কবর ভাগ্য - সানজিদ পারভেজ (পর্ব ৫-৬)



দুপুরের দিকে বেলায়েত সাহেব এলেন। রুমে ঢুকেই মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললেন, “যাক, তাহলে আছেন দেখছি। আমি আবার ভাবলাম আপনাকে পাই কিনা।” মুখ থেকে মিটিমিটি হাসিটা সরালেন না, চেয়ারটা টেনে বসতে বসতে বললেন, “তা শুনলাম, ইদানিং নাকি চেম্বারে মাঝে মধ্যে আপনাকে পাওয়াই যায়না? রিক্সায় করে বলে হুটহাট এদিকওদিক বেরিয়ে পড়েন?” শেষের কথাটা বলেই বিশ্রী ভাবে একটা চোখ টিপি মারলেন।
--“আপনিও রসিকতা করছেন, বেলায়েত সাহেব? আপনারা আসলে যেমনটা ভাবছেন ব্যাপারটা কিন্তু সেরকম কিছুই না। এই একটু প্রোফেশনাল কার্টেসি রক্ষা করতে বেরিয়েছিলাম আর কি।”
--“প্রোফেশনাল কার্টেসি-ফার্টেসি যাই বলুন না কেন, গোটা ব্যাপারটার মধ্যে বেশ কিন্তু একটা ফিল্মি আমেজ আছে।”
--“ফিল্মি আমেজ? কি রকম?”
--“বুঝলেন না? নায়িকার ভাই টপ টেরর, গল্পের ভিলেন। বাইরে থেকে আসা শহুরে নায়ক কি পারবে ভালবাসা দিয়ে সবকিছু জয় করতে? হেহেহে...কি বলেন?”
--“আপনারা পারেনও, ভাই! এক অনুরোধের ঢেঁকি গিলতে গিয়ে এতকথা শুনতে হবে জানলে আপানাদের এই এলাকায় কোনদিন পা’ই দিতাম না।”
--“আরে! আপনি আবার মাইন্ড করে বসলেন নাকি? মাইন্ড করার কি আছে? শুনুন, মেয়ে কিন্তু খারাপ না। ওর ভাইটাই যা সমস্যা। তবে বাদল কিন্তু গুন্ডা হলেও নিজের বোন বলতে অজ্ঞান। খুবই আদর আর আহ্লাদ দিয়েই বোনটাকে মানুষ করেছে। আর তাই ওর ভালমন্দ যে কোন ব্যাপারেই সে বেশ সিরিয়াস...বোন কোথায় যায়, কি করে, কি খায়, কার সাথে মেশে...সবই তার নখদর্পনে থাকে বলতে গেলে।”
--“হে আল্লাহ্! তাহলে তো আমার সাড়ে সর্বনাশ হয়ে গেছে বলা যায়!”
--“কিসের সর্বনাশ? আরে গুটি তো এখন আপনার কোর্টে! গোটা ব্যাপারটাই নির্ভর করছে আপনার পরের চালগুলোর উপর। তবে হ্যাঁ, বাদল ছেলেটা আসলেই খুব ডেঞ্জারাস। উঠতে বসতে মানুষ মারাটা ওর বা হাতের কাজ, দুর্নাম আছে বেশি খেপলে নাকি লাশ টুকরো টুকরো করে নদীতেও ফেলে দেয়! তাই একটু সতর্কতা আর বুদ্ধিমত্তার সাথে আপনাকে পরবর্তী পদক্ষেপগুলো নিতে হবে। গোটা বিষয়টা থেকে যদি বেরিয়ে আসার চিন্তাভাবনাও করেন...”
--“ধুরও মিয়া! তখন থেকে কি সব বলে যাচ্ছেন! আমাদের মধ্যে তো আসলে তেমন কিছুই হয় নাই। ঐ মেয়েই তো আমাকে রাতবিরাতে ফোন করে উৎপাতটা শুরু করে।”
--“যদি ফোনই করে থাকে, তাহলে ঐ উৎপাতের সাথে আবার বাইরে বেরোতে গেলেন কেন? আপনি তো এখন লাইমলাইটে এসে গেছেন! আপনার কথা যদি ধরেও নেই, তারপরও বলব যতটা ফাঁসবার তা কিন্তু আপনি ফেঁসে গেছেন, রাজীব সাহেব।”
।। ৮।।
পরিস্থিতির গভীরতা, সম্ভাব্যতা আর নেতিবাচক ফলাফলের ভয়াবহতা নিয়ে বেলায়েত সাহেব আরও কিছুক্ষণ বকবক করলেন। বাসা থেকে হঠাৎ করে একটা জরুরি ফোন এসে পড়াতে ভদ্রলোক না চাইতেও উঠতে বাধ্য হলেন, আর আমিও হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। বিকেলটা বেশ কর্মব্যস্ততার মধ্য দিয়ে কেটে গেল।
সন্ধ্যার দিকে একটু ফুসরত পেতেই নিচ থেকে আরেক দফা চা-সিগারেট খেয়ে এলাম। চেম্বারে বসে আছি। ভাবছি আর আধা ঘন্টা ওয়েট করব, এর মধ্যে কোন পেশেন্ট না এলে বাসায় চলে যাব। ভাল লাগছে না কিছু, কেমন যেন অস্থির-অস্থির লাগছে। আসলে মেজাজটাই খারাপ হয়ে আছে সকালে ঐ মিল্টন ছোকরা আর দুপুরে বেলায়েত সাহেবের কাছ থেকে একগাদা সতর্কবাণী মূলক উপদেশ গিলে। কি যে করব তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। এদিকে ফরিদ ভাইও নাই কদিন ধরে এলাকাতে, রাজশাহীতে গেছেন তার কোন খালাতো ভাইয়ের বিয়ে খেতে। আচ্ছা, আজ আঠারো তারিখ না? আজকে রাতেই তো ওনার ফেরার কথা।
চিন্তাটা বাঁধাগ্রস্ত হল একজোড়া মসৃণ সোলের জুতোর মৃদু গম্ভীর আওয়াজ পেয়ে। আর সেই সাথে তাল মিলিয়ে কেমন যেন একটা ‘ঠক ঠক’ শব্দ। সামনে তাকাতেই পর্দার নিচ দিয়ে জুতোজোড়া দেখতে পেলাম। চকচকে পলিস করা শু, তার সাথে লাঠির মতও কিছু একটার মাথার দিকটা নজরে এল। আস্তে করে পর্দাটা সরিয়ে একজন বেশ কেতাদুরস্ত ভদ্রলোক এবার চেম্বারে প্রবেশ করলেন। হাতে চকচকে একটা ছড়ি, পড়নে গাড় ছাই রঙা স্যুট আর অফ হোয়াইট এক কালারের শার্ট। মাথার চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করা, গায়ের রঙটা তামাটে। সুন্দর ছড়িটার উপর হালকা ভর দিয়েই সামান্য খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কয়েক কদম এগিয়ে এসে থামলেন।
“আপনিই কি রাজীব সাহেব? এখানকার ডেন্টিস্ট?” গলার স্বরটা কেমন যেন ফ্যাসফ্যাসে, তবে চোখের দৃষ্টিটা তীব্র।
--“আসসালামালাইকুম, জ্বী...আমিই রাজীব।” স্বভাবজাত একগাল হাসি উপহার দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম।
গোটা চেম্বার জুড়ে ভদ্রলোক এবার নজর বুলাতে লাগলেন, ক্ষুরধার দৃষ্টি দিয়ে সবকিছু যেন পরখ করে দেখছেন। তারই মধ্যে বলে উঠলেন, “এই তল্লাটে আমাকে সবাই এক নামেই চেনে। আমার নাম বাদল, বাদল খন্দকার। আমার ছোট বোন মনে হয় কিছুদিন আগে এসে আপনার কাছে দাঁত দেখিয়ে গেছে।” সারা ঘরময় চোখের দৃষ্টিটা ঘুরতে ঘুরতে তা আবার আমারই উপর এসে থেমে গেল শেষ বাক্যটার সমাপ্তি টানার সাথে সাথেই।
কয়েক মুহূর্ত আমার মুখ ফুটে কোন কথা বেরালো না। না চাইতেও মনে হল ঘাড়ের কাছের রোমগুলো যেন সব দাঁড়িয়ে গেছে, পেটের ভেতর কেমন যেন এক ধরণের খিদে অনুভূত হল। লিকলিকে, শীতল সাপের মত কিছু একটা যেন মনে হল আমার শিরদাঁড়া বেয়েও নেমে গেল। কি আশ্চর্য! আমি কি ভয় পাচ্ছি? এত ভয় পাবার কি আছে? এই তাহলে ল্যাংড়া বাদল! এই এলাকার কুখ্যাত সন্ত্রাসী...শর্মিলার ভাই?!
বিমূর্ত হয়ে থতমত ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে ছিলাম বলেই হয়তোবা, বাদলের দুচোখের দৃষ্টি মনে হল আগের চাইতেও যেন আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল।
উফফ! সেকি অসহ্য, তীব্র এক দৃষ্টি! মনে হচ্ছিল আমার দুচোখ ছিদ্র করে ভেতরে ঢুঁকে যেন মগজ ফুঁড়ে এক নিমিষে বের করে নিয়ে আসবে আমার ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্
তমান, সবকিছু! টেনে হিঁচড়ে বের করে ফেলবে আমার সমস্ত লুকানো ভয় আর পাপবোধগুলোকে এক-এক করে মনের গোপন কোটর থেকে! দেখে ফেলবে...ক্ষণিকের জন্যে হলেও মনের গোপন ক্যানভাসে ভেসে ওঠা শর্মিলাকে নিয়ে নোংরা কিছু ভাবনার অশ্লীল চিত্রকল্প!
নাহ! এই দৃষ্টিকে তো আর প্রশ্রয় দেয়া চলে না। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে বাদলের চোখের উপর থেকে নিজের দৃষ্টিটা নামিয়ে আনলাম।
“জিজ...জ্বী, দাঁড়িয়ে কেন? ব্ব...বসুন না।” সামনের চেয়ারটা ইঙ্গিত করে নিজেও বসতে বসতে কথাটা বললাম বটে, কিন্তু একি! আমি তোতলাচ্ছি কেন? আমি তো তোতলাই না কখনো! ‘ছিঃ রাজীব ছিঃ, তোমার সেলফ-এস্টিমের এতটা অধঃপতন!’ নিজেকে দ্রুত বোঝাবার চেষ্টা করলাম...‘কুল ডাউন, রাজীব। এতটা ঘাবড়ে যাবার কি আছে, বলো তো? শর্মিলার ভাই চেম্বারে এসেছে, তো কি হয়েছে? হ্যা, সে এখানকার একজন ভয়ংকর সন্ত্রাসী, মানলাম; কিন্তু তাই বলে তো সে নিশ্চই এখনই তোমাকে এই চেম্বারেই কিছু করে বসবে না? অবস্থা তো আর যাই হোক, এখনও অতটা খারাপের দিকেও যায়নি। হতে পারে তারও হয়তো দাঁতে কোন সমস্যা থাতে পারে আর ঐ কারণেই তোমার কাছে আসা। হেহে, দেখেছ? খামোখা কিছু না বুঝেই একটা সহজ বিষয়কে কেন এতটা জটিল করে ভাবতে গেলে?’
ব্যাপারটাকে সেলফ মোটিভেশন বা সেলফ-রিজোনিং যাই বলুন না কেন, এতে করে কিছুটা হলেও কাজ হল। বিস্ময় আর আতঙ্কবোধটাকে অনেকটা সামলে নিয়ে যতটা পারা যায় স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞেস করলাম, “জ্বী...কিছু মনে করবেন না, আপনার বোনের নামটা বলবেন কি? আসলে আমার কাছে তো প্রতিদিন অনেক পেশেন্টই আসে, তাই ঠিক ধরতে পারছি না কার কথা বলছেন?”
একটু কষ্ট করে হলেও গাল ভরা হাসিটা সাথে জুড়ে দিতে ভুললাম না।
--“শর্মিলা খন্দকার।” কেমন যেন একটা অস্বস্তিকর, নিরুত্তাপ কণ্ঠে জবাব দিল বাদল।
--“শর্মিলা...শর্মিলা...ও হ্যাঁ! মনে পড়েছে, কিছুদিন আগে ওনার থার্ড মোলারে রুট ক্যানেল করে দিয়েছিলাম।”
বাদলের চোখে আবারো সেই দৃষ্টি, আর আমিও সাথে সাথে তা এড়িয়ে গিয়ে কাগজকলম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। প্যাডের মধ্যে সুন্দর করে বাদলের নামটা লিখে বললাম, “তা এবার আপনার দাঁতের সমস্যাটা বলুন?”
--“আমি কোন সমস্যা নিয়ে আসেনি আপনার কাছে, এসেছি আপনার সাথে একটু পরিচিত হতে।” সেই একই নিরুত্তাপ কণ্ঠ, তবে চোখের দৃষ্টিটা মনে হল একটু নমনীয় হয়ে এল।
অনেকক্ষণ পর এবার যেন কিছুটা স্বস্তির সাথে নিঃশ্বাস ফেলতে পারলাম। যাক! ব্যাটা তাহলে গ্যাঁজাতে এসেছে? তা আসতেই পারে, বোনের নতুন নাগরের কথা কানে গিয়েছে যেহেতু, তখন কি আর বসে থাকা যায়? আফটার অল একমাত্র ভাই বলে কথা, দায়িত্ব তো আর এড়িয়ে থাকা যায় না।
আমি এবার আরও দন্ত্য বিকশিত করে বললাম, “বাহ! সে তো খুবই ভাল কথা। আমি তো এদিকটায় একেবারে নতুনই বলা যায়। কিছুদিন হল এসেছি, খুব একটা মানুষজনের সাথে এখনো পরিচিত হতে পারিনি। ফরিদ ভাইই যা দুএকজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। আর আপনি সেখানে নিজ থেকে পরিচিত হতে এলেন দেখে বেশ ভাল লাগছে। দাঁড়ান, চা দিতে বলি। চা খেতে খেতে বসে গল্প করা যাবে। এই মিল্টন, কোথায় গেলি? দু’কাপ চা নিয়ে আয় ঝটপট...”
সেদিন আসলেই বাদল এসেছিল মূলত গ্যাঁজাতে। আমাকে একটু বাজিয়ে দেখতে আর কি। আমার খুব খোঁজখবরটবর নিল; লেখাপড়া, ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ইত্যাদি ইত্যাদি, যেমনটা শর্মিলা নিয়েছিল প্রথম দুদিনের ফোনালাপে। নিজের ব্যাপারে তেমন একটা মুখ খুলল না; বোনের কথার সাথে তাল মিলিয়েই শুধু জানাল বাবার রেখে যাওয়া ট্রান্সপোর্টের বিজনেসটা সামলাচ্ছে আর সেই সাথে লোকাল পলিটিক্সেও ইনভল্ভড। স্থানীয় লোকজনের ভালমন্দটা নাকি ওকেই দেখতে হয়, এছাড়া সামনের ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনেও দাঁড়াবার একটা চিন্তাভাবনা আছে। সবমিলিয়ে ল্যাংড়া বাদলের সাথে আড্ডাবাজিটা সেদিন মন্দ হল না, এমনকি যাবার আগে মৃদু হেসে হ্যান্ডশেক পর্যন্ত করে গেল!
।। ৯।।
শুক্রবার। ছুটির দিন। ঘরেই ছিলাম, দুপুরে জুম্মার নামাজ পড়ে এসে দেখি মোবাইলে ফরিদ ভাইয়ের মিসডকল। কলব্যাক করলাম, দুটো রিং হতেই উনি ধরে বললেন, “হ্যালো রাজীব? কি খবর তোমার?”
--“আসসালামালাইকুম। এই তো ফরিদ ভাই, আছি আল্লাহ্ দিলেই ভালই। তারপর আপনার খবর বলেন? বিয়ে কেমন খেলেন? ফিরলেন কবে? কাল রাতে?”
--“হ্যাঁ, কাল রাতেই ফিরেছি। আচ্ছা রাজীব, তুমি কি এখন ফ্রি আছ?”
--“হ্যাঁ, ফ্রিই বলতে পারেন। কী ব্যাপার, বলুন তো?”
--“কাল সন্ধায় বলে চেম্বারে বাদল এসেছিল?”
--“হ্যাঁ ফরিদ ভাই, আর বলবেন না, আমি তো প্রথমে দেখে চিনতেই পারি নাই! সে তো যাকে বলে ড্যাসিং হিরো! পরে পরিচয়টা দিলে বুঝলাম এই হিরোই আসলে আপনাদের ল্যাংড়া বাদল। হাহাহা!”
--“তা সে কি বলল তোমাকে? কোন হুমকি-ধমকি দিয়েছে?”
--“আরে না, সেরকম কিছু না। খোড়া পায়ের ধুলো দিয়ে বলল সে নাকি জাস্ট পরিচিত হতে এসেছে। পরে অনেক খোঁজখবর নিল আমার। ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড এইসব আর কি।”
--“আচ্ছা, তুমি কি ওর বোন শর্মিলার সাথে সত্যিই মায়াদীঘির ঘাটে গিয়েছিলে?”
বোঝাই যাচ্ছে, মিল্টন বা কারো কাছ থেকে ইতিমধ্যে সবই শুনেছে ফরিদ ভাই। আমি বললাম, “জ্বী ভাই, তা গিয়েছিলাম...অনেকটা বাটে পড়েই।”
--“আর?”
--“আর কি?”
--“আর কোথায় কোথায় গিয়েছ ওকে নিয়ে?”
--“আর তো কোথাও যাই নাই। তবে হ্যাঁ, তার আগে একদিন মার্কেটের ঐ দোকানটায়...ঐ যে যেখানে একদিন আপনি পেস্ট্রি আর পেটিস খাওয়ালেন, ওখানেই ওর সাথে দেখা হয়ে যায় হঠাৎ করে। পরে অল্প কিছুক্ষণ বসে কথাটথা বলে চলে আসি।”
--“তোমার সাথে শর্মিলার ফোনে কথা হয়?”
--“ফোন দিয়েই তো শুরু! কিন্তু ধীরে ধীরে এই যন্রণা যে আমার ঘাড়ে চেপে বসবে তা তো তখন বুঝতে পারি নাই, ফরিদ ভাই! এদিকে সবাই তো আমাকে ভয় পাওয়ায় দিচ্ছে, কাল আবার গুন্ডা ভাইটাও এসে চেহারা দেখিয়ে গেল! এখন কি করা যায় বলেন তো? একটা বুদ্ধি দেন না, এই ঝামেলা থেকে উদ্ধারের।”
--“শোন রাজীব, আমি তোমাকে এখন কিছু কথা বলব, খুব মন দিয়ে শুনবে, ঠিক আছে? বিষয়টা হল, তুমি যে আমার অনুরোধে সেই ঢাকা ছেড়ে আমাদের এখানে এসে প্র্যাকটিসটা শুরু করেছ, তার জন্য আমি আসলে সারা জীবন তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। তাছাড়া তোমাকে আমি স্রেফ একজন জুনিয়র ফ্রেন্ডই না, আমার ছোট ভাইয়ের মতই স্নেহ করি। আর এই ভাল লাগার জায়গাটা থেকেই তোমার প্রতি কিন্তু আমার আপনা-আপনিই একটা দায়িত্ববোধ কাজ করে। আফটার অল, তুমি আমার কথায় ছুটে এসেছ এখানে, তাই চাইলেও কিন্তু আমি তোমার ভালমন্দের ব্যাপারটা আমি এড়িয়ে যেতে পারি না। কিন্তু কথা হল, তুমি একজন ম্যাচিউরড ছেলে। নিজের ভালমন্দ বোঝার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। এখন তুমি যদি মনে কর, বাদলের মত একজন টপ টেরর এন্ড মার্ডারের বোনের সাথে অ্যাফেয়ার করবে, দুদিন পরে তাকে বিয়ে করবে, দ্যাটস ফাইন। ইটস ইওর লাইফ, ইওর ডিসিশন, তোমার এই পারসোনাল ম্যাটারে আমরা কেউই আর ইন্টারফেয়ার করব না। শেঠের বাজারের সবাই আমরা হাসিমুখেই তোমাদের বিয়ে খেতে যাব। কিন্তু, তোমার মাথায় যদি ঘুণাক্ষরেও অন্য কোন ধরণের চিন্তা থাকে বা মনে কর এই মেয়ের সাথে ফোনে ফোনেই কিছু দিন টাইম পাস করে কাটিয়ে দেবে, তাহলে কিন্তু মস্তবড় একটা ভুল করছো! কেননা এই মেয়ে হয়ত দুদিন কান্নাকাটি করে তোমাকে ভুলে যাবে, তারপর আরেকজনকে ধরবে, বাদল কিন্তু তোমাকে ভুলবে না! ওর এই বোকাহাবা বোনটার সাথে কেউ কিছুদিন মজা নিয়ে কেটে পড়বে, এই জিনিষটা ও একদমই পছন্দ করে না বা মানতেই পারে না বলা যায়। ছেলেপেলে দিয়ে ও তোমাকে এমনভাবে হেনস্তা করে ছাড়বে যাতে করে শেঠের বাজারে তোমার থাকাটাই মুশকিল হয়ে পড়ে। এই ভাই-বোন দুইজনেই আসলে বেশ সেন্সিটিভ, একটু মেন্টাল প্রকৃতির। এদের কাছ থেকে আমরা সবাই তাই কমবেশি দূরে থাকতে চেষ্টা করি। এখন তুমি কতদূর কি করেছ আর করতে যাবে তা তুমিই ভাল জানো আর তোমাকেই ঠিক করতে হবে...”
--“কিন্তু ভাই, আমি তো সত্যিই আসলে কিছু করি নাই! ঐ মেয়েই তো আমাকে ফার্স্টে ফোন করে খেজুরে আলাপ শুরু করে। আমি তো শুধু ভদ্রতার খাতিরে রেসপন্স করে গেছি...”
--“ইট ডাসেন্ট ইভেন ম্যাটার নাউ, রাজীব! ইন্টেনশনালি ওর নট, ইউ হ্যাভ ক্রিয়েটেড দিস প্রবলেম ফর ইউরসেলফ এন্ড নাউ ইউ হ্যাভ টু ডিল উইথ ইট! কে কবে কাকে আগে ফোন করেছিল, কে কার প্রতি কতটা ইন্টারেস্টেড, এগুলো এখন আর কোন ম্যাটার করে না, রাজীব। শেঠের বাজারে তুমি অলরেডি কালার হয়ে গেছ! বাদল এসে তোমার চেম্বারেও ঢুঁ মেরে গেছে! সবাই যা বুঝার বুঝে নিয়েছে। তারপরও তুমি যদি গোটা ব্যাপারটা থেকে মানসন্মান নিয়ে বেরিয়ে আসতে চাও, তাহলে আমার অ্যাডভাইস হবে, তাড়াহুড়া করে হুটহাট কিছু করে বসো না। একটু ঠান্ডা মাথায় শর্মিলার সাথে তোমার সম্পর্কটা নিয়ে আগে ভাল করে ভাব, তারপর চিন্তা করে দেখ এমন কিছু করার কোন সুযোগ আছে কিনা যাতে করে সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না! বুঝেছ?”
--“জ্বী ভাই...বুঝলাম।”
ফরিদ ভাই মনটাই আসলে খারাপ করে দিল! এ কোন বিশ্রী এক ঝামেলায় পড়া গেল? গতকাল বাদলের সাথে বেশ আলাপী একটা আড্ডা দিয়ে যাও না একটু হালকা লাগছিল, এখন আবার সেই দুর্ভাবনাটা আমাকে পেয়ে বসল। গতকালের মিল্টন, বেলায়েত সাহেব আর আজ ফরিদ ভাই; সবার কথায় কিন্তু ঐ একই সুর, একটাই বিপদসংকেত ক্রমশই যেন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে প্রতিধ্বনিত হল...শর্মিলাকে সামাল দেয়াটা যতটা না সহজ, বাদলের রোষানল থেকে নিজের গা বাঁচানোটা প্রকৃতপক্ষে ঠিক ততটাই কঠিন!
নাহ, আর দেরি করা যাবে না; শর্মিলার ব্যাপারে এবার সিরিয়াসলি একটা ‘সিদ্ধান্ত’ নেবার সময় এসেছে।



বিকেলের দিকে আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন হয়ে এল। কদিন ধরেই এমনটা হচ্ছে, খুব বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে না। বেশ একটা ঘনঘটার আমেজ নিয়ে আকাশে কিছুক্ষণ হুমকিধমকি চলে, কিন্তু শেষ মুহূর্তে আবার কি মনে করে মুখকালো মেঘগুলো দলছুট হয়ে পড়ে, পাড়ি দেয় অন্য কোন তল্লাটে। কেন জানি মনে হচ্ছে খুব শীঘ্রই একদিন ঠিকই বৃষ্টি নামবে, ভীষণ বৃষ্টি। ভাসিয়ে দিয়ে যাবে সবকিছু।
ছাদে উঠে সিগারেট ধরিয়ে ফরিদ ভাইয়ের কথাগুলো ভাবছিলাম। তিনি বেশ গুছিয়ে অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বলল বটে, তারপরও কাজে দিবে এমন কোন ক্লিয়ার সল্যুউশনও কিন্তু দিতে পারল না। এত বড় বড় কথা বলে, শেষে গিয়ে স্রেফ একটা হিন্ট দিয়েছে মাত্র, এমন কোন অ্যাপ্রোচ বা অ্যাকশনে যেতে হবে যাতে করে ‘সাপও মরে, অথচ লাঠিও না ভাঙে!’ যেটা বুঝলাম, যা করার আসলে আমাকেই করতে হবে, এদের কারো উপরই ভরসা করে থাকা যাবে না। একেকজন পণ্ডিত ক্রাইসিস সম্পর্কে ভালই ওয়াকিবহাল কিন্তু তার সল্যুউশনের ব্যাপারে ঠনঠন। আমিও তাই ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলাম ‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলব’! আর কি বোনকে দিয়েই ঠেকাতে হবে ভাইয়ের আগ্রাসন!
ব্যাপারটা আপাতদৃষ্টিতে একটু কঠিন মনে হলেও একেবারে অস্বম্ভবও কিছু না। মেয়েটা কিছুটা হলেও আমার প্রতি দুর্বল আর ওর এই দুর্বলতাকেই আমার সুন্দরমত কাজে লাগাতে হবে। এই কয়দিনে যতটুকু দেখেছি, তাতে করে শর্মিলাকে মেয়ে হিসেবে বেশ সহজসরল বা সত্যি বলতে স্টুপিডই বলা চলে। আর তার উপরে যেখানে আমার প্রতি একটু বেশিই অনুরক্ত, তাই মনে হয় না ওকে দিয়েই ওর মাস্তান ভাইটাকে ঠান্ডা রাখাটা খুব একটা অসাধ্য কিছু হবে।
কিন্তু এসবেরও আগে আরেকটা কাজ আছে, গুরুত্বপূর্ণ। আর তা হল, শর্মিলার কাছে ওর প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গিটা এবার মোটামুটি খোলাখুলি ভাবে তুলে ধরব। যাতে করে মেয়েটা আর ফারদার আমার সম্পর্কে কোন ভ্রান্ত ধারণা না রাখে, প্রত্যাশা না করে বসে এমন কিছু যা আমি কখনই ওকে দিতে পারব না। আর তার মধ্য দিয়ে ওর সাথে এই অর্থহীন সম্পর্কটারও খুব সুন্দর করে ইতি টানতে হবে, যাতে করে ও আবার খুব একটা কষ্টও না পেয়ে বসে...মনে কোন ক্ষোভ না পুষে রাখে। কেননা ওকে আমার দরকার বাদলকে সামলাবার জন্য। একটু ইমম্যাচিউরড মেয়ে, তাই রিঅ্যাকশনটা কি হয় তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না; তবে আমার বিশ্বাস ওকে সুন্দরমত গুছিয়ে বোঝাতে পারলে ও ঠিকই বুঝবে। কোনরকম ঝামেলা ছাড়াই হয়তো স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নেবে বিষয়টা।
শেষ হয়ে আসা সিগারেটটা দাবিয়ে শর্মিলাকে ফোন দিলাম।
 “হ্যালো, শর্মিলা?”
--“হ্যালো…আপনি! তা হঠাৎ কি মনে করে?”
--“না, মানে…আপনি তো আর কাল রাতে ফোন দিলেন না; তাই ভাবলাম, আমিই বরঞ্চ একটা কল দেই। ছুটির দিন, তার উপরে ওয়েদারটাও কেমন যেন, আপনার কথা মনে পড়ে গেল…” ধ্যাত! এই শেষ লাইনটা একটু বেশি বেশি হয়ে গেল!
--“বাহ! আপনার তো দেখি দারুণ উন্নতি! একটা মানুষের এত পরিবর্তন হয় কি করে?!” খুশি হয়ে গেছে মেয়েটা। শুরুতেই এত কিছু বলা ঠিক হয়নি। তাই ভাবলাম, আর দেরি না করে দ্রুত মূল প্রসঙ্গে চলে যাই, “হাহ হা! রসিকতা করছেন? ফোনটা দিলাম আসলে…আপনার সাথে জরুরি কিছু কথা ছিল।”
--“জরুরি কথা?”
--“জ্বী। দেখুন, আমার মনে হয় আমাদের মধ্যে কোন ভুল ধারণা থেকে থাকলে সেটাকে শুধরে নেয়া উচিত।”
--“ভুল ধারণা? কিসের ভুল ধারণা? ঠিক বুঝলাম না…”
--“ব্যাপারটা হচ্ছে…” গলাটা একটু ঝেরে নিয়ে বললাম, “আমার ধারণা আপনার দৃষ্টিভঙ্গিতে…আর কি আপনি আমাকে যেভাবে দেখছেন বা দেখতে চাচ্ছেন, কোথাও মনে হয় একটু ভুল হয়ে যাচ্ছে।”
--“আপনি ঠিক কি বলতে চাচ্ছেন একটু খুলে বলুন তো।” শর্মিলার কন্ঠ থেকে খুশির ছটা উধাও!
--“দেখুন শর্মিলা, আমি এখানে এসে সবে প্র্যাকটিসটা শুরু করেছি মাত্র। আমি এখনই না কোন ধরণের রিলেশনসিপের ব্যাপারে ইন্টেরেস্টেড না। আপনি চমৎকার একজন মেয়ে, সবই ঠিক আছে বাট জাস্ট নট মাই টাইপ। আমাদের চিন্তাভাবনা আর পছন্দ-অপছন্দের মাঝে ফারাকটা আসলে অনেক। এটা কিন্তু দোষের কিছু না। একটা মানুষের আরেকটা মানুষকে ভাল লাগতেই পারে, আবার সেই আরেকটা মানুষেরও ঐ মানুষটাকে ভাল নাও লাগতে পারে, ভেরি ন্যাচেরাল…”
--“আপনি নিজেকে কি মনে করেন, হ্যা? মনেটা করেন কি নিজেকে? আপনার সাহস তো কম না…!”
--“আশ্চর্য! আমি আবার নিজেকে কি মনে করব? আমার তো নিজেকে আর মনে করার কিছু নাই! মনে তো আপনি করে বসে আছেন, শর্মিলা! না হলে ওভাবে অনেকটা জেদ করে আমাকে দীঘির ঘাটেও নিয়ে যেতেন না আর ঐ ধরণের সব কথাও বলতেন না! কি...কিছু ভুল বললাম আমি?! এতটা ডেসপারেট বিহেভিয়ারের কি মানে দাড়ায়?”
কোন জবাব দিল না শর্মিলা। ওপাশ থেকে কোন সাড়াশব্দ নেই কিছুক্ষণ। কয়েক মুহূর্তের নীরবতাটা ভাঙল এবার ওর ফুঁপিয়ে ওঠা কণ্ঠস্বর, “ছি!...আপনি এত খারাপ! …এত ছোটলোক!”
 হায় খোদা! এ আমি কি করে বসলাম! মেয়েটা তো দেখি কান্নাকাটি শুরু করে দিচ্ছে! ওভাবে টেম্পার লস করাটা আসলে একদমই উচিৎ হয়নি। শিট! আমি তো মনে হয় কেস আরও জটিল করে ফেললাম!
“আমার না…আপনাকে….না, আপনাকে না, নিজের প্রতিই…প্রচন্ড ঘেন্না হচ্ছে!...” কান্নাভেজা কথাটা ও আর শেষ করল না, লাইনটা কেটে দিল হঠাৎ করে।
সাথে সাথে কল দিলাম আবার, কয়েকবার রিং হয়ে কেটে গেল। আরও দুতিনবার কল দিলাম, ঐ একই ফলাফল। শর্মিলা কেটে দিচ্ছে বারবার। এরপর আর পাওয়াই গেল না, সেলফোনই দিল সুইচড অফ করে।
ধ্যাত্তেরিকা! এটা কোন কাজ করলাম একটা?! এত চিন্তাভাবনা করে, এত আলোচনা করে শেষমেশ তো আরও হজপচ পাকিয়ে ফেললাম সবকিছু!
আচ্ছা, শর্মিলা যেহেতু এখন অনেকটাই ইমোশনাল হয়ে আছে, ওকে আর এখন বিরক্ত না করি। ঘণ্টাখানেক পর না হয় ফোনে আবার ট্রাই করব, এর মধ্যে কিছুটা ধাতস্ত্ব হয়ে নেবে আশা করি। পেয়ে গেলে সরিটরি বলে মেয়েটাকে আগে ঠান্ডা করতে হবে। আর মিনটাইম, কথাগুলো এবার একটু কষ্ট করে গুছিয়ে নিই। দরকার হলে নোট করে রাখি কিছু মেজর-মেজর পয়েন্ট। তখন তো অর্ধেক পেটে রেখে অর্ধেক মাথা গরম করে উগলে দিতেই সব ব্ল্যান্ডার করে বসলাম।
ঘণ্টাখানেক পর শর্মিলাকে আর কল দিতে হল না; তার আগেই ফরিদ ভাই ফোন করল, “হ্যালো রাজীব, তুমি কোথায়?” বেশ উত্তেজিত মনে হল তাকে।
--“আমি বাসাতেই আছি, ফরিদ ভাই।”
--“তুমি…খবর পেয়েছ শর্মিলার?”
--“খবর? না তো! ওর আবার কি খবর?” কেন জানি বুকটা ধক করে উঠল।
--“রাজীব…শর্মিলা বিষ খেয়েছে!”
--“হোয়াট?!।” মনে হল মাথায় একটা বাজ পড়ল যেন!
--“হ্যাঁ। একটু আগে বাদল ফোন করেছিল আমাকে, ওরা ওকে নিয়ে ক্লিনিকে আসছে…আমাকেও থাকতে বলেছে।”
--“কি বলছেন এসব!”
--“আমি এখন যাচ্ছি ক্লিনিকে। তুমি…ঘরেই থাক, কোথাও বের টের হয়ো না। তোমাকে পরে আপডেট দিব, ঠিক আছে?”
--“ঠিক আছে, ফরিদ ভাই…জানাবেন।” কেমন জানি খুব অসহায় লাগল নিজেকে। এটা কি হল!
ফরিদ ভাই ফোন ছাড়লেন না, “আচ্ছা, রাজীব…তোমার সাথে কি ওর কথা হয়েছিল রিসেন্টলি?”
--“হ্যা…না…মানে…ঘণ্টাখানেক আগে…কথা হয়েছে।”
--“তুমি ওকে কি বলেছ, রাজীব? সত্যি করে বলো তো?”
--“আরে...আমি তো ওকে তেমন কিছুই বলি নাই। জাস্ট ওকে একটু আমার দিকটা বোঝাতে গিয়েছিলাম আর কি...কিন্তু এই মেয়ে যে বিষ খেয়ে বসবে তা কে জানত!”
--“ড্যাম! ...এইটা তুমি কি করলে, রাজীব?! বাদল যদি ওর ফোন চেক করে এখন তোমার নামটাই আগে দেখে তাহলে তো খবর আছে তোমার!!”
আসলেই তো! ফরিদ ভাই তো ভুল কিছু বলে নাই! বাদলের তো দুয়ে দুয়ে চার মেলাতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না!
 চারপাশটা হঠাৎ করেই কেমন যেন মনে হল অস্বাভাবিক শান্ত হয়ে এল, আমি যেন স্পষ্টই নিজের হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকুনিটা এখন শুনতে পাচ্ছি! ওটা যেন আর হার্টবিট না…একটা টাইম বোমার ঘড়ির কাটায় পরিণত হয়েছে! বাদলের জন্য প্রতিটা মুহূর্ত গুণতে শুরু করে দিয়েছে! অপেক্ষা করছে ওর আসবার…আমার মৃত্যুদূতের!!
শর্মিলাকে ওভাবে ফোন করার ভুল ও পরিস্থিতির অনিশ্চয়তা নিয়ে আরও কিছুক্ষণ আফসোস আর হতাশা ব্যক্ত করলেন ফরিদ ভাই, তারপর ফোন ছাড়লেন। তবে ফোন রাখার আগে আবারো বললেন যে, বাসা থেকে যেন বের না হই আর উনি আমাকে ঘণ্টা খানেকের মধ্যে আপডেট দিচ্ছেন। এদিকে আমারও হা-হু ছাড়া তেমন কোন কথা বেরাল না মুখ থেকে; হাত-পা কেমন ঘামতে শুরু করেছে, অজানা আতঙ্কে শুকিয়ে আসা গলায় ঢোক গিলে গিলে নিঃশ্বাস ফেলে যাচ্ছি। শরীরটা ভাল লাগছে না একদম, শুয়ে পড়লাম বিছানায় সটান হয়ে।
এক-দেড় ঘণ্টার মধ্যেই ফরিদ ভাইয়ের ফোন চলে এল। জানালেন, শর্মিলাকে বাঁচানো গিয়েছে, মেয়েটা এখন বিপদমুক্ত! আর আমারও বুকের উপর থেকে একটা জগদ্দল পাথর যেন সরে গেল! যাক বাবা, এ যাত্রায় বাঁচা গেল!
কিন্তু আমার এই স্বস্তির হাঁসফাঁসও বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না ফরিদ ভাইয়ের পরের কথাগুলো শুনে; বাদলের চেহারা নাকি এখনও থমথমে, ওর ছেলেপেলেদের মাঝেও একধরণের উত্তেজনা বিরাজ করছে, তবে কেউই কিছু বলছে না। ক্লিনিকের সামনে মিল্টনকে নাকি একটু আগে ঘিরে ধরেছিল, কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে ছেড়ে দিয়েছে, তবে ক্লিনিকে আর ঢুকতে দেয়নি। ফরিদ ভাই বললেন, “এই মুহূর্তে পরিস্থিতি বেশ ঘোলাটে হয়ে আছে। বাদলের মতিগতি ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। তুমি বরং খালাম্মাকে নিয়ে কিছুদিনের জন্য ঢাকায় চলে যাও, রাজীব। এদিককার পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হয়ে এলে, আমি অবস্থা বুঝে তোমাকে কল দিব, তারপর না হয় ব্যাক করো, ঠিক আছে?”
--“ঠিক আছে, ফরিদ ভাই।”
কথাটা বলে ফোন রেখে দিলেও অনেকক্ষণ গোটা বিষয়টা নিয়ে ভাবলাম। তাতে মনে হল, ‘আচ্ছা, এখন ঢাকায় কেটে পড়াটা কি আদৌ ঠিক হবে? তাতে করে কি নিজেকেই আমি আরও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলব না? কাপুরুষের মত আমি কেন গা ঢাকা দিতে যাব? আমি তো অন্যায় কিছু করি নাই! স্রেফ নিজের পাশাপাশি শর্মিলারও ভালর জন্যই একটু খোলাখুলি কথা বলতে গিয়েছিলাম মেয়েটার সাথে...হ্যা, হয়তো এক পর্যায়ে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু সেভাবে তো ঐই প্রথমে রিঅ্যাক্ট করে...আর আমি তো ভুল বা মিথ্যে কিছুও বলি নাই! তাছাড়া এখন আম্মা আর খালা-খালুকেও বা কি বলব? বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ ক্লিনিক ফেলে ঢাকায় কেন?’
তাই সিদ্ধান্ত নিলাম এখনি কোথাও মুভ করব না। আজকের রাতটা অন্তত দেখি, কাল সকালে উঠে ফরিদ ভাইয়ের সাথে আরেকবার কথা বলে একটা ফাইনাল সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে।
কিছুক্ষণ পর মিল্টন ফোন দিল। বেশ ঘাবড়ে গেছে বেচারা, আমাকে খুব করে বলল রাত নটার দিকে ঢাকার বাসটা ধরতে। বাদলের তিন-চারজন ছেলেপেলে নাকি ওকে ডেকে নিয়ে আমার সম্পর্কে নানাবিধ প্রশ্ন করেছে। কোথায় থাকি, কোথায় কোথায় যাই, কাদের সাথে ওঠাবসা, আজ ক্লিনিকে এসেছিলাম কিনা ইত্যাদি। তবে মিল্টনের নাকি ওদের কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছে ওরা আসলে এসব সবই জানে মোটামুটি, ওকে শুধু একটু ধমক-টমক দিয়ে বাড়তি কিছু জানা যায় কিনা সেটাই যাচাই করে দেখেছে। ছেলেটা মুখ ফুটে না বললেও আমার বুঝে নিতে অসুবিধা হল না যে, ওরা সম্ভবত ওর গায়ে হাতও তুলতে দ্বিধা করেনি! খারাপ লাগল ছেলেটার জন্য, ও তো কোন অন্যায় করেনি, ওর উপর খামোখাই চড়াও হল গুন্ডাগুলো। আমি আর ওর সাথে বেশি কথা বললাম না। ফোনটা রেখে দিতেই উপলব্ধি করলাম একটা অন্য ধরণের অনুভূতি...ভয়, রাগ আর অসহায়ত্বের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ! ঠিক করলাম, বাদলের চ্যালাচুমাণ্ডরা বেশি বাড়াবাড়ি করলে এবার ওর সাথেই সরাসরি গিয়ে কথা বলব। ওকে সব বুঝিয়ে বলতে হবে, এটলিস্ট ট্রাই করব। কেননা ওর সাথে কথা বলে যতটুকু বুঝেছি, ও আর যাই হোক অন্তত শর্মিলার মত না; বরং অনেকটাই বিপরীত। ঘটে অনেক বুদ্ধি রাখে ছেলেটা বলদ বোনটার থেকে। না হলে এতদূর আসতে পারত না। কিন্তু কথা হল, ঐইবা এখন কতটুকু বুঝতে চাইবে, যেখানে শর্মিলা ইতিমধ্যে বিষ খাওয়ার মত একটা সর্বনাশ করে বসে আছে?! তাছাড়া এসব করে আদৌ কোন লাভ হবে কি? নিজের বিপদকেই না কেবল আরও কাছে ডাকা হবে?! নাহ! কাল সকালেই না হয় ফরিদ ভাইয়ের সাথে কথা বলে একটা কিছু বের করা যাবে। তার আগে আজকের রাতটা ভালয়-ভালয় পার করি।
(চলবে...)

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form