটুকু আমার লোক মুখে শোনা।
শিমু আপা দৌড়ে গিয়ে ম্যানেজারকে খবর দেন। ম্যানেজার আর আপা মিলে ধরাধরি করে আমাকে বাথরুম থেকে তুলে আনেন। তখন আমার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। রাত তখন একটা। অতো রাতেই ম্যানেজার সাহেব ডাক্তারের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন। পাহাড়ি অঞ্চলে রাত একটা মানে অনেক রাত, এই সময়ে ডাক্তার খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করে ম্যানেজার ডাক্তার নিয়ে ফিরলেন। আমার গায়ে তখন একশ পাঁচ ডিগ্রী জ্বর, জ্বরের ঘোরে রীতিমত প্রলাপ বকছি। ডাক্তারের কাছে অষুধপাতি তেমন কিছু ছিলো না। প্যারাসিটামল নেবুলাইজার দিয়ে তিনি বিদায় নিলেন। বলে গেলেন ভোর হবার সাথে সাথে যেনো আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
নেবুলাইজারে কোনো কাজই হলো না। আমার কপালে বরফ চাপা দেয়া হল। বরফ গলে পানি হয়ে গেল, কিন্তু গায়ের তাপ একটুও কমল না। রাত তিনটার দিকে আমার প্রবল খিঁচুনি উঠল। সেই সাথে মুখ দিয়ে ফ্যানা গড়াচ্ছে। আপা বলেছিলেন, আমার চোখ উলটে দাঁত কপাটি লেগে গিয়েছিলো। আপা তৎক্ষণাৎ আমার মুখে নিজের আঙুল ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। আপার আঙুলে আমার দুইপাটি দাঁত বসে গিয়েছিলো। আঙুল কেটে রক্তারক্তি অবস্থা। বিছানার চাদর ভেসে গেছে রক্তে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিলো আমাকে হয়তো ভোর পর্যন্ত কিছুতেই টিকিয়ে রাখা যাবে না। ম্যানেজার সাহেব তখন আপাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে আবার বেড়িয়ে পড়লেন।
হোটেল থেকে একটু দুরেই মসজিদ, মসজিদের পাশে একটা ছোট্ট বাসায় ইমাম সাহেব থাকেন। এতো রাতে ইমাম সাহেবের জেগে থাকার কোনো কারন নেই। তবুও ম্যানেজার আশায় বুক বেধে ইমামের দরোজার কড়া নাড়লেন। উনাকে অবাক করে দিয়ে প্রায় সাথে সাথেই দরোজা খুলে গেল। ওপাশে ইমাম সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। তার পড়নে পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি, হাতে জায়নামাজ আর তবজি। তিনি যেন বাইরে বের হবার প্রস্ততি নিয়েই আছেন। ম্যানেজার তাকে সব কথা খুলে বলতে গেলেন। ইমাম তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “আমি জানতাম আজ রাতে কারো আমাকে প্রয়োজন হবে। আমি জেগেই ছিলাম। জলদি চলেন, আমাদের হাতে সময় খুব কম।”
ইমামকে নিয়ে ম্যানেজার আবার হোটেলে ফিরে এলেন।
ইমাম আমাকে একবার দেখেই যা বুঝার বুঝে নিলেন। তারপর তিনি কি কি দোয়া পড়ে ফু দিলেন, আরো কি সব করলেন… পরিষ্কার জানি না। শিমু আপা আমাকে কিছু খুলে বলেনি। তবে ভোর পাঁচটার দিকে আমার জ্বর নেমে গেল। ইমাম আমার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে দুই রাকাত নামাজ পড়ে বিদায় নিলেন। বলে গেলেন, ও ওখন সারাদিন ঘুমাবে, ওকে জাগানোর দরকার নেই।
প্রায় ছত্রিশ ঘন্টা ঘুমিয়ে আমি জেগে উঠলাম। জ্বর কমে গেছে। কিন্তু সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা, যেন কেউ মুগুর দিয়ে আমাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত পিটিয়ে রেখে গেছে। গায়ে ব্যাথা নিয়েই আমি বান্দরবান ছাড়লাম। ঢাকায় ফেরার পর শরীর ব্যাথা এক সপ্তাহ স্থায়ি হলো। ঢাকায় ডাক্তার দেখালাম, ডাক্তার কোনো সমস্যা খুঁজে পেলো না। এক সপ্তাহ পর ব্যাথা আপনা থেকেই সেরে গেলো।
এরও কিছুদিন পর আমি শিমু আপাকে জিজ্ঞেস করলাম সেই রাতে আমাকে বাথরুমে দেখে এতো ভয় পেয়েছিলে কেন। আপা উত্তর দিলো না। এটাসেটা বলে এড়িয়ে গেল। আমি তো এতো সহজে ছাড়ার পাত্র নই। যখনি দেখা হয়, আপাকে সেই প্রশ্ন করি। আপা কখনোই জবাব দিতে চায় না। এরপর থেকে আপা আমার সাথে দেখা সাক্ষাৎ কমিয়ে দিলো। পারতপক্ষে আমার সামনে আর পড়তে চায় না। যেভাবে হোক এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। আমাকে দেখলেই উনার মুখ ফ্যাকাশে হয় যায়। চোখে কিসের যেন এক আশংকা উঁকি দেয়। আমি বুঝতে পারি আপা আমাকে ভয় পাচ্ছে।
একদিন উনার বাসায় গিয়ে সরাসরি আপাকে চেপে ধরলাম। আজ আমাকে উত্তর দিতেই হবে। শেষমেশ বাধ্য হয়েই শিমু আপা মুখ খুলে।
সেই রাতে হোটেলে ফেরার পর থেকেই নাকি আমি বেশ অদ্ভুত আচরণ করছিলাম। কথাবার্তা কেমন জড়িয়ে যাচ্ছিলো। অল্পতেই রেগে যাচ্ছিলাম। আর রেগে গিয়ে খুব কুৎসিত ভাষায় গালিগালাজ করছিলাম। এতো কুৎসিত ভাষা আপা এর আগে আমার মুখ থেকে শুনেনি। আপা বুঝতে পারছিল না কি বলে আমাকে শান্ত করবে। আমি এক সময় আপাকে জানালাম, আমার খুব খিদে পেয়েছে। রুমে খাওয়ার মত কিছু ছিলো না। আপার ব্যাগে একটা টিস্যু পেপারে মুড়ানো আধখাওয়া বার্গার ছিলো। আমি সেটাই বের করে রাক্ষসের মতো চিবুতে শুরু করি। টিস্যু পেপার খোলার সময়ও নাকি আমার ছিলো না। আমার এত ক্ষিধে দেখে আপা ভয় পেয়ে যান। বার্গার খেয়ে শেষ করে আমি নাকি আবার ক্ষেপে যাই। ঘরে আর কিছু খাওয়ার নাই কেন সেই জন্যে আপাকে গালিগালাজ করতে শুরু করি। কিছুতেই আমাকে ঠাণ্ডা করা যাচ্ছিল না। তারপর এক সময় হঠাত চিৎকার চ্যাঁচামেচি থামিয়ে ঘোষণা দেই আমার ঘুম পাচ্ছে। আমি এখন ঘুমাব। এই বলে আমি আপার সামনেই কাপড় ছাড়তে শুরু করি। শিমু আপার সাথে আমি এমনিতে অনেক ক্লোজ, কিন্তু কখনো তার সামনে নগ্ন হইনি। নিজেকে ঢেকে রাখার একটা প্রবণতা আছে আমার। সেই আমি দিব্যি আপার সামনে সব কাপড় খুলে বিছানায় শুয়ে পড়ি। হাত বাড়িয়ে আপাকেও বিছানায় ডাকি। আপা লজ্জা পেয়ে চোখ সড়িয়ে নেয়।
এই সময় বাথরুম থেকে অদ্ভুত আওয়াজ শুনা যায়। আমাকে বিছানায় রেখে আপা কিসের শব্দ খোঁজ করতে যায়। বাথরুমের দরোজা খুলে আপা দেখে মেঝেতে আমি শুয়ে আছি।
আমাকে বাথরুমে রেখে ফিরে এসে আপা দেখে বিছানায় কেউ নেই। ঘর খালি।
এই ঘটনার কিছু দিন পর শিমু আপার ক্যান্সার ধরা পড়ল। লিউকিমিয়া। ছয়মাস ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করে আপা হার মানলেন।
আমার কি মনে হয় জানেন? আপা মরে গিয়ে বেঁচে গেছে। কিন্তু… কিন্তু আমি … আমি কিভাবে বাঁচব?
অদ্ভুত একটা কিছু আমার সাথে আছে।
আমি এখনও ওটার অস্তিত্ব টের পাই।
ও আমার সাথেই থাকে।
ছায়ার মতো…
সব সময় আমাকে চোখে চোখে রাখে…
যখন ঘুমুতে যাই তখন…
তখন…
আমি এভাবে আর বেঁচে থাকতে পারছি না
আমি আপনার সাহায্য চাই…
আপনি কি আমাকে সাহায্য করবেন?
অনেক রাত হল… তিনটা তেত্রিশ… ৩৩৩… মজার না সংখ্যাটা…? দ্যা হোলি ট্রিনিটি…
আমার শেষ গল্পটা বাকি থাকল… সেটা ফোনে বলব না। কোনো একদিন আপনার সাথে দেখা করে সামনা সামনি বলব। আপনি সব শুনে আমার সমস্যার সমাধান করবেন।
আজ শুভরাত্রি…

Writer:  Ashif Abdul, (Studied Finance at University of Dhaka)

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form