আমাদের এই মহাবিশ্বে পাঠ্যপুস্তকের মধ্যকার মাথা ঘোরানোর জিনিস থেকে শুরু করে পৃথিবীর থেকে দূরবর্তী গ্রহ নক্ষত্র সবকিছুই যেন খুবই বিস্ময়কর। লক্ষ্য লক্ষ্য আলোক বর্ষ দূর থেকে দেখেই যতটা অবাক করা লাগে, তার থেকেও হয়তোবা বেশি অবাক করা লাগবে যখন আমরা সেইসব বিস্ময়কর জায়গায় পৌছাতে পারব।।
সপ্নের স্থানে সপ্নে সপ্নে না পৌছিয়ে বাস্তবে পৌছাতেও কেমন জানি রাস্তাটা সেই সপ্নের রাস্তার মতই লাগে। রাস্তাটার নাম দেই ' বিন্দুর পথ ', বিন্দুর পথের যাতায়াত ভাড়া অনেক বেশি। বিন্দুর পথ দিয়ে চলতে গেলে আপনাকে অবশ্যই অনেক বড়লোক হতে হবে, হতে হবে হাজারো ট্রিলিয়ন টাকার মালিক। তবে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় এত্ত টাকা কোথা থেকে আসবে, এত মুল্যবান বস্তুতে কি আছে যেটা বিক্রি করে আপনি এত্ত টাকা পাবেন বা সেই বস্তুকে ব্যাবহার করে আপনি বিন্দুর পথের গন্তব্যে পৌছাতে পারবেন!!? জিনিসটা কি হবে সেটা অবশ্যই এতক্ষণে বুঝতে পেরেছেন। হ্যা,আমি এন্টি-ম্যাটারে (Antimatter) কথাই বলছি।। 'এন্টি-ম্যাটার ' শব্দটা প্রথমে শুনলেই প্রথমে আমাদের মনে এই প্রশ্নটি আসে,
|> এন্টি ম্যাটার মানে কি!!?,
. খায় নাকি মাথায় দেয়!!
. এটা খুজতে এখন থেকেই মাটি খোড়া শুরু করে দিব কিনা ;
matter এর অর্থ পদার্থ সুতরাং antimatter এর অর্থ অপদার্থ, তাই তো!? তবে না, একে প্রতিবস্তু বলা হয়ে থাকে( অপদার্থ ও প্রতিবস্তু কিন্তু এক নয়)। আমরা আমাদের চারপাশে যা কিছু দেখি,যা কিছু স্পর্শ করি সব কিছুই হলো ম্যাটার। এই সকল ম্যাটারই ছোট ছোট কণিকা বা particle দিয়ে গঠিত হয়েছে। ঠিক একই ভাবে Antimatter গঠিত হয় Antiparticle এর দ্বারা। একটু ঘুরে আসা যাক অতিত থেকে, কিভাবে এই antiparticle বা বিপরীত কনার ধারণা আমাদের সামনে উপস্থিত হলো,:-
১৯২৮ সালে Paul Dirac (পল ডিরাক) আলোর কাছে কাছাকাছি গতিশীল কোনো পার্টিকেলের আচার-আচরন কেমন হবে সেটা নিয়ে কাজ করছিলেন। তখন তার ম্যাথমেটিক্যাল ইকুয়েশন থেকে তিনি দুই ধরনের সমাধান পাচ্ছিলেন, একটা ধনাত্মক এবং একটা ঋণাত্মক। অনেকটা এরকম যে x^2=4 (x=2, -2) । তিনি এই দুইটা অংশের মধ্যে নেগেটিভ অংশ নিয়ে ভাবতে থাকেন এবং একসময় প্রেডিক্ট করেন যে, সকল কণারই একটি করে বিপরীত কণা আছে। তারই চার বছর পর Carl David Anderson ক্লাইড চেম্বার এক্সপেরিমেন্ট ( এটা দ্বারা পার্টিকেলের দৃশ্যমান গতিপথ দেখা যায়) এর মাধ্যমে তিনি খুবি অদ্ভুত একটা বিষয় দেখতে পান। সেখানে ম্যাগনেটিক ফিল্ড প্রয়োগ করা হলে সকল পার্টিকেলের বেকে যাওয়ার একটি নির্দিষ্ট গতিপথ তৈরি হয়। তবে তিনি দেখেন ইলেকট্রনের গতিপথের ঠিক বিপরীত একটি গতিপথ তৈরি হয়েছে, যেটা পল ডিরাকের ভবিষ্যতবাণীর বিষয়টি প্রমান করে এবং এটার মাধ্যমেই সর্বপ্রথম ইলেক্ট্রনের বিপরীত এন্টি-ইলেক্ট্রন বা পজিট্রন (positron) আবিষ্কৃত হয়।
কোনো কনার বিপরীত কনা বলতে তার বিপরীত আধান বিশিষ্ট কনাকে বোঝায়।আমরা ইলেকট্রনকে ঋণাত্মক আধান বিশিষ্ট ধরে থাকি অর্থাৎ এর এন্টি এলেক্ট্রন হবে ধনাত্মক চার্জ বিশিষ্ট। ঠিক তেমনই প্রোটনের এন্টি প্রোটন হবে ঋণাত্মক আধান বিশিষ্ট। নিউট্রনের চার্জ যেহেতু শুন্য, সে কারনে এন্টি নিউট্রনের চার্জও হবে শুন্য। তাহলে এই তিনটি এন্টি পার্টিকেল সংযুক্ত করলে আমরা আমাদের কাঙ্খিত এন্টি-পরমানু বা এন্টি-মৌল পাব। যদি আমরা আমাদের পর্যায় সারণির প্রথম মৌল নেই তবে সেটি হবে Anti-Hydrogen। সেখানে কেন্দ্রে থাকবে নিউট্রন ও নেগেটিভ চার্জবিশিষ্ট প্রোটন এবং বাইরের কক্ষপথে পজেটিভ চার্জযুক্ত ইলেক্ট্রন। তবে এখানে একটা প্রশ্ন আসতে পারে যে, এই এন্টি-হাইড্রোজেন বা এন্টি-ম্যাটার তৈরি করেই বা কি হবে!? কেনই বা আমরা একে এত্ত মূল্যবান বলব??
আমরা কোনো কিছুর মুল্য বিবেচনা করি তার দুষ্প্রাপ্যতা অথবা সহজলভ্যতার উপর বিবেচনা করে। সোনার থেকে হীরার দাম বেশি কারন এটি সোনার তুলনায় অধিক দুষ্প্রাপ্য। এবার এমন কিছুর যদি কথা বলা হয় যেটা এই মহাবিশ্বে কোথাও নাই, তাহলে এর দুষ্প্রাপ্যতা বা বিরলতা কতখানি হওয়া উচিত। এন্টিম্যাটার এই মহাবিশ্বে কোথাও নাই বুঝালাম তবে আমি যদি আর্টিফিশিয়ালি ১কেজি আন্টিম্যাটার বানাতে পারি তাহলে আমি এটা দিয়ে করবটা কি!!
আমরা জানি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে দুইটি পারমানবিক বোমা ফেলা হয়েছিল, যেটার বিধ্বংসী ক্ষমতা ছিল হিউজ।
একটি এন্টিম্যাটার এবং একটি ম্যাটারকে যদি পরষ্পরের সংস্পর্শে আনা হয় তবে তারা বিস্ফোরিত হয়ে তাদের সম্পুর্ন ভরকে শক্তিতে রুপান্তরিত করবে (100% pure energy release)। কি পরিমান শক্তি রিলিজ করবে সেটা আমরা E=mc^2 সুত্রের মাধ্যমেই নির্নয় করতে পারব। সেই হিসাবে আমরা ১গ্রাম এন্টি ম্যাটারের থেকে প্রায় ৯০,০০০,০০০,০০০,০০০ জুল পরিমান শক্তি পাব। যেটার বিস্ফোরণ হবে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে সংঘটিত বিস্ফোরণের চেয়েও অনেক বড়। শুধু তা-ই নয়, আমাদের আন্টিম্যাটার ও ম্যাটার এর মাধ্যমে এটি ঘটানোর জন্য কোনো প্রকার এরেঞ্জমেন্টের প্রয়োজন নেই,শুধু দুটিকে এক করলেই হবে। যেমন ১ গ্রাম এন্টিম্যাটারকে মাটিতে ফেলে দেওয়ার মতো ব্যাপার। তাহলে তোমরা বুঝতে পারছ যে আমার কাছে ১কেজি এন্টিম্যাটার থাকলে আমি কি করতে পারতাম :)
আবার সেই প্রথমের বিন্দুর পথের কাছে আসা যাক।আমাদের এই বিন্দুর পথ পাড়ি দেবার জন্য বা ইন্টারস্টেলার ট্রাভেলের জন্য একটি দারুণ জ্বালানি হতে পারে এই এন্টিম্যাটার। যেহেতু ১গ্রাম থেকে এত্ত পরিমান শক্তি পাওয়া যায় তবে ২০ গ্রাম থেকে কত্ত শক্তি পাওয়া যাবে, সেটা আমরা কল্পনা করতে পারি!! এর পাশাপাশি, এর মাধ্যমে আমরা আলোর বেগের ৫০% বেগ অর্জন করতে সক্ষম হব। এ থেকে বুঝিতে পারতেছি যে, আমাদের পক্ষে Interstellar travel করাটা কতটা সোজা, এই কথা শুনেকি এখনই ব্যাগ গুছিয়ে বিন্দুর পথ পাড়ি দিতে মন চাচ্ছে!? "তবে না", যতটা সোজা মনে হচ্ছে তার থেকেও
(যতটা সোজা মনে হচ্ছে)^n গুন কঠিন [n=∞ ] :')
কেন এত কঠিন কেন আমরা সবাই এটা তৈরি করতেছি না!?
আমাদের এই পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত শুধু একটি জায়গায়তেই এন্টি ম্যাটার তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। CERN (European Council for Nuclear Research) এ অবস্থিত LHC(Large Hadron Collider) তে উচ্চগতির পার্টিকেলের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটানো হয়, যেখান থেকে এন্টি-পার্টিকেল পাওয়া যায়। এই পর্যন্ত CERN শুধু এন্টি-পার্টিকেলই নয় বরং একটি এন্টি-হাইড্রোজেনও তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।
যদি এই LHC কে টানা ১ বছর চালানো হয় তবে সেটি থেকে ১০০ট্রিলিয়ন এন্টি-প্রোটন উৎপন্ন করা সম্ভব হবে। ১০০ ট্রিলিয়ন শুনেকি অনেক বেশি মনে হচ্ছে!! ১টি প্রোটনের ভর 1.673×10^-24g হলে, ১গ্রাম এন্টি-প্রোটন তৈরি করতে CERN এর ৬ বিলিয়ন বছরেরও বেশি লেগে যাবে। যার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারতেছি যে এটা আমাদের জন্য একটা অসম্ভব বিষয়। এ ছাড়াও আরেকটি সমস্যা হলো আমরা কোনো এন্টিম্যাটারকে ম্যাটারের পাত্রে রাখতে পারব না।
আমরাও যেহেতু ম্যাটার সেহেতু হাতে ধরলেও বিস্ফোরণ ঘটবে। এইটার একটা সমাধান হলো ম্যাগনেটিক ফিল্ড। CERN এ penning malmberg trap এর মাধ্যমে এন্টি-হাইড্রোজেন টা সংরক্ষিত করা হয়েছে। যেখানে ম্যাগনেটিক ফিল্ডের মাধ্যমে এটিকে ভাসিয়ে রাখা হয়েছে (যদিও এটার আরো অনেক ব্যাখ্যা আছে)।
উপরের এসব কিছু দেখে আমরা অবশ্যই বুঝতে পারতেছি যে antimatter কতটা নামি দামি লোক। তাহলে এন্টিম্যাটারে দাম কত নির্ধারণ করা হয়েছে!! NASA এর তথ্যঅনুসারে এখন ১গ্রাম এন্টিম্যাটার এর মুল্য ৬২.৫ ট্রিলিয়ন USD, যেটা বাংলাদেশি টাকায় ৫,৩৫২,৫৭০,৬২৫,০০০,০০০ টাকা (৫ এর পর কত অঙ্ক সেটা গুনতে গিয়ে বোর হলে কতৃপক্ষ দায়ি নয় ;') আমরা বুঝতে পারতেছি যে, আমাদের বিন্দুর পথের যানবাহনের জ্বালানিতে এন্টিম্যাটার ব্যাবহার করার চেয়ে, আমাদের সপ্নের জ্বালানিতে এটি ব্যাবহার করা অধিকতর সুবিধার। তাহলে সপ্নের যানবাহনে একটু কল্পনাতে ঘুরে আসা যাক।।
কী হতো যদি আমাদের এই সম্পুর্ন মহাবিশ্বটাই এন্টি-পার্টিকেল দ্বারা গঠিত হতো?এই মহাবিশ্বের বাইরেও কি এন্টিম্যাটারের মহাবিশ্বের অস্তিত্ব আছে?আমাদের পক্ষে কি সেখানে যাওয়া সম্ভব? আমরা না পারলে, এমন কি আছে যেটা এই মহাবিশ্বেও থাকতে পারবে আবার এন্টিম্যাটারের মহাবিশ্বেও থাকতে পারবে??
প্রথমত আমাদের এই পুরো মহাবিশ্ব যদি এন্টি পার্টিকেল দ্বারা তৈরি হতো তাহলে ওইটাই হতো আমাদের সাধারণ পার্টিকেল। আমাদের এই মহাবিশ্ব যে এখন এন্টিম্যাটার না সেটা বোঝার কোনো উপায় নাই। আমাদের কাছে যারা হবে এন্টিম্যাটারের প্রানী,ঠিক তাদের কাছেও আমরা হবো এন্টিম্যাটারের প্রানী। এন্টিম্যাটারের দুনিয়া এবং ম্যাটারের দুনিয়ার মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য থাকবে না। এই মহাবিশ্বের বাইরে antimatter এর অন্য কোনো মহাবিশ্ব আছে কিনা সেটা আমরা এখনো বলতে পারি না। যদি থেকেও থাকে তাহলে, এই দুনিয়া এবং ওই দুনিয়া উভয় জায়গায়তেই আমরা চলাচল করতে পারব যদি আমরা ফোটন বা আলো হয়ে থাকি, কারন এটি একইসাথে ম্যাটার এবং এন্টিম্যাটার (অন্য কোনো দিন এটি নিয়ে কথা বলব)।।
পরিশেষে একটা কথাই বলব যে,
বিস্ময়কে উন্মোচন করতে গেলে
বিস্মিত তো হতেই হবে।।
বনান ভুল হতে পারে ;
ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন
দেবজ্যোতি গোস্বামী অতনু
Reference,
https://home.cern/science/physics/antimatter
https://www.livescience.com/32387-what-is-antimatter.html
https://youtu.be/nUBVMUiZtQ4
https://youtu.be/y6eDh45tX7Q