।। ১১।।
প্রথম অধ্যায়ের পর...
বাদলের মুখের ক্রুর হাসির রেখাটা আরও বিস্তৃত হল। নিঃশব্দেই খিলখিল করে হাসছে যেন শয়তানটা। ওর কুৎসিত অভিব্যক্তিই বলে দিচ্ছে যে, ওর মাথায় কোন ভয়ংকর খারাপ আইডিয়া খেলা করছে। আর আমার ধারণা মিথ্যা হল না।
ধীরে ধীরে মাথা তুলে এবার সোজা হয়ে দাঁড়াল বাদল। ওর অনুগত সাঙ্গপাঙ্গদের দিকে তাকাল একবার। তারপর সেই পরিচিত ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, “ঐ, মাটি খোড়...শালার পুতরে জ্যান্ত কবর দে!”
শুধুই আমিই না, উপস্থিত অনেকেরই চেহারা দেখে মনে হল কথাটা ঠিক বোধগম্য হল না যেন প্রথমে। দুএকজনকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে দেখেই বাদল এবার গর্জে উঠল, “কি? কথা কানে যায় না বাল? এই নবাবের বাচ্চাটার জন্য কবর খোঁড় একটা...এইখানেই! তারপর ওরে মাটি চাপা দে। জ্যান্ত!”
হোয়াট?! ল্যাংড়াটা কি বলল এটা? আমাকে জ্যান্ত কবর দিবে!? এ তো আরও ভয়ংকর মৃত্যু! মাটি চাপা দিয়ে শ্বাসরোধ করে তিলে তিলে কষ্ট পাইয়ে মারবে! তাহলে আর এত কান্নাকাটি করে, কাকুতিমিনতি করে লাভটা হল কি? বাদলের বাচ্চা তো আর জ্যান্ত কবর দিয়ে উপরে নিশ্চই সাইনবোর্ড টাঙিয়ে রাখবে না, “এখানে শায়িত আছে ডেন্টিস্ট রাজিবুল পাটোয়ারী, দাফনকালে তিনি জীবিত ছিলেন।”
আসলেই তো...এভাবে মাটিতে পুঁতে মেরে ফেললে তো কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পাবে না! সেই অস্বাভাবিক গায়েবী মৃত্যুর পুরানো অভিশাপ...সেই নিদারুণ কষ্ট আবারো ভেতরে ভেতরে ছাড়খার করে দেবে আম্মা আর ছোট চাচাকে। আর এবার আমার বেলায় এসে তারা এই শোক সামলে উঠতে পারবে তো? তারা তো কোনদিন জানবেও না, নির্মম ভাবে হলেও একদিক দিয়ে আমার ভাগ্যে যে অন্তত ‘কবর’ জুটেছে!
গা শিউরে ওঠা আতঙ্কের মধ্যেই খেয়াল করলাম বাদলের ছেলেপেলেদের মাঝে এক ধরণের ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে। বসের অর্ডার, কবর তো খুঁড়তে হবে। এক চাপাতিওয়ালাকে দেখলাম তার চাপাতি দিয়েই মাটি খোড়ার পায়তারা করছে। বাইক মুরাদকে কিছু সময়য়ের জন্য মনে হল সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে, বারবার নিজের হাতের রডটার দিকে তাকাচ্ছে, হঠাৎ ওটা দিয়েই আস্তে আস্তে খোড়াখুড়ি শুরু করে দিল। বড় একটা ছোরা হাতে সেই চুলে ঝুঁটি বাঁধা ছেলেটা ইতস্তত ভঙ্গিতে সাহস করে বলে উঠল, “বস, কবর খুঁড়ব কি দিয়া?”
--“তোর মাথা দিয়া খোঁড়, হারামজাদা! ছাগলের বাচ্চা কোথাকার!” এই ঝাড়িটা মনে হয় বাদল না দিলেও পারত, ছেলেটাকে দেখে মনে হল বাদলের অগ্নি দৃষ্টিতেই ভেতরে ভেতরে যেন ভস্ম হয়ে গেল।
“এই বিল্লাল, তুই মুরাদরে নিয়া যা। দ্যাখ, কাছেধারে কারও কাছ থেকে বেলচা, কোদাল, কিছু একটা জোগার করা যায় কিনা।”
বিল্লাল আর মুরাদ এক মুহূর্ত দেরি না করে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। যাক, বেলচা-কোদাল খোঁজার তাগিদে সামান্য হলেও অল্প কিছুটা বাড়তি সময় তো এদিকে পাওয়া গেল।
এত নিষ্ঠুরতার মাঝেও শেষবারের মত ইচ্ছে করল মধ্যরাতের পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য্যটুকু দুচোখ ভরে দেখে নিতে, পৃথিবীর সবটুকু বাতাস বুকের ভেতর টেনে নিতে। নির্মম মৃত্যু তো এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু ইচ্ছাটাকে চেপে রেখে বাদলকে লক্ষ্য করে বলে উঠলাম, “ভাই...এটা কেমন বিচার করলেন? সেই একই তো কথা...কেউ তো খুঁজেও পাবে না...” বাদল আর আমার কথা শেষ করতে দিল না। এগিয়ে এসে আমার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা হ্যাংলা রতনের কাঁধে একটা হাত রেখে ভরটা সামলে নিল আগে, তারপর অন্য হাতের ছড়িটা দিয়ে বেধড়ক পেটাতে শুরু করল। সারা শরীরের ঝিমিয়ে পড়া ব্যাথাগুলো যেন আরও নতুন সঙ্গী পেয়ে মাথাচারা দিয়ে উঠল, খেপল আবার; আর্তনাদ হয়ে মুখ দিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে পালাবার ব্যর্থ চেষ্টা করল। আর বাদলও যেন সারাদিনের দমিয়ে রাখা ক্ষোভটাকে এবার মুক্তি দিল কিছুটা, “তুই বিচার চাইস, শুয়োরের বাচ্চা?! বিচার চাইস! আমার বোন তোর কারণে বিষ খাইল আর তুই বিচার চাইস!? এই নে তোর বিচার! এই নে...” শরীরটা গুঁটিয়ে নিয়ে শেষ রক্ষা করতে চাইলেও কিছু কিছু ক্ষতস্থানে ঠিকই ছড়ির গোঁড়াটা দিয়ে খোচাতে ভুলল না খোঁড়া সন্ত্রাসী। একটা সময় ক্লান্ত হয়ে নিজেই থেমে গেল।
এদিকেআমার মনে হল আমি বুঝি কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান হারাতে যাচ্ছি; গুঙিয়ে উঠে অনেকখানি বমি করে দিলাম, ব্যাথায় অশ্রুসিক্ত চোখের দৃষ্টিও ঝাপসা হয়ে এল। নিজেকেই নিজে অবাক করে দিয়ে এরপরও জ্ঞানটা হারালাম না কোন কারণে। মুখ থুবড়ে আবার মাটিতে পড়ে থাকলাম রক্তাক্ত, বিধ্বস্ত অবস্থায়।
অসহ্য যন্ত্রণায় চোখ বুজে গেলেও কান দুটো মোটামুটি তখনও সজাগ। আশেপাশের অনেকেরই টুকরো টুকরো কথা ভেসে আসছিল। কেউ কেউ বেশ তারিফ করল মনে হল বাদলের এই নয়া হত্যার প্রক্রিয়াকে, একটা নতুন কিছু করতে যাচ্ছে দেখে খানিকটা যেন উত্তেজিতও।
“ভাই, যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা বলতাম।” আমার সব থেকে কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল রতন, তাই ওর গলাটা চিনে নিতে অসুবিধা হল না।
এবার একটা ম্যাচের কাঠি জ্বালাবার আওয়াজ পেলাম, বাদলই সম্ভবত আরেকটা সিগারেট ধরাল।
--“কী?” হ্যা, এটা বাদলের কণ্ঠস্বর।
--“ভাই, বলছিলাম কি...এই জায়গাটার কিন্তু দোষ আছে। জায়গাটা ভাল না।”
--“মানে?”
--“ভাই, এইটা তো ফকিরবাবার পাড়! এই জায়গাতে কোন কিছু করতে মানা আছে, যারাই করতে গেছে ধরা খাইছে!”
--“কি বলদের মত কথা কস? এই জায়গায় তো আমরা কতজনরেই ফালাইলাম...” বাদল না, পাশ থেকে এবার অন্য কেউ বলে উঠল।
--“আহা! ঐগুলা তো সব নদীতে ফালায় দিসি! এই পাড়ের মধ্যে তো কিছু করি নাই। তাই ভাই বলছিলাম...”
--“ঐ! তুই আমার চোখের সামনে থেকে দূর হ। এই সমস্ত বালের আলাপ শোনার আমার মুড নাই।”
ল্যাংড়া বাদলের ধমক খেয়ে রতনও আর কথা বাড়াল না, দ্রুত সরে গেল মনে হল।
কিছুক্ষণ পর ঘাড়ের কাছে আবারো ছড়ির গুঁতো খেলাম, তবে খানিকটা আলতো করে। আস্তে করে চোখ মেলে তাকাতেই দেখি বাদল আবার আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে; মাথাটা ঝুঁকে একটু নিচে নামিয়ে বলল, “চিন্তা করিস না, তোর মায়ের কাছে না হয় একটা বেনামী চিঠি পাঠায় দেব, ‘আপনার সন্তান এখন কবরবাসী’।”
বিশ্রীভাবে এবার স্বশব্দেই খিলখিল করে হেসে উঠল বাদল। হাসির দমকের চোটেশুনতে পেল কিনা জানি না, আমি শুধু বিড়বিড় করে বললাম, “তাই দিয়েন, ভাই...তাই দিয়েন।”
আমার এখনও মনে আছে কায়েসকে হারাবার সময় ছোট চাচা কিরকমটাই না কষ্ট পেয়েছিলেন! খবর পেয়ে সাথে সাথে ছুটে গিয়েছিলেন দূর্ঘটনাস্থলে, যেখানে বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ব্রিজ ভেঙে পড়ে গিয়েছিল নদীতে। পাগলের মত দিনরাত এক করে নদীর এপারওপার কত লোকজন লাগিয়ে খুঁজেছিলেন তার একমাত্র ছেলেটিকে, কোথাও যদি লাশটা একটু ভেসে ওঠে। দুহাতে টাকা খরচ করে কত জানাশোনা লোকটোক ধরে বলে-কয়ে বারবার ডুবুরিদেরকে পাঠাচ্ছিলেন সেই খরস্রোতা নদীর বুকে, যদি পাওয়া যায় ফুলে ফেঁপে ওঠা সন্তানের লাশ। ডুবুরিরা হাল ছেড়ে দেবার পর তার সেকি আহাজারি! বারবার বুক চাপড়িয়ে নিজেকেইদোষারাপ করছিলেন...‘কেন আমি ছেলেটাকে যেতে দিলাম?’। ছোট বাচ্চাদের মত পা ছড়িয়ে,নদীর পাড়ে বসে কাঁদছিল লোকটা... উফফ! আমি ঐ দৃশ্যটার কথা বুঝি কখনোই ভুলতে পারব না! পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম কষ্টদায়ক এক দৃশ্য।
চাচীও ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলেন। স্বাভাবিক, মা তো। অকালে সন্তান হারালে মা-বাবার কষ্টের থেকে বেশি পৃথিবীতে আর কি আছে? আর আম্মা যেন স্রেফ পাথর বনে গিয়েছিল। অনেক কষ্টে ভুলে থাকা স্বামীকে হারাবার সেই দুঃসহ দিনগুলোর স্মৃতি আবার যেন ফিরে এসে তীরের মত বিঁধছিল তার ক্ষতবিক্ষত বুক জুড়ে। যেদিন কায়েসের গায়েবী জানাজা হল, সেদিন রাতে আম্মার ঘরে গিয়েছিলাম তার ঔষধপত্রের খোঁজ নিতে; কোনটা ফুরালো নাকি সেটা দেখতে। আমাকে কাছে পেয়েই ভীষণভাবে ভেঙে পড়ে আম্মা; অনেক দিনের দাবিয়ে রাখা কান্নারা যেন বাঁধভাঙ্গা ঢল হয়ে নেমে আসে তার, “আমরা কবে এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাব রে? সবাই একে একে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে? আমি আর পারিনা, রাজীব...আর পারি না রে বাবা...মেনে নিতে! আল্লাহ্ আমাকে না নিয়া কায়েসকে নিল কেন আগে?” আম্মা আমার কাঁধে মাথা রেখে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ঘুরে ফিরে বারবার এই প্রশ্নগুলোই করে যাচ্ছিল সেদিন। যার কোন জবাব ছিল না আমাদের কাছে, যার কোন জবাব হয়তো কোনদিনই পাওয়া যাবে না কারো কাছে।
স্মৃতির দৃশ্যপট থেকে বাস্তবে ফিরে এলাম মুরাদের বাইকের আওয়াজ পেয়ে। বিল্লালকে সাথে নিয়ে বিজয়বেশে প্রত্যাবর্তন। বেলচা-কোদাল কিছুই বাকি রাখে নাই আনতে। বাদলকে আর কিচ্ছু বলতে হল না, ছেলেপেলে বেশ স্বতুস্ফুর্ত ভাবেই কাজে নেমে পড়ল। যেখানে পড়েছিলাম, তার থেকে কিছুটা দূরেই কবর-খনন পর্ব আরম্ভ হল। নিজের চোখের সামনে নিজেরই কবর খোঁড়া দেখতে লাগলাম! কজন মানুষের আর এমন দুর্ভাগ্য হয়?!
আয়তুল কুরসি থেকে দুরুদ শরীফ, যত দোয়া আর সুরা আমার জানা ছিল সব একটার পর একটা বিড়বিড় করে পড়তে লাগলাম। এখনও সময় আছে, যদি কোন মিরাকেল ঘটে! উপরওয়ালার কাছে তো কোন কিছুই অস্বম্ভব না।
বাদলের কাছে ঝাড়ি খেয়েই হয়তোবা, রতন আর খনন কার্যে অংশ নেয়ার সাহস করল না। তাই যেহেতু হাতে কোন কাজ নেই, হারামজাদাটা আমার পাশে এসে এবার হাঁটু গেড়ে বসল; মুখ থেকে একদলা থুথু আমার মাথার কাছেই ফেলে বলল, “হা, ভাইজান...দোয়া পড়েন। শুনছি মরার আগে নাকি বেশি বেশি দোয়া পড়লে পাপ কাঁটা যায়। পড়েন, বেশি কইররা দোয়া পড়েন।” কথাটা বলেই ময়লা কতগুলো দাঁত বের করে বিশ্রী একটা হাসি উপহার দিয়ে উঠে চলে গেল, যেন এই কথাগুলোই বলতে এসেছিল। খুব ইচ্ছে করছিল অশ্রাব্য একটা গালি দিতে ছ্যাঁচোড়টাকে, কিন্তু দোয়াদুরুদ পড়ছিলাম বলে মুখটা আর খারাপ করলাম না।
খোঁড়াখুঁড়ি পুরাদ্দোমেই চলছিল, হঠাৎ বাদলের মুখ থেকে নতুন হুকুম শোনা গেল, “আশফাক! মাইক্রোর ভেতর থেকে কাফনের কাপড়টা বের কর।”
‘কাফনের কাপড়! মাইক্রোতে আবার কাফনের কাপড় আসলো কোথা থেকে?! কবর দেয়ার চিন্তা তো বাদলের আগে ছিল না!...’ মনের ভেতর প্রশ্নটা আসতেই তার জবাবটাও পেয়ে গেলাম একটু পরেই। কাছেই রতনের সাথে সেই মাথায় ক্যাপ পড়া গাঁট্টাগোট্টা ছেলেটা দাঁড়িয়েছিল। ওদের কথাবার্তাতে যেটা বুঝলাম তা হল, কাপড়টা নাকি কেনা হয়েছিল কোন এক উকিলকে হুমকি দেয়ার জন্য। কিন্তু এই বিশেষ ইঙ্গিতবহুল কাপড় যেহেতু পরেও ঐ উকিলকে পাঠানো যাবে, তাই ওটার সদ্ব্যবহার এখনি করা হচ্ছে।
কাফনের কাপড় চলে আসতেই বাদল এবার পরপর দুটো নির্দেশ দিল; প্রথমটা হল পিছমোড়া করে আমার হাত দুটো বেঁধে ফেলা আর দ্বিতীয়টা হল, আমার সারাটা শরীর কাফনের কাপড়ে মুড়িয়ে দেয়া। তবে মাথার উপরটা ফাঁকা রাখতে বলল কিছুটা বাতাস চলাচলের জন্য, যাতে করে পুরোপুরি কবরে যাবার আগ পর্যন্ত যেন অন্তত কাফনের মধ্যে টিকে থাকি। এতে করে একটা ব্যাপার সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল, আমার মৃত্যুটা বাদল কবরের মধ্যেই নিশ্চিত করতে চাচ্ছে; যতটা সম্ভব কষ্ট পেয়েই যেন পাঁচ-ছয় ফিট মাটির নিচে চাপা পড়ে তিলে তিলে আমার মৃত্যু ঘটে!
।। ১২।।
মনের গভীরে কোথাও খুব ক্ষীণ হলেও সম্ভবত একটা শেষ আশা লুকিয়েছি যে, কোন না কোনভাবে আমি হয়তো ঠিকই এই ভয়ংকর পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পাব একটা সময়; না হলে এতটা ভয় আমি এতক্ষণ পাইনি কেন? তাহলে একেই বুঝি বলে সত্যিকারের মৃত্যুভয়! কেননা গা হিম করা নিশ্চিত মৃত্যু যে খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছে, তা এবার আমি হাড়ে হাড়ে টের পেলাম যখন ওরা আমার হাতদুটোকে সত্যিই পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলল। লম্বা এক টুকরো কাপড়ের শক্ত বাঁধনটা আমার কব্জি দুটোকে যেন অসাড় করে দিতে চাইল। চোখের সামনেই এখন খোড়া কবরটা যেন ক্ষুধার্ত কুকুরের মত চেয়ে আছে! ভেতর থেকে ক্ষণে ক্ষণে মাটির দলা নিয়ে বেরিয়ে আসা বেলচাটাকে দেখে মনে হচ্ছে কোন কুৎসিত সাপের ফণা! রক্তের শিরায় শিরায় যেন ছোবল মেরে যাচ্ছে ভয়ের চাবুক হয়ে। আর আতঙ্কিত শিকারের মত দ্রুততর হচ্ছে নিঃশ্বাসের গতিবেগ।
ওরা যখন আমার আপাদমস্তক কাফনের কাপড় দিয়ে মোড়াতে শুরু করল, তখন আর আমি সত্যি থাকতে পারলাম না...পুরোপুরি ভেঙে পড়লাম। আমার পুরুষত্বের সমস্ত শৌর্য্যবীর্য, অহংকার, আত্মবিশ্বাস...সব যেন চোখের জলের সাথে অঝোরে ঝড়তে লাগল। নিজের বুকের খাঁচায় কাঁপন ধরিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বাদলের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে লাগলাম, “বাদল ভাই! আমাকে মাফ করে দেন, বাদল ভাই! আমাকে মাফ করে দেন! আপনার পায়ে পড়ি ভাইরে! এভাবে প্রাণটা নিয়েন না!...”
একটা সময় কবর খোঁড়া শেষ হলে সবার মধ্যে কেমন যেন এক ধরণের স্থিরতা নেমে এল। কেউ আর কোন হাসিঠাট্টা করছে না, অপ্রয়োজনীয় কথাও বলছে না। হঠাৎ করেই বেশ ঠান্ডা একটা ঝড়ো বাতাস বইতে শুরু করল। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দের মাঝে ক্ষণিকের জন্যে হলেও আমি যেন কোন কান্নার সুর খোঁজার চেষ্টা করলাম; কবরে চলে যাচ্ছি অথচ পরিবারপরিজন কেউ দুফোটা চোখের জলও ফেলার সু্যোগ পেল না! যখন দুতিনজন এগিয়ে এসে আমাকে তুলবার জন্য ধরল, তখনও শেষবারের মত চিৎকার করে প্রানভিক্ষা চাইতে লাগলাম। কে যেন খুব জোরে এবার একটা চড় মেরে বসল, “চুপ কর শালার পুত! এত চ্যাচ্যামেচি কিসের?!” চাপা স্বরে বললেও গলাটা যে মুরাদের তা চিনতে কষ্ট হল না। কয়েকজন মিলে এরপর আমাকে তুলে ধরে সদ্য খোঁড়া কবরটার কাছে নিয়ে গেল, ঝটপট দুতিনজন লাফিয়েও নামল ওটার মধ্যে।
এদিকে ফোঁপাতে ফোঁপাতে আমার চোখের পানি নাকের পানি এক হয়ে এলেও, বেশ যত্নের সাথেই আমাকে কবরে শোয়ানো হল। মনে হচ্ছিল এরা যেন এদেরই চেনা কাউকে যথেষ্ঠ দায়িত্বের সাথে দাফন করতে এসেছে। তফাতটা শুধু এটাই, কবরে আসলে এরা কারো লাশ শোয়াল না। কাফন দিয়ে মুড়িয়ে, ফেলে রেখে উঠে গেল একজন জলজ্যান্ত মানুষকে! যে জালে আটকে পড়া মাছের মত ছটফট করতে লাগল মৃত্যুনীল আতঙ্কে।
“তাড়াতাড়ি কর!” বাদলের কণ্ঠে অস্থিরতা ধরা দিল।
নরম, ঝরঝরা গুড়ো মাটির ঢল নামতে শুরু করল আমার শরীরে। মাঝে মধ্যে দুএকটা ছোটবড় মাটির চাকাও এসে পড়াতে ব্যাথায় গুঙিয়ে উঠছিলাম। বুকে, পেটে, পায়ে, মুখে সর্বত্রই কমবেশি মাটির আস্তরণ জমতে লাগল। ভুলে থাকা চিরায়ত মাটির গন্ধে চারপাশটা ভরে উঠল। এদিকে আম্মা, আব্বা, ছোট চাচা, ঢাকায় ফেলে আসা প্রিয় বন্ধুবান্ধব...সবাইকে শেষবারের মতন একটু দেখতে ইচ্ছে হল, সবার টুকরো টুকরো কিছু স্মৃতির মুহূর্ত ভেসে উঠতে চাইল মনের পর্দায়। কিন্তু সেটাও বাঁধাগ্রস্ত হল শরীরের উপর মাটির আস্তরণের স্তরটা বাড়তে থাকায়। একটা সময় উপরের বাদল বাহিনীর অস্তিত্বও হারিয়ে ফেললাম।
ছিন্ন হয়ে গেল বাইরের পৃথিবীর সাথে সকল সম্পর্ক। আর গ্রাস করতে সময় নিল না...কবরের অন্ধকার!
এদিকে বুকের উপর ক্রমশ মাটির চাপটা বৃদ্ধি পেতে থাকায় ফুসফুসে বাতাসের লুকোচুরি শুরু হয়ে গেল। অক্সিজেনের অভাবটা প্রকট হতে লাগল ধীরে ধীরে। যে কোন মুহূর্তেই শেষ প্রাণবায়ুটুকু বেরিয়ে যাওয়াটা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র!
।। ১৩।।
কতক্ষণ হল তা ঠিক বলতে পারব না। তবে তখন যদি আমি শেষ মুহূর্তে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারতাম তাহলে এতক্ষণও আসলে আর টিকে থাকার কথা না! এই ধরণের পরিস্থিতিতে সব থেকে বড় শত্রু হচ্ছে ‘আতঙ্ক’; যা যত দ্রুত কাবু করবে, ততই অস্থিরতায় ত্বরান্বিত হবে শ্বাসপ্রশ্বাস, ফলে সীমিত অক্সিজেনটুকুও ফুরিয়ে যায় তাড়াতাড়ি আর জলদি ঘনিয়ে আসে মৃত্যু! কবরস্থ হবার সাথে সাথে আমারও দশা ঠিক তেমনটাই তো হতে যাচ্ছিল; কিন্তু শরীরের নিজস্ব ডিফেন্স ম্যাকানিজমের কারণেই কিনা জানি না, নিজেকে সামলে নিতে শুরু করি মনের গহীন কোল থেকে এই জরুরি সংকেতটা পেতেই। মেপে মেপে শ্বাস ফেলে দ্রুত দমের লাগামটা ধরে ফেলতে তাই আর এক মুহূর্ত দেরি করিনি।
ভাবলাম, মরবই যখন, তখন আর এত সহজে কেন জিততে দিব এই নির্মমতম মৃত্যুকে? বাদলের সাথে তো আর কিছুই করতে পারলাম না, অন্তত এই শেষ লড়াইটা হোক মনে রাখার মত। তবে এতকিছুর পরেও, বাদলকে কিন্তু একটা ব্যাপারে আসলে ধন্যবাদ না দিলেই নয়; ও যদি তখন অতি চালাকি করে কাফনের কাপড়টা এভাবে সাথে না দিত, তাহলে তো এতক্ষণে নাকে-মুখে ধুলোবালি আর মাটির গুঁড়ো ঢুকে যাচ্ছেতাই একটা অবস্থা হত! অন্তিম দফারফাটা আর ঠেকানই যেত না। কিন্তু যতই বড় মুখে লড়াই-ফড়াইয়ের কথা বলি না কেন, এখনও যে এই পরিস্থিতিতে বেঁচে আছি কি করে সেটাই আশ্চর্য্যের! বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ কম আর তাই শ্বাস নিতে একটু বেগ পেতে হচ্ছে বৈকি। তবে যা আছে তা দিয়ে মনে হচ্ছে আরও বেশ কিছুটা সময় টিকে থাকা যাবে।
ভাগ্য ভাল, পাশ দিয়ে নদী বয়ে গেলেও পাড়ের এই দিকের মাটিটা অপেক্ষাকৃত বেশ শুষ্ক ও নরম। যার কারণে ভারটাও অতটা জোরাল না। ভেজা ভেজা থাকলে ঘনত্ব বেশি হয়ে তা অনেক ভারী হয়ে যেত এবং তখন আর এতক্ষণ এত বুলি আউরাবার সুযোগই পেতাম না।
তারপরও বেশ কিছুক্ষণ ধরেই সামান্য নড়াচড়া করার চেষ্টা করছি, কিন্তু কোন সুবিধা করতে পারছি না। মাটির জেঁকে বসা চাপের কারণেই সম্ভবত গোটা শরীরটাই কেমন অসাড় হয়ে আছে। মুখটা একটু বাম দিকে কাঁত করা, ওপাশে ফেরানো যাচ্ছে না আর পিছনে বেঁধে রাখা হাত দুটোর কথা আর নাই বা বলি।
ইস! কেউই কি জানে না আমি এখন কোথায় আছি? আচ্ছা, ঘর থেকে বেরাবার সময় কেউই কি টের পায়নি? আশেপাশের কোন বাসা কিংবা গলির কোন প্রান্ত থেকে কি কেউই আমাকে দেখতে পায়নি যখন ওরা আমাকে জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল? দেখলেও বা কি? সারা দেশ তন্নতন্ন করে খুঁজলেও তো কেউ আর এখন আমার কোন চিহ্নই খুঁজে পাবে না। কেউ কি দুঃস্বপ্নেও ধারণা করতে পারবে আমার এই পরিণতি? আচ্ছা...আমি এরকম গাধার মত একটা কাজ করলাম কিভাবে?! মুরাদের ফোন পাবার পরপরই তো আমার উচিৎ ছিল ফরিদ ভাইকে একটা কল দেয়া! কল না দেই, বাসা থেকে বেরাবার আগে একটা ম্যাসেজ তো তাকে অন্তত দিতে পারতাম...হায় রে বলদ! নিজেকেই নিজে দুষলাম কিছুক্ষণ। খবরটা পেলে তো ফরিদ ভাই নিশ্চই বাদলকে ফোন দিয়ে একটা মিটমাট করার উদ্দ্যোগ নিতে পারতেন। মিটমাট না হলেও ঐ ‘ম্যাসেজ’টাই তো অনেক কাজে দিত বাদলকে আইনের আওতায় আনতে...তাছাড়া বাসা থেকে আমাকে ডেকে নেয়ার ব্যাপারটা যে ফরিদ ভাই জানে, এটা জানলে বাদলও হয়তো সাহস পেত না এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠতে। এখন আর অবশ্য এসব চিন্তা করে কি লাভ?
কথাটা ভাবতে না ভাবতেই চিন্তার রেশটাও হঠাৎ কেটে গেল একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটাতে।
খুব সুন্দর আর মিষ্টি একটা ঘ্রাণ এসে নাকে লাগল। কি ব্যাপার?! এত সুন্দর ঘ্রাণটা আসছে কোথা থেকে? ভাল করে শুঁকে মনে হল খুব সম্ভবত কোন ফুলের হবে; বেলি, জুঁই বা ঐ জাতীয় একটা কিছু। আসলে সত্যি বলতে এসব ফুলটুল বা গাছপালা সম্বন্ধে আমার জ্ঞান আর আগ্রহ বরাবরই ছিল কম, তাই নিশ্চিত হতে পারলাম না। ভাবলাম, হয়তো কবর দেবার সময় কোন ফুলের গাছটাছও এই অভাগার সাথে মাটি চাপা পড়ে গেছে আর সেটারই এখন ঘ্রাণ ছুটেছে কোনভাবে। তবে আমাকে অবাক করে দিয়ে ঘ্রাণটা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে হতে দুম করে আবার মিলিয়েও গেল একটা সময়। ঠিক বুঝলাম না ব্যাপারটা। অদ্ভুত তো!
কিছুটা সময় যেতেই বিস্ময়ের ঘোরটা যেন অন্য মাত্রা পেল।
এবার নাকে এসে ঠেকল আতরের ঘ্রাণ!
এ কিভাবে সম্ভব?! ফুলটা না হয় বুঝলাম, কিন্তু কবরের ভেতরে আতরের ঘ্রাণ আসবে কোথা থেকে?! আর বিস্ময়ের এই ধাক্কাটাকেই ধীরে ধীরে দখল করে নিল এক অজানা আতঙ্ক। হঠাৎ মনে হতে লাগল আমার পিঠের নিচে যেন কোন কিছু একটা নড়াচড়া করছে।
'কি ব্যাপার? কাফনের মধ্যে আবার পোকামাকড় বা সাপ টাপ কিছু ঢুকে পড়ছে নাকি?’ সন্দেহটা হতে না হতেই নড়াচড়াটাও থেমে গেল, আর সাথে সাথেই গা শিউরে ওঠা আরেকটা বিশ্রী অনুভূতির উদয় হল সেখানে।
কোন কিছু যেন খুব আস্তে করে আঙুল বোলাচ্ছে আমার পিঠে; কোন রুগ্ন হাতের রগরগে আঙুলের আদিম ও শীতল স্পর্শ! আতঙ্কটাও এবার আর ভাল মত পেয়ে বসতে দেরী করল না, সেই সাথে উস্কে দিল নিঃশ্বাসের গতিবেগ।
কবরের নিঃসীম অন্ধকার ছাপিয়ে এরপর যেটা ঘটল তার কাছে মনে হয় সেদিনের সমস্ত দুঃসহ অভিজ্ঞতাগুলোও ম্লান হয়ে গেল।
কবরের তল থেকে ভীষণ ভাবে বলপ্রয়োগের মত প্রচন্ড এক ধরণের চাপ অনুভব করতে লাগলাম। আর তার সাথে যোগ হল কোন যেন জান্তব গোঙানির সুর! চাপটা প্রথমে সেই নিচ দিয়েই পিঠ বরাবর এলেও, দ্রুত তা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। মনে হল দানবীয় কোন শক্তি যেন জোর করে মাটি ফুড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে! আর আমাকেও পারলে যেন উপরের মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়! যেখানে সেই পিলে চমকানো পরিস্থিতিতে আমার হাড় গুড়োগুড়ো হয়ে পিষ্ট হবার কথা, সেখানে কিনা আমার জন্য আসলে অপেক্ষা করছিল আরও চূড়ান্ত রকমের বিস্ময়!
আমার চারপাশের মাটির স্তরে একটা অস্বাভাবিক পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম; ঝুরঝুরা বালির মত তা যেমন মসৃণ হয়ে গেছে, সেই সাথে যেন অনেকটা আবার নির্ভারও মনে হচ্ছে! যার ফলে কবরের তল হতে ধেয়ে আসা পরের ধাক্কাটা আমার শরীরটাকে যেন অনেকটা ছুড়েই মারল সেই দুর্বল গুড়োমাটির স্তর ভেদ করে - উর্ধমুখে। সমস্ত শরীরটা ব্যাথায় ককিয়ে উঠলেও এর মধ্যেও অবাক হয়ে টের পেলাম পিছমোড়া সেই হাতের বাঁধনটা কখন জানি খুলে গেছে!
সত্যি বলতে, আমার তখন মনে হচ্ছিল আমি যেন একটা অপ্রকৃতস্থ ঘোরের মধ্যে চলে গেছি; যেখানে চরম আতঙ্ক, বিস্ময় আর মৃত্যুভয়ের একটা অপার্থিব ঘূর্ণীঝড় যেন আমাকে মাঝখানে নিয়ে খেলছে। বিশ্বাস-অবিশ্বাস, বিভ্রম, বাস্তবতা সব যেন তখন একাকার হয়ে গেছে কোন খেয়ালি মৃত্যুদূতের চটুল রসিকতায়।
আমি যখন সারফেস বা পৃষ্ঠদেশের অনেকটা কাছাকাছি পৌছে গেছি, ঠিক তখনই একটা বিশ্রী ব্যাপার ঘটল।
মনে হল কেউ যেন তার হাড় সর্বস্ব পা দিয়ে সজোরে আমার পশ্চাদ্দেশে একটা লাথি মারল! ব্যাথার চোটে শরীরটা ধনুকের মত পিছন দিকে বেঁকে গেলেও পরক্ষণেই শুণ্যে উঠে আমি আছড়ে পড়লাম মাটিতে। আর এই মাটিটা শক্ত মাটি...যাকে বলে ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগ! সমস্ত শরীর জুড়ে নিদারুণ ব্যাথার দাপটটাকে আমি আর এতটুকু আমলে নিলাম না। টেনে হিঁচড়ে গায়ের সাথে লেপ্টে থাকা কাফনের কাপড়টাকে সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। যতক্ষণ না ওটা মুখের সামনে থেকে সরছিল, আমার কেন জানি কিছুই আর বিশ্বাস হতে চাচ্ছিল না। হ্যা, বিশ্বাস করুন, ক্ষণিকের জন্যে হলেও মনে হয়েছিল আমি কবরে শুয়েই কোন স্বপ্ন দেখছি না তো?
বাতাসের একটা হালকা ঝাঁপটা এসে মুখে লাগতেই আমি চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলাম। আমার এই দ্বিতীয় জীবনের প্রথম চিৎকার, প্রথম কান্না!
আসলে গোটা রাতজুড়ে আমি যত নিষ্ঠুরতারই শিকার হই না কেন, ঐ মুহূর্তে আমার কাছে তার আর যেন কোন গুরুত্বই ছিল না; এমনকি কিছুক্ষণ আগেও যেই অবিশ্বাস্য, অলৌকিক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে বেঁচে ফিরেছি সে কথাও যেন ভুলতে বসেছিলাম। কেননা তখন আমার কাছে ঐ মুহূর্তে সব থেকে বড় কথা ছিল...আমি বেঁচে আছি! আমি সত্যি বেঁচে আছি! জ্যান্ত কবর দেয়ার পরও আমি যে নিশ্চিত মৃত্যুর গ্রাস থেকে ফিরে আসতে পেরেছি, এবার সেই আনন্দেই কাঁদলাম। অঝোরে কাঁদলাম, বহু বছরের অভিশাপের মুখে এতদিনে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে পারার আনন্দে!
এরই মধ্যে ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করল, যেমনটা বয়েছিল আমাকে কবরে নামাবার সময়। কষ্ট হল অনেক, তবুও কোনরকমে উঠে বসলাম এবার। এখানে আসার পর পা রেখে তো ঠিকমত দাঁড়েতেও পারিনি, তার আগেই তো বাদল বাহিনী পৈশাচিক ভাবে পেটাতে শুরু করে। আর সেই যে বিশ্রী রকমের মার খেয়ে মুখ থুবড়ে শুয়ে পড়েছিলাম, তারপর তো এই প্রথম আসলে উঠে বসবার জন্য মনোবল আর সুযোগ পেলাম।
এবার এই সুযোগটা শরীরের ব্যাথারাও আর হাত ছাড়া করল না। উঠে বসতেই এখানে-সেখানে তাদের সজাগ উপস্থিতির কথা মনে করিয়ে দিল। বিশেষ করে ডান হাঁটু আর পশ্চাদ্দেশের ব্যাথাটা এখনও আছে, অনেক ভোগাবে মনে হল।
কোনরকমে দলা পাকিয়ে কাফনটা একপাশে ফেলতে যেতেই মুখ হা করা শুন্য কবরটার দিকে চোখ চলে গেল।
আমার প্রয়াত কবর; জীবনের প্রথম কবর। যার ভেতরে কিছুক্ষণ আগেও আমি ছিলাম!
ভেতরের মাটিগুলো এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে চারপাশে পড়ে আছে একটি ভীষণ অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে। হ্যা, অলৌকিকই তো! না হলে সেখান থেকে যে কিভাবে আমি বেরিয়ে এলাম তার কি কোন সায়েন্টিফিক ব্যাখ্যা আদৌ দাড় করানো যায়? না, যায় না। কোন সুস্থ, স্বাভাবিক, শিক্ষিত মানুষকে এই অভিজ্ঞতার কথা বললে ব্যাখ্যা তো দূরের কথা, আমাকে পাগলই বলে সন্দেহ করে বসতে পারে একচোট হেসে নেয়ার পর। তারপরও, প্রশ্নটা থেকেই যায়...ভেতরে আসলে কি ছিল ওটা? কোন জীবজন্তু? প্রশ্নই আসে না! কোন ধরণের জন্তু জানোয়ারেরই তো অতটা মাটির নিচে থাকারই কথা না। তার উপর সেকি অস্বাভাবিক জোর! তবে আমি স্পষ্টই অনুভব করেছিলাম এমন কিছু ব্যাপার যার সাথে আর যাই হোক কোন ধরণের ন্যাচেরাল অ্যাক্টিভিটি বা ফেনোমেনার কোন সম্পর্কই থাকতে পারে না।
সম্পর্ক যদি থেকেই থাকে তবে তা থাকবে আমাদের লাস্ট অপশনের...প্যারানরমাল বা সুন্দর বাংলায় যাকে বলে অতিপ্রাকৃত! আর এই ব্যাপারটাকে টানতে গেলেই এসে যায় এখানকার সেই ফকিরবাবার ইতিহাস! বেলায়েত সাহেব যার কথা বলতে গিয়ে শুরুতেই ‘সুপারন্যাচেরাল
ি গিফটেড’ বলে একটা টার্মও ব্যবহার করেছিলেন বলে মনে পড়ে। সদাই যার সাথে উঠত-বসত নাকি সাত-সাতটা জ্বীন! যিনি মৃত্যুর আগ দিয়ে বলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে গিয়েছিলেন যে, এখানে কখনো যেন...কোন ধরণের স্থাপ...না...
ভাইরে! আমি এখনও এখানে বসে আছি কেন? যুক্তিটুক্তি ধুয়ে এখন কি আর এমন উদ্ধার করব? জানটুকু নিয়ে যে বেঁচে বেরিয়ে আসতে পেরেছি সেটাই তো বড় কথা। কথাটা ভেবেই যেই না উঠতে যাব, ঠিক তখনি কবরের সেই মিষ্টি ফুল-ফুল ঘ্রাণটা আবার পেলাম! খুব কাছ থেকেই যেন আসছে। ভয়ের একটা শীতল স্রোত যেন আমার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। সব ব্যাথা-বুথা উপেক্ষা করে জোর করে উঠে দাঁড়ালাম। সাথে সাথেই দূর থেকে মনে হল একঝাক সমবেত কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। আর যতই তা একটু একটু করে এদিকেই এগিয়ে আসতে লাগল, ততই যেন জিকিরের মতই শোনাল! খোঁড়াতে খোঁড়াতেই দ্রুত পা বাড়ালাম। আমি জানি, আর কিছুক্ষণ থাকলে এরপর একটা আতরের তীব্র ঘ্রাণও নাকে এসে ঠেকবে! আর তারপরে যে কি ঘটবে বা ঘটতে পারে তা আর আমার দেখা তো দূরে থাক, একবিন্দু ভাবারও সাহস হল না।
খুব কষ্ট হচ্ছিল, তারপরও কোনরকম খোঁড়াতে খোঁড়াতে বেশ খানিকটা পথ হেঁটে আসলাম। সেই ঝড়ো বাতাসটা আবার বইতে শুরু করেছে, আর তার মধ্যেই একটু জিরোবার জন্য থেমে দাঁড়ালাম।
কেন যেন একটিবারের জন্য হলেও খুব পিছনে তাকাতে ইচ্ছে হল। দেখি না, ফকিরবাবার পাড়টা কতটা পিছনে ফেলে এসেছি? ছেলেমানুষি আগ্রহের কাছে হার মেনে পিছনে তাকাতেই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আর তা হলাম মূলত দুটো কারণে...প্রথমটা হল; অনেকক্ষণ ধরে হাঁটলেও, আমি ফকিরবাবার পাড় থেকে আসলে খুব একটা দূরে এখনো চলে আসতে পারিনি...আর নয়তো, আমি চলে আসতে চাইলেও ফকিরবাবার পাড় আর আমার পিছু ছাড়ছে না কোন কারণে!
এবার আসা যাক দ্বিতীয়টায়। সময়টা সুবেহ সাদিক বা ভোরের আলো ফুটবে ফুটবে বলে। এই আবছা আলোতেও ফকিরবাবার পাড়টা মোটামুটি স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে এখান থেকে, যেমনটা বোঝা যাচ্ছে সেখানে খুঁড়ে রাখা একটি কবরের অস্তিত্ব...আর তার ঠিক পাশেই দাঁড়ানো একজন লম্বাটে মানুষের ছায়ামূর্তি! কি যেন বলতে চাইছে লোকটা, সামনের দিকে তর্জনী উঁচিয়ে নেড়ে-নেড়ে, অনেকটা যেন বেশ রেগে গিয়ে ধমক দেবার ভঙ্গিতে। এমনিতেই কন্ঠস্বরটা কেমন ঘ্যারঘ্যারে মনে হচ্ছিল, তার উপরে ঝড়ো বাতাসের কারণে কথাগুলা কেমন যেন কেটে কেটে আসছিল, স্পষ্ট কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। এর মধ্যে আমি স্রেফ তিনটা শব্দ ধরতে পারলাম...”স্পর্
ধা...অপয়া...” আর তৃতীয়টি হল...”অভিশাপ!”
সারা রাতের ভয়াবহ ধকল আর ক্লান্তিতেই কিনা জানি না, সাথে সাথেই আমি জ্ঞান হারালাম ওখানে।
।। ১৪।।
জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে আবিষ্কার করলাম খালুর বাসায়।
প্রাথমিক কথাবার্তায় যেটা জানতে পারলাম তা হল, কয়েকটা বাচ্চা ছেলে নাকি সকাল-সকাল স্কুলে যাবার পথে আমাকে পড়ে থাকতে দেখতে পায় একটি বাঁশঝাড়ের কাছে (যা থেকে আরও বেশ খানিকটা পথ এগোলেই নাকি ফকিরবাবার পাড়)। তো, সেই ছেলেগুলোই বাজারে গিয়ে তড়িৎ খবরটা রটিয়ে দেয়। আর তার পরপরই উৎসুক কিছু এলাকার লোক আগ্রহের বসে দেখতে এলে সেখান থেকে অবশেষে আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। ভাগ্য ভাল, মিল্টনও ছিল ঐ উৎসুক জনতার একজন যে কিনা দেখেই সাথে সাথে আমাকে চিনতে পারে।
কিছুটা ধাতস্ত্ব হয়ে এলে এরপর সবাই আমাকে জেঁকে ধরল আমার এই দুরাবস্থার রহস্যটা জানতে। কখনইবা ঘর থেকে বেড়ালাম আর কিভাবে ও কেনইবা এই দুরাবস্থার শিকার হলাম? জবাবে আম্মা, খালা আর খালুকে এবার মোটামুটি সব খুলেই বললাম, স্রেফ ফিনিশিং-এ এসে কবরের পার্টটা ছাড়া। ওটা এডিট করে বলে দেই, বাদল বাহিনী স্রেফ আমাকে আচ্ছামত ধোলাই করে বাঁশঝাড়ের কাছে ফেলে রেখে দিয়ে চলে যায়। অবশ্য শর্মিলার ব্যাপারটাও কিছু কিছু জায়গায় অনেক কাটছাঁট করতে হয়েছে যাতে করে আবার আমার সম্পর্কেই কোন ভুল ধারণা না করে বসে। সেগুলো বিস্তারিত আর নাই বা বলি।
এদিকে খবর পেয়ে দুপুরে ফরিদ ভাই আর বেলায়েত সাহেব দেখা করতে এলে তাদের কাছ থেকে পেলাম দিনের সব থেকে চমকপ্রদ খবরটি, যাকে বলে ‘নিউজ অফ দ্যা ডে’।
বাদলকে নাকি জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজনে দেশের বাইরে নেয়া হচ্ছে। ‘কি ব্যাপার? ঘটনা কি? শয়তানটার আবার কি হল?’ ঘুরেফিরে এই একই প্রশ্নগুলোর জবাবে ফরিদ ভাই জানালো, ল্যাংড়াটা নাকি সকালবেলা বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গিয়ে হাফ-প্যারালাইজড হয়ে গেছে! ওর শরীরের বা দিকটা নাকি আর রেসপন্সই করছে না!
আমি আর আম্মা এখন বাসে বসে আছি। আমরা ঢাকায় ফিরে যাচ্ছি। শেঠের বাজারে শীঘ্রই আর ফিরব বলে মনে হয় না। এদিকে আকাশটা আবার ভীষণ মেঘলা করে এসেছে। মনে হচ্ছে আজ বেশ জাঁকিয়েই বৃষ্টিটা নামবে। বাসে উঠার আগে মুরাদ আর হ্যাংলা রতনের সাথে দেখা হয়েছিল, বাসস্টান্ডেই। ঐ ব্যাটারাও মনে হল কোথাও কেটে পড়ছে। তবে আমাকে দেখেই যেন অনেকটা বরফের মত জমে গেল। স্বাভাবিক, গতরাতে সবে যাকে জ্যান্ত কবর দিয়ে এল, তাকে দেখছে কিনা এখন কেতাদুরস্ত হয়ে বাসে উঠতে। আমি আর ওদের মনে কোন সন্দেহ না রেখে দন্ত্য বিকশিত করে গাল ভরা একটা হাসি দিয়ে সাথে সাথে বাসে উঠে পড়লাম।
বাসের চাকা ঘুরতেই বৃষ্টিটা নামল। আর সেকি আর যেইসেই বৃষ্টি? যাকে বলে দুকুল ছাপানো আকাশ ভাঙা বৃষ্টি! আমিও উদাস হয়ে গত কয়েকদিনের শেঠের বাজারের অভিজ্ঞতাটা নিয়ে ভাবতে বসলাম। নিয়তির খেল আর কাকে বলে! তবে একটা কথা কি...আমাদের অপয়া বংশের ধারাবাহিকতায়, গায়েবী মৃত্যুর যে সংশয়টা ছিল সেটা কি আদৌ দূর হয়েছে বলা যায়? যাও না একটু কবর জুটেছিল সেটাও তো হারাতে হল শেষমেশ পশ্চাদ্দেশে একটা লাথি খেয়ে! জানি, যে কেউ শুনলে বলবে, “ব্যাটা, বেঁচে যে ফিরতে পেরেছিস তার জন্য আগে শুকরিয়া আদায় কর!” তারপরও যত যাই বলুন না কেন, সংশয়টা কিন্তু রয়েই গেল। কাল যদি মরেও যেতাম, কবরের ঠাইটা তো অন্তত পেতাম! এখনও প্রশ্নটা তাই থেকেই যাচ্ছে...মরে গেলে, কবর পাব তো?
হঠাৎ চিৎকার-চ্যাচামেচি শুনে চিন্তার জগত ছেড়ে এবার বাস্তবে ফিরে এলাম। সামনে তাকাতেই দেখি কিছু যাত্রীর সাথে ড্রাইভারের বিশ্রী একটা ঝগড়া চলছে। ঝগড়া লাগাটাই স্বাভাবিক। এই ঝুম বৃষ্টির মধ্যেও ভীষণ বেপরোয়া গতিতেই গাড়ী চালাচ্ছে ড্রাইভার, তাকে অনেক মানা করা সত্ত্বেও গতি কমাবার নামগন্ধ নেই। হাতাহাতির আগে তুইতোকারির পর্যায়ে এখন পৌছে গেছে ঝগড়াটা। ড্রাইভার যেন পারলে স্টিয়ারিং ছেড়ে উঠে এসে উত্তেজিত যাত্রীদের উপরই ঝাঁপিয়ে পড়ে, “আমারে তোরা গাড়ী চালানোর গিয়ান দ্যাস! জানোস, আমি এই লাইনে কত বছর গাড়ী চালাই?”
একে তো বেপরোয়া গতি, তার উপরে সামনে দেখাও যাচ্ছে না ঠিকমত; যে কোন মুহূর্তেই ভয়ংকর একটা অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে যেতে পারে!
আম্মা আমার হাতটা চেপে ধরতেই তাকিয়ে দেখি ভয়ে তার মুখটা একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। চোখ জুড়েও রক্তহীম হয়ে যাওয়া আতঙ্ক।
আমি জানি, এই ভয়টা আসলে কিসের...আতঙ্কটাও বা সত্যি বলতে কি নিয়ে!
-------------------------------------------
সমাপ্ত-----------------------------------
______________________________
_____________________________