বিষয়টি দেখে ফারাবী অনেকটা অবাক হয়। সাবিহা ভয়ে চোখ বন্ধ করে তাকে জড়িয়ে ধরে আছে। থরথর করে হাত কাঁপছে তার। হঠাৎ প্রচন্ড বজ্রপাত হয়, সঙ্গে তীব্র বৃষ্টি! ঝড়ো বাতাসে খোলা জানালার পর্দাগুলো এলোমেলো ভাবে উড়তে শুরু করে। একগাল হেসে সাবিহাকে ছাড়িয়ে জানালা লাগিয়ে পর্দা টেনে দিল ফারাবী।
- কি করছো? সাবিহা বলল
- ফুলদানিটা ভূতে নয়, বরং এই তীব্র বাতাসে ফেলেছে। হাসতে হাসতে ফারাবী বলল
পর্দা টেনে দিয়ে সাবিহার কাছে এসে বলল, ওসব ভেবো না, এবার চুপ করে ঘুমিয়ে পড়ো। রাত অনেক হয়েছে।
- তুমি ঘুমোবে না?
- হুম, তবে তোমায় ঘুম পাড়িয়ে দিব তারপর।
ফারাবীর কথা শুনে মুচকি হাসলো সাবিহা, সাবিহাকে শুইয়ে কম্বল টেনে দিল ফারাবী। বিছানার পাশে ড্রেসিং টেবিলের টুলে বসে সাবিহার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে থাকলো। বাহিরে ঝড়ো বাতাস বইছে, সাথে প্রচন্ড বৃষ্টি। বৃষ্টির তীব্র ফোটায় জানালার গ্লাসে ঠাস ঠাস শব্দ হচ্ছে, বাতাসের কারণে শা শা শব্দ। এখনো ইউনিফোর্ম খুলেনি ফারাবী, শরীরটা বেশ ভারি ভারি মনে হচ্ছে। হওয়ারই কথা, বুট, বুটের সঙ্গে প্যান্টের পা পুরোপুরি গুজে রাখা। ফুল হাতা শার্ট, সাথে হাতের বোতামটাও বন্ধ, কোমরে শক্ত বেল্ট। এমনকি মাথাটাও ঢেকে রেখেছে মিলিটারি ক্যাপ। সাবিহা চোখ বুজে শুয়ে আছে এখনো, হয়তো ঘুমের জগতে পারি দিয়েছে। মাথা থেকে মিলিটারি ক্যাপটি খুলে সেটার দিকে তাকালো ফারাবী, ক্যাপটি পুরোপুরি চারটি রঙে ঢাকা। সবুজের অর্থ বাংলা, কালো হলো শোক, বাদামিতে বুঝায় শহীদের রক্ত। এবং ধূসরের অর্থ...ফারাবী আর ভাবলো না। পাশ ফিরে তাকালো দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা বড় দেয়াল ঘড়িটির দিকে। রাত ১১:৫৯ মিনিট। ফারাবী তাকিয়ে থাকতেই মিনিটের কাটাটি এগিয়ে বারোটায় পরিণত করলো রাতটিকে।
এখন রাত ৩:০০টা। খ্রিষ্টানদের কবরস্থানটি ভরে আছে পূর্ণিমার আলোয়। বৃষ্টি থেমে গিয়ে আকাশটি এখন মেঘ মুক্ত। কবরস্থানের এক গাছে পেঁচা ভূতুড়ে ভাবে ডাকছে। চারদিক নির্জন, শুধু পেঁচার ভূতুড়ে অশুভ ডাকগুলো ছাড়া। কবরস্থানের বেশ ভেতরের একটি কবরের উপরের প্লেট হঠাৎই যেন নড়ে উঠলো! প্লেটটি কিছুটা সরে গিয়ে লম্বা নখওয়ালা হাত বেরিয়ে এসে প্লেটটি সরাতে থাকে, তা দেখে ডানা ঝাপটাতে শুরু করে ভূতুম পেঁচাটি। প্লেটটি সরে গিয়ে সেখান থেকে উঠে আসে এক জ্যান্ত লাশ! পরনে কালো কোট, হাতের প্রতিটি নখ ভাল্লুকের নখের মতো, শরীরের চামড়া অনেকটা ফ্যাকাসে সাদা। উঠে দাঁড়িয়ে মাথা তুলে পেঁচার দিকে তাকালো জ্যান্ত লাশটি, মূহুর্তেই সাদা পেঁচাটি ডানা ঝাপটে উড়ে গেল। টলতে টলতে জ্যান্ত লাশটি এগিয়ে গেল কবরস্থানের পাশের বাড়িগুলোর দিকে। তার কবরের সাইন বোর্ডে লেখা 'রজার্স হার্ন'!
বাড়ির সবাই গভির নিদ্রায় মগ্ন, বৃষ্টি হয়েছে বলে বেশ আরামে ঘুমোচ্ছে বাড়ির সবাই। হঠাৎ দরজায় কড়ানাড়ার শব্দ! ঘুম হালকা হওয়ায় ওপাশ ফিরে ঘুমালো ড. হ্যারি। পুনরায় ঠকঠক শব্দ, ড. হ্যারি উঠে বসলো। বেশ অদ্ভুদ রকমের কড়া নাড়ছে। আবার দরজায় ডাকতেই হ্যারি সাড়া দিল, কে ওখানে? এত রাতে কি চাও? কোনো উত্তর এলো না দরজার অপর প্রান্ত থেকে, ড. হ্যারি বসে থাকা অবস্থায় পুনরায় ঠকঠক শব্দ! ড. হ্যারি ভাবলো, হয়তো কেউ ঔষধের জন্য এসেছে। কেন না সে সরকারি ডাক্তার। বিরক্তি ভাব নিয়ে কম্বল সরিয়ে দরজা খুলল ড. হ্যারি। দরজা খুলতেই তার শরীরের সমস্ত রক্ত যেন হিম হয়ে গেল, তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক ভয়ানক রূপের অধিকারী!
- ড. হার্ন তুমি, তুমি বেঁচে আছো? তোমার মুখের এ অবস্থা কেন? কাঁপা কন্ঠে ড. হ্যারি বলল
- কাঁচা মাংস হবে?! গম্ভীর কন্ঠে ড. হার্ন বলল
- কাঁচা মাংস?!
কথাটি শুনে যেন বুক কেঁপে উঠে ড. হ্যারির। হার্ন মাথা দুলিয়ে বলল,
- হ্যাঁ, দাও। খুব ক্ষুধা পেয়েছে!
- কি বলছো এসব? কে তুমি?
- ড. রজার্স হার্ন!
- কিসের কাঁচা মাংস! যাও এখান থেকে!
- দিবে না?
- না, যাও!
- শেষবার বলছি।
- অসহ্য!
দরজা লাগিয়ে দিতে চাইল ড. হ্যারি, তবে হার্ন ধরে ফেলে!
- কি হয়েছে এত রাতে বিরক্ত করছিস কেন! ড. হ্যারি বলল
- আমি রক্ত চাই!
- কি!
হঠাৎ ড. হ্যারির উপর ঝাপিয়ে পড়ে হার্ন, মূহুর্তেই বাড়ি জুড়ে এক ভয়ানক আর্তনাদ!
পরদিন সকালে,
- ফারাবী? সাবিহা বলল
- হুম? ফারাবী বলল
- পেপার দেখেছো?
- সময়ই তো হয়না, কেন?
- একজন সরকারি ডাক্তারের রহস্যময় মৃত্যু।
- রহস্যময়?
সাবিহার কাছ থেকে পেপারটি নিয়ে দেখলো ফারাবী। একটি মৃতদেহের ছবি, তার নিচে কি কি যেন লেখা।
- লোকটির শরীরের সমস্ত রক্ত কিছু যেন সুষে নিয়েছে, সমস্ত শরীর সাদা হয়ে আছে। এবং দেখো, তার ঘাড়ের পাশে দুটো দাঁতের চিহ্ন!
সাবিহার কথা শুনে ছবির নিচে লেখা আর্টিকেলটি পড়ার চেষ্টা করলো ফারাবী। সাবিহা যা বলেছে, তাই সত্য। ছবিতে দাঁতের চিহ্ন দুটো স্পষ্ঠ দেখা যাচ্ছে।
- আচ্ছা শুনো।
- হুম? সাবিহার ডাকে ভাবনায় ছেদ পড়লো ফারাবীর
- তুমি ফিরতে বেশি রাত করবে না প্লিজ।
- কেন?
- দেখছো না কি লেখা?
- আরে পাগলী, এটা ভূত বা ড্রাকুলা যাই হোক না কেন, এই ক্যান্টনমেন্ট এ্যারিয়াতে শিকার খুঁজতে এলে বেচারা নিজেই শিকার হবে।
- কিভাবে?
- ক্যান্টনম্যান্ট এ্যারিয়ায় দিন রাত চব্বিশ ঘন্টাই গার্ড থাকে, সি সি ক্যামেরা থাকে। আর এই আজগুবি বানোয়াট গল্পে আমি বিশ্বাস করিনা।
পেপারটি বিছানার উপর রেখে অফিসে চলে গেল ফারাবী। সাবিহা পেপারটি তুলে ছবিটির দিকে তাকালো। ফারাবী সেনাবাহিনীর লোক, তাই এসব বিশ্বাস না করারই কথা।
অফিসের চেয়ারে গিয়ে বসলো ফারাবী, পাশের চেয়ারে একসঙ্গে তিনজন গাদাগাদি করে কি যেন করছে। ফারাবী অনেকটা রাগের ভঙ্গিতে বলল, এই, তোরা কাজ বাদ দিয়ে কি করছিস? ফারাবীর কথা শুনে তার দিকে তাকায় তিনজন।
- দেখ না, পেপারে কি লিখেছে। শহরে নাকি ড্রাকুলা এসেছে! ক্যাপ্টেন সজীব বলল
- আরে গাধা, এটা ড্রাকুলা নয় কোনো রাক্ষস হবে। ক্যাপ্টেন রুহুল বলল
- তাহলে ড্রাকুলা কি? তুই নাকি সজীব? ক্যাপ্টেন দিব্যর বলল
এমন সময় হঠাৎ সজীবের হাত থেকে পত্রিকাটি ছিনিয়ে নিল ফারাবী, তা দেখে হা করে ফারাবীর দিকে চেয়ে রইল তারা। ফারাবীর ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে যেন সেই লোকটির রক্ত চুষে খেয়েছে!
- এটা কার টেবিল? ফারাবী বলল
- আমার। ক্যাপ্টেন সজীব বলল
- রুহুল আর দিব্য, এখনই এখান থেকে যা। ফারাবী বলল
- ধুর ভাই, আমরা তো... ..
- নয়তো এখন তোদের রক্ত খাব! ফারাবী বলল
- আরে বাবা যাচ্ছি যাচ্ছি, শান্ত হো। দিব্য চল।
সেখান থেকে নিজেদের টেবিলে চলে গেল ক্যাপ্টেন রুহুল ও ক্যাপ্টেন দিব্য। পেপারটি রেখে নিজের টেবিলে গেল ফারাবী।
- আমার বিশ্বাস হয়না যে তোরা এসবে বিশ্বাস করিস! চেয়ারে বসতে বসতে ফারাবী বলল
- কিসের কথা বলছিস? ক্যাপ্টেন সজীব বলল
- কিসের আবার! এই ড্রাকুলা না রাক্ষস, ওটার কথা।
- কথাটি তো আমারও বিশ্বাস হয়না, তবে মিডিয়া সব কাঁপিয়ে ফেলেছে।
উত্তরে কিছু বলল না ফারাবী। তার মনে একটাই কথা, এসব মিথ্যা। নিজেদের নাম কামাতে লোকে কত কিই না করে। এবারও যা ভাইরাল হয়েছে, তাও নাম কামানোর এক নতুন ধান্দা।
সেদিন রাত ৩:০০টা।
চাঁদটি পুরোপুরি মেঘে ঢেকে আছে। পরিত্যাক্ত এক খ্রিষ্টান বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে রজার্স হার্ন! পাশের গির্জায় ঢং ঢং শব্দ। রক্তের পিপাসা ও তীব্র ক্ষুধায় আশেপাশে তাকালো হার্ন রূপের ড্রাকুলা। পুরোপুরি নির্জন রাস্তা, মাঝে মাঝে দুয়েকটা কুকুরের রক্ত হিম করা ভূতুড়ে ডাক শোনা যাচ্ছে। এক পা দু পা করে সামনে এগিয়ে গেল হার্ন।
হাসপাতালে কেউ নেই, দু একজন গার্ড ছাড়া। মর্গের দরজার পাশের চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছে একজন সিকিউরিটি গার্ড। প্রতিটা রাতই তার এভাবেই কাটে। হঠাৎ খট করে একটা শব্দ হলো, মূহুর্তেই হালকা ঘুমটি ভেঙে গেল তার! উঠে দাঁড়িয়ে আশেপাশে টর্চের আলো ফেলল, কেউ নেই। তবে পায়ের শব্দ স্পষ্ঠ! মর্গের ঘটনা ভেবে দরজা খুলল সে, পুরো রুমে স্ট্রেচারে শোয়ানো ও সাদা কাপড়ে ঢাকা লাশ, আভছা আলো এসে পড়ছে সমস্ত রুমে। টর্চ মেরে রুমের ভেতরটা ভালো করে দেখলো সিকিউরিটি গার্ড। রুমে কাউকে না পেয়ে বের ওয়ার জন্য পেছন ফিরবে এমন সময় একটি ঠান্ডা হাত পেছন থেকে তার হাত চেপে ধরলো! রক্ত যেন হিম হয়ে গেল তার, ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো।
- তুমি কে!
বলেই পিছু হটলে লাগলো সে, তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো হার্ন। গার্ডি পালাতে যাবে এমন সময় হার্ন তার ঘাড়ে সুচালো দাঁত বসিয়ে দেয়, যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠে সে! নিচে লুটিয়ে পড়ে, হার্ন তার রক্ত খায়নি। মর্গের ভেতর প্রবেশ করে হার্ন, একটি লাশের পাশে গিয়ে সাদা কাপড়টি সরায়। ক্ষুধায় জিবে জল চলে আসে তার, তার মুখের লালা এসে পড়ে লাশটির মুখে। হার্ন তার লম্বা নখ দিয়ে লাশের বুক ছিড়তে থাকে, সাথে লাশের রক্তগুলো ছিটকে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। হার্ন সেগুলো পাগলের মতো চেটে খায়, বুকের ভেতর থেকে কলিজা ছিড়ে নিয়ে কচ কচ চিবুতে থাকে। এর মাঝে নতুন ভ্যাম্পায়ারের রূপে চোখ মেলে তাকায় মর্গের দরজার পাশে পড়ে থাকা সিকিউরিটি গার্ড!
পরদিন সকালে। অফিসের ফাইলে কাজ করছে ফারাবী। কেন যেন কাজে মন বসছে না আজ, দুদিন যাবত ভ্যাম্পায়ারের গল্পগুলো শুনে বেশ ভয় পাচ্ছে সাবিহা। হঠাৎ টেবিলের পাশে রাখা সাদা টেলিফোনটি বেজে উঠলো, টেলিফোনটি তুলে কানে লাগালো ফারাবী।
- হ্যালো ক্যাপ্টেন ফারাবী বলছি।
- ফারাবী আমি রায়হানের মা।
- আন্টি? হঠাৎ আমায় ফোন করলেন কেন? সব ঠিক আছে তো?
(চলবে..)
লিখাঃ ফারহান আহমেদ ফারাবী
দ্যা হন্টেড নাইট (পর্ব ৩)