১৬০৮ সালে ডাচ চশমা নির্মাতা হ্যান্স লিপারশে (Hans Lippershey) সর্বপ্রথম টেলিস্কোপ উদ্ভাবন করেন। টেলিস্কোপ উদ্ভাবন ছিল পর্যবেক্ষণ মূলক জ্যোতির্বিদ্যায় একটি বিপ্লবের মতো। হ্যান্স লিপারশের টেলিস্কোপের বিবর্ধন ক্ষমতা খুব একটা বেশি ছিল না৷ তবুও দূরের জিনিস কিছুটা হলেও বড় দেখা যেত৷
লিপারশের তথ্যাবলি গ্যালিলিওর কানে পৌঁছানোর পর তিনি নিজে নিজেই একটি টেলিস্কোপ তৈরি করে ফেললেন৷ উত্তল লেন্স এবং অবতল লেন্সের এই যন্ত্রটি আকাশের দিকে ফিরিয়ে তিনি যা দেখেছিলেন আর যে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন তা গুড়িয়ে দিয়েছিল পুরনো সংস্কার, বিশ্বাস।
মনে রাখা দরকার গ্যালিলিও কিন্তু প্রথম নয় যিনি আকাশের দিকে টেলিস্কোপ দিয়ে দেখেছিলেন। বলা যেতে পারে গ্যালিলিও তার পর্যবেক্ষণকে কাজে লাগিয়েছিলেন আমাদের এই মহাবিশ্ব বোঝার জন্য। যেটা আগে কেউ করেনি৷
গ্যালিলিও কি দেখেছিলেন তার টেলিস্কোপে? গ্যালিলিওর পর্যবেক্ষণের অংশবিশেষ এখানে দেওয়া হলো :
* খালি চোখে ছায়াপথের বিশালতা সহজেই অনুমেয় কিন্তু খালি চোখে কয়টা তারাই বা দেখা যায়! গ্যালিলিও দেখেছিলেন আমাদের ছায়াপথ অসংখ্য তারকা দিয়ে পূর্ন। তার ভাষ্যমতে খালি **চোখে যত তারা দেখা যায় তিনি তার টেলিস্কোপ দিয়ে তার ১০ গুন তারা দেখেছিলেন।**
* চাঁদের দিকে টেলিস্কোপ ফেরালে তিনি চাঁদের বুকে পাহাড়, গর্ত, সমতল ভূমি লক্ষ্য করেছিলেন। কিন্তু অ্যারিস্টটলীয় মতবাদ অনুসারে স্বর্গীয় বস্তুসমূহ সুষম। তাহলে চাঁদের গায়ে পাহাড় -পর্বত থাকলে চাঁদ কীভাবে সুষম হতে পারে। **অ্যারিস্টটলীয় মতবাদের ধারণা বাদ দিয়ে গ্যালিলিও খুব ভালো করে চাঁদের উঁচু-নিচু অঞ্চল পর্যবেক্ষণ করলেন। **সেসব অন্ঞ্চলের ছায়া পর্যবেক্ষণ করে তিনি পাহাড়ের উচ্চতা কিংবা গর্তের গভীরতাও অনুমান করতে পেরেছিলেন।** **
* বৃহস্পতি গ্রহের দিকে টেলিস্কোপ ফেরালেন গ্যালিলিও। ১৬১০ সালের ৭ জানুয়ারি তিনি বৃহস্পতির চারপাশে তিনটি আলোকবিন্দু দেখতে পান। দিন যত যায় ততই আলোকবিন্দুগুলোর স্থান পরিবর্তন হয়। **১৩ জানুয়ারি ৪ টা আলোকবিন্দু দেখা গেল। এই পর্যবেক্ষণ থেকে তিনি সহজেই বুঝতে পারলেন ওগুলো বৃহস্পতি গ্রহের চাঁদ। **বৃহস্পতির এই চাঁদগুলো কোপার্নিকান মডেলের একটি সমালোচনার সমাধান দেয়৷ কোপার্নিকাসের সৌরকেন্দ্রিক মডেলের সমালোচনায় একদল বলেছিল পৃথিবী যদি গতিশীল থাকে তাহলে চাঁদ তো পিছনে পড়ে যাবে! কিন্তু গ্যালিলিও দেখলেন বৃহস্পতি দিব্যি তার চাঁদ নিয়ে গতিশীল। তাহলে আমাদের চাঁদ পৃথিবীর সাথে গতিশীল এটাতেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। গ্যালিলিও যখন বৃহস্পতির চাঁদগুলোর ঘূর্ণনকাল নির্ণয় করলেন তখন দেখলেন গ্রহের কাছের চাঁদটির ঘূর্ণনকাল কম কিন্তু দূরের চাঁদটির ঘূর্ণনকাল বেশি। বৃহস্পতি এবং তার চাঁদের এই সিস্টেমটি কোপার্নিকাসের সৌরকেন্দ্রিক মডেলেরই অনুরূপ!
* খালি চোখে কৃত্তিকা তারকাগোষ্ঠীর দিকে তাকালে মোটামুটি ৬টি তারা স্পষ্ট দেখা যায়। কিন্তু গ্যালিলিও কৃত্তিকাতে ৩৬টি তারকা দেখেছিলেন। নিঃসন্দেহে গ্যালিলিওর পর্যবেক্ষন আমাদের এটাই বলছিল যে **মহাবিশ্ব আমরা যা দেখি তার থেকেও বিশাল।
**
* ১৬১০ সালের শেষের দিকে শুক্র গ্রহের দিকে তাকিয়ে তিনি দেখলেন শুক্র গ্রহও চাঁদের মতোই কলা প্রদর্শন করছে। টলেমির মডেলানুসারে শুক্রগ্রহের এমনভাবে কলা প্রদর্শন সম্ভব ছিল না। **শুক্র গ্রহের কলা একটি জোরালো প্রমান দিল শুক্র গ্রহও সূূর্যের চারপাশে ঘুরছে**। এটি সৌরকেন্দ্রিক মডেলেরই ইঙ্গিত দিচ্ছিল।
* সূর্যের দিকে দৃষ্টি ফেরালে তিনি সৌরকলঙ্ক দেখতে পান। দিনের পর দিন সৌরকলঙ্কের গতিবিধি পর্যেবেক্ষন করে দেখেন সৌরকলঙ্ক স্থির নয়। সেটা সৌরপৃষ্ঠে ঘূর্ণায়মান। এই গতিবিধি থেকে তিনি বুঝতে পারলেন** সূর্য নিজ অক্ষের চারদিকে প্রায় ২৭ দিনে একবার আবর্তন করে এবং সূর্য একটি বৃহৎ গোলক।** একটু ভাবুন তো তখন কত বড় একটা পর্যবেক্ষণ ছিল এটি! কিছু কিছু সোর্সে উল্লেখ করা হয় গ্যালিলিও টেলিস্কোপ দিয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। এ তথ্যটি অতিরঞ্জিত। গ্যালিলিও অন্ধ হয়েছিলেন ৭২ বছর বয়সে। কিন্তু সেটি তার পর্যবেক্ষনের জন্য নয় বরং Cataract এবং Glaucoma এর জন্য।
* চাঁদের দিকে তাকিয়ে শুধু কি পাহাড়-পর্বত দেখেছিলেন তিনি? না। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন বছরের কিছুসময় চাঁদের বুকে সামান্য একটি অংশ দেখা যায়। আবার বছরের কিছু সময় সেটি দেখা যায় না। এ থেকে **চাঁদ যে নিজ অক্ষের উপরও অনিয়মিত ভাবে ঘোরে সেটা প্রমানিত হয়।
**
* **গ্যালিলিওর অন্যতম একটি পর্যবেক্ষনের মাঝে আছে শনির বলয় পর্যবেক্ষণ**। কিন্তু পৃথিবী থেকে দেখলে কোন কোন সময় শনি গ্রহের বলয় দেখা যায় না। শনি গ্রহের বলয় কিন্তু হারিয়ে যায় না। তাহলে কোথায় যায়? আসলে শনি গ্রহের বলয় গ্রহটির সাথে কোণ করে অবস্থান করে। শনি গ্রহের গতিপথে যখন এই বলয় তল আমাদের কাছে এমন কোণে অবস্থান করে যাতে সেখান থেকে আলো আসে না তখন তা আমাদের কাছে অদৃশ্য বলে মনে হয়। গ্যালিলিওও কিন্তু শনির বলয়ের এই অবলুপ্তির ব্যাপারটি লক্ষ্য করেছিলেন। তিনি শনির এই উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যটির মর্ম বুঝতে অনেকদূর এগিয়েছিলেন। কিন্তু বলয়গুলোর এই অবলুপ্তি তাকেও বিস্মিত করেছিল। এছাড়া তিনি যখন শনির বলয় দেখেছিলেন তখন তার নিম্ন ক্ষমতা সম্পন্ন যন্ত্রে তিনি কিন্তু শনির বলয় দেখেননি। তিনি দেখেছিলেন গ্রহটির দুইপাশে দুইটি কান আছে!। তখনকার কেউ কিছু আবিষ্কার করলে এই ভয় ছিল যদি কেউ এটি জানতে পারে, তাহলে যে জানতে পারে সে আবিষ্কারটিকে নিজের নামে চালিয়ে দিতো। এই ভয়ে, আবিষ্কারকেরা যে বিষয়টির সাহায্য নিতেন সেটি হলো এনাগ্রাম। এনাগ্রাম হলো এমন সাংকেতিক জগাখিচুড়ি ব্যাপার যার অর্থ আবিষ্কারক ছাড়া আর কেউ জানতেন না। গ্যাললিও তার এই আবিষ্কারটিকে লিখে রেখেছিলেন এভাবে:
***Smaismrmielmepoetaleumibuvnenugttaviras
***এই সংকেতের মানে কিন্তু কেউ বুঝতে পারেননি। তখনকার সমসাময়িক কেউ একজন প্রচুর পরিশ্রম করে এই শব্দগুলোকে পুনর্বিন্যাস করেন এভাবে :
***Slave,umbistineum geminatum Martial proles
***এটি লাতিন ভাষায় ছিল। এর অর্থ হলো :
"*তোমাদের নমস্কার, মঙ্গলের যমযসন্তান*।"
তখন অনেকের দৃঢ়বিশ্বাস হলো গ্যালিলিও হয়ত মঙ্গলের ২টি উপগ্রহ আবিষ্কার করেছেন। কিন্তু মঙ্গলের উপগ্রহ আবিষ্কৃত হয় আরও প্রায় ২৫০ বছর পরে। যাই হোক গ্যালিলিও তার গোপন রহস্য প্রকাশ করেন এভাবে :
***Altissimum planetam tergeminum observaci
***(*একটি অত্যন্ত উঁচু আর ত্রিগুণ গ্রহ পর্যবেক্ষন করিয়াছি*) যাই হোক, এটি ছিল গ্যালিলিওর টেলিস্কোপ এর ত্রুটির কারণে দেখা শনি গ্রহের প্রকৃত রূপ।
এই ছিল গ্যালিলিও যা দেখেছিলেন তার কিছু সারসংক্ষেপ। যখন কেউ মানতে পারছিল না কোপার্নিকান মতবাদ, আঁকড়ে ধরে ছিল টলেমি, অ্যারিস্টটলীয় মতবাদকে, তখন কেউ একজন খেয়ালের বশে একটা টেলিস্কোপ তৈরি করল নিজের মতো। আর বিস্ময়াবিভূত করে দিলো পুরো মানবজাতিকে।
*লিখেছেন - রাজহাঁস *