আঠার শতকের মুসলিম বীর ইমাম শামিল ( রহঃ)

উসমানী খিলাফতের সৈনিক ইমাম শামিল ( রহ:) কে বলা হয় আঠারো শতকের রুশ সিংহ। দাগেস্তান ও ককেশাসের এই মহান বীর অর্ধশত বছর ধরে নাকানি চুবানি খাইয়েছেন প্রতাপশালী রুশ জার সম্রাটদের। ইতিহাস তাই তাকে করে রেখেছে অমর, অক্ষয়।

.
এক যুদ্ধে তার পাঁজরের তিনটি হাড় কেটে যায় ও তাকে ঘেরাও করে ফেলে জার সৈন্যরা। তখন তিনি তার বিখ্যাত ঘোড়ায় চড়ে এক লাফে আল্লাহু আকবার হুংকার দিয়ে, তিন সারি সৈন্যের মাথার উপর দিয়ে চলে যান। এরপর থেকেই তিনি সিংহ বলে পরিচিত। বিখ্যাত লেখক লিউ তলস্তয়কে তার খালা জোর করে যুদ্ধে পাঠান শুধুমাত্র ইমাম শামিল কে দেখতে। যেনো তিনি গর্ব করে বলতে পারেন তার ভাগিনা ইমাম শামিলকে দেখেছে। এ যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়েই তলস্তয় লিখেছিলেন কাফকার ডায়রি ও ওয়ার এন্ড পিস নামের জনপ্রিয় দুটি বই।
.
রুশ আগ্রাসন বিরোধী এই মহান বীর ১৭৯৭ সালের ২৬ শে জুন, দাগেস্তানের উনসুতলস্কি জেলার গিমরী গ্রামে জাতিগত এক আভার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মকালীন সময়ে রুশ সাম্রাজ্য ককেশাস অঞ্চলে তাদের আগ্রাসনের সূচনা করে। জন্মের পর প্রথমে তার নাম রাখা হয়েছিল আলী। তাঁর পিতা ছিলেন স্বাধীন ভূস্বামী। জমিদার বা ভূস্বামীকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় শামিল। সেই অনুসারে পিতার কাছ থেকে তিনি শামিল উপাধী লাভ করেন।
.
শৈশবে তিনি স্থানীয় শিক্ষকের কাছে ইসলামী বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানার্জনের মধ্য দিয়েই বেড়ে উঠেন। বিশ বছর বয়সে তিনি সিরিয়া গমন করেন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্বে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। শিক্ষা সমাপ্তির পর দেশে ফিরে তিনি রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে যোগদান করেন, যা ততদিনে ককেশাসের বুকে জেঁকে বসেছিল।১৮৩২ সালে এক যুদ্ধে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। ফলে তিনি যুদ্ধ থেকে কিছুদিনের জন্য অব্যহতি নিয়ে বিশ্রাম গ্রহণ করতে বাধ্য হন।
.
১৮৩৪ সালে তিনি পুনরায় নবোদ্যমে জিহাদে ফিরে আসেন। এর মধ্যে যুদ্ধে পরপর দুইজন ইমাম শাহাদাত বরণ করায় তাকে প্রতিরোধ সংগ্রামীদের নতুন নেতা হিসেবে নির্বাচন করা হয়। তার শারীরিক সক্ষমতা, জ্ঞানগত দক্ষতা এবং নেতৃত্বগত যোগত্যার মাধ্যমে তিনি সকলের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হন।তিনি ককেশাসের সকল মুসলমানদের একতাবদ্ধ হয়ে রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করেন। তার প্রতিরোধ সংগ্রামের মাধ্যমে তিনি জনসাধারণের মনে ককেশাসের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখার আশা জাগাতে সক্ষম হন।
.
১৮৩৪ থেকে ১৮৫৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ পঁচিশ বছর তিনি রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটানা প্রতিরোধ করে যান। রুশ বাহিনী বিভিন্ন যুদ্ধে অসংখ্যবার তার কাছে পরাজিত হতে বাধ্য হয়। কিন্তু প্রতিনিয়ত নতুন নতুন রুশ সেনার ককেশাসে অব্যাহত আগমনের প্রেক্ষিতে রুশ বাহিনী ককেশাস দখলে ক্লান্তিহীনভাবে নতুন নতুন অভিযান চালাতে থাকে। অপরদিকে ককেশাসে বসবাসকারী বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মাঝে গোত্রীয় বিরোধ ছড়িয়ে পরলে ইমাম শামিল তার বিভক্ত বাহিনী নিয়ে বিশাল রুশ বাহিনীকে বাধা দান করতে সক্ষম হতে পারেননি। রুশ বাহিনীর ক্রমাগত চাপে তারা ধীরে ধীরে পিছু হটতে বাধ্য হন।
.
১৮৫৯ সালে রুশ বাহিনী তাকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বন্ধী করতে সক্ষম হয়। তাকে মস্কোতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং কড়াভাবে নজর বন্দী করে রাখা হয়। দশ বছর পর তাকে মুক্তি দিয়ে হজ্জ্ব করার অনুমতি দেওয়া হয়। হজ্জ্বের পর তিনি মদীনায় আগমন করেন এবং এখানেই অসুস্থ হয়ে ১৮৭১ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারী ইন্তেকাল করেন। মদীনার জান্নাতুল বাকী কবরস্থানে রুশ আগ্রাসনের প্রতিরোধের এই শেষ নায়ককে দাফন করা হয়।
.
ইমাম শামিল সম্পর্কে রুশ ঐতিহাসিক জেনারেল কাদিইফ লিখেছেনঃ ককেশাস পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীদের সঙ্গে যুদ্ধে আমাদের এত অসংখ্য সৈন্য নিহত হয় যে, ভারতবর্ষ থেকে জাপান পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল জয় করার জন্যে যারা ছিল যথেষ্ঠ। (রুশ মে কাওম, পৃষ্ঠা ৪২)
.
সূত্র: ওয়ানপাথ নেটওয়ার্ক, উইকিপিডিয়া।

Writer: Md Milon Akanda

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form