তিমির আত্মহত্যার রহস্য



সুইসাইড! 

এই গম্ভীর শব্দটির সাথে মানুষের জীবন ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িত হলেও,  কয়েকমাস আগে এমন একটি কান্ড করে বসলো এক তিমি।

হ্যাঁ,

বাংলাদেশের কক্সবাজার এলাকায় কিছু দিন আগে দুটো মৃত তিমি ভেসে আসে, মৎস্য গবেষকরা ধারণা করছে তারা দম্পতি ছিলো এবং পুরুষ তিমিটি জাহাঁজের ধাক্কায় আঘাত প্রাপ্ত হয়ে মারা গেলে, স্ত্রী তিমিটি তার শোকে আত্মহত্যা করে। 

যদিও তিমি আত্মহত্যার কথা নতুন নয়, এর আগেও 

অস্ট্রেলিয়ার তাসনানিয়া  সৈকতে প্রায় ৪০০ টির মত পাইলট তিমি উঠে এসেছিলো। ২০১৭ এর ফেব্রুয়ারীতে নিউজিল্যান্ডেও প্রায় ৭০০ তিমি তীরে উঠে এসেছিলো।

ভোলানটিয়াররা এদের অনেককে সমুদ্রে নিয়ে ছেড়ে আসলেও এদের অনেকেই বার বার সৈকতে চলে আসে। যদিও তারা বুঝতে পারে যে সৈকত তাদের জীবনের জন্য হুমকি স্বরুপ। তবুও জেনে শুনে যেন সৈকতকেই বেছে নেয়, আর পানিশুন্যতা থেকে মারা যায়। 

সুস্থ তিমিদের এরকম দল বেঁধে বেলাভূমিতে উঠে আসার অনেক ঘটনা রয়েছে সারা বিশ্বে।  তিমির এরুপ আচরণ থেকে একটি গুজব বা ভুল ধারণার জন্ম হয়েছে তিমিরাও মানুষের মত আত্মহত্যা করে।

তবে উচ্চ গবেষণা কেন্দ্র গুলোও কি তিমির এই আচরণকে আত্মহত্যা হিসেবে দেখছে?? চলুন এবার তা জানা যাক।

তিমির এরুপ সৈকতমুখী যাত্রার পেছনে তারা কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন - 

১) হ্যাঁ, 

তিমিও একটি অনুভূতিশীল প্রাণী । তাদের মধ্যেও রয়েছে সামাজিক বন্ধন। যখন ঘনিষ্ঠ কেউ মারা যায় তাদের মধ্যেও ডিপ্রেশন তৈরী হয়, এখান থেকে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিতে পারে। এবং দীর্ঘ সময় এভাবে না খেয়ে থাকাতে অসুস্থ হয়ে যায়, ফলে ভালো সাঁতার কাটতে পারেনা, গভীর সমুদ্রে গিয়ে শিকারও ধরতে পারে না, এভাবে অসুস্থ তিমিরা জলে ভাসতে ভাসতে একসময় সৈকতে এসে পৌঁছায়। তাহলে তিমির এধরনের মৃত্যুকে আমরা নিশ্চয় "আত্মহত্যা" বলতে পারিনা? 

২) ঝাঁকে ঝাঁকে তিমির সৈকতে উঠে আসার পেছনে অনেক বিশেষজ্ঞরা ভাবছেন,  হয়তো দলনেতা যখন ভুলক্রমে সৈকতে উঠে আসে তাকে ফলো করা বাকি তিমিরাও সৈকতে আটকা পড়ে যায় অথবা হতে পারে পরিবারের কোন সদস্য সৈকতে ফেঁসে গেছে, তাকে বাঁচানোর জন্য সিগনাল পাঠালে সেই সিগনাল শুনে দুরদুরান্ত থেকে দলে দলে তিমিরা ছুটে আসে তাকে বাঁচানোর জন্য

যেহেতু তারাও সংঘবদ্ধ জীব। কিন্তু বেশির ভাগ সময় বাঁচাতে তো পারে না, উল্টো নিজেরাও সৈকতের কাঁদা মাটিতে আটকা পরে যায় আর বড় শরীরটা নিয়ে সমুদ্রে ফিরে যেতে পারে না। ২-১ ঘন্টার মধ্যেই ডিহাইড্রেটেড হয়ে মারা যায়। 

তবে প্রশ্ন হলো-

তাদেরকে  জলে ফিরিয়ে দিয়ে আসলে আবার সৈকতে উঠে আসে কেন? 

এর কারণও হলো তাদের পরিবার, সমাজের প্রতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। যতক্ষণ না তাদের সঙ্গীদের সাথে করে নিয়ে যেতে পারছে নিজেদের সাথে তারা তাদের ছেড়ে যেতে চাই না, বার বার ছুটে আসে তাদের বাঁচানোর জন্য। ওদিকে সৈকতে আটকে থাকা তিমিরা তো ক্রমাগত বাঁচানোর জন্য সিগনাল দিতেই থাকে, সেই শব্দ শুনেও চোখ বুঝে আত্মীয়দের এভাবে ছেড়ে সমুদ্রে চলে যেতে পারেনা।  এভাবেই উপকূলে তিমির গণ মৃত্যু হয়।

3) সেনাবাহিনীদের সোনার (SONAR), যা সমুদ্রের তলদেশে চলার সময় শব্দ তরঙ্গের সৃষ্টি করে, ৩৬০ ডিগ্রি তে সেই শব্দ চারদিকে ছড়াতে থাকে যেন সমুদ্রের গভীরে শত্রুপক্ষের কোন সাবমেরিন চলাচল করলে তাকে ডিটেক্ট করতে পারে শব্দের প্রতিধ্বনির মাধ্যমে। 

কিন্তু বিষয় হলো তিমি, ডলফিনরাও শব্দ তরঙ্গ ব্যবহারের মাধ্যমে একে অপরের সাথে করে। সোনার থেকে আসা শব্দ তাদের যোগাযোগে সমস্যা করে, সেই শব্দের তীব্রতাও অনেক বেশি, ফলে সামুদ্রিক প্রাণীরা ভয় পেয়ে ঔ শব্দ থেকে বাঁচতে হয় গভীর সমুদ্রের দিকে ছুটতে  থাকে ফলে শ্বাসকষ্টে মারা যায় নতুবা সৈকতের দিকে ছুঁটে আসে দলে দলে। এরপর যা হয় তা তো আগেও বলছিলাম। 

৩) এটি হলো- ডিকমপ্রেশন সিকনেস। 

নাহ,,

নাম শুনে ভয় পেতে হবে না। সহজ ভাষায় বলছি- আপনি শুনলে হয়তো অবাক হবেন,  আমরা যেই বাতাস হরদম নিশ্বাসের সাথে গ্রহণ করছি তা কিন্তু বিশুদ্ধ অক্সিজেন নয়। সেই বাতাসের মাত্র ২১% হলো অক্সিজেন আর ৭৮% থাকে নাইট্রোজেন। 

এই যে এতো বিশাল মাত্রার নাইট্রোজেন গ্রহন করার পরও এর প্রভাব আমরা বুঝতে পারিনা কারন এটি বলার মত ক্ষতিকর প্রভাব রাখে না।

কিন্তু যত সমুদ্রের গভীরে যায় তত আমাদের উপর চাপ বাড়তে থাকে। আর এই চাপ যত বাড়তে থাকে আমাদের শরীরে থাকা নাইট্রোজেন গ্যাস গুলো রক্তে দ্রবীভূত হতে থাকে। আর সেই অবস্থায় আমরা যখন তাড়াহুড়ো করে গভীর জল থেকে সমুদ্রের পৃষ্ঠে উঠে আসি, দ্রবীভূত নাইট্রোজেন গুলো নাইট্রোজেন বাবলে পরিণত হয় আর সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে, ফলে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। প্রাথমিক উপসর্গ হিসেবে আমরা জয়েন্ট পেইন অনুভব করি কিন্তু সমস্যা যদি আরো গুরুতর হয় সেক্ষেত্রে  প্যারালাইসি, ব্রেইনের কাজ করা বন্ধ হয়ে যাওয়া এসব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত হয়ে যায়।

এখন তিমির ক্ষেত্রে চিন্তা করতে গেলে তাদের শরীর এবং সাতারের কায়দা এমন ভাবে বিবর্তিত হয়েছে যে তারা জানে কোন পদ্ধতিতে গভীর সমুদ্র থেকে সারফেসে উঠে এলে তারা নাইট্রোজেন বিষক্রিয়া থেকে বাঁচতে পারবে কিন্তু তবুও সৈকতে ভেসে আসা তিমির শরীর পরীক্ষা করে দেখা গেছে তাদের শরীরেও নাইট্রোজেনের বিষক্রিয়া হয়। এর সম্ভাব্য কারণ হলো সমুদ্রের গভীরে অনেক হাঙর আছে যারা তিমিদেরও শিকার করে, তাদের হাত থেকে বাঁচতে দ্রুত পালাতে বা সোনার থেকে আসা শব্দ শুনে ভয়ে বা নার্ভাসনেস থেকে পালাতে গিয়ে দ্রুত সারফেসে উঠে আসে, আর এখানেই করে ফেলে ভুল।

ফলে নাইট্রোজেনের বিষক্রিয়ায় বা ডিকমপ্রেসার সিকনেসে মারা যায়। আর তাদের মৃতদেহ ভেসে আসে সৈকতে।

যদিও এদের বাইরে থেকে দেখে সুস্থই মনে হয়, কিন্তু ভেতরে ঠিকই Internal damage হয়ে যায়।  আর আমরা ধরে নি, সে হয়তো কারো শোকে আত্মহত্যা করলো।

আরো কিছু কারণ রয়েছে। যেমন-

সমুদ্রের কোন অঞ্চলে সায়ানো ব্যাকটেরিয়া অতিরিক্ত বেড়ে গেলে, ঐ এলাকা Dead zone. এ পরিণত হয়, কারণ অক্সিজেনের পরিমাণ খুব কমে যায়। সেই এলাকা ছেড়ে ভালো বাসস্থান খুঁজতে খুজতে অনেক সময় তিমিরা সৈকতে চলে আসে।

তো, এই পর্যন্ত যে ক'টি কারণ দেখলাম তার কোনটায় তিমির আত্মহত্যাকে সরাসরি সমর্থন করে না।  হয়তো হলুদ সাংবাদিকেরা মানুষকে আকর্ষণ করার জন্য এসব চিত্তাকর্ষক নিউজ ছড়িয়ে থাকেন।

Arpita Arpi Das

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form