অরোরা বোরিয়ালিস ব্যাপারটাকে তো চেনেন মনে হয়। না চিনলে ছবিতে দেখে নিন। পৃথিবীর উত্তর-দক্ষিণ প্রান্তের আকাশে এরকম অদ্ভুত সুন্দর আলোকসজ্জা দেখা যায়।
আমেরিকার কিছু উপজাতি এই জিনিসকে বলত "হরিণ"। অর্থাৎ তাদের ভাষায় হরিণের প্রতিশব্দ যা, উত্তর আকাশের এই আলোর প্রতিশব্দও তাই। শ'খানেক বছর পুরোনো একটা নৃতত্ত্বের বইতে তথ্যটা পেলাম।
এর কারণটা বেশ মজার। এই উপজাতির লোকজন লক্ষ্য করেছে, কনকনে শীতের রাতে হরিণের পশমে হাত বুলোলে একরাশ জ্বলজ্বলে বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ তৈরি হয়। আকাশের এই আলো দেখতে অনেকটা এই স্ফুলিঙ্গের মত। কাজেই আকাশেও নিশ্চয়ই একপাল হরিণ আছে, এবং তাদের গা ঘষাঘষির ফলে এরকম আলোকসজ্জা তৈরি হচ্ছে।
এই ছোট্ট ভাষাতাত্ত্বিক উদাহরণ থেকে বিজ্ঞানের দর্শন ও সমাজতত্ত্ব সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস শেখার আছে। প্রথমত, উপসংহার ভুল হতে পারে, কিন্তু নেটিভ আমেরিকানদের এই চিন্তাপ্রক্রিয়া সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক। বিজ্ঞান মানেই হল একটা জানা জিনিসের কার্যকারণের আলোকে অজানাকে ব্যাখ্যা করা। মর্ত্যের স্ফুলিঙ্গের কারণ হরিণের পশমে ঘষাঘষি, কাজেই আকাশের স্ফুলিঙ্গের কারণও একই হতে বাধ্য। উপসংহার ভুল হওয়ার কারণ ছিল তাদের তথ্য-উপাত্তের স্বল্পতা, প্রক্রিয়ার ভুল নয়।
ব্যাপারটা আরো আশ্চর্যজনক এই কারণে যে, তারা তাদের এই বিজ্ঞানচিন্তায় সে সময়কার ইউরোপীয়দের থেকে এগিয়ে ছিল। দীর্ঘদিন পর্যন্ত ইউরোপের বিজ্ঞানচিন্তায় অ্যারিস্টটলিয় অধিবিদ্যা ছড়ি ঘোরাত। এই অধিবিদ্যার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল মর্ত্য ও স্বর্গের বিভেদ। অ্যারিস্টটলের মতে আকাশের আইনকানুন পৃথিবীর থেকে আলাদা- চাঁদ সূর্য গ্রহ তারা এক ধরণের বিশেষ বস্তু, তাই সেগুলো নিখুঁত বৃত্তাকার পথে অপরিবর্তনীয় গতিতে অনাদিকাল থেকে চলছে। কিন্তু মর্ত্যের সবকিছুই পরিবর্তনীয়, অস্থায়ী এবং অন্য একসারি নিয়ম মেনে চলে। এরকম প্রেক্ষিতে পশ্চিমের বিজ্ঞানচিন্তায় একটা গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লব এল নিউটনের (এবং নিউটন-সমসাময়িক অন্যান্য আরো দার্শনিকের) হাত দিয়ে, যিনি দাবি করলেন স্বর্গে প্রকৃতির যে আইন চলে, মর্ত্যেও একই আইন চলে। এ কারণেই পৃথিবীতে যে নিয়ম মেনে আপেল গাছ থেকে পড়ে, সে একই নিয়ম মেনে আকাশের গ্রহ নক্ষত্রের গতিপথ ধার্য হয়। বিজ্ঞানের কার্যকারণ সবজায়গায় একই।
নেটিভ আমেরিকান 'বিজ্ঞানীরা' অ্যারিস্টটলের সেই অধিবিদ্যাকে থোড়াই পরোয়া করলেন। তাদের চিন্তা এদিক থেকে ছিল খুব স্বচ্ছ- হরিণের গায়ে যে কার্যকারণ, আকাশেও সেই কার্যকারণ- দু'টো ঘটনার অবস্থান বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের জন্য আদৌ প্রাসঙ্গিক নয়।
উল্লেখ্য যে, অ্যারিস্টটলীয় অধিবিদ্যার প্রভাব ছিল তৎকালীন ইউরোপীয় জানলেঅলাদের মধ্যে- বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকাবুকো অধ্যাপক বা ধর্মযাজকদের বইতে (মানে 'এলিট' সমাজ আর কি)। কিন্তু সাধারণ মানুষের বিদ্যের অবস্থা ছিল এর থেকেও অনেক পেছনে। তারা এসব ব্যাপার ব্যাখ্যা করত স্রেফ রূপকথা দিয়ে- অমুক বীর যোদ্ধা শহীদ হয়ে আকাশে গিয়ে আলো জ্বালিয়েছেন ইত্যাদি।
এর সাথে লাগোয়া একটা নৃতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ- একটি জাতির বাহ্যিক সংস্কৃতি দিয়ে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থাকে যাচাই করা যায় না। অর্থাৎ স্থাপত্য, পয়ঃনিষ্কাশন বা গণিতবিদ্যাই মানুষের মানসিক অগ্রসরতার একমাত্র পরিচায়ক নয়। নেটিভ আমেরিকার উপজাতিদের সাথে ইউরোপের বিজ্ঞানচিন্তার তুলনা এর একটি ছোট্ট উদাহরণ। কিন্তু এর চেয়েও নাটকীয় উদাহরণ হল প্রাচীন মানুষের গুহাচিত্র। এই মানুষগুলোর বসবাস ছিল আজ থেকে প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার বছর আগে- এরা আধুনিক স্থাপত্যশৈলী দূরে থাক, পশুপালন পর্যন্ত জানত না। অথচ তাদের চিত্রকর্ম দেখে পিকাসো বলেছিলেন- আমরা আর কি ছবি আঁকব, যা আঁকার তা তো তুষারযুগের মানুষেরাই এঁকে গেছে। তাদের গুহাচিত্রের গভীর জটিলতার কাছে আধুনিক মানুষের কোন শিল্পকর্ম দাঁড়াতে পারবে কিনা সন্দেহ।
প্রাচীন মানুষের নৃতত্ত্ব (paleoanthropol ogy) বিষয়ে আমার প্রিয় বিজ্ঞানীদের নাম বলতে বললে ইয়ান ট্যাটারসল ওপরের দিকে থাকবেন। তিনি এই বাস্তবতাটাকে তুলে ধরেছেন এভাবে (ভাবার্থ করে লিখছি)-
উনিশ শতকের ইউরোপীয় জীবনব্যবস্থার সাথে তুলনা করলে প্রাচীন মানুষ ছিল নেহায়েতই বুনো। আমরা ইউরোপীয়রাই সৃষ্টির সেরা। আশরাফুল মাখলুকাত। আমাদের বাসগৃহ দুর্দান্ত মজবুত, ঝড়ে বাদলায় আমাদের ভ্রূক্ষেপমাত্র হয় না। আমরা মাটি চষে আমাদের প্রয়োজনমত খাবার উৎপন্ন করি। প্রকৃতি একরকম আমাদের হাতের মুঠোয়। আমাদের গীর্জাগুলোর স্থাপত্য অনিন্দ্যসুন্দর, আজ পর্যন্ত ইতিহাসে যার জুড়ি নেই। অন্যদিকে এই মানুষগুলোর স্থায়ী নিবাস পর্যন্ত ছিল না- এরা পশুর মত জায়গায় জায়গায় ঘুরে বেড়াত, যেখানে খুদকুঁড়ি যা পেত তাই খেয়ে জীবন চালাত। কাজেই এই আশ্চর্য জটিল গুহাচিত্রগুলো যে আসলেই প্রাচীন মানুষের করা, সেটা হজম করতে ইউরোপীয়দের বেশ বেগ পেতে হল। হয়ত আধুনিক কালেরই কোন চিত্রকর্ম বিজ্ঞানীরা প্রাচীন মানুষের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করছেন- এ ধরণের একটা সন্দেহের কথা কোন কোন মহলে শোনা যেতে লাগল।
এই সন্দেহ অবশ্য বেশিদিন টিকল না- কারণ পৃথিবীময় একের পর এক গুহার মধ্যে এ ধরণের শিল্পকর্ম আবিষ্কার হওয়া শুরু করল।
আসলে একজন সাংঘাতিক জটিল, অগ্রসর মনস্তত্ত্বের মানুষও খুব আদিম জীবনব্যবস্থা নিয়ে চলতে পারেন। এই বিশ ত্রিশ হাজার বছর আগের মানুষদের ঘরবাড়ি খেত ছিল না, কিন্তু তাদের চিত্রকর্ম ছিল মোনা লিসা পর্যায়ের। আর তাদের ভাবনার জগতটা জুড়ে ছিল অসামান্য জটিলতা।
আমাদের মতই।
ট্যাটারসলের বইটা হল Masters of the Planet। চমৎকার সুখপাঠ্য।
আমেরিকার কিছু উপজাতি এই জিনিসকে বলত "হরিণ"। অর্থাৎ তাদের ভাষায় হরিণের প্রতিশব্দ যা, উত্তর আকাশের এই আলোর প্রতিশব্দও তাই। শ'খানেক বছর পুরোনো একটা নৃতত্ত্বের বইতে তথ্যটা পেলাম।
এর কারণটা বেশ মজার। এই উপজাতির লোকজন লক্ষ্য করেছে, কনকনে শীতের রাতে হরিণের পশমে হাত বুলোলে একরাশ জ্বলজ্বলে বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ তৈরি হয়। আকাশের এই আলো দেখতে অনেকটা এই স্ফুলিঙ্গের মত। কাজেই আকাশেও নিশ্চয়ই একপাল হরিণ আছে, এবং তাদের গা ঘষাঘষির ফলে এরকম আলোকসজ্জা তৈরি হচ্ছে।
এই ছোট্ট ভাষাতাত্ত্বিক উদাহরণ থেকে বিজ্ঞানের দর্শন ও সমাজতত্ত্ব সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস শেখার আছে। প্রথমত, উপসংহার ভুল হতে পারে, কিন্তু নেটিভ আমেরিকানদের এই চিন্তাপ্রক্রিয়া
ব্যাপারটা আরো আশ্চর্যজনক এই কারণে যে, তারা তাদের এই বিজ্ঞানচিন্তায় সে সময়কার ইউরোপীয়দের থেকে এগিয়ে ছিল। দীর্ঘদিন পর্যন্ত ইউরোপের বিজ্ঞানচিন্তায় অ্যারিস্টটলিয় অধিবিদ্যা ছড়ি ঘোরাত। এই অধিবিদ্যার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল মর্ত্য ও স্বর্গের বিভেদ। অ্যারিস্টটলের মতে আকাশের আইনকানুন পৃথিবীর থেকে আলাদা- চাঁদ সূর্য গ্রহ তারা এক ধরণের বিশেষ বস্তু, তাই সেগুলো নিখুঁত বৃত্তাকার পথে অপরিবর্তনীয় গতিতে অনাদিকাল থেকে চলছে। কিন্তু মর্ত্যের সবকিছুই পরিবর্তনীয়, অস্থায়ী এবং অন্য একসারি নিয়ম মেনে চলে। এরকম প্রেক্ষিতে পশ্চিমের বিজ্ঞানচিন্তায় একটা গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লব এল নিউটনের (এবং নিউটন-সমসাময়িক অন্যান্য আরো দার্শনিকের) হাত দিয়ে, যিনি দাবি করলেন স্বর্গে প্রকৃতির যে আইন চলে, মর্ত্যেও একই আইন চলে। এ কারণেই পৃথিবীতে যে নিয়ম মেনে আপেল গাছ থেকে পড়ে, সে একই নিয়ম মেনে আকাশের গ্রহ নক্ষত্রের গতিপথ ধার্য হয়। বিজ্ঞানের কার্যকারণ সবজায়গায় একই।
নেটিভ আমেরিকান 'বিজ্ঞানীরা' অ্যারিস্টটলের সেই অধিবিদ্যাকে থোড়াই পরোয়া করলেন। তাদের চিন্তা এদিক থেকে ছিল খুব স্বচ্ছ- হরিণের গায়ে যে কার্যকারণ, আকাশেও সেই কার্যকারণ- দু'টো ঘটনার অবস্থান বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের জন্য আদৌ প্রাসঙ্গিক নয়।
উল্লেখ্য যে, অ্যারিস্টটলীয় অধিবিদ্যার প্রভাব ছিল তৎকালীন ইউরোপীয় জানলেঅলাদের মধ্যে- বিশ্ববিদ্যালয়ের
এর সাথে লাগোয়া একটা নৃতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ- একটি জাতির বাহ্যিক সংস্কৃতি দিয়ে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থাকে যাচাই করা যায় না। অর্থাৎ স্থাপত্য, পয়ঃনিষ্কাশন বা গণিতবিদ্যাই মানুষের মানসিক অগ্রসরতার একমাত্র পরিচায়ক নয়। নেটিভ আমেরিকার উপজাতিদের সাথে ইউরোপের বিজ্ঞানচিন্তার তুলনা এর একটি ছোট্ট উদাহরণ। কিন্তু এর চেয়েও নাটকীয় উদাহরণ হল প্রাচীন মানুষের গুহাচিত্র। এই মানুষগুলোর বসবাস ছিল আজ থেকে প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার বছর আগে- এরা আধুনিক স্থাপত্যশৈলী দূরে থাক, পশুপালন পর্যন্ত জানত না। অথচ তাদের চিত্রকর্ম দেখে পিকাসো বলেছিলেন- আমরা আর কি ছবি আঁকব, যা আঁকার তা তো তুষারযুগের মানুষেরাই এঁকে গেছে। তাদের গুহাচিত্রের গভীর জটিলতার কাছে আধুনিক মানুষের কোন শিল্পকর্ম দাঁড়াতে পারবে কিনা সন্দেহ।
প্রাচীন মানুষের নৃতত্ত্ব (paleoanthropol
উনিশ শতকের ইউরোপীয় জীবনব্যবস্থার সাথে তুলনা করলে প্রাচীন মানুষ ছিল নেহায়েতই বুনো। আমরা ইউরোপীয়রাই সৃষ্টির সেরা। আশরাফুল মাখলুকাত। আমাদের বাসগৃহ দুর্দান্ত মজবুত, ঝড়ে বাদলায় আমাদের ভ্রূক্ষেপমাত্র হয় না। আমরা মাটি চষে আমাদের প্রয়োজনমত খাবার উৎপন্ন করি। প্রকৃতি একরকম আমাদের হাতের মুঠোয়। আমাদের গীর্জাগুলোর স্থাপত্য অনিন্দ্যসুন্দর,
এই সন্দেহ অবশ্য বেশিদিন টিকল না- কারণ পৃথিবীময় একের পর এক গুহার মধ্যে এ ধরণের শিল্পকর্ম আবিষ্কার হওয়া শুরু করল।
আসলে একজন সাংঘাতিক জটিল, অগ্রসর মনস্তত্ত্বের মানুষও খুব আদিম জীবনব্যবস্থা নিয়ে চলতে পারেন। এই বিশ ত্রিশ হাজার বছর আগের মানুষদের ঘরবাড়ি খেত ছিল না, কিন্তু তাদের চিত্রকর্ম ছিল মোনা লিসা পর্যায়ের। আর তাদের ভাবনার জগতটা জুড়ে ছিল অসামান্য জটিলতা।
আমাদের মতই।
ট্যাটারসলের বইটা হল Masters of the Planet। চমৎকার সুখপাঠ্য।
Writer: Hassan Uz Zaman Shamol
Tags:
জানা-অজানা