পরিবারের কারো সঙ্গে ঝগড়া বিবাদ করে রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে যে কেউ এই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে । আবার কেউ মানসিকভাবে আঘাত পেয়ে রাগের বশবর্তী হয়ে জীবন ধ্বংসকারী কোন ওষুধ পান করে । এছাড়াও বড়দের অসতর্কতার কারণে বাচ্চারা ভুলবশত বিষ পান করে । প্রায়ই বিষপানের রোগী পাওয়া যায় সেগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো— কীটনাশক পান করা , অনেক পরিমাণে ঘুমের ঔষধ খাওয়া , কেরোসিন পান করা , ধুতরার বীজ খাদ্যের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়া , কোন ঔষধ ভুলক্রমে বেশি পরিমাণে খেয়ে ফেলা , বিষাক্ত মদ্যপান বা অতিরিক্ত মদ পান করা ইত্যাদি ।
বিষপানের রোগী আসামাত্র বিষপানের ধরণ সম্পর্কে আন্দাজ করা সম্ভব । সাধারণভাবে বিষপানের পর দেরি না করে নিম্নরূপ ব্যবস্থা নিতে হবে এবং তাকে হাসপাতালে পাঠাতে হবে ।
প্রাথমিক চিকিৎসাঃ
* রোগী শ্বাস নিতে না পারলে তাকে কৃত্রিমভাবে শ্বাস - প্রশ্বাস দিতে হবে । প্রয়োজনে সিপিআর পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে ।
* সজ্ঞান রোগীকে সর্বপ্রথম এক মগ পানি বা দুধ পান করানো ভাল কারণ এতে বিষ পাতলা হয়ে যায় ও বিষের ক্ষতির প্রভাব কমে আসে । শিশুদের ক্ষেত্রে আধা মগের মতো পানি বা দুধ রোগীকে পান করানো ভালো । অজ্ঞান রোগীকে তরল দেয়া যাবে না । তাকে সুবিধাজনক স্থানে শুইয়ে দিতে হবে ।
* রোগীকে বমি করানো উচিত হবে কিনা তার সিদ্ধান্ত নিতে হবে । কারণ সকল বিষপানের পর বমি করানো যাবে না । রোগীর শরীরে খিঁচুনি থাকলে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় রোগীকে বমি করানো যাবে না । কিছু বিষ যা প্রবেশের সময় মুখ , মুখগহ্বর ও অন্ননালীতে প্রদাহের বা দগ্ধতার সৃষ্টি করে অথবা ফুসফুসে প্রবেশ করে সংক্রমণের সৃষ্টি করে । এরূপ বিষপানের রোগীকে কোনক্রমেই বমি করানো উচিত নয় । কারণ বমি করার সময় এই পদার্থগুরো পুনরায় ক্ষতিসাধন করে ক্ষতের পরিমাণ বৃদ্ধি করে ।
পোড়া ও ক্ষত সৃষ্টিকারী বিষঃ
* এসিড ।
* ক্ষার বা এ্যালকালি ।
* গৃহে ব্যবহৃত বিশোধক ।
* গোসলখানা পায়খানা নর্দমা পরিষ্কারক বিশোধক ।
প্রদাহ সৃষ্টিকারী বিষঃ
* কেরোসিন ।
* তারপিন তেল ।
* রঙ এবং রঙ পাতলাকারক দ্রব্য ।
* পেট্রোলিয়াম ও পেট্রোলিয়াম জাতীয় দ্রব্য ।
রোগী কোন ধরনের বিষপান করেছে তা রোগীর মুখ , মুখগহ্বর ও শ্বাস - প্রশ্বাস পরীক্ষা করলে অতি সহজেই অনুমান করা যায় ।
* পোড়া ও ক্ষত সৃষ্টিকারী বিষপানে রোগীর মুখ ও মুখগহ্বরে পোড়া ক্ষত বা ফোসকা দেখা যাবে ।
* কেরোসিন জাতীয় বিষপানে রোগীর শ্বাসে উক্ত দ্রব্যের গন্ধ পাওয়া যাবে ।
৪ ঘণ্টার ভিতর বিষ খেয়ে থাকলে এবং জ্ঞান থাকলে রোগীকে নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে বমি করানো যেতে পারে ।
* মুখের মধ্যে আঙুল প্রবেশ করিয়ে বমি করানো যায় ।
* খারাপ স্বাদযুক্ত ডিমের সাদা অংশ ও কুসুম স্বল্প গরম দুধসহ বা স্বল্প গরম লোনা পানি পান করালে অনেকেরই সহজে বমি হয়ে যায় । তিতা কোন দ্রব্য মুখের মধ্যে দিয়েও বমি করানো যেতে পারে ।
* বমি করানোর সময় বিশেষভাবে নজর দিতে হবে যেন বমিকৃত কোন জিনিস বা পানীয় ফুসফুসে প্রবেশ না করে । এজন্য বমি করানোর সময় রোগীর মাথা নিচের দিকে ও মুখ পাশে কাত করিয়ে রাখতে হবে । হাসপাতালে রোগীকে বিষ অপসারণের ক্ষেত্রে রাইলস টিউবের ( একটি বিশেষ নল ) সাহায্যে করা যেতে পারে ।
বিষের বিরুদ্ধে কার্যকর ঔষধ
কিছু বিষকে নিষ্ক্রিয় করার ঔষধ রয়েছে । রোগী কোন বিষ দ্বারা আক্রান্ত তা জানতে পারলে সেই বিষকে নিষ্ক্রিয় করা ঔষধ প্রয়োগ করে রোগীর অবস্থার উন্নতি করা সম্ভব । এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে ।
নিচে কয়েকটি বিষপানের লক্ষণ উদাহরণসহ দেয়া হলো।
এনড্রিন বা বিভিন্ন কীটনাশকের বিষক্রিয়াঃ
এই ধরনের কীটনাশক পদার্থ পান করলে এর ঘ্রাণ পাওয়া যাবে । বিষপান করার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে রোগী মাথাব্যথা , ঘাম বের হওয়া , পেটে ব্যথা , বমি , পাতলা পায়খানা , মাংসপেশীর সংকোচন ও কামড়ানো ব্যথা , খিঁচুনি , দৃষ্টি ঘোলা হয়ে যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ নিয়ে আসতে পারে । এই ধরনের রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে পাঠাতে হবে । হাসপাতাল খুব দূরে হলে নিচের ব্যবস্থাপনা দিয়ে হাসপাতালে পাঠাতে হবে । * রোগীর গায়ের কাপড় - চোপড় যতটা সম্ভব খুলে সমস্ত শরীর ধুয়ে ফেলতে হবে এবং নখগুলো পরিষ্কার করতে হবে ।
* রোগীকে বমি করাতে হবে ।
* শ্বাসনালী পরিষ্কার রাখার ব্যবস্থা করতে হবে ।
* খোলামেলা বাতাসে রাখতে হবে যাতে শ্বাস নিতে কষ্ট না হয় ।
* যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিতে হবে ।
ধুতরার বিষক্রিয়াঃ
ধুতরা একটি উদ্ভিদজাত বিষ । এগুলো খেলে নিচের লক্ষণগুলো প্রদর্শিত হয়ে থাকে ।
* ধুতরা বিষে রোগীর মুখ শুকিয়ে যায় , মুখে জ্বালাপোড়াসহ প্রচণ্ড পিপাসা থাকে ।
* বমিবমি ভাব বা বমি হয় , পেট ফেঁপে ওঠে , কিছু ধরতে অসুবিধা হয়
* চামড়া শুকনো এবং গরম থাকে , জ্বর থাকতে পারে ।
* হাঁটা এলোমেলো হয়ে যায় । ঘুমঘুম ভাব থাকে , নাড়ির গতি বেড়ে যায় ।
* চোখের মনি বড় হয়ে যায় । যা টর্চের আলোতে সংকুচিত হয় না । দেখতে অসুবিধা হয় ।
* অস্থিরতা থাকে , বুঝতে শুনতে ও বলতে ভুল হয় , প্রস্রাবে তলপেট টন টন করে ।
* এরপরে খিঁচুনি হতে পারে এবং রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে । এই অবস্থায় প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যবস্থা করে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে ।
কেরোসিনের বিষক্রিয়াঃ
কেরোসিনের বিষক্রিয়ার ক্ষেত্রে নিচের লক্ষণগুলো দেখা যায় । সাধারণত বাচ্চারা না বুঝে কেরোসিন তেল খেয়ে ফেলে । এক্ষেত্রে বাবা - মা নার্ভাস না হয়ে প্রথমে লক্ষণগুলো লক্ষ্য করুন ।
* এই ধরনের রোগীর বমি , মুখ , শ্বাস - প্রশ্বাস , প্রস্রাব ও কাপড়চোপড় থেকে কেরোসিনের গন্ধ পাওয়া যাবে ।
* গলায় জ্বালাপোড়া ও ব্যথা থাকবে ।
* পাতলা পায়খানা ও পেটে ব্যথা থাকবে ।
* শ্বাসপ্রশ্বাস ঘন ঘন হবে ।
* বুকের মধ্যে ঘড়ঘড় শব্দ হতে পারে । জ্বর থাকতে পারে ।
* নাড়ি দুর্বল ও অনিয়মিত হতে পারে ।
এই ধরনের রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে পাঠাতে হবে । এই রোগীর স্টম্যাক ওয়াশ দেয়া বা বমি করানো যাবে না । এ্যান্টিবায়োটিক দিতে হবে যাতে নিউমোনিয়া বা ফুসফুসে অন্য কোন সংক্রমণ না হতে পারে ।
এসিড কিংবা ক্ষারের বিষক্রিয়াঃ
* রোগীকে বমি করানোর চেষ্টা করা যাবে না ।
* ক্ষতের উপর প্রলেপ সৃষ্টি করে এমন খাদ্যবস্তু যেমন দুধ , ডিমের সাদা অংশ খাওয়ানো যেতে পারে ।
* মুখ বা শরীরের কোন অংশে এসিড বা ক্ষার পড়লে সেখানে প্রচুর পানি ঢেলে ধুয়ে ফেলতে হবে । এসিড খেলে এন্টাসিড সাসপেনশন দেয়া যেতে পারে ।
* যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে ।
ঘুমের ওষুধের বিষক্রিয়াঃ
* বমি করানোর চেষ্টা করতে হবে ।
* ঠিকমত বমি করানো না গেলে স্টোমাক ওয়াশ করানোর জন্য নিকটস্থ হাসপাতালে পাঠাতে হবে ।
বিষক্রিয়ার প্রতিরোধের উপায়
* আমাদের দেশের ক্ষেত - খামারে পোকা মারার জন্য অনেক ধরনের বিষ ব্যবহার করা হয়ে থাকে । এছাড়া কেরোসিন , ঘুমের ওষুধ ইত্যাদি দিয়ে বিষক্রিয়া ঘটতে পারে । দুর্ঘটনাক্রমে ঘটে যাওয়া বেশিরভাগ বিষক্রিয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব ।
* বিষক্রিয়া চিকিৎসার চেয়ে এর প্রতিরোধ নিরাপদ ও সহজ ।
* নিজের ঘরবাড়ি , কর্মস্থলকে নিরাপদ রাখার জন্য কৃষক , কলকারখানায় ও মাঠে খামারে নিয়োজিত কর্মী , শিক্ষক , স্বাস্ত্যকর্মী , বাবা - মা সহ ছাত্র - ছাত্রী কিংবা ছেলেমেয়ে সবার ভূমিকা রয়েছে ।
* যে কোন ধরনের কেমিক্যাল বা রাসায়নিক সামগ্রী নিরাপদভাবে ব্যবহার ও নাড়াচাড়া করুন ।
* রাসায়নিক সামগ্রী নিরাপদে রাখুন । ব্যবহার করে তা সরিয়ে নিরাপদে রেখে দিন । শিশুর নাগালের বাইরে কীটনাশক , ওষুধ ও পরিষ্কারকরণ সামগ্রী ( ডেটল , স্যাভলন ইত্যাদি ) রাখুন ।
* আপনার প্রয়োজন নেই এমন কোন রাসায়নিক পদার্থ ঘরে বা বাড়িতে রাখবেন না ।
* খাবার জিনিসের কোন পাত্রে রাসায়নিক সামগ্রী রাখবেন না । ভুলবশত কেউ খাবার কিংবা পানীয় মনে করে খেতে বা পান করতে পারে ।
* যথাযথ পরিমাণ ও যথাযথভাবে কীটনাশক , ওষুধ ও পরিষ্কারকরণ সামগ্রী ব্যবহার করুন । গায়ে আঁটা লেবেল পড়ে নির্দেশ অনুযায়ী ব্যবহার করুন । পড়তে না পারলে অন্য কারো সাহায্য নিন । লেবেলহীন পাত্র থেকে রাসায়নিক সামগ্রী ব্যবহার করা বিপজ্জনক । প্রয়োজনে দোকান থেকে লেবেলসহ সামগ্রী বদলিয়ে নিন ।