জীববিজ্ঞানীর চাকরি

Biologists job


১।

ধরুন আপনার ছোটবেলা থেকেই কোনকিছুর শখ। সেটা হতে পারে ঘুড়ি ওড়ানো বা মাছ ধরা। আমার সবসময়কার ঝোঁক ছিল ভিডিও গেম। সেই বাচ্চাকাল থেকেই। ধরে নিলাম আপনার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই। আপনি একজন সাংঘাতিক পর্যায়ের ‘গেমার’।

একদিন আপনার মাথায় চিন্তা এল- আচ্ছা, ভিডিও গেম জিনিসটাকে তো আমি খুবই পছন্দ করি। এমনটা কি করা যায় না যে এইসব ভিডিও গেম নিয়েই আমি বাকি জীবন কাটাব? ভিডিও গেম খেলার চাকরি বলে কি কিছু আছে?

ব্যাপারটা নিয়ে আপনি একটু ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখলেন, গেম জার্নালিস্ট বলে আসলেই একটা বস্তু আছে। এই পেশার মানুষদের কাজ হল যখন যত ভিডিও গেম বের হয় একধার থেকে সব খেলা এবং রিভিউ করা।

একটু লেখার হাত থাকলে এর চেয়ে ভাল চাকরি আপনার জন্য আর হয় না। এতদিন বড়দের কথা কানে তুলেই ভুল করেছেন। সারাদিন ভিডিও গেম নিয়ে পড়ে থাকাতেই আসল মুক্তি।

কিন্তু এরকম পেশাদার গেমারদের সাক্ষাৎকার ইত্যাদি যখন শুনলেন, তখন ব্যাপারটা আপনার কাছে একটু কেমন কেমন ঠেকল। এই মানুষগুলো দিনরাত ভিডিও গেম খেলেন ঠিকই, কিন্তু সেটা তাদেরকে একটা কড়া নিয়মের মধ্যে থেকে করতে হয়। এদের কাজ হচ্ছে নতুন ভিডিও গেম বের হওয়ার সাথে সাথে যত দ্রুত সম্ভব সেটা আগাগোড়া খেলা শেষ করে রিভিউ বের করা। এর ফলে গেমটা কেমন যেন গিলে ফেলতে হয়, আস্বাদন করা হয় না- আর পরে আস্বাদন করার সময়ও পাওয়া যায় না, কারণ একটা গেম শেষ করতে না করতেই বাজারে নতুন গেম চলে আসে। আর সবসময় সব গেম খেলতে তো ভালও লাগে না। মনে করুন আপনার খেলতে ইচ্ছে করছে চাষবাসের গেম। কিন্তু ওপরতলার লোকেরা হয়ত বলছে- চাষবাস সামনের মাসে, এই সপ্তাহে ঐ রক্তারক্তির গেমটা নিয়ে লিখতে হবে। কাজেই সেটা আপনার এখনই খেলতে বসতে হবে। পরীক্ষার আগের রাতে যেরকম চা-কফির সাগরে ভেসে পুরো সিলেবাস নিয়ে বসতে হয়, সেরকম এখানে আপনার রাত দু'টো তিনটে চারটে পর্যন্ত ভিডিও গেমে শত্রু মারতে হবে।

চাকরি মানেই হল কোন একটা কাজের বিনিময়ে আপনাকে টাকাপয়সা দেওয়া। অর্থই অনর্থের মূল জানেন তো। কাজেই যতক্ষণ পর্যন্ত ওপরতলার লোকেরা আপনার জীবন খানিকটা বিষিয়ে তুলতে না পারছেন, ততক্ষণ যেন টাকাটা উসুল হয় না।

উদাহরণ দিলাম ভিডিও গেমের, কিন্তু জীবনের আরো সিরিয়াস বিষয়ের ক্ষেত্রে এই কথা আরো বেশি প্রযোজ্য। যেমন বিজ্ঞান।

আমার পড়াশোনা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞানে। সেখানে অনার্স মাস্টার্সের পাট চুকিয়ে আমি মহাখালির আইসিডিডিআরবি,তে গবেষক হিসেবে যোগদান করি, এবং যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষায় আসার আগ পর্যন্ত প্রায় আড়াই বছর এখানেই পড়ে থাকি। এই পুরো সময়টার অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখতে গেলে বই হয়ে যাবে। আমার এই লেখাটার উদ্দেশ্য আরো সীমিত- আমার অভিজ্ঞতাকে প্রেক্ষিত হিসেবে ব্যবহার করে চাকরিজীবনে বিজ্ঞানচর্চা ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা। একজন জীববিজ্ঞানের ছাত্র যখন তার ইউনিভার্সিটির ল্যাবে মনের আনন্দে গবেষণা করে, সেটার সাথে টাকার বিনিময়ে গবেষণা করার কিছু গুরত্বপূর্ণ ফারাক আছে।

মিলও আছে, কারণ বিজ্ঞানচর্চা তো বিজ্ঞানচর্চাই। কিন্তু ফারাকগুলো সম্পর্কে জানাই মনে হয় বেশি জরুরি।


২।

কলেজ কিংবা ভার্সিটিতে পড়ার সময় আমাদের অনেকের কাছে বৈজ্ঞানিক গবেষণার ধারণাটা থাকে খুব সরলরৈখিক। গবেষণা মানে আমাদের কাছে ল্যাবে কাজ করা, তার ফলাফল নিয়ে চমৎকার সব গবেষণাপত্র প্রসব করা, এবং তারপর দেশ-বিদেশের সবার কাছে সমাদৃত হওয়া। বিশেষ করে ভার্সিটির ল্যাবে মাগনা ছাত্রসুলভ গবেষণার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আসলেই তাই (যদি ভাগ্য একটু ভাল থাকে আরকি)।

জীববিজ্ঞানীর চাকরিজীবন কিন্তু খানিকটা আলাদা। ছাত্র হিসেবে আমরা বিজ্ঞানের যে অংশটুকুর সাথে পরিচিত থাকি- আলখেল্লা পরে গবেষণাগারে এই সেই পরীক্ষা করা- সেটা আসলে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার শুরু নয়, বরং শেষ।

যেকোন ধরণের গবেষণা করার জন্য প্রথমে যে বস্তু লাগে সেটা হল টাকা। পৃথিবীর বেশ কিছু অনুদান সংস্থা শুধু এই উদ্দেশ্যেই টাকার বস্তা নিয়ে বসে আছে। বিজ্ঞানীদের দরখাস্ত সাপেক্ষে তারা তাদের সাগর থেকে বালতি বালতি করে পানি দেয়।

এই টাকা আনার পথ ঊষর কণ্টকাকীর্ণ।

সাধারণত টাকা আনার প্রক্রিয়া শুরু হয় কোন বৈজ্ঞানিক পার্টনার বা সহযোগী জোগাড় করার মাধ্যমে- বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেটা বিদেশের কোন গবেষক দল। তারপর শুরু হয় তাদের সাথে মিলে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে দিন নেই রাত নেই করে গবেষণার নকশা করা, বাজেট বানানো, অনুদান হাতানোর জন্য দরখাস্ত লেখা। এই সময়টাতে অফিসে রাত এগারোটা-বারোটা বাজা অস্বাভাবিক না। অবশেষে প্রতীক্ষার পর কপাল ভাল থাকলে পনেরো-বিশ শতাংশ ক্ষেত্রে টাকা মঞ্জুর হয়।

টাকা মঞ্জুর হওয়া গবেষণার প্রথম ধাপ। এরপর আইনের লোকের কাছে গিয়ে দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে লালফিতে করো রে, ফাইন্যান্সে দৌড়ে বাজেট মঞ্জুর করো রে, ব্যবস্থাপনার লোকের সাথে কথা বলে রিভিউ বোর্ডের একশ' পাতার প্রোটোকল বানাও রে, শ'খানেক লোকের কাছে হাজার সাইনের জন্য হুটোপুটি করে বেড়াও রে, লোকলস্কর আনার জন্য হিউম্যান রিসোর্সকে ধরো রে-

বিজ্ঞান অতিশয় কুৎসিত বস্তু। আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে এসব ঘুরেফিরে বিজ্ঞানীদেরই করতে হয়।

এই সব কিছু পার করে প্রজেক্ট শুরু করতে পারলে তারপর গবেষণার সাজসরঞ্জাম অর্ডার করা, অনুদানের টাকা ঠিকঠাকমত আনার জন্য বিলপত্র করা, মাঠে কাজ থাকলে সেদিককার যুদ্ধকৌশল ঠিক করা- কবে কোথায় যাওয়া হবে, কার কী দায়িত্ব, যাওয়ার জন্য টাকাপয়সা কোত্থেকে আসবে, ফাইন্যান্সের লোকজন সেটা মানবে কিনা, টিমের বাকিরা ঘাড়ত্যাড়ামি করবে কিনা, ইত্যাদি লাখো চিন্তার পর তারপর ল্যাবের মধ্যে পা দেওয়ার সৌভাগ্য হয়।

দেশে বিজ্ঞানীর চাকরি করার সময় পুরো প্রক্রিয়ার এমন কোন অংশ ছিল না যার সাথে সরাসরি জড়িত ছিলাম না- অনুদানের দরখাস্ত লিখে জমা দেওয়া থেকে নিয়ে পানি সংগ্রহের বোতল কেনা পর্যন্ত।


৩।

আমি যখন ভার্সিটির পর কলেরা হাসপাতালে নিয়োগের ভাইভা দিয়ে আসলাম, তখন এই সংস্থায় কী ধরণের বিজ্ঞান করব সেটা সম্পর্কে আমার কিছু ধারণা ছিল। আমি ভেবেছিলাম, আমি ভার্সিটিতে যা গবেষণা করেছি, একটা আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে কলেরা হাসপাতালে করা কাজ তার চেয়ে বেশি জটিল এবং 'উন্নতমানের' হবে। ভার্সিটির অণুজীব বিজ্ঞানের চেয়ে চাকরির অণুজীব বিজ্ঞানের মধ্যে আকর্ষণ জাঁকজমক বেশি থাকবে।

অথচ চাকরি জীবনে আমাকে প্রথম যে প্রজেক্টে নেওয়া হল সেটার "গবেষণাগারের" অংশ ছিল গ্রামদেশের একগাদা টিউবওয়েল থেকে বোতল বোতল পানি এনে সেখানে পায়খানার জীবাণুর সংখ্যা গোনা।

এটুকুই। এটা গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা সন্দেহ নেই, কিন্তু আকর্ষণীয় বা কাটিং-এজ ঠিক বলা যায় না।

এমনিতে কিন্তু গবেষণা প্রকল্পটার উদ্দেশ্য ছিল ইন্টারেস্টিং- আমরা তলিয়ে দেখছিলাম, বিশেষ বিশেষ পেশা কিংবা অর্থসম্পদের মানুষের কি পেটের অসুখ বেশি হয় কিনা। কিন্তু এই প্রকল্পের পঁচানব্বই ভাগ হচ্ছে সমাজবিদ্যা আর অর্থনীতি, বাকি পাঁচ ভাগ অণুজীব বিজ্ঞান। সেই পাঁচ ভাগও শুধুমাত্র রোবটের মত পানি টেস্ট।

এখানে বলে রাখি- বাংলাদেশের সব জীববিজ্ঞান চাকরিজীবীর অভিজ্ঞতা আমার সাথে মিলবে এমন ভাবার কারণ নেই। কলেরা হাসপাতাল নিজেই প্রায় একটা মহাবিশ্বের মত, এবং তার ভেতরে স্থান-কালের প্রভাব অনেক- একেক তলায় এবং একেক সময়ে গবেষণার মান একেকরকম দেখা যায়। আমার উদ্দেশ্য তাই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পুরো সংস্থাটার সরলীকরণ করা নয়। কিন্তু অন্তত বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে যদি আপনি জীববিজ্ঞান গবেষণা করতে চান, তাহলে এখন পর্যন্ত আপনার একটু “মামুলি” গোছের জনস্বাস্থ্য গবেষণা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। এটাই অধিকাংশ ক্ষেত্রের বাস্তবতা।

এর কারণ বোঝা সহজ- আমরা উন্নয়নশীল দেশের মানুষ। আমাদের এখানে সবচেয়ে দামী বিজ্ঞান হল জনস্বাস্থ্য। ভিব্রিও কলেরির ইন্টিগ্রেজ জিনগুলোর ফাইলোজেনি বের করা আপনার মাস্টার্স থিসিসের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে পেটের অসুখের টিকা পরীক্ষা করা তার চেয়ে বহুগুণে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই বাংলাদেশের প্রথম সারির গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে কলেরা হাসপাতালও একই নীতিতে বিশ্বাসী হবে এটা স্বাভাবিক- তারা দেশে বড়সড় প্রভাব রাখে এমন গবেষণাকে গুরুত্ব দিতে চাইবে। এজন্যই এখানের গবেষণা হল গরীবদুখীর দুঃখ মোচনের গবেষণা- শ'খানেক মানুষের রক্তের নমুনা নিয়ে এসে সেটার কোষ গুনতে বসা, মলের নমুনায় জীবাণু পরীক্ষা করা, হাতধোয়া পানিতে কয়টা করে জীবাণু থাকে সেটার গোনাগুনতি, এইগুলো হচ্ছে এসব গবেষণার থিম বা ভাব।

বাংলাদেশে এসব বিজ্ঞানের বৈষয়িক মূল্যই বেশি। হাজার হোক, আপনি একজন বেতনভোগী কর্মচারী। চাকরিজীবনে আপনি নিজের মনের আনন্দে গবেষণা করে বেড়ান খুব ভাল কথা, কিন্তু সেই গবেষণা যদি টাকা আনতে না পারে, তাহলে আপনাকে বেতন দিয়ে রেখে সংস্থার লোকসান। সাংগঠনিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখলে আপনি টাকা আনা বা টাকা উসুলের একটা হাতিয়ার মাত্র। এজন্যই গবেষণার উৎকর্ষের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল পাইকারী মূল্য।

আপনি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অতিআণুবীক্ষণিক জগত আর কাটিং-এজ বিজ্ঞানের প্রতি যে বুকভরা কৌতুহল নিয়ে বেরিয়েছেন, সেই কৌতুহলটার অর্থমূল্য বাংলাদেশে কম।

এটাই বাস্তবতা।


৪।

এই হচ্ছে আমার অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশে জীববিজ্ঞান (আর হয়ত সাধারণভাবে বিজ্ঞান) গবেষণার সংস্কৃতি। তবে হ্যাঁ, দেশে যে চমৎকার আকর্ষণীয় গবেষণা একদমই হয় না তা মোটেও নয়- সেই পুরো বিষয় নিয়ে আমার একটা বইই আসছে সামনের বইমেলায়। সেদিক থেকে দেখলে দেশে করা গবেষণার মূল্যটুকু হাজারগুণ বেশি, কারণ বাংলাদেশের বিজ্ঞান বহু কষ্টের ফসল।


Writer: Hassan Uz Zaman Shamol

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form