প্রীতিলতা❤ Nowshin Nishi Chowdhury ২য় খন্ড


১৬ তম পর্ব🍂

সূর্যের অকৃত্রিম মিষ্টি রোদের ছটা মুখের উপ ভেঙ্গে গেল আমার। চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে মুখে হাত দিয়ে একটা লম্বা হাই তুললাম। অভ্যাসবশত ঘাড় ঘুরিয়ে সাফওয়ানের দিকে তাকালাম। কিন্তু না আজ আর সাফওয়ানের বুকের মধ্যেখানে শুয়ে নেই আমি। 

পাশে পুতুল চাদর জড়িয়ে শুয়ে আছে। কপালের ওপরে ছড়িয়ে আছে একগুচ্ছ বেবি হেয়ার। কি নিষ্পাপ লাগছে পুতুলকে। পুতুলের দিকে কিছুটা এগিয়ে এগিয়ে চুলগুলো কপালের উপর থেকে সরিয়ে একটা চুমু এঁকে দিলাম।

 হঠাৎ মনের মধ্যে একটা ব্যাপার চারা দিয়ে উঠলো। আমার আর সাফওয়ানের  এর মধ্যকার সবকিছু ঠিক থাকলে হয়তো আজকের সকালটা অন্যরকম হতো। ভেতর থেকে আপনি ইচ্ছে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

না আমি আর ওসব নিয়ে ভাববো না। সবার ভাগ্য সমান হয় না। এই পৃথিবীতে খুব কম ভাগ্যবান মানুষ আছে যে তার ভালোবাসার মানুষকে আপন করে পেয়েছে। তাই বলে তারা মরে যায়নি বরং নতুন ভাবে বাঁচার অনুপ্রেরণা পেয়েছে। আমিও বাঁচবো এবার নতুন করে নিজের জন্য বাঁচবো।

বিছানায় বসে চুলগুলো হাত খোঁপা করে নিলাম। জোরে একটা শ্বাস নিয়ে দু হাতে তালুই মুখ ঘষে। চাদর সরিয়ে বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে খেয়াল আসলো। আমার গায়ে আলাদা একটা চাদর জড়ানো। কিন্তু আমার যতদূর মনে আছে রাত্রে আমি তো সোজা এসে পুতুলকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়েছিলাম চাদর কে দিল। সাফওয়ান...!

নিজেকে নিজে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি উপহার দিলাম।

--- হাহ্। তোর এখনো মনে হয় সাফওয়ান তোর গায়ে চাদর টেনে দেবে। পায়ের কাছে ছিল হয়তো ঠান্ডা লেগেছে নিজ হাতেই টেনে নিয়েছি। 

বিছানা থেকে নেমে চাদরটা ভাজ করে রেখে ওয়াশরুমে চলে গেলাম ফ্রেশ হতে। কিছুক্ষণ পর ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে চিরুনি নিয়ে চুলগুলো আঁচলে একটা পাঞ্চ ক্লিপ লাগিয়ে নিচে চলে আসলাম।

নিচে নেমে এসে দেখি খালা ঝাড়ু দিচ্ছেন। আমাকে দেখে গাল ভরা একটা হাসি দিলেন।

আমি কিছুটা এগিয়ে গিয়ে ডাইনিং এর চেয়ারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তাকে বললাম,

--- আজ ঘুম থেকে উঠতে অনেক দেরি হয়ে গেল খালা। 

--- কাল অনেক রাইতে বাসায় আইসো তাই না। তোমরা আইসিলা আমি টেরডাও পাই নাই। কি মরনের ঘুম দিছিলাম।

আমি মুচকি হেসে বললাম,

--- তাতে কি হইছে। এই দেখো সকালে তো সবার আগে তুমি ওঠো সবকিছু গুছিয়ে রাখো। তোমার উচিত সবার আগে ঘুমাতে যাওয়া।

ঝাড়ু দেওয়া শেষ হয়ে গেছে খালার। হাত ধুয়ে আমার কাছে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

--- তোর মন খুব ভালা। আল্লাহর কাছে দোয়া করি তোর খুব ভালো হোক।

আমি নিঃশব্দে হাসলাম।

একি তোর মুখ এমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন? জ্বর-টর বাধালি নাকি আবার।

--- আরে না খালা এমনি।

--- এমনি মানে? মুখটা শুকায়ে একেবারে ধুলো হয়ে গেছে। কিরে জামাই এর সাথে ঝগড়া লাগাইছস।

আমি চমকে উঠলাম। খালা কিছু শুনে ফেলিনি তো। ভয়ে আমতা আমতা করে কিছু বলতে যাব তার মধ্যেই খালা বলে উঠলেন আমি মজা করছিলাম।।

আমি সব গুছাইয়া রাখছি নতুন বউ। তুমি খালি আইসা রান্নাবাড়া শুরু কইরা দাও।

কথাটা বলে খালা রান্নাঘরের দিকে চলে যাচ্ছিল। আমি তাকে থামিয়ে বললাম,

--- খালা। বলছি কী। আজ আমি একটু আমার বাসায় যাব।

খালা ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন। তারপরে সন্দেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

--- আমি কি তাইলে আন্দাজে ঠিক জায়গায় ঢিল টা মারলাম।

আমি হালকা হেসে বললাম,

--- না খালা। আজ আমার ছোট ভাইয়ের জন্মদিন। প্রতিবছর তো বাড়িতেই থাকি। এবারই শুধু বাড়ির বাইরে। জানি ভাইটা মন খারাপ করে বসে আছে। তাই ভাবছিলাম সকালেই চলে যাব ওই বাড়িতে।

খালা দ্রুত পায়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন,

--- তুমি এটা আমারে আগে বলবা না। তাহলে আমি আগে আগে রান্নাটা বসাই দিতাম। সকাল সকাল বেরোবে এখনই তো সাড়ে সাতটা বেজে গেছে।

এত ব্যস্ত হওয়ার দরকার নেই। দশটা সাড়ে দশটার দিকে যাব। ততক্ষণ এদিকে রান্নাবান্না সব হয়ে যাবে।

আচ্ছা ঠিক আছে তোমাকে আর বেশি কিছু করা লাগবে না তুমি বরং তোমার ভাইয়ের জন্য পায়েসটা তৈরি করো। আর আমাকে বলে বলে দিও আমি সেই ভাবে রান্নাবান্না করে নেব।

এছাড়া দুপুরে আর খাবা না বাসায় তোমরা সকালের নাস্তাটাই বানাই তোমাদের জন্য।

আমি খালাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম আমি আর পুতুল যাব। তোমার ছোট বাবা বাড়িতেই থাকবে। আর কাল শুনলাম ভাবি আর ভাইয়াও চলে আসবে আজকে।

এজন্য সবার জন্যই রান্না করব। তাড়াতাড়ি চলো। না হলে আমার দেরী হয়ে যাবে।

______🌺🌺________

রান্নাবান্না শেষ করতে করতে প্রায় সাড়ে নয়টা বেজে গেল। এই হালকা শীতের মধ্যেও ঘেমে শরীর ভিজে গেছে আমার। আমি দ্রুত পুতুলের রুমে গেলাম। গিয়ে দেখে মেয়েটা ফ্রেশ হয়ে টেবিলে বসে কি যেন করছে। আমি গিয়ে দেখলাম কোচিংয়ের পড়াগুলো লিখছে।

আমি ওকে টেনে তুলে বললাম,

--- আজ আপনাকে আর কোচিংয়ে যেতে হবে না ম্যাডাম। সাথে আমি কথা বলে নিয়েছি, আজকে তুমি আমার সাথে বাইরে যাচ্ছ।

--- কোথায় প্রীতিলতা?

--- আমার বাড়িতে। কেশবপুর। আজ তোমার প্রীতম ভাইয়ের জন্মদিন। সে স্পেশালি তোমাকে যেতে বলেছে।

--- ইয়েহ...! আমি যাব। কিন্তু আমি তো কোন গিফট কিনিনি ভাই এর জন্য।

--- তুমি নিজেই তো একটা গিফট।চল চল তাড়াতাড়ি গোসল করে নাও। আমিও গোসল করে আসছি। তারপর পরে নাস্তা করে বেরিয়ে পড়বো আমরা। ঠিক আছে...!

--- ওক্কে।

বলেও ওয়াশরুমে চলে গেল গোসল করার জন্য। আর আর আমি এদিকে ওর জন্য পোশাক বিছানার উপরে বের করে রেখে রুমে চলে আসলাম।

রুমে এসে দেখি বিছানায় উবু হয় শুয়ে আছে সাফওয়ান। তাকে দেখার সাথে সাথে কাল রাতের ঘটনাগুলো মনে পড়ে গেল। নজর অন্যদিকে ঘুরিয়ে আলমারি থেকে নিজের জামা কাপড় গুলো বের করে বাথরুমে চলে গেলাম। 

১৫ মিনিট পরে গোসল করে বের হয়ে আসলাম আমি। পরনে লং হাই নেকের ফুল হাতার সুতির ফ্রক। ভালোভাবে চুল মুছে তোয়ালেটা বারান্দায় শুকিয়ে দিয়ে এসে পুতুলের রুমের চলে আসলাম।

--- পুতুল তোর হলো....! আরে বাহ এ আমি কাকে দেখছি তো পুরোপুরি পরী লাগছে।

--- তোমাকেও তো পুরোপুরি পরী লাগে। দেখে মনেই হয় না যে তোমার বিয়ে হয়েছে।

আমি বারান্দায় ওর রেখে দেওয়ার তোয়ালে টা মেরে দিচ্ছিলাম। ওর কথা শুনে অবাক হয়ে পেছনে তাকিয়ে পুতুলকে বললাম,

--- এই বুড়ি এত পাকা পাকা কথা কোথা থেকে শিখলি রে তুই?

পুতুল খাটের উপর আরাম করে বসে বলল,

--- কেন স্কুলের ওই আন্টিগুলো তো সেদিন বলল।

--- কি বলল?

---আমার কাছে জিজ্ঞাসা করছিল তোমার সাথে যে মেয়েটি আসে সে তোমার কেমন বোন হয়?

আমি বলেছি আমার ভাবি হয়। ওকে আমি আদর করে প্রীতিলতা বলে ডাকি। প্রথমে বিশ্বাস করিনি জানো পরে আমাকে বলল দেখে তো মনেই হয় না যে ওই মেয়ের বিয়ে হয়েছে।

আমি হেসে ওর মাথার ক্লিপটা করে লাগিয়ে দিয়ে বললাম ,

--- ভালো কাজ করেছিস আমার পরিচয়টা দিয়ে দিয়েছিস। নে এখন তাড়াতাড়ি চল আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।

ওয়েট ওয়েট বলে দৌড়ে ওর পড়ার টেবিলের কাছে চলে গেল। হাতে করে দুটো ডেইরি মিল্ক সিল্ক আর একটা কালার বক্স নিয়ে এসে বলল,

--- এগুলো আমি প্রীতম ভাইয়াকে গিফট করবো।

আমি হেসে বললাম 

--- তুই পারিসও।এত বুদ্ধি নিয়ে রাতে ঘুমাস কি করে রে তুই।

হেসে উত্তর দিল,

--- বালিশের নিচে রেখে।

_________🌺🌺__________

পুতুল আর আমি তাড়াতাড়ি নাস্তা শেষ করে নিলাম। ব্যাগে করে দুটো জামা ও নিয়েছি। পারলে একটা দিন থেকে আসব। ব্যাগটা নিতে আবার রুমে চলে আসলাম। ব্যাগটা ঠিকঠাক মতো গুছিয়ে ফোনটা চার্জের থেকে ছাড়িয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে আয়নার দিকে তাকালাম। 

হঠাৎ সাফওয়ানের একটা কথা মনের মধ্যে ভেসে উঠলো। এরপর যখন বাইরে যাবেন বোরকা পরে বের হবেন। 

ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে পাঁচকলিপ টা দিয়ে ভালো করে চুলটা আটকে নিলাম। তারপরে আলমারি থেকে হিজাব বের করে এনে সেট করে নিলাম। নিচে আমার ফুল হাতার লং ফ্রক পরা আছে।

 আয়না দিয়ে একবার ঘুমন্ত সাফওয়ানের দিকে তাকালাম। মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে ঘুম ভেঙ্গে গেছে তার এখনই চোখ মেলে তাকাবেন তিনি। আমি তাড়াতাড়ি রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম।

নিচে এসে দেখি পুতুল সোফায় বসে জুতোর ফিতে আটকাচ্ছে। আমি খালার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললাম,

--- খালার সময় মত কফিটা দিয়ে এসো। এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি তাই বলে যেতে পারছি না। তুমি বলে দিও আমরা ওই বাড়িতে গিয়েছি।

--- আচ্ছা। হ্যাঁ রাতে হয়তো ঘুম হয়নি ছোট বাবার। ভোরবেলায় দেখলাম পুতুলের রুম থেকে বের হতে।

আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম পুতুলের রুমে ভোর বেলায় কি করছিলেন উনি। তারমধ্যে পুতুল বলে উঠলো 

--- প্রীতিলতা আমি তৈরি এবার চলো।

আমিও সমস্ত চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে পুতুলের হাত ধরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলাম।

_______🌺🌺_______

কতক্ষণ ধরে কলিং বেল দিচ্ছে দরজা খোলার কোন নাম গন্ধ নেই। এবার দরজায় জোরে জোরে দুটো চাপড় মারলাম। এবার ভাই দরজা খুলে আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল,

--- আপু তুই আসছিস...!

পুতুল আমার পেছন থেকে সামনে এসে বলল,

--- সাথে আমিও এসেছি প্রীতম ভাইয়া। হ্যাপি বার্থডে। এই নাও এগুলো তোমার গিফট।

--- আরে বাবা আমার ছোট বোনু ওটা আমার জন্য গিফট এনেছে নাকি। থাঙ্কস বনু।

তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন আপু ভেতরে আয়। ভেতরে আসতে আসতে প্রীতম আবার প্রশ্ন করল,

--- ভাইয়া কোথায় ভাইয়া আসেনি?

আমি কিছুটা ভেবে উত্তর দিলাম। আসবে ওর একটা কাজ বেঁধে গেছে তো। কাজ শেষ হয়ে গেলে চলে আসবে বলেছে।

--- ও আচ্ছা। আম্মু দেখো আপু এসেছে।

আম্মু রান্নাঘর থেকে হাত মুছে বেরিয়ে এসো আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আম্মুর চোখে পানি চিক চিক করছে।

আমাকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

--- জামাই আসেনি?

--- পরে আসবে বলেছে।

--- ও। আরে এটা কে? যে আমাদের ছোট কুটুম।

পুতুল হেসে আম্মুকে জড়িয়ে ধরে বলল

--- কেমন আছো আন্টি।

--- খুব ভালো। তুমি কেমন আছো মা?

--- ভালো।

আমি ব্যাগ থেকে পায়েসের বাটিটা বের করে আম্মুর হাতে দিয়ে বললাম,

--- আম্মু আমি পায়েস বানিয়ে এনেছি।

আম্মু আমার হাত থেকে পায়েসের বাটিটা নিয়ে বললে,

--- তোরা গিয়ে ভেতরে বোস আমি বাটিতে করে আনছি তোদের জন্য।

______🌺🌺______

এদিকে সাফওয়ান ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে বিছানায় বসলো। গায়ে গেঞ্জি আর ট্রাউজার পরা। ফোনে কি যেন দেখছে। এর মধ্যে খালা এসে সাফওয়ান এর সামনে কফির মগটা রাখলেন। সাফওয়ান কিছুটা অবাক দৃষ্টিতে খালার দিকে তাকিয়ে বলল,

--- কফিটা আজ তুমি আনলে যে...

--- হয় নতুন বউ তো চলে গেছে।

সাফওয়ান চমকে উঠলো। এতটাই চমকেছে যে তড়িৎ গতিতে দাঁড়িয়ে পড়ল। উচ্চস্বরে চেচিয়ে উঠে বলল,

কীহ...!

 নিজের আচরণে নিজেই বিব্রত বোধ করল। আমতা আমতা করে বলল,

--- চলে গেছে মানে...!

--- নতুন বউয়ের ভাইয়ের আজ জন্মদিন। তাই পুতুল রে নিয়ে ওই বাসায় গেছে।

--- ওহ।

খালা চলে গেলেন। সাফওয়ান বিছানায় বসে পড়ল। বিড়বিড় করে নিজেই নিজেকে বলল,

আমাকে না বলেই চলে গেল.....


১৭ তম পর্ব🍂

তরকারি দিয়ে ভাত মেখে মুখে দিতেই চোখ মুখ কুঁচকে গেল সাফয়ানের। তরকারিটা কেমন যেন বিষাদ লাগলো তার কাছে। পাশাপাশি মাছ থেকেও কেমন যেন হালকা আঁশটে গন্ধ ও লাগলো নাকে। সাফওয়ান স্বভাবতই খুবই খুঁতখুঁতে। আগে মায়ের রান্না ছাড়া তার মুখে অন্য কারোর রান্নার রুচি ছিল না। কিন্তু ইদানিং প্রীতির হাতের রান্নায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। সে মনে প্রানে বিশ্বাস করে  প্রীতির রান্নার হাত অসাধারণ।

সাফওয়ান গলা ছেড়ে খালাকে ডাকলো। খালা রান্নাঘর পরিষ্কার করছিলেন। হাত মুছতে মুছতে সাফয়ানের পাশে এসে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন,

--- কি হয়েছে ছোট বাবা?

সাফওয়ান হাত ধুয়ে এসে টিস্যুতে মুছে বলল,

--- আজকে রান্নাটা কে করেছে খালা?

সাফানের প্রশ্নটা শুনতে খালার মুখ জুড়ে আতঙ্ক ভর করলো। তিনি জানেন যে তার ছোট বাবা কতটা খুঁতখুতে। ইতস্তত করে জবাব দিল 

--- আমি রান্না করেছি। আসলে নতুন বউয়ের ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছিল আর তাড়াতাড়ি তাকে বের হতে হবে। তাই আমি জোর করে তাকে রান্না করতে না দিয়ে নিজেই রান্না করেছি। নতুন বউ শুধু পায়েস রান্না করেছে।

সাফান টেবিলের উপর হাত রেখে এতক্ষণ খাবার কথা শুনছিলেন। কথা শেষ হতে মাথা নিচু করে বিড়বিড় করে বললেন,

--- কি এমন রাজকার্য ছিল ওই বাড়িতে যে একটু রান্না করে যাওয়ার সময় হয়নি তার।

সাফওয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে খালাকে প্রশ্ন করলেন,

--- দুধ আছে?

--- হ্যাঁ আছে তো নতুন বউ পায়েশ রান্না করছিল আর আলাদা পাতিলে অল্প দুধ রাখা আছে।

খালার কথা শেষ হতেই সাফওয়ান রান্নাঘরে চলে গেলেন। দুধটা গরম করে একটা বাটিতে ঢেলে তাতে কনফ্লেক্স মিশিয়ে নিয়ে চলে আসছিলেন কিন্তু হঠাৎ পাশে রাখা ক্ষীরের পাত্র দেখে আরো একটা বাটি বের করে তাতে বড় দুই চামচ পায়েস তুলে নিল সাফওয়ান। একটা ট্রেতে দুটো পাত্র রেখে ফোনটা হাতে নিয়ে চলে গেলেন নিজের রুমে।

ল্যাপটপটা নিজের পায়ের উপরে রেখে দ্রুত হাতে টাইপ করা শুরু করলেন। কনফ্লেক্স এর বাটিটা উঠাতে গিয়েও তা রেখে দিয়ে পায়েসের বাটিটা তুলে নিল হাতে। তা থেকে এক চামচ পায়েস মুখে দিতে আপন ইচ্ছায় চোখ বন্ধ হয়ে আসলো তার। তৃপ্তি ভরে এক চামচের পর আরেক চামচ মুখে দিতেই লাগলেন সাফওয়ান। অবশেষে পুরো বাটিটা সাবাড় করে দম নিল সে। কিন্তু বেশিক্ষণ নয় হঠাৎ তার কাশি শুরু হলো। আপন মনেই বলে উঠলো,

--- পানি। পানি দাও প্রীতি।

হাত বাড়িয়ে দেয় আপন মনে। কিন্তু কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে সামনে তাকিয়ে হঠাৎ তার টনক নড়ে যে প্রীতি এই ঘরে নেই। নিজেই উঠে গিয়ে সেন্টার টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাসটা এনে বিছানায় বসে ঢক ঢক করে পুরো গ্লাসটা ফাঁকা করে দিল।

তারপরও রুমটা এক নজর ঘুরিয়ে ল্যাপটপ টা পায়ের উপর তুলে আবার কাজ করতে শুরু করলো সাফওয়ান। ফোনের রিংটোনে তার ধ্যান ভাঙল। একটা আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে। সাফওয়ান কিছু একটা ভাবনা তারপর ফোনটা রিসিভ করল। কানে ধরতে ওপাশ থেকে একটা কণ্ঠস্বর শুনে মুচকি হেসে কথা বলতে শুরু করল।

আচ্ছা দুপুর নাগাদ চলে আসবো আমি। হ্যাঁ হ্যাঁ আমি দুপুরেই আসবো। দুপুরে এসে একসাথে লাঞ্চ করব। আচ্ছা রাখছি বলে ফোনটা কেটে ল্যাপটপটা জায়গায় রেখে গোসল করতে চলে গেলেন সাফওয়ান।

________🌺🌺_______

অনেকদিন পরে সেই চিরচেনা রান্নাঘর। কোমরে আঁচল গুঁজে, দুপুরের জন্য রান্না বান্না করছে আম্মু। আমি পেছন থেকে গিয়ে আম্মুকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরি। আমি বুঝতে পেরে পিছনে না ঘুরে হাত বাড়িয়ে আমার মুখে হাত বুলিয়ে দিলেন।

থুতনি টা আম্মুর কাঁধে রেখে উঁচু হয়ে দেখে আম্মু মাংস কষাচ্ছে। একটি জিভে পানি চলে আসলো। আম্মুকে ছেড়ে পাশের রেগ থেকে ছোট একটা বাটি বের করে আম্মুর পাশে এসে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,

--- দাওনা আম্মু কয়েক পিস কষা মাংস। কতদিন তোমার হাতের কষা মাংস খাইনা।

আম্মু হেসে বাটিতে বেশ কয়েক পিস মাংস তুলে দিলেন। আমি রান্না ঘরের ডেক্সের এর উপর বসে আয়েশ করে মাংস খেতে শুরু করলাম। আহাম্মক কতদিন পরে তোমার হাতের সেই কষা মাংস। খুব মিস করি জানো।

আম্মু হেসে উত্তর দিলেন,

--- এইজন্যই তো তোর আব্বুকে বেশি করে আজ মাংস আনতে বলেছিলাম আমি জানতাম তুই আসবি আজকে। 

মায়ের কথা শুনে আমি হেসে গালের মধ্যে এক টুকরো মাংস চিবতে লাগলাম।

আম্মু তরকারির নাড়া দিতে দিতে বললেন,

--- ও বাড়ির সবার কি অবস্থা কেমন আছে?

--- সবাই ভালো আছে। ভাইয়া ভাবি ভাবির বাপের বাড়িতে আছে। আর আমি আমার বাপের বাড়িতে।

--- আর সাফওয়ান?

--- সে তার বাপের বাড়িতে।

মা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে দিলেন। তারপর তরকারিতে পানি দিয়ে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে আমার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললেন,

--- জামাই আর তোর মধ্যকার সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে তো মা?

খাওয়া বন্ধ করে মায়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হালকা হেসে বললাম,

--- বেঠিক কি ছিল যে ঠিক করতে হবে।

আম্মু আমার মাথায় গাট্টা মেরে বললাম,

--- সব সময় এমন ত্যাড়া ব্যাকা উত্তর দিস কেন?

তোমার মেয়েটাই তো ঘাড় ত্যাড়া। বলে হেসে আরেক কিছু মাংস তুলছিলাম খাব বলে।

আম্মু বলছে ,

--- তাহলে আজকে একা একা এলি কেন? জামাইকে সাথে করে কেন আনলি না। চোখ মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে যে জামাইয়ের সাথে ঝগড়া করে এসেছিস।

আমি আম্মুর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বাটিটা সাইডে নামিয়ে রেখে ডেক্স থেকে নেমে বললাম,

--- তারমানে এখন আমার এই বাড়িতে একা আসা নিষেধ?কী তাই তো।

আম্মু অবাক হয়ে আমাকে বলল,

--- এটা আমি কখন তোকে বললাম?

--- এইতো বললে।

আম্মু আমাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,

--- মেয়েদের নিয়ে মায়েদের মনে অনেক দুশ্চিন্তা থাকে । যেটা বিয়ের আগে থাকে একরকম বিয়ের পরে হয়ে যায় আরেকরকম। বিয়ের পরে মেয়েটা শ্বশুরবাড়িতে মানিয়ে নিতে পারছে কিনা স্বামীর সাথে এডজাস্টমেন্ট ঠিক আছে কিনা 

এরকম নানারকম দুশ্চিন্তা ভর করে মায়েদের মনে।

 তুই এখন এসব বুঝবি না আগে একটা মেয়ের মা হও তারপর হাড়ে হাড়ে টের পাবি। আর তারপর যদি মেয়েটা হয় তোর মতো ঘাড় ত্যাড়া । তাহলে তো আর কথাই নেই।

বলে মা শব্দ করে হেসে উঠলেন সাথে আমিও।

আম্মু চুলার আঁচটা ঠিক করে দিতে দিতে বললেন,

--- শোনো মেয়ে এই ত্যাড়ামো গুলো জামাইয়ের সাথে করতে যেও না। কারণ 

পুরুষরা হচ্ছে বন্য ঘোড়ার মত, যদি রেগে যায় তাহলে সংসার ওলট-পালট করে দেবে।

তুমি যদি তোমার ঘরে শান্তি চাও তাহলে কখনও তার ওপর হুকুম চালানোর চেষ্টা করো না; হুকুমের দাস হয়ে থাকার জন্য তার জন্মই হয় নি।

তবে হ্যাঁ,তার সাথে সবসময় ছায়ার মত থাকার চেষ্টা করো, তার প্রয়োজনের দিকে নজর রেখো, তার দেখাশোনার কোনো অবহেলা করো না,

তাহলে দেখবে সে কেমন সোজা ঘোড়ার মত তোমার কথায় চলে। যদি এ কায়দায় না চলতে পারো মা, তবে কখনই ওর মনে জায়গা করতে পারবে না..! 

আমি আম্মুর কথাগুলো শুনলাম। মনোযোগ সহকারে শুনলাম। আর মনে মনে ভাবলাম এত জটিল সমীকরণ আমি বুঝিনা আম্মু। যে থাকার সে হাজার প্রতিকূলতা ঝড় ঝাপটা পেরিয়েও থেকে যায়।

 আর যার চলে যাওয়ার হয় তাকে হাজার ভালবাসা দিয়েও নিজের নীড়ে আটকে রাখা সম্ভব হয় না সে ঠিকই অন্য নীড়ের সন্ধানে ডানা ঝাপটে উড়ে চলে যায়।

আমি বুঝি আম্মু তোমার আসল ভয়টা কোথায়। কোন মেয়ের গায়ে যদি একবার ডিভোর্সের কালিমা লেগে যায় সেই মেয়ে যে সমাজের জন্য কতটা বোঝা হয়ে যায় তা রুমি আপুকে দেখে খুব ভালোভাবে বুঝেছি।

এ সমাজ বড্ড স্বার্থপর। তারা শুধু মেয়েটাকে এককভাবে দোষারোপ করে কিন্তু একটিবার কেউ ভেবে দেখে না যে মেয়েটা হয়তো তার সর্বোচ্চ চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে বিধ্বস্ত ও ভারাক্রান্ত মন নিয়ে নিজের সাথে এক প্রকার বিশ্বযুদ্ধ করে এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে।

আমি জানিনা আমার ভাগ্যে কি লেখা আছে। কিন্তু এটুকু জানি আমি আমার মা বাবার বোঝা হয়ে থাকবো না। নিজের যেটুকু যোগ্যতা হয়েছে সেটুকু যোগ্যতা দিয়েই এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর সাথে লড়াই করে যাব।

আমি যে এক মরণ খেলায় নেমেছি। সংসার নামক এই মরণ খেলা। অনেকটা ডু অর ডাই ম্যাচও বলা চলে। জিতলে হয়তো ওই সংসার আর সংসারের লোকগুলো সারা জীবনের জন্য আমার হয়ে থাকবে। 

আর যদি হেরে যাই....! তাহলে হয়তো তাদের মাঝ থেকে আমি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব সারা জীবনের জন্য।

_______🌺🌺________

এমন সময় দরজায় কলিং বেল এর শব্দ কানে আসলো। আম্মু আমার দুইজনেরই ভুরু কুঁচকে গেল। এ সময়ে কে আসতে পারে? 

আম্মু বলল,

---  দেখ গিয়ে তোর আব্বু মনে হয় সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য আগে আগে অফিস থেকে চলে এসেছে তুই গিয়ে দরজা খোল।

--- আচ্ছা।

 বলে আমি রান্নাঘর থেকে এক ছুটে মেইন ডোরের কাছে চলে গেলাম। দরজা খুলে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠলাম।

কারণ আমার সামনে স্বয়ং সাফওয়ান দাঁড়িয়ে আছে। ঘাড়ে তার ক্রিকেট কিটের ব্যাগ ঝুলছে। যা বাম হাত দিয়ে খুব শক্ত করে আঁকড়ে রেখেছে। ডান হাতে কিছু মিষ্টি আর কেকের প্যাকেট।

আমি বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। দরজা থেকে যে সরে দাঁড়াব সে হু হারিয়ে ফেলেছি। হাত মুছে আম্মু এগিয়ে আসতে আসতে বললেন,

--- কিরে দরজার ঐ পাশে কি ভূত দেখেছিস নাকি এভাবে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছিস কেন কে এসেছে?

দরজার ওপাশে সাফওয়ান কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আম্মু এগিয়ে এসে আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলল,

--- জামাই এসেছে। আর এই মেয়েটাকে দেখো কান্ডজ্ঞানহীন এর মত দরজা আগলে  দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এগুলো কি বাবা? এতকিছু?

--- তেমন কিছু না আন্টি। প্রীতম কোথায়?

বলতে বলতে ড্রয়িং রুমের সোফায় এসে বসলেন তিনি।

গলা ছেড়ে প্রীতমকে ডাকলেন। প্রীতম ও কিছুক্ষনের মধ্যে ড্রইংরুমে এসে হাজির হলো। সাফওয়ান কে দেখে দৌড়ে এসে আলিঙ্গন করল তার সাথে। আমি সবকিছু অবাক ও নীরম দৃষ্টিতে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছি।

সাফওয়ান আলিঙ্গনমুক্ত হয়ে প্রীতমকে জিজ্ঞাসা করল,

--- কেমন আছো চ্যাম্প?

--- একদম ফাস্ট ক্লাস। খুব খুশি হয়েছি ভাইয়া তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসেছ বলে।

আমার দিকে আর চোখে তাকিয়ে এক প্রকার আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,

---তুমি ডেকেছো আর আমি আসবো না এটা কখনো হয় নাকি।

আমি মনে মনে একটা মুখ ঝামটা দিলাম। সরাসরি দেওয়ার সাহস নেই।

--- হুহ..! ঢং। কাল রাতে এক রূপ দেখলাম। এখন আরেক রূপ দেখতেছি। এই ব্যাটার যে কয়টা রূপ আছে একমাত্র আল্লাহই ভালো জানে।

আমার ভাবনার মাঝে ক্রিকেট কিট এর ব্যাগটা প্রীতমের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

--- এটা তোমার বার্থডে গিফট। প্র্যাকটিসটা যেন খুব সুন্দর হয়। নেক্সট স্কুল টুর্নামেন্টের এর ট্রফিটা যেন তোমার হাতেই দেখতে পাই।

--- ওকে ভাইয়া আই উইল ট্রাই মাই বেস্ট।

আমি চলে এসেছি ওখান থেকে ওসব ঢং দেখার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। হাতটা ধুয়ে সবাইকে পাশ কাটিয়ে সিঁড়িবে ছাদে চলে এসেছি আমি। ছাদে পা রাখতেই দেখলাম। আমার লাগানো বেলি ফুল লাল গোলাপ এর গাছগুলো অনেক বড় হয়ে গেছে। কলি আশা ও শুরু করে দিয়েছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে যত্নআত্তির কোন ত্রুটি হয় না এদের। পাশে কিছু ঝালগাছ আর গন্ধরাজ লেবু ও আছে। এগুলো আমার ভাইয়ের হাতে লাগানো।

গাছগুলোতে ছোট ছোট কয়েকটা লেবু ঝুলে আছে। মরিচ গাছে কিছু মরিচ ও আছে। গাছগুলো দেখে মন ভালো হয়ে গেল। সেদিকে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু গাছগুলোর কাছাকাছি আর যাওয়া হলো না। পেছন থেকে হাতের হেচকা টানে ঘুরিয়ে দেওয়ালের সাথে লাগিয়ে দিল কেউ। শব্দ  করে ছাদের দরজাটাও বন্ধ করে দিল সে।

এমন হওয়ায় ভয়ে চোখ কুঁচকে নিয়েছিলাম আমি। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি সাফওয়ান আমার বরাবর দাঁড়িয়ে আছেন।

আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,

--- আমাকে না বলে এখানে চলে এসেছ কেন তুমি?

--- নিজের বাড়িতে এসেছি তাই বলে আসার প্রয়োজন বোধ করিনি। আপনি কেন এসেছেন এখানে? আমার বাড়ির মানুষগুলোকে দেখাতে দেখো আমি তোমাদের কত ভালো জামাই।

সাফওয়ান গাল বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন,

--- এমন মনো ভাব যদি আমার হতো তাহলে তোমার সাথে এতদিন লোক দেখানো সংসার শুরু করে দিতাম। যাক গে। তোমাকে আমার কিছু বলার আছে। কিছু না অনেক কিছুই বলার আছে।

--- আমি শুনতে ইচ্ছুক নই। আমার যা শোনার তা কাল রাত্রে সোনা হয়ে গেছে। আপনি কি আর কেমন এটা আপনার মধ্যে খিচুড়ি পাকিয়ে রেখে দিন। আমার জানার কোন প্রয়োজন নেই।

বলে দিয়েছেন না আমি আপনার বাবার পছন্দ। তাই যে পছন্দ করে নিয়ে এসেছে তার কাছেই একটা আর্জি জানাবো আমি। রাখলে রাখবেন না রাখলে আমার আর কিছু করার নেই।

সাফওয়ান আমার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন,

--- কিসের আর্জি?

--- সেটা আমি তাকেই বলবো।

বলে দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা তার হাতটা সরিয়ে দিয়ে চলে আসতে নিলে আবার হাতটা খপ করে ধরে আটকে দিয়ে বললেন,

--- বাড়ি ফিরে চলো প্রীতি।

--- কিসের প্রয়োজনে?

--- আমার প্রয়োজনে...! 

কানে বজ্র ধ্বনির তোর শোনালো বাক্যটা। আমি অবাক স্বরে তাকে তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন করলাম,

--- ক্ কীহ বললেন?

সাফওয়ান আমার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে নিজের দুই বাহুর মধ্যে আমাকে নিয়ে তার মুখ কিছুটা আমার মুখের দিকে এগিয়ে এনে বললেন,

--- কিছু না...!


১৮ তম পর্ব🍂

ছোটবেলা থেকে খুব দুরন্ত স্বভাবের ছিলাম আমি। আর ভাইয়া ছিল আমার একদম বিপরীত একদম শান্ত বাচ্চা। আমার ক্রিয়েটিভ জিনিসপত্র  খুব ভালো লাগতো। কোন কিছু তৈরি করা, এক্সপেরিমেন্ট চালানো এ বিষয়গুলোর উপরে আমার আলাদা ঝোঁক ছিল। 

এমনও হয়েছে ছোট্ট একটা এক্সপেরিমেন্ট চালাতে গিয়ে আমি পুরো ঘর নোংরা করে ফেলেছি। আম্মুর সে কি বকাবকি।

বলে হাসলেন সাফওয়ান। ছাদের উপরে ডিভান এ পাশাপাশি বসে আছি। কথাগুলো বলতে গিয়ে কেমন যেন একটা শিশুশুলভ আচরণ ফুটে উঠলো তার মুখে।

তারপরও যান এসব আমি কখনো গায়ে মাখতাম না। আমি তো সবসময় আমার মর্জি মতোই চলতাম। খেলাধুলা , পড়াশোনা কোন কিছুতেই পিছিয়ে ছিলাম না আমি। যখন যেটা চেয়েছি হাতের মুঠোয় পেয়েছি। এজন্যই হয়তো আমি একটু উগ্র টাইপ।

আমার জীবনে ছোট খালামনির অবদান অনেক। তাকে প্রথম প্রথম আম্মু বলে ডাকতাম এখনো ডাকি ছোট আম্মু বলে। শুধু একটা জিনিসের অভাব ছিল একটা ছোট পুতুলের মত বোন যেটা আমার ছিল না।

একদিন দেখলাম খালামণি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। পেট আঁকড়ে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে কাঁদছে। সবাই তাড়াতাড়ি ছোট আম্মুকে নিয়ে কোথায় যেন চলে গেল।

আমি রুমে গিয়ে দেখি সায়েম বসে কাঁদছে। আমি যে তাই আমাকে জড়িয়ে ধরে আরো জোরে কান্না করে দিয়ে বলল,

--- আম্মুকে সবাই কোথায় নিয়ে গেল?

আমি সায়েমকে কাঁদতে নিষেধ করে ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বললাম,

--- ছোট আম্মুর পেটে ব্যথা করছে তাই হয়তো ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে। দেখবি কিছুক্ষণ পরেই ছোট আম্মু সুস্থ হয়ে বাসায় চলে আসবে।

সেদিন সারারাত মা বাবা ছোট ফুপা ছোট আম্মু কেউই বাসায় আসেনি। সারারাত আমি সায়েম আর সামিরা আপু একসাথে ছিলাম। সায়েম কান্নাকাটি করছিল। আম্মুর কাছে ফোন দিয়েছিলাম আম্মু বলল,

--- ছোটআম্মু সকালে একদম সুস্থ হয়ে যাবে।

 পরে সকালবেলায় আম্মু ফেরত এসে আমাদের সবাইকে তৈরি করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। হাসপাতালে গিয়ে দেখি ছোট আম্মুর পাশে তোমাদের পেছানো একটা ছোট্ট পুতুল রাখা আছে। পুতুলটাকে ছুঁতে ই কেমন যেন নড়ে চড়ে উঠলো।

 সত্যি বলতে ওই সময় তোয়ালে পেঁচানো ওই ছোট্ট পুতুলকে দেখে আমি যে কি খুশি হয়েছিলাম সেটা বলে বোঝাতে পারবো না। ছোট্ট একটা পুতুল বোন। তোয়ালে পেঁচানোর একটুখানি ফাক দিয়ে মুখটা দেখা যাচ্ছে। আমি আর সায়েম তো একেবারে হামলে পড়েছিলাম দোলনার উপরে। 

পরে আর বাসায় আসিনি। একেবারে ছোট আম্মুকে সাথে করে নিয়ে হসপিটাল থেকে বাড়ি এসেছিলাম সন্ধ্যায়।

ছোট্ট পুতুল বোনের নাম রাখা হলো সায়েম আর আমার নাম অনুসারে সাইমা।

কথাটা শেষ করে উনি আমার দিকে তাকালেন। আমি চমকে উঠলাম। উনি সাইমাকে বোন বলে সম্বোধন করলেন কেন?

আমাকে চুপচাপ থাকতে দেখে উনি আবার বলতে শুরু করলেন,

--- সায়েম আর আমার সারাদিনের কাজ ছিল সায়মা ওর ছোট ছোট হাত নাড়িয়ে কি বলতো? কি বুঝাতো তাই নিয়ে একজন আরেকজনের সাথে ঝগড়া করা। বলতে গেলে সারাদিনই সাইমাকে নিয়ে বসে থাকতাম আমরা। সারাদিন দেখতাম চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে আছে মাঝে মাঝে যখন খিদে লাগতো তখন ভ্যাক করে কেঁদে দিয়ে জেগে উঠতো সে।

 খুব সুন্দর একটা জীবন্ত খেলনা পেয়ে গিয়েছিলাম আমরা। স্কুলে যাওয়া ছাড়া প্রায় সময় পড়ে থাকতাম সাইমার পাশে। বাহির ও খেলতে যেতাম না আমি আর সায়েম। তাই নিয়ে বন্ধুদের সাথে অনেক গন্ডগোল তারপরে মারামারি হয় আমাদের। তারপরে সায়েম এবং সায়মা এরা দুজনই আমার একমাত্র বন্ধু হয়ে ওঠে ।

 সায়েম আর আমি একসাথে কলেজ পর্যন্ত পড়েছি। তারপরে ও বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজে চান্স পেল সেখানে চলে গেল আর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগে। কিন্তু সাইমা যখন ক্লাস এইটে পড়ে তখন থেকে ওর মধ্যে কেমন একটা পরিবর্তন দেখা শুরু করি।

 আমি আমার সামনে লজ্জা পাওয়া। ভাইয়া বলে ডাকতে না চাওয়া। কিন্তু প্রথমে আমি ব্যাপারটা অতটাও পাত্তা দিইনি। কিন্তু আমার কলেজ ফ্রেন্ড এর বোন সায়মার সাথে পড়তো । 

আমার সেই বন্ধু একদিন এসে আমাকে বলল,

---  কিরে খালাতো বোন ফিক্সড করে রাখছো নাকি। তোমার নামে সাধারণ কথা বলা যায় না।

আমি আর সায়েম কিছুটা ক্ষেপে উঠে বললাম,

---  কি যা তা বলতেছিস?

আমার সেই বন্ধু রাগ ঝেড়ে বলল ,

--- সায়মা আমার বোনকে ধরে মারছে আর চিল্লায় চিল্লায় স্কুলে বলছে তুই নাকি শুধুমাত্র ওর জন্য তোদের নাকি বিয়েও ঠিক হয়ে আছে।

কথাগুলো শুনে আমি আকাশ থেকে পড়েছিলাম পরে সায়েম সায়েমাকে চেপে ধরলে সে সবকিছু স্বীকার করে। কিন্তু আমি ওকে সবসময় আমার বোনের নজরেই দেখেছি।

ব্যাস ব্যাপারটা ওখানেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। সায়েম সাইমাকে খুব ভালোভাবে বুঝিয়েছিল। আমি ওকে অন্য দৃষ্টিতে দেখিনা ছোট বোনের মতোই দেখি। 

সাইমা চুপ হয়ে গিয়েছিল। তারপরে আমাদের এডমিশন টেস্টের পরে আমি ঢাকা আর সায়েম বরিশাল, সায়মা খুলনায় থেকে গেল।

এসব ব্যাপার নিয়ে আর কোন আলোচনা হয়নি আমাদের মধ্যে। কিন্তু আবার এই ব্যাপারটা সূত্রপাত ঘটে সায়মার বুয়েটে চান্স পাওয়ার পরে। ওর খুশি দেখে কে?

 যতটা না খুশি ছিল বুয়েটে চান্স পেয়েছে তার থেকেও বেশি খুশি ছিল ঢাকায় থাকতে পারবে বলে। ঢাকায় ওর ভালোভাবে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম আমি। 

আমিতো একটা ছোট ফ্লাট নিয়ে থাকতাম। বারবার যখন-তখন আমার ফ্লাটে এসে হাজির হত নানা বাহানায় থাকার চেষ্টা করত আমার ফ্ল্যাটে।

আমি দাঁতে দাঁত চিপে সাফওয়ানের কথার  উত্তর করলাম,

--- ফ্লাটে আর কি কি করতেন সেগুলো বলুন। ভেঙে বলুন শুনতে খুব ভাল লাগছে।

সাফওয়ান ক্ষেপে উঠলেন,

--- তোমার ওই অশ্লীল মস্তিষ্ক থেকে এইসব অশ্লীল চিন্তাভাবনা বাদ দাও। জীবনে সুখী হতে পারবা।

হ্যাঁ আপনি তো সুখী মানুষ সৌখিন মানুষ ভদ্র নম্র ধোয়া তুলসী পাতা একেবারে।

সাফওয়ান ডিভানে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বললেন,

---  তোমার থেকে ভালো আছি।

আমি দাঁতে দাঁত চিপে বললাম,

--- আপনাকে তো আমি।

সে চোখ বন্ধ করা অবস্থা তাই বলল,

---  যেখানে বসে আছো সেখানেই চুপচাপ থাকো এখনো কথা শেষ হয়নি আমার।

আমি থেমে গেলাম। কারন আমার সবকিছু জানতে হবে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য।

---- যেহেতু ছোট বোন মানি ওকে, সেহেতু ওর উপর একটা অন্যরকম দুর্বলতা ছিল আমার। ওর কোন কথা ফেলতে পারিনা আমি। হঠাৎ হঠাৎ ফ্লাটে এসে বায়না করতো চলো না ভাই আজকে একটু ঢাকা শহরটা ঘুরে দেখি। চলনা আজ বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসি। চলো আজ আমি রেস্টুরেন্টে খাব।

ওর সব বায়না আমি নির্দ্বিধায় মেনে নিতাম। আরো কি করতো গোপনে ছবি তুলে তুলে ফেসবুকে আপলোড করতো এবং বিভিন্ন ধরনের রোমান্টিক ক্যাপশন লিখতো। 

আমার ফ্রেন্ড সার্কেলদেরও বলেছিল এবং প্রমাণ দেখিয়েছিল যে আমি নাকি ওর বয়ফ্রেন্ড। ফ্রেন্ডরাও সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ছাড়তো। আমার হাজারবার না বলা কে সহস্রবার এর মতো হ্যাঁ মনে করত ওরা।

তাই একসময় হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। কাউকে কিছু বলতাম না। এর মধ্যে প্রায় অনার্স কমপ্লিট হয়ে যায় আমার। মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছি। এরমধ্যে আমার এক ফ্রেন্ড পুরো খবর নিয়ে আসলো আমার সো কল্ড গার্লফ্রেন্ড মানে সায়মা নাকি বুয়েটের কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কে আবদ্ধ। 

কথাটা অতটাও যাচাই করার ইচ্ছা হলো না কারণ বন্ধুদের সামনে নিজেকে প্রমাণ করার খুব দরকার ছিল যে আমি আর সায়মা কোন সম্পর্কে ছিলাম না। ফ্রেন্ডদের অনেকে বিশ্বাস করলো আবার অনেকে বলল সাইমা নাকি আমাকে ধোঁকা দিয়েছে। তা গেল।

 অনার্সে যেহেতু ভালো রেজাল্ট করেছি মাস্টার্সেও একটা ভালো রেজাল্ট আমার কাম্য‌ তাই বছরের প্রথম থেকেই পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ দিলাম একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম সায়মা আগের মত অত ঘনঘন আমার ফ্ল্যাটে আর আসে না। 

আগে যে মেয়ের সপ্তায় ৫-৬ দিন আসতো সে এখন মাসে সর্বসাকুল্যে একবার আসে। ব্যাপারটা তো আমিও খুশি হয়েছিলাম ভেবেছিলাম হয়তো পড়াশোনা একটু মনোযোগী হয়েছে।

 এর মধ্যেই হঠাৎ বাড়ি থেকে জানতে পারলাম ভাইয়া আর সামিরা আপুর বিয়ে ঠিক হয়েছে ফাইনাল পরীক্ষার পরেই বিয়ে। শুনে খুব খুশি হলাম আমারও সামনে পরীক্ষা পরীক্ষাটা শেষ হয়ে গেলে ভালোই মজার একটা মুহূর্ত কাটবে।

ধীরে ধীরে পরীক্ষার ডেট এগিয়ে আসতে লাগলো, আমিও পুরোটা পড়াশোনার মধ্যে ঢুকে গেলাম। সায়মার ব্যাপারটা পুরো মাথা থেকেই চলে গিয়েছিল আমার। এর মধ্যে সাইমা আর কখনো ফ্ল্যাটে আসেনি। পরীক্ষাটাও আলহামদুলিল্লাহ শেষ করলাম। 

এখন খুলনায় ফিরে যাওয়ার পালা। ডিসেম্বর মাস আমরা প্রায় সবাই ঝনঝাট মুক্ত। ব্যাগ পত্র গুছিয়ে সাইমাকে কল দিলাম ফোন ওয়েটিং পেলাম। মনে করলাম বাসায় হয়তো কথা বলছে। 

প্রায় আধা ঘন্টা পরে আবার রিং দিলাম তখন ওয়েটিং। এবার ফোন রেখে দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই সায়মা আমাকে কল ব্যাক করল। জানালো কালকে আমার সাথে খুলনায় ফিরবে। আমি যেন ট্রেন স্টেশনে জন্য অপেক্ষা করি।

পরের দিন ট্রেন ছাড়ার সময়ের অনেকটা আগেই আমি রেল স্টেশনে গিয়ে উপস্থিত হই। টিকিট অনুসারে আমার আর সাইমার সিট দেখে সিটের উপরে লাগেজ তুলে রেখে জানালা বরাবর বাইরে এসে স্টেশনে পাকা করে বাঁধিয়ে রাখা জায়গায় বসি। 

ট্রেন ছাড়ার ৫ মিনিট আগে দেখলাম সাইমা স্টেশনের মেন গেট থেকে ভেতরে আসছে। না দেখে আবার আমি আমার ফোনে নজর বন্ধ করলাম। এখন পরে দেখলাম সাইমা আমার কাছে এসে পৌঁছায়নি। 

নজর ঘুরিয়ে দেখলাম পিলারের পাশে কার সাথে কথা বলছে এবং লাস্টে জড়িয়ে ধরে বাই বলে টলি ব্যাগের হ্যান্ডেল ধরে এগিয়ে আসছে। পিলারের ওপাশে কে ছিল আমি দেখতে পাইনি।

আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,

--- তুমি কি আমার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছো ভাইয়া?

ওর মুখে ভাইয়া ডাক শুনে আমি যেন তাজ্জব বনে গেলাম। এবার বলে বলেও ভাইয়ার ডাক ডাকানো যায়নি। সে আজ নির্দ্বিধায় ভাইয়া বলে ডাকছে।

সাফানের মুখে সায়মার ভাইয়া ডাক সোনাটা শুনে নিজের মনের মধ্যে যেন একটা বসন্তের হাওয়া বয়ে গেল। সাফানের উপর অনেক রাগ হল ভাইয়া ডাকছে বলে পিত্তি জ্বলে গেছে ওনার। হুহ ঢং

তুমি আমার সাইট ব্যাগটা সরিয়ে ওই পাশে রেখে ওকে বসা জায়গা করে বললাম,

--- বেশি নয় মাত্র 15 মিনিট হলো বসে আছি।

--- ওহ 

বলেও ফোনে কি যেন করতে লাগলো। ট্রেনে উঠে বসার সংকেত দিতেই আমরা তাড়াতাড়ি সিটে গিয়ে বসে পড়লাম।

খুলনা পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেশ রাত হয়ে গেল আমাদের। বাড়িতে গিয়ে জানতে পারলাম আগামীকাল আপু আর ভাইয়ার এনগেজমেন্ট। রাতটুকু বিশ্রাম নিয়ে সকাল থেকে কাজে লেগে পড়লাম। 

ভাইয়াকে সাথে করে নিয়ে শপিংয়ে যাব এছাড়া ঘরোয়া ভাবে এনগেজমেন্টের আয়োজন করা হলেও আত্মীয়-স্বজনে ভরপুর ছিল বাড়িটা 

সন্ধ্যাবেলায় যখন এনগেজমেন্ট এর জন্য ভাইয়াকে তৈরি তৈরি করছিলাম তখন ভাইয়া আরও একটা প্যাকেট বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন তৈরি হয়ে আসতে। 

চেঞ্জিং রুমে গিয়ে প্যাকেট থেকে ড্রেস বের করতে দেখলাম ভাইয়ার এনগেজমেন্ট এর জন্য যে ড্রেস কেনা হয়েছে আমার জন্য সেই একই ড্রেস কিনেছে ভাইয়া। প্রথমে একটু সন্দেহ হলেও। পরে ভাবলাম তুই ভাই একই ড্রেস পরব। তাই হয়তো ভাইয়া কিনেছে। 

ভাইয়া আর আমি তৈরি হয়ে নিচে চলে আসলাম। পরে দেখি সামিরা আপু এবং সায়মা ও একই ড্রেস পরা। এবার আমার সন্দেহটা গাড়ো হল কি করতে চাইছে কি?

আমার ভাবনার মধ্যে ভাইয়া আর সামিরা আপু হাঁকে স্টেজে তোলা হলো । আংটি বদল হয়ে গেল। তখন আব্বু স্টেজে উঠে সবাইকে অবাক করে দিয়ে আমার আর সায়মার এঙ্গেজমেন্ট ঘোষণা করল। 

আমি যতটা না অবাক হয়েছি তার থেকে দ্বিগুণ অবাক হয়েছে সাইমা। ভয়ে ওর মুখটা রক্তশূন্য হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কেন সেটা আমি বুঝতে পারিনি।

আমাদের কথার মাঝে প্রীতম হঠাৎ ছাদে এসে বলল,

--- তোমরা এখানে বসে গল্প করছ আর আমি সারা বাড়ি খুঁজে মরছি। কতক্ষণ এখানে আছো তোমরা? মা ওই দিকে তোমাদের খাওয়ার জন্য ডাকছে।

প্রীতম কে বললাম,

--- তুই যা আমরা আসছি।

প্রীতম নাছোড়বান্দার মত সাফওয়ানের পাশে এসে তার হাত ধরে টেনে হিচড়ে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল আগে চলো পরে কথা বলবে তোমরা। এসো এসো

সাফওয়ান আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

--- খাওয়ার পরে বাকিটুকু বলবো।

আর এদিকে আমি হাজারটা প্রশ্নের মধ্যে ডুবে গেছি। সাইমা যদি সাফোয়ানকে এতটাই ভালবাসবে তাহলে এনগেজমেন্টের কথা শুনে কেন ভয় পেল এবং আতঙ্কে মুখটা রক্তশূন্য হয়ে গেল। 

তারমানে সায়মা যা বলেছে সব মিথ্যে কথা। আমার সাফওয়ান কেউ কতটা বিশ্বাস করব আমি? কেমন যেন সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। উফ উ ফ প্রীতমকে এখনি আসতে হলো।

 আমায় বাকিটুকু শুনতেই হবে না হলে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর ও আমি পাব না। আর না পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিতে পারব।


১৯ তম পর্ব🍂

পুরো টেবিল জুড়ে আম্মু তার জামাইয়ের জন্য এলাহী কাণ্ড বাধিয়ে ফেলেছে ‌। কি নেই এখানে সরষে ইলিশ, চিংড়ি মাছের মালাইকারি,তেল কই, মুরগির রোস্ট, গরুর মাংস, পোলাও,পায়েস, সালাদ।

চোখ বুলিয়ে শেষ করতে গিয়েই তো আমার চোখ ব্যথা হয়ে গেল আর এই ব্যাটা এত খাবে কি করে? কোথায় তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে বাকিটুকু বলবে তা না রান্নার যা বহর দেখছি খেতে খেতেই তো দুইদিন পার হয়ে যাবে।

সাফওয়ান হাত ধুয়ে এসে টেবিলে বসতেই চোখ চড়ক গাছ। দেখতে পেলাম ভয়ে তার মুখটা চুপসে গেছে। আহারে বেচারা...! 

আমার মা আজ হাতে করে তার সকল ডায়েটের বারোটা বাজাবে। বেশ হয়েছে, একদম ঠিক হয়েছে।

সাফওয়ান এবার মুখ খুললেন,

--- মামনি এত খাবার ?

আমার মা তার প্লেটে পোলাও বেড়ে দিতে দিতে বলল,

--- আমি জানতাম প্রীতমের জন্মদিনে আমার মেয়ে জামাই ঠিকই আসবে আর প্রথমবার আমার মেয়ে জামাই আমাদের বাড়িতে আসছে আয়োজন করতে হবে না এই তো তাড়াহুড়োর মধ্যে এই টুকুই আয়োজন করতে পেরেছি।

আমি ডাইনিং টেবিলের চেয়ারের উপর দুহাত ভাঁজ করে রেখে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আম্মুর কথা শুনে চেয়ার নিয়ে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম।

এটাকে সামান্য আয়োজন বলে.....! উরি মা রে তাহলে বড় আয়োজন কাকে বলে রে ভাই?এই যে আয়োজন করেছে এই যদি আমি একা রান্না করতে যায় তো চোখের জল নাকের জল এক  হয়ে যাবে।

 আমার।

আম্মু আমার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে বলল,

--- কি হইছে একটু কোমর সোজা করে দাঁড়ায় থাকা যায় না। ঠুস ঠাস করে চেয়ার নিয়ে পড়ে যাচ্ছিস।

আমি চেয়ারটা টেবিলের সাথে সোজা করে লাগিয়ে রেখে মায়ের উদ্দেশ্যে বললাম,

--- আমি ঠিক আছি কিন্তু তোমার এতো এতো রান্না গুলো তোমার জামাই বাবাকে খাওয়ালে তিনি ঠিক থাকবেন কিনা সন্দেহ।

আম্মু আমার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বলল কি বললি

না না কিছু বলিনি খাওয়াও খাওয়াও তোমার জামাই বাবাকে খাওয়াও। তা আমাদের কপালে কি কিছু জুটবে নাকি দেখেই পেট ভরতে হবে।

আম্মু আমাদের সামনে প্লেট দিয়ে বলল ,

তোরাও খেতে বস অনেক বেলা হয়ে গেছে।

আমি প্রীতমকে ডাক দিলাম। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম প্রিতমের হাত ধরে পুতুল হেলতে দুলতে এসে ডাইনিং এর চেয়ারে বসলো। আমি ওর সামনের প্লেটটা সোজা করে তাতে পোলাও তুলে বললাম,

--- কি দিয়ে খাবি পুতুল সোনা?

--- আমি পোলাও আর সরিষা ইলিশ খাব।

ভয়ে আমার মুখ শুকিয়ে গেল। আমি নিজেই ঠিকমতো ইলিশ মাছ বেছে খেতে পারি না। ওকে খাওয়াবো কি করে? পুতুলের কথার প্রতি উত্তরে মা শব্দ করে হেসে উঠলো। 

--- মামনি ও খাওয়াবে তোমাকে ইলিশ মাছ বেছে। নিজেই খেতে পারে না। ও নাকি আবার ইলিশ মাছ বেছে তোমাকে খাওয়াবে। আমার কাছে এসো মামনি, আমি তোমাকে ইলিশ মাছ বেছে পোলাও দিয়ে খাইয়ে দেবো।

 পুতুল কিছুক্ষণ দুই ঠোট চিপে আমার দিকে তাকিয়ে বসে থাকলো চেয়ারে। আমি অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ওর দিকে। ও কিছুক্ষণ ভেবে বলল,

--- আমি পোলাও আর রোস্ট খাব। খাইয়ে দাও প্রীতিলতা।

আমার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। তাড়াতাড়ি প্লেটে পোলাওয়ের রোস্ট তুলে নিয়ে ভাত মেখে ওর মুখে তুলে দিতে দিতে আম্মুর দিকে তাকালাম দেখলাম আম্মু সহ সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

--- বাবা কি ভালোবাসে প্রীতিলতাকে। তার হাতেই খেতে হবে। একদিন একটু আন্টির হাতে খাওয়া যাচ্ছিল না।

পুতুল মুখের খাবার চিবিয়ে খেয়ে নিয়ে বলল,

--- তুমি আমাকে ইলিশ মাছ বেছে দিও আন্টি রোস্ট খাওয়ার পরে আমি তোমার বাছা ইলিশ মাছ খাব।

আমরা সবাই ওর কথা শুনে হেসে উঠলাম।

প্রীতম এসে সাফওয়ানের পাশে বসলো। আর আম্মু সে তো তার মেয়ে জামাইয়ের প্লেটের উপরে সুন্দর করে একটা পাহাড় বানাই দিল।

সাফওয়ান অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছে। আমি ক্যাবলাকান্তের মতো একটা করে হাসি দিচ্ছি। আব তেরা কেয়া হোয়েগা কালিয়া হিহি হিহি।

________🌺🌺________

সাফয়ানদের খাওয়ার পর্ব শেষ হলো কিছুক্ষণ আগে। একটা বিষয় দেখে অবাক ও সাথে খুশি হলাম যে সাফোয়ান আম্মুকে নিরাশ করেনি। আম্মু যত্ন করে যাই মেয়ে জামাইয়ের প্লেটে তুলে দিয়েছে সাফওয়ান তার সব ই অতি তৃপ্তি সহকারে খেয়েছে। খাবারের অপচয় করিনি। যেটুকু খেতে পারবে। সেটুকুই প্রত্যেকটা আইটেম থেকে নিয়েছে।

আম্মু আজ মেয়ে জামাইকে খাইয়ে অনেক সন্তুষ্ট। শেষে প্লেটে মিষ্টি আর দই তুলে দিতে গেলে সাফওয়ান বাধা দিয়ে বলে,

--- মামনি এতক্ষণ কিন্তু তোমার ছেলে তোমার সব কথা শুনেছে। তুমি যা যা প্লেটে তুলে দিয়েছো সব কিন্তু আমি তৃপ্তি ভরে খেয়েছি। সত্যি বলতে পেটের মধ্যে আর এক ফোটাও জায়গা নেই। মিষ্টি আর দুই পরে খাব এখন আর নয়।

-- আর তোমার রান্না এককথায় দুর্দান্ত । বাহিরে এসে এত খাবার কিন্তু আমি কখনো খাই নি। এবার বুঝেছি প্রীতির হাতের রান্না কেন এত সুন্দর।

লাস্টের কথাটা কানে আসতেই চমকে উঠলাম। তাকিয়ে পড়লাম সাফওয়ানের দিকে। উনি কি আদৌ সেই সাফওয়ান। নাকি এই বাড়িতে আসার আগে ওনাকে জিনে ধরেছে। আমার আম্মুকে ও মামনি বলছে আবার আমার হাতের রান্নার প্রশংসা করছে।

সাফানের মুখে আমার হাতের রান্নার প্রশংসা শুনে আম্মু খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,

--- তুমি যাও বাবা উপরে গিয়ে বিশ্রাম করো।

এই প্রীতম তোর ভাইয়াকে নিয়ে যা। পরে প্রীতমের সাথে সাফওয়ান রুমে চলে গেল। পুতুলেরও খাওয়া শেষ তাই পুতুল ও তাদের পিছন পিছন চলে গেল।

আমি আর আম্মু এবার খেতে বসলাম। আম্মুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার চোখে মুখে তৃপ্তির হাসি জ্বলজ্বল করছে। আমাকে খাবার বেড়ে দিতে দিতে বললেন,

ভাগ্য করে সত্যিই আমি একটা মেয়ে জামাই পেয়েছি। এত বড় লোকের ছেলে হওয়ার পরেও কত তৃপ্তি সহকারে গরিবের ঘরে ভাত খেলো। প্রিতমের সাথেও দেখলি কত মিলেমিশে চলছে। আবার তোর রান্নার প্রশংসা করলো।

মায়ের কথা সবগুলো শুনে আমার মনের মত আলাদা একটা শান্তি অনুভব করলাম । মুখে বিড় বিড় করে কয়েকবার আওড়ালাম," আমার জামাই"।

_______🌺🌺_______

দই আর মিষ্টির ট্রে নিয়ে আমার রুমে আসলাম আমি। প্রথমে প্রীতমের রুমে গিয়ে দেখি সাফোয়ান সেখানে নেই। পরে প্রীতম বলল যে সাফওয়ান নাকি আমার ঘরে গেছে। রুমে এসে দেখলাম আমার পরিপাটি ছিমছাম রুমটা ঘুরে ঘুরে দেখছেন তিনি। আমার রুমে তেমন কিছুই নেই কিছু প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র ছাড়া। 

দই আর মিষ্টির ট্রেটা বিছানার ওপরে রেখে তাকে বললাম খেয়ে নিন মা পাঠিয়েছে।

সাফওয়ান আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

--- তোমার রুমটা খুব সুন্দর। আর ওয়াল আর্ট গুলো তো আরো বেশি সুন্দর। তোমার হাতের কাজ সত্যিই প্রশংসা যোগ্য আর এই মেডেল গুলো কিসের জন্য পেয়েছিল?

আমি স্থির দৃষ্টিতে সাফওয়ানে দিকে তাকিয়ে থাকলাম এই এক মাসে হয়তো তিনি আমার সাথে এত কথা একসাথে  বলেননি। কিন্তু আজ উনার কি হয়েছে বুঝতে পারছিনা।

আমি খাটে বসে দেয়ালে ঝোলানো মেডেল গুলোর দিকে পুরাতন স্মৃতি গুলোর মধ্যে ডুবে গিয়ে বললাম 

--- এগুলো আমি স্কুলে থাকতে পেয়েছিলাম। জাতীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতা ২০১৮ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল "সরকারি করোনেশন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় খুলনা।"

 যার তিনজন প্রধান প্রতিযোগী ছিলাম আমি , তন্বী আর হিয়া ট্রফি তো স্কুল রেখে দিয়েছিল কিন্তু এই মেডেলগুলো আমাদের পরিয়ে দিয়েছিলেন মোহাম্মদ জাফর ইকবাল আর প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আনিসুর হক।

কথাগুলো বলা শেষ হতেই ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসলো। ইস্ আবার যদি সেই লাল সাদা স্কুল ড্রেসটা গায়ে জড়িয়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ফিরে যেতে পারতাম সেই স্কুলের বারান্দায়। কতটাই না সুখময় ছিল সেই দিনগুলো।

২০১৭ চ্যাম্পিয়ন কিন্তু আমরা ছিলাম খুলনা জিলা স্কুল এটা ভুলে যেও না কিন্তু। আর চ্যাম্পিয়নশিপের প্রধান প্রতিযোগী কিন্তু আমি ছিলাম।

আমি ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে গাল বাঁকিয়ে হেসে বললাম,

--- তাহলে তো আপনি আমার চিরকালের প্রতিদ্বন্দ্বী।

তা ঠিক বলেছ। যেহেতু দুইজনই চ্যাম্পিয়ন ছিলাম বিতর্কতে সেহেতু একদিন প্র্যাকটিকাল প্রতিযোগিতা করাই যাই বল।

 আমি তার দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বললাম,

---  এখন কি কম হচ্ছে নাকি যে আলাদাভাবে প্রাকটিক্যাল প্রতিযোগিতা করতে হবে। তাছাড়া ভবিষ্যতে আমরা এভাবে এক জায়গায় বসে থাকবো  তার কি গ্যারান্টি আছে। এমনও তো হতে পারে এটাই আপনার সাথে আমার শেষ যাত্রা।

সাফওয়ান বোধহয় কিছুটা চমকে উঠলেন। কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। আমি উঠে চলে আসছিলাম তো আমার ডান হাতটা আঁকড়ে ধরে থামিয়ে দিয়ে বললেন,

--- বাকিটুকু শুনবেনা?

আমি তার দিকে না তাকিয়েই দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বললাম আপনার ওই অর্ধেক বিয়ের কাহিনী আমার শুনতে ইচ্ছা করছে না।

সাফওয়ান হাসলেন। তারপর আমার হাতটা জোরে টান দিয়ে তার বুকের সাথে আমার পিঠ ঘেঁষে বসিয়ে দিয়ে দুই হাতে আমাকে আটকে দিয়ে বললেন,

--- আরে শোনো শোন, না হলে দুপুরে যে কটা ভাত খেয়েছ ওগুলো আর হজম হবে না।

ঐদিন এনগেজমেন্টের সন্ধ্যায় ভাইয়াদের পরে আমার আর সায়মার এনগেজমেন্ট ও হয়ে গিয়েছিল। খালামনির আমার হাত আঁকড়ে ধরে বলা কথাগুলো আমি ফেলতে পারিনি। তোমাকে আগেই বলেছি আমার জীবনে খালামণির অবদান অনেক।

কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সায়মার মুখে আমি কোন হাসি দেখতে পাই নি। মুখ দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে কি সে আদৌ খুশি হয়েছে নাকি আপত্তি আছে । অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাওয়ার পরে আমরা সবাই যে যার বাসায় চলে আসি এবং আমার বাবা আগ বাড়িয়ে ই একই দিনে দুই ছেলের বিয়ে ঠিক করেন তাও সামনের সপ্তাহে । মানে এগুলো তাদের আগে থেকেই প্ল্যান করা ছিল। 

রাতে বিছানায় ঘুমাতে যাওয়ার সময় হঠাৎ আমার সেই বন্ধুটার কথা মনে পড়ল যে বলেছিল বুয়েটের এক শিক্ষকের সাথে নাকি সায়মার সম্পর্ক আছে। আমি তাকে ফোন করলাম। আমার ব্যাপারে তার কাছে শুনলাম সে সিউরিটি দিয়ে বলল আমাকে যে যা সে যা বলেছে সব সত্য। ফোন কেটে দিয়ে এবার আমি সাইমাকে ফোন দিলাম। দেখলাম ফোন এনগেজড। পরে কিছুক্ষণ পরে সাইমা আমাকে কল ব্যাক করে তাড়াহুড়ো করে বলে,

--- আসলে বাসা থেকে এমন সিদ্ধান্ত নেবে আমি নিজেও জানতাম না। তোমার এই বিয়েতে মত আছে।

ওর কথার উত্তর না দিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলাম,

--- তুমি কি অন্য কাউকে পছন্দ করো সাইমা?

সাইমা ওপাশে চুপ হয়ে গেছে আর একটা কথাও বলছে না। আমার সন্দেহ আরো গাড়ো হয়। ও হঠাৎ বলে ওঠে ,

--- না না আমি তো এটাই চেয়েছিলাম। এ বিয়েতে আমার কোন সমস্যা নেই।

সাফওয়ানকে থামিয়ে দিয়ে আমি তাকে বললাম,

--- তাহলে বিয়েটা হলো না কেন? আর ও কানাডা চলে গিয়েছিল বলে, সেদিন তো আমাকে তাই বলল। ও নাকি অনেক সুন্দর একটা অপরচুনিটি পেয়েছিল।

সাফওয়ান গাল বেঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,

অপরচুনিটি না ছাই। ওর ওই বুয়েটের স্যারের সাথেই পালিয়ে ছিল সেদিন।বউ কমিউনিটি সেন্টার থেকে পালিয়ে গেছে। 

 বিয়ের ঐ ভরা মঞ্চে ওতগুলো আত্মীয়-স্বজনের সামনে আমি একটা কার্টুনে পরিণত হয়েছিলাম। আমার ইউনিভার্সিটি টিচার আমার ফ্রেন্ডস সবাই ছিল সেখানে। আমার বাবার ওই হটকারী সিদ্ধান্তের জন্য সেদিন অনেক অবদস্থ হয়ে ছিলাম আমি।

তারপরও সেদিন বড় ভাইয়া আর সামিরা আপুর বিয়ে সম্পন্ন হয়। খালামণি আমার হাত ধরে বলেছিল,

--- মাফ করে দে সাফু বাবু। আমি বুঝতে পারিনি ওই মেয়ে এমন করবে। আর দয়া করে এই কথা তুই সায়েম কে জানাবি না ও তো এখন ইন্টার্নশিপের জন্য বান্দরবনে আছে। জানতে পারলে ওই মেয়ের মুখ আর কখনো সায়েম দেখবে না।

খালামনির কথাগুলো শুনে ওই কমিউনিটি সেন্টারে আরেক মুহূর্ত দাঁড়াইনি আমি বেরিয়ে চলে এসেছিলাম। আমার ফ্রেন্ডরা তো আমাকে বারবার বলতে লাগলো তোকে সাবধান করেছিলাম কিন্তু তুই শুনিস নি। দেখ গরিবের কথা বাসি হলেও মিষ্টি হয়।

বাড়ি এসে পোশাক পরিবর্তন করে কাউকে কিছু না জানিয়ে ফোন অফ করে ছোট একটা ব্যাগ গুছিয়ে রওনা হয়ে গেলাম উদ্দেশ্যহীন পথের দিকে। সেখান থেকেই আমার ভ্রমণের নেশা চেপে বসেছে। যখনই মনটা খারাপ হয়। বা মনে হয় যে আমার চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে গেছে তখনই আমি বেরিয়ে পড়ি মুক্ত বায়ু সন্ধানে।

পরে অবশ্য জানতে পেরেছিলাম বুয়েটের ওই স্যারের অন্য আরেক জায়গায় আগেই বিয়ে হয়েছিল সেটা জানতে পেরে ঢাকায় সেই হোস্টেলে কয়েকদিন ছিল সায়মা। বাড়িতে আসার তো কোন উপায় ছিল না ওর ।তারপরে কানাডা চলে গিয়েছিল। এই কয়েকদিন আগে ফিরেছে কানাডা থেকে। ফিরে এসেই আবার....

কৌতুহলীভাবে প্রশ্ন করলাম,

--- আবার কী?

--- প্রথম অপশনটাকে হারিয়ে এখন দ্বিতীয় অপশনের পিছনে ছুটছে।

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেঝের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললাম,

--- তা সমস্যা কোথায় বলুন। আপনি তো আর আমাকে ভালোবাসেন না। সাইমাকে না হয় একটা সুযোগ দিন।

সাফওয়ান দাঁতে দাঁত চেপে আমাকে দুই হাতে নিজের সাথে চেপে ধরে মুখটা নামিয়ে এনে আমার কানের কাছে বললেন,

--- আমাকে কি বাজারের আলু পটল পেয়েছো? যে যাকে ইচ্ছা তাকে অধিকার দিয়ে বসে থাকবো। মনের সিংহাসনে বসার অধিকার মাত্র একজনের থাকে বুঝেছ।

তার বুকে পিঠ ঘেষে বসে থাকা অবস্থায় মাথাটা তার কাঁধে এলিয়ে দিয়ে ধিমে গলায় বললাম,

--- তা পেয়ে গেছেন বুঝি...!

সাফওয়ান নিজের হাতের বাধন আরও শক্ত করে বললেন,

--- হয়তো।

কথাটা শুনে অভিমানে চোখে পানি চলে আসলো আমার। ধরা গলায় বললাম,

--- সে কি আপনার খুব বেশি আপন....?

আমার কাধের কাছে তার উষ্ণ নিঃশ্বাসের অস্তিত্ব অনুভব করলাম। তৎক্ষণাৎ আমার কাঁধে মুখ ডুবিয়ে দিয়ে জড়ানো কন্ঠে বললেন,

--- হুমমমম খুবই....!

আমি আবেশে চোখ বুজে নিলাম।

লাস্টের লাইনটা কান পর্যন্ত পৌঁছালেও মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছালো না আমার।


২০ তম পর্ব🍂


ড্রয়িং রুমটা খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে প্রীতমের জন্মদিন উপলক্ষে। ওর কিছু ফ্রেন্ডস কেউ নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আব্বু অফিস থেকে ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে। ফ্রেশ হয়ে এসে সোফায় বসে সাফওয়ানের সাথে কথা বলছেন।

 টেবিলে সবকিছুই প্রায় সাজানো গোছানো হয়ে গেছে শুধু কেক টাই প্যাকেট থেকে বের করে রাখা বাকি। প্যাকেট খুলে কেকটা টেবিলে রাখতে গিয়ে সাফওয়ানের দিকে নজর চলে গেল। দেখলাম আব্বুর সাথে কথা বলতে বলতে তিনি আর চোখে আমার দিকে তাকালেন। তাড়াতাড়ি আমি চোখ সরিয়ে নিলাম।

মুহূর্তে কিছুক্ষণ আগের ঘটনা মনে পড়ে গেল।

 তার স্পর্শগুলো গভীর থেকে গভীরতার হওয়ার আগেই নিজেকে তার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলাম।

কি দরকার নিজেকে এই মিথ্যা মায়ায় জড়ানো। উনি এটা বললেন ঠিকই যে সে সাইমাকে পছন্দ করেন না। তিনি একবারও বললেন না তিনি আমাকে পছন্দ করেন। বা ভালোবাসেন। দুটো শরীর একত্রে থাকলে আকর্ষণ তো আসবেই কিন্তু মনের আকর্ষণ...!

এটা তো বেশি ইম্পরট্যান্ট তাই না। একটা সময় পড়ে গিয়ে শরীরের উপরে আর কারো আকর্ষণ থাকে না। চামড়া কুঁচকে যায় বয়সের ভারে নুয়ে যেতে হয় কিন্তু মনের আকর্ষণটা সে প্রথমবারের মতোই সতেজ থেকে যায়। যার আকর্ষণে শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত সমস্ত ঝর ঝাপটা পেরিয়ে প্রিয় মানুষটার হাত আঁকড়ে ধরে থেকে যাওয়া যায়।

আজ আবারও সেই প্রথম দিনের মত বুকের বা পাশটা খুব যন্ত্রণা করছে। আমি ভেবেছিলাম আজ হয়তো তিনি সবকিছু বলে আমাকে নিজের মনের কথাগুলো বলবেন। আশায় বুক বেঁধেছিলাম আমি। আজি হয়তো বলবেন,

--- প্রীতি আনমনে সত্যিই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি । থেকে যাওনা সারা জীবন আমার পাশে। আমি তোমাকে প্রয়োজন আর মনের প্রয়োজনে

বেহায়া মত বারবার তাকে একই প্রশ্ন করেছি কিন্তু একবারও তিনি বললেন না। উঠে রুম থেকে বেরিয়ে আসার সময় পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখছিলাম। তিনি হয়তো অবাক হয়ে গিয়েছিলেন আমার আচরণে।

 এতদিন তো স্বেচ্ছায় তার কাছে ধরা দিতে চেয়েছি। ভগ্ন বিক্ষুব্ধ হৃদয় নিয়ে ফিরে এসেছি। কিন্তু আজ নিজেই নিজেকে তার কাছ থেকে গুটিয়ে নিচ্ছি। 

দুটো মানুষকে এক ছাদের নিচে বাধলেই সংসার হয় না। উভয় দিক থেকে ভালোবাসা বরাবর হতে হয়। একজন কাঙালের মত ভালবাসবে আরেকজন তা বসে বসে উপভোগ করবে এমনটা হলে আর যাই হোক সংসার করা যায় না। 

এমন একজনকে ভালো না বাসলেই বোধ হয় ভালো করতাম।

_________🌺🌺________

প্রিতমের বন্ধুরা বেরিয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে। প্রীতম আজ বেজায় খুশি। তার জন্মদিনটা একদম তার মনের মতো করে পালন করা হয়েছে। এবং এবারের জন্মদিনের সে তার সবথেকে পছন্দনীয় উপহার তার দুলাভাইয়ের কাছ থেকে পেয়েছে।

রাত আটটা বাজে,

আম্মু ডাইনিং এর খাবার গোছাচ্ছে। আজ  সবাই অনেক ক্লান্ত। তাই আগে আগে খেয়ে নেওয়াই ঠিক হবে বলে আমার মায়ের মনে হয়। পুতুলকে দেখলাম সোফায় বসে বসেই ঝিমুচ্ছে। বেচারী আজ দুপুরে আর ঘুম হয়নি। সারাদিন লম্প ঝম্প করে এখন সে খুবই ক্লান্ত। তাকে ডাকতে যাব তখন দেখি কলিং বেল বেজে উঠল।

বাসায় তো সবাই আছে। এখন আবার কে এলো? তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা খুলে দেখে একটা ছেলে কিছু শপিং ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে সালাম দিয়ে বলল,

--- সাফোয়ান স্যারকে একটু ডেকে দিন। এগুলো ওনার পার্সেল।

আমি ভ্রু কুচকে মনে মনে ভাবলাম ওনার পার্সেল এখানে আসবে কেন? লোকটাকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে আমি সাফওয়ানকে যেই ডাকতে যাব।

 তখন দেখলাম তিনি রুম থেকে বেরিয়ে মেইন দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন। ছেলেটার হাত থেকে প্যাকেট গুলো নিয়ে সালাম বিনিময় করে বিদায় জানালেন। তারপরে দরজা আটকে দিয়ে প্যাকেট গুলো নিয়ে সোফায় গিয়ে বসলেন।

প্যাকেট গুলো ভালোভাবে চেক করে সোফার এক সাইডে রেখে দিয়ে আমার এসব বললেন রুমে এসো তোমার সাথে কথা আছে।

আমি তাকিয়ে দেখলাম মা রান্নাঘরে। প্রীতম টিভি দেখছে পাশের সোফায় প্রিতমের হাতের উপরে হেলান দিয়ে পুতুল শুয়ে আছে।

কিছুক্ষণ পরে আমি চলে গেলাম আমার রুমে। গিয়ে  দেখলাম তিনি রেডি হয়ে বিছানায় বসে হাতে ঘড়ি পরছেন। আমাকে দেখে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,

--- তাড়াতাড়ি রেডি হও আমরা কিছুক্ষণ পরে বাড়ি ফিরে যাব।

--- আমি দুইদিন পরে যাব।

--- তোমার ব্যাগের সাইজ দেখে তো মনে হচ্ছে না তুমি দুই দিনেও ওই বাড়ি আসবে। কালকে সকালে ফ্লাইটে মা বাবা ওমরা পালন করে ফিরছে।

আমি সাফওনের দিকে তাকালাম । তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললাম,

--- ও আচ্ছা এবার বুঝেছি। আপনি কেন বারবার আমাকে ওই বাড়ি ফিরে যেতে বলছেন। কাল সকালে যখন মা-বাবা আসছেন তার আগে আমি ওই বাড়ি পৌঁছে যাব। কিন্তু রাতে আমি এই বাড়িতে থাকব।

--- কাল সকালে তুমি কার সাথে যাবে?

আমি দায়সারাভাবে উত্তর দিলাম,

--- আমি তো আগেও খুলনা থাকতাম। হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছি। আমার একা একা যাতায়াতে অভ্যাস আছে। চিন্তা করবেন না ভোরেই পৌঁছে যাব।

সাফওয়ান আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন,

--- আমাদের বাড়ির মেয়ে বউরা এমন একা একা যাতায়াত করে না। একা একা এ বাড়িতে এসেছো ঠিক আছে কিন্তু এ বাড়ি থেকে ও বাড়িতে ফিরবে তুমি আমার সাথে।

কথাগুলো বলে দরজা খুলে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন সাফওয়ান কিন্তু আমার একটা কথা শুনে তিনি থেমে গেলেন।

---- চিন্তা নেই আপনাদের বাড়ির বউ এর তকমাটা আমার নামের পাশ থেকে কিছুদিনের মধ্যেই  মুছে যাবে।

শব্দ করে দরজা আটকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি।

__________🌺🌺__________

মামনি আমি রাতেই প্রীতিকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে যেতে যাচ্ছি। 

কেন বাবা এত রাত থেকে যাও আমাদের বাড়িতে এতদিন পর আমার মেয়েটা এসেছে আর তুমিও তো প্রথমবার এসেছ। জামাই মেয়ে প্রথমবার বাড়িতে এলে একরাত থাকতে হয়।

আম্মু খুবই অনুরোধের সুরে কথাটা বললেন। সাফওয়ান আম্মুর হাত জোড়ায় জড়িয়ে ধরে বলল,

কাল সকালে মা বাবা চলে আসছে। প্রীতিকে নিয়ে  এয়ারপোর্টে যেতে হবে। না হলে ও আর আমি এক সপ্তাহ থেকে যেতাম এই বাড়িতে।

আমি খাওয়ার টেবিলে বসে মা আর সাফোয়ানের কথাগুলো শুনছি আর খাচ্ছি। নিরবা নির্মিত ভঙ্গিতে। তাদের কথা যেন আমার কোন কিছু যায় আসে না।

পরে অনেক জোরাজুরি শেষে আম্মু আমাদেরকে যেতে দিলে রাজি হলেন। কিন্তু শর্ত দিলেন সামনের সপ্তাহে এ বাড়িতে দাওয়াত আছে সে সময় আম্মু আমাকে ১০ দিন এ বাড়িতে রেখে দিবেন।সাফওয়ান 

বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিলেন।

খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাইকে সাফওয়ান ড্রইং রুমে ডাকলেন। সোফায় বসে এক এক করে মা বাবা আর প্রীতমের দিকে তিনটি শপিং ব্যাগ এগিয়ে দিলেন।

বাবা সাফোয়ান কে বলে উঠলেন,

--- বাবা এসবের আবার কি দরকার ছিল?

সাফওয়ান মুচকি হেসে বাবার পাশে বসে বললেন ,

--- মা বলছিল জামাইরা প্রথম শ্বশুরবাড়ি গেলে শ্বশুরবাড়িতে বাজার করে নিয়ে যেতে হয় আরো অনেক উপঢৌকন দিতে হয়। আমিও প্রথমবার আসলাম কিন্তু তাড়াহুড়ায় তেমন কিছুই আনতে পারিনি। এই সামান্য ...!

আমরা তোমাকে আমাদের ছেলের মতোই মনে করি। কোন বিষয় নয় তুমি এসেছ এটাই অনেক।

--- আমিও সেই ভেবে এইগুলো এনেছি বাবা। তাছাড়া এগুলো দেওয়ার আরও একটা কারণ আছে যেটা এখন বলতে পারছি না পরে সবাইকে বলব ইনশাল্লাহ।

এবার আমাদের বিদায় দিন। আমাদেরকে এখন বেরোতে হবে।

______🌺🌺_______

প্রায় দেড় ঘন্টা জার্নি শেষে বাসায় এসে পৌছালাম আমরা। রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিল। তাছাড়া এমনিতে সকালে জার্নি করে যাওয়া তার উপর ভাইয়ের বার্থডে সেলিব্রেশন আবার এই জার্নি সবমিলিয়ে আমি অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। 

ঘুমে দুচোখ বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে আমার অনেক কষ্টে পা চালিয়ে মেইন রোডের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম বেশ কয়েকবার ডোরবল বাজালাম বেশ খানিকটা সময় পড়ে এসে কে জানি দরজাটা খুলে দিল কিন্তু চেহারাটা দেখতে পেলাম না। 

আমিও আর অত কিছু না ভেবে নিজের প্রায় অবশ হয়ে যাওয়া পা জোড়া টেনে নিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছিলাম তখন পেছন থেকে কারোর কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম।

--- কেমন আছেন মিসেস প্রীতিলতা? এই অধমের দিকে তো একটু দৃষ্টিপাত করুন। তিনি তো আপনার অপেক্ষায় অনেকক্ষণ যাবত আপনার পথ চেয়ে বসে আছে।

পিছনে ফিরে দেখলাম। সুঠাম দেহের টোল ওয়ালা ডাক্তার ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে আমার পিছনে। আমি ক্লান্ত মিশ্রিত হাসি হেসে বললাম,

--- আরে কখন এলেন ভাইয়া?

--- সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পরে। সে শুনলাম আপনারা নাকি সবাই বাইরে গেছেন। এই তো বসে বসে আপনাদের অপেক্ষা করতে লাগলাম। তা এই অধমের সাথে কি দুমুঠো ভাত খাওয়া যায়।

তখনই পেছন থেকে সাফওয়ান বলে উঠলো,

--- ওই বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছি। তুই খেয়ে নে সায়েম। আমরা অনেক ক্লান্ত আজ। কাল সকালে জমিয়ে আড্ডা দেওয়া হবে।

কথাগুলো বলে সাফওয়ান আমার বাম হাত  টেনে নিয়ে আসলেন রুমে। পুতুলকে রুমে নিয়ে যাওয়ার আগে আমাকে বলে গেলেন ফ্রেশ হয়ে নিতে। 

আমিও বিনা বাক্য ব্যয় ফ্রেশ হতে চলে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে দেখি। সাফওয়ান অলরেডি পোশাক চেঞ্জ করে বিছানায় বসে পানি খাচ্ছে। হয়তো পুতুলের রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসেছে।

আমি ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে সাফয়ানের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলেন ‌। আমার হাত ধরে আটকে দিয়ে বললেন,

--- কোথায় যাচ্ছ তুমি?

আমি তার দিকে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,

--- পুতুলের ঘরে।

সাফওয়ান উঠে আমার সরাসরি দাঁড়িয়ে বললেন,

--- কেন বিয়ে করে বউ হয়ে কি এ বাড়িতে এসেছিল পুতুলের রুমে থাকার জন্য?

আমি অশ্রুসিক্ত নয়নে তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,

--- এখানে মানুষটাই আমার নয় সেখানে এই রুম দিয়ে আমি কি করবো?

সাফওয়ান কিছুটা চাপা ধমকের সুরে বলে উঠলেন,

--- তখন থেকে খালি আজেবাজে কথাবার্তা বলে যাচ্ছ তুমি। কি বলতে চাইছ কি তুমি?

--- মুক্তির ঘণ্টা বেজে গেছে সাফোয়ান। আমার মুক্তি চাই সবকিছু থেকে। মুক্তি.....!

তিনি যেন আর রাগ সংবরণ করতে পারলেন না। আমার দুই বাহু সে তার শক্তপাঞ্জা দ্বারা আটকে ধরে ঝাঁকিয়ে উচ্চস্বরে বললেন,

--- মুক্তি...! কিসের মুক্তি। একটা কথা কান খুলে শুনে রাখ মৃত্যু ব্যতীত এই ঘর থেকে তোমার কোন মুক্তি নেই.....!


২১ তম পর্ব🍂

ফজরের নামাজ শেষ করেই রান্নাঘরে চলে এসেছি। আর বের হওয়ার সুযোগ পাইনি। কতদিন পরে মা-বাবা আসছেন। তাদের জন্য প্রায় ১৫ থেকে ১৬ টা আইটেম রান্না করার প্রস্তুতি নিয়েছি আমি। আর আমাকে সব দিক থেকে সাহায্য করছে রহিমা খালা।

 দশটার ফ্লাইটে যশোর এয়ারপোর্টে এসে নামবে, মা বাবা। তারপর সেখানকার ফরমালিটি কমপ্লিট করে বাসায় পৌঁছাতে কটা বাজবে তার ঠিক নেই। তাছাড়া জার্নিপথেও তেমন কিছু খাওয়া দাওয়া করা যায় না। তাই এলেই তাদেরকে আগে খাবার দিতে হবে। সে অনুযায়ী তো আমাকে আগে আগেই রান্না শেষ করতে হবে তাই আমার এত তাড়াহুড়ো।

রহিমা খালা এক এক পদ কেটে কুটে গুছিয়ে দিচ্ছে আর আমি রান্নার জন্য তা চুলায় চাপিয়ে দিচ্ছি। জার্নি করে আসছেন সেজন্য লাইট খাবার যেমন শাকসবজি আছে তার পাশাপাশি মাছ মাংসের রান্না করছি আমি।

বড় ভাইয়া, সাফওয়ান, সায়েম ভাইয়া, আর পুতুল নয়টার দিকে বের হবেন যশোরের উদ্দেশ্যে। এর আগে তাদেরকেও সকালের নাস্তা দিতে হবে। বলতে গেলে একেবারে তাড়াহুড়ো বেধে গেছে আমার।

 হঠাৎ ভাবি এসেছেন রান্নাঘরে। আমার সাইডে এসে দাড়ালেন তিনি। আমি শত ব্যস্ততার মধ্যেও তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম। তরকারির কড়াইটা চুলার উপর থেকে পাশে নামিয়ে রাখতে রাখতে ভাবিকে জিজ্ঞাসা করলাম,

--- তোমার র কিছু লাগবে ভাবী?

ভাবি না বোধক মাথা নাড়ালেন। তারপরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

--- রান্নাবান্না কি সব শেষ হয়ে গেছে তোমার?

--- না ভাবি এখনো কয়েকটা পদ বাকি আছে। মাছ-মাংসের সকল আইটেম শেষ হয়ে গেছে রান্না করা সবজি আর ভাত ,পায়েস আর সালাদ বাকি আছে। 

তার আগে ওনাদের জন্য সকালের নাস্তার ব্যবস্থা করতে হবে তাই এখন রুটি বানাবো। মাংস রান্না করা হয়ে গেছে মাংস দিয়ে খেয়ে চলে যেতে পারবে তারা।

---  আচ্ছা ঠিক আছে তুমি আমার কাছে দাও আমি রুটি বানাচ্ছি।

আমি চমকেও উঠলাম। বিয়ের এক মাসের মাথায় এই প্রথমবার দেখলাম ভাবি রান্নাঘরে এসেছে তার উপর আবার রান্না করতে চাইছেন। খালামণি বলেছিলেন। সামিরা ভাবি নাকি ভালো রান্নাবান্না পারেন না।

আমি হেসে বললাম,

--- ভাবি তুমি কি কি রান্না করতে পারো?

দেখলাম ভাবির মুখটা কেমন ভয়ে চুপসে গেছে। আমতা আমতা করে বললেন,

 আসলে তেমন রান্নাবান্না পারিনা আমি কিন্তু রুটি,ভাত, পায়েশ চা কফি নুডুলস এগুলো টুকটাক রান্না করতে পারি।

আমি ভাবীর হাত জোড়া আঁকড়ে ধরে বললাম,

--- চা টা এখনো আমি বানাতে পারিনি। একটু কষ্ট করে চা বানিয়ে দেবে। তারে আমি এদিকে রুটিগুলো বেলে দি ই তুমি না হয় ছেঁকে দিও।

ভাবির মুখে খুব মিষ্টি একটা হাসি ফুটে উঠলো। সম্মতি জানিয়ে চা বানাতে উদ্ধত হলেন তিনি। পিছনে তাকিয়ে দেখলাম রহিমা খালার কিছুটা রাগ হয়েছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে ইশারায় মাথা নাড়িয়ে রাগ করতে নিষেধ করলাম।

সবাই সব গুণের অধিকারী হতে পারে না।ভাবি হয়তো রান্নাটা পারেন না কিন্তু ডাক্তারি চিকিৎসায় তার নৈপুণ্যতা আছে। মানুষের সেবায় তিনি ফ্রন্ট লাইনার হিসাবে কাজ করেন। মানুষ হিসেবে উনি যথেষ্ট ভালো। এটাই তার বড় গুণ।

তার মধ্যেই ভাবি আমাকে বলে উঠলো,

--- সাফওয়ানের কাপে কয় চামচ করে চিনি দাও প্রীতি?

--- এক চামচ দাও ভাবি।

কথাটা বলে আমি রুটি বেলায় মনোযোগ দিলাম।

_________🌺🌺_______

সাফোয়ান ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখল এখনো চা নিয়ে আসেনি প্রীতি। বিরক্তিতে তার মুখটা সামান্য কুঁচকে গেল। সাফওয়ান রুম থেকে বের হয়ে পুতুলের রুমে গেল। দরজা ঠেলা দিয়ে ভিতরে ঢুকে দেখল পুতুল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এক একটা জামা নিজের গায়ে ধরছে আর দেখছে আর বিছানার উপর ফেলে দিচ্ছে।

 সাফওয়ান পুতুলের রুমে ঢুকে দেখে বিছানার উপরে পাহাড় বানিয়ে ফেলেছে জামাকাপড়ের। তা দেখে তার কপালে আরো বেশি বিরক্তি ভর করলো। বিছানা থেকে চোখ সরিয়ে পুতুলের দিকে তাকিয়ে বলল,

-- তোর অত দেখে কাজ নেই যা পরবি তাতেই পেত্নীর মত লাগবে। আর বিছানার উপরে কি জঙ্গল বানায় রাখছিস। দেখে তো মনে হচ্ছে সুন্দরবনে চলে আসছি।

--- তোমাকে কে আসতে বলেছে আমার সুন্দরবনে।

--- বেশি কথা বলিস তোর ভাবী কোথায় রে?

--- ও আমার প্রীতিলতা হয়।

--- তার আগে ও আমার বউ হ.....

কথাটা বলে নিজেই তাজ্জব বনে গেল সাফোয়ান। পুতুল চোখ মোটা মোটা করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

--- তুই কি বললি ভাইয়া?

সাফওয়ান আমতা আমতা করে বলল,

--- ক্ কোথায় কী বলছি? যা তোর প্রীতিলতাকে গিয়ে বল আমাকে চা দিতে। আর বিছানার উপরে জঙ্গল পরিষ্কার কর । না হলে এসব জামা একটা ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে রেল স্টেশনে ফেলে দিয়ে আসব। তখন তোকে পাতা পুতি দিয়ে কাজ চালাতে হবে।

পুতুল সাফোয়ানের দিকে তেড়ে গিয়ে বলল,

--- তোর হাতে কামড় দিব আমি।

--- আমারও দাঁত আছে।

--- বের হ তুই।

-- হুহ...!

বলে সাফওয়ান চলে আসছিলেন নিজের রুমে তখন হঠাৎ নিচের দিকে নজর যেতে দেখলো। আমি ডাক্তার ভাইয়াকে চা এগিয়ে দিয়ে সোজা আবার রান্নাঘরে চলে এসেছি। কিছুক্ষণ পরে সাফওয়ানের জন্য চায়ের কাপ হাতে আমাকে উপরে উঠতে দেখে তিনি তার রুমে চলে গেলেন।

আসলে তখন চায়ের কাপ নিয়ে আমি উপরেই আসছিলাম । সায়েম ভাইয়া সোফায় বসে নিউজ দেখছিলেন আমাকে দেখতে পেয়ে ডেকে আমার হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে নিলেন। যার ফলে আবার আমাকে রান্নাঘরে গিয়ে সাফোয়ানে জন্য চা নিয়ে উপরে আসতে হয়েছে।

চায়ের কাপ নিয়ে রুমে ঢুকে দেখি বিছানার ওপরে সাফোয়ান বসে আছে। মুখে রাগের আভাস। তাকে দেখে গত রাতের ঘটনা মনে পড়লো আমার।

 তখন আমার উপর রাগ ঝেড়ে আমার হাত থেকে বালিশটা কেড়ে নিয়ে তার বালিশের পাশে ছুড়ে দিয়ে বলল,

--- এখনই গিয়েও ওই পাশে শুয়ে পড়ো। আমার কথা যদি তোমার বোধগম্য না হয় তাহলে বল দ্বিতীয় বারে কিন্তু অন্যভাবে বোঝাবো তোমাকে।

আমিও আর কথা বাড়াইনি। চুপচাপ গিয়ে বিছানার অপর পাশে শুয়ে পড়েছিলাম। এমনিতে তো ক্লান্ত ছিলাম তাই ঘুম আসতেও বেশি দেরি হয়নি। মুহূর্তে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গিয়েছিলাম।

 চায়ের কাপটা তার পাশে রেখে চলে আসতে নিলে আমার উদ্দেশ্যে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে উঠলেন,

--- চায়ের কাপটা নিয়ে যাও।

অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,

--- কেন?

--- এই কাপটা আমার নয়।

আমি অবাক এর সর্বোচ্চ চূড়ায় চলে গেলাম।

--- চায়ের কাপেও কি আপনার নাম লেখা আছে?

আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলল 

---  না। চা টা নিয়ে যাও।

দেখুন আবোল তাবোল কথা বলা বন্ধ করুন। আর চা টা খেয়ে রেডি হয়ে তাড়াতাড়ি নিচে আসুন। ব্রেকফাস্ট দিচ্ছি। আর নিচে সবাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। আপনাদের বের হতে দেরি হয়ে যাচ্ছে।

তাড়াতাড়ি রুম থেকে বেরিয়ে আসছিলাম আমি তখনই সাফওয়ানের একটা কথা শুনে দাঁড়িয়ে গেলাম।

--- যাও যাও তোমার ব্রেকফাস্ট খাওয়ার জন্য তো একজন উদগ্রীব হয়ে আগে থেকে রেডি হয়ে সোফা সেটের উপরে বসে আছে। কি রসগোল্লা বানিয়েছো? তাকে গিয়ে গেলাও। আমার ব্রেকফাস্ট লাগবে না।

আমার এবার সত্যি সত্যি রাগ হলো। এমন কেন এই লোকটা? তার দিকে ফিরে তাকিয়ে বললাম,

--- সমস্যা কি আপনার? এভাবে কথা বলছেন কেন?

 উনি যেন এমনই একটা প্রশ্নের অপেক্ষায় ছিল।মুখে কিছু না বলে দাঁড়িয়ে আমার মুখোমুখি হয়ে এসে বলল,

--- অন্য সময় তো দেখি রুমের মধ্যেও ওড়না পেচিয়ে বসে থাকো। আজ কি হয়েছে। ওড়না কি খাটো হয়ে গেছে নাকি দোকানদার সিট কাপড় কম দিয়েছে। যে কাপড় মাথায় দেওয়া যাচ্ছে না।

আমি মাথায় হাত দিয়ে দেখলাম সত্যি ওড়না মাথায় নেই। কাজের চাপে অতটা খেয়াল নেই। উনাকে এটাই বলতে যাব তার মধ্যে আমার হাত সরিয়ে দিয়ে আমার শরীর থেকে ওড়না খুলে মাথায় পরিয়ে দিলেন। টাইট করে ওড়নাটা মাথার সাথে আটকে দিলেন। তারপর বিছানায় বসে চায়ের কাপটা হাতে নিলেন।

উহ রান্নাঘরে ওই তাপে আমি সিদ্ধ হয়ে যাব। এত টাইট করে কেউ ওড়না বাধে?

--- তোমার ওই এক গোছা চুলের মায়া থাকলে ভুলেও ওড়নাটা মাথা থেকে সরাবে না।।

রাগ করে রুম থেকে বেরিয়ে আসতে নিলে আবার বলে উঠলেন,

--- সায়েম ভাবীর ভাই। তার যত্ন করার জন্য ভাবি যথেষ্ট। তোমাকে এত খাতির-দারি করা লাগবে না।

বলে চায়ে চুমুক দিলেন। মুহূর্তে তার মুখটা বিকৃত হয়ে গেল। 

--- উমহ এই  চা কে বানিয়েছে?

রুম থেকে বের হতে হতে বলে আসলাম ,

---- আপনার ভাবি।

__________🌺🌺______

রুম থেকে বেরিয়ে এসে পুতুলের রুমে উঁকি দিয়ে দেখলাম। ম্যাডাম খুব কনফিউজড হয়ে গেছে। আমি ওর  রুমে গিয়ে চুপি চুপি আলমারি থেকে ওপরে কটি দেওয়া ফুল খাতার একটা গোল ফ্রক চুরিদার পায়জামা বের করে ওর সামনে ধরতে চমকে আমার দিকে ঘুরে বলল,

--- এটা পরে যাব প্রীতিলতা।

আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম।

--- ওকে। আমি এক্ষুনি রেডি হয়ে নিচ্ছি।

--- আর তাড়াতাড়ি নিচে নামবেন ম্যাডাম। ঠিক আছে।

--- ওক্কে।

বলে ওয়াশরুমে চলে গেল পুতুল।

সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে দেখলাম ডাক্তার ভাইয়া ভাবিকে বকাঝকা করছে।

--- বুড়ি হয়ে গেছিস এখনো ভালো করে চা বানাতে শিখলি না কি বানাইছি এটা?

ভাবিও কম না। সেও ডাক্তার ভাইয়াকে বকাঝকা করতেছে। ওপর পাশের সোফায় দেখলাম সাকলাইন ভাইয়া চুপচাপ বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন আর তাদের ঝগড়া দেখছেন।

ভাবি এবার না পেরে উঠে বড় ভাইয়ার পাশে গিয়ে বসে বললেন,

--- এই  চা কি খারাপ হয়েছে?

না বোধক মাথা নাড়িয়ে চায়ের কাপটা উঁচু করে ধরে বললেন ,

--- দারুন হয়েছে।

--- তাহলে ও কেন বলতেছে যে চা খারাপ হইছে।

--- আরে বাদ দাও তো। ছেলেমানুষ। বিয়েশাদি করছে নাকি যে বউয়ের চায়ের মর্ম বুঝবে। কোথায় কি বলতে হয় তা জানে না। আগে বিয়ে করুক শিখে যাবে।

ভাইয়ার বলার ধরন আর কথা  শুনে অনেক কষ্টে নিজের হাসিটা চেপে রাখলাম পেটের মধ্যে কিন্তু ডাক্তার ভাইয়া তো অনেক ধাপ এগিয়ে আছে । হাসতে হাসতে পেট জড়িয়ে ধরে সোফায় বসে পড়লো।

আর ভাবি ভাইয়ার দিকে কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যেন বাগে পেলে এখনই খেয়ে ফেলবে এমন ভাব। ভাইয়া সেদিকে তাকিয়ে  এক চুমুকে চায়ের কাপ ফাঁকা করে দিয়ে বলল,

--- সন্ধ্যায় এমন আরেক কাপ চা বানিয়ে দিও কেমন। এখন আমি যাই তাড়াতাড়ি গিয়ে রেডি হয়ে নেই না হলে দেরি হয়ে যাবে আমার।

ভাবি ও চোখ ছোট ছোট ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

---  হ্যাঁ খুব বেশি দেরি হওয়ার আগে এখান থেকে কেটে পড়ো তুমি। এটাই তোমার জন্য খুব ভালো হবে।

ভয় মিশ্রিত হাসি হেসে ভাইয়া নিজের রুমে চলে গেলেন বলতে গেলে এক প্রকার কেটে পরলেন। আমিও হাসতে হাসতে রান্নাঘরে চলে আসলাম।

________🌺🌺________

সকাল সাড়ে আটটা।

ব্রেকফাস্ট টেবিলে এসে বসেছে সবাই। আমি আর ভাবি মিলে তাদের সবাইকে খাবার সার্ভ করলাম। সবাই যে যার মত তাড়াহুড়ো করে খেতে শুরু করলো। খাওয়ার মধ্যে হঠাৎ সায়েম ভাইয়া বলে উঠলেন,

--- উমমম...! রান্নাটা সত্যি অনেক সুস্বাদু হয়েছে। তাহলে পুতুল ঠিক কথাই বলেছিল প্রীতিলতা খুব ভালো রান্না করতে পারে। 

পুতুল রুটির একাংশ নিজের মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে সাথে বলল,

--- পুতুল মিথ্যে কথা বলে না। হুম।

পুতুলের দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচি দিয়ে বলল,

--- চুপ থাক এই প্রথম সত্যি কথা বললি তুই।

তারপর ডাক্তার ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

--- থাঙ্কস প্রীতিলতা ফর ইওর ট্রিট।

বিনিময়ে আমি শুধু মুচকি হাসলাম। আর চোখে তাকিয়ে দেখলাম সাফোয়ান তাকিয়ে আছেন সায়েম ভাইয়ার দিকে।

_________🌺🌺_____

সবাই বেরিয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে। যাওয়ার আগে পুতুল অনেকবার বায়না করেছে আমাকে নিয়ে যাবে বলে কিন্তু আমি ইচ্ছা করেই যায়নি। ভাবি আমি আর রহিমা খালা একসাথে সকালের নাস্তা করে নিলাম। তারপরে রান্নাঘরে চলে আসলাম বাকি রান্না গুলো করার জন্য।

ভাবি কেউ দেখলাম কিছুক্ষণ পরে রান্না ঘরে চলে আসলেন। সে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,

--- পায়েস আর সালাদ আমি তৈরি করতে পারবো। পোলাও টা কিভাবে রান্না করতে হয় আমাকে একটু দেখিয়ে দেবে । আমি রান্না করতে চাই।

অবশ্যই।

বলে দুজনেই রান্নার কাজে লেগে পরলাম।এই প্রথম ২ জা মিলে রান্না করছি। ব্যাপারটা সত্যি অন্যরকম ভালো লাগছে আমার কাছে। ভাবি কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমার কাছ থেকে এটা ওটা দেখিয়ে নিচ্ছেন বিনা সংকোচে।আর আমিও যথাসম্ভব হেল্প করছি।

রান্না শেষ হয়ে গেছে। এগারোটার বেশি বাজে। ভাবি ফোন দিয়েছিল বড় ভাইয়ের কাছে। মা বাবা নাকি ভেতরে আছে ফর্মালিটি পূরণ করছেন। মধ্যে তারা যশোর থেকে খুলনার উদ্দেশ্যে রওনা দেবে। উনাদের ফিরে আসতে ৪৫ মিনিটের মত সময় লাগবে।

গোসল করার জন্য যে যার রুমে চলে আসলাম। ২০ মিনিটের একটা লম্বা শাওয়ার নিয়ে বের হলাম।পরনে গোলাপী রঙের সিল্কের শাড়ি। চুল থেকে বেয়ে পরা টপটপ পানি আটকাতে মাথায় টাওয়েল পেঁচিয়ে নিলাম। ড্রেসিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলাম। আয়নার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে নিজেকে দেখে হঠাৎ পটাপট করে নাকফুল, গলার চেন, কানের দুল আর হাতের চুরি জোড়া খুলে ছোট একটা বক্সে ভরে নিলাম। পুরনো গুলো পড়ে নিলাম।

বক্সটা ড্রেসিং টেবিলের উপরে রেখে আলমারির দিকে এগিয়ে গেলাম আলমারির উপর থেকে নিজের ব্যাগটা নামিয়ে আলমারি থেকে আমার সব জামাকাপড় ভরে নিলাম ব্যাগে। সবকিছু প্যাকিং করে চেন আটকে ব্যাগটা আলমারির পাশে রেখে দিলাম।

বারান্দায় চলে আসলাম চুল থেকে টাওয়েল ছাড়িয়ে মুছতে মুছতে পাশের ডালের দিকে তাকিয়ে দেখলাম দুটো হলুদ পাখি এসে বসেছে। এদিক ওদিক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার উড়াল দিয়েছে তাদের নিজ গন্তব্যে।

সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎ নিজ কণ্ঠে গিয়ে উঠলাম।

"শেষ হোক এই খেলা এবারের মতো ।।

 মীনতি করি আমাকে

 হাসি মুখে বিদায় জানাও

আমায় ডেকো না ফেরানো যাবে না

ফেরারী পাখিরা কুলায় ফেরে না" 


২২ তম পর্ব🍂

দরজা খুলতেই সেই চির পরিচিত প্রিয় মুখগুলো ভেসে উঠল আমার চোখের সামনে। আমাদেরকে দেখে বাবা মা  মুচকি একটা হাসি দিলেন। এতদিন পরে দেখলাম তাদেরকে। সত্যি বলতে ভেতর থেকে আলাদা রকমের একটা স্বস্তি ও শান্তি অনুভব করছি।

 পুতুল মায়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আর পেছনে সাফোয়ান, সাকলাইন আর সায়েম ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে বাবা মায়ের জিনিসপত্র নিয়ে।

আমি তাড়াতাড়ি দরজার সামনে থেকে সরে আসলাম । উনারা ভেতরে ঢুকলেন।ড্রয়িং রুমের সোফা সেটের উপরে এসে বসলেন। দীর্ঘ পথ জার্নি করে যে তারা মারাত্মক ক্লান্ত সেটা তাদের চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সামিরা ভাবি সবার জন্য লেবুর শরবত বানিয়ে আনলেন। ভাবিও আজকে শাড়ি পড়েছে।

মা বাবা খুশি মনে ভাবীর হাত থেকে শরবত নিয়ে খেয়ে উঠে দাঁড়ালেন। চলে গেলেন ফ্রেশ হওয়ার জন্য। সাথে সাফওয়ান সায়েম ভাইয়া এবং সাকলাইন ভাইয়া ও চলে গেলেন রুমে ফ্রেশ হওয়ার জন্য। আমরাও চলে আসলাম তাড়াতাড়ি খাবারগুলো গরম করে ডাইনিং এ সাজানোর জন্য।

কিছুক্ষণের মধ্যে উনারা সবাই চলে আসলেন ডাইনিং এ। আমি আর ভাবি সবাইকে খাবার পরিবেশন করলাম। তারপর  মা-বাবা একপ্রকার জোর করেই আমাদেরকে তাদের সাথে খেতে বসিয়ে দিলেন। আগেই বলেছি বাবা খাওয়ার সময় কথা বলা পছন্দ করেন না তাই সবাই যে যার মত খাওয়া-দাওয়ায় মনোযোগ দিলাম।

খাওয়ার মধ্যে বাবা হঠাৎ বলে উঠলেন। কতদিন পরে বাসার খাবার খাচ্ছি। তার ওপর খাবারগুলো স্বাদ ও অসাধারণ।

খালা পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সবাইকে টুকটাক খাবারের পাত্র গিয়ে দিচ্ছিলেন। হঠাৎ বলে উঠলেন,

--- বড় সাহেব রান্নাবান্নাগুলো আজ আপনার দুই বৌমা মিলে করেছে। 

বাবা উজ্জ্বল মুখে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন,

--- সেই জন্য খাবারের স্বাদ আজকে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। দুই মায়ের হাতের ছোঁয়া যে আছে এই খাবারে।

আমি আর ভাবি বাবার দিকে কৃতজ্ঞতা পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম তারপরে একে অপরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে খাবারে মনোযোগ দিলাম। 

হঠাৎ পাশে আর চোখে তাকিয়ে দেখলাম সাক্লাইন ভাইয়া ভাবির দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে কিছু একটা ইশারা করছে, একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখলাম হাত দিয়ে ইশারায় ভাবির রান্নার প্রশংসা করছে। 

ভাবি আবার ভাইয়ার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে নিষেধ করছে এরকম না করার জন্য। সত্যি ভাবির পোলাও রান্নাটা আজ অনেক সুন্দর হয়েছে।

তাদের দুজনের মধ্যে ভালোবাসায় পরিপূর্ণতা আছে বলেই  হয়তো একে অপরের সামান্যতেই তারা একজন আরেকজনকে প্রশংসা করে। কিন্তু আমার মানুষটা তার কি একটুও ইচ্ছা করে না আমার রান্নার প্রশংসা করার। 

আমি সাফওয়ানের দিকে নজর দিলাম। আর তার নজর তার প্লেটের দিকে। আপন মনে খাওয়া-দাওয়া করছেন। তাকালে দেখতে পেতেন আমার কৌতূহলী দৃষ্টিতে তার চেহারায় বিচরণ করছে। 

ভেতরের সত্তাটা উদগীব হয়ে বসে আছে প্রিয় মানুষটার কমপ্লিমেন্ট শোনার জন্য। কিন্তু না ভাগ্য আমার সহায় হলো না।

পাশে তাকিয়ে দেখলাম ডাক্তার ভাইয়া ইশারায় বোঝালেন রান্না বরাবরের মতো অসাধারণ হয়েছে।

 প্রিন্সেস ডায়না একটা কথা বলেছিলেন,

" আমি যাকে ভালবেসেছিলাম সে বাদে সারা পৃথিবী আমাকে ভালোবেসেছিল।"

এখানে আমারও বলতে ইচ্ছা করছে,

" আমি যার প্রশংসা শুনতে চেয়েছিলাম সে বাদে সবাই আমার প্রশংসা করেছে।"

তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলাম।নিজের খাবারে মনোযোগ দিলাম। সবার কপালে সব সুখ থাকে না।

_________🌺🌺_________

যেহেতু সবাই ক্লান্ত ছিল তাই দ্রুত খাওয়া দাওয়া শেষ করে বিশ্রামের জন্য যে যার রুমে চলে গেল। পুতুলকে আজ বেশ চঞ্চল দেখাচ্ছে। অনেকদিন পরে মা বাবাকে দেখতে পেয়েছে তো আজ ওর মনের ভেতরটা যে আনন্দে ভরে গেছে সেটা ওর বাহ্যিক রূপ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

কিছুক্ষণ ড্রয়িং রুমে লম্বা ঝম্প করে এখন সোফা সেটের উপরে বসে টিভিতে মটু পাতলু দেখতে লাগলো। আমি ওর পাশে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম,

---  কি আজ এত এনার্জি আসছে কোথা থেকে শুনি‌ দুপুরে ঘুমাবে না।

পুতুল আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

--- ঘুম আসছে না। আমি এখন কার্টুন দেখব। তুমি দেখবা প্রীতিলতা?

আমি আলসেমি ঝেড়ে বললাম,

---  না রে আমার শরীরটা আজ খুব ক্লান্ত লাগছে। আমি একটু রেস্ট নিয়ে আসি। আর ঘুম আসলে রুমে গিয়ে ঘুমাবি এখানে ঘুমালে কিন্তু ঘাড়ে ব্যথা হবে। তখন রোবটের মত হাঁটাচলা করতে হবে।

পুতুল আমার কথা শুনে হেসে সোফায় হেলে পরলো।

--- আচ্ছা, তুমি যাও রেস্ট নাও প্রীতিলতা। আমি এখানে ঘুমাবো না।

--- ওকে সোনা।

গাল টিপে দিয়ে রুমে চলে আসলাম আমি। রুমে এসে দেখি সাফওয়ান বিছানার উপরে এক পা ভাজ করে আরেক পা লম্বা করে নিজের কোলের উপরে ল্যাপটপ রেখে খাটের হেডবোর্ডের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে। খুব মনোযোগী সহকারে কি যেন একটা করছে ল্যাপটপে।

তাকে দেখতেই মনের ভেতরে অবুঝ অভিমান গুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।এই মানুষটা একদম আমার মনের মত নয়।

আমি সে দিক থেকে নজর সরিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে শাড়ির আঁচলটা মাথার উপর থেকে সরিয়ে দিলাম।

 মাথা থেকে যাতে আচলটা না সরে তার জন্য মাথায় একটা পিন লাগিয়েছিলাম।

 ভেজা চুল থেকে পাঞ্চক্লিপ ছাড়িয়ে চুলগুলো ছেড়ে দিলাম।। এখন একটু রিলিফ লাগছে নিজেকে।

আয়নার দিকে নজর যেতেই দেখলাম সাফওয়ান বিছানা বসে থেকেই আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি হাতের চুড়ি গুলো খুলে রেখে আলমারির দিকে এগিয়ে গেলাম ঢিলেঢালা গোল ফ্রক আর নিচে চুড়িদার সালোয়ার নিয়ে ওয়াশরুমে যাব এমন সময় সাফওয়ান বললেন,

--- যা পড়ে এতই অস্বস্তি হয় তা পড়ার কি দরকার তোমার।কেউ তো তোমাকে জোর করে না এগুলো পরার জন্য।

আমি সাফায়ানের দিকে ক্লান্ত মাখা সরে বললাম,

--- ভাবি বলেছিল আজ ভাবি শাড়ি পরবে, আমাকেও বলেছিল শাড়ি পরার কথা। তাই পরলাম।

কথা শেষ করে তাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লাম। 

ফ্রেশ হয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে বের হলাম কিছুক্ষণ পরে টাওয়ালটা বারান্দায় মেলে দিয়ে এসে বিছানার এক কোনায় শুয়ে পড়লাম। তার সাথে আর কোন ধরনের কথাবার্তা বললাম না।

সাফওয়ান এর উল্টোদিকে শুয়ে আছি। বেডরুমের পরিবেশটা আজ বড্ড নীরব অন্য সময় হলে বকবক করে তার কান ঝালাপালা করে দেই আমি। কিন্তু না এখন আমি আর তাকে বিরক্ত করবো না।

কিছুক্ষণ পরে সাফওয়ান নিজেই মুখ খুললেন। গলাটা বেশ ভালোভাবে পরিষ্কার করে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন,

--- আজ এত চুপচাপ তুমি তোমার কি মন খারাপ?

কথাটা কানে আসতেই না চাইতেও নিঃশব্দে হেসে উঠলাম আমি। উনার কথাটা কেমন শোনালো জানেন,

 নিজেই ব্যথা দিয়ে আবার নিজেই জিজ্ঞাসা করছে তুমি কি ব্যথা পেয়েছো?

তার কথার প্রতিউত্তরে আমি বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে ঘাড় কাত করে তার দিকে তাকিয়ে বললাম,

--- না। সব সময় একতরফা বকবক করতে কার ভালো লাগে বলুন। 

আমার বিপরীত পাশের মানুষটিকে সবসময় বিরক্ত করতে ভালো লাগে না। 

আপনার দরকারি কাজের অনেক ব্যাঘাত ঘটিয়েছি আমি। এরপর থেকে আর এমন করবো না।

সব কয়টা কথাই চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছি আমি। সেও বরাবরের মতো নীরব শ্রোতা সেজে কথাগুলো শুনলো। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চাদরটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিলাম।

তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম গাল বাঁকিয়ে হালকা হাসলেন তিনি। ল্যাপটপটা বন্ধ করে পাশের ডেক্সের এর উপরে রাখতে রাখতে বললেন,

--- সম্মোধন টাও বাদ দিয়েছো তাহলে?

--- কুমড়ো পটাশ নামটা আমি আপনাকে মজা করে দিয়েছিলাম। পরে বুঝেছি আপনার সাথে আমার ঠাট্টার সম্পর্ক নয়। তাই ওই সম্মোধন টাও নিজের কাছে ফিরিয়ে নিলাম।

পাশে তাকিয়ে দেখলাম সাফওয়ান আমার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমিও তৎক্ষণা ৎ উত্তর দিলাম,

আর অন্তত আপনার বিরক্তির কারণ হতে চাই না আমি।

__________🌺🌺________

একেবারে মাগরিবের নামাজ শেষ করে সবাই ড্রয়িং রুমে জড়ো হয়েছে। মা একেবারে কোমরে আঁচল গুঁজে সন্ধ্যার নাস্তা তৈরি করতে লেগে পড়েছে। তার এত শখের রান্নাঘর। কতদিন রান্না করতে পারেননি এখানে । এ নিয়েও তার যেন  আফসোসের শেষ নেই।

মায়ের চেহারা দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কতটা তৃপ্তি সহকারে নাস্তাগুলো বানাচ্ছে। পিঁয়াজি গুলো তেলে ভাজতে ভাজতে আফসোসের সুরে বললেন,

--- ওখানে কি আর আমার রান্নাঘরের মত সবকিছু গোছানো-গোছানো ছিল নাকি। প্রথমে গিয়ে খাবারের কষ্ট হয়েছে একটু। রেস্টুরেন্টের অভাব নেই কিন্তু ওদের রান্নাটা যেন কেমন একটা। 

তোমাদের বাবা যাও একটু খেতে পারতো আমি তো মোটেও পারতাম না আর ঝাল বলতে তো কিছু খায় না ওরা। পরে হোটেলেই তোমাদের বাবা আমাকে রান্নার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। সেখানে কোন রকম রান্না বান্না করে খাওয়া দাওয়া করেছি। 

কথা বলতে বলতে পেঁয়াজি, বেগুনি , আলুর চপ গুলো সব ভাজা হয়ে গেছে। মা আর ভাবি নাস্তাগুলো নিয়ে গেছে আর আমি পরে চা আর কফি বানিয়ে নিয়ে এসেছি। ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই সায়েম ভাইয়ের কথা কানে আসলো।

--- আরে বাহ! আজ দেখি খাবারে ধামাকার উপরে ধামাকা অফার চলছে। দুপুরে অত সব মজার মজার খাবার খেয়ে এখন আবার তোমার হাতের এই লোভনীয় তেলেভাজা । 

উফ! কোনটা রেখে কোনটা খাব। খালামণি তুমি তো আজকে আমার দিনটাকে স্পেশাল করে দিলে। থ্যাঙ্ক ইউ।

মা সায়েম ভাইয়ার দিকে চপের বাটিটা এগিয়ে দিয়ে বলল,

--- এই নে । আমি তো ভাবতেই পারিনি এয়ারপোর্টে নেমে তোকে দেখতে পাবো। কতদিন পরে দেখলাম তোকে।

পেঁয়াজি চিবাতে চিবাতে উত্তর দিলেন,

গতকালকে তোমার দুই ছেলের কাছ থেকে শুনলাম তোমরা আসছো তাই ভাবলাম কাজের চাপ যখন কম আছে আমার বদন খানা তোমাদের একটু দেখিয়ে আসি।

সাকলাইন ভাইয়া বলে উঠলেন,

--- ডাক্তারি পেশার কাথাঁয় আগুন দিয়ে তুই যে এখানে বসে এসব ওয়েলি খাবার গিলতেছিস তোর রুগীরা জানতে পারলে তোর মুখও দেখবে না আর।

--- ধুর রোগী ওরা আমি নই ‌। একদিন খেলে তেমন কিছুই হয় না।

সায়েম ভাইয়ের কথা শুনে সবাই হেসে উঠলেন। সাফওয়ান এবার সায়েম ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,

--- এই হচ্ছে টুকে পাশ করা ডাক্তারের নমুনা।

বাবা এবার সকলের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন। আচ্ছা এবার থাম তোরা। সকলের জন্য যে জিনিসপত্র গুলো নিয়ে এসেছি এবার একে একে দিতে হবে। 

পাশে থেকে বড় দুটো লাগেজ বের করলেন। লাগেজ খুলে টেবিলের উপরে রাখলাম এক এক করে সবাইকে উপহার সামগ্রী দিতে লাগলেন। এবং দুটো বড় ব্যাগে তাদের বেয়াই বেয়ানদের জন্য উপহার আলাদা করে রাখলেন।

ভাবিকে ডেকে পাশে বসিয়ে  হাতে তার জন্য আনা সব উপহার তুলে দিলেন। ভাবি খুশি মনে উপহারগুলো নিয়ে সরে আসতেই বাবা হাতের ইশারায় আমাকে ডাকবেন তার কাছে। 

আমি গিয়ে তার পাশে বসলাম। বাবা আমার হাতে কয়েকটা ব্যাগ ধরিয়ে দিলেন। ব্যাগ থেকে জিনিস কতগুলো বের করে দেখলাম একটা জায়নামাজ , পাথরের তসবি, আতর, দুটো বোরকা এবং স্বর্ণের কানের দুলও গলার চেন। ভাবি ও আমার একই উপহার।

সবকিছু দেখে বাবার দিকে তাকাতেই বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন পছন্দ হয়েছে মামনি।

আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম। উপহারগুলো ব্যাগের মধ্যে রেখে বাবার উদ্দেশ্যে বললাম,

আমার আরও একটা জিনিস চাই বাবা।

বাবা মুচকি হেসে ইশারায় জিজ্ঞাসা করলেন কি?

সকলে দেখলাম বোধক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

আমি জোরে একটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে বাবাকে বললাম,

--- বাবা আমি কাল সকালে বাবার বাড়িতে যেতে চাচ্ছি।

বাবা মুচকি হেসে আবার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন অবশ্যই তুমি এবার যতদিন কয়েক দিন ্ ওই বাড়ি থেকে ঘুরে আসবে। আর আমরাও তো যাব বেয়াই বেয়ান কে দেখতে। তাদের সাথে কতদিন দেখা হয় না‌। না হয় আমাদের সাথে আবার চলে আসবে।

এবার বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে নিজের কন্ঠ টাকে সর্বোচ্চ স্বাভাবিক রেখে বললাম,

--- না বাবা আমি আর ফিরবো না। আগামীকাল সকালে আমি সারা জীবনের জন্য ওই বাড়িতে যাচ্ছি....!


২৩ তম পর্ব🍂

মুহূর্তের মধ্যেই পুরো ড্রয়িং রুমটা নীরবতা এসে গেল কিছুক্ষণ আগে সেই গমগমে ভাবটা এখন আর নেই ড্রয়িং রুমে উপস্থিত সকলের প্রশ্নবোধক দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দুতে বসে আছি আমি সকলের মনে হয়তো একটাই প্রশ্ন জেগে উঠেছে যে আমি হঠাৎ এমন কিছু কেন বললাম?

 কিন্তু না এদের মধ্যে বাবা আগের মতোই শীতল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু কিছুক্ষণ আগে সেই প্রাণোচ্ছল হাসিটা ঠোঁট থেকে মিলিয়ে গেছে মা-বাবার পাশেই বসে ছিলেন অস্থির কন্ঠে বলে উঠলেন,

---- এসব তুমি কি বলছ প্রীতি তুমি আর ফিরবে না এর মানে কি তুমি এই বাড়ির ছোট বউ এই বাড়িতে ফিরবে না তো কোথায় যাবে তুমি?

মায়ের কথায় তার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে মাথা নিচু করে তার উদ্দেশ্যে বলে উঠলাম,

----  আপাতত বাবার বাড়িতে কিছুদিন থাকব তারপর ভালো একটা ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স এর জন্য চান্স হয়ে গেলে সেখানে চলে যাব। আমি আর কারোর ঘাড়ের বোঝা হয়ে থাকতে চাই না ।

শেষের কথাটার চোখের সামনে দিকে তাকিয়ে বললাম। আর চোখে যেটুকু দেখলাম তাতে বুঝলাম সে আমার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ।

মা যেন আমার কথা শুনে আরও বেশি অস্থির হয়ে উঠলেন সামনের দিকে এগিয়ে এসে বললেন কিন্তু কে....

বাবা মাকে থামিয়ে দিলেন। আমি এখনো মাথা নিচু করে বাবার সামনে বসে আছি কিছুক্ষণ পর বাবা অতীব স্নেহের কন্ঠে বলে উঠলেন,

--- মামনি মাথা উঠাও বাবার দিকে তাকাও।

 কন্ঠটা কানে আসতে ভেতরে এতক্ষণে চেপে রাখা কষ্টগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠল ঠোট ভেঙ্গে নিঃশব্দ থেকে দূরে উঠলাম যার ফলশ্রুতি গাল দিয়ে দুই ফোটা নোনা জল গড়িয়ে গেল । 

বাবা এবার নিজের হাত আমার মাথায় ভুলিয়ে দিয়ে বললেন কি হলো তাকাও না আমি এবার আর তার কথা অমান্য করলাম না বাবার দিকে তাকালাম। 

আমার ছল ছল চোখ জোড়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বাবা আমাকে প্রশ্ন করলে,

---  তোমার এই মা-বাবা কী তোমাকে খুব বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে মা যার জন্য তুমি আমাদেরকে ছেড়ে চলে যেতে চাইছ?

 আমি না বোধক মাথা নাড়ালাম। তা দেখে বাবা আবার বললেন,

----  তাহলে কেন তুমি চলে যাবে মা তুমি জানো না পুতুল তোমাকে ছাড়া থাকতে পারে না? 

পুতুলের কথা ভাবতে বুকের মধ্যে কেমন যেন করে উঠলো সত্যিই তো আমার এই বাড়িতে এত দিনের একমাত্র সঙ্গী ছিল আমার পুতুল সোনা ।

ওই একমাত্র ব্যক্তি যে আমাকে নিঃস্বার্থভাবে এতদিন ভালোবেসে গেছে ও আমাকে ছেড়ে থাকবে কি করে তার থেকে বড় কথা ওকে ছাড়া আমিও তো থাকতে পারবো না 

কিন্তু আমি যে নিরুপায়। ওর সাথে যে আমার রক্তের সম্পর্ক নেই কিন্তু তৎক্ষণাৎ আমার মন বিদ্রোহ করে বলে উঠলো,

 তাতে কি হয়েছে রক্তের সম্পর্কের বাইরে এমন অনেক সম্পর্ক আছে যা সকল রক্তের সম্পর্কের উর্ধ্বে হয়ে থাকে। যেমন আমার আর পুতুলের সম্পর্ক।

আমি বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম,

 পুতুলকে কখনো আমার ননদের চোখে আমি দেখিনি ও আগেও আমার ছোট বোন ছিল এখনো আছে আর ভবিষ্যতেও তাই থাকবে। আমি যেখানে থাকি না কেন প্রতিদিন আমি ওর সাথে দেখা করব। 

ওর সাথে দেখা না করে আমি থাকতে পারবো না বাবা এছাড়া ও খুব বুঝদার মেয়ে ওকে বুঝালে ঠিকই বুঝবে। আমি আমার মাস্টার্স কমপ্লিট করতে চাইছি আর মোট কথাই বাড়ি থেকে চলে যেতে চাইছি।

মা যেন আর চুপ করে থাকতে পারলেন না আমার কথা শেষ হতেই মা পাল্টা প্রশ্ন করলেন,

--- এই বাড়ি থেকেই কেন চলে যেতে হবে তোমাকে তুমি চাইলে মাস্টার্স কমপ্লিট করে চাকরিও করতে পারো তাতে আমাদের কোন আপত্তি নেই। তাহলে এসব বলার মানে কি তোমার?

আমি মার দিকে তাকিয়ে বললাম,

--- আপনি হজ্বে যাওয়ার সময় আমার কাঁধে বড় একটা দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন মা । আপনাদের এবং আপনার ছেলের মধ্যকার সম্পর্ক ঠিক করা। কিন্তু যেখানে তার সাথে আমার মধ্যকার সম্পর্কই ঠিক নাই সেখানে এ দায়িত্ব আমি পালন কীভাবে করব।

কথাগুলো একনাগাড়ি বলে আমি থামলাম। কিছুক্ষণ দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করলাম ,

--- বাবা এই বাড়িতে যার হাত ধরে ঢুকেছিলাম। বিয়ের এতদিন পরেও তাকে আমি নিজের আপন করে তুলতে পারিনি একই ছাদের নিচে থাকলেও দুজনের মধ্যে যোজন যোজন দূরত্ব রয়েই গেছে আমাদের।

 সে ছাড়া এবাড়ির প্রত্যেকটা সদস্য আমার আপন হয়ে উঠেছে। কিন্তু যার বেশি আপন হওয়ার কথা ছিল সেই বরাবরের মতো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে আমার থেকে।

এতে আমি তার দোষ দেব না। আসলেই তার কোন দোষ নেই।মন এর উপরে কখনো জোরজবরদস্তি চলে না। নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কখনো সুখে থাকা যায় না। মন থেকে না চাইলে কারোর কাছ থেকে জোর করে ভালোবাসা আদায় করা যায় না বাবা। যেটা পাওয়া যায় সেটা হচ্ছে সহানুভূতি।

 উনি এই কয়দিনে আমার জন্য অনেক কিছু করেছেন। আমার পরিবারের জন্য করেছেন। আমার পরিবারের  চোখে উনি একজন আদর্শ জামাই আমার মা-বাবাকে এতটা সম্মান জন্য আমি সারাজীবন তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। আমি জানি আমি না বললেও উনি সারা জীবন এরকম দায়িত্ব পালন করে যাবেন। কিন্তু আমি শুধু ওনার দায়বদ্ধতা হয়ে থাকতে চাই না।

 মন চাইনি সে আমাকে ভালোবাসে নি।

তাই বলে জোর করে এই অনিশ্চিত সম্পর্কের দোহাই দিয়ে আমি তাকে আটকে রাখতে পারি না। তার ও স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার আছে সাথে আমারও ।তাই এই মিথ্যা সম্পর্কটা এখানে সমাপ্তি হোক। 




যার কোন ভিত্তি নেই সেই সম্পর্কের বোঝা আমি আর বইতে পারছি না। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার মানসিকভাবে এই ব্যাপারটা আমাকে খুব পীড়া দিচ্ছে বাবা। আর এই বাড়িতে থাকলে প্রতিনিয়ত আমার এই সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে তাই আমি এখান থেকে চলে যেতে চাইছি।

মা বাবা আপনারা আমাকে মাফ করবেন। আপনাদের  কথা আমি রাখতে পারব না। একবার যখন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছি তখন আমি তার পরিবর্তন করতে চাই না।

মা থম মেরে সোফায় বসে রইলেন। বাবা আমার কথাগুলো শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। 

আর সাফওয়ান তিনি তো মনে হয় কথা বলতেই ভুলে গেছেন। এই পুরোটা সময় তিনি একটা কথা বলেননি। আর দিকে না তাকিয়েও যতটা বুঝেছি তিনি পুরোটার সময় আমার দিকে ই স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। হয়তো তিনি ভাবতে পারেননি যে আমি এভাবে চলে যাওয়ার কথা বলব। 

কিন্তু কি আর করার এটা তো হওয়ারই ছিল।


২৪ তম পর্ব🍂

এমন হটোকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া তো ঠিক না প্রীতি। তুমি আর একটু ভেবে দেখো। এভাবে চলে যেতে চাইলেই যে চলে যাওয়া যায় না। কথাটা সামিরা ভাবি বলে উঠলেন। একই সাথে তাল মিলিয়ে মা বললেন,

--- হ্যাঁ সেটাই তো। তুমি এ বাড়ির ছোট বউ প্রীতি। কিভাবে বলতে পারো বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে? মানছি তোমার রাগ হয়েছে তাই বলে এভাবে কেন তুমি সারা জীবনের জন্য চলে যাবে?

একটু সময় দাও আমার ছেলেকে। ধীরে ধীরে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আমি জানি আমার ছেলে খারাপ ছাড়া, বেপরোয়া, এই সম্পর্কটা নিয়ে সে উদাসীন। কিন্তু তাই বলে তুমি একেবারে ওকে ছেড়ে চলে যাবে এ কেমন সিদ্ধান্ত।

মা আমার কাছে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

প্রত্যেকটা সংসার এই রকম ছোটখাটো ঝামেলা সমস্যা হয়েই থাকে তাই বলে কি সবাই সংসার ভেঙে চলে যায় নাকি।বরং মানিয়ে নিতে হয়।

আমি শুকনো হেসে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,

--- মা মানিয়ে  তো আপন মানুষের সাথে নিতে হয়। আপনার ছেলে যে আপন মানুষ হতে চাইনি কখনো। আপনারা ঢাকায় যাওয়ার আগেরদিন রাত্রে উনি ডাইনিং রুমে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন,

* ওনাকে বিয়েটা করতে বাধ্য করা হয়েছিল। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে, উনি আমাকে বিয়েটা করেছিলেন। উনি চাননি এই সম্পর্কটা তৈরি হোক। তাহলে কেন আমি এখানে থেকে তার বিরক্তির কারণ হব।

মা আরো কিছু বলতে চাইছিলেন কিন্তু বাবা-মাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,

--- ও তো ঠিকই বলেছে... প্রীতি কেন তোমার ছেলের বিরক্তির কারণ হবে? একপাক্ষিক প্রচেষ্টা কেন শুধু প্রীতি করবে শুধুমাত্র এবাড়ির বউ বলে।

এখানে যদি তোমার নিজের মেয়ে থাকতো তাকেও কি জামাইয়ের দোষ লুকিয়ে ফেলে  মানিয়ে নিতে বলতে। সেই জামাই এর কাছে তুমি কৈফিয়ত চাইতে না যে সে কেন তোমার মেয়ের সাথে এমন আচরণ করছে?

কেন শুধু শুধু তোমার বেপরোয়া ছেলের সাথে মানিয়ে নেবে? রূপে গুনে যোগ্যতায় কোন দিক থেকে কম আছে সে যে এখানে তোমার ছেলের শত অবহেলা শর্তেও মাটি কামড়ে পড়ে থাকবে। 

কি যোগ্যতা আছে তোমার ছেলের, প্রীতির পাশে দাঁড়ানোর। পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষিত বেকার সেজে বসে আছে ঘরে। শুধুমাত্র আমার উপরে জেদ করে। 

আমার কথা না শোনার কসম কেটে বসে আছে তো তোমার ছেলে। আমি বুঝতে পেরেছি ও আমার সাথে জেদ করে প্রীতি মামণির সাথে এমন আচরণ করছে।

তোমার ছেলের কাছে শুনো তো আমি তার কি ক্ষতি করেছি? শুধুমাত্র নিজের ছেলেকে বিচারকের আসনে দেখতে চেয়েছিলাম। এটা কি আমার ঘোর অন্যায় হয়ে গেছে। 

প্রত্যেক মা-বাবার কি তার সন্তানের কাছে কিছু চাওয়া পাওয়া থাকে না থাকতে পারে না? তাই বলে এমন আচরণ করে কেন তোমার ছেলে?

আর হ্যাঁ ওর মতামত ছাড়াই সাইমার সাথে বিয়ে ঠিক করে আমি ভুল করেছিলাম।আমি স্বীকার করছি।যার জন্য ওকে ভরা আসরে অপমানিত হতে হয়েছিল। 

তা আমিও কি কম অপমানিত হয়েছিলাম।

 মানুষের ভুল হতে পারে না। আমারও হয়েছিল। তার জন্য কি এখন ওর পা ধরে মাফ চাইতে হবে আমার। তাহলে কী ও আমাকে ক্ষমা করবে?

উপস্থিত সকলে বাবার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। বিশেষ করে আমি তো যেন আমার বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। বাবা যে এমন কিছু বলবেন আমি ভাবতেও পারিনি। 

আর সেই রাগ ভিতরে পুষতে পুষতে তোমার ছেলের সেটা জেদে পরিণত হয়েছে আর তা থেকে একের পর এক ভুল করে যাচ্ছে সে।

আমি বুঝতে পেরেছি ও কেন প্রীতিকে মেনে নেয় নি। ওই যে ও আমার বন্ধুর মেয়ে বলে।এটাই হয়েছে  মেয়েটার আসল অপরাধ।আচ্ছা ঠিক আছে।

ও ওর ক্রোধ আর ইগো এগুলো নিয়েই থাকুক। আমার ওই একটা ভুলের জন্য ও যদি সারা জীবন আমার ওপরে রাগ দেখিয়ে শান্তিতে থাকতে পারে ও তাই থাকুক। বাবা হিসেবে আমি সবসময় চাই আমার সকল সন্তানরা ভালো থাকুক।

 একাই থাকুক ও সারা জীবন। এই ধরনের মানুষদের কখনো সঙ্গী থাকে না।

 আমাদের দুজনের রেষারেষির মধ্যে আমি প্রীতির জীবন নষ্ট করতে পারি না। ওর ও ভালো থাকার পূর্ণ অধিকার আছে। সেই ব্যবস্থা আমি করব। 

কথাগুলো শেষ করে বাবা আমার উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,

প্রীতি মামনি তুমি আমার একটা কথা রাখো শুধুমাত্র। আমি জানি মামনি তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছি আমি। তোমার মায়ের মাথায় ভুত চেপে ছিল তার ছেলেকে ঠিক একমাত্র তুমিই পারবে। 

আমি নিষেধ করেছিলাম কিন্তু তিনি তা কানে নেননি। এক সময় আমিও বিশ্বাস করেছিলাম যে আমার ছেলেটা হয়তো তোমার সান্নিধ্যে গেলে হয়তো সবকিছু আবার আগের মত হয়ে যাবে। লোভী হয়ে গিয়েছিলাম মা। ছেলেটাকে আবার আগের মতন নিজেদের কাছে ফিরে পাব বলে।

কিন্তু না বড্ড ভুল হয়ে গেছে আমাদের। তোমার মা-বাবা এখনই তোমার বিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন না।এক প্রকার জোর করে তোমাকে চেয়ে এনেছিলাম আমি তাদের কাছ থেকে।

 খুব বড় মুখ করে বলেছিলাম যে তোমাকে একদম নিজের মেয়ের মত করে রাখবো। সামান্য কষ্ট স্পর্শ করতে দেব না তোমাকে। কিন্তু না কথা রাখতে পারিনি আমি।

তাকে বাধা দিয়ে বললাম,

---  না বাবা আপনি এসব কি কথা বলছেন। এমন শশুর শাশুড়ি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু আমার ভাগ্যে এত সুখ শান্তি লেখা ছিল না। এতে আপনাদের কারোর কোন দোষ নেই।

কিন্তু মা আমি তো নিজের কাছে নিজে অনেক অপরাধী হয়ে গেছি। অপরাধ থেকে সামান্য হলেও মুক্তি দান করো আমাকে। আমার একটা মাত্র অনুরোধ রাখ। তাহলে বুঝবো আমার একটু হলেও অপরাধমোচন হয়েছে।

আমার সাথে সাথে উৎসুক দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকালো। পাশে তাকিয়ে দেখলাম আমার বরাবর সোফা সেটের উপরে মাথা নিচু করে বসে আছেন সাফওয়ান।

সেদিক থেকে নজর ঘুরিয়ে বাবার উদ্দেশ্যে বললাম 

--- কি অনুরোধ বাবা?

বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

--- আমি তোমাকে নিজের মেয়ের মত মনে করি। তাই আমাদের ভুলের কারণে তোমার জীবনে যেটুকু সময় নষ্ট হয়েছে সময়টা তো ফিরিয়ে দিতে পারব না কিন্তু তোমার একটা নতুন জীবন উপহার দিতে পারব।

পরবর্তী জীবনটাকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিতে চাই। তুমি যদি বাড়িতে থাকতে না চাও থাকবে না।  আমার মেয়ে বাইরে পড়াশোনা করলে তাকে যেভাবে সবদিক থেকে খেয়াল রাখতাম আমিও তাই রাখবো।

আর দয়া করে তোমার মা-বাবাকে এখন কিছু জানিও না। লজ্জা, আমি তাদেরকে মুখ দেখাতে পারবো না। আগে তোমার একটা যথার্থ ব্যবস্থা করে নেই তারপরে ভাইয়ের কাছে হাতজোড় করে মাপ চেয়ে নেব আমি।

আর তোমার পড়াশোনা শেষ হয়ে গেলে আমি ভালো ছেলে দেখে তোমাকে আবার বিয়ে দিব। তোমার যোগ্য পাত্রই তোমাকে উপহার দিব।

বাবার বলা শেষ কথাটি কানে পৌঁছাতে যেন বজ্রপাত হলো আমার ওপরে। পায়ের তলার মাটিটাও যেন কেঁপে উঠল আমার। এসব কি বলছেন বাবা...!

মা এবার বাবার হাত চেপে ধরে কাঁপা গলায় বললেন,

--- এসব তুমি কি বলছো? ও আমার ছোট ছেলের বউ। তুমি আবার ওর বিয়ে দেবে মানে?

বাবা দৃঢ় গলায় বললেন,

--- হ্যাঁ। আমার ছেলের সাথে ডিভোর্স করিয়ে আমি প্রীতিকে আমার বিয়ে দেব। ভুল যখন আমি করেছি শুধরে দেওয়ার দায়িত্ব আমার।

আমার সারা শরীর কাঁপছে। ঘাড় ঘুরিয়ে সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তিনি চমকে বাবার দিকে তাকালেন। কিন্তু তিনি বরাবরের মতো নিশ্চুপ।শান্ত দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তার চোখ হালকা ছল ছল করছে বাবা ও তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।

সাফোয়ান শুকনো হেসে অন্য দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন। সবাইকে পেরিয়ে তিনি সিড়িতে পা রাখতেই 

বাবা দ্বিতীয়বারের মতো হুংকার ছাড়লেন। যার ফলে উপস্থিত সবাই হালকা কেঁপে উঠলোও সাফোয়ান আগের মত ভাবলেশহীন ভাবে দাড়িয়ে পড়লো 

--- আমার কথা এখনো শেষ হয়নি। প্রীতি তুমি উপরে যাও গিয়ে তোমার সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে পুতুলের রুমে চলে এসো। কাল সকালে আমার মেয়ের জন্য কেনা ফ্লাটে তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবো।

 আপাতত কাল থেকে তুমি ওখানেই থাকবে। আর আমি তোমার ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির ব্যবস্থা করে দেব। তুমি শুধু তোমার ক্যারিয়ারে মনোনিবেশ কর।

আর হ্যাঁ ।সকলের উদ্দেশ্যে বলছি। আমি এখন যে কথাগুলো বললাম এইগুলোই শেষ কথা। এই কথার নড়চড় হলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। এবার যাও সবাই যে যার রুমে যাও।

_______🌺🌺_________

রুমে এসে আলমারির কাছে এগিয়ে গেলাম আলমারির লক খুলে আমার লাগেজটা বের করে নিলাম। আলমারিটা আটকাতে গিয়ে হঠাৎ সেই সাফয়ানের কিনে দেওয়া কালো লং গাউন এর দিকে নজর গেল। হাতে তুলে নিলাম গাউনটা তাতে হাত বুলিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরতেই চোখে দিয়ে দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।

এই পোশাকটা তার দেওয়া প্রথম উপহার ছিল। ভালোবেসে দিক আর না বেসেই দিক তার থেকে পাওয়া প্রথম উপহার। এটা আমি এখানে রেখে যাব না। ব্যাগের চেইন খুলে ড্রেসটা ব্যাগে রেখে দিলাম। আলমারিটা লক করতে গিয়ে আবারো থেমে গেলাম আমি সাফওয়ানের শার্ট আর ছবি আগে ঢুকিয়ে যেন আটকে পেছনে ঘুরতেই সাফোয়ানের সাথে প্রায় ধাক্কা খেলাম।

তার চোখের দিকে তাকিয়ে যেন থমকে গেলাম। তার মুখটা আজ বড্ড শুকনো আর নির্জীব। শার্টের সামনের দুটো বোতাম খোলা চুলগুলো এলোমেলো চোখটা হালকা লালচে হয়ে আছে।

আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে চোখ ঘুরিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসে হেসে বলল,

--- আজকাল কী নিজের পোশাক ছেড়ে আমার শার্ট গায়ে দেওয়াও শুরু করেছেন নাকি?

আমি তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে  বললাম,

--- না। প্রিয় মানুষটার বুকে ঘুমানোর অভ্যাস হয়ে গেছে তো তাই রাত্রে যদি ঘুম না আসে তাই ঘুমের ওষুধ হিসেবে নিয়ে যাচ্ছি সাথে করে। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাবো আর কি।

সাফওয়ান এক নজরে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন । দেখে মনে হচ্ছে উনি কিছু বলতে চাইছেন। দাঁড়িয়ে থাকে জিজ্ঞাসা করলাম,

--- আপনি কি কিছু বলতে চাইছেন?

উনি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালেন। 

আমার মনের মধ্যে কিঞ্চিত  আশার সঞ্চার হল। হয়তো ইনি এখুনি বলবেন এই প্রীতি কোথায় যাবে তুমি? এই ঘর থেকে একবার বেরিয়ে দেখো তোমার হাল খারাপ করে দেবো আমি। কোথাও যাবে না বুঝেছ তুমি। এই ঘরে আমার বউ হয়েই সারা জীবন থাকতে হবে তোমাকে।

আমি  সাফোয়ানের দিকে আরো কিছুটা এগিয়ে গিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম,

--- বলুন না কি বলবেন আমি শুনছি।

তিনি কিছুক্ষণ ইতস্তত করে 

হঠাৎ বলে উঠলেন,

--- তুমি সত্যিই চলে যাবে প্রীতি?

আমার কিছুক্ষণ আগের ভাবনাগুলো চুরমার হয়ে আমারি চোখের সামনে ভেঙে পড়ে গেল। চোখে পানি নিয়েই জোরে হেসে উঠলাম।

--- তো আপনার কি মনে হচ্ছে আমি মজা করছি। আপনি এমন কেন বলুন তো আপনার কেন মনে হয় আমি সব সময় মজা করার মুডে থাকি।

বরং মজা তো আপনি করলেন আপনি চাইলে কিন্তু সবকিছু ঠিক করে দিতে পারতেন। কিন্তু আপনি করলেন না। আমাকে ভালবাসলে কি আপনার খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেত?

আরো কিছুটা আমার দিকে এগিয়ে এসে ধীর গলায় বললেন,

---- উহু আমার না বরং তোমার খুব ক্ষতি হয়ে যেত। তোমার সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ পরে আছে। রূপে গুনে যোগ্যতায় কোন দিক থেকে কম আছো তুমি? কেন মিছে  আমার মত একটা বেকারের সংসার করবে।

আমি এবার রাগে নিজেকে সামলাতে না পেরে তার শার্টের কলার চেপে ধরলাম,

--- আপনি জানেন আপনি কত বড় অমানুষ। নিজ হাতে করে আমার ভালোবাসাটাকে প্রতিনিয়ত গলা টিপে হত্যা করে যাচ্ছেন।

 কেন করলেন আপনি আমার সাথে এমন? আপনাকে আমি জীবনেও ক্ষমা করব না। শুধুমাত্র রাগ জেদ আর ইগোর জন্য আপনি কতগুলো সম্পর্ক থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন একবার ভেবে দেখেছেন। 

আপনি জীবনের কোন না কোন এক সময় গিয়ে এর জন্য পস্তাবেন আমি বলে রাখলাম। তখন হাজার খুজলেও আর কাউকে আপনার পাশে পাবেন না।

আমার ফ্রেন্ড আমাকে বলেছিল জীবনের প্রথম ভালোবাসা নাকি ভুল মানুষের সাথে হয়ে থাকে। আজ বুঝতে পারছি কথাটা মিথ্যা ছিল না। আপনি আমার জীবনের সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল মানুষ। আর এই ভুল থেকে আমার মনে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে হয়তো সারা জীবনেও তা ঠিক হবে না।

শেষের কথাটা আমি কান্না জড়িত কণ্ঠে চিৎকার করে বললাম। উন্মদের মতো তার কলার ধরে ঝাকাতে লাগলাম,

--- কেন করেছেন আপনি আমার সাথে এরকম? কেন কেন বলুন।

আমার হাত দুটো চেপে ধরে নিজের কলার ছাড়াতে ছাড়াতে বললেন,

কি করছো তুমি প্রীতি এত জোরে জোরে চিৎকার কেন করছো? বাড়িতে সবাই শুনছে।

--- শুনুক। এখানে আমি আমার হাজবেন্ডের সাথে চেঁচাচ্ছি । কার কী তাতে। আমাদের মাঝে যে আসবে তাকে আমি মেরেই ফেলবো।

সাফওয়ান আমাকে ধমকে বললেন,

--- পাগল হয়ে গেছো তুমি?

---- হ্যাঁ। পাগল হয়ে গেছি আমি।

আর কি বললে তুমি? তুমি বেকার বলে আমি তোমার সংসার করতে চাইছি না? তুমি বেকার জেনেও আমি তোমার সংসার করতেই বাড়িতে এসেছি তোমার হাত ধরে। জেনে শুনেই বেকার ছেলেটাকেই ভালোবেসেছি আমি। ভবিষ্যতেও ভালোবেসে যাবো।

আর কী যেন ও হ্যাঁ  যোগ্যতা....! ভালোবাসার জন্য কোন যোগ্যতার প্রয়োজন হয় না । কেন বোঝনা তুমি এগুলো?

বরং এই বেকার ছেলেটা আমার ভালোবাসাটাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে তার থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে আমাকে।

আপনি জানেন আপনার এই কথাগুলো শোনার পরে আপনাকে আমার খু/ন করতে ইচ্ছা করছে। আমি না আপনার এই খাপ ছাড়া আচরণে এই এক মাসে ক্লান্ত হয়ে গেছি। আর নিতে পারছি না আপনার এই আচরণ।

এমনিতেই আজ সারা দিনের শারীরিক পরিশ্রম আর কিছুক্ষণ আগে মানসিক চাপের মুখে পড়ে শরীরটা একদম ক্লান্ত হয়ে গেছে।  আমার গলার স্বর ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে আসলো।

 মাথাটা কেমন যেন ঘুরে উঠল আমার। সাফওয়ানের কলার থেকে হাত সরিয়ে দু হাত পিঠের কাছে নিয়ে গিয়ে শার্টটা আঁকড়ে ধরে আমার মাথাটা দিয়ে তার বুকে জায়গা করে নিলাম।

চোখ বুজে ঝিমিয়ে আসা গলায় তাকে বললাম,

---আমি তোমাকে সত্যি সত্যিই ভালোবেসেছি। আমার ভালবাসাটা মিথ্যা ছিল না সাফওয়ান। এমনটা না করলেও পারতেন। আপন....

বাকি কথাগুলো মুখের মধ্যেই হারিয়ে গেল। ঢলে পড়লাম তার বুকে...!


২৫ তম পর্ব🍂

পিটপিট করে চোখ খুলেই প্রথমে নজর গেল ছাদের দিকে।বড্ড বেশি অপরিচিত লাগলো। কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে  সেদিকে তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ মানসপটে সব ঘটনা একের পর এক ভেসে উঠলো। 

ধরফর করে উঠে বসলাম আমি। চারিদিকে খুব সূক্ষ্মভাবে নজর ঘোরালাম। না এটা সাফওয়ানের রুম নয়। সম্পূর্ণ অন্য একটা ঘর। সম্ভবত সেই ফ্ল্যাট।

 বাবা যেখানে আমাকে রাখতে চেয়েছিলেন। ভাবতেই চোখ জোড়া অশ্রুতে টই টুম্বুর হয়ে গেল।

আমাকে তার জীবন থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার এতই তাড়া। যে আমার অচেতন অবস্থায় এই ফ্লাটে এসে রেখে গেছে আমাকে। এতটা পাষাণ, হৃদয়হীন! মানুষ কিভাবে হতে পারে? এতগুলো দিন একই ছাদের নিচে তার সাথে থেকেছি ভালোবাসা দূরে থাক একটু কি দয়া মায়া জন্মায়নি আমার উপরে।

কথাগুলো নিজ মনে ভাবতেই ঠোঁট ভেঙ্গে কান্নায় ভেঙে পড়লাম আমি। দুই হাতের তালু মাথার চুলের মধ্যে চালিয়ে চুলগুলো মুঠো করে ধরে শব্দ করে কেঁদে উঠলাম।

কান্নার চাপে দম নিতেও কষ্ট হচ্ছে আমার।ফোপাতে ফোপাতে বলে উঠলাম,

--- কম চেষ্টা তো করিনি সাফওয়ান তোমার মনে জায়গা করার জন্য। একটু কেন বুঝলে না তুমি আমাকে? আমাকে একটু ভালোবাসলে তোমার কি এমন ক্ষতি হয়ে যেতো?

তুমি যদি  বলতে যে তুমি আমাকে ঘেন্না করো তাহলে আমি নিজের মনকে বোঝাতে পারতাম । কিন্তু তুমি তো শুধু সব সময় নীরবতা পালন করে এসেছো আমি থেকে গেলেও তোমার কিচ্ছু যায় আসেনা চলে গেলেও যায় আসে না। তোমার এমন উদাসীন আচরণ আমি মেনে নিতে পারি না।

কেন এমন করলে তুমি আমার সাথে?কেনো?

বলে পাশে রাখা ডেক্সের ওপর ফুলদানি টা হাত দিয়ে আছাড় মেরে ভেঙে ফেললাম। ফুলদানিটা কয়েক টুকরো হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে আর ফুলগুলো এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে।

কাঁচের ফুলদানি হওয়ায় ভাঙার সময় বেশ জোরে শব্দ হয়েছে। তৎক্ষণাৎ দরজার লক খুলে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করল কেউ। দরজা খোলার শব্দ হতেই মাথা তুলে সেদিকে তাকালাম।

আমার বয়সে একটি মেয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে ব্ল্যাক সালোয়ার কামিজ কিন্তু পোশাকটা দেখে কেমন uniform এর মত লাগছে। আমি ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে কিছুটা এগিয়ে এসে আমার উদ্দেশ্যে বললো,

--- এনিথিং রং ম্যাম?

কথা না বলে তার দিকে তাকিয়ে আছি এক নজরে। আমার কোন রেসপন্স না পেয়ে আরো কিছুটা এগিয়ে আসতে দেখে কাছের ফুলদানিটা নিচে ভেঙ্গে পড়ে আছে। সে ওটা পা দিয়ে ডিঙিয়ে আমার কাছে এসে হাত ধরে দেখে বলল,

---  আপনার লাগেনি তো ম্যাম?

আমি না বোধক মাথা নাড়ালাম তা দেখে মেয়েটা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তারপরে জায়গাটা পরিষ্কার করে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,

--- আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন ম্যাম। আমি আপনার জন্য খাবার আনছি।

এবার আমি মুখ খুললাম তাকে প্রশ্ন করলাম,

---  তুমি কে?

--- আমি মিতা। আপনার দেখাশোনা করার জন্য এসেছি। আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন ম্যাম আমি আসছি।

বেরিয়ে যাচ্ছিল প্রায় তখনই আমি ওকে প্রশ্ন করলাম,

--- কতক্ষণ আগে নিয়ে এসেছে আমাকে এখানে?

পেছনে ফিরে আমার উদ্দেশ্যে বলল,

--- দুই ঘন্টা আগে ম্যাম।

আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। চোখ মেলে তার উদ্দেশ্যে বললাম,

---  চলে গেছে তাই না।

মেয়েটি হাত দুটো সামনে রেখে অনুগত ছাত্রের মত উত্তর দিল 

--- জ্বী ম্যাম। কিছুক্ষণ আগে।

--- আচ্ছা তুমি যাও। আমার জন্য এক কাপ আদা চা বানিয়ে আন। মাথাটা খুব ব্যথা করছে।

--- ওকে ম্যাম। আর এই যে আপনার লাগেজ। এখানে আপনার সবকিছু আছে।

আমি মাথা নাড়াতেই মিতা রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

চাদরটা সরিয়ে  উঠে দাঁড়ালাম। আরেকবার ঘরটায় চোখ বুলিয়ে লাগেজ এর কাছে এগিয়ে গিয়ে খুলে জামা কাপড় আর তোয়ালে বের করে ওয়াশরুমে চলে গেলাম।

প্রায় ৪৫ মিনিটের মত একটা শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে আসলাম ওয়াশরুম থেকে। বের হতে ই মিতাকে দেখলাম ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ সেন্টার টেবিল এর উপরে রাখছে। আমাকে দেখে বলল,

--- এই নিন ম্যাম গরম গরম চা। আগেরটা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। খেয়ে নিন তাড়াতাড়ি।

আমার হাত থেকে টাওলটা নিয়ে বারান্দায় মেলে দিয়ে এসে বলল,

--- আমি খাবার আনছি ম্যাম। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন।

--- তাড়াতাড়ি কেন?

মেয়েটা কিছুটা দমে গেল। কিছুক্ষণ পরে বলল,

--- না ম্যাম ।আপনি নাকি রাত থেকে কিছু খান নি তাই বললাম।

--- ওহ। খেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি যাও। আর হ্যাঁ, তুমি আমাকে আপু বলে ডাকতে পারো।ম্যাম বলো না । শুনতে ভালো লাগছে না। 

মেয়েটা খুশি খুশি আমাকে বলে উঠলো,

--- তাহলে ভাবি ডাকি।

কথাটা কানে যেতেই আমার যেন সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠলো। আমি বেশ জোরেই বলে উঠলাম,

--- মোটেও না। আমাকে একদম ভাবি বলে ডাকবে না। আপু ডাকতে বলেছি।তাই ডাকবে। বুঝতে পেরেছো।

মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ের সম্মতি জানালো।তারপর চলে গেল। আমি বিরক্ততে "চ" এর মত উচ্চারণ করে বললাম,

---  কার রাগ কার উপরে ঝাড়ছি আমি। ধ্যাত...!

রুমে রাখা সোফার উপরে বসে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে চা খেতে লাগলাম। মাথাটা সত্যি বড্ড ব্যথা করছে।

__________🌺🌺________

 কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ পর সে আবার ঘরে চলে আসলো। হাতে খাবারের ট্রে।

কিছু বলতে যাব তার আগেই মেয়েটা সেন্টার টেবিল এর উপরে খাবার পরিবেশন করলো। ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, কালোজিরা আর শুঁটকি মাছের ভর্তা, আর মুরগির মাংস ।

আমি খাবারের উপর চোখ বুলিয়ে মিতার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও মুখভরা হাসি দিয়ে বলল,

--- আমি জানি আপু। এগুলো আপনার খুব পছন্দের খাবার এবার তাড়াতাড়ি  খেয়ে নিন।

আমি মিতার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম ও জানবে কিভাবে যে এই খাবারগুলো আমার খুব পছন্দের। কেউ তো জানেনা। আমি মিতাকে প্রশ্ন করলাম,

--- কে বলেছে এগুলো আমার পছন্দের খাবার?

মেয়েটি অকপটে জবাব দিল,

---  কেন স্যার বলেছে।

আমি মনে মনে ভাবলাম বাবা বাবা জানলেন কিভাবে মেয়েটার ডাকে আমার হুস ফিরল আর কিছু না ভেবে খাবারের মনোযোগ দিলাম সত্যি বড্ড খিদে পেয়েছে আমার।

খাওয়া-দাওয়া শেষে এখন একটু শরীরটা ভালো লাগছে মেয়েটা মাথা যন্ত্রণার ওষুধ আর পানি আমার হাতে ধরিয়ে দিল মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ওষুধটা খেয়ে নিলাম সত্যি এটুকু সময় মেয়েটাকে আমার বড্ড ভালোই লেগেছে মেয়েটা আমার মাথার দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠে বলল,

--- এ কী আপু। তোমার চুলগুলো তো দেখি একেবারে ভেজা। এসো আমার সাথে 

বলে হাত ধরে টেনে বেড সাইড ড্রেসিং টেবিলের সামনে চেয়ারে বসিয়ে দিল আমাকে প্রথমে তোয়ালে দিয়ে চুলগুলো মুছে তারপর হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল গুলো ভালো করে শুকিয়ে ঝরঝরে করে পিঠে ছড়িয়ে দিল ।

হঠাৎ এর মধ্যে মেয়েটার ফোন বেজে উঠলো মেয়েটার ফোন নিয়ে কথা বলতে বাহিরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর মেয়েটা ফিরে এসে ওয়াল আলমারি থেকে হ্যাঙ্গারে ঝুলানো একটা লং ড্রেস ব্যাগ বের করল। 

হাতে করে নিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে চেন খুলে ড্রেসটা বের করল। ওশান ব্লু কালারের লং জর্জেট গাউন। এক কথায় অসাধারণ একটা গাউন চোখ ধাঁধিয়ে গেল আমার।

আমি ড্রেস থেকে চোখ সরিয়ে মিতার দিকে তাকালাম। মিতা আমার হাতের ড্রেসটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,

--- এটা পড়ে নিন আপু।

আমি অবাক হয়ে তাকে প্রশ্ন করলাম,

--- ড্রেস পড়বো মানে? এই ড্রেস কেন পড়বো আমি? আর কোথায় যাব এটা পরে?

মেয়েটা ড্রেস আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

--- তা আমি বলতে পারব না ম্যাম সময় হলে আপনি বুঝতে পারবেন কিন্তু তাড়াতাড়ি এটা পড়ে আসুন বেশি সময় নেই হাতে।

--- আমি পড়বো না।

--- প্লিজ আপু স্যার বলেছে আপনাকে তাড়াতাড়ি রেডি করে দিতে। আধা ঘন্টার মধ্যে আপনাকে তৈরি করে দিতে না পারলে স্যার আমাকে বকা দেবেন।

কখন থেকে মেয়েটা খালি স্যার স্যার করেই যাচ্ছে।আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,

--- তোমার স্যার কে এখানে আসতে বল। এই ড্রেস আমি পড়বো না।

--- প্লিজ আপু।

--- বললাম না তোমার স্যারকে আসতে বল।

মেয়েটার উপায় না পেয়ে কাকে যেন ফোন করল। ফোনটা কেটে দেওয়ার পরে হঠাৎ আমার ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রিনে নাম্বারটা দেখতে সাথে সাথে রিসিভ করলাম আমি।

--- হ্যাঁ বাবা।

--- ''''''''

--- কিন্তু বাবা কেন?

---- """"""

--- আচ্ছা ঠিক আছে।

ফোনটা কেটে দিয়ে ড্রেসটা হাতে নিয়ে মিতার দেখানো চেঞ্জিং রুমে চলে গেলাম আমি। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে আসলাম গাউটা পড়ে । গাউনটা অনেক লং তাই ঘের ধরে উঁচু করে হাঁটতে হচ্ছে। আমাকে বেরিয়ে আসতে দেখে মেয়েটা বলল,

--- মাশাল্লাহ। আপনাকে একদম বার্বি ডলের মত লাগছে। স্যারের পছন্দ সত্যিই অসাধারণ।

ভুরু কুঁচকে মেকার দিকে তাকালাম সে কখন থেকে খালি স্যারের গুনগান করেই যাচ্ছে।কে এই স্যার?

মিতার কথায় ধ্যান ভাঙল।

--- আপু আপনার বেশি সাজগোজের প্রয়োজন নেই এমনিতেই অপ্সরীর মত লাগছে।

আমাকে নিয়ে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসালো। চুল খোলাই রাখল সে। শুধু বাম দিকে থেকে শিথি করে চুলগুলো কপালের ডান সাইট থেকে নিয়ে গিয়ে পেছনে ওশান ব্লু কালারের পাথরে ক্লিপ দিয়ে আটকে দিল। 

ঠোঁটে হালকা মিষ্টি কালারের লিপস্টিক, চোখে কাজল , আইলাইন ার আর হালকা মেকআপ দিয়ে সাজিয়ে দিলো আমাকে। তারপর সামনে রাখা সাদা পাথরের একটা নেকলেস আমার গলায় পরিয়ে দিল হাতে দুই জোড়া করে পাথরের চুরি আর কানে পাথরের কানের দুল পরিয়ে দিল।

--- ব্যাস। আপনার সাজ কমপ্লিট। কি লাগছে আপু আপনাকে। আমারিতো চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। তার কি হবে কে জানে?

আমিও আয়নায় নিজেকে দেখলাম। তারপর চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মিতা আমার হাত ধরে উঠে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল,

--- চলুন আপু আমাদের এবার যেতে হবে।

-- কোথায় যাব আমি?

--- গেলেই দেখতে পাবেন।

রুম থেকে বাইরে বের হতে কেমন খটকা লাগলো। এটা তো কোন ফ্লাট নয়। দেখে তো মনে হচ্ছে কোন রেসর্ট। মিতা আমার হাত ধরে ক্রমশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ড্রয়িং রুমে পৌঁছাতেই দেখলাম সম্পূর্ণ কাঠ দিয়ে তৈরি করা একটি ঘর।

আমি মিতার হাত ছাড়িয়ে বললাম,

--- এটা কোথায় মিতা?

মিতা থেমে গিয়ে পিছনে ঘুরে আমার উদ্দেশ্যে বলল,

--- আপু আপনি কুয়াকাটায় আছেন।এটা একটি কটেজ 

আমি চমকে উঠলাম। অবাকের শীর্ষে চলে গিয়েছি যেন। মৃদুস্বরে চিৎকার করে বললাম,

কীহ...! কুয়াকাটা! এখানে আমি আসলাম কি করে?কে এখানে নিয়ে এসেছে আমাকে ?

--- এটা আমি আপনাকে বলতে পারবো না আপু। আপনি চলুন আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।

--- না আমি কোথাও যাবো না।কারা তোমরা?

--- আপনি আমার সাথে চলুন সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন। নিশ্চিন্তে আসুন আপনার কোন ক্ষতি হবে না।

আমি আর কথা বাড়ালাম না। মনের মধ্যে একরাশ কৌতূহল নিয়ে মিতার পেছন পেছন যেতে লাগলাম। মেইন ডোর পেড়িয়ে সামনে এগোতেই দেখতে পেলাম সাগর কন্যাকে।

 ঢেউ এসে পাড়ে আছড়ে পড়ছে।  মেইন গেটের কাছে গিয়ে দাড়াতেই দেখতে পেলাম জায়গাটা কেমন একটা দ্বীপের মত। কিন্তু সমুদ্রের সৌন্দর্য দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছে যে কিছুক্ষণ আগের ব্যাপার গুলো মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে।

মিতা আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,

--- এবার আপনাকে একাই যেতে হবে আপু। আপনি সোজা এগিয়ে যান।

আমি পেছনে ঘুরে মিতার দিকে এক নজর তাকিয়ে সামনে এগোতে লাগলাম। দু হাতে লং গাউনটা উঁচু করে ধরে ধীরপায়ে এগিয়ে গেলাম। বেশ কিছুটা যেতেই একটা জিনিসের চোখ আটকে গেল।

 সামনে চাওনা একটা ফুলে বিছানো রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। সে রাস্তার দুই ধারে স্টিক পুতে তাতে রংবেরঙের বেলুন ঝুলিয়ে খুব সুন্দর একটা সেতুর মতো তৈরি করা হয়েছে। দেখতে এত সুন্দর হয়েছে যে আমার মাথায় আর প্রশ্ন আসলো না যে এটা কার জন্য তৈরি করা হয়েছে?

আমি সোজা তার মধ্যে দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। মনের মধ্যে একটা অন্যরকম অনুভূতি সৃষ্টি হতে লাগলো। আপন ইচ্ছায় ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। দূর থেকেও সেই হাসিতে একজন তাল মেলালো।

বেশ অনেকটা পথ হাঁটার পর সেই ফুলে বিছানো রাস্তার শেষ প্রান্তে এসে থামলাম। এবার হঠাৎ মাথায় আসলো যে রাস্তাটা কার জন্য ছিল পেছনে ঘুরে এদিক-ওদিক তাকিয়ে সামনে তাকাতেই দেখলাম পাড় থেকে ঢেউ সরে গেছে। আর সাথে সাথে আমার চোখগুলো যেন বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। কারণ

সমুদ্রের পাড়ে মাঝারি সাইজের ঝিনুক দিয়ে খুব সুন্দর করে খোদাই করে লেখা ,

          🐚শুভ জন্মদিন আমার প্রিয়তমা🐚 

                             প্রীতিলতা।

লেখাটা পড়তেই বুকের মধ্যে কেমন হাতুড়ি পেটানো শুরু হল।আমার মনে হল এগুলা আমার চোখের ভুল। তাই আরো কিছুটাই এগিয়ে গিয়ে দেখলাম। না ঠিক আছে। উত্তেজনা, আনন্দ, ভয় তিনটাই কাজ করছে আমার মধ্যে।

ভাবনার মধ্যে দুই কদম পিছিয়ে গেলাম গাউনের ধরে পেছনে ঘুরে দৌড় দিতে থেমে গেলাম আমার সামনে এক হাটু গেড়ে বসে থাকা মানুষটাকে দেখে।

ফর্সা শরীরে ব্ল্যাক সুট দারুন মানিয়েছে তাকে। গলায় ওশান ব্লু রঙের টাই ঝুলানো। চুলগুলো জেল দিয়ে খুব সুন্দর করে সেট করা। আজ তাকে দেখতে অন্যদিনের তুলনায় বেশি আকর্ষণীয় লাগছে।তার থেকে বেশি আকর্ষণীয় লাগছে তার চোখ জোড়া আজ তা পুরোটাই মাদকতায় পরিপূর্ণ।

তাকে এভাবে দেখে ভিতরের সমস্ত আবেগ অশ্রু হয়ে চোখে ভিড় জমালো।

মুখ থেকে অস্পষ্ট সরে বেরিয়ে আসলো,

--- সাফওয়ান। আপনি...!

সাফওয়ান ওভাবেই বসে থেকে আমার দিকে তার বা হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

---- many many happy returns of the day my prettiest lady.

কথাগুলো কানে আসতেই আবেশে চোখ বুজে ফেললাম। শিরদাঁড়া দিয়ে যেন শীতল স্রোত বয়ে গেল। আহা আজ আমার জন্মদিন ।আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম।

ডান হাতে টান পড়তেই চোখ মেলে তাকালাম। দেখলাম ডান হাতের অনামিকা আঙ্গুলে একটা আংটি পরিয়ে দিলেন সাফওয়ান। তারপর তালুর উল্টো পিঠে ঠোঁট ছুঁয়েও উঠে দাঁড়ালেন।টান দিয়ে আমাকে তার সাথে মিশিয়ে নিলেন। বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে নেশাক্ত স্বরে বলে উঠলেন,

--- I thought a different type gift for you. May I sweetheart...

শেষের শব্দটা ফিসফিস করে বললেন।

আমি অশ্রু সিক্ত নয়নে তার দিকে তাকালাম। সে যেন আরেকটু বেশি মাদকতাই ডুবে গেল। বাঁ হাতে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে তার সাথে আরো একটু গভীর ভাবে মিশিয়ে নিলেন ।ডান হাতটা আমার চুলের মধ্য  গলিয়ে দিয়ে মাথার পিছনে হাতটা রেখে মুহূর্তের মধ্যে আমার ওষ্ঠদ্বয় দখল করে নিলেন।

এমন হটোকারী কান্ডে আমি হকচকিয়ে গেলাম। প্রথমে হালকা কেঁপে উঠলাম।পরক্ষণে চোখ বুজে নিলাম। হয়ে গেলাম তার দুই বাহুর মধ্যে বন্দি ।কার্নিশ বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। ইশ্ এ কেমন যেন এক অন্য রকম অনুভুতি।


২৬ তম পর্ব🍂


গোধূলি বেলায় প্রিয় মানুষটার বুকে মাথা রেখে সাগর কন্যার পাড়ে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখা এ যেন এক প্রকার স্বর্গীয় সুখানুভূতি। বুক ভরে একমুঠো প্রশান্তির বায়ু টেনে নিলাম নিজের মধ্যে। তার সাথে নাকে ধাক্কা খেলে সেই চির পরিচিত মানুষটার গন্ধ। মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। মনে মনে কয়েক বার আওড়ালাম একটা শব্দ।" আমার মানুষ" "আমার একান্ত মানুষ"।

মুখটা আরো গুজে দিলাম তার বুকে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্যটা সাগরে অতলে তলিয়ে গেল। চারিদিকে কেমন অন্ধকারচ্ছন্ন হয়ে উঠলো। সাফওয়ান এবার আমাকে তার বুক থেকে সরিয়ে সোজাসুজি দার করিয়ে মুখটা কিছুটা নিচে নামিয়ে এনে আমার নাকের সাথে নাকের একটা ঘষা দিয়ে বললো,

---  চলুন ম্যাডাম এবার কটেজে ফিরে যাওয়া যাক।

আমি না বোধক মাথা নাড়ালাম অবুঝ শিশুর মত। তা দেখে সেও ছোট বাচ্চাদের মত মুখ করে প্রশ্ন করল কেন?

আমি তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললাম,

আমি আরো কিছুক্ষণ থাকবো।

বলে তার কানের কাছ থেকে মুখটা সরিয়ে এনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মাথা হ্যা বোধক নাড়ালাম। মুখটা কুচকে অনুরোধ করে বললাম প্লিজ।

সাফওয়ান আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ হেসে দিয়ে বলল,

---  আচ্ছা ঠিক আছে।

ইশ্ আবার সেই হৃদয় বিগলিত হাসি। এই হাসিরই তো পাগল হয়েছিলাম আমি। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মাথায় একটা প্রশ্ন চলে আসলো। তার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তাকে প্রশ্ন করলাম,

--- আচ্ছা সাফওয়ান আমি এখানে আসলাম

 কিভাবে?

কিছুক্ষণ ভাবুক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল ,

--- এভাবে।

মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে শূন্যে অনুভব করলাম। হঠাৎ এমন হওয়ায় ভয়ে তার ঘাড়ের কাছে কোটটা খামচে ধরলাম।

--- এই নামাও নামাও পড়ে যাব আমি।

আমাকে কোলে করে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল,

--- এত বড় সাহস তোমার আমার কোল থেকে পড়ে যাবে তুমি। পড়লে আগে আমি ফেলব তোমাকে তার পরে তুমি পড়বে । নিজে থেকে পড়লে তোমার খবর আছে।

আমি বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এই ছেলে বলে কি মাথা টাথা গেছে নাকি?

আমাকে কোলে করে নিয়ে সি বিচ এর ছাতাওয়ালা লম্বা চেয়ার টিতে গিয়ে বসলো। নিজে হেলান দিয়ে বসলো আর আমাকে টেনে তার বুকে আধার শোয়া করে বসিয়ে দিল।

দুজনেই সমুদ্রের ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ আমি তাকে প্রশ্ন করলাম,

--- বললেনাতো এখানে কিভাবে আসলাম? আর এক রাতের মধ্যে তোমার আচরণ এত পরিবর্তন হলো কিভাবে? কি হয়েছিল কাল রাতে?

আমাকে তার বুকের সাথে আমার একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

--- অনেক কিছু হয়েছে গতকাল  রাতে। বাবার হাতে থাপ্পড় খেয়েছি, তোমাকে নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছি তারপরে কোলে করে নিয়ে এই কটেজ এসে উঠেছি।

আমি তাকে ঝাড়া দিয়ে উঠে বসে এক প্রকার চিৎকার করে বললাম,

--- কিহ...!!

তোমাকে বাবা মেরেছে। তুমি আমাকে নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছো?

সাফওয়ান আমার দিকে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে সোজা হয়ে ওঠে বসে নিজের পরনের কোটটা ঠিক করে বলল,

---  তো কি হয়েছে? পরের মেয়ে নিয়ে তো আর পালাইনি নিজের বউ নিয়ে পালিয়েছি।

আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম,

--- কি সর্বনাশ তুমি সবাইকে না বলে আমাকে নিয়ে চলে এসেছ ওদিকে তো তাহলে সবাই আমাদেরকে খুঁজছে। ফোন করে জানিয়েছ ওদেরকে?

সাফওয়ান দায় সারাভাবে উত্তর দিল,

--- তাদেরকে জানানোর প্রশ্নই আসে না। আর খুঁজুক যত পারে খুঁজুক। কি সর্বনাশী কথা আমার বউকে আমার সামনেই আবার বিয়ে দেবে। দেওয়াচ্ছি বিয়ে।

এখানে আগে আমরা দুজন আবার বিয়ে করবো। হানিমুন করবো। একটা দুটো বাচ্চা কাচ্চা হলে তারপরে সেগুলো কোলে করে নিয়ে বাড়ি যাবো। তখন এই সেকেন্ড হ্যান্ডকে আর কেউ বিয়ে করতে চাইবে না।

কথাটা শেষ করে আমাকে একটা চোখ মারলো সাফওয়ান। ওর কথার মুখের ভঙ্গিমা দেখে আমার বিষম লেগে গেল। এই সাফওয়ান কী সেই সাফওয়ান। আমি কিছুটা তার দিকে এগিয়ে গিয়ে ভালো করে দেখে বললাম,

--- এতক্ষণ আমার ডাউট হচ্ছিল কিন্তু এবার আমি একদম শিওর যে তুমি মানুষ নও সাফওয়ানের ভূত হবে অথবা আমি কল্পনা করতেছি ।

কথা শেষ হওয়ার আগেই কোমর পর্যন্ত চুলে বেশ জোরেশোরে টান পরলো আমার। ব্যথায় মৃদু আর্তনাদ করে উঠলাম। মাথা ডোলে চোখ গরম করে সাফওয়ানের দিকে তাকালাম।

সাফওয়ান গাল বেঁকিয়ে হেসে বললেন,

--- কি এবার স্বপ্ন মনে হচ্ছে।

দাঁত কটমট করে বললাম,

---  না। এত জোরে কেউ চুল ধরে টানে।

হেলান দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে আমার উদ্দেশ্যে বলল,

--- তোমার তো সব চুল টেনে ছিড়ে ফেলে দেওয়া উচিত ফাজিল মেয়ে। সবাইকে দেখায় বেড়াও না দেখো আমার কোমর পর্যন্ত চুল সবাই আমাকে দেখে ফিদা হয়ে যাও । 

আর ওই সায়েম আরেক ফাজিল ব্যাটা । ওর সাথে অত হা হা হি হি করার কি আছে? ইচ্ছা তো করতো ওটার ঘুষি মেরে দাঁত ফেলে দেই আর তোমার মুখে কসটেপ মেরে রেখে দি।

আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম,

--- আমি কখন হাহা হিহি করলাম। স্বাভাবিকভাবেই কথা বলেছি ভাইয়ার সাথে। তাছাড়া ওনাকে আমি আগে থেকেই চিনতাম। ডাক্তার ভাইয়া বলে ডাকি আমি ওনাকে।

উহ ভাইয়া। ডাক্তার ভাইয়া। তোমার মায়ের পেটের ভাই না। যে অত খাতিরদারি করা লাগবে। সেদিন দেখলাম তো একেবারে মাথার কাপড় ফেলিয়ে দিয়ে চায়ের কাপ নিয়ে তার হাতে গিয়ে দিলে।

আরে ওটা তো আমি ইচ্ছা করে দেইনি। ভাইয়া ডেকেই আমার হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে নিয়েছিল কিন্তু আমি কি কর...

মাথার মধ্যে হঠাৎ একটা শয়তানের বুদ্ধি খেলে গেল। চুলগুলো কানের পিছনে গুজে তার দিকে আরো কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বললাম 

--- জেলাসি...! জ্বলে তাই না। আপনি তো আবার আমাকে পছন্দই করেন না তাহলে এত জ্বলতেছে কেন আপনার?

ভুরু কুঁচকে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাতের কনুই ধরে হেচকা টান দিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলল,

আমার পেছনে লাগা হচ্ছে, তাই না। আমি একবার তোমার পেছনে লেগে গেলে না জীবন কয়লা বানিয়ে দেবো কিন্তু। লাগবো নাকি?

আমি তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,

--- আরে না না ছেড়ে দিন। বাবা আগে আনরোমান্টিক ছিল ওটাই ঢের ভালো ছিল। এখন রোমান্টিক হোল কিউব হয়ে গেছে। জীবনটা আগে তো তেজপাতা ছিল এখন আরো বেশি তেজপাতা হয়ে যাবে।

আচ্ছা আপনি বলুন না গতকালকে কি হয়েছিল।

নিজে সেই লম্বা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আমার বাম হাতটা টেনে নিয়ে তার বুকের বা পাশে রেখে দু হাত দিয়ে জড়িয়ে নিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। কিছুক্ষণ পর নিজে থেকেই বলতে শুরু করল,

--- আমি প্রথমে সত্যিই খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম যেন। তুমি আসলেই কালকে উন্মাদের মত আচরণ করেছ। তারপর যখন সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলে। তখন তো আমার ভয়ে হাত পায়ে ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। আমার পৃথিবী যেন থমকে গিয়েছিল।

 তখন কি করব ভেবে না পেয়ে তোমাকে তাড়াতাড়ি কোলে করে নিয়ে বিছানায় শুয়ে দিয়েছিলাম দরজা খুলে আম্মু আব্বুকে জোরে জোরে চিৎকার করে ডেকে যাচ্ছিলাম।

 কিছুক্ষণ পর তারাও ঘরে এসে উপস্থিত হল বিছানায় তোমাকে ওইভাবে শোয়া দেখে আম্মু আর ভাবি দৌড়ে চলে গিয়েছিল তোমার কাছে।

 ভাবি যখন বলল সেন্সলেস হয়ে গেছ তুমি। 

বাবা তৎক্ষণাৎ থাপ্পড় মেরে দিলেন আমার বা-গালে। ছিটকে কিছুটা দূরে সরে গিয়েছিলাম আমি। আব্বু বলতে শুরু করলেন,

--- কুলাঙ্গার জন্ম দিয়েছি আমি। না হলে এমন হবে কেন সে। কি করেছিস তুই মেয়েটার সাথে। এমনিতেই তো তোকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে মেয়েটা আধমরা। সরিয়েই তো দিচ্ছি তোর জীবন থেকে। আর কি চাচ্ছিস তুই। পরের মেয়েকে মেরে ফেলবো আমি।

আম্মু এসে ওকে আটকে দিলেন। ভাব নিও জোরে চিৎকার করে বলল,

--- তেমন কিছু হয়নি আব্বু। মনে হয় অনেক স্ট্রেসের মধ্যে ছিল তাই এখন সেন্সলেস হয়ে গেছে। খাওয়া দাওয়া হয়তো ঠিকমতো করেনি। তার থেকেই এমন হয়েছে।

বাবা ভাবীর উদ্দেশ্যে বললেন,

--- দ্রুত জ্ঞান ফেরাও। ওকে আমি রাত্রি বেলায় ফ্ল্যাটে রেখে আসবো। এই ছেলের আশেপাশে আর এই মেয়েকে রাখবো না। মেয়ের উপরে তোর ছায়াও যাতে না পড়ে সেই ব্যবস্থা করছি আমি। 

বলে আব্বু রুম থেকে চলে গেলেন। আম্মু আর ভাবি আমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ভাইয়া আর সায়েম বেরিয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে। ভাবির কথা মত আম্মু তোমার জন্য স্যুপ বানাতে গিয়েছিল। সেই ফাঁকে আমি গিয়ে তোমার মাথার কাছে বসলাম। ভাবি আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

--- তুই কিন্তু ভুল করছিস সাফোয়ান। মেয়েটা কিন্তু অনেক ভালো। তুই এভাবে ওকে ইগনোর করতে পারিস না। দেখ অতীতে যা হয়েছে হয়েছে সবকিছু ভুলে এবার তো নিজের জীবনে এগিয়ে যায়।

আমি ভাবির দিকে এক ঝলক তাকিয়ে নজর সরিয়ে তোমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেছিলাম,

--- অনেক আগেই এগিয়ে এসেছি আমি ভাবি। আর এতটা এগিয়েছি যে এই মেয়েটার থেকে দূরে যাও আমার পক্ষে সম্ভব না। কোন ভাবেই সম্ভব না।আমি শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু ও যে বড্ড ছেলেমানুষই করে।

ভাবি আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

--- সঠিক সময় মানে!

সেটা তোমাকে এখন আমি বলবো না। তুমি শুধু আমার একটা হেল্প কর।

--- কি হেল্প?

--- ওর যদি জ্ঞানও ফেরে খাইয়ে দাইয়ে আবার ঘুম পাড়ানোর ব্যবস্থা করে দাও।

--- মানেই....!

--- উফ এতটা হাইপার হওয়ার কিছু নেই। আমি ওকে নিয়ে বাড়ি থেকে পালাবো। জ্ঞান থাকা অবস্থায় সেটা সম্ভব না। আর বাইরে একটা গাড়ির অ্যারেঞ্জ করে দাও। কোথায় যাব জিজ্ঞাসা করো না ওটা আমি তোমাকে বলতে পারব না।

--- তুই পাগল হয়ে গেছিস এই অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে কোথায় যাবি তুই?

--- বললাম না আমার বউকে সুস্থ করার দায়িত্ব তোমার সুস্থ করে দাও আর একটা গাড়ির অ্যারেঞ্জ করে দাও আর কিছু নিয়ে ভাবতে হবে না তোমার আমার বউ আমি দেখে নেব।

--- নিজে তো মরবি সাথে আমাকেও মারবি না।

--- প্রবলেম নাই কেউ জানতে পারবে না তুমি আমাকে হেল্প করেছ। করবে কিনা বল।না হলে তোমার জামাইয়ের কিন্তু খবর খারাপ করে দেবো।

--- থাক। তোমাকে আর কিচ্ছু করা লাগবে না। যা ভালো বোঝো তাই কর। যা যা করতে বলছো করবো কিন্তু কেউ যেন জানতে না পারে।

--- নিশ্চিন্তে থাকো।

তারপরে আর কি তোমার মাঝখানে একটু জ্ঞান ফিরেছিল। মা যত্ন সহকারে নিজের হাতে করে তোমাকে চিকেন সুপ খাইয়ে দিয়েছিল। তারপরে শরীর দুর্বল থাকার কারণে তুমি আবারও শুয়ে পড়েছিলে। আমার কথা মত ভাবি তোমাকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল।

তারপরে আর কি ফজরের আযানের পরে তোমাকে কোলে করে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলাম বাড়ি থেকে। এত কষ্ট করে ব্যাগ গোছালে তুমি। হানিমুনে যাবো না তা কি করে হয় সোনা । 

তাইতো তোমাকে কোলে করে নিয়ে সোজা কুয়াকাটা চলে এসেছি তুমিই তো বলেছিলে সমুদ্র তোমার খুব পছন্দের। তাই হানিমুন করার জন্য সমুদ্রের পাড়টাকেই বেছে নিলাম।

 তাই ড্রাইভারকেউ টাকা খাইয়া মুখ বন্ধ করে রেখে এসেছি।

আপাতত ওই বাড়িতে ভাবি বাদে সবাই তোমাকে খুঁজছে। আর ভাবি, একটু একটু নাটক করছে।

আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। কি করেছেন আপনি এগুলো। ওই বাড়ির সবাই হয়তো টেনশনে টেনশনে অজ্ঞান হয়ে গেছে।আর এতক্ষণে তো আমার মা বাবার কানে ওই কথা চলে গেছে। না জানি কি করতেছে সবাই ঐদিকে সবাই। আর আপনি এখানে সটান হয়ে শুয়ে চিল করতেছেন।

সাফওয়ান বিরক্তিতে চ  এর মত উচ্চারণ করে বলল,

--- আরে ধুর। তোমার কি মনে হয় ভাবির যা পেট পাতলা তা এতক্ষণ না বলে বসে আছে সে। এতক্ষণে ওই বাড়ির সবাই জেনে গেছে তুমি আর আমি হানিমুনে এসেছি । আর বাচ্চাকাচ্চা নিয়েই ফিরবো।

আমি তার ডান বাহুতে চাপড় মেরে বললাম,

--- ধ্যাত! বেশররম ব্যাটা।খালি আবোল তাবোল কথা বলে।

বলে আমি সী-বিচের দিকে তাকালাম। কিন্তু সী-বিচ এত সুনসান কেন? এত নিরব তো সমুদ্র সৈকত হয় না।

সাফওয়ানের বহু ঝাঁকিয়ে বললাম,

--- সমুদ্র সৈকত তো এত নীরব হয় না। আজ এমন লাগছে কেন?

--- তোমার দ্বিতীয় বিয়ে উপলক্ষে আমার সাথে সমুদ্র সৈকত ও নিরবতা পালন করছে।

--- আরে ফাজলামি বন্ধ করে বলো না কি হয়েছে এখানে?

সাফওয়ান চেয়ারে বসে নিচু হয়ে নিজের শুয়ে ফিতে বাধতে বাডধতে বললো,

--- একজন সাব জজ তার প্রিয়তমাকে নিয়ে এখানে সমুদ্র বিলাস করতে এসেছে ।তাই প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিশেষ অনুমতি নেওয়া আছে।

আমি চারিদিকে নজর বুলিয়ে কোথাও কাউকে দেখতে না পেয়ে বললাম,

--- কোথায় তারা। দেখতে পাচ্ছি না তো তাদের।

সাফওয়ান তার জুতো বাধা শেষ করে আমার সামনে এসে নিজের কোট ঠিক করে বলল,

--- সেই সাব জজ তোমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে আর তার প্রিয়তমা আমার সামনে বসে আছে।

কথাটা কানে পৌঁছাতেই যেন স্থম্ভিত হয়ে গেলাম আমি। কথা বলতে ভুলে গেছি যেন। অবাক হয়ে তার দিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।

জড়ানো কন্ঠে মুখ বলে উঠলাম,

ত্ তার ম্ মানে.....

স্বপন আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

--- জ্বী আগ্গে। আপনি যেদিন আমার ওপরে রাগ করে বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিলেন সেদিন দুপুরেই নিউজটা পেয়েছিলাম দশদিন পরে জয়নিং এর ডেট। তাই আপনার জন্মদিনটাকে স্পেশাল করার জন্য ই এতকিছু মুখ বুজে সহ্য করে গেছি।

 কিন্তু তুমি তো তুমিই না বুঝে না শুনে। ঘরবাড়ি ছেড়ে দিয়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছো। পুরো পরিবারের গালাগালি শুনিয়েছো। নিজে অজ্ঞান হয়েছে সাথে আমাকেও থাপ্পড় খাইয়েছো। সিরিয়াসলি ডেঞ্জারেস মেয়ে তুমি। 

আমি না থাকলে তোমার এগুলো যে কে সহ্য করত একমাত্র উপরওয়ালাই জানে।

আমি বসে বসে কলের পুতুলের মত তার কথাগুলো শুনছি। ও আমার জন্মদিনটাকে স্পেশাল করার জন্য এত কিছু সহ্য করার পরেও ধৈর্য ধরে এই দিনটার জন্য ওয়েট করেছিল। আর আমি কিনা কথাগুলো ভাবতেই চোখের কান্না আসবে এক ফোটা নোনা জল গড়িয়ে পড়ল।

হঠাৎ কোন কিছু না বলেই আবার আমাকে কোলে তুলে নিল। আচমকা এমন হওয়ায় আমিও কিছুটা ভরকে গেলাম।

কী হলো আবার কোলে নিচ্ছ কেন আমায়?

--- এইটুকু সারপ্রাইজে কাবু হলে চলবে ম্যাডাম। তোমার জন্য আর সারপ্রাইজ অপেক্ষা করে বসে আছে।

নাকে না ঘসে দিয়ে বলল,

--- এবার চলুন ম্যাডাম আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।

সে আমাকে কোলে তুলে নিয়ে অজানায় হারিয়ে যাচ্ছে, আমি তার গলা জড়িয়ে ধরে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছে দেখলাম সমুদ্রের বিশালতা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে।


২৭ তম পর্ব🍂


অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে আছে চারপাশ। কিছুক্ষণ পরপর ঝিঝিপোকার ডাক এবং সাথে সমুদ্রের কলকল শব্দ মুখরিত করে তুলছে এই জায়গাটিকে। এই মুহূর্তটাকে যদি একটু তৈলচিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হতো।

 তাহলে দেখা যেত এক চমৎকার প্রেমিক পুরুষ তার প্রিয় রমণীকে কোলে করে নিয়ে সমুদ্রের পাড় দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। অসাধারণ হতো কিন্তু চিত্রটি।

সাফওয়ান হেটেই যাচ্ছে। আস্ত একটা মানুষকে যে সে কোলে করে আছে তার জন্য চেহারায় কোন  বিরক্তিভাব বা ক্লান্তি নেই তার। এ যেন এক নতুন মানুষকে আবিষ্কার করেছি আমি। 

কত কিছুই ভেবেছি কত কিছুই করেছি সেগুলো ভেবে এখন ভারী লজ্জিত হচ্ছি আমি। মানুষটা আমাকে ভালবেসে ছিল কিন্তু নীরবে নিভৃতে। যার অদৃশ্য দেওয়াল আমি ভেদ করতে পারিনি। কি লজ্জা কি লজ্জা আসলেই কি আমি তার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য ছিলাম।

আমার দৃষ্টির সাফওয়ানে নিবদ্ধ আর সাফওয়ানের দৃষ্টি দূর অজানায়। তার বাম গালের দিকে তাকালাম। কাল নাকি বাবা এখানেই থাপ্পড়টা মেরেছিলেন।

ইশ্ আমার জন্য তাকে মার ও খেতে হয়েছে। ডান হাতটা উঁচু করে তার বা গালে রাখলাম। ধীরে ধীরে ছুঁয়ে দিতে লাগলাম তার খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলো। কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলেন যেন সাফওয়ান।

তার পা জোড়া থেমে গেল। তিনি পূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। কিঞ্চিৎ সময় পর আমাকে সহ তার ডান বাহুটা কিছুটা উঁচু করে বেশ সময় নিয়ে আমার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালেন। আবেশে চোখ বুজে নিলাম আমি। প্রিয় মানুষের স্পর্শ গুলো নিদারুন সুন্দর হয়।

আমাকে কোল থেকে নামিয়ে দিলেন তিনি। পকেট থেকে তার রুমাল বের করে মুহূর্তের মধ্যেই আমার চোখ জোড়া বেঁধে দিলেন। ব্যাপারটিতে আমি খানিকটা হকচকিয়ে গেলাম। এবার পেছন থেকে আমার দুই বাহু ধরে সামনে এগোতে এগোতে বললেন,

--- আমাকে বিশ্বাস করো তো প্রীতিলতা? না মানে এখন যদি তোমাকে এই সমুদ্রে ফেলে দেই।

আমি কিটকিট করে হেসে উঠে বললাম,

--- তা ফেলে দিন না আপনার হাত জোড়াও কিন্তু আমার হাতের মধ্যে আছে। সো সমুদ্রের পানি আমি একা খাব না সাথে আপনিও খাবেন। এখানে আবার দেখলাম দুজনের নোনা পানি খাওয়ার ওপরে ডিসকাউন্ট আছে।

সাফওয়ান হো হো করে হেসে উঠে বললেন,

--- রেলস্টেশনের মত এখানেও তাহলে ডিসকাউন্ট আছে।

বলে এক ঝটকায় চোখের উপর থেকে রুমালটা সরিয়ে দিলেন। একটা বেশ কড়া আলোর ঝলকানি এসে লাগল আমার চোখে। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম একটা উঁচু ঢিবির মতো জায়গায় খুব সুন্দর করে ডেকোরেশন করা হয়েছে।

 যার মাঝখানে একটা গোল টেবিল লাল কাপড়ের মোড়া এবং দুপাশে দুটো চেয়ার রাখা আছে এবং মাথার উপর থেকে নিচ পর্যন্ত স্টিকের সাথে ছোট ছোট লাইট লাগিয়ে সুন্দর করে ডেকোরেশন করা। পুরো জায়গাটাকে আকাশী এবং সাদা বেলুন দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে তোলা হয়েছে।

আমার হাত ধরে সেই বেলুনের মধ্য দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে এসে টেবিল ঘেঁষে দাঁড়ালেন সাফওয়ান। আমাকেও মাঝ বরাবর দাঁড় করালেন। টেবিলটার উপরে বড় একটা বক্স রাখা। বক্সের ফ্রিতে ধরে টান দিতে চারিপাশ থেকে বক্সটা খুলে পড়ে গেল। 

সাথে সাথে বেরিয়ে আসলো একটি ওশান ব্লু এবং চকলেট ফ্লেভার কম্বিনেশন এর একটি তিন পার্টের কেক। সে কেকের সামনে ক্রস করে দুটো ছোট ইস্টিক লাগানো আছে। যার একটার উপরে লেখা হ্যাপি বার্থডে অন্যরাতে লেখা হ্যাপি ওয়ান মান্থ অ্যানিভার্সারি।

লেখাটা দেখেই চমকে উঠলাম। এক মাস হয়ে গেছে আমাদের বিয়ের। আজকের এই দিনে গত মাসে বিয়ে হয়েছিল আমাদের। আবোল তাবোল চিন্তাভাবনার উদ্ভট কাজের চাপে এই ব্যাপারটা তো আমার মাথা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল।

আমি সাফয়ানের দিকে তাকাতেই সে আমার বা গালে ছোট্ট একটা চুমু দিয়ে বলল হ্যাপি ওয়ান মান্থ অ্যানিভার্সারি সুইটহার্ট।

আমি হতাশ গলায় তাকে বললাম,

--- এটাও মনে ছিল আপনার।

 সে বক্সগুলো টেবিলের উপর থেকে সরিয়ে সাইডে রাখতে রাখতে বলল,

--- হুম। এই তারিখে একটা গোটা মানুষকে নিজের নামে দলিল করেছিলাম ।তা মনে থাকবে না তারিখ টা। ইনফ্যাক্ট আমি তো চিন্তা করে রেখেছি আগামী এক বছর এভরি মান্থ তোমরা সেলিব্রেশন করব।

অবাক হলাম আমি এগুলো তো আমার পরিকল্পনা ছিল। উনি জানলেন কি করে। সাফওয়ান বক্সগুলো সরিয়ে রেখে সোজা হয়ে আমার দিকে দাঁড়িয়ে বললেন,

--- কি অবাক হচ্ছো। প্রিয় মানুষকে শুধু ভালবাসলেই হয় না মনের কথা বুঝতে পারার ক্ষমতা থাকতে হয় , চোখের ভাষা বুঝতে হয়, মনের আবেগ অনুভব করতে হয়। তারপরেই প্রেমিক পুরুষ হওয়া যায়।

সাফোয়ানের কথাগুলো আমার মনের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম যন্ত্রনা সুত্রপাত ঘটালো। আমিও ভালোবেসেছি । কিন্তু এতটা অনুভব করে নয়। আমি ভালোবাসার স্বীকৃতি চেয়েছি কিন্তু কিন্তু উনি আমাকে অনুভব চেয়েছেন‌‌।ইশ্ এভাবেও ভালোবাসা যায়।

চোখের কোণে অশ্রু গুলো ভিড় জমালো। তা দেখে সাফওয়ান আমার কাছে আরো কিছুটা এগিয়ে এসে আমার মুখটা আঁজলা করে নিজের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে চোখের পাতা মুছে দিয়ে বললেন,

--- তোমার ভালবাসার নিদারুণ ক্ষমতা আছে প্রিয়তমা। আমার মরু মনে তোমার ভালবাসা রহমতের বৃষ্টি হয়ে নেমেছে বলেই আজ আমি আমার অস্তিত্বকে খুঁজে পেয়েছি। রাগ হিংসা এগুলো মনের মধ্যে পুষতে পুষতে এক সময় নিজেই পাথরে পরিণত হয়েছিলাম আমি।

 তুমি ঠিক বলেছিলে রাগ হিংসা এগুলো মনের মধ্যে যত বাড়ে আপনজনরা তত বেশি দূরে সরে যায়। সরেই তো গিয়েছিলাম সবার থেকে। নিজের চারিপাশে একটা অদৃশ্য প্রাচীর তৈরি করে নিয়েছিলাম আমি। 

কিন্তু সেই দুর্ভেদ্য প্রাচীর তুমি ভেদ করতে সক্ষম হয়েছিলে। তোমাকে যতই দূরে সরাতে চেয়েছি তুমি তত বেশি কাছে এসেছো। তোমাকে যত বেশি ঘৃণা করতে চেয়েছি তুমি তত বেশি ভালোবাসায় মুরিয়ে দিয়েছো আমাকে। 

আগে যে তোমার ছায়াও সহ্য করতে পারত না। সে এখন তোয়ায় বুকে করে নিয়ে না ঘুমাতে গেলে ঘুম আসে না। তোমার রান্না ছাড়া এখন অন্য কোন রান্না খেতে পারেনা, ঘরে ঢুকলে তোমার সুবাস না পেলে দম বন্ধ হয়ে যায় তার, জিনিসগুলো তুমি গুছিয়ে না দিলে সবকিছু অগোছালো হয়ে যায়।

তোমার হাসির শব্দ, তোমার করা মজা গুলো, তোমার সম্মোধন টাও প্রতিদিন সকালে তোমার স্নিগ্ধ স্পর্শ গুলো সবকিছু কেমন যেন অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে আমার 

 ইদানিং কল্পনাতেও আসা যাওয়া বেড়েছে তোমার। আমারও পুরো অস্তিত্বের সাথে মিশে গেছো তুমি। তুমি বিহীন শ্বাস নিতেও এখন আমার কষ্ট হয় প্রিয়তমা।

ভাবলে কি করে প্রিয় , তুমি আমার জীবনের বোঝা হয়ে গেছো। যখন থেকে তোমাকে ভালবাসতে শুরু করেছি তখন থেকেই নিজের মধ্যে তোমাকে হারানোর একটা ভয় সৃষ্টি হয়ে  গিয়েছিল আমার। তোমাকে কারো সাথে সহ্য হতো না আমার।

 সেদিন খালামনির বাড়িতে সায়েমের সাথে তোমার সাধারণ কথাও আমার চোখে লেগেছিল। রাগ হয়েছিল তোমার উপর তাই সেদিন রাতে তোমার সাথে অমন আচরণ করেছিলাম। পরে সায়েম জানিয়েছিল তোমার আর ওর ব্যাপারে।

 তার পরেও ওর পাশে তোমাকে দেখলে কেন জানি আমার সহ্য হতো না। তারপর তুমি যখন তার পরের দিন সকালে তোমার বাড়িতে চলে গিয়েছিলে তখন উপলব্ধি করেছিলাম।

  যে আমার মনের অনুভূতিগুলো এবার তোমাকে জানানোর সময় এসে গেছে না হলে সত্যিই অনেক দেরি হয়ে যাবে। তাই সামিরা আর আমার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ক্লিয়ার করে দিয়েছিলাম তোমার কাছে। যাতে তুমি আমাকে ভুল না বোঝো।

আমি স্বভাবত অনেকটা নিরব স্বভাবের। মনে করেছিলাম তুমি হয়তো বুঝতে পারবে। কিন্তু না তুমি তো উল্টো বুঝে বসে আছো। এবং মনে মনে চক কষেছো কিভাবে আমার থেকে দূরে চলে যাবে। 

ভালবাসতে শিখিয়ে এভাবে চলে যাবে তা তো হয় না বেইবি ।তাই মনে মনে আমিও একটা ছক কষে নিলাম। তোমাকে নিয়ে এই বাড়ি থেকে পালাবো। এন্ড সি পালিয়ে এসেছি তোমাকে নিয়ে।

আর জানো তুমি আমার জন্য খুব লাকি। সেদিন দুপুরে তুমি বাপের বাড়ি যাওয়ার পরে রেজাল্ট টা পেয়েছিলাম। যদি সত্যি তুমি ওখানে উপস্থিত থাকতে না আমি কিন্তু উঠে গিয়ে তোমাকেই জড়িয়ে ধরতাম প্রথমে।

বিয়ের পরে কত তালবাহানায় আমার কাছে ঘেষে থাকতে চাইতে তুমি। আর সেদিন তোমাকে যে একটু জড়িয়ে ধরলাম ছিটকে দৌড় দিলে। সত্যি বলতে সেদিন আমার মধ্যকার সমস্ত আনন্দগুলো আমি তোমার সাথে ভাগ করে নিতে চেয়েছিলাম। তোমাতেই বিলীন হতে চেয়েছিলাম।

আমি তার বাহু জোড়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে তার শ্রুতি মধুর কথাগুলো শুনছি। আর নীরবে চোখের জল ফেলছি। সত্যি অপেক্ষার ফল সুমিষ্ট হয়। যে মিষ্টতা এখন আমার সর্বাঙ্গকে পুলকিত করছে। মন জুড়ে আনন্দের জোয়ার বইছে। আর সেই আনন্দের জোয়ারে স্রোত ধারা হয়ে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।

স্বপন আমার দিকে আরও কিছুটা এগিয়ে এসে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন,

--- আজ মনে হচ্ছে যেন তোমার চোখের পানির বাঁধ ভেঙেছে। অস্রু গড়িয়েই যাচ্ছে গড়িয়ে যাচ্ছে থামার নামই নেই। চলো এসো এবার কেক কাটবে।

কথাগুলো বলে আমার গালের রাখা তার হাত সরিয়ে নিতে গেলে আমি হাত জোড়া চেপে ধরে বললাম,

--- আমাকে এতটা ভালবাসলে কবে কুমড়া পটাশ?

সাফওয়ান স্নিগ্ধ হেসে আমার নাকের নাক ঘষে বললেন,

--- আমিও তো দিনক্ষণ দেখে তোমাকে ভালবাসিনি সোনা। আমি নিজেও বলতে পারব না সেই নির্দিষ্ট দিনটা কবে এসেছিল। শুধু এটুকু জানি অনুভূতিটা জন্মে গেছে ভেতর থেকে ‌। যাকে প্রতিরোধ করা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়।

আমি শব্দ করে কেঁদে উঠলাম। দুহাত দিয়ে সাফওয়ানকে জড়িয়ে ধরে তার বুকের মাথা রেখে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর তিনি আমাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে বললো,

---  অনেক কেঁদেছো তুমি।আর না। আমি তোমাকে প্রমিস করছি। এরপরে থেকে আর এক ফোঁটাও অশ্রু তোমার চোখ থেকে গড়াতে দেবো না আমি।

এসো আমার সাথে। আমি অনেক কষ্ট করে তোমার জন্য ডেকোরেশন করেছি। দয়া করে এখন কান্নাকাটি করে এই সুন্দর মুহূর্তটাকে নষ্ট করো না।

কেকটা কাটলাম। একে অপরকে অতি ভালবাসার সাথে খাইয়ে দিলাম। আর এই সুন্দর মুহূর্তটাকে নিজের মুঠো ফোনে ক্যাপচার করে রাখলেন সাফওয়ান।

ভালোবাসা তখনই সুন্দর যখন দুটি মানুষ একে অপরকে শ্রদ্ধাবোধের সাথে আপন করে নেয় দুই দিক থেকেই বরাবর প্রেম থাকে। যেটা আজ আমি অনেক সাধনার পরে পেয়েছি। হ্যাঁ সত্যিই তাকে আমি পেয়েছি। একদম নিজের করে।

_________🌺🌺_________

সন্ধ্যা সাতটা বাজে,

নিজের রুমে বিছানার ওপরে আদর্শোয়া হয়ে বসে চায় চুমুক দিচ্ছেন সাখাওয়াত হোসেন। পাশে তার অতি পছন্দের উপন্যাস শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সমগ্র আধা ভাঁজ করে রাখা আছে।

 মাগরিবের নামাজ পড়ে কেবল বসে ছিলেন উপন্যাসের পাতায় ডুব দিতে কিন্তু তৎক্ষণাৎ মিসেস শায়লা হোসেন স্বামীর জন্য চায়ের কাপ নিয়ে রুমে প্রবেশ করলেন। স্বামীর হাতে চায়ের কাপটা ধরিয়ে দিয়ে বিছানার পাশে থাকা জায়গায় বসে স্বামীকে প্রশ্ন করলেন,

--- এটা কি হলো সাফওয়ান এর আব্বু। আমাদেরকে সব প্ল্যানই তো ভেস্তে গেল। কী ভেবে রেখেছিলাম আমরা আর কি হয়ে গেল। হাহুতাশ করে বলে উঠলেন তিনি।

মোঃ সাখাওয়াত হোসেন নির্বিঘ্নে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তৃপ্তির শ্বাস ফেলে বললেন,

--- মূল উদ্দেশ্য যেটা ছিল সেটা তো পূরণ হল। এখন কোথায় আর কিভাবে পূরণ হলো সেটা ভেবে লাভ কি। বরং আয়োজন করো তোমার ছেলে আবার বিয়ে করে বউ নিয়ে আসছে। 

মহা ধুমধামে আমি এবার বৌভাত এর আয়োজন করব। বিয়েটা যেমনই হয়েছে কিন্তু আমার ছেলের বৌভাতটা জমজমাট হওয়া চাই ।সাব জজ এর বৌয়ের বৌভাতের অনুষ্ঠান বলে কথা।

মিসেস শায়লা হুসাইন চোখ ছোট ছোট করে বললেন,

--- তুমি এতটা শিওর হলে কি করে তোমার ছেলে প্রীতিকে আবার বিয়ে করে তারপরে আসবো।

মিস্টার সাখাওয়াত হুসাইন রহস্য করে হেসে বললেন,

--- ছেলেটা তো আমার। সব দিক থেকে স্বভাবটাও আমার মত পেয়েছে। আমার ছেলেকে আমার থেকে আর কে বেশি চিনবে। এইজন্যই তো প্রীতিকে এনেছি ওর জীবন সঙ্গিনী করে আমার বিশ্বাস ছিল এই মেয়েই পারবে তোমার ছেলেকে সোজা করতে। এবং পেরেছেও।

মিসেস শায়লা হোসেন হেসে বলে উঠলেন,

--- জানো সকালবেলায় যখন ওদের রুমে গিয়ে দেখলাম প্রীতি বিছানায় নেই। আমি তো আঁতকে উঠেছিলাম। পুরো রুমটা তন্ন তন্ন করে খুঁজে কাউকে না পেয়ে আমার তো মাথা কাজ করাই বন্ধ করে দিয়েছিল। সাফওয়ান যে প্রীতি কে নিয়ে এভাবে চলে যাবে এটাতো আমার মাথাতেই আসিনি।

তারপর তুমি যখন বললে সকালবেলায় প্রীতিকে নিয়ে তুমি সাফওয়ানকে বেরিয়ে যেতে দেখেছ বাড়ি থেকে। তার পরেও কেন যেন আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। পরে সামিরাও একই কথা বলল। আমি এখনো ভাবতে পারছি না সাফওয়ান এমন একটা কাজ করবে।

আমরা তো ভেবে রেখেছিলাম প্রীতিকে প্রথমে অন্য ফ্ল্যাটে গিয়ে রাখবো। কয়দিন পরে সাফওয়ান  নিজে গিয়ে প্রীতিকে নিয়ে চলে আসবে। কারণ আমি তো মা আমার ছেলের চোখে আমি প্রীতির জন্য অন্যরকম কিছু দেখেছিলাম সেটা কখনো ভুল হতে পারে না। আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার ছেলে পেতে কে ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু ও যে এমন পাগলামি করবে এটা আমার ধারণার বাইরে ছিল।

মিস্টার সাখাওয়াত হোসেন পাশের ডেক্সের এর উপরে চায়ের কাপটা রেখে বললেন,

--- ফজরের নামাজ মসজিদে পড়ার জন্য যখন ঘর থেকে বাইরে বের হলাম তখন দেখি সামিরা সদর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক নজর বুলাচ্ছে। পরে সদর দরজার দিকে না গিয়ে দোতলার বারান্দায় পিছন সাইডে গিয়ে দেখলাম। তোমার ছেলে বৌমাকে কোলে করে নিয়ে গাড়িতে ঢুকছে আবার দারোয়ান কেউ কিছু টাকা দিয়ে গেছে মুখ বন্ধ রাখার জন্য।

তাইতো ফজরের নামাজটা ঘরেই পড়েছি আজকে। তার সাথে দুই রাকাত শোকরানা নফল নামাজ পড়েছি আল্লাহর উদ্দেশ্যে। আমার পাগল ছেলেকে বুঝদার বানানোর জন্য। নাও তাড়াতাড়ি শুরু করো আমার মন বলছে তোমার ছেলে কাল সকালেই বৌমাকে নিয়ে চলে আসবে। আর আমি দেরি করতে চাই না কালকে বৌভাতের অনুষ্ঠান হবে। সবাইকে প্রায় ইনভাইট করা হয়ে গেছে। আর কিছু বাকি আছে কাগজ-কলম নিয়ে এসো ফোন করে করে জানিয়ে দেই।

এর মধ্যে হাতের ট্রে করে সন্ধ্যার নাস্তা নিয়ে ঘরে ঢুকলো সামিরা। তার পেছন পেছন ঢুকলো পুতুল এবং সাকলাইন ‌। সেন্টার টেবিলটা টেনে এনে মাঝখানে রেখে নাস্তার ট্রেটা টেবিলের উপরে রাখল সামিরা। সাকলাইন আর পুতুল বিছানার ওপরে বসলো, আর স্বামীরা সোফা সেটের উপরে।

সাক লাইনের দিকে তাকিয়ে সাখাওয়াত হোসেন বললেন,

--- ক্যাটারিং এর দায়িত্ব কিন্তু তোমার। নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে পড়ো এখন। বাজার ঘাট সদাই পাতে সবকিছু বাকি আছে একে একে করতে হবে।

বলে পাকড়াও বাটিটা তুলে এক এক করে খেতে লাগলেন।

সাকলাইন চায়ের চুমুক দিতে দিতে বলল,

--- চিন্তা করো না বাবা তুমি শুধু ইনভাইট লিস্ট টা ভালোভাবে চেক করো আর কাদের কাদের ইনভাইট করতে বাকি আছে তাদের ফোন করে জানিয়ে দাও এদিকে আর যা আছে সব কিছু আমি সামলে নেব আর আমি একা তো নয়, আমার সাথে সায়েম আছে। ও একটু হসপিটালে গেছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে বলেছে। এখনো তো সারারাত পড়ে আছে। কাল ওরা আসার আগেই সবকিছু গোছানো হয়ে যাবে। কাল চমৎকার একটা সারপ্রাইজ দেওয়া হবে ওদেরকে।

পুতুল হৈহই করে বলে উঠলো। আম্মু প্রীতিলতা আর ছোট ভাইয়ার কি আবার বিয়ে হবে। শায়লা হোসেন মেয়েকে কোলের দিকে টেনে নিয়ে বললেন,

--- বিয়ে তো তোমার ভাইয়ার হয়ে গেছে সোনা। এবার তোমার ভাইয়া আর ভাবির বৌভাতের অনুষ্ঠান হবে।

না ও আমার প্রীতিলতা হয়। আমি সারা জীবন ওকে প্রীতিলতা বলে ডাকবো।

পুতুলের কথা শুনে উপস্থিত সবাই হেসে উঠল। সামিরা বলে উঠলো,

--- বাবা কালকে প্রীতিকে পড়ানোর জন্য কিছু ড্রেসও তো কিনতে হবে। তাছাড়া কালকে অনুষ্ঠানের জন্য আমরা মেয়েদের কিন্তু নতুন ড্রেস চাই।

মিস্টার সাখাওয়াত হোসেন মুচকি হেসে সামিরার দিকে তাকিয়ে বললেন,

--- আমার বাড়ির সব মেয়েরা কালকে নতুন পোশাক পরবে। তোমরা মেয়েরা সবাই বেরিয়ে পড়ো, শপিংয়ের জন্য আর আমরা এদিকে আমাদের কাজ সেরে আসি। দশটায় ডিনারের টেবিলে সবার সাথে বাকী কথা হবে।ঠিকাছে।

সবাই ঘাড়বাঁকিয়ে সম্মতি জানালো। পুতুল তো বায়না জুড়ে দিয়েছে সে নাকি পছন্দ করে তার প্রীতিলতার জন্য বৌভাতের পোশাক কিনবে। সে তার সেটা তো সে অবশ্যই কিনবে। আফটার অল প্রীতিলতার পুতুল সে।

হঠাৎ ফোনে মেসেজ এর শব্দ আসায় সবাই কিছুটা থেমে গেল। সাখাওয়াত হোসেন ফোনটা তুলে নিয়ে দেখলেন মেসেজে লেখা

Assalamualaikum, baba 

finally your plan has succeeded. Coming back very soon... "Preeti" 


২৮ তম পর্ব🍂

বিছানা জুড়ে  বিয়ের গর্জিয়াস লাল লেহেঙ্গা , গহনা সহ বিয়েতে সাজার জন্য মেয়েদের যাবতীয় শ্বাস সরঞ্জাম রাখা রয়েছে।

সকালে হাতমুখ ধুয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখলাম সাফওয়ান রুমে নেই কিছুক্ষণ পর মিতা এসে বিছানার পরে এক এক করে বিয়ের শ্বাস সরঞ্জাম সাজিয়ে রাখলো। বলতে গেলে একেবারে এলাহি কাণ্ড।

আমি অবাক হয়ে মিতাকে প্রশ্ন করলাম,

ওগুলো কি মিতা?

আপনার বিয়ের পোশাক আপু। আপনি যখন ঘুমিয়ে ছিলেন তখন স্যার গিয়ে এই সমস্ত শাড়ি গহনা আপনার জন্য কিনে এনেছেন। এখন তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট করে গোসল করে নিন। কিছুক্ষণের মধ্যে পার্লারের মেয়েরা চলে আসবে আপনাকে সাজানোর জন্য।

আমি বিছানার কোনায় বসে বিছানার উপরে রাখা জিনিসপত্রের দিকে তাকিয়ে ব্রেকফাস্ট এর প্লেটটা নিজের হাতে তুলে নিলাম। কিন্তু খেতে ইচ্ছে করছে না। একদৃষ্টিতে ওই জিনিসগুলোর দিকে তাকিয়ে আছি আমি। 

আমার খুব ইচ্ছা ছিল আমি বিয়েতে লাল লেহেঙ্গা পড়বো, ভারী সাজগোজ। কিন্তু আমার আশা পূরণ হয়নি । বিয়েটা খুব তাড়াহুড়ো আর ঘরোয়া ভাবে হয়েছিল বলে বেনারসি আর কিছু হালকা গহনা পড়েছিলাম আমি বিয়েতে।

কিন্তু আজ মনে হচ্ছে আমার সেই ইচ্ছাটা পূরণ হবে। ভাবতেই চোখের কোনায় সুখের অশ্রু জমা হল। কোনরকমে নাস্তাটা করে চলে গেলাম সোজা গোসল করার জন্য।

_____🌺🌺______

প্রায় ২০ মিনিট পর ওয়াশরুম থেকে বের হলাম আমি। বের হয়ে দেখলাম পার্লারের দুটো মেয়ে বসে আছে সোফা সেটের উপরে। আমাকে দেখে সালাম দিয়ে হ্যাঙ্গারে ঝুলানো লেহেঙ্গা সেট টা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়েছে চেঞ্জিং রুমে গিয়ে চেঞ্জ করে আসতে বলল।

কিছুক্ষণ পর পুরো কমপ্লিট লাল কম্বিনেশন এর লেহেঙ্গা টা পড়ে চেঞ্জিং রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম আমি। চুলগুলো পেছনে ছেড়ে দেওয়া , মুখে কোন মেকাপ নেই। ওড়নাটা বুকের উপরে দিয়ে রেখেছি আমি।

মেয়ে দুটো আমার কাছে এসে আউটফিটটা আরেকটু ঠিকঠাক করে দিয়ে বলল,

--- স্যার বলেছে খুব হালকা মেকআপ করাতে। তার ওয়াইফ এমনিতেই খুব সুন্দর দেখতে। এখন তো দেখছি মেকআপেরও কোন প্রয়োজন পড়বে না। এভাবেই স্যারের সামনে নিয়ে গেলে স্যার মাথা ঘুরে পড়ে যাবে।

আমি মাথা নিচু করে নিঃশব্দে হাসলাম। মেয়েটা তাড়াহুড়ো করে আমাকে নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনের টুলে বসিয়ে দিল। দ্রুত হাতে হেয়ার ড্রায়ার বের করে চুলগুলো প্রথম শুকিয়ে নিল। তারপর ব্যস্ত হয়ে পড়ল তাদের স্যারের নির্দেশনা পালন করতে।

প্রায় এক ঘন্টা পরে আমার সাজগোজ সম্পন্ন হল। মেয়ে দুটো এখন লেহেঙ্গার বড় ওড়নাটা মাথায় তুলে সেট করে দিচ্ছে। আয়নার দিকে তাকিয়ে আজ নিজেকে চিনতে একটু অসুবিধা হচ্ছে। বেশ সাদাসিধে নরমাল পোশাক পড়তে পছন্দ করি আমি। কিন্তু বিয়ের সাজ প্রতিটা মেয়েরই স্বপ্ন থাকে। সে স্বপ্নের বাস্তবায়ন আজ নিজের মধ্যে দেখে সত্যি চঞ্চল হয়ে উঠেছে আমার দুটো চোখ। নিজেকে খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি। মনে হচ্ছে আমি যেন স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু না অতীতের স্বপ্নটা আজ বাস্তবায়ন হয়েছে।

______🌺🌺______

 বাইরে বের হতেই একটি কালো গাড়ি কটেজের বাইরে পার্ক করা দেখলাম। ড্রাইভার বাইরে বেরিয়ে এসে বলল,

--- চলুন ম্যাম আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম।

আমি আশে পাশে তাকিয়ে সাফওয়ান কে খুঁজলাম কিন্তু তাকে পেলাম না। ড্রাইভার তা দেখে বলল,

 স্যার আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। শষ তার পর্যন্ত আমি আপনাকে পৌঁছে দেব। প্লিজ গাড়িতে উঠুন।

আমি মিতাকে আমার সঙ্গে যেতে বললাম। কিন্তু না ও আমাকে জড়িয়ে ধরে নতুন জীবনের শুভেচ্ছা জানালো। তারপর বলল,

--- আপনারা আর আবার আসবেন আমাদের এখানে। খুব শীঘ্রই আমাদের হয়তো দেখা হবে।

আমি মুচকি হেসে আরো একবার তাকে জড়িয়ে ধরে। গাড়িতে উঠে বসলাম হাত বাড়িয়ে মিতাকে বিদায় জানালাম। তারপর গাড়িটা স্টার্ট দিল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই মিতা চোখের আড়াল হয়ে গেল। দ্রুত গতিতে ছুটছে গাড়িটি। তার সাথে তাল মিলিয়ে ছুটছে আজ আমার হৃদপিন্ড । ইস এতটা নার্ভাস কেন লাগছে আমার।

বেশ কিছুক্ষণ পর গাড়িটা একটা বড় মাঠের সামনে এসে থামল। আমি চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম খোলা মাঠ ছাড়া কিছুই চোখে পড়ছে না। এবার কেন জানি আমার ভয় হতে শুরু করল। আমি এবং ড্রাইভার ছাড়া তো আর কেউ নেই এখানে। আমি বেশ গুটিশুটি মেরে বসলাম। তা দেখে ড্রাইভার বলল,

--- ভয় পাবেন না ম্যাম। আমার যে নির্দেশনা দেওয়া ছিল আমি সেই নির্দেশনায় পালন করছি। এই পর্যন্তই আমি আপনার যাত্রা সঙ্গী ছিলাম। এবার অন্যভাবে আপনাকে যেতে হবে।

ভয় রীতিমতো আমার গলা কাঁপতে শুরু করল । কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বললাম

---  অন্যভাবে মানে...!  কিভাবে যাব আমি? কোথায় যাব এখানকার রাস্তাঘাট তো কিছু চিনি না আমি।

ড্রাইভার আমাকে অভয় দিয়ে বললো আপনাকে কিছু ভাবতে হবে না ম্যাম আপনি মাঠে গিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন স্যার আসছে।

তার পরেও আমার ভয় একটুও কমেনি।মনে মনে ভাবলাম বদ্ধ গাড়ির মধ্যে বসে থাকার চেয়ে খোলা মাঠে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভালো। কোন অসুবিধা হলে দৌড়ে পালানো যাবে।

 চুপিচাপে গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম দুহাতে লেহেঙ্গার ঘেরটা উঁচু করে মাঠের এক কোনায় গিয়ে দাঁড়ালাম। আকাশটা হালকা মেঘাচ্ছন্ন সূর্যের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। এই মেঘাচ্ছন্ন আকাশ বড্ড কাছে টানে আমার আকাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চারিপাশা আবারো নজর গোলাম না সাফওয়ানের কোন দেখা নেই।

হঠাৎ কিছুক্ষণ পর কেমন যেন হেলিকপ্টারের শব্দ কানে আসতে লাগলো খুব ক্ষীণ ভাবে। তাকিয়ে দেখলাম দূর আকাশে কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। কিছু মুহূর্তের মধ্যেই ভালোভাবে দেখতে পারলাম সত্যি একটা হেলিকপ্টার।

 ধীরে ধীরে শব্দ প্রগাঢ় হতে লাগলো তারপর এক পর্যায়ে ধীরে ধীরে আকাশ থেকে নেমে আসতে লাগলো হেলিকপ্টারটি আমার সামনের মাঠে। মাঠের চারপাশের গাছপালায় যেন ঝড়ের তান্ডব হতে লাগলো।হেলিকপ্টারের পাখার দাপটে আমার ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে যাচ্ছিল এত পরিমানের বাতাস হচ্ছিল যেন।

তার কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে হেলিকপ্টারের পাখা বন্ধ হয়ে যেতে লাগলো এবং চারিদিকের কৃত্রিম প্রলয়  ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে লাগলো তার কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে বেরিয়ে আসলো গোল্ডেন কালারের শেরওয়ানি পড়া সাফওয়ান। চোখে ব্ল্যাক সানগ্লাস চুলগুলো উঁচু করে সেট করে রাখা। পায়ে নাগরায় জুতা।

বেশ দ্রুত পায়ে এসে আমার সামনে থামলেন। সানগ্লাসটা খুলে শেরওয়ানির পকেটে ঝুলিয়ে রেখে আমাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে গাল বাকি হেসে বলল

--- নট ব্যাড। ভালই লাগছে তোমাকে।

আমার ভারী রাগ হল। নাকের পাটা টা ফুলে উঠল রাগে। এতক্ষণ ধরে সেজেগুজে এসেছি যার জন্য তার মুখে শুধু এটুকুই প্রশংসা নট ব্যাড আর ভালই লাগছে। মুখ ভেঞ্চি দিয়ে বললাম,

---  ইউ লুকিং সো জঘন্য।

সাফওয়ান চমকে উঠে বলল,

--- কিহ...!

আমি দুটো হাত ভাঁজ করে তার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম,

--- আমি এতক্ষণ সেজেগুজে এসে যদি শুধু নট ব্যাড আর ভালই লাগছে এমন কমপ্লিমেন্ট শুনি তাহলে তুমি তো কিছুই সাজগোজ করোনি, সেহেতু তোমাকে একদম জঘন্য লাগছে।

সাফওয়ান ভাবুক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে শাহাদাত আঙ্গুল নাড়িয়ে বলল ,

--- ইয়াহ লজিক আছে। তুমি এক কাজ কর ওকালতির কোর্সটা কমপ্লিট কর। তোমার ক্যারিয়ার একদম চকচক করছে।

আমি গাল ফুলিয়ে মাঠের অন্য দিকে তাকিয়ে রইলাম।

সাফওয়ান হঠাৎ আমার ডান গালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল। তারপর মুখটা কিছুটা ডানের সরিয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,

--- ইউ আর লুকিং ড্যাম গর্জিয়াস বিউটি কুইন। ইচ্ছা তো করছে এখনই কোলে করে নিয়ে বাসর ঘরে ঢুকে যাই। যাবে নাকি।

আমার থেকে কিছুটা দূরে সরে গিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ মারলেন।

আমার এবার আরো বেশি রাগ হল। কোথায় সাহিত্যিকদের মতো একটু বউয়ের প্রশংসা করবে। তা না। উনি আছে ওনার ধান্দা নিয়ে। ধুর ভালো লাগেনা।

আমি লেহেঙ্গার ঘের অল্প উঁচু করে ধরে উল্টোপথে হাঁটা শুরু করলাম। তা দেখে সাফওয়ান আমার পেছন পেছনে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

--- কি হলো তুমি উল্টো যাচ্ছ কেন?

--- আমি যাব না তোমার সাথে আর বিয়েও করবো না তোমাকে। সারা জীবনে কুয়াকাটাই থেকে যাব আমি। এমন কচুর বর আমার দরকার নেই।

সাফওয়ান আমার দিকে আরো কিছুটা এগিয়ে এসে বলল কি বললে তুমি? আমি তোমার কচুর বর। তুমি কি জানো এই গল্পের পাঠিকারা আমার উপরে ফিদা হয়ে বসে আছে। আর তুমি কিনা আমাকে কচুর বর বললে।

আমি মেকি হাসি দিয়ে বললাম,

--- তা জান না আপনার পাঠিকাদের কাছে। আমার কাছে এসেছেন কেন? তারাও একটু বুঝুক আপনি কি চিজ। জীবনটাই আমার তেজপাতা বানিয়ে ছেড়েছেন আপনি।

স্বপন এবার কোমরে দুই হাত বাঁধিয়ে আমার সামনে তাকিয়ে বলল,

--- তাহলে সত্যিই তুমি যাবা না?

--- না।

--- সত্যি..!

---সত্যি।

--- তিন সত্যি।

আমি চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম,

--- ১০০ সত্যি।

সাফওয়ান শেরওয়ানির পকেট থেকে নিজের সানগ্লাস টা বের করে চোখে পড়ে নিয়ে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল

--- ওকে থাকো তাহলে আমি গেলাম।

আমার এবার মনের মধ্যে ভয় কাজ করা শুরু করলো,

--- এ ব্যাটা সত্যি সত্যি আমাকে ফেলে রেখে চলে যাবে না তো।

সাফওয়ান ঘুরে আমার পেছনে দিকে গিয়ে হঠাৎ কোলে তুলে নিলেন।

আমি মনে মনে বললাম,

--- উফ আলহামদুলিল্লাহ। যাক এই ব্যাটা  আমাকে নিয়েই যাবে তাহলে।

উপরে উপরে বললাম,

--- কি হলো কথায় কথায় খালি কোলে নিচ্ছেন কেন? নামান আমাকে। আমি হেঁটে যেতেই পারবো।

সাফওয়ান উত্তর দিল,

--- মাঠ পেরিয়ে ওই যে দূরে দেখছ গাছ পালায় ভরা জায়গা ওটা কিন্তু আসলে একটা জঙ্গল। রাতের বেলায় বাঘ মামারা তাদের পিকনিকের মাংস খুঁজতে এখানে আসে। তুমি তো হেঁটে যেতে চাইছিলে ওইখানে আমি না হয় তোমাকে কোলে করে পৌছে দিলাম।

ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। আমি চেয়েছি কিনা ওই জঙ্গলের মধ্যেই যেতে চাইছিলাম। সাফওয়ান হাঁটা শুরু করলে আমার হুশ ফিরল। তাকিয়ে দেখলাম সে সত্যি আমাকে নিয়ে জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে।

আমি তার কোলের মধ্যে লাফালাফি শুরু করে বললাম,

--- এ্যাই না না আমি বাড়ি যাব। আমাকে দয়া করে বাড়িতে নিয়ে চলুন।আমি আর এক মুহূর্ত এখানে থাকবো না। কী এমন বয়স আমার এখনই বাঘের পেটে যেতে চাই না আমি।

স্বপন আমার মুখের দিকে কিছুটা ঝুঁকে এসে সন্দিহান কন্ঠে বললেন,

--- সিওর তো..!

--- ওয়ান থাউজেন্ড পার্সেন্ট।

সাফওয়ান এবার উল্টো ঘুরে হেলিকপ্টারের দিকে যেতে লাগলেন ‌। আমি ঘর ঘুরিয়ে পেছনের দিকে তাকিয়ে জঙ্গলটা আরেকবার দেখে নিলাম না বাবা সব জায়গায় জেদ করতে নেই।

সাফওয়ান উত্তর দিলেন একদম ঠিক বলেছ সব জায়গায় জেদ করতে নেই। তার ফল ভালো হয় না বাবু।

আমি তো মুখ ফুটে কিছু বলিনি। তাহলে কিভাবে জানলেন?

সাফওয়ানগাল বাকি হেসে বলল,

--- তোমার মন এত জোরে জোরে কথা বললে না শুনে কোথায় যাব আমি তো আর বহেড়া নই।

আমি মুখ ভেংচি দিয়ে বললাম,

--- হুহ ঢং।

সাফওয়ান হেলিকপ্টারের সিটে আমাকে বসিয়ে দিলেন। পাশে নিজেও বসলেন। প্রথমে আমার সিটবেল্ট এবং পরের নিজের সিট বেল্ট বেঁধে দিয়ে হেলিকপ্টার স্টার্ট দিতে বললেন।

প্রথমবার এমন আকাশ ভ্রমণ মনের ভিতরে একটা আলাদা রোমাঞ্চকর মুহূর্তের সৃষ্টি করছে। আমি সিটে হেলান দিয়ে বাইরের দৃশ্য উপভোগ করতে লাগলাম। সাফওয়ান আমার পাশে বসে আছে ফোনে কি যেন দেখছেন।

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললাম,

--- আচ্ছা আমরা যাচ্ছি কোথায় কুমড়া পটাশ?

ফোনের দিকে নজর রেখে বললেন,

--- গেলেই দেখতে পাবে। আপাতত কোন প্রশ্ন করো না।

তাই এটুকু তো বলুন হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা কেন করলেন।

সাফওয়ান ফোনটা পকেটে ভরে রেখে বললেন,

--- গন্তব্য খুব নিকটে নয় তাই। তাছাড়া আমি একটা ঘোড়ার ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলাম । কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম তোমার যা ওজন হয়েছে। তুমি ঘোড়ার পিঠে উঠলে সে তৎক্ষণাৎ পটল তুলতো। তাই তাড়াতাড়ি হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করেছি।

আমি তার শেরওয়ানি ধরে কিছুক্ষণ ঝাঁকাঝাকি করলাম। পরের দিন করে হাতের উপর একটা কিল বসিয়ে দিলাম।

সাফওয়ান নিজের বাহাত বলতে বলতে বলল,

--- কেন এত লাফালাফি করে নিজের এনার্জি লস করছে? যানো মাটি থেকে আমরা কতটা উপরে আছি। আরে ক্যাপ্টেন ও কিন্তু বেজায় রাগী। রেগে গেলে তোমাকে আর আমাকে একসাথে ধাক্কা মেরে ফেলে দেবে। চুপচাপ হয়ে বসে থাকো।

আমিও আর তার সাথে কোন কথা না বলে বাইরের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। আকাশটা সত্যি আজ বড্ড সুন্দর।

______🌺🌺_______

প্রায় দুই ঘন্টা জার্নির পর সাফওয়ান এর গন্তব্যে এসে পৌছালাম। হেলিকপ্টার থেকে নেমে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম এটাও একটি মাঠ। সাফওয়ানো হেলিকপ্টার থেকে নেমে এসে আমার ডান হাতের কব্জি ধরে নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে লাগলো। চারিপাশ দেখে যায় বুঝলাম এটা একটা গ্রাম্য এলাকা। ইটের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গিয়ে সামনেই মেইন রোড। 

সাফোয়ান হঠাৎ আমার পেছনে গিয়ে তার পকেট থেকে রুমাল বের করে আমার চোখ জোড়া বেঁধে দিলেন।

--- কি করছেন? চোখ বেঁধে দিলেন কেন?

পেছনে দাঁড়িয়ে আমার দুই বাহু ধরে কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন,

--- এখন আর একটা কথাও বলবে না। যেখানে নিয়ে যাচ্ছি চুপচাপ সেখানে  চল আমার সাথে। না হলে ফল কিন্তু ভালো হবে না।

সাফোয়ানের কন্ঠ টা কেমন যেন লাগছে আমার কাছে। কাঁপা কাঁপা গলায় আমি তাকে আবার প্রশ্ন করলাম,

--- কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?

আবার ও সাফোয়ানের ফিসফিসানি কন্ঠ,

--- হুসসস...! কিপ কোয়াইট। এন্ড কাম উইথ মি।


অন্তিম পর্ব🍂

বেশ অনেকটা সময় পর চলন্ত গাড়িটা এবার থেমে গেল। চোখে যেহেতু রুমাল বাধা আছে। তাই বুঝতে পারছি না গাড়িটা কোথায় এসেছে থেমেছে। তার কিছুক্ষণ পরে গাড়ির দরজা খোলার শব্দ পেলাম সাফওয়ান বোধহয় গাড়ি থেকে নেমেছেন। তারপর দরজা বন্ধের শব্দ কিছুক্ষণ পর আমার সাইটের গাড়ির দরজা খুলে আমার ডান হাত ধরে ধীরে সুস্থ নামলেন তিনি।

পেছন থেকে গাড়িটা চলে যাওয়ার আওয়াজ পেলাম। এখনো তিনি আমার চোখের পর্দা টা সরলেন না। আবার আমি খুলতে চাইলেও তিনি বারবার হাত আটকে দিচ্ছেন। ব্যাপারটা আসলে কি হচ্ছে এটাই বুঝতে পারছিনা। তাই চুপচাপ তাকে অনুসরণ করছিলাম।

বেশ অনেকটা সময় তার পিছু পিছু হেটেই যাচ্ছি হেঁটেই যাচ্ছি আসলে কোথায় নিয়ে যেতে চাচ্ছে আমাকে তিনি। আমি এবার অধৈর্য হয়ে তাকে প্রশ্ন করলাম ,

--- সেই কখন থেকে শুধু হেঁটেই যাচ্ছি হেঁটেই যাচ্ছি আর কত দূর সাফওয়ান?আমরা আসলে  যাচ্ছিটা কোথায়?

কিন্তু প্রতিউত্তরে উনার সেই একই উত্তর:- গেলেই দেখতে পাবে। 

ধুর ভাল লাগে না এমনিতেই ভারী লেহেঙ্গা এটা উঁচু করে হাঁটতে বেশ সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে আমাকে। বেশ কিছুক্ষণ পর বুঝলাম মহাশয় এর পদযুগল থেমেছে। 

আমিও দাঁড়িয়ে পড়লাম। চোখ যেহেতু বাধা সেহেতু নাসা ইন্দ্রিয় বড্ড সজাগ হয়ে গেছে। নাকে খুব সুন্দর ফুলের মিষ্টি গন্ধ লাগছে। একটা ফুলের গন্ধ নয় অনেকগুলো ফুলের সুবাস মিশ্রিত হয়ে খুব সুন্দর একটা মিষ্টি গন্ধ।

সাফওয়ান আমার হাত জোড়া ছেড়ে দিলেন। আমি আঁকড়ে ধরতে চাইলেও ধরতে পারলাম না তার হাতটা। তার আগে আমার পাশ থেকে সরে গেলেন তিনি। আমি হাতড়ে তাকে আশেপাশে পেলাম না। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ একজোড়া হাত আমার কোমর জড়িয়ে ধরল। 

এমন হঠকারী ঘটনায় আমি হকচকিয়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি কোমরে জড়িয়ে রাখা হাতগুলো হাত দিয়ে ছড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়ে দেখলাম স্পর্শটা কেমন যেন খুব পরিচিত। সামনের মানুষটার মাথা আমার বুক বরাবর। তার মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে আমার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। আমি তার মুখটা নিজের দুই হাতের মধ্যে নিয়ে খুশিতে বলে উঠলাম ,

-- পুতুল সোনা!

তখনই পেছন থেকে কেউ আমার চোখের বাধন খুলে দিল। সামনে তাকিয়ে দেখলাম। আমার সামনের স্বয়ং পুতুল সোনা দাঁড়িয়ে আছে। সে আবার আমার মত লেহেঙ্গাও পড়েছে। মুখে লেপ্টে আছে এক চিলতে মিষ্টি হাসি।

 ওকে আমার নিজের সাথে জড়িয়ে ধরলাম। কেন জানিনা এই মেয়েটার সবকিছুই আমার ভালো লাগে।এর স্পর্শ এর সম্মধন সবকিছু।

পুতুলকে জড়িয়ে ধরে রাখা অবস্থায় সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আমার পুরো পরিবার দাঁড়িয়ে আছে। এখনো নির্দিষ্ট কোন পরিবার নেই। দুটো পরিবার মিলেমিশে এখন একটা পরিবার হয়ে গেছে। তাদের সবার মুখে লেপ্টে আছে তৃপ্তির হাসি। আর এই তৃপ্তিময় হাসির কারণ হতে পেরেছি এটাই আমার জন্য অনেক বড় ব্যাপার।

মানুষ এমনি এমনি একটা জিনিস পাওয়া আর কষ্ট করে অর্জন করার আনন্দের মধ্যে অনেক তফাৎ থাকে। যে আনন্দটা আজ আমি উপভোগ করছি। নিশ্চয়ই কষ্টের পরে অপরিসীম সুখ থাকে। যেমন রাতের আধার কাটিয়ে দিনের সূর্য উদয় হয় সমস্ত পৃথিবীকে আলোকিত করার জন্য তেমনি আমার জীবনের সমস্ত দুঃখ কষ্ট আজ মুছে গিয়ে সেই জায়গাটা আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে।

আজ ভালবাসার মানুষটার হাতটাও আজ আমার হাতের মুঠোয় আবার পুরো পরিবারের দোয়াও আছে আমার মাথার উপরে। আর কি চাই এটুকু জীবনের জন্য। না চাইতেও আল্লাহ দুহাত ভরে আমাকে দিয়েছেন। তার জন্য তাকে কোটি কোটি শুকরিয়া।

মনে মনে এই সকল কথা ভাবতে ভাবতেই চোখে অশ্রু কনা জমা হলো। হঠাৎ পুতুল হাত বাড়িয়ে আমার চোখের পানি মুছে দিল।

--- কেদোনা প্রীতিলতা। চলো তোমার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে। এসো।

আমার ডান হাতটা তার হাতের মুঠোয় নিল আরেক হাত দিয়ে সাফওয়ানের বাঁ হাতটা জড়িয়ে ধরল। লাল কার্পেট মোড়ানো রাস্তাটা দিয়েই হেঁটে আসতে লাগলাম আমরা তিনজন। সাফওয়ানের দিকে তাকাতে তিনি আমাকে একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিলেন। বিনিময়ে আমিও হাসলাম। প্রাণখোলা মিষ্টি হাসি।

ডাক্তার ভাইয়া গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যেখানেই সুযোগ পাচ্ছেন সেখানে ক্যামেরা তাক করে কিছু সুন্দর সুন্দর মুহূর্ত ক্যাপচার করে নিচ্ছেন। যেমন কিছুক্ষণ আগে আমি পুতুল আর সাফওয়ান যখন একসাথে হেটে আসছিলাম তখন বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নিয়েছেন তিনি।

পরিবারের কাছে এসে দাঁড়াতে মামনি এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন প্রথমে। তার চোখ জোড়াও আজ ছল ছল করছে। কৃতজ্ঞতা ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। কপালে চুমু দিয়ে এক হাতে জড়িয়ে ধরে আমাকে ভেতরে নিয়ে আসেন। পিছনে পিছনে সবাই আসলো।

ভেতরে ঢুকে বুঝতে পারলাম এটা একটা হোটেল। নিচের প্লেস টা খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে । বিভিন্ন রঙের ফুল লাইট দিয়ে পুরো সেন্টারটাকে সাজানো হয়েছে।

মামনি, আম্মু, বড় ভাবি আমাকে নিয়ে দোতালায় উঠতে গেলে সাফোয়ান বাধা দিয়ে বলে,

--- একটু ওয়েট করো তোমরা এখনো একটা কাজ বাকি আছে।

সকলে উৎসুক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল,

--- কী কাজ?

তখনই দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেন কাজী সাহেব। সাফওয়ান সেদিকে এগিয়ে এগিয়ে তাকে সোফায় বসার ব্যবস্থা করে দিয়ে বাবার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,

আব্বু আমি আবার প্রীতিকে বিয়ে করতে চাচ্ছি। সবার সামনে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই আমার যে প্রীতিকে যখন বিয়ে করেছিলাম তখন আমার এই বিয়েতে মত ছিল না। অনেকটা নিজের উপরে জোর খাটিয়ে করেছিলাম বিয়েটা। কিন্তু এখন ... তাই চিন্তা করলাম নতুন জীবনটা শুরু করার আগে সবার সম্মতি নিয়ে আমি আবার প্রীতিকে বিয়ে বাড়িতে তুলতে চাই।

দীর্ঘ কয়েক বছর পর ছোট ছেলের মুখে সেই আদর মাখা ডাক শুনে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়লেন সাখাওয়াত সাহেব। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। সাফওয়ানো বাবাকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরলেন। দীর্ঘদিনের মান অভিমানের পালা বুঝি এবার সমাপ্তি ঘটলো।

কান্না ভেজা কন্ঠে সাখাওয়াত সাহেব বললেন,

--- আমি মনে করেছিলাম তুমি হয়তো বিয়েটা সেড়ে এসেছো। তাই তোমাদের বরণ করার জন্য আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে বসে আছি আর বৌভাতের আয়োজন করেছি তবে ব্যাপার না পরিবারের সবাই এখানে উপস্থিত আছে। বিয়েটা এখনই হবে।

সাফওয়ান মুচকি হেসে বললেন,

--- আমাদের আম্মু আব্বু ছাড়া কিভাবে বিয়ে করতে পারি আমরা? বিয়ে তো শুধু মাত্র দুটি মানুষের মধ্যে হয় না, দুটো পরিবারের মধ্যে হয়।

কথাটা বলে আর চোখে আমার দিকে তাকানোর সাফওয়ান। আমি কৃতজ্ঞতা ভরা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে, এত সুন্দর একটা সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য।

বাবা মুচকি হেসে সাফয়ান এর পিঠ চাপড়ে চোখের পানি টুকু মুছে নিয়ে ছেলের হাত ধরে নিয়ে সোফায় বসিয়ে দিলেন। মামনি আর আম্মু আমাকে নিয়ে গিয়ে অপজিটের সোফায় বসিয়ে দিলেন। পুতুল সেই যে আমার হাত জোড়া আঁকড়ে ধরেছে এখনো ছাড়েনি। আমার পাশেই বসেছে সে।

আমার দুই বাবা কাজী সাহেবের দুই পাশে বসেছে। আমার ভাই প্রীতম বসেছে সাফোয়ানের পাশে।  ভাবি ফল মিষ্টি খেজুর আর শরবত সবকিছু এনে টেবিলের উপরে সাজিয়ে রাখলেন। কাজী সকল পেপার রেডি করে বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন।এমন সময় সায়েম ভাইয়া এসে বললেন,

--- এক এক মিনিট।

হঠাৎ এমন ভাবে থামিয়ে দেওয়ার সবাই সায়েম ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

--- কি হয়েছে সায়ে ম?

---  কেউ এসেছে তোমাদের সাথে দেখা করার জন্য।এই যে ট্যান ট্যানাআআআআ.... 

মেইন গেট দিয়ে প্রবেশ করলেন খালামনি। তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে সাইমা। সাইমাকে দেখে প্রথমে আমি কিছুটা অবাক হলাম। ভিতরে হালকা অস্থিরতা শুরু হয়ে গেল আমার। কিন্তু পরবর্তীতে সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে সেই অস্থিরতা কমলো। মানুষটা এখন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করলো যে সে আমার সাথে আছে।

খালামণিকে আসতে দেখে সবাই যেন অবাক হয়ে গেল তার থেকেও দ্বিগুণ অবাক হলো যখন দেখলো তার পেছনে সায়মা দাঁড়িয়ে আছে। খালাম্মা নিয়ে এসে সায়েমের পাশে দাঁড়ালেন।

 সায়েম চোখ দিয়ে ইশারা করলে খালামণি সাফওয়ানের পাশে গিয়ে বসলেন। সাফোয়ানকে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। তারপরে সবার উদ্দেশ্যে হাতজোড় করে মেয়ের হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিলেন। মামনি গিয়ে খালামনিকে জড়িয়ে ধরে বলল,

--- অতীতে যা হয়েছে সবকিছু ভুলে যা। তুই যে এসেছিস আমি খুব খুশি হয়েছি। দুই হাত ধরে ছেলে আর ছেলের বউকে দোয়া কর। তারা যেন ভবিষ্যতে খুব সুখী হয়।

অবশেষে পুরো পরিবারের উপস্থিতিতে দ্বিতীয়বারের মতো আবারো বিয়ের সম্পন্ন হল। কবুল বলার মুহূর্তে আমার গলা কাঁপছিল। মধ্যে একটা অন্যরকম অনুভূতি সৃষ্টি হচ্ছিল সেই প্রথম দিনের মত। গলা কাঁপছিল। তারপরে আম্মু আব্বুর দিকে তাকিয়ে আবার কবুল বলে আমার প্রিয় মানুষটিকে আপন করে নিলাম। আর সাফোয়ান..!

 সে তো আজ লজ্জা ভুলে গিয়ে গড়গড় করে কবুল বলে দিয়েছেন তিনবারের জায়গায় চারবার। তা নিয়ে আরো একবার হাসাহাসি হল পরিবারের মধ্যে। আর পুরো সময়টাকে ক্যাপচার করলেন।

 সায়েম ভাইয়া অবশেষে ফ্যামিলি ফটো তোলার জন্য স্ট্যান্ডে ক্যামেরা বাঁধিয়ে রেখে টাইমার সেট করে সবাই এসে বসে পড়লেন আমাদের পাশে। সায়মা প্রথমে ইতস্তত করছিল। পরে মামনি গিয়ে তাকে ট্রেনে পাশের সোফায় বসিয়ে দিলেন। ব্যাস একের পর এক বেশ কিছু পারিবারিক মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি হয়ে গেল।

______🌺🌺______

দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর কাজী সাহেব বিদায় নিলেন। সবাই যে যার কাজে লেগে পরলো। আমাকে  উপরের দোতলার একটি রুমে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য দিয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ পরে আবার পার্লারের মেয়েরা এসে বউ ভাতের জন্য সাজাবে আমাকে। পুতুল আমার কোমর জড়িয়ে ধরে বালিশে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে আর আমি বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছি। পুতুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।

এমন সময় দরজা ঠেলে রুমে প্রবেশ করলো সাইমা। আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নিল। আমি ওকে দেখে সোজা হয়ে বসলাম। বিছানার পাশে বসার জন্য ওকে জায়গা করে দিয়ে বসার জন্য অনুরোধ করলাম। ও কোন কথা না বলে সেখানে চুপচাপ বসে পড়ল। তারপর বেশ অনেকক্ষণ নিরবতা।

তাই আমি এবার মুখ খুললাম তাকে বললাম,

--- কেমন আছো সাইমা?

প্রতিউত্তরের ও আমার দিকে চাইল। তারপরে চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল ,

--- ভালো।

তারপর আমি আর কোন কথা খুঁজে পেলাম না চুপচাপ রইলাম অপেক্ষা করলাম সায়মা কি বলে তা শোনার জন্য। বেশ কিছুক্ষণ পর সে নিজে থেকেই বলে উঠলো

--- সরি ভাবি।

তার মুখে ভাবি ডাক শুনে আমি চমকে উঠলাম। আমি তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম,

--- সরি কিসের জন্য?

সে মাথা নিচু রত অবস্থায় উত্তর দিল,

---  তোমাকে মিথ্যা বলার জন্য। তুমি আমাকে মাফ করে দাও আমি অনেক বড় অন্যায় করেছি শুধু তোমার সাথে না। এই পুরো পরিবারের সাথে। অনেক বড় ভুল করেছি আমি। নিজের করা সেই ভুলের খেসারত এখনো আমি দিচ্ছি।

আর থ্যাঙ্ক ইউ আমার সম্মান বাঁচানোর জন্য। আমি জানি সেদিন ওই বদ্ধ রুমে আমি তোমার সাথে যেটা করেছি সেটা অনেক বড় অন্যায় ছিল ভুল ছিল কিন্তু তারপরেও তুমি কাউকে সেটা বলনি। তার জন্য আমি অনেক কৃতজ্ঞ তোমার কাছে। পারলে ছোট বোন মনে করে আমার এই অপরাধ ক্ষমা করে দিও।

[শেষ উক্তিটা সায়মা হাত জোড় করে বলল] আমি তার হাত জোড়া আঁকড়ে ধরে বললাম,

--- আমি কিছু মনে রাখিনি। অমন আচরণ তুমি কেন করেছিল সেটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু তুমি আসল নকলের পার্থক্যটা বুঝতে পারোনি।

সায়মা কান্নারত অবস্থায় বলল,

--- তার খেসারত তো এখন দিচ্ছি। আসলে সময় থাকতে মানুষের মূল্য বুঝতে হয়। আর ভালবাসলে একজনকেই বাসতে হয়। আমি আসলে সাফওয়ান ভাই কে ভালোইবাসিনি। যেটা বেসেছ তুমি। তাইতো তোমার ভালোবাসার জয় হয়ে গেল। অর্জন করেছ সেই মানুষটাকে। আর আমি কিনা তোমার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টায় ছিলাম।

আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম ,

--- থাক ভুলে যাওয়া পুরাতন সব কথা। জীবন কখনো কারো জন্য থেমে থাকে না। সে তার আপন গতিতে চলে। নিশ্চয়ই তোমার জন্য কোন উত্তর জীবনসঙ্গিনী অপেক্ষা করছে। শুধু সবুর কর। সবুরের ফল সুমিষ্ট হয়। 

আর বারবার এটা মনে করার কোন দরকার নেই যে আমি তোমার উপরে রেগে আছি। আমি তোমাকে অনেক আগেই মাফ করে দিয়েছি কারণ যে কারণে রাগটা করব তোমার উপরে, সেই কারণটা একান্ত আমার হয়ে গেছে।

_______🌺🌺______

রিসেপশন পার্টিটা লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে পুরো। চারিদিকে কত শত অচেনা মুখ। ভিতরে ভিতরে খুব নার্ভাস ফিল করছি আমি কিন্তু সাফওয়ান এক মুহূর্তের জন্য আমার হাত ছাড়েননি। খুব মিষ্টি হাসি দিয়ে সবার সাথে পরিচিত করে দিচ্ছে আমাকে।

কিছুটা দূরে তাকিয়ে দেখলাম আম্মু আব্বু  মামনি বাবা দাঁড়িয়ে একজন আরেকজনের সাথে কথা বলছে। আর প্রীতম পুতুলের হাত ধরে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভাইয়া ভাবি পুরোদমে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে অতিথি আপ্যায়নের জন্য। আর সায়েম ভাইয়া অনেকক্ষণ ধরে দেখছি একটা মেয়ের দিকে খুব মনোযোগ সহকারে তাকিয়ে আছে আবার সুযোগ বুঝে ফটো তুলছে। যাক তার পেছনে লাগার একটা টপিক পেয়ে গেছি।

খাওয়া-দাওয়া শেষ হওয়ার পর ক্যামেরাম্যান আসলো ফটো সেশন এর জন্য। আমার এবং সাফওয়ান এর কিছু কাপল পিক তোলা হলো। তারপরে পুরো পরিবারের সাথে কিছু সুখময় মুহূর্ত। পুতুল আর আমি একসাথেও বেশ কয়েকটা ছবি তুলেছি।

স্টেজের সোফা সেটের ওপরে বসে আছে আমি আর সাফওয়ান। কিছুক্ষণ পর রেপিং পেপারের মোড়ানো বড় একটা গিফট নিয়ে হাজির হলেন পুতুল আর প্রীতম। আমার আর সাফনের সামনে তুলে ধরে বলল,

--- এটা আমাদের দুজনের পক্ষ থেকে তোমাদের বিয়ের গিফট ।উফ ধরো ধরো অনেক ভারি।

আমি আর সাফোয়ান একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে হেসে গিফট টা হাতে নিয়ে আমি তাকে বললাম ,

--- বাব্বাহ এতো ভারী গিফট!কী আছে এতে পুতুল সোনা?

পুতুল কপাল চাপড়ে বলল,

--- উফ এই মেয়েটাকে নিয়ে যে আমি কি করি। তুমি তো কিছুই বোঝনা প্রীতিলতা। গিফট পেলে বুঝি কেউ প্রশ্ন করে কি আছে গিফটের ভিতরে? গিফট খুলে দেখতে হয় বোকা মেয়ে।

উপস্থিত সবাই পুতুলের এমন পাকা পাকা কথা শুনে হেসে দিল। আমি মুখটা ইনোসেন্ট বানিয়ে তাকে বললাম কি আর করা যাবে বল পুতুল সোনা তোমার প্রীতিলতা তো এমনই বোকা। ওর দ্বারা চালাক হওয়া হবে না। তার থেকে বরং গিফট টা খুলে দেখে আমার পুতুল সোনা আমার জন্য কি এনেছে।

রাপিং পেপারটা আস্তে আস্তে খুলে ফেললাম প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলাম ফটো ফ্রেমের মত কিছু একটা হবে। কিন্তু আমি তো খুলে অবাক ।বিভিন্ন সাইজের কয়েক টা ফটো ফ্রেমগুলো  সাজানো।

পুতুলকে কোলে নিয়ে বাসার বারান্দায় বসে ছবি তুলেছিলাম। তার বেশ কিছু মুহূর্ত প্রথম ফ্রেমের মধ্যে বন্দি আছে। 

দ্বিতীয় ফ্রেমে আমার আর সাফওয়ানের বিশেষ কিছু মুহূর্ত। ফটো ফ্রেমের একদম মাঝখানে বেশ বড় করে আটকানো আছে সেই ছবিটা যেটা দোলনায় বসে আমরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এছাড়া বিয়ের ছবি। কিন্তু আরও একটা ছবিতে চোখ আটকে গেল সেটা হচ্ছে সেদিনের ছবি সাফওয়ান বাড়ির ছাদে হাস্যজ্জল ভাবে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে উঁচু করে ধরেছিলেন আমাকে। এই ছবিটা কে তুলল?

আরেকটি ফ্রেমে পুরো পরিবারের সাথে কিছু আনন্দময় মুহূর্ত। উপহারটা সত্যি এক কথায় অসাধারণ হয়েছে। এত সুন্দর একটা গিফট ভেবে রেখেছে আমার জন্য আমার পুতুল সোনা। আনন্দে জড়িয়ে ধরলাম ওকে।

পুতুল আমার গালে টুক করে একটা চুমু দিয়ে বলল,

--- এরকম সব সময় হাসি খুশি থাকবে তুমি প্রীতিলতা। হাসিখুশিতেই তোমাকে সব থেকে বেশি সুন্দর লাগে।

আমি পুতুলের কপালে চুমু দিয়ে বললাম,

--- তুমি থাকতে প্রীতিলতা কে কখনো কোনো দুঃখ কষ্ট ছুঁতে পারবে না পুতুল সোনা। এভাবে সারা জীবন আমার পাশে থেকো। আমি সারা জীবনে এমন পুতুলের প্রীতিলতা হয়ে থাকতে চাই।

_______🌺🌺_______

ফুলে সাজানো বিছানার মাঝখানে বসে আছি আমি। কিছুক্ষণ আগে ভাবি আমাকে রুমে বসিয়ে দিয়ে গেছেন। বুকের মধ্যে কেমন যেন ধীরিম ধীরিম শব্দ হচ্ছে। গতকালের থেকেও বেশি নার্ভাস ফিল করছি আমি। গতবার বাসর ঘরে যখন বসেছিলাম সাফওয়ান তো সারারাত এ ঘরমুখ হননি।

কিন্তু এবারের ব্যাপারটা ভিন্ন। তাই আরো বেশি নার্ভাস ফিল করছি। রীতিমতো হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছে আমার। অন্য সময় সাফোয়ানের মুখের উপর অনেক কথাই বলেছি। যেগুলো ভাবতেও এখন লজ্জা লাগছে। কি জানি আজ কি বলে খ্যাপাবেন আমাকে।

এরমধ্যে দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করলেন সাফওয়ান। শেরওয়ানি ওর মাথায় পাগড়ি পরিহিত পুরুষটিকে আজ একটু বেশি সুন্দর লাগছে। এক নজর তাকিয়ে আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। নিজের শাড়িটা দুহাতে খামছে ধরলাম। তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগলেন আমার কাছে।

মুখটা আরো নিচে নামিয়ে নিলাম যার ফলে আমার থুতনি গিয়ে বুকের উপরে স্পর্শ করল। বেশ অনেকক্ষণ কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে আমি মুখ তুলে তাকালাম দেখলাম তিনি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আর নজর আমাকে নিবদ্ধ। আমি তাকাতেই তিনি শব্দ করে হেসে উঠলেন।

বিছানায় আমার পাশে বসে পাগড়ি টা খুলে খাটের পাশে বক্সের উপরে রেখে বললেন,

--- কি ম্যাডাম। এতদিনে এত সাহস দেখালেন। আজকে সব ফুস করে হাওয়া হয়ে গেল। আপনাকে কিন্তু এভাবে মানায় না। মিস ভয়ঙ্করীতে কিন্তু আপনাকে বেশি মানায়। ক্যারেক্টার চেঞ্জ করুন। নিজের ফর্মে ফেরত আসুন।

উফ এই আজাইরা বেটা রোমান্টিক মোমেন্টের বারোটা বাজিয়ে দিল। ঘোমটাটা মাথার উপর থেকে তুলে দিয়ে বললাম,

---ঠিকই আছে। আমি একটু বেশি ভেবে ফেলছিলাম। কিন্ত কুমড়া পটাশ তো কুমড়ো পটাশ ই । কোথায় দুই একটা ভালো কথা বলবে। তানা এসেই পেছনে লাগতে শুরু করে দিয়েছে।

বলে মুখটা ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পর সা ফোন উঠে দাঁড়িয়ে আমার মুখের সামনে হাত নাড়িয়ে বলল,

--- আপনার অভিযোগ শেষ হয়েছে ম্যাডাম। তাহলে আমার কিছু কথা আছে। তার আগে উঠে দাঁড়াও।

আমি তার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,

--- কেন?

সাফান অধৈর্য হয়ে বললেন,

--- বড্ড বেশি প্রশ্ন করো। বলছি উঠে দাঁড়াতে দাড়াও নারে বাবা।

বলে আমার হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দিলেন। এরপর আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলেন বাইরের দিকে। আমি বিরক্ত নিয়ে বললাম,

--- এ সকাল থেকে শুধু টানা হেঁচড়ার উপরেই আছি আমি। এখন আবার কোথায় টেনে নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?

সাফওয়ান আমার ঠোঁটের ওপরে এক আঙ্গুল দিয়ে বললেন,

--- আস্তে কথা বলো না রে বাবা। না হলে বাড়ির সবাই টের পেয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি পা চালাও ছাদে যাব।

কথাটা বলে নিজেই টেনে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো আমাকে। বেশ দ্রুত পায়ে ছাদের দরজায় এসে দাঁড়ালাম আমরা। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। কিছুক্ষণ পরপর বিদ্যুতের ঝলকানি দেখা যাচ্ছে। ঝিরঝির করে বাতাস বইছে।

আমি চারিদিকে নজর বুলিয়ে সাফওয়ানের দিকে তাকালাম। তিনি মুচকি হেসে আমার বা হাতটা ধরে ছাদের মাঝখানে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করালেন।

একি কি করছেন? আকাশের অবস্থা তো তেমন ভালো নয়। যেকোনো মুহূর্তে বৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে। এর মধ্যে ছাদে টেনে আনার মানে কি?

সাফওয়ান আমার দিকে কয়েক কদম এগিয়ে এসে বলল,

--- আমার ভালবাসাটা যেখান থেকেই শুরু হয়েছিল প্রীতিলতা। এখানে উদযাপন করবো না তা কিভাবে হয়।

আমি উৎসব দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার কথাগুলো শুনছি।

তিনি আবার বলতে শুরু করলেন,

--- এমন একটা বৃষ্টিমুখর রাতে আমি আমার প্রেয়সী কে ছাদের কার্নিশ বরাবর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম। যে তার দুঃখ বিলাসে ব্যস্ত ছিল। মনের মধ্যে একটা আলাদা অনুভূতির সঞ্চার হয়েছিল সেদিন। আর যি পরবর্তীতে ভালোবাসায় রূপ নিয়েছে।

সেদিন যখন আমার বুকের উপরে ঢলে পড়েছিলে কিছু মুহূর্ত যেন মনে হয়েছিল আমার হৃদপিণ্ড ছাড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এর আগে এমন অনুভূতি আমার হয়নি কখনো। তোমাকে নিয়ে উন্মাদের মত সিঁড়ি থেকে নেমেছিলাম আমি। আমার মস্তিষ্ক সেদিন আমার কথা শুনেনি। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলো সেদিন বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল আমার বিরুদ্ধে।

কেন জানি খুব করে চাইছিলাম একবার চোখ মেলে তাকাও আমার দিকে। তবে হয়তো এই অস্থিরতা কমবে আমার। তারপর যখন মাঝরাতে তোমার জ্ঞান ফিরলো। ইচ্ছে তো করছিল বুকের সাথে জড়িয়ে নেই। কিন্তু ওই যে আমার ইগো। সে অতটা এগোতে দেয়নি আমাকে। তাই ওভাবে ধরে তোমাকে শুধু পানি খাইয়ে ছিলাম। ওই রাত্রে তোমার জন্য যা যা করেছিলাম সবগুলোই মন থেকেই করা ছিল।

কথাগুলো বলতে বলতে কখন জানি ছাদের কার্নিশের পাশে চলে এসেছে আমরা দুজন। সবকিছু কেমন যেন একের পর এক মনে দৃশ্যপটে ভেসে উঠতে লাগলো। আমি ঘুরে রাতের শহর দেখতে লাগলাম। এর মধ্যে হঠাৎ ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি নামলো। আমি ঘুরে পিছনের দিকে যেতে গেলে ই সাফওয়ানের বুকের সাথে ধাক্কা লাগে সে আমাকে ওইভাবে সোজা করে দাঁড় করিয়ে রাখে। থুতনিটা কাঁধের উপরে রেখে বলেন,

--- এখান থেকেই আমাদের সম্পর্কের শুভ সূচনা হয়েছিল। আজ আবারো সেই বর্ষণমুখর মুহূর্ত। আমাদের জীবনের অতীতের সকল গ্লানি ধুয়ে মুছে আগামীর নব সূচনা করব আমরা।

আনন্দে আমার অশ্রু আর বৃষ্টির পানি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল । আমি তার বুকে মাথার পিছন থেকে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। বৃষ্টির কনা গুলো সত্যি আমার সকল মন খারাপে ধুয়ে মুছে সব করে দিচ্ছে। ভেতর থেকে কেমন যেন খুব হালকা অনুভব করছি আমি।

সাফও নেবার হঠাৎ হাত ধরে তার দিকে ঘুরিয়ে নিলেন। দুহাতে কোমর পিছিয়ে ধরে তার দিকে টেনে নিলেন। আমাদের মধ্যে এক ইঞ্চিও দূরত্ব নেই যেন। নাকে নাক ঘষে বেশ জোর গলায় বললেন,

            প্রীতিলতা তুমি পদ্য

         পাতা ঝিমঝিমানো গদ্য

           তোমার আমার সন্ধি,

             একি ছকেতে বন্দি।

কথাটা শেষ করেই আমার ঠোঁট জোড়া নিজের আয়ত্তে করে নিলেন।আমিও ভেসে গেলাম তার ভালবাসার অনন্ত মায়ায়। এভাবেই পূর্ণতা পেয়েছেন আমাদের ভালোবাসা।

সমাপ্ত🌺

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form