কবর ভাগ্য - সানজিদ পারভেজ (পর্ব ৩-৪)



।। ৪।।
কেমন যেন একটা অজানা শঙ্কায় আচ্ছন্ন ছিলাম বলেই হয়তবা, মোবাইল ফোনটা বেজে উঠতেই তড়িঘড়ি করে বিছানায় উঠে বসলাম।
-- “হ্যালো?”
বেশ আমুদে একটা কণ্ঠে ওপাশ থেকে কেউ বলে উঠল, “হ্যালো, ডেন্টিস্ট সাহবে? ঘুমিয়ে পড়েছিলেন নাকি?”
-- “না! কেন...কে বলছেন?”
-- “জ্বী, আমাকে মনে হয় চিনবেন না। আমি মুরাদ, বাদল ভাইয়ের হয়ে এই টুকটাক কাজটাজ করি আর কি। তো যেই কারণে ফোন করলাম আর কি, আপনি একটু কষ্ট করে বেরিয়ে আসুন। বাদল ভাই আপনার সাথে আরজেন্ট একটু কথা বলতে চাচ্ছেন। আমরা আপনাদের বাসার সামনেই দাঁড়িয়ে আছি।”
অস্বীকার করব না, অত রাতে বাদল দেখা করতে এসেছে শুনে ভেতরে ভেতরে আঁতকেই উঠেছিলাম আমি; তারপরও যতটা পারা যায় আতঙ্ক বোধটা আড়াল করে খানিকটা নিস্প্রহ কণ্ঠেই বললাম, “এত রাতে বাসার সামনে কি কথা!? কাল সকাল-সকাল আমার চেম্বারে আসলেই তো হত...”
-- “দেখেন মিয়া, আলগা ঝামেলা কইররেন না, বাসা দিয়ে বের হতে বলছি বের হন। আপনার খালু শমসের সাহেবকে এখনো আমরা কিছুটা সম্মান করি বইল্লাই এখনো বাসার ভেতরে ঢুঁকে কোন ঝামেলা বাঁধাই নাই। তাড়াতাড়ি বের হন, বাদল ভাই কিন্তু বেশিক্ষণ ওয়েট করতে পচ্ছন্দ করেন না।”
-- “আচ্ছা...আমি আসছি।” আমি আর কথা বাড়ালাম না। এখন মনে হচ্ছে আমারই ভুল হয়ে গেছে। সন্ধ্যার পরপরই উচিৎ ছিল শেঠের বাজার থেকে কেটে পড়া। ফরিদ ভাই আর মিল্টন পইপই করে বলেছিল ঢাকায় গিয়ে কিছুদিনের জন্য গা ঢাকা দিতে। কিন্তু কথা হচ্ছে আমি গা ঢাকা দিতে যাব কেন?! আমি তো কোন অন্যায় করিনি। একটা ইমম্যাচিউরড মেয়ে পাগলের মত কান্ড করে বসবে আর তার জন্য আমাকে কেন গা ঢাকা দিতে হবে? কথাগুলো ভাবতেই মেজাজটা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল; কিন্তু এখন মেজাজ খারাপের সময় না, বাদল বাহিনী এসেছে দেখা করতে, মাথা যতটা সম্ভব ঠান্ডা রেখে এদের সাথে কথা বলতে হবে। বুঝাতে হবে, যা হয়ে গেছে তার জন্য আমাকে আসলে দায়ী করা যায় না।
নিচের গেটের চাবিটা ফ্রিজের উপরই রাখা ছিল, আমি আর দেরি না করে চাবিটা নিয়ে খুবই সন্তপর্ণে দ্রুত নিচে নেমে এলাম।
ছোট গেটটা খুলতেই প্রথমে দুজনকে চোখে পড়ল, গেটের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। আধো অন্ধকারে যতটুকু বোঝা গেল এদের কারোরই বয়স ২৭-২৮-এর বেশি হবে না। একজনের গায়ে ঢিলেঢালা একটা সার্ট, মাথায় ব্যাকব্রাশ করা চুল পিছনে ঝুঁটি করে বাঁধা। টি-শার্ট পড়া বেশ গাঁট্টাগোট্টা অন্যজনের মাথায় ক্যাপ, গোটা মাথাটাই কামানো মনে হল। ওদের ছাড়িয়ে এবার সামনে চোখ যেতেই পরপর দুটো গাড়ি দেখতে পেলাম, ছোট্ট গলিটার একপাশে সাইড করে রাখা। প্রথমে একটা সাদা রঙের মাইক্রোবাস, যার বাইরে একজন হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে মোবাইল নিয়ে দ্রুত তার উপর আঙ্গুল বোলাচ্ছে, মাইক্রোবাসটার ভেতর থেকেও দুএকজনের কণ্ঠস্বর ভেসে এল। ওটার ঠিক পিছনেই একটা মেরুন রঙের প্রাইভেট কার। সব বাতিগুলো নিভানো, কালো কাঁচে মোড়া, তাই ভেতরে কে বা কারা আছে তাৎক্ষণিক বোঝা গেল না।প্রথমে খেয়াল করিনি, এবার প্রাইভেট কারটার পিছনে একটা মোটর সাইকেলও দেখতে পেলাম।
“ভাই গাড়ীতে আছে। চলেন গাড়ীর কাছে যাই।” চুলে ঝুঁটি বাঁধা ছেলেটা ছোট্ট একটা হাই তুলে বলল।
আমার কাছে গোটা ব্যাপারটাই তেমন একটা সুবিধার ঠেকল না। বাদল যদি আমার সাথে শুধু ‘কথা'ই বলতে আসে তবে সাথে করে দুএকজনকে আনলেই তো চলত, এভাবে আলাদা মাইক্রোতে করে এত ছেলেপেলে নিয়ে আসার কি মানে? অবশ্য এমনও হতে পারে আমার সাথে কথা বলে চ্যালাচুমান্ডদের নিয়ে ওর অন্য কোথাও যাবার কথা...
“আসেন” চিন্তার ছেদ ঘটিয়ে কথাটা বলেই ঝুঁটিওয়ালা ছেলেটা এবার আমার কাঁধে এমন ভাবে হাত রাখল যেন অনেকদিন পর কোন পুরানো বন্ধুকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছে। অগত্যা আমিও ওর সাথে পা চালালাম। আমরা দুজন পাশাপাশি হাঁটছি, সামান্য ব্যবধানে ক্যাপ পড়া ছেলেটা পিছন-পিছন আসছে। বেশিক্ষণ লাগল না, মাইক্রোবাসটার ঠিক পাশ দিয়ে যাবার সময়ই ঘটনাটা ঘটল।
পিছন থেকে গাঁট্টাগোট্টা, ক্যাপ পড়া ছেলেটা এগিয়ে এসে আমার বাম হাতটা চেপে ধরল। চুলে ঝুঁটি বাঁধাও সাথে সাথে আমার ডান দিকটা সামলে নিলে দুজন মিলে এবার অনেকটা টেনেই আমাকে মাইক্রোবাসের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেল।
“আরে! হচ্ছেটা কি?! কি হচ্ছে এসব...” হতভম্ব হয়ে কথাটা বলতে না বলতেই দেখতে পেলাম মাইক্রোটার গায়ে হেলান দেয়া ছেলেটা একটানে স্ল্যাডিং ডোরটা খুলে ফেলল। ভেতরে মনে হল আমারই জন্য কেউ অপেক্ষা করছিল। মুখ দিয়ে অস্ফুট একটা চিৎকার বেরতেও পারল না ঠিকমত, তার আগেই গাড়ীটার ভেতর থেকে ষন্ডামার্কা একটা ছেলে বেরিয়ে এসে আমার গলার টুঁটিটা চেপে ধরল।
“একটা টুঁ শব্দ করবি তো এইখানেই ফাইররা ফালামু!” শীতল ও ভরাট কণ্ঠের হুমকিটা চোখের কোটর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসা অগ্নিদৃষ্টির সাথে নিমিষেই আমাকে চুপসে দিল।
মুহূর্তের মধ্যেই পরিস্থিতি বুঝে নিতে আমার আর বেগ পেতে হল না। ল্যাংড়া বাদল তার সাগরেদদের পাঠিয়েছে আমাকে তুলে নিয়ে যেতে। এখন কোথায় নিয়ে যায়, কি করে সেটাই হচ্ছে কথা। বাদলও আশেপাশেই থাকতে পারে; বলা যায় না, এই মুহূর্তে হয়তো পিছনের প্রাইভেট কারটায় বসে বসে সব দেখছে। লোকবল আর শক্তি সামর্থ্যের বিচারে যেহেতু এরা সবদিক দিয়েই এগিয়ে আছে, তাই আমি আর ঐ মুহূর্তে কোন ধরণের প্রতিরোধের চিন্তা আমলে নিলাম না। তাতে করে হিতে বিপরীত হয়ে বিপদকে কেবল ত্বরান্বিতই করা হতে পারে।
আমাকে বসানো হয়েছে মাইক্রোর মাঝখানের সিটের মাঝ বরাবর। আমার দুপাশে দুজন, পিছনের সিটে একজন আর সামনে চালকের পাশের সিটটাও দখল করে আছে বেশ রুক্ষ চেহারার আরেক যুবক। চালকের আসনে বেশ মোটাসোটা এক গুরুগম্ভীর লোক, জানালা দিয়ে একটা হাত বের করে ইশারা করতেই কিছুক্ষণের মধ্যে পিছনের মোটর সাইকেলটায় চড়ে সবার আগে দুজন বেরিয়ে গেল। তারপর আস্তে করে মেরুন রঙা প্রাইভেট কারটা আমাদের ছাড়িয়ে সামনে এগোতেই মাইক্রোর ইগনিশনে এবার চাবি ঘোরাল গুরুগম্ভীর চালক।
“বাদল ভাই কোথায়?” গাড়ী চলতে শুরু করলে আমার বা পাশে বসা সেই হুমকিদাতাকে উদ্দেশ্য করেই প্রশ্নটা করলাম।
-- “ভাই সামনের গাড়ীতেই আছে।” বাইরে তাকিয়ে ছিল ছেলেটা, আমার দিকে না ফিরেই নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জবাব দিল। তারপর সিটটা সামান্য পিছন দিকে এলিয়ে শরীরটা এবার একটু ছেড়ে দিয়ে আয়েশ করে বসে বলল, “আলগা প্যাঁচাল পাইররেন না আর, সবার মেজাজ-মুজাজ কইলাম এমনিতেই খারাপ আছে।”
পরিস্থিতি হালকা করার জন্য আমিও খেজুরে আলাপের চিন্তা মাথা থেকে বাদ দিলাম। সিচুয়েশন যা খারাপ হবার তা ইতিমধ্যে হয়ে গেছে, এখনি তা নিয়ন্ত্রণে আনার তড়িঘড়ি করাটা বোকামি হবে বলেই মনে হল।
মধ্যরাতের শুনশান একটা মফস্বল শহরের অলিগলি আর রাস্তা পেরিয়ে ছুটে চলছে একটা বাইক, একটা প্রাইভেট কার আর তার পিছনে একটা সাদা মাইক্রোবাস, যার ভেতরে জোর করে আমাকে কিছুক্ষণ আগে তুলে নেয়া হয়েছে। জানি না কোন অমোঘ নিয়তির মুখোমুখি হতে চলেছি আমি। মাথায় শুধু একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, বাদলের সাথে কথা বলা দরকার, যতটা পারা যায় ওকে সব বুঝিয়ে বলতে হবে। না হলে কি যে আছে কপালে...আল্লাহ মালুম!
।। ৫।।
আবারো সেই রাতের ঘটনায় ফিরে গিয়েছিলাম, না? সত্যি বলতে এবার আসলে ইন্টেনশনালি করেছি। ভাবলাম পরে আবার ভুলে টুলে না যাই, তার চেয়ে বরং মনে থাকতে থাকতে বাদল বাহিনীর বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাবার ঘটনাটা লিখে রাখি। কথা দিচ্ছি, এমনটা আর হবে না। এখন থেকে সিরিয়াসলি সব সিরিয়ালি বলে যাব। তাই আর কথা না বাড়িয়ে চলুন, এবার সেই বিকেলের পর্বে ফেরত যাই...
“জ্বী, আসুন” সন্মতি জানাতেই পর্দাটা সরিয়ে যে মেয়েটি চেম্বারে ঢুকল, তাকে যথেষ্ট সুন্দরীই বলা চলে। তবে সেই সৌন্দর্য্যকেও কিছুটা যেন বিতর্কিত করে তুলেছে মেয়েটার অতিমাত্রার সাজসজ্জা। হতে পারে এখান থেকে কোথাও কোন প্রোগ্রামে যাবার কথা, তাই হয়তো একবারেই এত সেজেগুজে বের হয়েছে। পায়ের হাই হিলের কারণেই সম্ভবত, বেশ কোমর দুলিয়ে গটগট করে হেঁটে এসে টেবিলের চেয়ারটা টেনে নিয়ে মেয়েটা এবার আমার মুখোমুখি বসল। মাথার চুলগুলো বেশ ঘন ও দীর্ঘ, পরচুলা বলে মনে হল না অন্তত। পরনের রঙচঙা, বাহারি সালোয়ার কামিজে মেয়েটার রুচিগত দুর্বলতা খানিকটা ধরা দিলেও সেটাকেও আসলে ক্ষমা করে দেয়া যায় টানাটানা, দীঘল চোখজোড়ার কারণে।
“ডাক্তার সাহেব, আমার মাড়ীর দাঁতে না ভীষণ ব্যাথা! এই বাম দিকের একদম কোণার দাঁতটায়।”
গালে হাত রেখে বেশ ঢঙ্গ করেই কথাটা বলে উঠল বসতে না বসতেই। ভালমন্দ মিলিয়ে মেয়েটিকে ঘিরে যাও না একটু আগ্রহ মনে দানা বাঁধতে শুরু করেছিল সেটাও একনিমিষে ধূলিসাৎ হয়ে গেল মুখ খুলবার সাথে সাথে। মেয়েটার বাচনভঙ্গি ভীষণ নাটুকে, অনেকটা যেন চোখেমুখে কথা বলা টাইপ মেয়ে আর সেই সাথে আঞ্চলিকতার টানটাও প্রকট।
-- “ব্যাথা কি সবসময়ই হচ্ছে নাকি মাঝে মধ্যে হয়?”
-- “প্রথম প্রথম মাঝে মধ্যে হত, এখন না প্রায়ই ব্যাথা করে, আর খেতে গেলে তো কথাই নাই।”
“দেখা যাক, একবার” বলেই উঠে দাঁড়িয়ে ছোট্ট পকেট টর্চটা নিয়ে পেশেন্টের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, “দেখি, হা করুণ”।
বলামাত্রই মেয়েটাও বড় একটা হা করে মুখটা মেলে ধরল; সেই সাথে একটু নড়াচড়ার কারণেই কিনা জানি না, মেয়েটার বুকের উপর থেকে ওড়নাটা বেশ খানিকটা সরে গেল। আমি বুঝি না, পড়তে না জানলে এভাবে মেয়েমানুষের ওড়না-টড়না পড়ার কি দরকার? কামিজের গলার কাছের উন্মক্ত অংশটা V শেপে নেমে এসেছে বুক পর্যন্ত, আর তাতে করে আড়াল করতে যেয়ে বরং স্ফীত বুকের মাঝের কোমল খাঁজটা আরও উদ্ধত হয়ে উঁকি দিচ্ছে।
‘আচ্ছা, একফোটা জল এখন ওর গলার কাছ থেকে বুকের এই খাঁজ বরাবর ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়লে কেমন হত?’ অস্বীকার করব না, এক মিলিসেকেন্ডের জন্য হলেও চিন্তাটা মাথায় এসেই আবার পালিয়ে গেল। দ্রুত চোখের দৃষ্টিসহ নিজেকে সংযত করে নিলাম। ভাল করে এবার পেশেণ্টের মুখের ভেতরটা একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে নিজের চেয়ারে ফিরে এসে বললাম, “একটা ওপিজি করিয়ে নিন।”
-- “ওপিজি?”
-- “ডেন্টাল এক্স-রে যাকে বলে। আপনার থার্ড মোলারে, আর কি আক্কেল দাঁতটায় গ্রস ক্যারিস হয়ে গেছে। সোজা বাংলায় দাঁত পোকায় ধরেছে বলতে পারেন। ওপিজি দিলাম, ওতে করে তার গভীরতাটা তো বোঝা যাবেই, সেই সাথে বাকি দাঁতগুলোরও কারেন্ট কন্ডিশনটা ক্লিয়ারলি ফুটে উঠবে। ওপিজি রুমটা বেরলেই দেখতে পাবেন। আমি লিখে দিচ্ছি, পারলে আজকেই করিয়ে নিন। বেশি সময় লাগবে না, রিপোর্টসহ হাফ এন আওয়ার সর্বোচ্চ।”
--“তা না হয় করলাম, কিন্তু তারপর?”
--“তারপর রিপোর্টটা নিয়ে আমার কাছে আসবেন, তখন অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেয়া হবে। জ্বী...নামটা বলবেন দয়া করে।” প্রেসকিপশন প্যাডে ওপিজির কথা উল্লেখ করে তারিখটা বসিয়ে নিলাম।
--“শর্মিলা খন্দকার। এইজ অ্যারাউন্ড টুয়েন্টি টু।” কথাটা বলেই মুচকি একটা হাঁসি দিল মেয়েটা, তবে সাথে সাথেই আবার অভিব্যক্তিটা পাল্টে নিয়ে স্বাভাবিক হল।
ইঁচড়ে পাকা মেয়ে, ছেলেমানুষিতে দুষ্ট; আমি আর কথা বাড়ালাম না, নামের পাশে কর্ণারে এবার বয়সের ঘরটাও পূরণ করে নিলাম।
পরের কয়েকটা দিন জুড়ে সব মিলিয়ে মোট তিনটা সিটিং-এ শর্মিলা খন্দকারের থার্ড মোলারে রুট ক্যানেল করে দিলাম। আক্কেল দাঁত বলে আর ক্যাপের ঝামেলায় গেলাম না। ট্রিটমেন্টটা উইদাউট এনি কমপ্লিকেসি ঠিকঠাক ভাবেই সম্পন্ন হয়েছিল। কোন সমস্যা হবার কথা ছিল না, কিন্তু সমস্যা একটা ঠিকই উদয় হয়েছিল দুদিন যেতে না যেতেই। যদিও তা অবশ্য ‘দন্ত্য সম্পর্কিত’ কিছু ছিল না, তাছাড়া গোটা ব্যাপারটাকে তো আদৌ কোন ‘সমস্যা’ বলেই মনে হয়নি প্রথম দিকে।
ফাইনাল সিটিং-এর ঠিক দুদিন পর প্রথম ফোনটা পাই মধ্যরাতে।
বিছানায় শুয়েছিলাম একটা গল্পের বই হাতে নিয়ে; তৈমুর স্যারের ‘বংশালের বনলতা’, গল্পগুলো দারুণ, বেশ লাগছিল পড়তে। হঠাৎ সেলফোনটা বেজে উঠল, কিন্তু ধরতে না ধরতেই কেটে গেল। অপরিচিত নাম্বার, তাই আর পাত্তা দিলাম না। অল্প সময়ের ব্যবধানে আরও দুতিনটা মিসডকল পেলাম ঐ একই নাম্বার থেকে। এবার বিরক্ত লাগল, ‘কোন গাধার বাচ্চা এত রাতে মিসকল দিচ্ছে?’ এমনিতেই আননোন কলার, কলব্যাক করার তো প্রশ্নই আসে না। গরজ থাকলে নিজেই ঠিকমত ফোন দিক না! ভাবতে না ভাবতেই এবার আবারো বেজে উঠল মোবাইল। মিসডকল হবার আগেই কলটা এবার সাথে সাথে ধরে ফেললাম, ‘তোর মিসকলের মজা এবার বের করছি, হারামজাদা!’ মনে মনে কথাটা আউরিয়ে নিরাসক্ত কন্ঠে বললাম, “হ্যালো?”
ও প্রান্ত থেকে প্রথমে কোন সাড়াশব্দ পেলাম না, স্রেফ একটা ভারী দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেলাম মনে হল, পুরুষ না নারী তা ঠিক বোঝা গেল না। কলারকে শুনিয়ে এবার আমিও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
কিছুটা টেনে আবারো বললাম, “হ্যালোওও...” তাও কোন সাড়াশব্দ নেই। শেষবারের মত অনেকটা বিরক্ত কণ্ঠেই এরপর বলে বসলাম, “হ্যালো? কে বলছেন? কাকে চাচ্ছেন?”
-- “হ্যা...হ্যালো, ডাক্তার সাহেব?” কিছুটা আড়ষ্ট ভঙ্গিতে একটি নারী কণ্ঠ ভেসে এল।
-- “জ্বী, কে বলছিলেন?” বিস্ময়ের প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে উঠতে চেষ্টা করলাম।
-- “আমি...শর্মিলা।” আড়ষ্টতা পুরোপুরি এখনও কাটিয়ে ওঠেনি, তবে নামটা বলার সাথে সাথে মনে হল অনেকক্ষণ ধরে চেপে রাখা ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল যেন।
-- “শর্মিলা?” মনের ইনডেক্সে একটা কুইক সার্চ শুরু হয়েছিল শোনামাত্রই, কয়েক সেকেন্ড লাগল এবার নামটা খুঁজে পেতে।
-- “জ্বী, শর্মিলা। এরই মধ্যে ভুলে গেলেন?” ইতস্ততা এখন আর নেই বললেই চলে, কণ্ঠস্বর অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।
-- “না, না, ভুলে যাব কেন? তা আপনি এত রাতে, কি ব্যাপার বলুন তো?” একপাশে বইটা রেখে বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালাম।
-- “ব্যাপার কিছুই না, এমনি ফোন দিলাম আর কি। অবশ্য আপনি বিরক্ত হলে...”
-- “ছিঃ ছিঃ, বিরক্ত হব কেন? এই একটু অবাক হলাম আর কি।”
-- “কেন দুদিনের পুরানো পেশেন্ট কি ফোন দিতে পারে না বুঝি?”
-- “তা পারবে না কেন, তবে আমার আবার সেই অর্থে এমন সৌভাগ্য হয়ে ওঠেনি তো...” খানিকটা উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম বলেই সম্ভবত, এরই মধ্যে কখন যে ঘরের ভেতর পায়চারি শুরু করে দিয়েছি তা টেরই পাইনি।
দেখুন, মিথ্যা বলব না; স্বীকার করছি শর্মিলাকে চেম্বারে এই নিয়ে তিন-চারবার যতটুকু দেখেছি তাতে করে মেয়েটার প্রতি আমার সেরকম একটা আগ্রহ না জন্মালেও সেই রাতে কিন্তু ওর কাছ থেকে প্রথম ফোনটা পেয়ে আমার আসলে খারাপ লাগেনি অতটা। হ্যাঁ, মেয়েটার হয়তো একটু রুচিগত সমস্যা থাকতেই পারে, সোজা বাংলায় যাকে আপনাদের মধ্যে বেশ রুচিসম্পন্ন মানুষেরা হয়তো ‘ক্ষ্যাত’ বলতেও দ্বিধা করবেন না; কিন্তু আপনারাই বলুন - মধ্যরাতে উষ্ণ ফোনালাপের একজন সঙ্গী জুটে গেলে আমি তার রুচি ধুয়ে কি এমন কি উদ্ধার করব?!
অস্বীকার করব না, অনেকদিন ধরে তেমন একটা নারীসঙ্গের সান্নিধ্য পাইনি বলেই সম্ভবত, শর্মিলাকে আমি আসলে কিছুটা প্রশয়ই দিয়ে ফেলি। আর সেটাই আমার কাল হয়ে দাঁড়ায়।



।। ৬।।
শর্মিলার সাথে আমার ফোনালাপের পর্বটা বেশ সাদামাটা ভাবেই শুরু হয়। দুজনের পরিবার-পরিজনের খোঁজখবরই প্রথম দুরাতের কথোপকথনের অনেকটা অংশ জুড়ে ছিল। ঐই প্রথম শুরু করে...আমারা এখানে আসার আগে কোথায় ছিলাম, ঢাকাতে কোথায় বাসা, পরিবারে আর কে কে আছে, লেখাপড়া কোথায় করেছি ইত্যাদি ইত্যাদি। অনেকটা যেন বিয়ের আগে ঘটকের পাত্রের খোঁজখবর নেয়ার মত।
স্বভাবতই ভদ্রতার খাতিরে আমাকেও আগ্রহ দেখাতে হয়েছিল শর্মিলার পরিবার আর ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে। ওর সাথে তাই কথা বলে তখন যতটুকু জানতে পেরেছিলাম তা হল, শর্মিলারা দুই বোন, এক ভাই। ওদের বাবা ট্রান্সপোর্টের বিজনেস করতেন, কিন্তু ভদ্রলোক আজ গত হয়েছেন প্রায় পাঁচ-ছয় বছর হতে চলল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। মা বেঁচে আছেন, ডায়বেটিস আর হাই কোলস্টরলে ভুগছেন অনেকদিন হল, তবে এখনো নাকি পাকা গৃহিণীর মতই ঘরদোর সামলে রেখেছেন। বাবার মৃত্যুর আগে ওর বড় বোনটার বিয়ে হয়ে যায় এদিককারই কোন এক সড়ক পরিবহনের নেতার সাথে, তাদের ঘরে এখন দুটো ছেলেমেয়ে। আর ওদের একমাত্র ভাই (দুই বোনের মাঝামাঝি বয়সের দিক থেকে সিরিয়ালে) বেশ দায়িত্বের সাথেই নাকি ওদের পরিবারটিকে আগলে রেখেছেন বাবার রেখে যাওয়া ব্যবসার দেখভালের পাশাপাশি টুকটাক সমাজসেবার মধ্যে দিয়ে, শুনে যেটা বুঝলাম পলিটিক্স-টলিটিক্স করে আর কি।
শর্মিলার স্কুল-কলেজ এখানটাতেই, এখন একাউন্টিং-এ অনার্স পড়ছে কাছেধারেই একটা কলেজে। আমি আর এর থেকে আর বেশি ঘাঁটাইনি। মেয়েটা এমনিতেই বেশ বাঁচাল প্রকৃতির, ফোন করলে সহজে ছাড়তে চাইত না।
তারপরও সত্যি বলতে কি, সব মিলিয়ে আমি কিন্তু শুর্মিলার ঐ সঙ্গটুকু প্রথম প্রথম বেশ উপভোগই করতাম। প্রতিদিন ভাতটাত খেয়ে ঘুমাতে যাবার আগ দিয়ে যখন আমার মুঠোফোনটি বেজে উঠত শর্মিলার কল পেয়ে (মাঝে মধ্যে আমিও ফোন দিতাম অবশ্য), ঢাকা ছেড়ে কাজের তাগিদে এই ছোট্ট মফস্বল শহরটায় পাড়ি দেয়া আমার মত এক নিঃসঙ্গ যুবকের জন্য যখন মেয়েটা কথার ঝাঁপি মেলে ধরত, তখন সে যেমনি হোক না কেন, সেই অতি আহ্লাদ মাখা, কিছুটা টেনে টেনে বলা কথাবার্তার মাঝেও আমি এক ধরণের বিনোদন খুঁজে পেয়েছিলাম। হ্যাঁ, সত্যি বলতে এক দিক দিয়ে ‘বিনোদন’ বললেই মনে হয় ঠিক হবে, মাঝে মধ্যে চলচ্চিত্র সমালোচকরা যাকে বলে ‘টাইমপাসিং এন্টারটেইনমেন্ট’...শর্মিলার সাথে মধ্যরাতের ফোনালাপগুলো আমার কাছে আসলে তার থেকে বেশি কিছু ছিল না।
তাছাড়া শর্মিলার সাথে সম্পর্কটাও আমি আর এর চাইতে বেশিদূর গড়াতে আগ্রহী ছিলাম না। কেননা এই ধরণের মেয়েরা বড়জোর কিছুদিনের জন্য বন্ধু হতে পারে, যেখানে সম্পর্কের পরিধি ফোনালাপ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকাটাই ঠিক আছে, তার বেশী কিছু না। আমার দিক দিয়ে অন্তত, শর্মিলার প্রতি কোনদিনই আমি আসলে সেভাবে রোমান্টিক্যালি ইনভেস্টেড হতে পারিনি। শর্মিলার কথা বলার ঢং, চালচলন, চিন্তাভাবনা কোনকিছুর মধ্যেই না আমার মনের আকাঙ্ক্ষিত নারীর ছায়াটিও কখনো খুঁজেও পাইনি। চোখ বন্ধ করলে আমার স্ত্রী হিসেবে, আম্মার স্নেহধন্য হয়ে থাকা ঘরের বউ হিসেবে যেই ধরণের রুপবতী, মার্জিত ও রুচিশীল একটা মেয়ের ছবি মনের পর্দায় সবসময় ভেসে উঠত, তার সাথে শর্মিলার তফাৎটা ছিল বিস্তর বলতে গেলে।
অন্যদিকে আমার প্রতি শর্মিলার দৃষ্টিভঙ্গি বা মনোভাবটা ছিল যেন তার বেশ খানিকটা বিপরীত। প্রথম দিকে সন্দেহটা অনুমান নির্ভর থাকলেও একটা সপ্তাহ যেতে না যেতেই শর্মিলার বেশ খোলামেলা ব্যবহারে তা যেন আরও স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। মেলামেশার দিক দিয়ে সম্পর্কটাকে ও এবার পরের স্তরে নিয়ে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করে; ‘আমরা বাইরে দেখা করব কবে?’ নানান টালবাহানার মধ্য দিয়ে সুকৌশলে তা কিছুদিন এড়িয়ে গেলেও মেয়েটার সাথে একদিন ঠিকই বাইরে দেখা হয়ে গেল অনেকটা দুর্ভাগ্যক্রমেই বলা যায়।
সেদিন সন্ধার পরপর একটু তাড়াতাড়িই চেম্বার থেকে বেরিয়ে পড়ি টুকটাক কিছু কেনাকাটা করব বলে। ভাবলাম, ক্লিনিকে জয়েন করবার পর সেভাবে তো আর খালা, খালু আর মাকে তেমন কিছুই দেয়া হয়নি; তাই মার্কেটে একটু ঢুঁ মেরে দেখি, পছন্দসই কিছু পেয়ে গেলে তাদের জন্য নিয়ে নিব। আমাদের ক্লিনিকের নিচের দুটো ফ্লোর জুড়ে রমরমা মার্কেট, ওখান থেকেই ঝটপট কেনাকাটাটা সেরে ফেলে সিদ্ধান্ত নিলাম ঘরের জন্য এবার না হয় কিছু খাবারদাবারও নিয়ে যাই। দোতলার সামনের দিকটায় দুই-তিনটা ফাস্ট ফুডের দোকান আছে, যার একটাতে আবার ভাল পেস্ট্রি আর পেটিস পাওয়া যায়। যেই ভাবা সেই কাজ, কিন্তু ওখানে গিয়েই ধরাটা খেয়ে বসি।
খাবারের দোকানটায় পা রাখতেই শর্মিলাকে দেখতে পেলাম। ও কর্ণারের একটা টেবিলে বসে আরও দুটো মেয়ের সাথে গল্প করছিল। আমার সাথে চোখাচোখি হতেই নিমিষের মধ্যে ওর চেহারা জুড়ে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল। যেহেতু চোখাচোখিটা হয়েই গেছে, তাই আর এড়িয়ে যাবারও সু্যোগ ছিল না সেই মুহূর্তে। দুষ্টু-দুষ্টু একটা হাঁসি নিয়ে দ্রুত উঠে এসে বলল, “কি ব্যাপার? আপনি এখানে? আপনার না চেম্বার আর বাসা ছাড়া কোথাও বেরোবার সময়ই হয় না, তা আজ এখানে কি মনে করে?”
“না মানে হঠাৎ করেই এই একটু শপিং-এ বেরিয়েছিলাম। আজ চেম্বারে তেমন একটা ভিড় ছিল না তো তাই...” অপ্রস্তুত ভাবটা যতটা সম্ভব রাখঢাক করে বললাম।
-- “হুমম, বুঝলাম। তা আসুন না, একটু বসি কোথাও। এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে ভাল লাগছে না।”
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম বলেই হয়তোবা, দোকানে উপস্থিত সবার দৃষ্টি তখন আমাদের উপরই নিবদ্ধ ছিল। তার উপরে শর্মিলার সাথের মেয়ে দুটো যেভাবে মাথা ঘুরিয়ে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়েছিল, আমি আর ওর প্রস্তাবটা মুখের উপর ফিরিয়ে দিলাম না; মেয়েটা না আবার কষ্ট পেয়ে বসে।
সেদিন রাতে আর তার পরের দুটো দিন শর্মিলা কোন ফোনই দিল না। অবাক লাগল, ভাবলাম মেয়েটা আবার কোন কারণে অভিমান-টভিমান করে বসল কিনা ওদিনের ব্যবহারে। হ্যাঁ, আমার আচরণে কিছুটা আড়ষ্ঠতা বোধ থেকে থাকতে পারে, কিন্তু আমি তো ওর সাথে যথেষ্ট মার্জিত ভাবেই কথাবার্তা চালিয়ে গিয়েছিলাম বলে মনে পড়ে। খুব একটা কথা হয়নি অবশ্য আমাদের মধ্যে, দুজন দুটো কোক আর স্যান্ডুইচ সাবাড় করেই চলে এসেছিলাম। আমিই আগে বের হয়ে আসি, বাসায় ফিরে একটা দাওয়াতে যেতে হবে এই অজুহাত দিয়ে।
মেয়েটা তারপরও আরেকটা কান্ড ঘটিয়ে বসল। কথা নেই, বার্তা নেই, দুদিন পর বিকেলবেলায় সোজা এবার চেম্বারে এসে হাজির। আবদার করে বসল, “চলেন না, কাছেধারে কোথাও থেকে একটু বেরিয়ে আসি।”
কপালের ফের বলতে হয়, সেদিন বিকেলে পেশেন্টের উপস্থিতিও ছিল অনেকটাই কম। তারপরও ঐ আপদ থেকে তৎক্ষণাৎ উদ্ধার পাবার জন্য একটু মিথ্যা বলতে বাধ্য হলাম, “আজ তো বেশ কিছু ইম্পর্ট্যান্ট অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে, এখন তো বেরানো যাবে না।” কথাগুলো কিছুটা আস্তে আস্তে, চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছিলাম বলেই কিনা জানি না, শর্মিলাকে মনে হল কপাট রাগ করল। কেমন যেন ভাবলেশহীন ভাবে কিছুক্ষণ নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, “ঠিক আছে, আমি বাইরে ওয়েট করছি। দেখি আজ আপনার কয়টা ইম্পর্ট্যান্ট পেশেন্ট আসে।” আমাকে অবাক করে দিয়ে গটগট করে রুম থেকে বেরিয়ে বাইরে গিয়ে বসল শর্মিলা।
পেশেন্ট বলতে এরপর এসেছিল মাত্র একজন, তাও খুব সামান্য প্রয়োজনে, বেশীক্ষণ আটকে রাখা যায়নি। একঘণ্টা পর পর্দাটা আলতো সরিয়ে দেখি শর্মিলা তখনও ওয়েটিং রুমে বসে আছে। বুঝলাম, আজকেও আর এড়িয়ে যাবার কোন চান্স নেই, হাতেনাতে কট যাকে বলে।
“চলুন, এবার তাহলে যাওয়া যাক।” আর কালক্ষেপণ না করে শর্মিলার সাথে বেরিয়ে পড়লাম আমি।
একটা রিক্সা নিল মেয়েটা, গন্তব্য অত্র এলাকার সেই বিখ্যাত মায়াদীঘির ঘাট। সারাটা পথ রিক্সায় তেমন একটা কথা হল না। তবে কিছুদূর যেতেই মনে হল একটা মোটর সাইকেলে চড়ে দুটো ছেলে যেন পিছন-পিছন আমাদেরকে ফলো করে আসছে। কোন ঝামেলা হল না অবশ্য, নির্ঝঞ্ঝাট ভাবেই পৌছে গেলাম আমরা বনমালা রোডের শেষ মাথায় মায়াদীঘির ঘাটে।
বেলায়েত সাহেব বাড়িয়ে বলেননি; বিকেলবেলা জায়গাটা আসলেই যেন একটা প্রেমকুঞ্জ হয়ে ওঠে। জোড়ায় জোড়ায় কিছুদূর পরপর অল্প বয়েসি ছেলেমেয়েরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। কেউবা গাছের নিচে, কেউবা ছোট ছোট বেঞ্চিতে। তবে জায়গাটা আসলেই বেশ সুন্দর। টলটলে দীঘির সাথে লাগোয়া মোটামুটি বড়সড় পার্কের মত একটা স্থান, গাছগাছালিতে ঘেরা। বন্ধুবান্ধব বা পরিবার-পরিজন মিলে ঘুরতে আসার মত।
আমি আর শর্মিলাও খালি একটা বেঞ্চি পেয়ে বসে পড়লাম। একটা অদ্ভুত ব্যাপার আমার নজর এড়ালো না; মাঝে মধ্যে কেউ কেউ না আড়চোখে আমাদের দিকে তাকাচ্ছিল। প্রথমে ভাবলাম প্রতিদিনকার ভিড়ে আমরা এখানে নতুন সংযোজন বলেই হয়তবা ওরকম করে দেখছে; কিন্তু পরোক্ষণেই আবার মনে পড়ল, ক্লিনিক থেকে বেড়াবার পরে রিক্সায় ওঠার সময় কিংবা সেদিন সেই ফাস্ট ফুডের দোকানেও আশেপাশের অনেকেই তো এভাবে কেমন অবাক চোখে তাকাচ্ছিল আমাদের দিকে।
“জায়গাটা সুন্দর না?” ভাবনায় ছেদ ঘটাল শর্মিলার প্রশ্নটা।
-- “হ্যাঁ, বেশ সুন্দর।”
-- “আগে এর চাইতেও সুন্দর ছিল অবশ্য, যখন সত্যি সত্যি এখানে একটা বাঁধানো ঘাঁট ছিল। তারপর দেখতে দেখতে অনেক কিছুই কেমন বদলে গেল। মনে পড়ে...একবার বাসার সবাই মিলে আমরা এখানে পিকনিক করতে এসেছিলাম। তখন এই পাশটা আরও অনেক নিরিবিলি ছিল, এত লোক সমাগম হত না। আপু তখন কলেজে পড়ত আর ভাইয়া সেই বছর ম্যাট্রিক দিল; সত্যিই, ছবির মত সুন্দর ছিল দিনগুলো।”
এরপর বেশ কিছুক্ষণ আমাদের মধ্যে কোন কথা হল না। দুজনেই চুপচাপ বসে চারপাশের মনোরম পরিবেশ উপভোগ করতে লাগলাম; আমি অন্তত।
কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম সম্ভবত, না হলে শর্মিলা হঠাৎ করে যখন বলে উঠল, “তাকান তো এদিকে!”, কিছু বুঝে উঠার আগে ওর দিকে তাকাতেই ‘খ্যাচ!’
না, ছুরিটুরি মেরে বসেনি, সেলফি তুলল একটা, আমাকেসহ। বেশ অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেলাম, সেলফিটা কি না তুললেই হত না?
একটা সময় কোথা থেকে এক বাদামঅলা এসে জুটল। শর্মিলার দিকে এগিয়ে এসে বলল, “আফা, বাদাম খাইবেন?”
-- “দাও দেখি পাঁচ টাকার।” ও কিছু বলে ওঠার আগে আমিই আগ বাড়িয়ে বাদাম দিতে বললাম। ভাবলাম, চুপচাপ বসে থাকার চেয়ে বাদাম খাওয়া ভাল, টাইমটা পাস হবে।
আয়েশ করে এবার বাদাম খেতে বসলাম। লক্ষ্য করলাম, শর্মিলা নিজে খাচ্ছে কম, আমার দিকেই ছিলে ছিলে এগিয়ে দিচ্ছে বেশি।
বেশ মনোযোগ দিয়ে পেটমোটা একটা বাদাম ছিলতে ছিলতে গলাটা হঠাৎ একটু নিচু করে বলে উঠল, “আপনি মানুষটা না কেমন যেন, মাঝে মধ্যে ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। নিজেকে মনে হয় এক ধরণের ধোঁয়াশার মধ্যে রাখতেই পছন্দ করেন, না?”
জবাবে একগাল হেঁসে বললাম, “কী যে বলেন না, আমাকে আবার না বুঝার কি আছে? আই অ্যাম লাইক অ্যান ওপেন বুক।”
মৃদু হেঁসে শর্মিলা এরপর যা বলল তার জন্য আমি আসলে প্রস্তুত ছিলাম না, “আচ্ছা, আপনি এখনো আমাকে ‘আপনি’ করে বলেন কেন? বয়েসে তো কয়েক বছরের ছোটই হব আপনার থেকে, আমাকে তো তুমি করেই বলতে পারেন।”
কিছুটা সময় নিয়েই এবার একটু ভেবে জবাব দিলাম, “দেখুন, আপনি-তুমিটা বড় কথা না, বিষয়টা হল প্রোফেশনাল কার্টেসি। আর সেদিক দিয়ে ভেবে দেখলে আমার মতে ‘আপনি’টাই মনে হয় ঠিক আছে।”
--“আপনি কি তাহলে প্রোফেশনাল কার্টেসির খাতিরেই আমার সাথে এখানে এসেছেন?” এক ধরণের কাঠিন্য ধরা দিল শর্মিলার মুখায়বে।
--“জ্বী, না মানে...ব্যাপারটা মনে হয় সেভাবে দেখলেই ভাল হয়...” আমতা আমতা করে বললাম কোনরকমে।
শর্মিলার মুখটা কিছুক্ষণের জন্য একটু চুপসে গেল মনে হল যেন, তবে সাথে সাথে আবার অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। মেয়েটার হাবভাব আমার সুবিধার ঠেকল না, ভালয়-ভালয় তাড়াতাড়ি এখান থেকে কেটে পড়াটাই মনে হল বুদ্ধিমানের কাজ হবে। এমনিতেই সন্ধ্যা হয়ে আসছিল, তার উপর মেয়েটা আবার একটু দমে যাওয়াতে আমিও আর সুযোগটা হাতছাড়া করলাম না। যাবার জন্য দুইএকবার তাড়া দিতেই উঠে দাঁড়াল।
ক্লিনিক পর্যন্ত আমরা একসাথেই এলাম, এবারো পথে তেমন একটা কথা হল না। বাইকের সেই ছেলে দুটোকে আবারো দেখলাম আমাদের পিছন পিছন আসতে। একবার ভাবলাম, শর্মিলাকে জিজ্ঞেস করি ছেলে দুটো ওর পরিচিত কিনা, পরে আবার ভাবলাম দরকারটা কি মেয়েটাকে দুশ্চিন্তায় ফেলে, ওরা তো আমাদের ক্ষতি করছে না কোন কিংবা সেভাবে এখন পর্যন্ত কোন উৎপাত বা বিরক্তও তো করেনি। ক্লিনিকের সামনে নামিয়ে দিতেই শর্মিলাকে দেখলাম এক সাইডে পার্ক করে রাখা একটা মেরুন রঙের প্রাইভেট কারে উঠে গেল। আমারও সাথে সাথে মনে পড়ল, বিকেলে ওর সাথে বের হবার সময় এই গাড়িটাকেই যেন ঠিক একই জায়গাতে পার্ক করা দেখেছিলাম। তবে কি ও এই গাড়ীতে চড়েই এসেছিল? তাহলে মায়াদীঘিতে যেতে গাড়ীটা নিল না কেন? আমি ছিলাম বলে?...অদ্ভুত তো!
।। ৭।।
পরদিন বেশ সকাল-সকাল ক্লিনিকে চলে এলাম। নিচ থেকে চা-সিগারেট খেয়ে চেম্বারে এসে দেখি এক ভদ্রলোক এসেছেন স্কেলিং করাতে, তিনি বিদায় নিতেই মিল্টনকে দেখলাম কেমন যেন উস্কুস করছে কিছু একটা বলবে বলে। একটা সময় আমিই ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “কি ব্যাপার, মিল্টন? তখন থেকে দেখছি কেমন ঘুরঘুর করছ, কিছু বলবে?”
কিছুটা ইতস্তত ভাব নিয়েই মুখ খুলল মিল্টন, “দেখেন স্যার, কিছু মনে করবেন না। আপনাকে অনেক সন্মান করি বলেই মন হল ব্যাপারটা নিয়ে আপনার সাথে একটু কথা বলা দরকার। ছোট মুখে বড় কথা হয়ে গেলে বেয়াদবি মাফ করে দিয়েন। কাল একবার মনে হল আপনাকে বলি, কিন্তু পরে আর সাহস হয় নাই। কিন্তু এদিকে আবার না কোন ঝামেলা...”
--“এত ভনিতা না করে আসল কথায় আসো। কি বলবে, বল।”
একটু দম নিয়ে এবার কিছুটা অভিযোগের সুরেই বলল, “স্যার, কাল যে শর্মিলা ম্যাডামকে নিয়ে ঘুরতে বের হলেন, এদিকে ল্যাংড়া বাদলের বিষয়টা কি একবারও ভেবে দেখছেন?”
--“কে? ল্যাংড়া বাদল? সে আবার কে? আর শর্মিলার সাথেইবা তার কি সম্পর্ক?”
মিল্টন যে এভাবে সরাসরি শর্মিলার প্রসঙ্গটা টেনে আনবে তা আমি ঘুণাক্ষরেও ধারণা করতে পারিনি, তাই মনে মনে একটু চমকালাম বটে, আর ল্যাংড়া বাদলের নামটা তো তখনও আমার কাছে অপরিচিত।
--“হায় খোদা! সে তো দেখি আপনাকে তাইলে কিছুই বলে নাই! সাংঘাতিক তো! আসলে আপনি বাইরে থেকে আসছেন দেখে আস্তে করে চেপে গেছে মনে হয়।”
--“মানে? কি বলতে চাচ্ছ? আমি তো আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না।”
--“স্যার, অত্র এলাকার কুখ্যাত সন্ত্রাসী ল্যাংড়া বাদল...আপনার শর্মিলা ম্যাডামের ভাই!”
ঘরের ভেতর একটা বোমা ফাটল যেন। আর বিস্ফোরণের পরে চারপাশ যেমন শুনশান হয়ে আসে, রুমটার ভেতরও কেমন যেন এক ধরণের অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এল। কয়েক সেকেন্ড লাগল কথাটা হজম করে নিতে। মিল্টনকে দেখে মনে হল এত নাটক করে এমন একটা তথ্য দিতে পেরে কিছুটা যেন তৃপ্তি বোধ করছে, বুকের ভেতর আটকে থাকা একটা পাথরের ভার থেকে যেন ও মুক্তি পেল।
ছোট্ট একটা বিরতি নিয়ে আবার বলতে শুরু করল, “বিগত পাঁচ ছয় বছর যাবত শেঠের বাজারসহ এর আশেপাশের কয়েকটা এলাকার ডন হয়ে বসে আছে ল্যাংড়া বাদল। ডেয়ারিং সব পোলাপাইন নিয়ে বিশাল একটা গ্যাং আছে তার, বাদল নিজেসহ যার অনেকেই একাধিক মার্ডার কেসের আসামি। তবে যা হয় আর কি, ক্ষমতার জোরে বাদল বাহিনী আজও ধরাছোঁয়ার বাইরে।”
--“কিন্তু শর্মিলা তো আমাকে বলেছিল ওর ভাই বলে ওদের কি বিজনেস দ্যাখে আর পলিটিক্স করে...” গলার স্বরে তেমন একটা জোর পেলাম না যেন।
--“আরে স্যার, তবে আর বললাম কি?! পলিটিক্স করেই তো এতদূর আসা! রুলিং পার্টির ছাত্র সংঘটন দিয়ে শুরু, এমনকি ছাত্রনেতাও হতে পারছিল কিছুদিনের জন্য। পরে বেশ কয়েকটা মার্ডার চার্জে পড়ে গেলে এক সময় বহিষ্কৃতও হয়। কিন্তু ওসব তো নাটক মাত্র, কেননা তার দেমাগ আর প্রতিপত্তি দিনে দিনে বরং বেড়েই গেছে, কমে নাই। আসলে স্যার কঠিন ব্যাকআপ আছে পিছনে, যতদূর জানি এখানকার এম.পি. উনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আর তার উপরে দুলাভাইটা আবার পরিবহন নেতা, আর কিছু লাগে, বলেন?”
ঢোক গিললাম একটা, কেমন যেন বেশ তেষ্টা পাচ্ছে মনে হল। একটু পানি খেতে পারলে ভাল হত।
আমাকে দেখে কি বুঝল কে জানে, ছেলেটা আরও স্বতর্স্ফুর্ত ভাবে ল্যাংড়া বাদলের ‘গুণকীর্তন’ গেয়ে চলল; বাদলের ল্যাংড়া হবার ইতিহাস, দুএকটা চাঞ্চল্যকর বীভৎস মার্ডার কেসের কাহিনীসহ এলাকায় ওর ত্রাস হয়ে থাকার নানান নমুনা, “এই যে স্যার এখানে আজ মার্কেটটা হল, ক্লিনিক হল, এসব কি আর এমনি এমনি হতে পারছে বলে মনে করেন বাদলের অনুমতি ছাড়া? ওর গ্রুপের ছেলেপেলে মাসে মাসে যে কিরকম টাকা উঠায় নেয় এখান থেকে খোদাই জানে! অবশ্য এই ব্যাপারে আমাদের ফরিদ স্যার ভাল বলতে পারবেন, উনাকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখবেন, তাহলে আইডিয়া পাবেন।”
মনে পড়ল, টেবিলের পায়ার কাছেই তো একটা পানির বোতল রাখি সবসময়। বোতলটা তুলে এবার কিছুটা পানি ঢকঢক করে খেয়ে নিলাম।
--“এছাড়া শর্মিলা আপার ব্যাপারে আমি আর কি বলব, স্যার? আপনি মিশছেন, আপনিই ভাল জানেন। তবে উনি আপনাকে কতদূর কি বলছে জানি না, উনাকে কিন্তু এর আগেও বেশ কয়েকজনের সাথে এদিকওদিক ঘুরতে দেখা গেছে। কিছুদিন খুব ঘুরাঘুরি করে, পরে কি হয় আল্লাহ্ই জানে! শেষে গিয়া বাদলের পোলাপাইনের কাছে চরথাপ্পড় খেয়ে এলাকা ছাড়ে ছেলেপেলেগুলা। এই কারণেই স্যার আপানাকে এত কিছু বলা। আপনি স্যার ভাল ফ্যামিলির ছেলে, দুইটা কথা বললেই বুঝা যায় অনেক লেখাপড়া করা আদব-লেহাজ জানা মানুষ; আর আপনার মত একজনকে যদি দেখা যায় বাদলের ঐ বোনের সাথে ইদ্রীসের পেটিসের দোকানে কিংবা দীঘির পাড়ে বসে বাদাম খাইতে তাইলে কেমন লাগে বলেন? আপনাকে স্যার খুব পছন্দ করি বলেই কথাগুলা বললাম, বেয়াদবি নিবেন না। বাদলের চ্যালাচুমান্ডরা এখন কবে যে এসে আপনার উপর চড়াও হয় এলাকার লোকজন এখন ঐ চিন্তায় অস্থির।”
--“এলাকার লোক!?” বলে কি ছেলে! চেম্বারের বাইরে শর্মিলার সাথে এই নিয়ে মাত্র দুটো সিটিং দিয়েছি, আর এরমধ্যেই তা রাষ্ট্র হয়ে গেল!
মিল্টন মনে হচ্ছে এখন আমার থট রিডও করতে শিখে গেছে; বলল, “কি আর করবেন স্যার? ছোট এলাকা, মানুষ বেশি। কথা কি আর একজন-দুইজনের পেটে চাপা থাকে? তাই স্যার বলি পানি আর বেশিদূর গড়াবার আগে যা করবেন, ঠান্ডা মাথায় নিশ্চই ভেবে চিন্তেই করবেন। আপনি শিক্ষিত, বুদ্ধিমান মানুষ। আপনাকে আমি সবক দেবার কে?”
সবক যা দেবার তা এতক্ষণ দিয়ে মিল্টন এরপর কেটে পড়ল একজন পেশেন্ট এসে পড়াতে।
কপালে হাত দিয়ে দেখলাম বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। গরমটা সম্ভবত আজ একটু বেশিই পড়েছে।
(চলবে...)

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form