বিয়ের পর প্রথম যেদিন শ্বশুর বাড়িতে পা রাখি সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম এই নতুন জগৎটা আমার জন্য মোটেও সহজ হবে না। বাবার বাড়িটা দারিদ্র্যতায় পরিপূর্ণ থাকলেও সুখ শান্তি ছিল আকাশ ছোঁয়া। বাবা-মায়ের অতি আদরের সন্তান ছিলাম বলে অভাব শব্দটার সাথে তেমন পরিচিত ছিলাম না।
কিন্তু তাদের আদরও ভালোবাসা সুরক্ষা বলায় ভেঙে যখন এই আলিশান বাড়িতে পা দিলাম তখন বুঝেছিলাম এখানে রূপ-সৌন্দর্য ও অর্থ-আভিজাত্যের রাজত্ব চলে সুখ শান্তির পায়রাদের এখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ।
স্বামী নামক যে মানুষটার হাত ধরে এই রাজত্বের প্রবেশ করেছিলাম। ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে শুরু করি মানুষটা ঠিক অপরিচিতা গল্পের অনুপমের মতো "মাকাল ফল"।রূপ সৌন্দর্য ও শিক্ষায় আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর পাশ করেও তা ব্যবহারিক ক্ষেত্রে কোন কাজেই লাগাতে পারেননি তিনি।
স্বাধীনচেতা ও বাউন্ডুলে স্বভাবের কারণে পরিবারের কাছে তার অবস্থান কোথায় তা সে উপলব্ধি না করতে পারলেও আমি বুঝতে পেরেছিলাম তার অবস্থান।
সোজা বাংলায় তাদের এই বাউন্ডুলে স্বাধীনচেতা বড়লোকের বিগড়ে যাওয়া ছেলেটাকে একটু হাতের আয়ত্তে আনার জন্য আমাকে বলির পাঠা বানানো হয়েছে। কিন্তু আদৌ কি তা সম্ভব।
বিয়ের পরের দিন সকালে ফুপু শাশুড়ি তো বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলছিলেন রূপের জোড়েই নাকি আমি এ বাড়ির বউ হতে পেরেছি তা নাহলে আমার বাবার যে আর্থিক জোর আছে তা দিয়ে নাকি এ বাড়ির ত্রি সীমানায় আসার যোগ্যতা আমার ছিল না।
কথাগুলো শেষ করে ফুপু শাশুড়ি আভিজাত্যপূর্ণ একটা পরিতৃপ্তের হাসি হাসলেন। যার বিপরীতে কেউ উচ্চবাচ্য করলেন না। প্রমাণ করে দিলেন এখানে কেউই আমার আপন নয়। একান্ত আপন যিনি হয়েছেন তিনি এই সভার ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন।
মাথা নিচু করে শুধু কথাগুলো হজম করেছিলাম। কারণ গরিব মানুষদের অর্থের জোগান না থাকলেও আত্মসম্মান ও মর্যাদা বোধের জোর প্রবল। সম্মান রক্ষার্থে তারা নিজেদের জীবন বলিদান দিতেও পিছপা হয় না। কিন্তু যখন তারা এই জোর দেখাতে ব্যর্থ হয় তখন তারা মাথা নিচু করে অপমান হজম করতে শিখে যায়।যেমন আমিও শিখে গেছি।
এই বাড়ির প্রতিটা মানুষেরই আচার-আচরণ কেমন অদ্ভুত রকমের। মনে হয় সবাই যন্ত্রচালিত এক একটা যান্ত্রিক পুতুল। একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের পেছনে সবাই ছুটে বেড়াচ্ছে। না আছে কারোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক না আছে একে অপরের প্রতি সহমর্মিতা।
_______🌺🌺________
চোখের পলকে বিয়ের সপ্তাহটা ঘুরে গেল। এখনো পর্যন্ত ফেরানিতে বাবার বাড়িতে গেলাম না। একপ্রকার মনের অভিমান ও ক্ষোভ থেকেই যায়নি আমি। তাছাড়া যার সাথে জোট বেঁধে ফেরানিতে যেতে হয় তার সাথে মনের সম্পর্ক তো দূরের কথা চোখের সীমানাতেও তাকে বাঁধতে পারিনি এখনো।
দিনশেষে শুধু রাতের বেলাতেই তার সাথে আমার দেখা হয়। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এগিয়ে দেওয়া এই নিয়ে ই যা এক দুই কথা হয় মাত্র।
এখনো অব্দি উপলব্ধি করতে পারলাম না আমি কি তার অপছন্দ নাকি খুবই অপছন্দের তালিকায়। কারণ তার প্রতিক্রিয়া দেখে মোটেও মনে হয়নি তার পছন্দটা আমার সাথে যায়।
আমার সারাদিনটা কাটে বদ্ধ চার দেয়াল এর মাঝে। রান্নাঘরটা একছত্র শাশুড়ি মায়ের দখলে। আর তাকে সাহায্য করার জন্য রয়েছে দুজন গৃহ পরিচারিকা। আমার সারাদিনের কাজ বলতে নিজের এই ঘরটা গুছানো আর শ্বশুর মশাইকে সারাদিনের নিয়ম করে চার কাপ চা বানিয়ে খাওয়ানো।
হয়তো অনেকের মনে হতে পারে শাশুড়ি মা নিষেধ করলেই কেন রান্নাঘরের ছায়া মারানো যাবে না। কিন্তু উনার সাথে সাক্ষাৎ হলেই আমার কাজে বাধা দিয়ে প্রথমে জিজ্ঞাসা করেন উনার ছেলে কখন ফিরবেন, কোথায় আছেন , কি করছেন, যার একটার উত্তরও আমার কাছে নেই।
মুখের উপরে একনাগাড়ে না বোধক উত্তর দেওয়ার চেয়ে লুকিয়ে বেড়ানোই শ্রেয়। শাশুড়ি মা হয়তো মনে করেন বিয়ের পরের দিনই তার ছেলে শুধরে যাবেন।হিহি হিহি ব্যাপারটা সত্যি হাস্যকর তাই না।
আমার বিকালটা কাটে ছাদে, কিন্তু অন্যরকম ভাবে। এ সময়টা নিজেকে একজন মানুষ মনে হয় আমার । কারণ এই যান্ত্রিক মানবদের মাঝে একটা ছোট্ট ফুল বাস করে। তিনি আমার ছোট ননদ ক্লাস ফাইভে পড়ে।
সারাদিন স্কুল কোচিং শেষ করে বিকালের সময়টাতেই তার অবসর মেলে। তখন সে গুটিগুটি পায়ে আমার কাছে চলে আসে এবং আমরা ছাদে চলে আসি এই সময়টাকে উপভোগ করার জন্য।
আমার নাম শামসুন্নাহার প্রীতি। কিন্তু আমাকে ও প্রীতিলতা বলে ডাকে। আমিই ওকে ভাবি ডাকতে নিষেধ করেছি। তাই সে অনেক ভেবে চিন্তে এই নামটি বেছে নিয়েছে "প্রীতিলতা"। নামটা অনেক সুন্দর তাই না আমারও অনেক পছন্দ হয়েছে। আমি ওর একটা নাম দিয়েছি "পুতুল" কারণ ও দেখতে একদম পুতুলের মত।
আমি ওর সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়তে চেয়েছি ভাবি ননদের মধ্যকার ওই জটিল সম্পর্ক নয়।
_______🌺🌺________
শুক্রবার,
আজও বিকালে সবাইকে লুকিয়ে আমরা ছাদে চলে এসেছি। সবাই এখন যে যার রুমে। এই ফাঁকে ওই ছোট্ট দুটো পায়ের সাথে তাল মিলিয়ে আমিও গুটিগুটি পায়ে ছাদে চলে আসলাম।
আমার বিকালটা কাটে ওকে ঘিরে। মাঝে মাঝে ওর সাথে কানামাছি খেলে আবার মাঝে মাঝে ওর সারাদিনের গল্প শুনে। যখন আমার কোলে বসে আমার গলা জড়িয়ে ধরে ওর সারাদিনের গল্প বলে, তখন আমিও ওকে দুহাতে আলতো জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে ভাবি,
" এই বাড়িতে এই মেয়েটা না থাকলে হয়তো এত দিনে দম বন্ধ হয়ে এই কাল কুটুরিতে অপমৃত্যু হতো আমার।"
আজ সে আমাকে তার অনেক অভিমানের কথা বলল। এতদিন নাকি তার কথা শোনার লোক বাড়িতে ছিল না। ছোট মানুষ বলে তার কথার কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই।
আমি তার কথা শুনে তাকে জড়িয়ে ধরে হাসি, খুব হাসি।
কত পাকা পাকা কথা বলে মেয়েটা ।পাকা বুড়ি একটা।
কি সাংঘাতিক অভিযোগ !
এই পাকা বুড়ির কথা নাকি কেউ গুরুত্ব দেয় না। তার কথা শোনার কারোর সময় নেই।বলতে গেলে সত্যিই তাই
এতদিন আসলাম এই বাড়িতে এক জায়গায় বসে গল্প করা তো দূরের কথা খাওয়ার টেবিলেও পুরো পরিবারকে একসাথে পাওয়া যায় না। কত ব্যস্ততা এদের মাঝে , পরিবারকে সময় দেওয়ার মতো সময় নেই এদের কাছে।
ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। আমি এবং আমার ছোট ভাই সব সময় রাতের খাবারটা বাবার সাথে খেতাম। বাবার বাসায় আসতে অনেক দেরি হতো। আম্মু আমাদের কে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে বলতো কিন্তু সেই রাত জেগে আমরা বসে থাকতাম। কখন আব্বু আসবে। আমি আর আমার ভাই খেতে খেতে আমাদের সারাদিনের গল্পগুলো আব্বুর সামনে উগরে দেব। আর সেই গল্প শুনে আব্বু খিলখিল করে হাসতেন। আমারও বেশ আনন্দ হতো।
পুরনো স্মৃতি, ঘাটতে ঘাটতে চোখের কোণে অশ্রু বিন্দু জমা হলো। এখন সব স্মৃতি হয়ে গেছে। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে বাবা কী এখন বাড়ি ফিরে তার মেয়ের গল্প গুলো মিস করে...
বাবা তো সব সময় বলতো আমি তো তার রাজত্ব বিহীন রাজকন্যা। তাহলে হঠাৎ এমন বোঝা হয়ে গেলাম কেন? কেন আমাকে তারা এত তাড়াতাড়ি পর করে দিল।তারা এত ভুলে গেল কেন আমাকে?
আমি বুঝি বড়লোক বাড়ির সাথে আত্মীয়তা করেছে, সৌজন্য সাক্ষাতে অনেক কিছু উপহার সামগ্রী দিতে হয়। যার সামর্থ্য আমার বাবা-মার নাই তাই এখন মেয়েটা ও আর তাদের নাই।
হায়রে কন্যা ভাগ্য...!
কন্যার পিতা হওয়া সত্যিই বড্ড কঠিন কাজ। তার উপরে যদি পিতা গরিব হন তাহলে তো আর কথাই নেই...
পুতুলের ডাকে হুস ফিরল আমার।
--- কী হয়েছে প্রীতিলতা? তোমার ও কী আমার মতো চোখে পোকা ঢুকে গেছে। আমি ফু দিয়ে দেই।
চোখের অবশিষ্ট পানিটুকু মুছে ফেলে পুতুলের দিকে তাকিয়ে গাল ফুলিয়ে বললাম,
--- পোকা তো বেরিয়ে গেছে পুতুল সোনা। তাই তো চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। এই দেখো মুছে নিয়েছি আর পানি পড়বে না।
--- তাহলে ঠিক আছে।
আমি পুতুলকে জড়িয়ে ধরে প্রশ্ন করলাম,
--- আচ্ছা পুতুল সোনা তোমার ছোট ভাইয়া সারাদিন এমন বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায় কেন? তুমি কি একটু বকে টকে দিতে পারো না।
পুতুল কিঞ্চিৎ হতাশ হওয়ার মতো করে বলল,
--- ও তো কারোর কথা শুনে না প্রীতিলতা। সারাদিন বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ানো ওর কাজ। জানো ছোট ভাইয়া মাঝে মাঝে কি করতো?
--- কি করতো?
--- এক / দুই সপ্তাহ আবার মাঝে মাঝে এক মাস ও কোথায় জানি হারিয়ে যেত। আম্মুর ফোনেও পেত না ওকে। যখন বাড়িতে ফেরত আসতো, আর আম্মু ওকে বকতো তখন বলতো,
* ছোট ভাইয়াকে নাকি পাহাড়, সমুদ্র প্রতিনিয়ত হাতছানি দিয়ে ডাকে। সেই ডাকে সাড়া দিতে মাঝে মাঝে তাদের বুকে চলে যায়।*
--- হিহিহি কি পাগল পাগল কথা তাই না।
আমিও একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম ,
--- হুম।
জানো, প্রীতিলতা ভাইয়া যখন প্রত্যেকবার বেড়ানো শেষে বাড়ি আসতো তখন আমার জন্য অনেক কিছু আনতো। আগে ওই তো ছিল আমার গল্প করার বন্ধু। সারাদিন বলতে গেলে আমাদের দেখাই হতো না। কিন্তু রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর আমি ওর রুমে চলে যেতাম আর বসে বসে ভাইয়ার গল্প শুনতাম। অ্যাডভেঞ্চারের গল্প....!
এখন তুমি আমার গল্প বন্ধু। তোমার সাথে কত গল্প করি তুমি একটুও বিরক্ত হও না। একদম ছোট ভাইয়ের মতো।
আমি ওর কথা শুনছি আর মিটিমিটি হাসছি।
কথা শেষ করে হঠাৎ পুতুল ঘুরে আমার গলা জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
--- তোমাকে আজ একটা সিক্রেট কথা বলবো প্রীতিলতা। কাউকে বলবে না কিন্তু।
আমি ইশারায় চোখ দিয়ে তাকে আশ্বস্ত করলাম।
দেখে সে আমার দিকে আরেকটু এগিয়ে এসে আস্তে আস্তে বললো,
--- জানো প্রীতিলতা। ভাইয়া না তোমাকে বিয়ে করতে চাইনি। আম্মুর জন্য বাধ্য হয়ে তোমাকে বিয়ে করেছে।
২য় পর্ব🍂
দেখেছ কতটা কে*টে গেছে তোমার হাত , ইশ্ র*ক্ত ও পড়ছে তোমার হাত থেকে। তুমি নিজের একটুও খেয়াল রাখো না প্রীতিলতা।
গাল ফুলিয়ে অভিমানী ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে পুতুল তুলো দিয়ে আমার হাতের কেটে যাওয়ার অংশটুকু মুছে দিতে লাগলো।
আমি কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে আমার অশ্রু সিক্ত নয়নজোড়া অন্যদিকে ঘুরিয়ে বাঁ হাতের তালুতে চোখ মুছে তাকে বললাম,
--- তুমি আছো তো আমার খেয়াল রাখার জন্য। তাহলে মিছে সময় নষ্ট কেন করব।
ও তুলো দিয়ে হাত মুছতে মুছতে আমার দিকে আর চোখে তাকিয়ে "চ" এর মত উচ্চারণ করে বলল,
--- উফ ও প্রীতিলতা। আমি না থাকলে যে তোমার কি হত?
বলার ধরন দেখে আমার ভারি হাসি পেল। কিঞ্চিত হেসে উত্তর দিলাম,
--- কী আর হতো বলো, তুমি যদি এই বাড়িতে না থাকলে এতদিনে হয়তো ম'রে'ই যেতাম।
পুতুল নিজের কাজ বন্ধ করে কোমরে দুই হাত বাধিয়ে রাগান্বিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে এক আঙুল উঁচিয়ে বলে উঠলো,
--- এই তুমি পঁচা পঁচা কথা কেন বলছ প্রীতিলতা? তুমি ম*রে যাবে না। আমি সব সময় তোমার সাথে সাথে থাকবো তাহলে তো তুমি আর মরে যাবে না তাই না?
ওর হাত ধরে টেনে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে মুখে উত্তর দিলাম,
--- উহু তাহলে আর ম'রে যাব না।
*তোমার হাতে খুব ব্যথা করছে তাই না প্রীতিলতা? তখন আমায় অত জোরে কেন জড়িয়ে ধরতে গেলে তুমি?তাহলে কাঁচের চুড়ি গুলো আর ভেঙ্গে তোমার হাতের মধ্যে ঢুকে যেত না।
আমিতো শুধু সিক্রেট কথা বলছিলাম। ভুতের গল্প তো বলছিলাম না যে ওমনি ভাবে জড়িয়ে ধরতে হবে। আমার দম নিতেও কষ্ট হচ্ছিলো।বাবাহ্
তুমি হাতের যন্ত্রণার কথা বলছো পুতুল সোনা! কই সেখানের য*ন্ত্র*ণা তো আমি অনুভব করতে পারছি না। নাকি হাতের য'ন্ত্র'ণার তুলনায় বক্ষপিঞ্জরের য'ন্ত্র'ণা বেশি হয়ে গেল। তাই হয়তো অনুভব করতে পারছি না।
তুমি তো বোঝো না পুতুলসোনা মনের য/ন্ত্র/না কতটা ভ/য়/ঙ্ক/র। যে য/ন্ত্র/না কাউকে না দেখানো যায়, না কাউকে বলে বোঝানো যায়। এ তো শুধু একান্ত ভাবে নিজেকে অনুভব করতে হয়।যা প্রতিনিয়ত তার অদৃশ্য লেলিহান শিখা দিয়ে দ*গ্ধ করতে থাকে অন্তঃস্থকে।
আচ্ছা। তুমি একটু বসো আমি আসছি। একদম কোথাও যাবে না কিন্তু আমি এক্ষুনি আসছি প্রীতিলতা।
--- আবার কোথায় যাচ্ছ তুমি। হাতের ব্যথা এমনিতেই সেরে যাবে তুমি আমার এখানে এসে বসো যেও ন...
তার মধ্যে এক ছুটে চোখের আড়াল হয়ে গেল পুতুল।
_________🌺🌺_________
রাতে খাওয়ার টেবিলে সবাই একসাথে দেখে অনেকটাই অবাক হলাম আমি । এই বাড়িতে নয়টার মধ্যে রাতের খাবার খাওয়া হয় কিন্তু বড় ভাইয়া এবং ভাবী দুজনে ডাক্তার হওয়ার কারণে তাদের চেম্বার থেকে আসতে দেরি হয় যার ফলে তারা নিজেদের রুমেই ডিনার সেরে নেন।
আর সাফওয়ান তো অনেক রাত করে বাড়ি আসেন। অনেক সময় বাহিরে থেকেও খেয়ে আসেন আবার যখন না খেয়ে আসেন। নিচে ডাইনিং টেবিল থেকে খেয়ে আসেন। উঁকি দিয়ে দেখেছি শাশুড়ি মা বসে থেকে যত্ন করে তার ছেলেকে খাওয়ান। তাই আর খাওয়ার ব্যাপারে আমি আর তাদের মাঝে যাই না।
তবে আজ হয়তো বিশেষ কোনো কারণ আছে নাহলে এই অদ্ভুত গ্রহগুলোকে একই কক্ষপথে পাওয়া যেত না। আমার ভাবনার মাঝেই সাফওয়ান চেয়ার টেনে বসে পড়লেন।
টেবিলের উপরে তার জন্য বরাদ্দকৃত প্লেটটা সোজা করতে করতে আমার দিকে এক ঝলক তাকালেন তাতেই আমাদের দৃষ্টি বিনিময় হল কারণ আমি তার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। তিনি দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন।
সবাইকে পরিবেশন করা হলো। আমি মাকে হাতে হাতে সাহায্য করছিলাম। ভাবী বাহিরে থেকে আসায় তাদের সাথে ক্ষেত্রে বসে পড়ল। খাওয়ার সময় কথা বলা বাবা পছন্দ করেন না। তাই সবাই চুপচাপ খাবারে মনোনিবেশ করল।
খাওয়া দাওয়া শেষে বাবা বললেন,
--- আগামীকাল সকালের ট্রেনে আমি আর তোমাদের মা ঢাকায় যাচ্ছি। তিন দিন তোমাদের খালামণির বাসায় থাকবো। তারপর ওখান থেকেই আমরা ওমরা হজের জন্য ক্যাম্পের সাথে যোগ দেব।
সবাই একেবারে আকাশ থেকে পড়ল যেন। বড় ভাইয়া সাকলাইন বললেন,
--- বাবা তুমি তো আমাদের আগে জানাওনি যে তোমরা হজে যাচ্ছ।
পুতুলকে জানিয়েছি। সে তো তার প্রীতিলতাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। তাকে সাথে করে ঢাকায় তোমাদের খালামনির বাসায় রেখে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু সে বলল সে তার প্রীতিলতার কাছেই ভালো থাকবে। বলে বাবা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন।
তারপর আমার দিকে নরম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
--- মামনি, পুতুলের খেয়াল রেখো তুমি। খুব শিগগিরই ফিরে আসার চেষ্টা করব।
--- জ্বী বাবা।
তারপর বাবা আবার বড় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
---- তোমাদের সবাইকে তো আগে বলে রেখেছিলাম সাফওয়ানের বিয়ের পর আমি আর তোমাদের মা ওমরা হজের জন্য মক্কায় যাব। আমি যাওয়ার প্রসেসিং অনেক আগে থেকেই শুরু করেছিলাম গতকালকেই কনফার্ম হলাম।
তোমরা তো বাবা খুব ব্যস্ত মানুষ। এতসব ব্যাপার মাথায় রাখা সম্ভব না। আড় চোখে সাফওয়ান দিকে তাকিয়ে বললেন,
--- আর কেউ কেউ তো কোনো কিছু না করেই খুব ব্যস্ত মানুষ।
সাফওয়ান কিছুক্ষণ বাবার দিকে নিরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নিজের ফোনে কি করতে লাগলেন যেন।
তোমাকে বলেছিলাম প্রীতি মামনি কে নিয়ে তার বাবার বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে যাওনি কেন?
*সাফওয়ান নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলেন।
আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। বাবার বাড়ির কথা শুনে ভিতরের কষ্টগুলো কেমন যেন মাথা চারা দিয়ে উঠলো।
বাবা এবার একটু ধমকের স্বরে বলে উঠলেন,
--- আমি তোমার সাথে কথা বলছি সাফওয়ান।
এবার তিনি নম্র দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে শিতল কন্ঠে বললেন,
--- আমি তো সেই শুরু থেকে আপনার কথাই শুনে আসছি বাবা। আপনি বলুন আমি শুনছি বাবা।
ছেলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হতাশার শ্বাস ফেলে বাবা আবার বললেন,
--- তোমাকে বলেছিলাম প্রীতি মামনি কে নিয়ে তোমার শশুর বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে। তুমি গেলে না কেন? লজ্জায় রমজান ভাইয়ের ফোন রিসিভ করতে পারছি না আমি।
সাফওয়ান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
--- প্রীতি যদি যেতে চান, যেতে পারেন। কিন্তু আমি যাব না। আমার কাজ আছে।
উচ্চস্বরে ধমকে উঠলেন সাখাওয়াত সাহেব বললেন ,
--- কী রাজকার্য কর তুমি? সারাদিন থাকো তো বন্ধুদের সাথে আড্ডা নিয়ে নয়তো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে কোথাও হারিয়ে যাও। এইভাবে জীবন চলে নাকি?
সাকলাইন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সাফওয়ানের উদ্দেশ্যে বলল,
--- এখন বিয়ে করেছো তুমি। বিয়ের আগে যা করেছ করেছ। এবার চাকরি বাকরি খোজ এবং সংসারী হও। তোমার একটা ভবিষ্যৎ আছে। এখন থেকে চিন্তাভাবনা শুরু করো।
হ্যাঁ বাবার আদর্শ ছেলে তুমি। তার সমস্বরে ই তো কথা বলবে।
কখনো কি জানতে চেয়েছ আমি কি চাই। তোমাদের ইচ্ছা অনিচ্ছাটাকে সেই ছোটবেলা থেকেই আমার উপরে চাপিয়ে এসেছে তোমরা। জীবনের প্রতিটা স্তরে তোমাদের কথাই শেষ কথা। এমন কেন করো তোমরা আমার সাথে।
যা বলেছ তাই শুনেছি। হঠাৎ করে বিয়ে করতে বলেছ নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়েও বিয়ে করেছি আমি। আর কি চাও তোমরা আমার কাছে। এবার তো আমাকে একটু মুক্তি দাও।( হাত জোড় করে)
কথাগুলো একনাগাড়ে বলে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালেন না সাফওয়ান। দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে চলে গেলেন। ছেলের যাওয়ার পানে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সাখাওয়াত সাহেব। তারপর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন ,
--- ছোট ছেলেটাকে একদম মানুষ করতে পারলাম না।
কথাগুলো বলে আমার দিকে হতাশার দৃষ্টিতে এক ঝলক তাকিয়ে বাবা নিজের ঘরে চলে গেলেন। মাও তার পেছন পেছন ছুটলেন তাকে সামলানোর জন্য। সবাই যে যার রুমের দিকে চলে গেল।
বাকি রয়ে গেলাম শুধু আমি। পুরো ডাইনিং রুম জুড়ে পিন পতন নীরবতা। তবুও কানে বজ্র ধ্বনির মত বেজে চলেছে
*বিয়ে করতে বলেছ নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়েও বিয়ে করেছি আমি। আর কি চাও তোমরা আমার কাছে। এবার তো মুক্তি দাও আমায়।
________🌺🌺_______
রাতের আকাশে ধূসর মেঘের ঘনঘটা। সারা আকাশ জুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে তারা। দেখে মনে হচ্ছে যেন সূর্য সারা দিন পৃথিবীটাকে মে উনুনে গনগনে আঁচে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিঃশেষ করেছে অস্ত যাওয়ার পূর্বে সেই উনুনের আগুন চাপা ছাইটা সারা আকাশে ছড়িয়ে দিয়ে গেছে পৃথিবীটাকে নতুনভাবে সতেজ করে তোলার জন্য। শো শো করে বাতাস বইছে। ঝড়ের পূর্ব লক্ষণ।
আজ আকাশটার ও বুঝি আমার মত মন খারাপ করেছে। তাইতো আমার বুকের মত তার বুকে ও ঝড় বইছে। শুধু একটাই পার্থক্য আকাশ তার নিজের বুকের যন্ত্রণাটা চিৎকার করে পুরো ধরণীকে জানাতে পারবে কিন্তু আমি তা পারছি না নিজের বুকের যন্ত্রণাগুলো নিজের মধ্যেই পৃষ্ঠ করে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিতে হচ্ছে আমাকে। ইশ্ আমিও যদি তার মত চিৎকার করে একটু কাঁদতে পারতাম কতই না ভালো হতো।
ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালাম। দূরদূরান্ত পর্যন্ত কৃত্রিম আলোয় আলোকিত পুরো শহর। চাঁদের আলো এখন আর এই শহরের দরকার নেই।হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টির আবির্ভাব হলো পুরো শহর জুড়ে।
আকাশের দিকে তাকিয়ে আপন মনে বলতে শুরু করলাম,
আজ নিজের উপর নিজেরই প্রচন্ড করুণা হচ্ছে আমার। আজ সবাই আমাকে আমার নিজের অবস্থান আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কতটা বোঝা আমি তাদের জন্য। আচ্ছা এই বোঝাটা কি আমি ছোট থেকেই ছিলাম নাকি হঠাৎ করেই হয়ে গেলাম।
শ্লেষের হাসি হেসে নিজেকেই নিজে বলতে শুরু করলাম,
প্রথমে ছিলাম বাবার ঘাড়ের বোঝা। একটা সময় পর এসে তিনি আর বোঝা বইতে না পেরে। আরেকজনের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেন এই বোঝাকে। সেই আগুত্তক বোঝা বইতে না পেরে হুংকার দিচ্ছে মুক্তি পাওয়ার জন্য। আচ্ছা এই শহরের কোন এক কোণে কী এই বোঝার জায়গা হবে না। একটু কী জায়গা হবে না সবার দৃষ্টির অগোচরে চলে যাওয়ার জন্য।
শরীর ক্রমশ উষ্ণ হতে শুরু করলো আমার। চোখ জ্বালাপোড়া করছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে আমার। কেমন যেন জড়িয়ে যাচ্ছে কন্ঠনালী। তারপরে ও আজ নিজের ব্যর্থতা অপারগতাকে মুখে প্রকাশ করতে ইচ্ছা করছে।
কষ্ট হলেও যতদূর চোখ গেল জোর করে তাকিয়ে খুজলাম নাহ..! এ শহরে এই বোঝা টার কোন জায়গা হবে না। আবার বিদ্রুপের হাসি খেলে গেলো আমার ঠোঁট জুড়ে। আকাশের দিকে তাকিয়ে আপন মনে আবার বলতে লাগলাম,
--সৃষ্টি যখন তুমি করেছ তোমার ছায়া তলেই না হয় আমায় একটু জায়গা দাও। এ শহরে প্রীতিলতার কোন জায়গা নেই। কোথাও ন....
আর বলতে পারলাম না কন্ঠনালী রুদ্ধ হয়ে গেল। নিজের ভারসাম্য ছেড়ে দিলাম । হঠাৎ খুব জোরে আছড়ে পড়লাম কোথাও। বুঝতে পারলাম না কোথায় আছি। নিজের মধ্যেকার সর্বশক্তি দিয়ে জোর খাটিয়ে চোখ জোড়া মেললাম স্পষ্ট কিছুই দেখতে পেলাম না শুধু অস্পষ্ট একটা প্রতিবিম্ব। হাতড়ে ধরার চেষ্টা করলাম। কিন্তু না সত্যিই অস্পষ্ট।বিরবির করে বললাম,
প্রীতিলতা তুমি পদ্য
পাতা ঝিমঝিমানো গদ্য
তোমার আমার সন্ধি
না পাওয়া ছকে বন্দী।🍂
৩য় পর্ব🍂
পিপাসায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে আমার। গলাটা শুকিয়ে ধুদু মরুভূমি হয়ে গেছে যেন। তাই পানির সন্ধানে অনেক কষ্টে ভারী চোখের পাতা টা মেলে তাকালাম। শরীরের উপর দুই পার্টের কম্বল দেওয়া। শরীর টা কেমন যেন ম্যাজ ম্যাজ করছে।
দেখতে পেলাম মাথার ওপরে সিলিং ফ্যানটা ভন ভন শব্দ করে ঘুরছে। মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলাম জানালার পর্দা ফিনফিন করে উঠছে। বাহিরে তাকিয়ে সঠিক সময় অনুধাবন করতে পারলাম না এখন রাত নাকি ভোর।
শারীরিক ক্লান্তিতে আবার চোখ বুজে এলো আমার।শরীরে কোন জোর পাচ্ছি না আমি যে উঠে বসবো। শরীরটা এমন লাগছে কেন আমার?
হঠাৎ মস্তিষ্কের নিউরন গুলো সতর্ক করল আমাকে। গত রাতের ঘটনা গুলো এক এক করে মনের পর্দায় ভেসে উঠলো। আমি তো ছাদে ছিলাম এখানে এলাম কিভাবে। আর একটু কিছু মনে করার জন্য ব্রেনের উপরে প্রেসার দিতেই মাথাটা কেমন যন্ত্রণায় শির শির করে উঠলো।
ব্যথাটা সহ্য করতে না পেরে মুখ দিয়ে ব্যাথাতুর আওয়াজ বের হয়ে আসল। তৎক্ষণাৎ মাথার পেছনে কারোর হাতে স্পর্শ অনুভব করলাম কিঞ্চিত উঁচু করে ধরে আমার মুখের খুব নিকটে শীতল কন্ঠে একটা প্রশ্ন শুনলাম,
--- আপনার কি আবার শরীর খারাপ লাগছে? কি অসুবিধা লাগছে আমাকে বলুন?
কণ্ঠস্বরটায় কিছু একটা ছিল। যা আমার সারা শরীর জুড়ে শীতল একটা শিহরণ প্রবাহিত হল। হালকা কেঁপে উঠলাম আমি। চোখ মেলতে কষ্ট হলেও মনের মধ্যে আগুত্মক কে দেখার বাসনা প্রবাল ধারণ করল।
অল্প অল্প পলক ফেলে চোখ মেলে তাকালাম আমি। বেশি দূরে খুঁজতে হয়নি তাকে। নিজের মুখের উপরেই কিঞ্চিৎ দূরে একটা পুরুষয়ালী লম্বাটে অবয়ব ভেসে উঠলো।যার হালকা লালচে বর্ণ চোখ এবং ঠোঁট জোড়া শুষ্ক।
সম্পর্কের সে আমার স্বামী হলেও জীবনে প্রথমবার নিজেরা এত কাছে কোন পুরুষের উপস্থিতি আমাকে বড্ড অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিল। তারপরও বেহায়া চোখ জোড়া তার অবয়বে আটকে পড়েছিল। ঘনঘন কয়েকটা ঢোক দিলাম।
উনি হয়তো কোন কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। তাই মাথাটা আরেকটু উঁচু করে ধরে , সোজা করে বালিশের সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিলেন আমাকে। হাত বাড়িয়ে খাটের পাশের ল্যামশেড টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা তুলে আমার মুখের সামনে ধরে বললেন,
-- খাইয়ে দিতে হবে নাকি আপনি নিজে পারবেন?
এতক্ষণ আহাম্মকের মত তাকিয়ে থেকে তার কর্মকাণ্ডগুলো দেখছিলাম। আমার দুটো জিনিস মনে হচ্ছে। এক আমি স্বপ্ন দেখছি, নতুবা আপন মনে কল্পনা করছি। আসলে ব্যাপারটা কি?
--- কী হলো পারবেন?
আবার সেই কণ্ঠস্বর ...! নিজের লোপ পাওয়া বোধশক্তি ফেরত এসেছে, কিন্তু মুখ দিয়ে কোন আওয়াজে বের করতে পারলাম না শুধু কাঁপা কাঁপা হাতে পানির গ্লাসটা ধরলাম। খেতে গিয়ে বেশ খানিকটা পানি নিজের গায়ে এবং কম্বলের উপর ফেললাম। চ্যাহ...!কী করলাম এটা।
অপরাধীর দৃষ্টিতে সাফওয়ানের দিকে তাকালাম। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর পানি গ্লাসটা আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ধীরে ধীরে খাইয়ে দিলেন আমাকে।
একটা মানুষের এমন আকস্মিক পরিবর্তন এবং তার লালচে চোখ জোড়া দেখে ভয় আমার পেটের ভেতরের কেমন যেন গরগর করতে লাগলো। ওয়াশরুমে যাওয়া প্রয়োজন।
পানির গ্লাসটা পাশের টেবিলে রেখে আমার দিকে চোখ দিয়ে ইশারা করে বলল,
--- কি হয়েছে?
ভাঙ্গা গলায় অনেক কষ্টে উত্তর দিলাম,
--- ওয়াশরুমে যাব।
--- আসুন।
বলে হাত ধরেও আমাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলেন। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে বুঝতে পারলাম শরীরটা অনেক দুর্বল হয়ে গেছে। মাথার মন থেকেও কেমন চক্কর দিয়ে উঠলো।
সাফওয়ানের হাত ধরেই ওয়াশরুম পর্যন্ত গেলাম। তিনি আমাকে ওয়াশরুমের দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে রুম থেকে একটা টুল এনে দিলেন। এবং সেখানে বসেই ফ্রেশ হতে বললেন আর কোন দরকার পড়লে তাকে ডাক দিতে বললেন। তিনি বাহিরে আছেন।
আমি মাথা নাড়িয়ে সায় জানালাম। কিন্তু তার কোন কথাই আমার বোধগম্য হলো না।
কথাগুলো বলে ওয়াশরুমের দরজা চাপিয়ে তিনি বাহিরে চলে গেলেন।
আমি বেশিন ধরে টুলের উপরে বসলাম। আমি বুঝতে পারছি না আমি কি জেগে আছি নাকি এখনো ঘুমিয়ে আছি। মনে তো হচ্ছে নির্ঘাত ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি। কারণ এখন তো রাত দিবার স্বপ্ন দেখা তো সম্ভব নয়। কয়টা বাজে তাও বুঝতে পারছি না।ধ্যাত...!
বেশি করে মুখে পানি দে প্রীতি আর নিজের ঘুম ভাঙ্গা না হলে কয়দিন পরে পাগলা গারদেই তোর ঘুম ভাঙবে।
________🌺🌺________
আবোল তাবোল চিন্তা শেষে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। পরনে কলাপাতা রং এর থ্রি পিস।ফ্রেশ হতে গিয়ে ব্যাপারটা লক্ষ্য করলাম। আমার পোশাক কে চেঞ্জ করল...!
বাহিরে বের হয়ে এসে দেখি সেন্টার টেবিলে খাবারের প্লেট রাখছেন সাফওয়ান। আমি বেরোতে আমার দিকে এক ঝলক তাকালেন। তারপর গ্লাসে পানি ঢেলে দিয়ে বললেন,
---- দ্রুত খেয়ে নিন। খাওয়ার পরে আপনার একটা মেডিসিন আছে।
নাহ আমি তো ঘুমিয়ে নেই আর স্বপ্নও দেখছি না। নির্ঘাত এই ব্যাটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
আমাকে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে সাফওয়ান প্রশ্ন করলেন,
--- কি ব্যাপার এখন তো আপনাকে দেখে সুস্থ মনে হচ্ছে, তারপরও এখন কি আবার ভাত মাখিয়ে আপনাকে খাইয়ে দিতে হবে?
মুখে বিড়বিড় করে বললাম,
--- না থাক। এত সৌভাগ্য আমার হয়নি। এমনিতেই যা চমক দেখালেন তাতেই থমকে গেছি। আর দরকার নেই বাবা।
চুপচাপ গিয়ে সোফায় বসলাম। খাবারে হাত দিয়ে বুঝলাম খাবার গরম। ভেতরের কৌতূহল আর দমন করতে না পেরে প্রশ্ন করেই বসলাম,
--- কয়টা বাজে?
স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিলেন,
--- ভোর চারটা।
আমি চমকে উঠলাম। তারপর বললাম,
---- খালা এখনো জেগে আছেন?
ভুল কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
--- কেনো?
--- মানে খাবারটা গরম দেখছি, তাই আর কী
আমার কথার বিপরীতে তিনি একটা হতাশাজনক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
--- না খালা এখন জেগে নেই। তিনি অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। কেন আমাকে কি আপনার চোখে পড়ছে না নাকি আমাকে মনুষত্বহীন মনে হয় আপনার? কোনটা?
বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে চলে গেলাম।
--- হ্যাঁ মানে। আপনি খাবার না মানে আপনি আমার জন্য খাবার গরম করে নিয়ে এসেছেন?
--- খাবারটা ঠান্ডা হওয়ার আগে খেয়ে নিন।
আমিও আর কথা বাড়ালাম না চুপচাপ খাবার মনোযোগ দিলাম। খাওয়া শেষে ওষুধের পাতা থেকে তিনটে ট্যাবলেট আমার দিকে এগিয়ে দিলেন তিনি। আমি ওষুধের সাইজ দেখে ওনাকে প্রশ্ন করলাম । এর থেকে ছোট ওষুধ আর নাই বাজারে।
তিনি আমার দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে টিটকারী করে বললেন,
--- কি আর করা যাবে বলুন। না আমার আর না আপনার কারোর বাপেরই দুর্ভাগ্যবশত ঔষধ তৈরির কারখানা নেই যে তারা আপনার জন্য আপনার পছন্দসই আকার আকৃতি দিয়ে ওষুধ তৈরি করবে।
--- নাহ। ঠিক আছে।
--- কী?
--- কিছু না।
এরপর আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ ওষুধ খেয়ে নিলাম। মুখ থেকে পানির গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রেখে সাফওয়ানকে প্রশ্ন করলাম,
--- আচ্ছা আপনি আমাকে এত ওষুধ খাওয়ালেন কেন? কি হয়েছিল আমার?
স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিলেন,
--- ভুতে ধরেছিল।
--- কীহ..!
--- সঠিকভাবে বলতে পারছি না, জিন ও হতে পারে। না হলে রাত বারোটার সময় কোন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ এমনভাবে ছাঁদে দাড়িয়ে তো আর বৃষ্টিতে ভিজতে পারেনা তাই না...!
* তা আপনার এই জিন ভূতের সমস্যা কী ছোটবেলা থেকে নাকি হঠাৎ করেই উদয় হল।তার উপর আবার জ্বরের ঘোরে উদ্ভট বকবক করারও রোগ আছে আপনার।
আমার মনে পড়ল আমি তখন ছাদে থাকলেও একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু কি করেছি আর কি বলেছি তার কিছুই আমার মনে নেই।
তার উপর ছোটবেলা থেকেই বৃষ্টিতে ভিজলেই আমার জ্বর আসবে কনফার্ম আর জ্বরের ঘোরে উদ্ভট কথা বলি এটাও সত্যি।
তাই আমি মুখটা কাচুমাচু করে অতি বিনয়ের সাথে নিজের ভুল স্বীকার করে বললাম,
--- সরি। আসলে ত...
আমাকে থামিয়ে দিয়ে কটমট চোখে আমার দিকে তাকিয়ে সাফওয়ান বললেন,
--- আপনার সরি, আপনার কাছেই রাখুন। ওই সরি আমার কোন কাজে আসবে না। জানেন আপনার এই উদ্ভট কাজের জন্য আমার বাবা আমাকে কি...
কথা বলতে বলতে থেমে গেলেন সাফোয়ান।
--- কি হলো বলুন বাবা আপনাকে কি?
--- না । কিছু না।
চুপচাপ শুয়ে পড়ুন আর আমাকেও একটু ঘুমাতে দিন। সারারাত কত সুন্দর হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন পুরো বিছানা জুড়ে আর আমাকে আপনার চৌকিদারির দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে সারা রাত। এবার দয়া করে আমাকে একটু ঘুমাতে দিন।
যতসব উদ্ভট ঝামেলায় এসে জোটে আমার কপালে।
লাস্টের কথাটা বির বির করে বলে বালিশ নিয়ে খাটের ওপর পাশে শুয়ে পড়লেন। আমিও গায়ে কম্বল টেনে শুয়ে পড়লাম।
হঠাৎ গত রাতের কথাগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠতেই মুখ ফুটে তাকে প্রশ্ন করেই ফেললাম,
আচ্ছা আপনি কি কাউকে পছন্দ করেন?
বালিশে মুখ গুজে শুয়ে ছিলেন তিনি। আমার প্রশ্ন শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে ভুরু কুঁচকে তাকালেন তিনি।
আমি শুকনো কয়টা ঢোক গিলে বললাম প্লিজ আমি যে প্রশ্নটা করেছি তার সঠিক উত্তর দেবেন। আপনাকে আর বিরক্ত করবো না।প্রমিস।
সাফওয়ান গম্ভীর গলায় বললেন,
--- না আমি কাউকে পছন্দ করি না।
বুকের উপর থেকে যেন বড় একটা পাথর নেমে গেল আমার।তার পরেও না চাইতেই কৌতূহলবশত মুখ থেকে প্রশ্ন বেরিয়ে গেলো
--- তাহলে আমাকে অপছন্দ করার কারণ কি?
আমার প্রশ্ন তার কানে যাওয়ার কিয়ৎক্ষণ পরে পাশ ফিরে হঠাৎ আমার উপর চড়াও হলেন তিনি। আমাকে বিছানার সাথে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিসিয়ে বললেন,
--- কারণ তুমি আমার বাবার পছন্দ....!
৪র্থ পর্ব🍂
আকাশের নিকষ অন্ধকার কাটিয়ে ঊষার আবির্ভাব ঘটেছে কিছুক্ষণ আগে। মুহূর্তের মধ্যে তার উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত করে ফেলল পুরো পৃথিবীটাকে।
আজ সকালটা আমার অন্যরকম ভাবে শুরু হল যেন। ফজরের নামাজ পড়ার পর হঠাৎ মনে পড়ল যে বাবা-মা সকাল ন'টার ট্রেনে ঢাকায় চলে যাবেন। তাই আর এক মুহূর্ত দেরি না করে রান্নাঘরের দিকে ছুটলাম।
গিয়ে দেখলাম রহিমা খালা এখন রান্নাঘরে আসেননি। অন্য দিনগুলোতে দেখেছি খালা আগে এসে সব কিছু কেটেকুটে গুছিয়ে রাখে আর মা দাঁড়িয়ে শুধু রান্না করে।
আমি কেটেকুটে সব কিছু গুছিয়ে রান্না করব। সালোয়ার কামিজের ওড়নাটা কোমরে ভালো করে বেঁধে নিয়ে নেমে পড়লাম কাজে। প্রথমে ফ্রিজ থেকে মাছ আর মাংস বের করলাম।
সেগুলোকে পানিতে ভেজাতে দিয়ে চপিং বোর্ডে পেঁয়াজ, আদা রসুন এর খোসা গুলো সব ছাড়ানো হয়ে গ্্ পানি দিয়ে ধুচ্ছিলাম এমন সময় পেছন থেকে কেউ বলে উঠলো,
--- নতুন বউ । তুমি এহন পাক ঘরে কি করতাছো?
পেছনে রহিমা খালার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললাম,
--- খালা আজ আমি রান্না করবো। মা বাবা তো আজ ঢাকায় চলে যাবে অন্যদিন তো মা ই রান্না করে খাওয়ায় আমাদের। আজ না হয় আমি তাদেরকে একটু রান্না করে খাওয়ালাম।
--- হায় আল্লাহ..!এই পাগলি মাইয়া বলে কি হুনছো নি..! তা তুমি আমারে ডাকবা না। আমি এসে তোমার হাতে হাতে কইরা দিলে তাড়াতাড়ি হইয়া যাইবো। দেখি সরো। আমি ঝাল পিয়াজ আদা রসুন কুচায় দিতাছি।
কথাগুলো বলে আমার হাত থেকে ডালাটা নিয়ে বটি পেতে কাটতে বসলেন। আমি আর কথা বাড়ালাম না । চাল ধুয়ে পানি ঝরাতে দিলাম।
রহিমা খালা হঠাৎ পেঁয়াজ রসুন কাটতে কাটতে বললেন
---তা নতুন বউ তোমার শরীর এখন ভালা আছে? কাল রাতে কেমনে অসুস্থ হইয়া পরলা।অমন কইরা কেউ রাত্তির বেলায় বৃষ্টিতে ভেজে? কতখানি জ্বর উঠছিল তুমি তো জানো না। তুমি তো বেহুশের লাগান বিছনায় পইড়া ছিল।
আমি হাতে কাজ করতে করতে পেছনে ঘুরে উত্তর দিলাম,
--- এখন ভালো আছি খালা। শরীরে একটুও জ্বর নাই।
খালা সহাস্যে বললেন,
--- ভালো না হইয়া যাবা কই। আমার ছোট বাজান তোমারে যেমনে যত্ন করছে সুস্থ না হইয়া যাইবা কি? কিন্তু তোমার বোকামির দন্ড হিসাবে বড় সাহেবের কাছ থেকে অনেক কথা হুনছে আমার ছোট বাজান। তুমি এটা মোটেও ঠিক করোনি বউ। এমন কাজ আর কোনদিন করবা না।
আমি হাতে মাছ ধুচ্ছিলাম আর খালার কথা শুনছিলাম। হঠাৎ মনে পড়লো কাল রাতে সাফওয়ান বলতে বলতে থেমে গিয়েছিলেন ,
তুমি জানো তোমার জন্য বাবা আমাকে....
ইশ্ মানুষটাকে আমার জন্য না জানি কত কথা শুনতে হয়েছে?
--- না চাচী আর এমন কাজ কোনদিন করবো না।
--- এইতো ভালো ম্যাইয়ার লাগান কথা। কাটাকুটি হইয়া গেছে আদা রসুন কি বেটে ফেলাবো।
--- জ্বী। আচ্ছা চাচী তোমার ছোট বাবার প্রিয় খাবার কি?
ও মোর খোদা। এ মাইয়া বলে কি? বিয়া হইছে ১০-১২ দিন হইয়া গেল এখনো তোমার বরের প্রিয় খাবার তুমি জানো না?
ইতস্তত করে বললাম,
আসলে চাচির রান্নাঘরে তো মা তেমন ঢুকতে দেয় না। তারপর তোমার ছোট বাবাকে আমি খুব ভয় পাই। তাই আর কি...
আচ্ছা আচ্ছা আমি বলে দিচ্ছি। আমার ছোট বাজান পোলাও, গরুর মাংস ভুনা, সরষে ইলিশ খুব পছন্দ করে। আর গাজরের হালুয়া তার মেলা প্রিয়। বড় বাজানের ও এসব খাবার অনেক প্রিয়। এগুলো হইল দুই ভাইয়ের আর কিছু লাগে না। হে হে হে।
আচ্ছা খালা আপনি গাজর গুলো কুচিয়ে দিতে পারবেন গ্রেটার মেশিনে। আজকে গাজরের হালুয়া বানাবো আর সাথে এগুলো থাকবে।
--- আইচ্ছা। যা বলবা এই বান্দা তা কইরা দেবে।
--- আচ্ছা তাহলে আমরা কাজে লেগে পড়ি।
--- হ।
কথা বলা শেষ করে প্রয়োজনীয় কাজ করা শুরু করলাম কারন হাতে বেশি সময় নেই। আটটার মধ্যে খাওয়ার রেডি করতে হবে।
খালা গাজর কুচাতে কুছাতে বললেন,
--- বুঝলা নতুন বউ। বড় বউটা কোনদিন এরকম রান্নাঘরে আইসা, মুখ ফুইটা বলল না খালা আজ আমি রাধুম। এত ছুটির দিন যায়। একটা দিন রান্নাঘরের ধারের কাছে সে আহেনা।
খালা সে হলো ডাক্তার। সারাদিন কত রকম কাজে ব্যস্ত থাকে তারপরে কি আর শরীরে এনার্জি থাকে কাজ করার।
তারপর ও মানুষ নিজের স্বামীর জন্য তো পছন্দমত কিছু একটু রান্না করে। বড় বউ তো তাও করে না।
হাহ্ বড় বাজান হয়তো জানেনা তার বউয়ের হাতের রান্না কেমন?
________🌺🌺_______
ঘড়িতে সকাল ৬.:৩০ বাজে,
গরুর মাংস রান্না প্রায় শেষ। এখন রহিমা খালা ইলিশ মাছগুলো হালকা করে ভেজে তুলে রাখছিলেন ,আর আমি সরিষা বেটে নিচ্ছিলাম। সরিষা ইলিশের জন্য।
রান্নাঘরে হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে আসলেন মা।
--- ইশ্ কত দেরি হয়ে গেছে। রহিমা তুমি আমাকে ডাকো নি কেন? দেখতো আমি কখন এতো রান্নাবান্না ক....
দুই চুলার উপরে রান্না বসানো দেখে শায়লা বেগম তাজ্জব বনে গেলেন।
একি..! অসুস্থ শরীর নিয়ে রান্নাঘরে কেন এসেছ?
মায়ের কথা শুনে পেছনে ঘুরে মায়ের দিকে তাকালাম। খালা আমার দিকে তাকিয়ে মাছ ভাজার চুলাটা অফ করে মায়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
আবার নতুন বউয়ের জ্বর সেরে গেছে। আপনারা ঢাকায় যাবেন বলে আজ নতুন বউ নিজের হাতে রান্না বান্না করতেছে। আমি এসে দেখি নতুন বউ রান্নাবাড়া শুরু করে দিছে।আমি আপনারে আর কি ডাকুম?
মাংস রান্না শেষ। সরষে বাটা দিয়ে ইলিশ মাছ রান্না হবে এখন তারপর পোলাও আর গাজরের হালুয়া। একদম শেষের গরম গরম রান্না করে টেবিলে দেওয়া হবে। সব নতুন বউ নিজের হাতে রান্না করতেছে। তাই আপনাকে আর ডাকা হয়নি।
মা নিরব অদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে। এই চোখ জোড়া আর সাফওয়ানের চোখ জোড়া যেন একই রং তুলিতে আঁকা হয়েছে। তার মত মায়ের চোখের ভাষা বুঝতে বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে আমার। বুঝতে পারলাম না তিনি কি রাগ করেছেন নাকি খুশি হয়েছেন। আমি সৌজন্যমূলক হাসি হেসে কাজে লেগে পড়লাম।
আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে মাংসের কড়াইয়ের ঢাকনা তুলে দেখলেন তিনি। পাশের ডেক্সের থেকে ভাজা গরম মসলার গুঁড়ার পাত্র থেকে নিয়ে মসলা নিয়ে মাংসের উপরে ছিটিয়ে দিয়ে গ্যাসের চুলা অফ করে দিলেন। মাংসের কড়াই টা অন্যত্র সরিয়ে রাখলেন।
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে নরম কন্ঠে বললেন,
--- আরো দুটো আইটেম রান্না করতে হবে। মুরগির রোস্ট আর ফুলকপি গাজর দিয়ে একটা সবজি। বাসায় গেস্ট আসবে। তুমি সরিষা ইলিশটা রান্না করে ফেলো। তারপরে আইটেম দুটো রান্না করবো আমি।
আর রহিমা তুমি পেঁয়াজ আদা রসুন এগুলো বেটে ফেলো আর করে কিছু পেঁয়াজ কুচি করে রাখো বেরেস্তা তৈরির জন্য। দ্রুত হাত চালাও রহিমা।
--- জে আপা।
বলে রহিমা নিজের কাজে লেগে পড়লো।
আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে ইতস্ত করে বললাম,
--- মা।ওই দুটো আইটেম আমি রান্না করতে পারব। ইলিশ রান্না করতে তো বেশি সময় লাগবে না। এক্ষুনি হয়ে যাবে। আমি রোস্ট রান্না, আর
মা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
--- সবাই মিলে একসাথে করলে তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। তুমি দ্রুত সরিষা ইলিশটা বসিয়ে দাও চুলায়। রোস্টের চিকেন কাটাই আছে। তুমি মসলা ম্যারিনেট করবে তাতে।
--- আচ্ছা মা।
আমি রান্নার কাজে লেগে পড়লাম। মা ফুলকপি আর গাজর কাটতে কাটতে বললেন,
--- বিয়ের আগে কি রান্না শিখেছো নাকি আগে থেকেই করতে?
--- হাতে কলমে শিখিনি মা। আম্মু রান্না করতো আর আমি পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম। এইটুকুই দেখে দেখে শিখেছি।
--- ওহ
মুখে ছোট করে ওহ্ বললেও শায়লা বেগম এর মুখে ফুটে উঠলো তৃপ্তির হাসি। ছেলের জন্য বৌমা নির্বাচন করতে তিনি ভুল করেননি। এবার ছেলেটার মানে মানে শুধরে গেলেই হয় তার।
_________🌺🌺_________
ঘড়িতে তখন সাড়ে সাতটার একটু বেশি বাজে।
সব রান্না প্রায় শেষের দিকে। শাশুড়ি মা গিয়েছিলেন গোসল করতে গোসল করে রেডি হয়ে রান্নাঘরে এসে জোরে সরে একটা হুকুম চালিয়ে বললেন,
--- পোলাও আর হালুয়া তো প্রায় শেষের দিকে এবার যাও তুমি গোসল করে শাড়ি পড়ে আসো। আর সাফওয়ান কেউ বল দ্রুত রেডি হয়ে যেন নিচে নামে।
এত সকালে গোসল করতে হবে শুনে মুখটা কাচুমাচু করে বললাম,
--- এত সকালে গোসল করব।
শাশুড়ি মা পাল্টা উত্তর বললেন,
--- সারারাত জ্বরে ভুগেছো এখন যদি গোসল না করো শরীর আরো খারাপ হয়ে যাবে। বাথরুমে গিজার আছে । উষ্ণ গরম পানি দিয়ে গোসল করে আসে শরীর ভালো লাগবে।
কথাগুলো কাট কাট গলায় বললেও কথা গুলোর মধ্যে যে কতটা মায়া আর ভালোবাসা ছিল তা আমি বুঝতে পেরেছিলাম।
খুব বুঝতে পারলাম যে মা আর ছেলে একই ধাঁচের। উপর উপর কঠোরতা দেখালেও ভিতরে ভিতরে কোমলতা বিদ্যমান। বাহ গত ১২ দিনে যে ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি এক রাতের ব্যবধানে তা অনেক খানি বুঝে ফেললাম।
তাই আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত চলে আসলাম।
উপরে উঠেই বাবা মায়ের পাশের রুমটা হচ্ছে পুতুলের। দরজা খুলে উঁকি মেরে দেখলাম ম্যাডাম বিছানায় ঘাপটি মেরে শুয়ে আছে। পা টিপে টিপে ওর কাছে গিয়ে দেখলাম না এ জেগেই আছে। কাঁথার উপর দিয়ে ওকে চেপে ধরলাম,
--- কিরে দুষ্ট বুড়ি আমার সাথে মশকরা করা হচ্ছে।
পুতুল খিল খিল করে হেসে বলল,
--- তুমি সব সময় আমাকে কিভাবে ধরে ফেলো প্রীতিলতা?
--- ম্যাজিক।
---- তা এখনো উঠছো না কেন ঘুম থেকে?
--- উঠতে ভালো লাগছে না।
--- আম্মু আব্বু চলে যাবে বলে মন খারাপ?
ও আমার দিকে কিছুক্ষণ নিরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। তারপর বলল
--- না প্রীতিলতা তুমি আছো না আমার মন খারাপ করবে কেন?
আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
--- একদম মন খারাপ করে না সোনা। মাত্র তো কয়টা দিন। তুমি আর আমি ক্যালেন্ডারে দাগ দিতে দিতে আম্মু আব্বু চলে আসবে।
এখন যাও ফটাফট ফ্রেশ হয়ে নাও সবাইকে নিচে যেতে হবে। গেস্ট আসবে বাসায়। যাও যাও তাড়াতাড়ি যাও।
ওকে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে আমি চলে আসলাম নিজের ঘরে।
এসে দেখি এই মহাশয় ও বিছানার সাথে চিপকে আছে। বালিশের তলায় দুই হাত দিয়ে উবো হয়ে বালিশে মুখ বুজে শুয়ে আছে।
ইশ্ ঘুমানোর কি ছিরি......
ডাকতে গিয়েও হঠাৎ কাল রাতের কথা মনে পড়লো সারা রাত বেচারা জেগে ছিল আমার জন্য। থাক এখন ঘুমাক।
আলমারি থেকে জামা কাপড় নিয়ে ঢুকে গেলাম ওয়াশরুম রুমে।
_________🌺🌺_________
খট করে সিটকিনি খোলার শব্দে আয়নার দিকে তাকালাম। আঁচলটা গায়ে জড়ানো থাকলেও কুচিগুলো আমার হাতে। আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখলাম তোয়ালে হাতে মাথা মুছতে মুছতে বের হচ্ছে সাফওয়ান। পরনে ব্ল্যাক টাউজার আর উপরে ব্লু টি-শার্ট পরা।
আগে জানতাম গোসল করলে মেয়েদের স্নিগ্ধ সতেজ লাগে। ছেলেদের যে এত আকর্ষণীয় লাগে জানা ছিল না তো।হাহ্ এটা আমার বর ভাবতেও গর্বে বুক ভরে গেল আমার।
আমাকে কুচি হাতে এরকম অদ্ভুতভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুখে কি যেন বিড়বিড় করে বলে বারান্দায় চলে গেল। আর আমিও আহাম্মকের মত চেয়ে আছি তার পানে।
কাল থেকে সকাল সন্ধ্যা আয়তাল কুরসি পড়ে উনার গায়ে ফুঁক দেবো। কারোর বদ নজর যেন আমার বরের গায়ে না লাগে।
সকাল সকাল খাবার টেবিলে এত রকম পদের প্রিয় খাবার দেখে সকলের মনে যেন আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। এদিক থেকে আমার খুব ভালো লেগেছে ভাইবোনগুলো সবারই প্রায় খাবারের পছন্দের তালিকা একই রকম। তাই একজনের জন্য একটু বেশি করে রান্না করলে দুজনের মন জয় করে নেওয়া যাবে।
বাবা তো উত্তেজনায় বলেই ফেললেন?
--- করেছ কি শাইলা? এত রান্না তুমি কখন করলে?
শাশুড়ি মা আমার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বাবাকে বললেন,
--- এইসব রান্না তোমার ছোট বৌমা করেছে।
মায়ের কন্ঠে কেমন যেন আমাকে নিয়ে গর্বের আভাস ফুটে উঠলো। মুহূর্তের সবার দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দুতে আটকে পড়লাম।
বাবার সহাসে বললেন,
--- তাহলে কিন্তু ভাত আজ আরও এক প্লেট বেশি খাবো। গাজরের হালুয়া কিন্তু আরও এক বাটি চাই আমার।
আমি হেসে বাবাকে বললাম,
--- নিশ্চিন্তে খেতে পারেন বাবা। এটা সুগার ফ্রি দিয়ে রান্না করা হয়েছে।
পুতুল ও চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
--- আমিও খাব।
বড় ভাইয়া ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
--- ওই। তোর আগে আমি খাব চুপ কর তুই। ছোট মানুষ ছোট মানুষের মতো থাক।
সবাই প্রশংসা করলেও টেবিলের ডান পাশে যে বসে আছেন তিনি ছিলেন একদম নীরব।
হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজ শোনা গেল। বাবা মা একে অপরের দিকে তাকিয়ে বলল মনে হয় উনারা চলে এসেছেন।
বাবা মা দুজনেই উঠে গেলেন দরজার দিকে। তাদেরকে ভেতরে নিয়ে আসলেন।
পেছনে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমি কি স্বপ্ন দেখছি নাকি সত্যি.....!
৫ম পর্ব🍂
মানুষের জীবনে যত রাগ অভিমান থাকুক না কেন সে অভিমানের উচ্চতা যদি পাহাড় সমান হয় তবে কিছু প্রিয় মুখ আছে যা চোখের সামনে জীবন্ত ভেসে উঠলে মুহূর্তের সব রাগ অভিমানের বরফ গলে পানিতে পরিণত হয় এবং মনকে শীতল করে দিয়ে যায়।
একই যুক্তি আমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হলো। 12 দিনের সমস্ত রাগ অভিমান এই প্রিয় মুখগুলো দেখে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল। মাত্র ১২ দিন তাদের সাথে দেখা হয়নি আমার কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে দীর্ঘ 12 দশক পর আমি তাদেরকে দেখতে পেলাম।
চোখের সামনে মা-বাবাকে দেখে নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলাম কোথায় আছি কি করছি সবাই কি ভাববে তাতে আমার কিছু যায় আসে না আমার এখন এই উষ্ণ আলিঙ্গনটার খুব প্রয়োজন ।ব্যাস...
উফ বুকের ভেতর এত শান্তি লাগছে কেন? মনে হচ্ছে যেন এতদিনের খা খা মরুভূমির মাঝে এক পশলা রহমতের বৃষ্টি। যার শরীর ও মনের সকল দুঃখ, কষ্ট, ক্লান্তিকে নিজের মাঝে শুষে নিয়ে সতেজতায় ভরিয়ে দিচ্ছে আমার সারা শরীরকে।
হাউ মাউ করে কাঁদতে পারিনা কিন্তু অতি আবেগে চোখ জোড়া অশ্রুসিক্ত হতে ভুল করে না।। চোখ থেকে পানি ঝরছে অবিরাম মাকে জড়িয়ে রেখে বাবার দিকে তাকালাম । বাবার চোখ জোড়াও অশ্রুতে টুই টুম্বুর।
এই চোখের অনেক ভাষা আছে। মেয়ের বাবা হওয়ার ব্যর্থতার ভাষা। মেয়েকে এখন তিনি পাত্রস্থ করেছেন।দেখতে ইচ্ছে করলেই যে যখন তখন মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে হানা দেওয়া যায় না। আত্মসম্মান বলেও তো একটা কথা আছে নাকি।
আব্বু আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললেন,
--- খালি মায়ের মাঝে আটকে থাকলে হবে। এদিকে যে আমিও এসেছি তোর ভাইও এসেছে আমাদের দিকে একটু তাকাবি না।
--- তোমার সাথে আমার কোন কথা নেই। এতদিন একবারও আমার কথা মনে পড়েনি তোমার তাই না।
--- মনে পড়েছে তো আমার আম্মাকে। প্রতিনিয়ত মনে পড়ে। কিন্তু সত্যিই আমি অনেক কাজে আটকে গিয়েছিলাম। এবারের মত তোমার ছেলেটাকে মাফ করে দাও। আর এমন ভুল হবে না।
বাবা আমার চোখমুখ মুছে দিতে দিতে বললেন,
---এবার তো কান্না থামান। অনেক তো কাঁদলেন। মুখটা একেবারে লাল করে ফেলেছেন। এত দূর থেকে নিশ্চয়ই আপনার কান্না দেখার জন্য আসি নাই। আসছি আপনার হাসি মুখটা দেখতে।
আম্মু ও চোখের পানি মুছে আমার পিঠে হাত বুলিয়ে আমার শাশুড়িকে বললেন,
--- আসলে এতদিন এভাবে মেয়েটা আমাদেরকে ছেড়ে কখনো থাকে নি তো তাই এমন পাগলামি করছে কিছু মনে করবেন না ভাবি।
আমার শাশুড়ি মা সামনে এগিয়ে এসে বললেন,
--- এভাবে বলে আমাদেরকে লজ্জা দিবেন না ভাবি। যেখানে বিয়ের পরের দিনই মেয়েকে আপনাদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা। সেখানে আমরা ওকে বারো দিন আটকে রেখেছি। আমাদেরকে ক্ষমা করুন। আর ভেতরে আসুন আমরা আপনাদের জন্য অপেক্ষা করে বসে আছি।
সত্যি বলতে মা বাবাকে আমার পরিবারের সাথে করা আছে আচরণ দেখে প্রতিনিয়ত আমি মুগ্ধ হচ্ছি। আর এতদিনে নিজের মধ্যে গড়া ভুল ধারণা একটু একটু করে ভেঙে যাচ্ছে আমার।
আমি মনে করেছিলাম এরা আত্ম অহংকারী, সৌন্দর্যের পূজারী, অর্থলোভী কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এটা আমার ভুল ধারণা। সম্পূর্ণ ভুল কিনা বুঝতে পারছি না। আম্মু আব্বু ভিতরে চলে গেলাম তাদের সাথে।
তখন আমার ভাই প্রীতম এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। ক্লাস নাইনে পড়ে। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। আর
আমার ক্রাইম পার্টনার। আমি যেমন ওর সকল হাঁড়ির খবর জানি। তেমনি ভাবে ও আমার সকল হাড়ির খবর জানে। যখন আমাদের দুজনের মধ্যে ঝগড়া লাগতো তখনই একজন আরেকজনের হাড়ি ফাটানো শুরু হতো।
গলা কাঁপছে আমার ভাইয়ের অনেক কষ্টে বলল,
--- আমি তোকে অনেক মিস করি আপু। তুই চল আমার সাথে। আমি আর কখনো কোনো কিছু নিয়ে তোর সাথে ঝগড়া করবো না। তোর রুম তোর ই আছে। সবকিছু সেই ভাবে গোছানো। একটা জিনিস আমি নষ্ট করিনি। তুই আবার ফিরে চল না আপু।
নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করার সামর্থ্য হয়নি আমার। এবার সত্যিই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলাম ভাইকে জড়িয়ে ধরে। পৃথিবীর নিয়মটা এত কঠিন কেন? আর সব নিয়মই কেন মেয়েদের জন্য প্রযোজ্য।
সৃষ্টিকর্তা তো জানেন মেয়েদের মন কতটা স্পর্শ কাতর কতোটা আবেগপ্রবণ। তারা যে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে না।
__________🌺🌺_________
ভাইকে নিয়ে ডাইনিং রুমে প্রবেশ করতেই সে সরাসরি গিয়ে সাফওনের পাশে বসে পড়ল। আতঙ্কে আমার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল উনি যদি প্রিতমের সাথে কোন রকম খারাপ ব্যবহার করেন।
কিন্তু আমাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করে তিনি প্রীতমের সাথে খুব ভালোভাবে কথা বললেন। এখন আবার দুজনের মধ্যে কি ব্যাপার নিয়ে কথা হচ্ছে। দুজনেরই হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখে স্বস্তি পেলাম।
এগিয়ে গেলাম ডাইনিং টেবিলের দিকে দেখলাম মা সবাইকে সার্ভ করছে। আমি গিয়ে মাকে হাতে হাতে সাহায্য করা শুরু করলাম। সবাইকে সার্ভ করার পর আমি মাকে বললাম,
--- মা আপনি এবার বসে পড়ুন খেতে। অলরেডি ৮ টার বেশি বাজে।
-- হ্যাঁ বসছি। তুমিও বসে পড়ো। এরপর যার যা প্রয়োজন নিজে নিয়ে নেবে। এখানে তো সবাই আপন মানুষে বসে আছে তাই না।
আমি মুচকি হেসে বললাম,
--- আচ্ছা মা।
আমি আমার আম্মুর পাশে বসলাম। খেতে খেতে হঠাৎ বাবা বলে উঠলেন,
--- ভাইজান বললেন না তো খাবার কেমন হয়েছে?
আব্বু হেসে উত্তর দিলেন,
--- জী চমৎকার স্বাদের রান্না হয়েছে।
--- আপনার মেয়ে রান্না করেছে। মামনি চমৎকার হয়েছে তোমার হাতের রান্না। তোমার কিন্তু একটা উপহার পাওনা রইল। মক্কা থেকে ফিরে এসে তোমাকে উপহার দেব।
সাকলাইন ভাইয়া ও আমাকে ধন্যবাদ জানালো তাকে তার পছন্দের খাবার গুলো রান্না করে খাওয়ানোর জন্য। ভাবি ও রান্নার প্রশংসা করে বললেন,
--- রান্না গুলো অসাধারণ হয়েছে।
সকলের প্রশংসা শুনে আমার মা-বাবার খুশিতে চোখগুলো জ্বলজ্বল করে উঠলো।
তারপর আর কোন কথা হলো না। সবাই খাবারে মনোযোগ দিল।
হঠাৎ সাকলাইন ভাইয়া বাবার উদ্দেশ্যে বললেন,
--- বাবা তোমাদের সকাল ন'টার ট্রেন তো ক্যান্সেল হয়ে গেছে। ঢাকা টু খুলনা গামী এক মালবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে। লাইনে কাজ চলছে ঠিক হলে তারপর ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হবে। কী করবে এখন?
সবার খাওয়া শেষে হয়ে গেছে। হাত ধুতে ধুতে বাবা বললেন,
--- এরপরের শিডিউল কয়টায়? তোমার মাকে নিয়ে বাস জার্নি করা যাবেনা।জানোই তো।
--- রাত ৯ টায় বাবা।
--- তোমার করিম চাচাকে ফোন দাও। ওই দুটো টিকিট ক্যানসেল করে রাত ন'টার ট্রেনের জন্য দুটো টিকিট কাটতে বলো। রাত নটার ট্রেনে আমরা ঢাকায় যাব।
তারপর আব্বুর দিকে তাকিয়ে বললেন,
--- চলেন ভাইজান। সময় যখন পেয়েছি। অনেকদিন আপনার সাথে বসে দাবা খেলা হয় না। আজ মনের আয়েশ মিটিয়ে দাবা খেলা যাবে।
শেষ করে বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
---চমৎকার রান্না করে খাইয়েছো মা। আর একটু কষ্ট করে দুই কাপ চা বানিয়ে দেবে।
--- এক্ষুনি বানিয়ে দিচ্ছি বাবা।
________🌺🌺______
কতদিন পর মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি ,মা আস্তে আস্তে মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে আর মুখে নানা রকম ঘটনা বলছেন। এ কয়দিন বাড়িতে কি হয়েছে না হয়েছে। আর আমি চুপচাপ মায়ের কোলে শুয়ে সবকিছু শুনছি।
হঠাৎ মা বলে উঠলেন,
--- রুমির সাথে তোর কোন যোগাযোগ আছে নাকি? রুমির ব্যাপারে জানিস কিছু?
--- ছোট মামার মেয়ে রুমি আপুর কথা বলছো? না ওর সাথে তো আমার কোন যোগাযোগ নেই। সেইতো বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে চলে গেল। জানিনা তারপর কি হয়েছে।
--- হ্যাঁ। সেই মেয়ে ফেরত এসেছে বাপের বাড়িতে। চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। রুমির স্বামী ওকে মেরে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। বলেছে তার ব্যবসা করার জন্য পাঁচ লাখ টাকা না দিলে রুমিকে আর ঘরে তুলবে না।
চেহারার কি বাজে হাল হয়েছে রুমির। চোখ বসে গেছে। সারা গায়ে মারের দাগ। সারাদিন নাওয়া খাওয়া নেই জানালার ধারে বসে থাকে।
আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম,
--- এমন তো হবেই। বিশ্বাস করে এত ভালবাসলো,যার জন্য পরিবারের বিরুদ্ধে গেল। সেই যখন বিশ্বাসঘাতকতা করে তখন তো আর সহ্য করা যায় না।
মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
👉একটা কথা কি জানিস বর্তমানে ছেলে মেয়েরা বাবা মাকে নিজের সব থেকে বড় শত্রু মনে করে। তারা মনে করে বাবা-মায়েরা শুধু ভুলই ধরতে পারে। কিন্তু এই ভুল ধরার মাঝেই যে সন্তানকে সঠিক পথ দেখানোর মূল মন্ত্র থাকে,
*এটা তারা বুঝতে পারে না। তারা ভুলে যায় বাবা-মা ই একমাত্র সন্তানদের সর্বময় কল্যাণ কামনা করে ।
কিন্তু তারা তো শুধু বাবা মাকে ভুল ই বুঝতে পারে।
আর কেউ কেউ এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে বাবা-মার থেকে সন্তানকে আলাদা করে ফেলে। সুযোগ বুঝে মেয়েটাকে এমন ভাবে আঘাত করে তখন সে আঘাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সেই মেয়ের পক্ষে আর সম্ভব হয় না।
এদিক থেকে আমি সৌভাগ্যের অধিকারী। আল্লাহ আমাকে আমার মন মত একটা মেয়ে দিয়েছে। দেখিস তোর অনেক ভালো হবে। আমি আর তোর বাবা সবসময় তোর জন্য দোয়া করি। আর আমাদের জামাইও তো খুব ভালো। আর শ্বশুরবাড়ির লোকজন ও খুব ভালো।
আমি মায়ের কোলে আরো আরাম করে শুয়ে বললাম,
--- হ্যাঁ মা। আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন খুব ভালো আর জামাই তো আরো ভালো।
_________🌺🌺_________
কিছুক্ষণ পরে ট্রেন ছেড়ে দেবে ঢাকার উদ্দেশ্যে। বাবা মাকে বিদায় জানানোর জন্য আমরা সবাই এসেছি। আম্মু আব্বু আর প্রীতম রাতের খাবার খেয়ে, হজ্ব থেকে ফিরে আসার পরে সবাইকে তাদের বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে বাসায় চলে গেছেন। আসতে চেয়েছিল রেলস্টেশনে কিন্তু বাবাই নিষেধ করল।
নজর গেল মায়ের কোলে বসে থাকা পুতুলের দিকে। মেয়েটা আজ একদম চুপচাপ হয়ে গেছে। যতই মুখে বলুক না কেন হাজার হোক মা-বাবা তার অত দূরে চলে যাচ্ছে মন খারাপ তো স্বাভাবিক। কিন্তু কান্নাকাটি করছে না এটাই অস্বাভাবিক।
পরে ভাবির কাছে শুনলাম এর আগে কয়েকবার বাবা মা পুতুল কে রেখে ১০ দিন পর্যন্ত বাহিরে থেকে এসেছেন।তখন রহিমা খালা আর সাফওয়ান ওকে সামলাতো। এই জন্য সাফওয়ানের জন্য পুতুল এত পাগল।
ট্রেন এখনই ছেড়ে দেবে তাই সকল যাত্রীকে ট্রেনে উঠে বসার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। মা শক্ত করে পুতুলকে কিছুক্ষণ নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে রাখলেন। তারপর ছেড়ে দিলে আমি গিয়ে পুতুলকে কোলে নিলাম। আমাকে বললেন ,
পুতুলের খেয়াল রেখ।
বাবা এসে আমাদের দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
--- ভালো থাকো। মামনি আমার মেয়েটার খেয়াল রেখো।
বলে পুতুলের গালে একটা চুমু দিলেন তারপর বাবা মা সবার থেকে বিদায় নিয়ে ট্রেনে উঠে বসলেন। মুহূর্তের মধ্যে ট্রেন চলছে শুরু করল।হাত নেড়ে আমরা সবাই তাদেরকে বিদায় দিলাম।
পুতুল আমার ঘাড়ে মুখ গুজে ফুপিয়ে কাঁদছে। আমি ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। হঠাৎ কোথা থেকে সাফওয়ান এসে আমার কাছ থেকে পুতুল কে নিয়ে নিলেন। এবং বাইরে হেটে চলে যাচ্ছিলেন। আমি তার পিছু পিছু যাচ্ছিলাম।
কিন্তু একটা মেসেজ টোন আমাকে থমকে দিয়েছিল। আর মেসেজটা পড়ে তো আরও বেশি থমকে গেলাম।
৭ম পর্ব (প্রথম খন্ড)🍂
সাকলাইন ভাইয়া আর ভাবি এখান থেকে সোজা ভাবির বাপের বাড়িতে গেছেন। ভাবির মা নাকি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কয়টা দিন ওখানে থেকে আসবেন তারা। স্টেশন থেকেই সোজা চলে গেছেন গাড়ি ঘুরিয়ে।
থাকার মধ্যে স্টেশনে রয়ে গিয়েছিলাম শুধু আমি সাফওয়ান আর পুতুল। মেসেজ আসার কারণে আমি ওদের পেছনে পড়ে গিয়েছিলাম। পরে আবার মহাশয় যখন ক্ষেপে গেলেন তখন পুরো স্টেশন দৌড় করালো। আমাকে আর পুতুলকে।
তখন দৌড়ে এসে বাইরে বের হয়ে দেখি মহাশয় গাড়িতে উঠে বসছেন সবে। আমার ভারী রাগ হলো ঠোঁট ফুলিয়ে মুখ দিয়ে ফু দিয়ে সামনে থাকা চুল গুলো উড়িয়ে দিলাম। কি বদমাইশ ছেলেরে বাবা...! পুরো স্টেশন দৌড় করিয়ে ছাড়লো আমাকে।
পুতুল আমার হাত ছেড়ে দিয়ে গাড়ির সাইড গ্লাসে গিয়ে জোরে জোরে আঘাত করে বলল,
--- ওই ভাইয়া। তুই আমাদেরকে এইভাবে দৌড় করালি কেন? ব্যথায় আমার পা টনটন করছে।
সাফওয়ান মুখে কোন কথা না বলে গাড়ির দরজার লক খুলে দিলেন। পরে আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
--- গাড়িতে উঠে বসো না হলে বাকি রাস্তাটুকু তোমাদের দুজনকে হেঁটে যেতে হবে।
পুতুল রাগে গজগজ করতে করতে বলল,
--- ভাইয়া আমি তোর চুল ছিঁড়ে দেবো।
আমি পেছন থেকে পুতুলের পিঠে টোকা দিয়ে চোখ দিয়ে গাড়িতে উঠে ইশারা করলাম। না এ ব্যাটার কোন ভরসা নেই। যদি সত্যি সত্যি তাই করে। কথা না বাড়িয়ে আমি আর পুতুল একসাথে গাড়িতে উঠে বসলাম। সাফওয়ানো গাড়ি স্টার্ট দিলো বাড়ির উদ্দেশ্যে।
_________🌺🌺________
গাড়ি এসে থামলো "সুখনীড়"ভিলার সামনে। সাফওয়ান দুইবার গাড়ির হর্ন দিতেই দারোয়ান চাচা এসে গেট খুলে দিলেন। তারপর স্মুথলি বাড়ির পার্কিং লটে গিয়ে গাড়ি থামালেন তিনি। রেলস্টেশন থেকে বাড়ির পথ খুব বেশি দূর নয় ২০ মিনিটের রাস্তা।
এটুকু পথ আসতে আসতেই পুতুল আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে। গাড়ি পার্কিং লটে সুন্দর করে পার্ক করে রেখে সাফওয়ান গাড়ি থেকে বের হয়ে এসে পুতুলকে ডাকতে লাগলেন। এ মেয়ে প্রচন্ড ঘুমকাতুরে।
তাই শত ডাকাডাকির পরেও চোখ মেলে তাকালো না। বাধ্য হয়েই সাফওয়ান আবার ওকে কোলে নিল। আমিও গাড়ি থেকে বের হয়ে দরজা লাগিয়ে তাদের পেছনে পেছনে আসতে লাগলাম। মেইন ডোর বেল বাজাতে রহিমা খালা এসে দরজা খুলে দিলেন।
সাফওয়ান পুতুলকে নিয়ে সোজা দোতলায় চলে গেল। রহিমা খালা বলল,
--- পুতুলকে ডাকার প্রয়োজন নেই। বড় ম্যাডাম আর সাহেবের সাথে পুতুল খেয়ে নিয়ছিল। ও আর এখন খাবেনা ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। আমি বরং তোমাদের জন্য খাবার গরম করছি ফ্রেশ হয়ে নিচে এসো। খেয়ে নেবে।
আমি সম্মতি জানিয়ে উপরে চলে এলাম। সাফওয়ান রুমে নেই তারমানে সে পুতুলের ঘরেই আছে। আমি এই ফাঁকে ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। ঢিলেঢালা কুর্তি আর নিচে ধুতি পায়জামা পড়ে বের হয়ে এলাম।
কাজ চোরা মেয়ে আমি। অনেকদিন পরে আজ একটু কাজ কর্মের চাপ বেশি থাকায় একেবারে হাঁপিয়ে গেছি। নিচে যেতে ইচ্ছে করছে না। অলস ভঙ্গিতে হেঁটে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসলাম। মাথা থেকে পাঞ্চক্লিপটা ছাড়িয়ে চুলগুলো ছেড়ে দিলাম চুলগুলো আঁচড়ে নিবো বলে।
যতই ক্লান্ত থাকি না কেন চুল বেনী করে না ঘুমালে আমার ঘুম আসে না। চিরুনি হাতে নিয়ে চুল আঁচড়াতে শুরু করেছি এমন সময় মহাশয়ের আগমন।
আমি তার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে নিজের কাজে মন দিলাম। আয়নায় চুলের জট ছাড়াতে ছাড়াতে হঠাৎ আয়নায় ভেসে ওঠা একটা অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়লো আমার।
সাফওয়ান আলমারি থেকে টি-শার্ট আর ট্রাউজার বের করছিল। কিন্তু হাতে কি যেন একটা হয়েছে। ক্ষত চিহ্নের মতো। আমি উঠে গিয়ে তার পেছনে দাঁড়াতেই সে আমাকে পাত্তা না দিয়ে পাশ কাটিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল।
বিরক্তিটা আমার মুখটা কুঁচকে গেল। এক ঝলক দেখে ভালোই বুঝেছি হাতটা ভালই কেটেছে কিন্তু কেটেছে কিভাবে?
আমি চিরুনি ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে ড্রয়ার টেনে ফাস্ট ইনবক্স বের করে সাফওয়ান এর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিছুক্ষণ পর টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বের হলেন তিনি।
দেখে মনে হচ্ছে গোসল করেছেন। আজব মানুষ! এখনো পুরোপুরিভাবে ঠান্ডা না পড়লেও রাতের দিকে ভালোই ঠান্ডা পড়ে। এই রাতে ঠান্ডার মধ্যে কে গোসল করে? একমাত্র উনিই করে।
এই 12 দিনে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি উনি যখনই বাহিরে থেকে এসেছেন, তখনই গোসল করেছেন। উনার এই হাইজেনমেন্টেইন ব্যাপারটা আমার দারুন লাগে। বলতে গেলে পুরো মানুষটাকেই আমার ভালো লাগে।
উনার দিকে তাকিয়ে এ সমস্ত ভাবার মাঝে আবার উনি আমার সাইড কাটিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে চলে গেলেন। না আমি যে একজন মানুষ এই ঘরে আছি, উনার সামনে সোফায় বসে আছি।উনি কি তা চোখে দেখতে পান না নাকি অনুভব করতে পারেন না?
আমি এমন অদ্ভুত মানুষ জীবনে দেখিনি। শুনেছি বিয়ের পর পুরুষ মানুষ নাকি সব সময় বউয়ের চারপাশে ঘুরঘুর ঘুরঘুর করে। আর একে দেখো। আমি নির্লজ্জের মত সারাদিন তার পেছন ঘুরঘুর ঘুরঘুর করছি কিন্তু কোন পাত্তাই পাচ্ছিনা। সঙ্গে সঙ্গে আমার মন বিদ্রোহ করে বলল,
কিসের নির্লজ্জতা হে মেয়ে? ওখানে যে দাঁড়িয়ে আছে সে সম্পর্কে তোমার স্বামী হয়। তোমার একমাত্র বৈধ সম্পদ। তাকে ভালবেসে তার পেছনে ঘুরঘুর করা নির্লজ্জতা নয়। বরং এটা তার প্রতি তোমার ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ।
আমি উঠে ওনার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। চুলের ব্রাশ করতে করতে আয়নার দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করলেন,
--- কী?
---আপনার হাত কাটল কি করে?
চুলে ব্রাশ করা থেমে গেল। আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চিরুনিটা ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে দিয়ে বললেন,
--- কিছু না, গাড়ির গ্লাসে লেগে কেটে গেছে।
আমাকে কি আপনার পুতুল মনে হয়। বুঝিয়ে দেবেন বুঝে যাব। গ্লাসে লেগে বুঝি এতটা কেটে যায়।দেখে তো মনে হচ্ছে ছুরি দিয়ে আঘাত করেছে। স্টেশনে যাওয়ার সময় তো আপনার হাতে কোন আঘাত ছিল না এমনকি আপনি যখন আমার উপর রাগ করে চোখের আড়াল হয়ে গেলেন, তার আগেও তো আপনার হাত ঠিক ছিল তাহলে।
কথাটা বলতেই সাফওয়ান কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল। আরো খেয়াল করলাম কি যেন ভাবতে ভাবতে মুখের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল তাই। কিঞ্চিত রাগ ফুটে উঠলো তার মুখে।
--- কিছু না। তাছাড়া আমি আপনাকে কেন এত কৈফিয়ত দিচ্ছি?
--- হাহ তাও ঠিক। আচ্ছা আপনাকে কৈফিয়ত দেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। এখন এখানে চুপচাপ হয়ে বসুন।
--- কেন?
---আপনার হাতে মেডিসিন লাগাবো।
--- লাগবে না।
--- সেটা আপনাকে বুঝতে হবে না। আমাকে বুঝতে দিন এখানে চুপচাপ হয়ে বসুন।
তাকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হাত ধরে টেনে সোফায় বসিয়ে দিলাম। পরে ফার্স্ট এইড বক্স খুলে ক্ষতটা আগে পরিষ্কার করে নিলাম। তারপর ঔষধ লাগিয়ে দিতে দিতে
তার দিকে নজর পড়তেই দেখলাম সে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আমি মুচকি হেসে বললাম,
--- কী সৌভাগ্য আমার।তা কী বলতে চাইছেন বলে ফেলুন।
তৎক্ষণাৎ সাফওয়ান শীতল কন্ঠে সতর্কবাণী শোনালেন।
--- " এবার থেকে যখন বাইরে বের হবেন। বোরকা পরে বের হবেন। বোরকা ছাড়া আপনাকে যেন বাইরে বের হতে না দেখি।"
৭ম পর্ব এর (শেষ খন্ড)🍂
ঔষধ লাগিয়ে দিতে দিতে তার দিকে নজর পড়তেই দেখলাম সে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আমি মুচকি হেসে বললাম,
--- কী সৌভাগ্য আমার। মহাশয়ের দেখি তার স্ত্রীর প্রতি সদয়ের দৃষ্টি পড়েছে। তা কী বলতে চাইছেন বলে ফেলুন।
তৎক্ষণাৎ সফল শীতল কন্ঠে সতর্কবাণী শোনালেন।
--- " এবার থেকে যখন বাইরে বের হবেন। বোরকা পরে বের হবেন। বোরকা ছাড়া আপনাকে যেন বাইরে হতে না দেখি।"
************
আমি তার কথায় চমকে উঠে তার দিকে তাকিয়ে পড়লাম। হাতের কাজ এমনি এমনি থেমে গেল। কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করলাম হঠাৎ আমাকে এমন কথা বললেন কেন?
আমার দৃষ্টি দেখে উনি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন
উনি হয়তো বুঝতে পেরেছেন অনেক অধিকার বোধ খাটিয়ে তিনি কথাগুলো বলে ফেলেছেন। আমতা আমতা করে বললেন,
--- না মানে ঘরের বাহিরে এখন কোন মেয়েই নিরাপদ নয়। তাই বললাম আর কি। তাছাড়া শাড়ি ক্যারি করতে আপনার অনেক অসুবিধা হয় সেটা দেখেই বোঝা যায়। যা সামলাতে পারেন না তা পড়েন কেন?
আরো চমকে গেলাম। আজ কী আমার চমকে যাওয়ার দিন। উনি আমার ব্যাপারে ভাবছেন....!
তার মানে স্টেশনে কি কিছু হয়েছিল। আমার চোখের আড়াল হয়ে যাওয়ার পরে থেকে দেখছি এই হাতের আঘাত। আবার হঠাৎ করে বলছেন আমাকে বোরকা পরার কথা। যেটা পরে কমফোর্টেবল না সেটা পড়তে নিষেধ করছেন।
তার মানে কি আমার জন্য উনি হাতের এই আঘাত পেয়েছেন?
ভাবতে ঠোঁটের কোলে হাসি খেলে গেল আমার। সমীকরণ টা মিলেছে তবে। মাথা নিচু করে আমি আবার নিজের কাজে মন দিলাম।
উনার দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম উনি আমার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমি আবারো হাসলাম।
ওষুধ লাগিয়ে হাতটা ব্যান্ডেজ করে দিলাম। ক্ষতটা ভালোই গভীর হয়েছে। এরপরে যদি আবার আঘাত লাগে রক্ত বেরোবে তার সাথে সাথে ইনফেকশন হয়ে যাওয়ার ভয় আছে। সবকিছু গুছিয়ে ডেসিন টেবিলের ড্রয়ারে রেখে। সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে বললাম,
--- আপনি বসুন আমি নিচ থেকে খাবার নিয়ে আসি আপনার জন্য।
--- আমি খাব না। ইচ্ছে করছে না। মাথাটা ব্যথা করছে আমি ঘুমাবো।
আমি কন্ঠের জোর বাড়িয়ে কিছুটা বিরক্তির সাথে বললাম
--- খেয়ে ঘুমাবেন। মেডিসিন খেতে হবে। না হলে ব্যথা আরো বাড়বে। আপনি বসুন আমি খাবার নিয়ে আসছি।
ঘর থেকে বের হতে গিয়ে খেয়াল আসলো গায়ে ওড়না নেই। আবার ফিরে এসে বিছানার উপর থেকে ওড়না নিতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাফওয়ান প্রশ্ন করে উঠলেন,
--- এমনি সময় তো প্রশ্নের ঝুলি নিয়ে বসেন। কেন করেছি এটা কেন বললাম। আপনাকে বোরকা কেন পরতে বললাম প্রশ্ন করবেন না?
আমি মুচকি হেসে গায়ে ওড়না জড়িয়ে নিয়ে তার উদ্দেশ্যে বললাম,
---- আমি আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গিয়েছি। উত্তর পেয়ে যাওয়ার পরেও যদি আবার এক প্রশ্ন করা হয় সেটা হচ্ছে বোকামির পরিচয়। আর আমি এতটাও বোকা নই।
সাফওয়ান ও যেন এবার কিছুটা ভড়কে গেলেন। আমার কাছ থেকে হয়তো এমন উত্তর আশা করেননি তিনি। আমি বেরিয়ে আসলাম রুম থেকে।
_______🌺🌺_______
খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকতেই দেখি সাফওয়ান বিছানায় আধা শোয়া হয়ে বসে আছেন। কপালে এক হাত ঠেকিয়ে। আমি নিঃশব্দে ঘরে প্রবেশ করলাম। খাবার গুলো সেন্টার টেবিল এর উপর রাখার শব্দের হাত সরিয়ে আমার দিকে তাকালেন। তারপর উঠে এসে সোফায় বসলেন।
আমিও তার পাশে বসলাম কিন্তু দূরত্ব বজায় রেখে। তার প্লেটে খাবার গুছিয়ে দিয়ে। গ্লাসে পানি ঢালছিলাম আর আড় চোখে তাকিয়ে দেখলাম তিনি কিছু খুঁজছেন। আমি পানির গ্লাসটা প্লেটের পাশে এগিয়ে দিয়ে বললাম,
--- কিছু খুঁজছেন?
--- একটা স্পুন দরকার। না হলে আমি খেতে পারব না।
আমি ওনার সামনে থেকে প্লেট টা নিজের হাতে নিয়ে খাবার মাখতে শুরু করলাম। তারপর একটা লোকমা তৈরি করে তার মুখের সামনে ধরে বললাম,
--- বউয়ের হাত থাকতে স্পুন কেন?
সাফওয়ান আমার হাতে থাকা প্লেটের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,
--- আমাকে দিন আমি খেতে পারব আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।
--- আমার কষ্ট নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না । নিজের কষ্টটা আগে বুঝুন। আব চুপচাপ আমার হাতে খেয়ে নিন। নিচে খালা কিন্তু ঘুমিয়ে পড়েছে।
আপনি অবশ্যই চাইবেন না এখানে এমন কোন সিনক্রিয়েট হোক যে খালা নিচ থেকে উপরে উঠে আসেন।
--- তুমি আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছো?
--- উহু। সাবধান করছি। এবার চুপচাপ খেয়ে নিন।
--- তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছো
আমি কিঞ্চিত হেসে বললাম,
--- আপনার যদি তাই মনে হয় তাহলে বাড়াবাড়ি করছি। You know what.Everything is permissible with the husband.
বিপরীতে সাফওয়ান চুস হয়ে গেলেন। প্রথমবার তাকে কথার জালে আটকে দিতে পেরে নিজের মধ্যে পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে আমার। আপনাকে তো সোজা আমি করবোই সাফওয়ান। সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকাতে হয় এ পাঠ আমার খুব ভালো করে পড়া আছে।
কি হলো এবার হা করুন। হাত শুকিয়ে যাচ্ছে আমার। এক প্রকার বাধ্য হয়েই অনিচ্ছা সত্ত্বেও হা করলেন তিনি। তার মুখের রিঅ্যাকশন দেখে আমার পেটের মধ্যে হাসির ব্লাস্ট হচ্ছে কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করা যাবে না। অনেক কষ্টে হাসি চেপে রেখে বললাম,
--- হাত ঠিক না হওয়া পর্যন্ত এবার থেকে তিনবেলা আপনাকে আমার হাতেই খেতে হবে।
মুখে খাওয়ার নিয়ে হু হু করে কি বললেন সাফওয়ান তা বুঝতে পারলাম না। তাই বললাম,
--- মুখের খাবারটা শেষ করে তারপরে কথা বলুন। আপনার বউ পালিয়ে যাচ্ছে না।
টেবিল থেকে পানি নিয়ে কিছুটা পানি খেয়ে বললেন,
--- যখন মা-বাবা বাড়িতে ছিল ভিজে বিড়াল সেজে বসেছিলে আর এখন যেই মা-বাবা ঘরের বাইরে চলে গেছে। ভাইয়া ভাবিও নেই ওমনি নিজের আসল রূপ দেখাতে শুরু করে দিয়েছে। তোমরা মেয়েরা যে কত রকমের বহুরূপী হতে পারো? আমার তা খুব ভালো করে জানা আছে।
--- এ্যাই এক মিনিট এক মিনিট। আগে হা করুন খাবারটা নিন তারপরে বলছি। মেয়েরা বহুরূপী হয়, আপনি কয়টা মেয়েকে চেনেন হ্যাঁ? সেদিন রাতে না বললেন আপনি কাউকে পছন্দ করেন না। তাহলে মেয়েদের ব্যাপারে এত জ্ঞান আসতেছে কোথা থেকে আপনার?
সাফওয়ান আমার দিকে রাগিদৃষ্টি দিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বললেন,
--- আমি কি তোমার মত চোখ ,কান বন্ধ করে হুশ জ্ঞান হারিয়ে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করি।
আমি মুখ বাঁকিয়ে বললাম,
---- হাহ আসছে আমার কত জ্ঞানী বাবা। সারা শরীর দিয়ে ঝরে ঝরে পড়ছে তার জ্ঞান।
সোফায় বসে সাফওয়ান আমার দিকে তেড়ে এসে বললেন,
--- তোমাকে তো...
অবস্থা বেগতিক দেখে আমি দেরি না করে সাথে সাথে ভাতের লাস্ট লোকমাটা তার মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে বললাম,
--- প্রশংসা করতে ইচ্ছে করছে? তা করুন না ।আমি শুনেছি তো।স্বামীর মুখের প্রশংসা স্ত্রীদের খুব ভালো লাগে। তেমন আমারও ভালো লাগবে।
মুখে আর কিছু বললেন না তিনি। কিন্তু চোখ দিয়ে এমন ভাবে তাকিয়ে আছেন মনে হচ্ছে এখনই ধ্বংস করে ফেলবেন। তাই আমিও আর কিছু বললাম না। পাগল খেপিয়ে কাজ নেই বাবা। চুপচাপ খেয়ে উঠে পরলাম।
সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছে নিচে যার উদ্দেশ্যে বের হতে গিয়েও পিছনে ফিরে সাফওয়ানের উদ্দেশ্যে বললাম,
--- একটা বিষয় খেয়াল করলাম বুঝলেন।আপনি কিন্তু এতক্ষণ আমার সাথে তুমি সম্মোধন করে ঝগড়া করলেন। আরও
একটি বিষয় খেয়াল করলাম যে রাগ করলে আপনাকে একদম কুমড়ো পটাশ এর মতো লাগে । তাই আমি আপনাকে "কুমড়ো পটাশ" বলে ডাকবো।
_______🌺🌺______
পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার। চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে ছোট ছোট হামি দিয়ে উঠে বসতে গিয়ে চুলে বেশ জোরেশোরে টান খেলাম। ব্যথায় মুখটা বিকৃত হয়ে গেল। আবার আগের জায়গায় শুয়ে পড়লাম। এই হচ্ছে চুল বেঁধে না ঘুমানোর ফল। চাপা পড়া চুলগুলো আস্তে ছাড়িয়ে।
পাশে তাকিয়ে দেখলাম সাফওয়ান আমার থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরে বালিশে ঘুমিয়ে আছেন। দুজনের মধ্যবর্তী দূরত্ব খুব কম। প্রথমে চমকে উঠলাম পরে মনে পড়লো কাল রাতে তার মাথা ব্যাথা করছিল।
আমি তার মাথা মালিশ করে দিচ্ছিলাম । এক পর্যায়ে যখন বুঝতে পারলাম তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। তখন আমি এক দুঃসাহসিক কাজ করে বসলাম।
তার বালিশে মাথা রেখে তার বাম হাতের বাহু জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ গুঁজে চোখ বুঝে নিয়েছিলাম। প্রথমে অস্বস্তি আর ভয় করলেও পরে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতে পারিনি।
এখন দেখছি কম্বলের নিচে তার বুকে মুখ বুজে ঘুমিয়ে ছিলাম এতক্ষণ। আরো একটা অবাক করার বিষয় সাফওয়ান তার ডান হাতটা আমার কাঁধের কাছে দিয়ে রেখেছিলেন।
আমি ধীরে ধীরে উঠে বসে সাফওয়ানের মুখের উপর ঝুঁকে পড়লাম। আরো একটা দুঃসাহসিক কাজ। নির্দ্বিধায় কপালে একটা চুম্বন এঁকে দিলাম।
গুড মর্নিং ডিয়ার ।
মাশাল্লাহ..! কত সুন্দর কিউট তুমি। কতো কিউট করে ঘুমিয়ে আছো। কিন্তু এখন যদি তুমি জেগে থাকতে তাহলে বোধহয় লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলতে। সাধে কি আর তোমার নাম কুমড়ো পটাশ দিয়েছি।
রাগ করলে তোমার মুখটা একদম লাল হয়ে যায়। তখন দেখতে একদম মিষ্টি কুমড়ার মত লাগে। তাই তুমি আমার কুমড়ো পটাশ। শুধুমাত্র
প্রীতিলতার কুমড়ো পটাশ❤️
৮ম পর্ব🍂
সময় আর নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সে তার আপন গতিতে চলতে থাকে। প্রতিদিন নিয়ম করে সূর্য উদয় হয়ে সকালের আবির্ভাব হচ্ছে আবার সাঁঝের বেলায় সূর্য অস্তের মাধ্যমে দিনটার সমাপ্তি ঘটছে।
ঠিক একই ভাবে মাঝখানের কয়েকটা দিন কিভাবে কেটে গেল তা বুঝতেই পারলাম না। এখন পুরো সময়টা আমার ব্যস্ততার সাথেই কাটে। সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে রান্নাবান্না করা, তারপরে পুতুল সোনা কে রেডি করে স্কুলে পাঠানো। আবার ওকে স্কুল থেকে আনতে যাওয়া, দুপুরে খাইয়ে দেওয়া, হোমওয়ার্ক পাশাপাশি আবার কোচিংয়ে নিয়ে যাওয়া। এক কথায় বলতে গেলে বেশ দৌড়ের উপরে আছি আমি।
আর এই মেয়ে তো আমাকে ছাড়া কিছুই বোঝেনা। যদি বলি ড্রাইভার আঙ্কেলের সাথে স্কুল অথবা কোচিংয়ে যাও। ওমনি ছুটে এসে আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলবে,
--- প্রীতিলতা। তুমি কিন্তু আমাকে কিপটামো করে ভালোবাসছো। এরকম কিপটামো করলে কিন্তু আমি কান্না করে দেব। আমি আজ কোথাও যাবো না তাহলে এভাবেই সারাদিন তোমার গলা জড়িয়ে ধরে বসে থাকবো। পাগলি মেয়ে তাই না...!
খাইয়ে দিতে গেলেও তার তার আমাকে লাগে, রাতে ঘুম পাড়াতে গেলেও আমাকে লাগে। ঘুমিয়ে গেলে ওকে ঠিকঠাক করে শুইয়ে দিয়ে পা টিপে টিপে চলে আসি আমার ঘরে।
তার মধ্যে আবার আমার আরেক মহাশয় আছে তো।নিয়ম করে তিন বেলা তার পেছনে লাগতে আমার আবার ভুল হয় না। সারাদিন তো গম্ভীর মুখ করেই বসে থাকে। তার থেকে রাগী ফেসটাই আরো বেশি সুন্দর লাগে আমার কাছে। আর যখন খুব রেগে যায় তখন তেড়ে এসে বলে ,
তোমাকে তো আমি....
তখন আমিও মেকি হাসি দিয়ে বলি, ভালবাসতে ইচ্ছে করছে বুঝি। তা বাসুন না আমি কি নিষেধ করেছি নাকি।
এ পর্যন্তই বলার ক্ষমতা আছে তারপর বাবা আমি গা ঢাকা দেই। তখন সামনে থাকা সত্যিই বিপদজনক ধরতে পারলে যদি মার দেন।
কিন্তু এই কয়দিনে সম্পর্কের কেমন উন্নতি হয়েছে তা ঠিক বলতে পারব না । কিন্তু একটা উন্নতি হয়েছে উনার সম্মোধন টা পুরোপুরি ভাবে আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছে।
মাঝে মাঝে আবার নাম ধরেও ডাকেন।
তার ওপর আবার রাত্রে বেলায় তার হাতের বাহু জড়িয়ে ধরে ঘুমাই আমি। এটা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। আমি জানিনা তিনি রাত্রে টের পান কিনা। কিন্তু অবাক করার বিষয় হচ্ছে প্রতিদিনই আমার সকাল বেলার ঘুম ভাঙ্গে তার বুকের মাঝে। ব্যাপারটা আমার দারুন লাগে।
***********
যেমন আজকে সকালেও ঘুম থেকে উঠে তার বুকেই নিজের মাথাটা আবিষ্কার করলাম। দুই হাতে শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে ছিলাম এতক্ষন। সকাল হয়েছে কিছুক্ষণ আগে । জানালা থেকে পাখির কলকাকলি ভেসে আসছে । শোয়া থেকে সোজা হয়ে উঠে বসে চুল গুলো হাত খোপা করে নিলাম।
তারপর ঝুঁকে সাফওয়ানের ঘুমন্ত মুখটা দেখছিলাম। এই লোকটা দিন দিন এত সুন্দর হয়ে যাচ্ছে কি করে। রান্না তো আমি করছি সে রান্না তো আমিও খাচ্ছি। কই আমি তো সুন্দর হচ্ছি না। কিন্তু একে দেখো দিনদিন যেন রূপ গজাচ্ছে। রূপচর্চা করে নাকি?
নাহ। যা দেখতেছি এবার নিজের দিকেও খেয়াল করতে হবে। না হলে এরপরে বর মশাই আর ফিরেও তাকাবে না। যেহেতু সে ঘুমিয়ে আছে মনের কথা তাই মুখ দিয়েই বললাম। তারপর কপালে চুম্বন দিয়ে। মর্নিং উইশ করতেই দেখি পাশ ফিরে কোলবালিশ জড়িয়ে নিলো। আমি আতকে উঠলাম।
এ ব্যাটা আবার টের পেয়ে গেল নাকি। ওদিকে উকি দিয়ে দেখলাম না ঘুমিয়ে আছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে চলে গেলাম।
_________🌺🌺________
আজ শুক্রবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তেমন তাড়া নেই আমার। তাই আলসেমি ঝেড়ে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেল আমার। ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে এসে দেখি রহিমা খালা কাজ করতে শুরু করে দিয়েছেন। আমাকে দেখে মুচকি হাসি হেসে বললেন,
--- আজ তো শুক্রবার। এত তাড়াতাড়ি রান্না ঘরে আইতে গেলা কেন? সারা সপ্তাহেই তো রান্নাবান্না আর পুতুলরে নিয়ে ব্যস্ত থাকো। একটা দিন না হয় খালার হাতের রান্না খাইলা। তোমার মত অত ভালো রান্না করতে না পারলেও আমার হাতের রান্না খাইতে পারবা তুমি।
আমি হেসে দিয়ে বললাম,
--- তুমিও তো সারা সপ্তাহ কাজ করো খালা। আমি শুধু রান্নাবান্না করি আর পুতুলের পেছনে আমার সারা দিন কেটে যায় তাছাড়া বাড়ির বাকি কাজ তো তুমি করো। তোমার ও তো বিশ্রামের প্রয়োজন।
হাত বুলিয়ে বললেন,
--- তুই অনেক ভালা নয়া বউ। তুমি আমার জন্য এটুকু ভাবছো এটাই আমার কাছে অনেক। তোমার অনেক ভালো হবে।
আমি শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বললাম
--- আচ্ছা। আজ ইলিশ পোলাও রান্না করব। বড় ভাইয়া অনেকদিন ধরে খেতে চাইছিল তার পাশাপাশি তোমার ছোট বাবা আর পুতুল সোনার ও তো খুব পছন্দ এই খাবারটা।
কিন্তু তোমাদের যে সাকলাইন বাবার শ্বশুর বাড়িতে দাওয়াত আছে আজকে। তোমরা যাবা না?
কিন্তু খালা সেটা তো রাত্রে ডিনারের জন্য যাব। সারাদিন তো আমরা খাওয়া দাওয়া করবো তাই না।
আচ্ছা ঠিক আছে আমি সবকিছু গুছিয়ে দিচ্ছি তুমি শুধু আজকে রান্না করবে আর কিছু করা লাগবে না তোমার। লক্ষী মেয়ের মত আমার পাশে খাড়ায় থাকো।
মুচকি হেসে বললাম ,
---আচ্ছা।
__________🌺____
ঘড়িতে নয়টা বাজে ,
রান্না প্রায় শেষের দিকে।
এবাড়ির সকলের ঘুম থেকে উঠে চা বা কফি খাওয়ার অভ্যাস আছে। বড় ভাইয়ের জন্য কফি, রহিমা খালা দিয়ে এসেছেন।
আর আমি সাফওয়ানের জন্য উইদাউট সুগার এক মগ কফি তৈরি করে নিয়ে আসলাম। মর্নিং ওয়াক করে আসার পর উনার কফির দরকার পরে। খালা কফি দিয়ে এসে আমাকে জানালো সাফওয়ান মর্নিং ওয়াক থেকে ফিরে এসেছে।
তাই আমিও ছুটলাম কফির মগ নিয়ে।সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম।
সাফোয়ান পুতুলের রুমে উঁকি ঝুঁকি মারছে। ব্যাপারটা কি...! আমিও পা টিপে টিপে তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তার কাজে এতটাই মগ্ন ছিল যে আমি কখন যে তার পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি, সে বুঝতেই পারল না। আমিও সাইট থেকে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখলাম। পুতুল রুমে নেই। ওয়াশরুমে আছে বোধ হয়। কিন্তু উনি কাকে খুঁজছেন তাহলে?
আমি কফিটা সাইডের বক্সের উপরে রেখে ওনার কানের কাছে ফিসফিস করে বললাম,
--- আপনি কি আমাকে খুজছেন কুমড়ো পটাশ?
উনি যেন ভূত দেখার মত চমকে উঠলেন। তারপর নিজেকে ধাতুস্ত করে আমতা আমতা করে বললেন,
-- না। আমি তো পুতুলকে খুজছিলাম। ওকে দরকার ছিল। তোমাকে খুঁজতে যাব কেন আমি?
--- কিন্তু আপনার ভাব ভঙ্গি দেখে তো মনে হচ্ছে আপনি আমাকে খুঁজছিলেন।
--- প্রশ্নই আসে না।
--- অবশ্যই প্রশ্ন আসে। না হলে আপনি পুতুলের ঘরে এভাবে লুকিয়ে চুরিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছেন কেন। আর পুতুল তো রুমে নেই সেটা দেখতে পেয়েছেন তার পরেও ঝুঁকে কি দেখছেন মশাই?
--- বড্ড বেশি কথা বলছো তুমি। এতো কথা বলো কি করে মুখ ব্যথা করে না তোমার?
বাহ্ দারুন কথা ঘোরাতে পারেন তো আপনি। আরে আমি বুঝি। নতুন নতুন বিয়ের পর এমন হয় বুঝেছেন। যতই অস্বীকার করুন না কেন আমি তো বুঝতে পারছি।
তিনি ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
--- তা কি বুঝতে পারলে তুমি।
আমি অধিক আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে উঠলাম,
--- এই যে আপনি খুব খারাপ ভাবে ফেঁসে গেছেন।
--- ফেঁসে গেছি মানে?
--- হুম। খুব বাজে ভাবে ফেঁসে গেছেন তো। "আমার মায়ায়"। দেখুন না আমি কিন্তু কফি নিয়ে আপনার রুমে আসছিলাম। প্রত্যেকদিন তাই করি। আপনি সেটা খুব ভালো করেই জানেন।
কিন্তু তারপরেও আমাকে না দেখে, থাকতে না পেরে রুম থেকে বেরিয়ে এসে পুতুলের রুমে উঁকি ঝুঁকি মারছেন। আপনি কি বুঝতে পারছেন আপনি আমার কোন লেভেলের মায়ায় জড়িয়ে গেছেন।
কথাগুলো শুনে সাফওয়ানের রিঅ্যাকশন দেখার মত ছিল। পেটের মধ্যে হাসির ব্লাস্ট হলেও মুখে তা প্রকাশ না করে। মুখে একটা লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে বললাম,
--- ইশ আপনি যে এ রকম বউ পাগল হবেন আমি বুঝতেই পারিনি।
এ্যাই আপনি আবার আমার প্রেমে পড়ে গেলেন নাতো হুম।
এতক্ষন বকবক করলেও তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার সব হাওয়া বেরিয়ে গেল। রেগে এটোম বোম হয়ে গেছে থুরি কুমড়ো পটাশ হয়ে গেছে।
আমি মেকি হাসি দিয়ে বললাম,
--- ঠিক আছে বলা লাগবে না। প্রেমে তো সবাই পড়ে, কজনে আর মুখ ফুটে বলে। থাক আপনাকেও আর বলা লাগবে না।
ব্যাস হয়ে গেল। আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছি এবার দৌড়ানোর পালা। আজ আর নিস্তার নেই। আমি ধীর পায়ে পিছাতে গেলেই উনি খপ করে ধরে ফেললেন আমার হাত। কিন্তুআমার ভাগ্য প্রসন্ন হলো। আমি উনার হাত ফসকে বেরিয়ে এসেছি।
কিছুটা দূরত্ব দাঁড়িয়ে এসে নাকের নিচে একটা আঙ্গুল ঘষে বললাম,
হুহ। আমাকে ধরা অতো সোজা নয় কুমড়া পটাশ। স্কুলে থাকতে ৪০০ মিটার দৌড়ে ফাস্ট হতাম। যতোই চেষ্টা করুন আমার নাগাল আপনি পাবেন না।
আমার কথা শুনে উনি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললেন,
--- হাহ মিকি মাউস এর মত এটুকু শরীর নিয়ে আবার আমাকে চ্যালেঞ্জ করছে। হোয়াট এ জোকস
-- কিহ আমি মিকি মাউস।
--- কার্টুনের মতই তো দেখতে লাগে তোমাকে।
--- আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে ধরে দেখান আমাকে। কেমন পারেন।
বলে দৌড়াতে শুরু করলাম আমি। তিনি ও আমার পিছু নিয়েছেন। আবার তার পেছন থেকে পুতুলের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে।
ওই প্রীতিলতা তোমরা ছোট বাচ্চাদের মত দৌড়াদৌড়ি খেলছো কেন। আমিও খেলব আমাকেও না সাথে।
দৌড়াতে দৌড়াতে ওদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ছাদে চলে আসলাম। এসেই ছোট্ট চিলেকোঠার মধ্যে লুকিয়ে পড়লাম। তার কিছুক্ষণের মধ্যে ওরা দুজন ও ছাদে এসে পৌঁছালো। এদিকে ওদিকে আমাকে কিছুক্ষণ খোঁজ করে আবার নিচে নেমে গেল ওরা।
তার কিছুক্ষণ পর চিলেকোঠা থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতেই পিছন থেকে কেউ আমার কোমর জড়িয়ে ধরে শূন্যে তুলে ধরলো। হঠাৎ এমন হওয়ার কারণে আমি ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম। সাথে সাথে খিলখিল হাসির শব্দ ভেসে আসলো আমার কানে। তার সাথে হাত তালির আওয়াজ।
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম পাশে পুতুল দাঁড়িয়ে আছে আর হাত তালি দিতে দিতে বলছে
--- হিহিহি। প্রীতিলতা ধরা পড়ে গেছে ।ইয়েএএএএ
তারপর সাফওয়ান আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
কী ম্যাডাম। তখন তো বেশ বলছিলে আমি নাকি ফেঁসে গেছি। এখন তো তুমিই ফেঁসে গেছো আমার হাতের মুঠোর।
বলে শব্দ করে হেসে উঠলেন।এই প্রথম আমি তার প্রাণখোলা হাসির সাক্ষী হলাম।তার হাসির ঝংকারে আমার শরীর নিস্তেজ হয়ে গেল।তার কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে বললাম,
--- হ্যাঁ। সত্যি ফেঁসেছি তোমার নেশাক্ত মায়ায়। সে নেশা থেকে হয়তো মৃত্যু ব্যতিত মুক্তি মিলবে না আমার।
পর্ব-- ৯🍂
শাওয়ার নিয়ে বের হয়েছি কিছুক্ষণ আগে। টাওয়েল দিয়ে আলতো হাতে চুল মুছে বারান্দায় নেড়ে দিলাম। চুল থেকে এখনো টপটপ করে পানি ঝরছে তাতে আমার কি আমার যে চুল মোছায় ভারী আলসেমি।
বিয়ের আগে মা মুছে দিত চুলগুলো। তেল দিয়ে দিত বেনী করে দিত রাত্রে শোয়ার আগে। আমার চুলের যত্ন আমার মাই করত। আমি শুধু মাথায় করে বয়ে বেড়াতাম।
বারান্দা থেকে রুমে চলে আসলাম। রুম এখন ফাঁকা। সাফওয়ান জুম্মার নামাজ পড়তে গেছে। নামাজ থেকে আসতে এখনো দেরি আছে। আমি ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে বসলাম আয়নায় ভেসে ওঠা নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকালাম।
গোল্ডেন ব্লাউজের সাথে আসমানী রঙের সিল্কের শাড়ি পড়েছে আজকে। শাড়ি পড়া আমার তেমন পছন্দ না হলেও অপছন্দ নয়। তার কারণ শাড়ি তেমন সামলাতে পারি না।
হঠাৎ সাফওয়ানের কথাগুলো মনে পড়ে গেল।
--- শাড়ি সামলাতে পারেন না যখন পড়েন কেন?
আনমনে হেসে উঠলাম আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করলাম,
--- সারাদিন শুধু মাথার মধ্যে সাফওয়ান ঘোরে তাই না। সারাদিন কেমন আনমনা থাকিস? অকারণে হাসিস, তোর কি প্রেমের অসুখ করলো নাকি....!
আচ্ছা এই অসুখ কি ছোঁয়াচে? অবশ্যই হ্যাঁ না হলে পৃথিবীতে এত প্রেমিক যুগল আছে কি করে?
ড্রেসিং টেবিলের পাশে রাখা বক্সের উপরে সাফওয়ানের ফটো ফ্রেমের দিকে নজর পড়ে গেল। চোখ ছোট ছোট করে সেদিকে তাকিয়ে বললাম,
--- বাধিয়ে দিলেন তো প্রেম অসুখ? এখন এর থেকে মুক্তি পাবো কি করে বলুন তো? আপনি তো আবার প্রেম করবেন না। নিজের চারপাশে অ্যান্টি লাভ রেস্ট্রিকশন মেরে রেখে দিয়েছেন। এখন আমি কোথায় যাই? হুম
উঠে গিয়ে বক্সের এর উপর থেকে তার ছবিটা নিয়ে এসে খাটে বসে বললাম,
---ইস দেখো কত ইনোসেন্ট লাগছে একে। একে দেখে কে বলবে পা থেকে মাথা পর্যন্ত রাগ ঠুসে ঠুসে ভরা। আচ্ছা আপনি কি বুঝতে পারছেন আপনার জন্য আমার মনে একটা কঠিন সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। যা ধীরে ধীরে আপনাতে বশীভূত করে ফেলেছে আমাকে। মুক্তির প্রতিষেধক ও আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
এখন আপনার পালা ।সেই একই সংক্রমনে আপনাকেও সংক্রমিত হতে হবে কিন্তু। তার পরে না হয় দুজন দুজনের মাঝে প্রতিষেধক খুঁজে নেব
ফটো ফ্রেমটা শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে জায়গায় রেখে দিলাম। তারপর ড্রেসিং টেবিলের থেকে লোশন নিয়ে হাতে পায়ে আলতো করে মেখে নিলাম। ক্রিমটাও মুখে লাগিয়ে নিলাম। আমার সারা জীবনের সাজগোজ। তারপর চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াতে গিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মাথায় আসলো আজ কাজল পড়লে কেমন হয়...!
ড্রয়ার টেনে খুঁজতে শুরু করলাম কাজলের স্টিক । বৌভাতের দিন ওরা আমাকে সাজিয়ে গুছিয়ে জিনিসপত্রগুলোতে ড্রয়ারই রেখেছিল। কিছুক্ষণে খুঁজে ও পেয়ে গেলাম। কিন্তু তার পাশে ছোট একটা গয়নার বাক্স দেখে বের করে আনলাম।
খুলে দেখলাম তাতে ছোট একজোড়া কানের দুল, একটা নাকফুল, একটা স্বর্ণের চেন এবং এক জোড়া চিকন বালা।
তৎক্ষণাৎ মনে পরল শাশুড়ি মা বৌভাতের দিন এই বক্সটা আমার হাতে দিয়েছিল। দিয়ে কিছু বলতে চাইছিলেন কিন্তু নিচ থেকে ডাক পরায় তাকে চলে যেতে হয়েছিল। তাড়াহুড়ের মধ্যে আমিও আর খুলে দেখিনি।
আজ কেন জানি আমার খুব সাজতে ইচ্ছা করছে। বক্সটা ড্রেসিং টেবিলের উপরে রেখে এক এক করে গহনাগুলো পরতে শুরু করলাম।
কানের দুল গুলো খুলে নতুন কানের দুল পড়ে নিলাম। গলায় চেন। নাকফুল টাও পাল্টে নিলাম। হাতে বালা গুলো পড়ে নিলাম।
আয়নার দিকে তাকাতে নিজেকে অন্যরকম ভাবে খুঁজে পেলাম। এতক্ষণ সাধারণ লাগলেও গহনাগুলো পড়ার পরে নিজের চেহারার মধ্যে একটা জৌলুস খুঁজে পেলাম। চুলগুলো পেছনে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম গন্তব্য এখন পুতুলের ঘর।
__________🌺🌺_________
ভাউ ......! বলে পুতুল কে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলাম।
পুতুল আমার বাহুর মধ্যে কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠে বলল,
--- উফ প্রীতিলতা তুমি তো আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে। আরেকটু হলে আমার ড্রয়িংটা খারাপ হয়ে যেত।
আমি এখনো ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে থেকে বললাম,
--- সরিইইই। তা কী ড্রইং করলো আমার পুতুল সোনা।
--- এই দেখ ।
বলে একটা ফ্যামিলি ফটো ড্রয়িং দেখালো আমাকে। যেখানে আমাদের সবার ছবি আঁকা আছে।
আমি পুতুলকে বললাম সোনা এরকম একটা ছবি আমাকে একে দেবে। আমি আমার কাছে রেখে দেবো।
--- আচ্ছা এটা তুমি নাও। ওয়েট তোমাকে একটা জিনিস দেখানোর আছে।
--- কী ?
খাতার মধ্যে থেকে আরেকটা পেপার বের করল। যাতে পুতুল আর আমার ছবি আঁকানো। এটা আর্টিস্টের হাতে আঁকানো নয় যে পুরোপুরি ফুটে উঠবে। কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে ও ওর যথাসম্ভব চেষ্টা করেছে ফুটিয়ে তোলার । ছবিটা এরকম যে পুতুল আমার কোলে বসে আছে। দুজনেই শাড়ি পড়ে আছি। চুল খোলা মুখে অমায়িক হাসি। রং পেন্সিল দিয়ে কালারও করেছে।
--- ওরে বাবা রে । এই যে দেখি আমি আর আমার পুতুল সোনা। আমার শাড়ি ও পড়েছি সেম সেম।
--- হ্যাঁ। কেমন হয়েছে ছবিটা প্রীতিলতা?
--- খুব সুন্দর। সোনা আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। এর আগে চোখ বন্ধ করো তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
--- কি সারপ্রাইজ?
--- আগে চোখ বন্ধ করো। আমি না বলা পর্যন্ত চোখ খুলবে না। নো চিটিং।
--- ওক্কে। চোখ ঢেকে বসে আছি।
আমি দৌড়ে নিজের রুমে আসলাম আলমারি থেকে নেভি ব্লু রংয়ের একটি শাড়ি বের করে নিয়ে আবার পুতুলের রুমে আসলাম।
--- কি হলো প্রীতিলতা। কতক্ষণ?
--- হয়ে গেছে সোনা আর একটু।
আমি ওর আলমারি থেকে সাদা রঙের একটা টপস বের করলাম। ছোট মানুষ তো আমার ব্লাউজ পেটিকোট কিছুই নেই। ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে সাজগোজের কিছু জিনিস নিয়ে বিছানার উপর রেখে বললাম এবার চোখ খোলো।
চোখ খুলে ওর নজরটা প্রথম আমার দিকে পরলো। লাফিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
--- তুমি শাড়ি পরেছো প্রীতিলতা? কী সুন্দর লাগছে তোমাকে? একদম মিষ্টি বউ বউ লাগছে।
এবার তোমাকেও আমি মিষ্টি বউ বউ বানাবো। এই দেখো। আমার জন্য আমি শাড়ি এনেছি। তুমি ছবিতে এঁকেছো না আমি আর তুমি সেম সেম শাড়ি পড়েছি। এখন আমি তোমাকেও শাড়ি পড়াবো। তারপরে তুমি আর আমি মিলে ওই ছবিটার মত পোজ দিয়ে ছবি তুলব। একদম জীবন্ত ছবি হবে আমাদের।
--- ইয়েস... দাও আমাকে বউ সাজিয়ে দাও।
এসো আমার কাছে। আমি পুতুলকে শাড়ি পরাতে শুরু করলাম। তারপর একদম আমার মত সাজিয়ে গুছিয়ে বারান্দায় চলে গেলাম। পুতুল ছবিতে যেমন ড্রইং করেছে দোলনায় আমার কোলে বসে আছে ঠিক ওইভাবে দোলনায় বসে ছবি তোলার চেষ্টা করছি কিন্তু ঠিক মন মত আসছে না।আমাদের দুজনের মুখে বিরক্তির অভাব ফুটে উঠলো।
তখনই ঘরের দরজা খুলে পুতুলের ঘরে আসলো সাফওয়ান। থাই গ্লাসের ওপাশে আমরা দোলনায় বসে আছি। প্রথমে সাফোয়ানকে খেয়াল না করলেও পড়ে তাকিয়ে দেখি সে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি পুতুলকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। তার সাথে আমার দৃষ্টির বিনিময় হতে সে চোখ নামিয়ে নিল। কিন্তু আমি তার দিকে তাকিয়ে রইলাম সাদা শুভ্র পাঞ্জাবি আর মাথায় কালো টুপি পরিহিত সাফওয়ান কে বেহেস্তের হুরের থেকে কম কিছু লাগছে না। এত সুন্দর কেন এই মানুষটা...!
ভাবনার ভেতরে থাই গ্লাসটা সরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো সে। তারপর বলল,
--- তোমরা এখানে। ভাইয়া তোমাদের দুজনকে খুঁজছিল। তারা একটু পর বের হবে।
পুরো কথাটা সাফওয়ান অন্যদিকে তাকিয়ে বলল আমার দিকে ভুল করেও তাকালো না।
এই অপ্রস্তুত দৃষ্টির সূত্রপাত ঘটেছে সেই সকালের ঘটনার পর থেকে। তখন তিনি আমাকে আনমনে ই কোমর জড়িয়ে ধরে একপ্রকার কোলে উঠিয়ে নিয়েছিলো। যখন তিনি বুঝতে পারলো তখন তিনি ধীরে আমাকে নামিয়ে দিয়ে গম্ভীর মুখে ছাদ থেকে নেমে গিয়েছিলেন।
আমিও আকস্মিক এমন ঘটনায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে ভুলে গিয়েছিলাম কিন্তু পরে ঠিকই নিজের মধ্যে একটা অপ্রস্তুত অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল। তবুও অনুভূতিটা অনেক শান্তির ছিল।
তাকে জালানোর জন্য যতই মুখে বলি না কেন ভালোবাসি সত্যিকার অর্থে এমন পরিস্থিতিতে আমি অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিলাম।
বর্তমানে তার চোরা দৃষ্টি দেখে আমিও মিটমিট করে হাসলাম। আমারও কেমন জানি তার সাথে কথা বলতে অস্বস্তি আর লজ্জা লাগছিল। তার মধ্যে হঠাৎ পুতুল একটা বায়না করে বসলো। সাফওয়ান এর হাতে ক্যামেরা তুলে দিয়ে বলল আমাদের দুজনের কয়েকটা ছবি তুলে দিতে। আশ্চর্যের বিষয় কোন বাক বিতর্ক ছড়ায় তিনি রাজি হয়ে গেলেন। তারপর পুতুল আর আমার বেশ কয়েকটা ছবি তুলে দিলেন।
এরপর পুতুল আরও একটা ভয়ানক আবদার করে বসলো। দোলনায় আমার পাশে সাফওয়ানকে জোর করে বসিয়ে দিল। তারপর ক্যামেরাটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে বলল,
--- উফ্ এত দূরে দূরে বসেছ কেন তোমরা। তোমাদের দুজনের মাঝখান দিয়ে তো একটা ট্রাক চলে যেতে পারবে। ভাইয়া প্রীতিলতার দিকে চেপে বস। আমি কয়েকটা ছবি তুলব। তোমাদের দুজনকে আজ খুব সুন্দর লাগছে।
বোনের জেদের কাছে সাফওয়ান হার মানলো। তারপর তিনি আমার বেশ গা ঘেসে বসলেন। আমি তার দিকে তাকাতে তিনি আমার দিকে তাকালেন। তখনই ফ্লাশলাইট করলো আমাদের মুখের উপর। এভাবে কয়েকটা ছবি তুলল পুতুল। ছবি তোলা শেষে সাফওয়ান উঠে বারান্দার এক পাশে গিয়ে দাঁড়াল। পুতুল আমার পাশ ঘেঁষে দোলনায় বসে পুতুল ছবিগুলো দেখাতে লাগলো। বলল
--- দেখো প্রীতিলতা ছবিগুলো কত সুন্দর উঠেছে। এই ভাইয়া এই ছবিগুলো আমায় তাড়াতাড়ি প্রিন্ট করে এনে দিবি আমি ফটো ফ্রেম তৈরি করব। দেরি করবি না কিন্তু একদম।
________🌺🌺_____
ভাইয়া ভাবি বেরিয়ে গেলেন কিছুক্ষণ আগে। যাবার আগে বারবার বলে গেলেন সন্ধ্যা নাগাদ যেন আমরা ওই বাড়িতে চলে যাই। আমি সম্মতি প্রকাশ করলেও একটা জিনিস খেয়াল করলাম যতবারই ভাবির বাপের বাড়িতে যাওয়ার কথা উঠছে।
ততবারই সাফওয়ান খুব বিরক্তি প্রকাশ করছে। কেন তা বুঝতে পারলাম না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে উনার ওই বাড়িতে যাওয়ার মতো ইচ্ছা নেই। এক প্রকার হয়ে যাচ্ছে তিনি।
আমরা দুপুরে খাওয়া দাওয়ার জন্য ডাইনিং এ খাবার গোছাচ্ছিলাম। সাফোয়ান চেয়ার টেনে বসলেন । পুতুল কে ডেকে এসেছি। ম্যাডাম শাড়ি খুলতেছে। একটু পরে আসবে বলল। আমি সাফওয়ানকে খাবার বেড়ে দিলাম। তারপর আমার আর পুতুলের জন্য খাবার নিচ্ছিলাম তখন সাফওয়ান বললেন,
--- সন্ধ্যায় ওই বাসায় যাওয়ার জন্য কি শাড়ি পরবে?
--- হ্যাঁ। শাড়ি ছাড়া থ্রি পিস আছে। বিয়ের পরে এই প্রথম দাওয়াত খেতে যাচ্ছি, শাড়ি না পড়ে আর কি পরবো?
সাফওয়ান আমার কথার প্রতি উত্তর করলেন না চুপচাপ খাবারে মনোযোগ দিলেন। তাই দেখে আমি ভাবলাম হয়তো শাড়ি পড়ে যাওয়ার জন্য সম্মতি দিয়েছেন।। আমিও আর কথা না বাড়িয়ে পুতুল চলে আসার পর একসাথে খেয়ে নিলাম।
খাওয়া শেষে সাফওয়ান উপরে চলে গেলেন। সবকিছু গুছিয়ে রেখে ওপরে গিয়ে দেখি। সাফওয়ান জিন্স টি-শার্ট পরে রেডি হচ্ছেন। চুলে ব্রাশ করতে করতে আমার দিকে এক ঝলক তাকালেন।
আমি তাকে প্রশ্ন করলাম ,
--- এখন কোথায় যাচ্ছেন? দাওয়াতে যাওয়ার কথা তো সন্ধ্যায়।
আমরা বাইরে যাচ্ছি।আমি পুতুলকে বলে দিয়েছি তৈরি হতে। তুমিও তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও।
-- আমি তার পাশে দাঁড়িয়ে গিয়ে বললাম,
--- কিন্তু বাইরে যাচ্ছিটা কোথায়?
চিরুনি টা ড্রেসিং টেবিলের ওপরে রেখে আমার দিকে ঘুরে বললেন,
--- আপনি কি আমার সাথে বাহিরে যেতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন?
--- আরে না আমি ত....
আমাকে থামিয়ে দিয়ে সাফওয়ান বললেন,
--- তাহলে আমি যেখানে নিয়ে যাচ্ছি চলুন আমার সাথে।
১০ম পর্ব🍂
গাড়ি এসে থামল একটি বুটিক সেন্টারের সামনে। উপরের নেমপ্লেটে বড় বড় করে লেখা শায়লা বুটিক হাউস। নামটা দেখে কেমন সন্দেহ হলো। নামটা তো আমার শাশুড়ি মায়ের। তাহলে এটা কি মায়ের বুটিক হাউস।
তাছাড়া সাফওয়ান এখন এখানে এনেছো কেন আমাকে?
গাড়ি থামাতেই দরজা খুলে লাফিয়ে বেরিয়ে পরল পুতুল। আমিও বের হয়ে রাস্তার ফুটপাতে দাঁড়ালাম। সাফওয়ান গাড়িটা ভালো মতো সাইট করে রেখে এসে আমাদেরকে বললেন ,
--- ভেতরে চলো।
আমিও আর কোন কথাবার্তা না বাড়িয়ে পুতুলের হাত ধরে তাকে অনুসরণ করলাম। ভেতরে ঢুকতেই একটি চৌদ্দকি পনেরো বছরের বয়সের ছেলে এগিয়ে এসে সাফওয়ানকে সালাম দিল।
--- আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।
সাফওয়ান মুচকি হেসে সালামের উত্তর দিলে
--- ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছো রবিন?
--- জি ভাইয়া ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
---আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
তারপর ছেলেটা পুতুলটা হাই হ্যালো করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
--- আসসালামু আলাইকুম ভাবি। কেমন আছেন?
--- জি ভাইয়া ভালো আছি।
তারপর ছেলেটা আমাদেরকে নিয়ে শোরুমের দোতলায় এগিয়ে বসালো। দেখে মনে হল পুরোটাই মেয়েদের জন্যই খোলা হয়েছে বুটিক্স হাউজ। কারণ মেয়েদের মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সাজসজ্জার সবকিছুই এখানে আছে। সিঁড়ি দিয়ে দোতালায় ওঠার আগে সবকিছু চোখ বুলিয়ে নিলাম। বেশ সুন্দর বুটিক হাউস টা।
দোতালায় উঠে আরো বেশি অবাক হয়ে গেলাম। পুরো তলাটা জুড়ে একটা রুমের মতো তৈরি করা হয়েছে। এখানে মেয়েদের পাশাপাশি অন্য কর্ণারে ছোট বাচ্চাদের এবং ছেলেদের বিয়ের শেরওয়ানি, পাজামা পাঞ্জাবি নিয়ে অনেক সুন্দর করে সাজিয়ে তোলা হয়েছে।
সাফওয়ান সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ছেলেটার কাছ থেকে বুটিকের নানা রকম পড়া খবর এবং সুবিধা অসুবিধা শুনছিল। তাদের এখানে কাজ করতে কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা সেটাও শুনে নিল। আর আমি শুধু পুতুলের হাতটা ধরে চারিদিকে নজর বুলাচ্ছিলাম।
ছেলেটা আমাদেরকে চেয়ারে বসিয়ে নিচে চলে গেল। পাশের কাউন্টার থেকে দুটো মেয়ে উঠে আসলো আমাদের সামনে। তাদের পোশাক পরিচ্ছদ দেখে আমার দারুন লাগলো। একই রঙের একই রকমের পোশাক পরা। ফুল হাতার কালো থ্রি পিস উপরে কালো হিজাব পিন আপ করা।
একটা জিনিস খেয়াল করলাম এখানে ছেলেদের থেকে মেয়ে কর্মীদের সংখ্যা বেশি। বাইরে একজন দারোয়ান আর এই রবিন নামের ছেলেটা ছাড়া নিজে এবং উপরে প্রায় সবই মেয়ে সহকর্মী দেখলাম।
মেয়ে দুটো প্রথমে আমাদেরকে এসে সালাম দিয়ে সাফওয়ান কে জিজ্ঞাসা করল,
--- ভাইয়া ভাবীর জন্য কি বের করব? শাড়ি, থ্রি পিস, নাকি.....
--- এক এক করে বের করুন যেটা ভালো লাগবে সেটাই নেবো।
--- আচ্ছা।
বলে মেয়েটা একে একে প্রায় ১০-১৫টা শাড়ি তাক থেকে নামিয়ে আনলো। তারপরে একে একে থ্রি পিস এছাড়া আরো অন্যান্য চলতে সময়ের আধুনিক পোষাক ও নিয়ে আসলেন একগাদা।
এর মধ্যে রবিন নামের ছেলেটি ট্রেতে করে দুটো কোলড্রিংস একটা জুস আর কিছু স্নাক্স নিয়ে আসলো। ট্রেটা পাশে টুলের উপর রেখে আমাদের হাতে কোল্ড ড্রিংসের বোতল দিয়ে দিল আর পুতুল তো পুরো দোতলা দৌড়ে বেড়াচ্ছে ।
আমি খালি বসে অবাক চোখে এদের কাণ্ডকারখানা দেখছি।
মেয়েগুলো অবশেষে ক্ষ্যান্ত হলো। একপাশে কাপড়ের স্তুপ তৈরি করে ফেলেছে তারা। এরপর আমাদের সামনে কাউন্টারে বসে এক এক করে ড্রেস মেলে ধরতে শুরু করল। প্রথমের শাড়ি বের করলো।
একেকটা শাড়ির ওজন তো আমার থেকেও বেশি। এসব শাড়ি পড়ে হেঁটে চলে বেড়ানো তো দূরের কথা ঠিকমতো সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারবো না আমি। আমার মুখের শোচনীয় অবস্থা দেখে সাফয়ানের মনে হয়তো কিঞ্চিত দয়া হলো।
সে শাড়িগুলো সরাতে বলল। থ্রি পিস চুরিদার দেখানো শুরু করল। মেয়েগুলো হয়তো আমাকে নতুন বউ ভেবে সব থেকে বেশি গর্জিয়াস জামা কাপড় নিয়ে এসে হাজির করেছে আমার সামনে। এরা হয়তো জানে না আমি সিম্প্লিসিটি পছন্দ করি। ওদের দেখানো এই চোখ ধাঁধানো জামা কাপড় চোখে ভালো লাগলেও আমার তেমন পছন্দ হলো না।
সাফওয়ান কেউ দেখলাম দু-একটা কাপড়চোপড় নাড়াচাড়া করে রেখে দিল। মেয়েদুটো আমাদের অবস্থা দেখে আবার একগাদা কাপড় আনতে ছুটল। কিন্তু সাফওয়ান উঠে দাঁড়ানোতে মেয়েগুলো থেমে গেল। মেয়েগুলোকে বললো,
--- এই সবগুলো উঠিয়ে রাখুন।
সাফওয়ান হাঁটতে শুরু করল ডিসপ্লেতে সাজানো ড্রেসগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল। এর মধ্যে পুতুল এসে আমার পাশ ঘেঁষে বসলো,
--- প্রীতিলতা। জুসের বোতল টা খুলে দাও।
সামনে বসে মেয়ে দুটো কেমন অবাক হয়ে পুতুলের দিকে তাকালো। আমি বুঝতে পারলাম ওদের অবাক হওয়ার কারণ।
জুসের বোতলটা হাতে নিয়ে মুখ খুলতে লাগলাম। সামনে বসা একটা মেয়ে পুতুলের গাল টেনে বলল,
--- আপু ইনি তো তোমার ভাবি হয়। তুমি ওনার নাম ধরে ডাকছো কেন?
পুতুল কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে বলল,
--- না ও আমার প্রীতিলতা হয়। আমি ওকে প্রীতিলতা বলেই ডাকি আর ডাকবো।
আমি হেসে ওর হাতে জুসের বোতলটা দিলে দিয়ে খেতে খেতে আবারো ও দিকে চলে গেল।
আমি সৌজন্যের খাতিরে হেসে বললাম,
--- আমার নাম প্রীতি। ও আমাকে ভালোবেসে প্রীতিলতা বলে ডাকে। ভালোবাসাটাই তো আসল উদ্দেশ্য। কি নামে ডাকলো না ডাকলো তাতে কি যায় আসে। এতে আমার কোন অভিযোগ নেই বরং আমি ওকে ডাকতে বলেছি।
মেয়েগুলো আর কোন কথা বলিনি। আমাদের সমাজে অবস্থিত মানুষের ছোটবেলা থেকেই মাইন্ডে এটা সেট করে দেয় কে রক্তের সম্পর্কের কে রক্তের সম্পর্কের নয় । কার সাথে কেমন আচরণ করতে হবে। কিন্তু এরা বুঝেও বুঝতে চায় না যে রক্তের সম্পর্কের বাইরের সম্পর্ক টাও কতটা আপন আর কতটা মধুর হয়।
এরমধ্যে সাফওয়ান ব্লাক কালারের একটা গাউন নিয়ে এসে কাউন্টারে রাখল। হঠাৎ সামনে কিছু পড়ায় আমি চমকে উঠলাম। পাশে তাকিয়ে দেখলাম সাফওয়ান দাঁড়িয়ে আছে। চেয়ারে বসে বললেন,
--- এই গাউনটা পরে এসো।
নিচে যে একটা গাউন রাখা আছে এতক্ষণ তার দিকে তাকাইনি আমি। গাউনটার দিকে নজর যেতে কিঞ্চিৎ ভুরু কুঁচকে গেল আমার।
কাপড়টা কিসের বলতে পারব না কারণ কাপড় সম্পর্কে আমার তেমন আইডিয়া নেই। হাতে নিয়ে মনে হচ্ছে জর্জেট টাইপ। গোল্ডেন সুতো এবং হালকা পাথরের কাজ করা অসাধারণ একটি গাউন। কাপড়টা খুব সফট আর তেমন ভারী ও নয়। কিন্তু অসাধারণ জরি সুতোর নকশা করা।
ড্রেসের উপর হাত বুলিয়ে আমার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। আবারো কানে প্রতিধ্বনি ভেজে উঠলো,
--- যাও ড্রেসটা গিয়ে পড়ে এসো, ফিটিং আছে কিনা দেখতে হবে।
আমি চমকে উঠলাম। মানে কি। বাইরে শোরুমে আমি ড্রেস চেঞ্জ করবো নাকি। জীবনেও না কক্ষনো না। আমি সাফয়ানের দিকে কিছুটা হেলে যেতেই সেও পিছিয়ে গেল। অসহ্য মার্কা ছেলে একটা। ওর কি মনে হয় ওর সাথে রোমান্স করার জন্যই ভরা বাজারের মধ্যে ওর দিকে হেলছি। হাত ধরে টেনে আমার দিকে এগিয়ে নিয়ে এসে কানে কানে বললাম,
--- আপনার কোন আক্কেল জ্ঞান নাই। আপনি আমাকে এই ভরা শোরুম এর মধ্যে কোথায় গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করতে বলতেছেন। জীবনেও এখানে ড্রেস চেঞ্জ করবো না আমি। কোথায় কি ক্যামেরা-টামেরা লাগানো আছে তার নাই ঠিক।
সাফয়ান বিরক্তির একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
--- সব আক্কেল আর কাণ্ডজ্ঞান তো তোমার মধ্যে ঠুসে ঠুসে ভরা আছে। তার মধ্যে থেকে কিছু ধার দাও। না হলে তো রাস্তাঘাটে বিপদে পড়বো।
এবার সে উল্টো আমার দিকে হেলে এসে বললো,
--- এটা আমার শোরুম। আম্মু পরিচালনা করে। এখানে ট্রায়াল রুম আছে। সেখানে ক্যামেরা বসানোর মত কান্ডজ্ঞানহীন কাজ আমি করবো না।
--- হুহ ভাব দেখ আমার শোরুম।(ব্যঙ্গাত্মকভাবে)
আমার সামনে থেকে একটা মেয়েকে ডেকে বলল,
--- আপনাদের ম্যাডামকে সাথে করে নিয়ে যান ।
আমি গাউনটা হাতে তুলে নিতে চাইলে মেয়েটা আমার হাতের থেকে গাউনটা নিয়ে নিল। তারপরে আমাকে নিয়ে গেল অন্য রুম।
কিছুক্ষণ পর....
দরজা খুলে রুম থেকে বেরিয়ে এসেছি। সাফওয়ান ফোনে মনোযোগ সহকারে কি যেন দেখছিল। মেয়েটা এগিয়ে গিয়ে বলল,
--- স্যার ম্যাডামকে নিয়ে এসেছি।
তার কথা সে আমার দিকে তাকালো। বোরকা হিজাব খুলে চুল ছেড়ে দিয়ে ফ্লোর ছুই ছুই গাউনটা দুহাতে আঁকড়ে ধরে হেটে এসে সাফওয়ানের সামনে দাঁড়ালাম। উনার দৃষ্টি আমার দিকে আটকে আছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত স্ক্যান করে দেখে ঠোঁট বাঁকিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে হাসলো।
হুহ। ওভাবে হাসার কি হলো । আমাকে কি দেখতে কার্টুনের মত লাগছে নাকি। এবার ঘুরে আমি আয়নার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। নিজেকেই নিজে পা থেকে মাথা অব্দি দেখে অবাক হয়ে গেলাম। মুখে আমার হাসি ফুটে উঠলো। মেয়েটা এসে কাঁধের এক সাইড থেকে গাউনের ওড়নাটা দিয়ে দিল। এগুলো ভালোভাবে সেট করে দিয়ে আবার সাফওয়ানের দিকে ঘুরিয়ে দাঁড় করিয়ে বলল,
--- স্যার মাশাল্লাহ ম্যাডামের গায়ের রং এর সাথে এই পোশাকটা এত সুন্দর ম্যাচ করেছে। বিয়ের লেহেঙ্গা পড়লেও মেয়েদের এত সুন্দর লাগে না। কোনরকম সাজ ছাড়াই এত সুন্দর লাগছে। সাজালে না জানি কত সুন্দর লাগে।
আমি সাফওয়ানের দিকে তাকালাম। উনার মুখে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া বুঝতে পারলাম না। মেয়েটা তো প্রশংসা করে ধুয়ে দিল আমাকে। কিন্তু যার প্রশংসা শোনার জন্য সামনে এসে দাঁড়ালাম সেই তো কিছু বলল না ধুর। সবই কপাল আমার।
পোশাক চেঞ্জ করে আসার পর। দেখলাম বেশ কয়েকটা শপিং ব্যাগ কাউন্টারের রাখা আছে। আমি মনে করলাম হয়তো তার আর পুতুলের জন্য কিনেছে। আমি স্বপনকে জিজ্ঞাসা করলাম,
--- পুতুল কোথায়? ওর জন্যও তো কিছু কিনতে হবে।
--- জন্য অলরেডি কেনা হয়ে গেছে। নিচে রবিনের সাথে আছে।
--- আর আপনার জন্য।
কিছু বললেন না আমার দিকে তাকিয়ে নিজের ক্রেডিট কার্ড টা রিসেপশনের মেয়ের দিকে এগিয়ে দিলেন। বিল পে করা হয়ে গেলে ব্যাগগুলো নিয়ে নেমে আসলেন নিচে।
মেয়েগুলো আমাকে সালাম দিয়ে আবার আসার জন্য আমন্ত্রণ জানালো। সালামের উত্তর দিয়ে সৌজন্যের হাসি হেসে চলে আসলাম।
গাড়িতে করে সোজা বাড়িতে।
_______🌺🌺_______
মাগরিবের নামাজ পড়ে এসে আদা চা তৈরি করলাম সবার জন্য। মাথাটা বেশ ধরেছে আমার। চা খেতে খেতে খালাকে বললাম,
--- আসতে কিন্তু দেরি হবে খালা। তুমি সব দরজা জানালা বন্ধ করে শুয়ে পড়ো। দরকার হলে চাবি দিয়ে খুলে ভেতরে আসবো। আর খেয়ে নিও কিন্তু রাত্রে। বললাম আমাদের সাথে যেতে কিন্তু তুমি তো যাবা না।
---- নারে মা। এমনিতেই আমি কাজের মানুষ। এখানে যা পাচ্ছি এখানে এই অনেক।
--- হুম। আমার বাপের বাড়ি যাওয়ার সময় দেখো তোমাকে কিভাবে পাকড়াও করে নিয়ে যায় আমি। তখন এমা না আমি যাব না। কোন কিছুই শুনবো না।
খালা আমার কথা শুনে হেসে দিয়ে বললেন,
--- আচ্ছা সে পরে দেখা যাবে। তুই যা গিয়ে রেডী হয়ে নে।
--- আচ্ছা।
আমি উপরে চলে আসলাম। এসে দেখি সাফওয়ান ল্যাপটপে বসে কি যেন করছে। আমাকে দেখে কিছু না বলে আবার কাজে মনোযোগ দিল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সাতটা বেজে গেছে। আমি ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। আমি বের হতেই সাফওয়ান ওয়াস রুমে গেল। ব্যাগ থেকে কালো রংয়ের সেই গাউনটা বের করলাম। তার সাথে ম্যাচিং ব্ল্যাক হিজাব রয়েছে। চেঞ্জিং রুমে গিয়ে পরে আসলাম। মুখে ক্রিম। ও হালকা পাউডার মেখে নিলাম চোখে হালকা করে কাজল। ঠোঁটে হালকা লিপ বাম । ব্যাস আমার সাজগোজ কমপ্লিট।
তখনই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসলেন সাফওয়ান পরনে শুধু ব্লাক জিন্স প্যান্ট আর গলায় টাওয়েল ঝুলছে। খালি গায়ে তাকে এই প্রথম দেখলাম । আমি চোখ নামিয়ে নিলাম কেমন জানি সারা শরীরের মধ্যে একটা শিহরণ বয়ে গেল। দ্রুত চলে আসলাম পুতুলের রুমে।
________🌺🌺_______
বাড়িটার উপরে বড় বড় করে লেখা "সায়েম-সাইমা" ম্যানশন। সাফওয়ান গেটের সামনে গাড়ি থামিয়ে দুইবার হর্ণ দিতেই দারোয়ান এসে গেইট খুলে দিল।
তারপর গাড়িটা পার্কিং লটে গিয়ে থামলো। সাফওয়ান নিজে নেমে পুতুল এবং আমাকে নামিয়ে গাড়িটা লক করে দিলো।
নিজের পরনের কালো কোটটা দু হাতে ঠিক করে নিয়ে পুতুলের হাত ধরে মেইন ডোরের কাছে গিয়ে ডোর বেল বাজালো। কিছুক্ষণ পর দরজাটা ভাবি খুলল। ভাবিকে দেখে আমি কিছুটা অবাক হলাম। পরনে টাইট ফিট সেলোয়ার কামিজ। ওড়নাটাও গলায় ঝুলছে।
এমনি সময় তো ঘরের মধ্যে শাড়ি পড়ে থাকে এখানে এসে এত পরিবর্তন। ভাবি দরজা খুলে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমাদের ভিতরে আসার জন্য বললেন। সাফওয়ানের দিকে তাকালাম তার চেহারা একদম ভাবলেশহীন।
ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে ভাবি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন,
--- আসতে এত দেরি হল কেন? বাহিরে গিয়েছিলে বুঝি?
উত্তরে আমি শুধু হাসলাম।
আমরা সোফায় গিয়ে বসলাম। বড় ভাইয়া আমাদের পাশে এসে বসলেন। দুই ভাই নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। ভাবি গিয়েছিলেন রান্নাঘরে। কিছুক্ষণ পরে ফিরেও এলেন। হাতে একটা ট্রে। আমাদের সামনে রাখলেন। জুসের গ্লাসটা আমাদের হাতে ধরিয়ে দিলেন। সাফান ভাবিকে জিজ্ঞাসা করলেন,
--- সায়েম কী এখনো হসপিটাল থেকে আসেনি।
--- না । কিন্তু ফিরছে বাসায় রাস্তাতে আছে। আমি বলেছি তোমরা আসছো তাই আজ তাড়াতাড়ি ফিরছে।
তখনই দোতলার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসলো একটি মেয়ে । দৃষ্টিটা আমাতে নিবদ্ধ। মুখে লেগে আছে তাচ্ছিল্যের হাসি। কিন্তু কেন....!
১১তম পর্ব🍂
আমার সামনে সোফায় পায়ের উপর পা তুলে আমার মুখোমুখি বসে আছে সেই অদ্ভুত মেয়েটি। নজরটা এখনো আমাতেই নিবন্ধ। মাঝে মাঝে আবার আড়চোখে সাফওয়ানকে দেখছে সে।
ওর দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পারছি না আমি। আমাকে এভাবে দেখার কি আছে। তার সাথে আমার প্রথম বার দেখা হচ্ছে। কিন্তু তার দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে সে আমার উপর খুব রাগান্বিত।
আমিও ওকে পর্যবেক্ষণ করলাম। পরনে জিন্স আর উপরে ব্লু কালারের কুর্তি। নাম মাত্র একটা ওড়না স্কাপ এর মত গলায় জড়িয়ে রেখেছে। চুলগুলো লেয়ার কাট করা। পাশ্চাত্যের ছোঁয়া তার সর্বাঙ্গে।
আমার ভাবনার ভেতরে একটা সুমিষ্ট সালামের ধ্বনি কানে এসে লাগল। ধ্যান ভাঙতে সামনে তাকিয়ে দেখলাম মেয়েটি হাসছে। আমিও প্রতিদানে মুচকি হাসলাম। তারপর আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
--- হাই আমি সাইমা।এন্ড ইউ?
ভাবিকে দেখলাম তাড়াতাড়ি গিয়ে সাইমার পাশে দাঁড়ালো। আমার দিকে তাকিয়ে ইতস্তত ভাবে হালকা হেসে সাইমাকে বলল,
--- সাইমা ও তোমার ভাবি হয়। ভাবি বলে সম্বোধন কর।
সাইমা অবাক হওয়ার ভঙ্গিমা করলো। তারপর বলল,
--- উপস্ সরি আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। তা কেমন আছো ভাআআআবি।
তার বলার ধরন শুনে আমি ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকালাম। মানছি ননদ ভাবির সম্পর্ক একটু কৌতুক পূর্ণ হয়। কিন্তু আমি তার কন্ঠে স্পষ্ট তাচ্ছিল্যের আভাস পেয়েছি। ভাবির দিকে তাকালাম ভাবির মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। থমথমে চেহারা। সায়মার দিকে তাকিয়ে বললাম
--- জি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
সাইমাকে দেখলাম সাফয়ানের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল,
--- ভালো, ইনফ্যাক্ট খুব ভালো।
আমিও তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সাফওয়ানের দিকে তাকালাম। দেখলাম তিনি নজর সরিয়ে ভাইয়ার সাথে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
সাইমা সোফা থেকে কিছুটা সরে গিয়ে সামনে ঝুঁকে সাফওয়ান কে জিজ্ঞাসা করল,
--- কেমন আছো সাফওয়ান?
আমি চমকে উঠলাম। এত দরদ মাখানো সম্বোধন...! ওকে কেন করলো? বুকের মধ্যে কেমন চিন চিন ব্যথা করে উঠলো। খারাপ লাগলেও বাহ্যিক দিক থেকে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে আমি সাইমা কে বললাম,
--- যতদূর বুঝতে পারছি সাফওয়ান তোমার বয়সে বড়। তার উপর সম্পর্কে তোমার ভাই হয় তাই অবশ্যই তোমাকে ভাইয়া সম্বোধন করা উচিত তাই না সাইমা...!
সাইমা আমার দিকে কেমন ঝলসানো দৃষ্টিতে তাকালো। আমাকে সায়মার দিকে এক নজরে তাকিয়ে থাকতে দেখে সাফওয়ান বলে উঠলেন,
--- কল মি ভাইয়া। তোমাকে কতবার বলেছি সাইমা। সোজা কথা সোজাভাবে বুঝতে পারো না তুমি তাই না।
সাইমা গাল বাঁকিয়ে হেসে সোফায় হেলান দিয়ে বলল ,
--- হ্যাঁ তুমি তো আমার ভাই লাগো। তা কবে থেকে বলতে পারো। আমি ত....
ভাবি সাইমাকে কথার মাঝে থামিয়ে দিলেন। আমার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে বললেন।
--- এটা কোন ধরনের মশকরা সাইমা। মানছি সাফওয়ান অনেকদিন পরে এসেছে এই বাড়িতে। ভাই ওর পিছনে লাগছো। কিন্তু এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। তুমি তো কাজ করছিল উপরে, তা নিচে আসলে কেন? কোন দরকার ছিল।
সাইমা ভাবীর দিকে তাকিয়ে বলল,
--- কফির জন্য এসেছিলাম। নিচে নেমে দেখি আমাদের অনারেবল গেস্টরা এসে গেছে। তাই তাদের সাথে একটু দেখা করতে এলাম। কতদিন পরে আমাদের দেখা হচ্ছে তাই না সো কল্ড ভাইয়া।
ভাবি একপ্রকার সাইমাকে জোর করে দাঁড় করিয়ে বলল,
--- তুমি ওপরে যাও আমি তোমার জন্য কফি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
--- নো থ্যাংকস। কফির নেশা চলে গেছে আমার।
--- যাও তুমি ওপরে যাও আমি কফি পাঠিয়ে দিচ্ছি। খেয়ে রেস্ট নাও সারাদিন তো কম্পিউটারের সামনে বসে থাকো। যাও গো।
একপ্রকার খেলে সাইমাকে ওপরে পাঠিয়ে দিল ভাবি। ভাবি কেমন জড়তার মধ্যে আমতা আমতা করে বললেন,
--- কিছু মনে করো না প্রীতি। ও একটু ওরকমই। আসলে ফরেন কান্ট্রিতে থাকে তো। আমাদের লাইফ স্টাইল ওঠাবসা কথাবাত্রা সাথে ওর বিস্তার ফারাক আছে।
কথাগুলো বলে এক প্রকার আমার সামনে থেকে কেটে পড়লেন ভাবি।
ড্রয়িং রুমের পরিবেশটা কেমন থমথমে হয়ে গেছে। সাইমার বলা প্রত্যেকটা কথা আমার কানে বাজছে। মেয়েটার প্রতিটা কথা রহস্য পরিপূর্ণ। ভাবি ও কেমন ব্যাপারটা যেন ধামাচাপা দিতে ব্যস্ত। তাহলে কি সাইমা এবং সাফনের মধ্যে কোন অন্য রকম সম্পর্ক ছিল। যেটা তারা আমাকে জানাতে চাইছে না। সেটা কি কোন গভীর সম্পর্ক। না না এমন কিছু থাকলে তো আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল না।
বিয়ের আগে মানুষের পছন্দ থাকতেই পারে। সাফওয়ানের থাকলেও সেটা তো এখন অতীত। ওর বর্তমান তো শুধু আমি। সাফওয়ান বলেছিল আমাকে ।
আর সাফওয়ান ও তো ওকে ধমকে বলল ভাইয়া ডাকার জন্য। তারমানে সাফওয়ানের মনে সায়মার জন্য কিছুই নেই। হ্যাঁ নেই ।কিছু নেই ওর মনে।
অনেক কষ্টে নিজেকে অনেক কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছি কিন্তু তারপরও বারবার মনের ভিতরে একটা ভয় মাথা ছাড়া দিয়ে উঠছে। কলিজাটা খামছে ধরছে একটা বিষয়। সাফওয়ানকে আমার থেকে কেড়ে নেবে না তো। না না সম্পর্কেও আমার স্বামী হয়। ওর সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে আছি আমি। স্ত্রীর কাছ থেকে তার স্বামীকে কেড়ে নেওয়া এত সহজ ব্যাপার নয় । সাফওয়ান শুধু আমার। কাউকে দেবো না আমি ওকে।
অস্থিরতায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল আমার। পাশে তাকিয়ে দেখি। সাফওয়ান এখনো ভাইয়ের সাথে কথা বলছে। হাতটা সুপার হ্যান্ডেলের উপরে রাখা। ইচ্ছা করছিল খুব জোরে করে আঁকড়ে ধরি তাই হাতটা। কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে নিজেকে সংবরণ করলাম।
উঠে দাঁড়ালাম। এখানে বসে থাকতে যেন আরও অস্বস্তি লাগছে।
এরমধ্যে ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করলো একটি ছেলে। উচ্চতায় সাফওয়ান এর মত হবে। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণ। ফরমাল ড্রেস আপ। এক হাতে এপ্রোন ঝুলছে। ভারী কণ্ঠস্বরে আমি তার দিকে তাকিয়ে পরলাম।
--- হেই ব্রো হোয়াটস আপ?
সাফওয়ানকে দেখলাম উঠে গিয়ে তৎক্ষণাৎ জড়িয়ে ধরল। ছেলেটির পিঠ চাপড়ে বললো,
--- গ্রেট তোর কি খবর বল।
আমার আর কি খবর সকালে উঠে রোগীর মুখ দেখে আমার দিন শুরু হয় রাতটাও রোগীর মুখ দেখে এসে শেষ হয়। জীবনটা পুরো রোগী ময় হয়ে গেছে আমার।
কেন জানিনা এত অস্থিরতার মধ্যেও তার কথা শুনে আমার হাসি পেল। ছেলেটার দিকে এবার ভালো করে দেখালাম আমি। মুখটা একটু লম্বাটে কিন্তু অবয়বটা অসম্ভব সুন্দর। যা তার গায়ের রং কে হার মানিয়েছে। হাসতে হাসতে হঠাৎ তার নজর আমার দিকে পরল। সে এক নজরে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। তা দেখে আমি তাড়াতাড়ি নজর সরিয়ে নিলাম।
সাফওয়ানকে ছেড়ে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
--- কেমন আছেন আপনি?
আমি তার দিকে নজর তুলে তাকালাম। হালকা হেসে বললাম,
--- জি আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
আবারো মুচকি হেসে বললেন,
আমি আপনার দেওর হই। আপনার বর আমার ভাই প্লাস বেস্ট ফ্রেন্ড হয়। আপনিও কিন্তু আমার ফ্রেন্ড হতে পারেন। কি হবে নাকি ফ্রেন্ড।
আমি অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। প্রথম দেখায় এমন আবদার কেউ করে নাকি। আমি কোন রকমে তার দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম,
---- আচ্ছা ঠিক আছে। আপনারা বসে গল্প করুন আমি একটু পুতুলকে দেখে আসি।
আমার থেকে পেছনের সরে গিয়ে হাত দিয়ে ইশারা করে বলল,
ইহাহ সিওর ।
আমি তাড়াতাড়ি চলে আসলাম সেখান থেকে। পেছনে তাকালে হয়তো কারোর গাড়দৃষ্টির সাক্ষী হতাম।
__________🌺🌺_________
হাঁটতে শুরু করলাম। এসে ধরে পুতুলটা সেই উপরে চলে গেছে তার আর কোন পাত্তাই নেই। তাই পুতুলকে খুঁজতে খুঁজতে দোতলায় উঠে চলে আসলাম। দোতালার দরজা দিয়ে ঢুকতেই দেখলাম একটি করিডোর। বাহ বেশ লম্বা করিডোর একটা। যা প্রত্যেকটা রুমের সামনের বারান্দা কে একসাথে যুক্ত করে তৈরি করা হয়েছে।
গ্রিল ধরে আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগলাম। বাইরে তাকিয়ে দেখলাম পরিবেশটাও অত্যন্ত মনোরম। যান্ত্রিক শহরের মধ্যেও যে এমন একটা জায়গা আছে সত্যি আমার কল্পনায় ছিল না।
করিডোরটা বাড়ির পেছনের সাইডে হওয়া দরুন গ্রিল দিয়ে একটা মাঠ দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত এটা স্কুল মাঠ। কারণ রাতের বেলায় দুপাশে দুটো বাল্ব জ্বালিয়ে লম্বা করে জাল টানিয়ে নিয়ে রেকেট খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে একগুচ্ছ ছেলে।
আমারও ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেল। ছোটবেলায় আমরাও এমন হালকা হালকা শীতের আমি যে রেকেট নিয়ে দৌড়াতাম মাঠে। সন্ধ্যার পরে যেহেতু বাইরে থাকা সম্পূর্ণ নিষেধ ছিল তাই বিকেল বেলায় পুরো মাঠ দাপিয়ে বাড়ানো হতো এর রেকেট নিয়ে। তা নিয়েও মায়ের সে কত বকাবকি। আমি আপন মনে হেসে উঠলাম।
সে দিক থেকে নজর ঘুরিয়ে সামনে এগোতেই দেখলাম একজন ভদ্রমহিলা আমার থেকে কিছুটা দূরত্বে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
আমি কিছুটা ভরকে গেলাম। এতক্ষণ মনোযোগ সহকারে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম বলে উনার উপস্থিতি আমি টের পাইনি। আমি প্রথম এসেছি এই বাড়িতে। কাউকে চিনি না। আমাকে কি বলে সম্বোধন করব বুঝতে পারছি না।
আমি তাকাতে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে তিনি মুচকি একটি হাসি দিলেন। তার বিনিময় আমিও হাসলাম। আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। তারপর একটা মিষ্টি কণ্ঠস্বর বললেন,
--- আমার সাফু বাবুর বউ তুমি তাই।
আহা কেমন আদুরে সম্মোধন। আমি মুচকি হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম। তারপর তিনি আমাকে কাছে টেনে কপালে চুম্বন দিয়ে বললেন,
--- আমি সাফওয়ানের ছোট খালামণি হই। সাথে তোমারও। আমার সাথে এসো।
বলে আমার হাত ধরে করিডোরের মাথায় একটা রুমে নিয়ে গেলেন। রুমে ঢুকেই কেমন একটা শান্তি অনুভব করলাম। ছিমছম সুন্দর বড় একটি শয়ন কক্ষ। আসবাবপত্র দেখে মনে হচ্ছে তিনি যথেষ্ট সৌখিন রুচিসম্পন্ন মানুষ। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বাইরে একটি অপ্রয়োজনীয় জিনিস দেখলাম না তার ঘরে।
আমাকে তার বিছানায় বসিয়ে বললেন,
--- একটু অপেক্ষা করো মামনি আমি আসছি।
আমিও সম্মতি জানালাম। তিনি উঠে গেলেন ডবল পার্টের আলমারির কাছে। কিছুক্ষণ পরে আলমারি থেকে একটি কাঠের বাক্স বের করলেন। আলমারিটা ভালো করে লক করে কাঠের বাক্সটা নিয়ে এসে আমার সামনে বিছানায় বসলেন।
আমি খালামণিকে উদ্দেশ্যে বললাম,
--- কি আছে এতে খালামণী?
খালামণি বেশ রহস্য করে বললেন,
--- তোমার বরের গুপ্তধন।
১২ তম পর্ব🍂
গুপ্তধন..!
হ্যাঁ গুপ্তধন। দাঁড়া তোকে দেখাচ্ছি।
বলে মাঝারি সাইজের কাঠের বাক্সটা খুললেন। আমি একগাদা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছি বাক্সটার দিকে। তিনি প্রথমে বাক্সের উপরে থাকা বাচ্চাদের চার-পাঁচটা জামা কাপড় বিছানার উপর রাখলেন। বোঝা যাচ্ছে অনেক আগের জামাকাপড় কিন্তু খুব যত্ন করে গুছিয়ে রাখা হয়েছে।
জামা কাপড় গুলোর উপর হাত বুলিয়ে ভাবতে লাগলাম কত ভালোবাসা জড়িয়ে আছে এগুলোতে। খুটুর খুটুর শব্দ তুলে একটা ঝনঝনি দুটো ছোট খেলনা গাড়ি ছোট একটি বল বিছানার উপরে রাখলেন। আমি খালামণির মুখের দিকে তাকালাম দেখলাম এক চিলতে বাচ্চা সুলভ হাসিমুখে লেগে আছে।।
মনে মনে হয়তো এগুলোরই স্মৃতিচারণ করছেন শেষে একটা খাম বের করে বিছানার উপরে রেখে বাক্সটা একপাশে সরিয়ে রাখলেন। তারপর আমার কাছে এগিয়ে এসে বসলেন। জামা কাপড়গুলো হাতে তুলে নিয়ে বললেন,
--- এই পোশাক খেলনা যা যা দেখছিস সবকিছু আমার সাফু বাবুর। আমি সবকিছু খুব যত্ন করে তুলে রেখেছি তার বউয়ের জন্য।
বলে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। জিনিসগুলো সব আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন,
--- জানিস ও একদম আমার ছেলের মত এক কথায় বলতে গেলে ও আমার বড় ছেলে।
কথাগুলো বলে কিছুটা দম নিলেন আমি মনোযোগ সহকারে তার কথা শুনছি। হাফ ছেলে বললেন,
--- বুড়ো হয়ে গেছি বুঝলি? একসাথে অনেক কথা বলতে পারিনা। তোকে তুই করেই বলছি কিছু আবার মনে করিস না।
আমি মুচকি হেসে কোলের উপরে রাখা তার হাত জোড়া আঁকড়ে ধরে বললাম,
--- এতক্ষণে মনে হচ্ছে আপন কারোর কাছে এসেছি তোমারিতো মেয়ে তোমার যা মন চায় তাই বলে ডাকো। শুনতে ভালো লাগছে আমার।
বিনিময় তিনিও হেসে বলতে শুরু করলেন,
--- সাফু যখন মেজ আপার গর্ভে ছিল প্রথম ছয় মাস মেজ আপা সুস্থ থাকলেও ধীরে ধীরে তার স্বাস্থ্যের অবনতি হতে শুরু করে। অতিরিক্ত বমি মাথা ঘোরা ইত্যাদি তীব্র আকার ধারণ করে। ওয়াশরুমে যাওয়া আসা ছাড়া পুরোটা সময় বিছানায় শুয়ে বসে দিন পার করতে হতো তাকে।
দুলাভাই আপাকে নিয়ে অনেক চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। উনার তো ব্যবসা ছিল। উনার পক্ষে আপাকে সর্বক্ষণ খেয়াল রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। আর পাশাপাশি আবার সাকলাইনও তখন ছোট ছিল মাত্র ছয় কি সাত বছরের হবে সে। দুজনকে নিয়ে দুলাভাই একেবারে অথৈ সাগরে পড়েছিল।
কাজের লোকের ভরসায় আপাকে আর সাকলাইনকে রাখতে চাইছিলেন না। আপন কারোর কাছে রাখলে তিনি চিন্তামুক্ত থাকবেন। দুলাভাইয়ের পরিবারেও তেমন কেউ ছিলনা যে তাদের এখানে এসে আপাকে দেখাশোনা করবে। আমাদের বড় আপা তখন ঢাকায় ছিলেন। পক্ষেও সংসার রেখে আসা সম্ভব ছিল না।
কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় তখন তোর খালুর পোস্টিং হয় খুলনায়। আমার সামিরার বয়স তখন মাত্র তিন বছর। খুলনায় বদলি হয়ে এসে আবার কথা শুনে আর আমি এক মুহূর্ত দেরি করিনি। ওই বাড়িতে চলে যাই।
কাজের লোকের কাজ বুঝলি। রান্নাবান্নাও ভালো করে করে না। সাকলাইনের শারীরিক অবস্থাও তখন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সারাদিন দেখতো মা অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে ও ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করত না। আমি যাওয়াতে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করে বলে,
--- খালামণি আমার মা সুস্থ হয়ে যাবে তো। ওরা সবাই বলছে আমার মা নাকি মরে যাবে।
খালামণি আচল দিয়ে চোখ মুছলেন। আমার চোখের কোনায় পানি জমা হলো। তুমি আবার বলতে শুরু করলেন,
--- আমার সারাদিন কাটতো আপার পিছনে। তাকে সময় মত খাওয়ানো দাওয়ান। ওষুধ দেওয়া। ডাক্তারের দেখানো অনুসারে ব্যায়াম করানো। সবগুলো আমিই করাতাম।
সাকলাইন ছিল একদম শান্ত একটা ছেলে। ওর পেছনে আমার কিছুই করা লাগত না। আরো চোখের সামনে দেখতো মা অসুস্থ সে নিজের সব কাজ নিজে করতো। আমি শুধু ওকে একটু খাবার বেড়ে দিতাম।
আর আমার সামিরা মানে তোর বড় ভাবি ছিল সাকলাইনের একদম বিপরীত। বদমাইশের হাড্ডি ছিল একেবারে। কিন্তু সাকলাইনের বিশাল বড় ভক্ত ছিল। সাকলাইন যা বলতো তাই শুনত।
এমনকি সাকলাইনের হাতে খেতে পর্যন্ত। ওর সব সময় লক্ষ্য ছিল সাকলাইনকে ফলো করা। তারপর দুজনের ডাক্তারি পাশ করার পরে গত ডিসেম্বর ওদের বিয়ে দেওয়া হয়। একই সাথে সাকলাইনের ও বি...
কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেলেন খালামণী। চমকে তার দিকে তাকিয়ে বললাম। সাফওয়ানের বিয়ে নিয়ে কিছু বলছিলেন।
--- থেমে গেলেন কেন?
--- আরে না কিছু না। তারপরে সাফওয়ান যখন পৃথিবীতে আসে। সি সেকশনের মাধ্যমে ডেলিভারি হয়। আপা জরায়ুতে কিছুটা সমস্যা দেখা দিয়েছিল। তাই তার পক্ষে বাচ্চা সামলানো মোটেও সম্ভব ছিল না। সাফওয়ান বলতে গেলে সে শুরু থেকে এক বছর আমার কাছেই ছিল।
আমি ওর দেখাশোনা করেছি। আমার কোলেই ওর বেড়ে ওঠা। সাফু বাবু বলে ডাক দিলে হু হু করে শব্দ করতো। খুব দুষ্টু ছিল জানিস। আমার কোলে কাউকে দেখতে পেত না। উনি ঠোঁট ফুলিয়ে হাউ মাউ করে কান্না জুড়ে দিত। বলে হেসে দিলেন তিনি।
আমার ছেলে বাবুর বড্ড শখ ছিল জানিস যা ওই প্রথম মিটিয়ে ছিল আমাকে। মনে প্রানে ওকে আমার বড় ছেলে মনে করি।
তারপর সাফওয়ানের যখন ছয় মাস বয়স তখন জানতে পারি সায়েম আমার গর্ভে। আপাও ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে গেল এক বছর পরে আমিও বাড়ি চলে আসলাম। স্মৃতি হিসেবে এগুলো সব আমি আমার সাথে নিয়ে এসেছিলাম। চিন্তা করেছিলাম এগুলো যখন ওর বউ আসবে তখন তার হাতে দিয়ে তার ছোটবেলার সব ঘটনা বলব। আজ আমার স্বপ্ন পূরণ হয়ে গেছে।
তারপর বিছানা হাতে খামটা আমার কাছে নিয়ে এসে বলল,
--- খুলে দেখে এতে ওর ছোটবেলার অনেক ছবি আছে।
আমিও খামটা খুলে একে একে ছবিগুলো বের করলাম। কোনটাই দোলনায় বসে আছে। আবার কোনটাই ক্যাপ মাথায় দিয়ে স্টাইল দিয়ে ভ্রু কুঁচকে বসে আছে। আবার কোনটা পাঞ্জাবি পড়ে আছে। মাথায় একটা খানদানি টুপি। আমি হেসে দিলাম।
জিব বের করে ভেঙাচ্ছে কাউকে। দাঁতবিহীন কি সুন্দর হাসি। সবগুলো ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে তুলেছে। বাব্বাহ। ছোটবেলা থেকেই আমার বর বেশ স্টাইলিশ ছিল।
সেকালে তো আর অত ক্যামেরা ছিল না। যে ভিডিও টিডিও করে রাখবো। যা ছিল তাই দিয়ে যতটুকু স্মৃতি সংরক্ষণ করা গেছে আর কি। আমি খালার দিকে শ্রদ্ধা ভরে তাকিয়ে বললাম,
--- অসংখ্য ধন্যবাদ খালামণী এতো সুন্দর সুন্দর স্মৃতি গুলো সংরক্ষণ করে রাখার জন্য।
এরপরে খালামনির সাথে আরো অন্যান্য বিষয় নিয়ে অনেক কথা হলো। পরিবার-পরিজন সম্পর্কে সবকিছু জানলেন তিনি। এছাড়াও সাফওয়ানের সম্পর্কে আরো অনেক কথা হলো।
একটা প্রশ্ন রয়েই গেল বিয়েতে উনাকে দেখিনি কেন? যদিও বিয়েটা ছোট পরিসরে হয়েছিল। তারপরেও সাফওয়ানের জীবনে উনার অবদান অনেক। উনি বিয়েতে আসেননি কেন?
আচ্ছা যা এবার অনেকক্ষণ তোকে আটকে রেখেছি। ওদিকে হয়তো তোকে আর আমাকে খোঁজা শুরু করে দিয়েছে । খাওয়া দাওয়া করতে হবে তো নাকী।
আমি বিছানা ছেড়ে উঠতে নিচ্ছিলাম।সব কিছু গুছিয়ে খালামণি কাঠের বাক্সটা আমার হাতে এগিয়ে দিলেন । আমি খালামণিকে বললাম,
--- আপাতত এটা তোমার কাছেই রাখো খালা মনি। যাওয়ার সময় আমি তোমার কাছ থেকে এসে নিয়ে যাব।
--- আচ্ছা।
বলে খালামণি বাক্সটা বিছানার একপাশে রেখে দিলেন। তারপর হঠাৎ আমার হাত ধরে টেনে আবার বিছানায় বসিয়ে দিলেন। আর দুই হাত টেনে ধরে দুটো স্বর্ণের বালা পরিয়ে দিলেন আমাকে। আমি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতে তিনি বললেন,
--- এগুলো আমি আমার সাফু বাবুর বউয়ের জন্য বানিয়েছিলাম। আজ পরিয়ে দিলাম। মাশাল্লাহ তোকে খুব সুন্দর লাগছে।
মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন আর বললেন ,
--- যাওয়ার সময় আরো একবার দেখা করে যাস আমার সাথে। আরো কিছু বলার আছে তোকে।
_________🌺🌺_______
খালামণির রুম থেকে বেরোতে অনেক দেরি হয়ে গেল আমার। ব্যালকনি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নিচে যাচ্ছিলাম হঠাৎ একদম কর্নারের রুমটা থেকে কেমন যেন চাপা চিল্লাপাল্লার আওয়াজ পেলাম। এগিয়ে যেতে শুনতে পেলাম রুমের ভেতরেই তার সাথে যেন সাইমা চিল্লাচিল্লি করছে।
কান পেতে শুনলাম কিন্তু অপর পাশের মানুষের কোন আওয়াজ আমার কানে আসলো না। ফোনে কারো সাথে চিল্লাচ্ছে। এই মেয়েটার মাথায় সমস্যা আছে নাকি? কি জানি বাবা...!
সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নামতে নামতে দেখলাম ড্রয়িং রুমের সোফা সেটের ওপরে শ্যাম বর্ণের সেই পুরুষ বসে আছে। কি যেন একটা নাম হ্যাঁ সায়েম। দেখেই বোঝা যাচ্ছে চেঞ্জ করে এসেছে। কোলে বসে আছে পুতুল। কি নিয়ে জানি কথা বলছে আর হাসাহাসি করছে।
আমি নিচে নেমে দাঁড়াতেই পুতুল তার কোল থেকে নেমে সোজা দৌড়ে এসো আমাকে জাপটে ধরল।
--- তুমি কোথায় ছিলে প্রীতিলতা?
আমি ভারী অভিমানের সুরে বললাম,
--- এখানে কারোর প্রীতিলতা থাকে না। ম্যাডাম আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।
ছেড়ে দিয়ে পুতুল আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ঠোট ফুলিয়ে কান ধরে বলল,
--- সরি প্রীতিলতা। আমার ভুল হয়ে গেছে। তোমাকে ছেড়ে আর কোথাও যাবো না। আমি খেলে এসে দেখি তুমি এখানে ছিলে না। তারপর সায়েম ভাইয়া বলল তুমি নাকি উপরে গেছো। আমি যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু ও আমাকে ধরে এখানে বসিয়ে রেখেছে। তুমি নাকি কিছুক্ষণ পরে নেমে আসবে।
পুতুলের কথা শুনে আমি চোখ ফিরিয়ে সায়েমের দিকে তাকালাম। তাকাতেই তার সাথে আমার দৃষ্টি বিনিময় হল। এখন তিনি আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। চোখ সরিয়ে নিয়ে সাফওয়ান কে খুঁজলাম। কোথায় তিনি?
ভাবি এসে তাড়া দিতে লাগলো ডাইনিং এ খাবার দেওয়া হয়েছে। আমি পুতুলের হাত ধরে ডাইনিং রুমে গিয়ে বসলাম। সায়েম এসে আমাদের অপজিটে বসলেন।
কিছুক্ষণ পর দেখলাম সাফওয়ান এসে দাঁড়ালেন ডাইনিং রুমে। উনাকে দেখে মনে হচ্ছে একপ্রকার ঝড় বয়ে গেছে ওনার উপর দিয়ে। পরনের কোটটা খুলে বাম হাতে ঝোলানো। আমি ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকালাম। আমার দিকে তাকিয়ে সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিয়ে সায়েমের পাশে বসে পড়লেন। সায়েম টেবিলের উপরে দুই হাত ভাঁজ করে টেবিলের উপরে ভর দিয়ে সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
--- কি ব্র? রেসলিং খেলে এসেছো নাকি? চেহারার এ অবস্থা কেন?
তিনি বিড়বিড় করে বলল,
--- সে রকম কিছুই
আমি কৌতূহল দমন করতে না পেরে বলেই ফেললাম,
--- মানে..!
হঠাৎ প্রশ্ন করায় সামনে দুইজনই আমার দিকে তাকিয়ে পরলো। সাফওয়ান কিছু বললেন না। চুপচাপ খেতে শুরু করলো।আমিও আর কথা বাড়ালাম না। পুতুল খেতে খেতে বলল,
--- আমি আর খাব না। এগুলো তোমার রান্নার মত মজা হয়নি।
সায়েম খাওয়া থামিয়ে পুতুলের উদ্দেশ্যে বলল,
--- কেন তোমার প্রীতিলতা কি খুব সুন্দর রান্না করে।
পুতুল অতি উৎসাহের সাথে বলল,
--- হ্যাঁ তো। ও খুব ভালো রান্না করে।
--- তাহলে তো খেতেই হচ্ছে তোমার প্রীতিলতার হাতের রান্না।
সবাই প্রায় টুকটাক কথা বলছে আর খাওয়া দাওয়া করছে। কিন্তু সাফওয়ান একদম নিশ্চুপ হয়ে প্লেটের দিকে তাকিয়ে এক মনে খেয়ে যাচ্ছে। আরেকটা জিনিস খেয়াল করলাম সাইমা ডাইনিং রুমে অনুপস্থিত। আমাদের সাথে খেতে বসেনি।
_____🌺🌺_______
খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই সোফায় গায়ে দিয়ে দিল। অনেকদিন পরে ভাইয়েরা সব এক জায়গায় হয়েছে। তারা নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ জুড়ে দিয়েছে। ভাবি সবার জন্য মিষ্টি দই আর কোল্ডড্রিংস নিয়ে এসেছে। খেতে খেতেই সবার কথা শুনছিলাম। হঠাৎ পুতুল দৌড়ে আমার কাছে এসে বলল,
--- খালামণি তোমাকে ডাকছে প্রীতিলতা।
আমি উঠে গেলাম। আমার জায়গায় বসে সাফয়ানের ফোন নিয়ে গেমস খেলতে শুরু করব। সিঁড়ি ভেঙ্গে দোতালায় উঠে গেলাম। হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ বাম হাতের কব্জিতে খুব জোরে টান পরল। ছিটকে পড়লাম আমি। পড়ে না গেলেও হাতে বেশ টান লেগেছে আমার। পেছনে হঠাৎ দরজা আটকানোর শব্দ পেলাম। আমি আতঙ্কিত হয়ে প্রশ্ন করলাম,
--- এ্যাই কে?
ধমকের স্বরে কেউ বলে উঠলো,
--- হুসসসস! একদম চুপ । জোরে আওয়াজ করবে না।
১৩ তম পর্ব🍂
সাইমা তুমি....!
সাইমা মুখে কোন কথা না বলে ধীরে ধীরে আমার কাছে এসে হেচকা টান দিয়ে উঠে দাঁড় করালো। হীর হির করে টানতে টানতে সোফার উপরে ফেলে দিল আমাকে। আবারো বাম হাতের কব্জিতে খুব জোরে ব্যথা পেলাম। ব্যথায় চোখ কুঁচকে গেল। এবার আমার ভারী রাগ হলো। দাঁতের দাঁত চিপে উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে বললাম,
--- তুমি আমার সাথে এমন করছো কেন। কি করেছি আমি?
--- কি করেছো তুমি? সবকিছু কেড়ে নিয়ে এখন বলছো কি করেছো?
এবার আমি ওর মুখের দিকে ভালো করে তাকালাম। বিধ্বস্ত লাগছে। চুলগুলো সব এলোমেলো। গায়ে ওড়না নেই। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। কেমন যেন পাগল পাগল লাগছে ওকে।
আমি কিছুটা দমে গেলাম। আমাকে চুপ হয়ে যেতে দেখে আরো বেশি করে তেড়ে আসলো আমার উপর। লোফার দুই হ্যান্ডেলের উপর হাত রেখে আমার ওপর ঝুঁকে জোরে চেঁচিয়ে উঠে বলল,
--- তুমি আমার জীবনটাকে নরকে পরিণত করেছ। সবকিছু কেড়ে নিয়ে এখন বলছ কি করেছ? কেন এসেছ আমাদের দুইজনের মাঝে? কী চাই তোমার?
টাকা তো। বড়লোকের ছেলে পেয়েছো কোটিপতি শশুর বাড়ি। আর কি চাই হ্যাঁ। আজীবন পায়ের উপর পা তুলে বসে খেতে পারব। লাইফ পুরাই সেট। লোভ সামলাতে পারোনি তাই না। যেই সুযোগ পেয়েছো অমনি চোখ বুঝে কোপ মেরে দিয়েছো।
আমি সাইমার কথা শুনে থমকে গেলাম। তার এই অপমানে জড়ানো কথাবার্তাগুলো বিষের মতো সারা শরীর জ্বালিয়ে দিল আমাকে। এমন মনে হচ্ছে যেন কানে কেউ গরম সীসা ঢেলে দিয়েছে। চোখ দিয়ে দু ফোটানো না জল গড়িয়ে গেল।
--- কী যা তা বলছো তুমি সায়মা। মুখ সামলে কথা বল।
সাইমা নিজের চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে দুহাতে মুখ ঢেকে বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল,
--- গা জ্বলছে তাই না। কথা শুনলে সবারই এমন গা জ্বলে। তোমার করতে কোন দোষ নেই আমি বললেই দোষ। আমি এতদিন জানতাম গরিবদের আর কিছু থাকুক আর না থাকুক আত্ম সম্মানবোধ আছে।
কিন্তু তোমার তো দেখে এই চেহারাটা ছাড়া আর কিছুই নেই। তা এই চেহারা দেখিয়ে কয়টা ছেলের মাথা ঘুরালে শুনি।
--- সাইমাআআআআআ..!
--- গলা নিচে নামিয়ে কথা বলো। লোভী আত্মমর্যাদাহীন কোন মেয়ের গলা উঁচু করে কথা বলার কোন অধিকার নেই। আসলে তোমাদের মত এরকম মেয়েদের জন্য আজ অনেক মেয়ের সংসার ভেঙে যাচ্ছে। অনেক মেয়ে তার প্রিয়জনকে হারাচ্ছে। যেমন আমি হারিয়েছি...!
আমার এবার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। অনেক হয়েছে। আমি এবার উঠে সাইমাকে এক ধাক্কা মেরে সোফায় উপরে ফেলে দিলাম। ডান হাতে সাইমার গাল চেপে ধরে বললাম,
--- মুখ সামলে কথা বলো সাইমা। না হলে পরের শব্দ উচ্চারণ করার জন্যই মুখটা থাকবে না। আর কিছু না জেনে না বুঝে কি যা তা বলে যাচ্ছ। মাথা ঠিক আছে তোমার? পাগল হয়ে গেছো নাকি?
সাইমা এবার ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। দুহাতে নিজের মাথার চুল শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ছিঁড়ে ফেলার মত করে ধরে বলল,
--- হ্যাঁ হ্যাঁ পাগল হয়ে গেছি আমি। নিজের সব থেকে প্রিয় মানুষটাকে হারিয়ে সত্যি পাগল হয়ে গেছি। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না। বিশেষ করে তোমাকে ওর পাশে মোটেও সহ্য হচ্ছে না আমার কেন এসেছ বলতো তুমি ওর লাইফে?
--- তারমানে তুমি সাফয়ানকে....!
--- হ্যাঁ ভালোবাসি। আর সাফওয়ান ও আমাকে ভালবাসে। ইনফ্যাক্ট গত ডিসেম্বরে আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল।
কথাটা কানে পৌঁছাই আমার সারা শরীর অবশ হয়ে গেল। হৃদপিণ্ড টা মনে হচ্ছে কেউ খামচে ধরেছে। স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট হচ্ছে আমার।সাইমা সাফওয়ানকে ভালোবাসে এর থেকেও বেশি পীড়া দিচ্ছিল এই কথা শুনে সাফয়ান ও সাইমাকে ভালোবাসে।
ওরা যদি একে অপরকে ভালোবাসে, আবার যদি গত ডিসেম্বরে বিয়ে হওয়ার কথা ও ছিল তাহলে বিয়ে হলো না কেন? মস্তিষ্কের নিউরন গুলো হঠাৎ সজাগ হয়ে আমাকে জানিয়ে দিল খালামণি ও গত ডিসেম্বরে সাফওয়ানের বিয়ে নিয়ে কিছু বলছিল। কিন্তু বলতে বলতে থেমে গেলে কিছু একটা লুকিয়ে গেলেন আমার কাছ থেকে তাহলে সাফওয়ানের সাথে সাইমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। তাহলে হলো না কেন কারণটা কি?
না আমি আর ভাবতে পারছি না মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে দুচোখের অশ্রু ও বহমান রয়েছে। আমি খাটের স্ট্যান্ড ধরে বিছানায় বসে পড়লাম পুরো রুম জুড়ে নীরবতা বিরাজ করছে কিছুক্ষণ পর পর হেঁচকি তুলে গুনগুন করে কান্নার আওয়াজ আসছে সাইমার। আর আমি তো কাঁদতে ভুলে গেছি।
আমি সায়মার দিকে তাকালাম সায়মা মুখ থেকে এখনো কাঁদছে আমি বিরষ গলায় তার দিকে প্রশ্ন ছুড়লাম,
--- এতই যখন ভালোবেসেছিলে দুজন দুজনকে ডিসেম্বরেও বিয়ে হওয়ার কথা ছিল তোমাদের তাহলে বিয়ে হলো না কেন?(লাস্টের লাইনটা বলতে গিয়ে আমার গলাটা ধরে গেল।)
সাইমা নিজেকে স্বাভাবিক করতে কিছুটা সময় নিল। চোখ মুছে জোরে দুটো শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলো,
--- বিয়েটা হয়নি আমার দোষে।
আমি ভুরু কুঁচকে তাকালাম সায়মার দিকে। তা দেখে সে বলল,
--- অবাক হচ্ছো তাই না। কিন্তু এটাই সত্যি আমার একটা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য সাফওয়ান আজ আমার থেকে অনেক দূরে চলে গেছে।
সোফায় হেলান দিয়ে শুয়ে পড়লো সাইমা। শূন্যদৃষ্টিতে ঘরের ছাদে তাকিয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে কোন স্মৃতির গহব্বরে তলিয়ে যাচ্ছে সে। কিছুটা জড়ানো কন্ঠে বলতে শুরু করলো,য়
--- ছোটবেলার সাফওয়ান ও ছিল আমার খেলার সাথী। দুই পরিবারের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকায় যাতায়াত ছিল বরাবর ভালো। মামনি মানে তোমার শাশুড়ি আমাকে খুব ভালবাসতেন। বলতে গেলে একদম নিজের মেয়ের মত যত্ন করতেন আমাকে।
শৈশব থেকে কৈশোরে পা দিয়েছিলাম সাফওয়ান এর হাত ধরে। আবেগ অনুভূতি প্রগাঢ় হতে শুরু করেছিল যার সমস্তটা জুড়ে ছিল সাফওয়ান। জীবনের প্রথম প্রেমের অনুভূতি বোঝো প্রীতি?
আমি দুঃখিত তোমাকে সাফওয়ানের বউ হিসেবে ভাবি সম্মোধন করতে পারছি না ইন ফ্যাক্ট আমি চাইছি না।
তা যা বলছিলাম। প্রথম প্রেমের অনুভূতিটা ও আমার তাকেই ঘিরে ছিল। চোখের সামনে এমন সুদর্শন টগবগে সদ্ব্য যৌবনে পা দেওয়া একটা যুবককে দেখে মনের ভিতরে আলাদা একটা শিহরণ জাগ্রত হত।
স্টপ ইট। আজেবাজে কথা রেখে আসল কথা বল।
সাইমা হেসে উঠলো শ্লেষের হাসি। আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
--- কেন বুকের বা পাশটা জ্বলছে নাকি? মনে হচ্ছে কেউ ছুরি চালাচ্ছে তাই না। এমনটাই মনে হয়।
পড়াশুনা, স্পোর্টস, ডিফারেন্ট টাইপস কম্পিটিশন কোনোটাতেই পিছিয়ে ছিলো না সাফওয়ান। ওর লাইফের একটাই গোল ছিল। নিজেকে সর্বোচ্চ চূড়ায় দেখা। আমিও পাগলের মতো ওকে ফলো করতাম।
কিন্তু সমস্যাটা বেঁধে ছিল এক জায়গায় এসে। কলেজ কমপ্লিট করার পর হঠাৎ খালু বেশ বড়সড় আবদার করে বসলেন ছেলেকে তিনি ম্যাজিস্ট্রেট অথবা জজ বানাবেন। তখন আমি সবে এসএসসি দিয়েছি।
কিন্তু সাফওয়ানের ইচ্ছা ছিল অন্যরকম। সে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চেয়েছিল। তার কারণ ছিল সে লন্ডন অথবা কানাডা সেটেল্ড হবে। যেটা আমারও ইচ্ছা ছিল। আমিও চিন্তা করেছিলাম বাইরের দেশে গিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং টা কমপ্লিট করব সাফোয়ানের সাথে।
খালুর ইচ্ছায় সাফওয়ান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় মেরিট লিস্টে অতি সম্মানজনক একটা স্থানে উত্তীর্ণ হয়। আইন বিভাগে ভর্তি হয় সে। সেখান থেকে আমাদের দুজনের মধ্যে দূরত্বটা বাড়তে শুরু করে।
একটা সময় এইসএসসি পাশ করার পরে আমি ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে এবং বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। আমিও ঢাকায় চলে আসি। ঘুছে যায় দুজনের মধ্যকার দূরত্ব। দুজন কপোত কপতির মতো ঢাকা শহর জুড়ে প্রেম করে বেরিয়েছি। বিশ্বাস না হলে ওর কোন ফ্রেন্ডকে জিজ্ঞাসা করতে পারো। উত্তর পেয়ে যাবে। এতটাই ভালবাসতাম যে নিজেরা লুকিয়ে বিয়ে করে নিতে চেয়েছিলাম । কিন্তু খালু খালা কষ্ট পাবেন বলে সাহস করে উঠিনি আমরা।
সায়মার প্রতিটা কথার বিষাক্ত তীর এর মতো আমার হৃদয়টাকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিল। নিজের উপর অনেক জোর খাটিয়ে শক্ত করে খাটের স্ট্যান্ড ধরে রেখে বসে বসে তার কথাগুলো হজম করছিলাম।
পৃথিবীর কোন মেয়ের ই হয়তো সহ্য হবে না স্বামী সম্পর্কে তার ই প্রেমিকার মুখ থেকে তাদের প্রণয়ের কাহিনী শুনা।
গলার কাছে আটকে থাকা কান্নাটাকে অনেক কষ্টে গিলে নিজেকে স্বাভাবিক করে প্রশ্ন করলাম,
--- তাহলে বিয়ে হলো না কেন তোমাদের? ভাইয়া ভাবির সাথে তো ডিসেম্বরে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তো কোন সমস্যা ছিল না।
যেহেতু আমাদের মধ্যে এস ডিফারেন্স টা বেশি ছিল না। আর গত বছর হঠাৎ করে সাকলাইন ভাইয়া আর আপুর বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এদিকে কানাডা থেকে একটা দারুণ অপরচুনিটি পেয়ে গিয়েছিলাম আমি।
ভাগ্যবশত বিয়ের দিনই আমার ফ্লাইট ডেট পড়ে গিয়েছিল। আমি জানতাম না আপু আর ভাইয়ার বিয়ের সাথে আমার আর সাফওয়ানের বিয়েটাও ঠিক করে রেখেছিল তারা ।
আমি কাউকে কিছু না চলে গিয়েছিলাম কানাডা। সেখান থেকে সাফওয়ান আমার সাথে রাগারাগি করে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। আর কানাডা থেকে আমার পক্ষে দেশে আসা ও সম্ভব হচ্ছিল না। আর এভাবেই ইতি ঘটেছিল আমাদের সম্পর্কের।
কিন্তু আমার একটা আশা ছিল যে দেশে এসে ঠিকই সাফওয়ানকে আমি মানিয়ে নেব। সমস্ত রাগ অভিমান আমি ভেঙে দেবো। কিন্তু তার আগেই আমাদের দুজনের মাঝখানে চীনের প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে গেলে তুমি।
সাইমা আমার দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলে বললো,
--- আমার মন বলছে তুমি ফাঁসিয়েছো আমার সাফওয়ান কে। জোর করে বাধ্য করেছ বিয়ে করতে। না হলেও তো তোমাকে বিয়ে করতে পারে না ও তো আমাকে ভালবাসে। আর একজনকে ভালোবেসে আরেকজনের সাথে কোনদিনও সংসার করা যায় না।
সাইমার লাস্টের কথাটা আমার ভেতরটাকে পুরো চুরমার করে দিল। সত্যিই তো একজনকে ভালোবেসে আরেকজনের সাথে কখনো সংসার করা যায় না। সেজন্যই হয়তো সাফওয়ান এতদিনেও আমাকে মেনে নিতে পারিনি।
আমরা এক ছাদের নিচে থাকলেও আমাদের মধ্যে যোজন যোজন দূরত্ব রয়েছে। সে মুখ ফুটে পর্যন্ত কখনো আমার সাথে কথা বলতে চায় না। আমি বরং যা তা বলে তাকে জ্বালাই। বিরক্ত করি।
কিন্তু সাফওয়ান আমাকে বলেছিল সে কাউকে ভালোবাসে না। তাহলে সে আমাকে মিথ্যে বলল কেন? কি উদ্দেশ্য ছিল মিথ্যে বলার?
আমি সাফওয়ানের কথার উপর জোর খাটিয়ে কিছুটা আশার আলো নিজের মনের মধ্যে সঞ্চার করে প্রশ্ন করলাম সাইমাকে,
--- তুমি মিথ্যে বলছো সাইমা। সাফোয়ান তোমাকে ভালোবাসে না।ও আমাকে নিজের মুখে আমাকে বলেছে কাউকে ভালোবাসে না।
কথাগুলো শেষ করতে টুক করে দু ফোটা অশ্রু আমার গালবে গড়িয়ে পড়ল। তা দেখে সাইমা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
--- প্রীতি ও ওটা আমার উপর অভিমান থেকে বলেছে। ও আমাকে ভালোবাসে। বুকে হাত দিয়ে একটা সত্যি কথা বলতো। তোমাদের দাম্পত্য জীবন কী আদৌ সুখের?
পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল যেন আমার। দুটো ঢুকে গেলে নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক করে হ্যাঁ বলতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তার আগেই সায়মা বলল,
--- থাক এত কষ্ট করে নিজেকে আর সুখী দম্পতির অংশীদার বানাতে হবে না। তোমার মুখ দেখেই আমার সব বোঝা হয়ে গেছে। ও এখনো আমাকে ভালোবাসে বলে ই ওর জীবনে তোমার কোন অস্তিত্ব নেই। শুধু আগাছার মত জীবনে পরে আছো তুমি ।
একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করব প্রীতি। বিয়ের তো ২০ দিন হতে চলল। ও কী এখনো তোমাকে টাচ.....
চুপ করো তুমি। আমার এসব শুনতে আর ভালো লাগছে না।
হাহাহাহ... এটা তো খুব সাধারণ একটা প্রশ্ন। উত্তর দিতে এত অস্বস্তি বোধ করছ কেন? আমি তো বুক ফুলিয়ে বলতে পারি আমার প্রেমিক পুরুষ আমাকে অনেকবার জড়িয়ে ধরেছে। কিস ও
সহ্য হলো না আমার। উঠে গিয়ে সোফার সাথে বসে থাকা সায়মার গলা চেপে ধরলাম আমি। দাঁতের দাঁত চিপে অতি আক্রোশের সাথে বললাম,
--- একদম আজেবাজে কথা বলবেনা তুমি। তুমি কি ভাবছো তুমি এসব উল্টোপাল্টা বলে সাফানের বিরুদ্ধে আমার মনটাকে বিষিয়ে দেবে। তা হচ্ছে না।
--- আমার গলা ছাড়ো প্রীতি। আমার গলা চেপে ধরলেই সত্য টা মিথ্যা হয়ে যাবে না।
--- কিসের সত্যি হ্যাঁ? বানিয়ে বানিয়ে বানোয়াট কথাবার্তা বলছো। থাম এবার তুমি অনেক বলে ফেলেছ।
--- আমার কাছে প্রুফ আছে প্রীতি। আমার গ্যালারিতে এমন অজস্র ছবি দিয়ে পরিপূর্ণ। দেখবে দাঁড়াও দেখাচ্ছি।
তার আত্মবিশ্বাস দেখে ওর গলা থেকে আপন ইচ্ছায় হাত নেমে গেল আমার। সে পাশ থেকে ফোন হাতরে
নিয়ে গ্যালারি অন করে আমার মুখের সামনে স্ক্রিনটা তুলে ধরল। আমি অশ্রু সিক্ত নয়নের সেদিকে তাকালাম।
তাদের বিভিন্ন পোজের ছবি দিয়ে গ্যালারি পরিপূর্ণ। প্রতিটাতেই সাফওয়ানের হাস্যজ্জল মুখটা আমার নজর কেড়েছে। ধাক্কা মেরে ফোনটা ফেলে দিলাম।আর সহ্য হচ্ছে না আমার। নিজেকেই এখন কামড়ে কামড়ে ছিড়ে শেষ করে ফেলতে ইচ্ছে করছে।
আমাকে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাইমা আমার সামনে এসে বলল,
--- এখনো সময় আছে প্রীতি। সাফওয়ানের জীবন থেকে চলে যাও। তোমার সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ পড়ে আছে তা আঁকড়ে ধরো। এখানে থাকলে তোমার জীবন নষ্ট হয়ে যাবে।
আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বললাম,
--- নিজের চরকায় তেল দাও সাইমা। আমাকে নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। এতটাও খুশি হয় না। যে ভবিষ্যতে তোমাকে পস্তাতে হয়।
বলে রুম থেকে বেরিয়ে চলে আসলাম আমি। এলোমেলো পায়ে হাঁটছি আমি। নিজের অস্তিত্বটাকেই কেমন যেন ফিকে লাগছে আমার কাছে। ঠোঁটের সাথে ঠোঁট চিপে ধরে নিজের ভেতরের সমস্ত কষ্টগুলো যথাসম্ভব দমন করার চেষ্টা করছি। সাইমার বলা কথাগুলোকে বারবার ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করছি। কিন্তু আমার ভেতরের সত্তা বারবার আমাকে জানান দিচ্ছে। সাইমার বলা একটা কথাও অযৌক্তিক নয়।
বারান্দার রেলিংটা কে শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরলাম। রেলিং এর ওপর জোর হাতে দুটো ঘা দিয়ে বললাম,
--- প্রতিবার আমার সাথে কেন এমন হয়? যাকেই আমি জীবনে আকড়ে ধরতে চাই সেই আমার জীবনের জন্য বারবার ভুল প্রমাণিত কেন হয়?
নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না ঠোট ভেঙ্গে কাঁদতে শুরু করলাম।
পেছন থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো কানে,
চোখের পানি অনেক মূল্যবান । অপ্রয়োজনে তা খরচ করতে নেই। অপাত্রে আবার দানও করতে নেই। যেখানে যেটার মূল্য আছে সেখানেই সেটার সম্প্রদান শ্রেয়।
আমি পেছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখলাম সায়েম দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তাকাতেই আমাকে উদ্দেশ্য করে আবার বলে উঠলেন,
--- আমার সাথে আসুন। আপনার হাতটা অনেকখানি ছিলে গেছে। ওষুধ লাগাতে হবে।
আমি নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে তাকে বললাম,
--- মনের ক্ষতের ঔষধ কোথায় পাওয়া যায় সন্ধান দিতে পারেন।
আমার কথায় তিনি মুচকি হাসলেন। বাহ হাসলে তো আবার তার বাম গালে টোল পড়ে। আমার দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে বললেন,
--- আগে হাতের ক্ষতটাতে প্রলেপ দেই। তারপরে না হয় মনের অসুখের প্রতিষেধক দেব।
১৪ তম পর্ব🍂
আপনাকে তো আমি খুব বুদ্ধিমতী আর প্রখর স্মৃতিশক্তি সম্পন্ন মেয়ে মনে করেছিলাম প্রীতি। কিন্তু আপনি যে আমাকে ভুল প্রমাণিত করলেন। এত বোকা কবে হয়ে গেলেন?
সায়েম এর কাছ থেকে মলমটা নিয়ে আমি নিজের হাতে লাগাচ্ছিলাম। হঠাৎ কানে তার কথাগুলো আশাতে আমি তার দিকে তাকিয়ে পরলাম।
--- মানে?
--- মানে এই যে তিন বছর আগে যে প্রীতিকে দেখেছিলাম আমি। চেহারা আদলে একই রকম হলেও প্রখর মেধা সম্পন্নকারী সাহসী ও চমৎকার ব্যক্তিত্বের সেই প্রীতিকে তো খুঁজে পাচ্ছি না।
আমি চমকে উঠলাম। তাড়াতাড়ি নজর ঘুরিয়ে সায়েমের দিকে তাকালাম। চশমার আড়ালে চোখ জোড়া এবার একটু বেশি পরিচিত মনে হচ্ছে। কিছুক্ষণ এক নজরে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ আমার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।
--- ডাক্তার ভাইয়া...!
সায়েম এবার শব্দ করে হেসে উঠলেন। গালে আবারও সেই টোল পড়া। হায় টোল ওয়ালা ভাইয়াকে আমি এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলাম কি করে।
হাসি থামিয়ে ভাইয়া বলে উঠলেন,
--- যাক ম্যাডামের এতক্ষণে আমাকে তাহলে মনে পড়েছে। তো ম্যাডাম আপনার স্মৃতিশক্তি এত নড়বড়ে হয়ে গেল কি করে?
আমি কপোট রাগ দেখিয়ে বললাম,
--- মোটেও আমার স্মৃতিশক্তি নড়বড়ে হয়নি। তুমি বরং গড়বড়ে হয়ে গেছো।
--- যেমন?
--- আগেতো পাটকাঠির মত চিকন ছিলে এত বডি মাসেল বানালে কি করে?
---আগে হোস্টেলের খাবার খেতাম তাই পাটকাঠি ছিলাম। এখন মায়ের রান্না খাই তাই চেঙ্গিস খান হয়ে গেছি।
আমি ভাইয়ার কথা শুনে এবার হেসে দিলাম। ভাইয়া কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন,
--- এই প্রীতিকেই তো এতোক্ষণ খুজছিলাম। ওইখানকার বারান্দায় দাঁড়ায় থাকা প্রীতিকে তো চিনতেই পারিনি। মিস ভয়ঙ্করী নাকি আবার কাঁদতেও পারে। ভাবা যায়।
যে কিনা আমার সহকারীকে ধরে সারা বিল দৌড় করিয়ে পিটিয়েছিল কি দোষ ছিল কাঁচা আম চুরি করেছে তাই।
তোমার এখনো মনে আছে ভাইয়া।
--- না মনে তো থাকবে না। এমন মিস ভয়ঙ্করী পৃথিবীতে কয় পিস আছে যে তোমাকে ভুলে যেতে হবে।
প্রতিউত্তরে আমি শুধু হাসলাম।
ডাক্তার সরফরাজ আহমেদ। খুলনা মেডিকেলের নামকরা নিউরো সার্জন। তিন বছর আগে আমাদের গ্রাম কেশবপুরে গিয়েছিলেন। সেখানেই আলাপ হয়েছিল নাটকীয় ভাবে।
আমাদের বাড়ির পেছনে আমার আব্বুর হাতে লাগানো একটা ফল বাগান ছিল। যেটা আমি নিয়মিত পরিচর্যা করতাম। এই ফল বাগানেরই আম গাছের কাঁচা আম চুরি করছিলেন তার সহকারী।
কত যত্ন আর পরিচর্যার ফল এই কাঁচা আম গুলো। আম্মু আচার তৈরি করবে।আর সে কিনা নির্বিচারে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। ধরেছিলাম ব্যাটাকে আচ্ছা মত গাছের উপরে লম্বা লাঠি দিয়ে পিটিয়েছিলাম।। পরের লাফ দিয়ে পিছনের বিল দিয়ে দৌড়েছিল।
আমিও কম কিসে আমিও লাঠি নিয়ে তাড়া করেছিলাম তাকে। পুরো বিল দৌড় করিয়ে অবশেষে আমাকে মেডিকেল ক্যাম্পে নিয়ে গিয়েছিল ওই সহকারি। সেখানেই ডাক্তার ভাইয়ার সাথে দেখা। ডাক্তার ভাইয়াই আমার হাত থেকে ওই সহকারীকে বাঁচিয়ে ছিল না হলে ওটা কে পিটিয়ে আমি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করতাম। আলাপ করে ভালো লেগেছিল বলে আমগুলো ফ্রিতে দিয়ে এসেছিলাম।
তারপর প্রায়ই মেডিকেল ক্যাম্পে যেতাম।ডাক্তারি পেশার উপর আমার খুব কৌতুহল ছিল। ভাইয়া সবার রোগ জিজ্ঞাসা করতো আমি পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতাম। ওষুধ লিখে দিত। সেগুলো দেখতাম। ইনজেকশন কিভাবে পুশ করতে হয় প্রেসার কিভাবে মাপতে হয়। সেগুলো ভাইয়ের সাথে থেকে থেকে শিখে নিয়েছিলাম।
আমি একা যেতাম না। আমার ভাইও সাথে যেত।ধীরে ধীরে আম্মু আব্বুর সাথেও ডাক্তার ভাইয়ার পরিচয় হয়েছিল। উনি যেদিন আমাদের গ্রাম থেকে চলে যাবেন সেদিন আব্বু ওনাকে দাওয়াত দিয়েছিলেন দুপুরে। উনি এবং ওনার অ্যাসিস্ট্যান্ট দুপুরে খেয়েছিল আমাদের বাড়িতে। সেখানেই হয়েছিল আমাদের শেষ দেখা।
মাঝখানে তিন-তিনটা বছর কেটে গেছে। কতকিছুর পরিবর্তন হয়ে গেছে। আমি ভাবতেই পারিনি তিন বছর আগের সেই মেয়েটা আজ আমার সামনে আমার ভাইয়ের বউ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আমিও ভাবতে পারিনি, এত বছর পরে এভাবে আমাদের দেখা হবে আবার।
কথাটা বলে মলমটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম,
---থ্যাংকস ফর ইউর ট্রিটমেন্ট।
বলে বেরিয়ে আসছিলাম আমি তখন পেছন থেকে সায়েম বলে উঠলেন,
--- মনের অসুখটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলার ব্যবস্থা কর প্রীতি। মানসিক অশান্তি নিয়ে মানুষ বেশিদিন সুস্থভাবে বাঁচতে পারে না।
আমি তাকে কিছু বলতে যাব তার মধ্যে তিনি থামিয়ে দিয়ে বললেন,
--- আমি তোমার আর সায়মার কথোপকথন শুনেছি। দেখো সাফওয়ান আমার বন্ধু প্লাস ভাই হলেও ওর ব্যাপারে খুব কম জানি আমি। স্বভাবত ও খুবই চাপা। নিজের মনের কথা নিজের মধ্যে রেখে দিতে পারে অনায়াসে। মুখ দেখে কিছুই বোঝা যায় না ভেতরে কি চলছে।
আর আমার স্টাডি লাইফটা প্রায় বাইরে বাইরেই কেটেছে। ফ্যামিলির সাথে অতটাও কানেক্টেড ছিলাম না আমি। সেজন্য সাফওয়ান সায়মার ব্যাপারে তেমন কিছুই বলতে পারব না। সাইমা যদিও বলে সাফওয়ান কে সে পছন্দ করে। কিন্তু আসলে তাদের মধ্যে কি হয়েছিল সেটা একমাত্র সাফওয়ানই তোমাকে বলতে পারবে।
তাই বলছি হঠকারী কোন সিদ্ধান্ত না নিয়ে ভালোভাবে ভেবেচিন্তে ঠান্ডা মাথায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নাও। ঝোঁকের মাথায় এমন কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিও না যা নিয়ে ভবিষ্যতে পস্তাতে হয়।
যদি কোন দরকার পড়ে তবে আমাকে জানিও আমি তোমাকে যত সম্ভব সাহায্য করবো।
-- আচ্ছা।
বলে আমি রুম থেকে বেরিয়ে চলে আসলাম।
হ্যাঁ অনেক হয়েছে। এবার একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতেই হবে।
_________🌺🌺______
খালামনির সাথে দেখা করে কাঠের বাক্সটা হাতে নিয়ে নিচে নেমে আসলাম। খালামণিকে সাহস করে কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না। আর চাইছিলাম না। আমার তো চাই সাফওয়ানের উত্তর। খালামণি কাঠের বাক্স টা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
--- শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত আমি যেন তার সাফুর পাশে থাকি।
আমি কোন প্রতি উত্তর করতে পারিনি। চুপচাপ তার কথা শুনে বাক্সটা নিয়ে চলে এসেছি। এসে দেখি সাফওয়ান সোফা সেটের উপর বসে আছেন। চেহারায় স্পষ্ট গাম্ভীর্য ফুটে উঠেছে। আমি নিচে গিয়ে দাঁড়াতেই পুতুল দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
--- বাসায় যাব প্রীতিলতা আমার খুব ঘুম পেয়েছে।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে শুকনো একটা হাসি দিয়ে বললাম,
--- এইতো এখনই যাবো।
আমার কথা শুনে সাফওয়ান সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। ভাইয়া ভাবীরা আজ এই বাড়িতেই থাকবেন। সবার থেকে বিদায় নিয়ে সাফওয়ান পুতুলের হাত ধরে গাড়ির উদ্দেশ্যে চলে গেলেন। আমিও সদর দরজায় পেরিয়ে বেরিয়ে এসেছি। তখন খালামনি পিছন থেকে আমার হাত জড়িয়ে ধরে বললেন,
--- অনেক কিছু বলার ছিল কিন্তু আমি তোকে বলতে পারিনি। তার জন্য আমাকে ক্ষমা করে দিস তুই। শেষের শুধু একটা কথাই বলবো। আমার সাফু বাবু কোন অন্যায় করিনি বরং অনেক কষ্ট পেয়েছে। ওকে কখনো কষ্ট পেতে দিস না। সকল মান-অভিমান ভেঙে আমার সাফু বাবুকে নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু কর। ইনশাল্লাহ আল্লাহ তোদের মঙ্গল করবেন।
আমি বরাবরের মতন নীরব ছিলাম। হ্যাঁ ও বলেনি না ও বলিনি। কারণ আমার অনেক কিছু জানার আছে। সত্যিটা আমাকে আগে জানতে হবে ।
হেঁটে চলে এসে গাড়িতে উঠলাম। পুতুল দেখি গাড়িতে ঘুমিয়ে গেছে ।ওকে নিজের বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে গাড়ির সিটে মাথাটা এলিয়ে দিলাম। সাফওয়ানের দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পেরেছি তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ভুলেও তার দিকে তাকালাম না। কোন কথাও বললাম না।
সাফওয়ান জোরে একটি নিঃশ্বাস নিয়ে গাড়িটা স্টার্ট করলেন। আমি চোখ বুঝে নিলাম। মনে মনে নিজেকে শক্ত করছি। আজকেই সমস্ত লুকোচুরির সমাপ্তি করব। অনেক হয়েছে আর না। আজ রাত্রে সাফওয়ানকে ফয়সালা করতে হবে। কাল সূর্যোদয়ের সাথে তার আর আমার সম্পর্কের শুভ সূচনা হবে নাকি পরিসমাপ্তি ঘটবে.....!
১৫ তম পর্ব🍂
রাত প্রায় 12 টা বাজে। গাড়িটা বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সাফওয়ান হর্ন বাজাচ্ছেন। কিন্তু গেট খোলার কোন নাম গন্ধ নেই। প্রায় দশ মিনিট পর হন্তদন্ত হয়ে দারোয়ান চাচা গেট খুলে দিলেন।
তার চোখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তিনি। সাফওয়ান গাড়ি ভেতরে ঢোকাতেই গেটে তালা ঝোলালেন তিনি। এতক্ষণ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
সাফওয়ান গাড়ি পার্কিং লটে গিয়ে থামালেন। ইঞ্জিন বন্ধ করে দরজা খুলে বের হলেন। ঘুরে আমার সাইডে এসে গাড়ির দরজা খুলে পুতুলকে আমার সাইড থেকে নিয়ে নিলেন। পুতুল ঘুমিয়ে গেছে তাই কোলে তুলে নিলেন। আমার দিকে তাকালেন তিনি মুহূর্তেই নজরের বিনিময় হলো। গাড়ি থেকে বের হয়ে দাঁড়ালাম।
সাফওয়ান মেইন ডোর বেল আর বাজালেন না। খালা এতক্ষণে শুয়ে পড়েছেন। চাবি ঘুরিয়ে লক খুলেই ঘরে ঢুকলাম আমরা। সাফওয়ান পুতুলকে নিয়ে তার ঘরে চলে গেল আমি দরজাটা ভালো করে লক করে ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে গিয়ে বসলাম। এক গ্লাস পানি ঢেলে নিয়ে খেয়ে নিলাম।
তারপর ওপরের রুমে চলে আসলাম। সোজা গিয়ে ঢুকলাম ওয়াশরুমে। একেবারে ফ্রেস হয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে বিছানায় বসলাম। তখন রুমে প্রবেশ করলেন সাফওয়ান। পরনের কোটটা বাম হাতে ঝুলছে, গলার টাইটাও ঢিল। চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে তিনি বড্ড ক্লান্ত। আমার দিকে এক নজর তাকালেন তারপরে আলমারির কাছে গিয়ে টি-শার্ট আর ট্রাউজার বের করলেন। ওয়াশরুমে ঢোকার আগ মুহূর্তে আমি তাকে বললাম,
--- আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে,
তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসুন।
তিনি মুখে কিছু বললেন না। ওয়াশরুমে চলে গেলেন। প্রায় ১৫-২০ মিনিট পরে ফ্রেশ হয়ে বের হলেন। হাতমুখ মুছতে মুছতে বিছানায় বসলেন। হাত বাড়িয়ে নিজের ফোনটা চার্জে লাগালেন। আমি চুপচাপ তার কর্মকাণ্ডগুলো দেখছি। তিনি বারবার আরে আরে তাকাচ্ছেন আমার দিকে। হয়তো বলতে বলছেন আমাকে কি বলার আছে। নাকি অন্য কিছু বোঝাতে চাইছেন বুঝতে পারছি না।
আমি আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে সাফওয়ান এর হাত ধরে টেনে রুমের বাইরে নিয়ে চলে আসলাম। পুরো বাড়িটা নিস্তব্ধ ও ঘুমন্ত পুরীতে পরিণত হয়েছে। খালাতো অনেকক্ষণ আগেই ঘুমিয়ে গেছে আর কিছুক্ষণ আগে দেখেও এসেছি পুতুলও ঘুমিয়ে পড়েছে প্রগাঢ়ভাবে।
করিডরের স্বল্প আলোর মধ্য দিয়ে সাফানের হাত ধরে ছাদের সিঁড়িতে পা রাখলাম। সাফওয়ান এমন আকস্মিকতায় কিছুটা অবাক হয়েছেন বোধহয়। সিঁড়ি দিয়ে ছাদে ওঠার পর ঘাড় ঘুরিয়ে সাফয়ানের দিকে তাকালাম এতক্ষণ তিনি নিস্তব্ধ ছিলেন আমি তাকাতেই আমাকে প্রশ্ন করলেন,
--- এত রাতে ছাদে নিয়ে এসেছে কেন আমাকে?
ছাদে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে আমরা আকাশে আজ আবারো কালো মেঘের ঘনঘটা। ঝিরঝির করে বাতাস বইছে। যা আমার শরীরকে কম্পিত করছে। ছাদে থাকা ডিজাইনার লাইটগুলোর আলো য় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি সাফওয়ান আমার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
আমার সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। আমি তার চেহারার মানদন্ড মাপতে ব্যস্ত। আমাকে এমন শান্তভাবে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে সাফওয়ান বিরক্তিতে চ্যাহ শব্দ করে আমাকে বলল,
--- দেখো আমি কিন্তু খুব ক্লান্ত। তোমার এই সকল ফাজলামি করার ইচ্ছা হলে অন্য সময় করবে। এখন কিন্তু এসব ভালো লাগছে না আমার।
তাই বলে ছাদের দরজার দিকে এগিয়ে যেতে গেলে আমি হাত ধরে টেনে ধরে বলি,
--- এই মানুষটাকেই তো আপনার ভালো লাগেনা কুমড়ো পটাশ।তাহলে তার কর্মকান্ড কিভাবে আপনার ভাল লাগতে পারে বলুন।
আমার কথাগুলো শুনে তিনিও নিজ গরজে এগিয়ে আসলেন আমার দিকে। কপাল কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
--- মানে....!
আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। শুকনো হেসে তার দিকে এগিয়ে এগিয়ে তার চোখে চোখ রেখে বললাম,
--- আপনি সেদিন আমাকে মিথ্যে কথা কেন বললেন কুমড়ো পটাশ?
--- মিথ্যে বলেছি?
--- হ্যাঁ অনেক বড় মিথ্যে কথা বলেছেন।
কথাটা বলতে গিয়ে গলা কেঁপে উঠল আমার। দমকা হাওয়া এসে গায়ে লাগতেই চুল গুলো সব এলোমেলো হয়ে গেল দুহাতে চুল গুলো একটা হাত খোপা করে নিলাম। তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম
তিনি এখনো নিশ্চুপ হয়ে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
তা দেখে আমি আবারও শুকনো হাসলাম।
এগিয়ে গেলাম তার দিকে। তাকে অবাক করে দিয়ে আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম। কিছুক্ষণ তার বুকে মাথা রেখে চোখ বুঝে নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে নিলাম।
ঘাড় উঁচু করে তার দিকে তাকাতেই আমার চোখের কার্নিশ দিয়ে দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। তার দিকে তাকাতে দেখলাম সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
--- আপনি কি কখনো আমাকে ভেতর থেকে ফিল করেছেন কুমড়ো পটাশ? কখনো কি আপনার মনটা আপনাকে বলেছে এই মেয়েটাকে আপনার প্রয়োজন। একান্তভাবে প্রয়োজন।
কি হয়েছে তোমার। হঠাৎ এসব আবোল তা...
ঠোঁটে আঙুল দিয়ে তাকে থামিয়ে দিলাম।
--- আহ্ আ যেটা জিজ্ঞাসা করছি তার উত্তর দিন না। আবোল তাবোল তো আমি সারা দিন বকি।
সাফওয়ান চুপ হয়ে গেলেন। আমি সাফোয়ানের দিকে আরো এগিয়ে গেলাম। আরো ঘনিষ্ঠ হলাম তার সাথে। মুখটা তার কানের কাছে নিয়ে গিয়ে বললাম
--- কি হল বল? চুপ হয়ে গেলে কেন?
ঘাড় নিচু করে সে আমার মুখ পানে তাকালো। আমি অধীর আগ্রহে তার উত্তর শোনার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। মন থেকে বড্ড চাইছি। উত্তরটা যেন হ্যাঁ হয়। ওর অতীতে যাই হয়ে থাকুক না কেন। সবকিছু ভুলিয়ে দেবো আমি। শুরু করব আমাদের জীবনের পথ চলা।
তৎক্ষণাৎ কানে প্রতিধ্বনি হয়ে ফেরত আসলো একটা শব্দ
--- না...!
এই একটা শব্দ ই আমার শরীরটাকে নিঃশেষ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। সাফওয়ানের থেকে আলিঙ্গন মুক্ত হলাম। হাতটা আপন ইচ্ছাতে ই নেমে আসলো তার পিঠ থেকে।
আমার দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে উত্তর দিল,
--- পেয়ে গেছো তোমার উত্তর। এবার নিচে চলো।
আমি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি নিজের অবস্থানে। নিজের অবস্থানটা ঠাওর করতে পারছি না। বসে আছি নাকি দাঁড়িয়ে আছি কিছুই বুঝতে পারছি না চোখের সামনে পুরো দুনিয়াটা যেন ঘুরছে এমন লাগছে। সাফওয়ান নিচে যেতে গিয়েও আবারো ফিরে এলেন। আমার হাত ধরে টান দিতে আমি কিছুটা নড়ে উঠলাম।
অশ্রুসিক্ত নয়নের ডান দিকে তাকিয়ে বললাম,
--- বড্ড ভালোবাসেন সায়মাকে তাই না...!
মুহূর্তে ওনার চেহারার রঙের পরিবর্তন ঘটল।
--- তোমাকে বলার প্রয়োজন বোধ করছি না।
আমি এবার ক্ষেপে উঠলাম। দু কদমে গিয়ে এসে তার টি-শার্টের কলার দুহাতে চেপে ধরে চিৎকার করে বললাম,
--- কেন প্রয়োজন বোধ করছেন না? আপনাকে আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। এখন এবং এক্ষুনি। কেন ভালবাসেন না আপনি আমাকে? আমার জন্য আপনার মনে কেন জায়গা নেই.....
--- এর উত্তর আমি আগেও দিয়েছি।
--- ওসব লেইম এক্সকিউজ। আমি ছোট বাচ্চা না। যে যা বুঝাবেন তাই বুঝে যাব।
--- আর কোন কারণ নেই।
আছে। অনেক বড় কারণ আছে।আর এর পেছনে আসল কারণ তো অন্য সাফোয়ান । ভালবাসেন তো সাইমাকে তাই না। আমি আপনাদের দুজনের মাঝে চলে এসেছি। যার কারনে আপনাকে আমায় এত অপছন্দ।
মনে যা আসছে তাই বলে যাচ্ছে । যা বলছ ভেবে বলছ তো। নাকি এসব দোষ আমার কাঁধে চাপিয়ে মুক্ত হতে চাইছো।
আমি ভুককে সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে বললাম,
--- মানে...! এখন নিজের দোষ ঢাকতে আমাকে দোষী বানাচ্ছেন। আমি আপনার কথাগুলো জানতে এসেছি এখানে এসব লেইম এক্সকিউজ দেওয়া বন্ধ করুন।
বাবা মা পছন্দ করে আমাকে এই বাড়িতে নিয়ে এসেছে বলে আপনার এত অপছন্দ। এটা আবার হয় নাকি? এটা কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ হলো।
যুক্তিসঙ্গত..! ঠিক বলেছ তুমি । এটা আসলে কোন যুক্তিসংগত কারণেই হতে পারে না। তুমি বলছো না আমি তোমাকে কখনো ভেতর থেকে ফিল করেছি কিনা। একটা কথা বলতো তুমি কি আদৌ কখনো আমাকে ভেতর থেকে ফিল করেছো।
আমি নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।তা দেখে তিনি আবার বলতে শুরু করলেন,
তোমার কথা তো ছাড়ো আমার আপন কেউ কখনো আমার ভেতরটা ফিল করিনি। সবাই সব সময় আমার উপরে একটা বিষয়ে চাপিয়ে দিতে চেয়েছে। একটা বার ও কেউ ভেবে দেখেনা যে আদৌ আমি সেটা বহন করতে পারব কিনা।
আপনি এটা কেন বুঝতে চাইছেন না বাবা মা যা করেন তার সন্তানের মঙ্গলের জন্য করেন। তাছাড়া এ পর্যন্ত আপনার মা-বাবা আপনার জন্য যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাতে আপনার কি ক্ষতি হয়েছে বলুন।
হ্যাঁ আপনার মতের মিল হয়নি তাই বলে আপনাদের দুজনেরই রেষারেষির মধ্যে ফেলে আমার জীবনটা কেন নষ্ট করছেন? কি পেয়েছেন টা কি আমাকে? বলুন তো।
বাবা মার মনে হয়েছে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার দরকার। আর বোঝা টানতে পারছি না। বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। যার হাতে তুলে দিয়েছে সেই প্রথম মুখ ফিরিয়ে নিল আমার থেকে।
বিয়ের পরের দিন জানতে পারছি তাদের এই উড়নচণ্ডী বাউন্ডুলে ছেলেকে নিজেদের আয়ত্তে আনার জন্য আমাকে এ বাড়ির বউ করে আনা হয়েছে। চেষ্টা করছি। বিয়ে হয়েছে প্রায় এক মাস হয়ে গেছে। তার ভালোবাসা পাওয়া তো দূর, মনের এক কোনায় এখনো কোন জায়গাই তৈরি করতে পারিনি আমি।
আমার ভবিষ্যৎ টা কি বলতে পারেন। কাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচবো আমি। বলুন।
সাফোয়ান কোন কথা না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তার কলার ছেড়ে দিয়ে কিছুটা দূরে সরে গিয়ে বললাম।
--- আপনি যান গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ুন। আমার যা জানাজানা হয়ে গেছে। সকল প্রশ্ন উত্তরের পালা শেষ। উত্তর তো খুব সুন্দর করে দিয়েই দিলেন।
আপনার অনিচ্ছা সত্ত্বেও আপনার বাবা আমাকে ঘাড়ে আমাকে চাপিয়ে দিয়েছে।তাই তো। ঠিক আছে আমি নিজ দায়িত্বে আপনার ঘাড় থেকে আমার সকল বোঝা আমি নামিয়ে নিলাম। এখন থেকে আপনি সম্পূর্ণ মুক্ত। শুনতে পেয়েছেন আপনি। সম্পূর্ণ মুক্ত। এনজয় ইউর সেল্ফ।
মেঘের ঘর্ষনের আলোতে সাফওয়ান কে এক ঝলক দেখলাম আমি। অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলেন,
--- কী বলতে চাইছো?
--- সময় হলে বুঝতে পারবেন।আর হা আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। এবার যেতে পারেন আপনি।
কথাটা বলে উল্টোদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছি। কি আশ্চর্য এখনো চোখে কোন অশ্রু নেই আমার। কিন্তু মনে হচ্ছে বুকের ভেতরটাকেও চেপে ধরেছে। স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসেও যেন বুকের বা পাশটা চিন চিন ব্যথা করছে। এত খারাপ লাগছে কেন আমার।
সে তো আমাকে ভালবাসিনি। আমাকে কখনো অনুভব করাইনি যে সে আমাকে ভালোবাসে। বরং সে সব সময় অকপটে বলে গেছে আমাকে তার ঘাড়ে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
একতরফা আমি শুধু বোকার মত ভালোবেসে ফেলেছি। এখানে তো আমার দোষ। না না স্বামীকে ভালোবাসা কখনো অন্যায় হতে পারে না। আসলে এটা আমার ভাগ্যের দোষ।
কি হলো আপনি এখনো দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ভয় নেই ছাদ থেকে লাফ দিয়ে মরতে যাব না আমি। আপনাকে ভালোবেসে প্রথম ভুল তো করেই ফেলেছি। আত্মহত্যার মতো দ্বিতীয় ভুল আমি কখনোই করব না। নিশ্চিন্তে গিয়ে ঘুমাতে পারেন আপনি।
কথাগুলো বলে অন্য দিকে তাকিয়ে নিজের হাত ঘষতে লাগলাম। আবার ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখি সাফওয়ান এখনো দাঁড়িয়ে আছে।
কী হলো?ধ্যাত...!
বলে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসলাম। আর পেছনে ফিরে তাকাইনি আমি। পুতুলের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলাম। বিছানায় পুতুল গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। সত্যি বলতে এই মেয়েটাই আপন মনে আমাকে ভালোবেসেছে। বিছানায় গিয়ে পুতুলের পাশে শুয়ে পড়লাম। এক হাতে টেনে ওকে আমার কাছে নিয়ে আসলাম। হালকা নড়ে ওঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে আবার ঘুমে তলিয়ে গেল। আমি ওর কপালে ছোট করে চুমুকে দিয়ে বললাম,
--- পৃথিবীতে এই একটা জিনিস কোন বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না। ভালোবাসা ।যেটা মনের অন্তস্থল থেকে বের হয়ে আসে কিছু বিশেষ মানুষদের জন্য।
আমি তোর ভাইয়ের সেই বিশেষ মানুষ হতে পারিনি পুতুল সোনা।আদৌ কারোর হতে পেরেছি কিনা জানিনা।
চোখের কার্নিশ বেয়ে কয়েক ফোটা অশ্রু বালিশে পড়লো। পুতুলকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম নিজের বুকের সাথে। এই আলিঙ্গন টা আমার বড্ড দরকার।মনে হচ্ছে নিজেরই দুঃখগুলো একটু হলেও এই নরম শরীরটা শুষে নিচ্ছে।
আমি তোকে সারা জীবন মনে রাখব পুতুল সোনা। তুই একমাত্র ব্যক্তি যে নিঃস্বার্থভাবে আমাকে ভালবেসেছিস। হয়তো এখন জেগে থাকলে বলতিস
--- কেঁদো না প্রীতিলতা। আমি ভাইয়াকে খুব করে বকে দেব।
কষ্টের মধ্যেও হেসে দিলাম। তোর কথাগুলো আমার খুব আদর আদর লাগেরে পুতুল সোনা। তুই ছাড়া যে আমার এই বাড়িতে আপন বলতে আর কেউ নেই।
কেউ নেই....!
চলবে......❣️