ইনসুলিন আবিষ্কারের কাহিনী


ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র প্রাচীন এবং মারাত্মক একটি রোগ। এ রোগে আক্রান্ত রোগীর রক্ত ও প্রস্রাবে শর্করার পরিমান বেড়ে যায়। রোগাক্রান্ত শরীরে নানা ধরনের উপসর্গ দেখা যায়। রোগীর শরীর দ্রুত শুকিয়ে যায়,অল্প পরিশ্রমেই রোগী ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এভাবে নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে একসময় আক্রান্ত রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ ডায়াবেটিস এর সাথে পরিচিত হলেও ১৯১২ সালের আগে এ রোগের কোনো প্রতিষেধক আবিস্কৃত হয়নি। প্রতিষেধক বললে ভুল হবে,তা হবে প্রতিরোধক। কারন আজও প্রতিষেধক আবিস্কৃত হয়নি।আজ আমরা সেই প্রতিরোধক আবিষ্কার এর কাহিনী জানব।
কানাডার চিকিৎসক ফ্রেডারিক গ্রান্ট ব্যান্টিং ছিলেন এই প্রতিরোধক এর আবিস্কারক। ব্যান্টিং ডায়াবেটিস মেলিটাসের প্রতিরোধক আবিষ্কার করেছিলেন।
১৯১৬ সালে বিজ্ঞানীরা নিরলস গবেষণার মধ্যে দিয়ে জানতে পারেন অগ্নাশয়ের ভিতর আইলেট অব ল্যঙ্গারহান্স থেকে নিসৃত একপ্রকার হরমোনের অভাবেই প্রানিদেহ ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হয়। বিখ্যাত হরমোন বিশেষজ্ঞ শেফার এর নাম দেন ইনসুলিন(Insulin)।
এ রোগের কারণ সম্পর্কে ধারণা পেলেও বিজ্ঞানীরা এর প্রতিরোধক এর দেখা পায়নি। তারা নিরাশ না হয়ে গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকেন। অবশেষে এ কাজে সফল হন ব্যান্টিং।
তার আগে ব্যান্টিং সম্পর্কে ডিটেল্স জেনে নেইঃ
১৮৯১ সালের ১৪ নভেম্বর কানাডার এ্যালিস্টনে এক গরিব কৃষকের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন ব্যাটিং। পরিবারে লেখাপড়ার চর্চা নেই বললেই চলে। বাবা সারাদিন মাঠে কাজ করতেন। কিন্তু ব্যাটিং এর মনে ছিল অদম্য ইচ্ছাশক্তি যা তাকে হার মানতে দেয়নি। ব্যাটিং নিজের চেষ্টায় ১৯১১ সালে টরেন্টো মেডিকেল স্কুল এ ভর্তি হন। সেখান থেকে পাশ করার পর ১৯১৬ সালে কানাডার সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব দেখানোর জন্য তাকে সামরিক সম্মানে ভূষিত করা হয়।
যুদ্ধ শেষে ১৯২০ সালের ৩০ অক্টোবর রাতে ব্যান্টিং পাকস্থলী ও অন্ত্রের পেছনে অবস্থিত প্যাংক্রিয়াস গ্রন্থি সম্পর্কে পড়তে গিয়ে দেখেন পিত্তাশয়ের পাথরের চাপে প্যাংক্রিয়াসের কিছু কোষ শুকিয়ে যায়।ফলে জারক রসের কোষগুলো বন্ধ হয়ে যায়।যাদের এমন হয় তাদের কখনো ডায়াবেটিস হয় না।
অধ্যাপক মোসেস বেরনের লেখা প্রবন্ধটি পড়ে ব্যান্টিং এর মনে হয় প্যাংক্রিয়াসের জারক রস আইলেটের হরমোনকে আকেজো করে দেয় এবং এ জন্যই প্রণী ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত হয়।
ব্যান্টিং ভাবেন,আইলেট নিসৃত হরমোনের অভাবেই যদি ডায়াবেটিস হয় তাহলে বাইরে থেকে আলাদাভাবে হরমোন প্রয়োগ করেও এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। সেই থেকে শুরু হলো বেচারা ব্যান্টিং এর ভাবনা।
তখন অনেক রাত ছিল।ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। সেই রাতের সিদ্ধান্তের কথা যদি পরদিন না মনে থাকে তাই ব্যান্টিং সেগুলো নোট খাতায় লিখে রাখে যেঃ
১)কুকুর নিয়ে গবেষণা করতে হবে
২)ওদের প্যাংক্রিয়াস বেধে রাখতে হবে এবং তা ক্ষয়ের জন্য ৬-৮ সপ্তাহ ওয়েট করতে হবে।
৩)পরে বাকি অংশ থেকে নির্যাস বের করতে হবে।
বেচারা ব্যান্টিং কিন্তু সেদিনও ভাবেনি যে তার লেখা নোটগুলো একদিন কোটি কোটি মানুষের জীবন রক্ষা করবে।
পরদিন ব্যান্টিং সিদ্ধান্ত নেন সে অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে গবেষণার কাজে সময় লাগাবেন।ব্যান্টিং তার ইচ্ছার কথা বিভাগীয় প্রধান ড.মিলার কে জানান এবং মিলার তাকে টরেন্টো মেডিকেল স্কুলের পরিচালক ডাক্তার J.J.Mclleod এর সাথে আলাপ করার পরামর্শ দেন।
ডা.ম্যাকলিয়ড ছিলেন একজন অহংকারী দাম্ভিক গবেষক। ব্যান্টিং তার ইচ্ছার কথা ম্যাকলিয়ড কে জানালে ম্যাকলিয়ড তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করে এবং বলেন "বিশ্বের বড় বড় বিজ্ঞানীরা যেখানে সফল হয়নি তুমি এসেছো আমার সাথে মজা করতে। যাও পগলের ডাক্তার দেখাও"
ব্যান্টিং অনের কষ্ট পেয়েছিল কিন্তু হার মানেনি।কিছুদিন পর ব্যান্টিং আবার সেই একই ব্যাক্তির কাছে হাজির হন কারন তা ছাড়া গবেষণার আর কোনো উন্নত ল্যাব ছিল না। এবার সে সাথে কিছু প্রভাবশালী ব্যাক্তির সুপারিশ নিয়ে আসেন, শুধুমাত্র ল্যাবরেটরির এক কোনে ঠাই পাবার জন্য। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি।অহংকারী ম্যাকলিয়ড ব্যান্টিংকে কোনো সুযোগ দেয়নি। তার মনটা অনেক খারাপ হলো কিন্তু হার মানেনি।
এভাবে আরো কয়েক মাস কেটে গেল কিন্তু ব্যাটিং আর গবেষণার জায়গা পেলেন না। একদিন ব্যান্টিং এক খবর শুনল যে ডাক্তার ম্যাকলিয়েড দু-মাসের জন্যে স্কটল্যান্ডে যাচ্ছেন যার কারনে ল্যাবরেটরি দুমাস বন্ধ থাকবে। ব্যান্টিং আবার সেই ম্যাকলিয়ডের কাছে যান তাকে দুমাস ল্যাবরেটরি ব্যাবহারের করতে দেয়ার জন্য। সৃষ্টিকর্তার অপার কৃপায় এবার মনে হয় ম্যাকলিয়ডের মন কিছুটা হলেও নরম হয়। ম্যাকলিয়ডের রাজি হলেন অবশেষে ব্যান্টিংকে ৮ সপ্তাহ কাজ করতে দিবে। তবে ল্যাবে নয় চিলেকুঠায় বিসে কাজ করতে হবে। ব্যান্টিং মহাখুশি। কিন্তু ব্যান্টিংকে সাহায্য করবেন ম্যাকলিয়ডের এক ছাত্র যার নাম Beast.


১৯২১ সালের ৬ মে ব্যান্টিং ম্যাকলিয়ডের কাছে থেকে ল্যাবরেটরির দায়িত্ব পান।বেস্টের সাথে বুঝাপরা হতে থাকে।তারপর জটিন গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন নিজেকে।
৬ জুলাই কয়েকটি কুকুরের পেট চিরে ব্যান্টিং ওদের প্যাংক্রিয়াসের জারক রসবাহী শিরাগুলো বেধে দেন। একুশ দিন পর ২৭ জুলাই ব্যান্টিং আর বেস্ট মিলে কুকুরের পেট কেটে দেখেন যে সেই প্যাংক্রিয়াসগুলো শুকোয়নি-আগের মতোই সতেজ রয়েছে।তবে এটা তাদের ভুলের কারনেই হয়েছিল।তারা প্যাংক্রয়াসের মুখগুলো ভালোভাবে বাধতে পারেননি।
অন্যদিকে হাতে আছে ১ সপ্তাহ।এরপর ল্যাবরেটরি ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু একটি নতুন কাজ আরম্ভ করলে আরো অনেক দিন সময় লাগবে। ব্যান্টিং নতুন উপায় খুঁজছে।,অনেক ভেবে আবার কয়েকটি কুকুরকে অপারেশন করেন তিনি এবং বেধে দেন প্যাংক্রিয়াসের শিরাগুলি। তিন সপ্তাহ পর আবার সেগুলো বের করে নেয় কুকুরের পেট থেকে। এবার ব্যান্টিং আনন্দে আত্মহারা। কুকুরের পেটে এবার প্যাংকরিয়াস শুকিয়ে গিয়েছে মাত্র তিন সপ্তাহে যেখানে ৬-৭ সপ্তাহ লাগার কথা ছিল।
এবার ব্যান্টিং আর বেস্ট মিলে প্যাংক্রিয়াসগুলো পিষে তা থেকে একধরনের নির্যাস তৈরি করেন। তারা সেই পদার্থটির নাম দেন আইলেটিন। তারপর ৫ সি.সি পরিমান আইলেটিন বহুমূত্রে আক্রান্ত একটি কুকুরের শরীরে ঢুকিয়ে দেন। বেস্ট ঘন্টায় ঘন্টায় কুকুরের রক্ত আর প্রস্রাব পরিক্ষা করে চলেন। তিনি লক্ষ্য করের ন যে,আইলেটিন প্রয়োগে কুকুরটির রক্ত ও প্রস্রাবে শর্করার পরিমান কমে এসেছে। কুকুরটিও ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠেছে। তার মানে তাদের গবেষণা সফল হয়েছে।


ডায়াবেটিস রোগের প্রতিরোধক হিসেবে আইলেটিন কার্যকর প্রমাণিত হলেও ব্যান্টিং ও বেস্ট তেমন খুশি হতে পারেননি।কারন এর কার্যক্ষমতা ছিল খুবই অল্প সময়ের। আর তার চেয়ে বড় কথা হলো একটি কুকুরকে একদিন বাঁচিয়ে রাখার জন্যই তা শেষ হয়ে যাচ্ছিল। অবস্থা যদি এমন হয় তাহলে লাখ লাখ রোগীকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে কেমন করে????
ব্যান্টিং জানতেন প্রায় সব প্রশ্নের জবাব রয়েছে কারো না কারো লেখার উপর। তাই ব্যান্টিং এবার মনোযোগ দিলেন বই পড়ায়। তার মন বলছিল সে কোনো না কোনো সমাধান পাবেনই।অবশেষে তার ভাবনাটাই সত্যি হলো। একটি চিকিৎসা সাময়িকী পড়ে সে জানতে পারলেন যে,শিশুরা যখন মাতৃগর্ভে ভ্রুণ অবস্থায় থাকে তখন তাদের জারক রসের প্রয়োজন হয়না।ফলে ভ্রণের প্যাংক্রিয়াসে আইলেট অব ল্যাঙ্গারহান্সের পরিমাণ থাকে প্রপ্তবয়স্ক প্রানীর চেয়ে বেশি।
প্রবন্ধটি পড়ে ব্যান্টিং অন্ধকারে আলোর দেখা পান।তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে প্যাংক্রিয়াস নিয়ে গবেষণা চালাবেন।
শুরু হলো নতুন অভিযান,
ব্যান্টিং কসাইখানা থেকে বেশ কিছু ভ্রুণ সংগ্রহ করেন। বেস্ট আর তিনি মিলে সেগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণ আইলেটিন তৈরি করেন। তারপর সেগুলো ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত কুকুরের শরীরে ডুকিয়ে দেন।দুদিন না যেতেই তারা দেখতে পান গাভীর ভ্রণ থেকে প্রস্তুত আইলেটিন ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সমানভাবে কার্যকর।
এবার প্রচারনার পালা।ব্যান্টিং ও বেস্ট সিদ্ধান্ত নেন তাদের আবিস্কার এর কথা বাইরে প্রকাশ করার। তারপর এক রাতের ইয়েল ইউনিভার্সিটির শরীরতত্ত্ব বিভাগের জার্নাল ক্লাবের হলরুমে ম্যাজিক লণ্ঠনের আলো জ্বেলে তারা তাদের গবেষণার ফলাফল প্রদর্শন করেন।উপস্থিত চিকিৎসাবিদ এবং অধ্যাপকরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন তাদের উদ্ভাবনী শক্তি দেখে।কিন্তু এর পরেই যখন অধ্যাপকরা জানতে চান ব্যান্টিং এর উদ্ভাবিত আইলেটিন মানুষের উপকারে আসবে কি না।ব্যান্টিং তখন বেশ সমস্যায় পড়েন। আর বেস্ট ছোট গলায় বলেন যে সে ব্যাপারে কিছু বলা যাচ্ছেনা। তবে তারা গবেষণা চালিয়ে যাবেন।
এ ঘটনার পর ব্যান্টিং মানুষের উপর আইলেটিন এর কার্যকারিতা পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন।কিন্তু কে রাজি হবে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিতে??
সে সময় টরেন্টো হাসপাতালে থমসন নামে ১৪ বছর বয়সের একজন ডায়াবেটিস রোগী ছিল।চিকিৎসকরা তার জীবনের আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন।তাকে প্রস্তাব দেয়া হলে ছেলেটি পরীক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতে রাজি হয়।
১৯২২ সালে ১১ জানুয়ারি ব্যান্টিং থমসনের শুকিয়ে যাওয়া হাতের শিরায় আইলেটিন প্রয়োগ করেন।দেখতে দেখতে মৃতপ্রায় থমসনের প্রস্রাব ও রক্তে শর্করার পরিমাণ কমে আসে।মাত্র কয়েক দিনের চিকিৎসায় সে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে যায়।
ব্যান্টিং আর বেস্টের সাফল্য দেখে এবার রঙ্গমঞ্চে উপস্তিত হন ম্যাকলিয়ড। ম্যাকলিয়ড ছিলেন স্বর্থপর,বিশ্বস
ঘাতক। নিজের প্রাধান্য বজায় রাখার জন্য প্রথমেই আইলেটিন এর নাম বদলে দেন তিনি। তিনি এর নাম দেন ইনসুলিন। ১৯১৬ সালে হরমোন বিজ্ঞানী শেফার এই নামটি প্রস্তাব করেছিলেন।
ডা.বিশ্বাসঘাতক ম্যাকলিয়ড বিখ্যাত সব বিজ্ঞানীদের নিয়ে তার ল্যাবরেটরি ভরে ফেলেন।এদের কর্মকান্ডের মধ্যে ব্যান্টিং আর বেস্টের নাম হারিয়ে যায়। ডায়াবেটিস রোগের প্রতিরোধক আবিষ্কারের জন্য ১৯২৩ সালে ব্যান্টিং এবং ম্যাকলিয়ডকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
ডাক্তার ম্যাকলিয়ড পুরস্কার ছিনিয়ে নিয়েছিলেন তার প্রচার ও কৌশলের বিনিময়ে। কিন্তু এ পুরস্কারের প্রকৃত দাবিদার বেস্টকে রাখা হয় পুরো খেলার বাইরে।
ব্যান্টিং ম্যাকলিয়ডের এ আচরনের তীব্র প্রতিবাদ জানান।তিনি নোবেল কমিটির কাছেও বেস্টের নামে সুপারিশ করেন। বেস্টকে নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বৈঠক করেন।কিন্তু তাতে আর কি লাভ। তারপর বেচারা নিজের নোবেল পুরস্কারের অর্ধেক টাকা বেস্টকে দিয়ে দেন।


Source: বরণীয় বিজ্ঞানী স্মরণীয় আবিষ্কার
Credit: এনায়েত রসুল স্যার

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form