করোনার সুবাদে ইদানিং অণুজীব বিজ্ঞান বলে একটা বিষয়ের ওপর জাতির চোখ পড়েছে।
অসম্ভব ছোট ছোট কিছু বস্তু আমাদের সমস্ত পরিবেশ ছেয়ে আছে- ভাতের প্লেট থেকে সাগর মহাসাগর পর্যন্ত। এমনিতে এদের সাথে আমাদের সখ্যতাই থাকে। কিন্তু অসাবধানে আমরা যদি তাদের পাতা সংসারে হাত দেই- তাহলে বিপদ। নতুন করোনাভাইরাস এতদিন বনেবাদাড়ে বাদুড় আর বনরুইয়ের পেটে ছিল, তাতে সমস্যা ছিল না। সমস্যাটা বাঁধল যখন একদল অতি বুদ্ধিমান মানুষ মনে করল- বনরুইগুলো ধরে ধরে এদের গায়ের আঁশগুলো ছ্যাঁচা দরকার। সেই গুঁড়ো দিয়ে ওষুধ বানানো যাবে। এরকম বনের জীবকে নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া ব্ল্যাকমার্কেট করলে ভাইরাসের হুল গায়ে বিঁধবেই।
যত জায়গায় অণুজীব সংক্রান্ত যতরকম বিপদ ঘটে, সবকিছুর পেছনেই আমাদের কোন না কোন বেআক্কেলেপনা থাকে।
দক্ষিণ আমেরিকায় হাইতি বলে একটা দেশ আছে। আজ থেকে বছর দশেক আগে সেখানে ভয়াবহ এক কলেরা প্রাদুর্ভাব হয়। কলেরা জানেন তো? এই রোগে ধরলে শরীরের যাবতীয় পানি স্রোতের মত সামনে পেছনে দিয়ে বেরিয়ে আসে- কেউ যেন দেহের ফ্লাশ টেনে দিয়েছে। আমাদের দেশে এটা নিতান্তই পরিচিত ব্যাপারে, বছরে বার দু'য়েক করে কলেরার ধাক্কা আসে। কিন্তু হাইতিতে বিগত এক শতকে এই জিনিস এই প্রথম- রীতিমত চোখের পলকে এসে সে হাইতির দু'লাখ মানুষকে শুইয়ে দিল, আরো দশলাখকে শরণার্থী বানিয়ে ছাড়ল।
তো এই মহাবিপদটার সূত্রপাত কোথায়? এখন বিজ্ঞানীরা এর উত্তর জানেন।
দু'হাজার চারের দিকে হাইতিতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর জমায়েত শুরু হয়। উদ্দেশ্য ছিল দেশটার রাজনৈতিক দাঙ্গাহাঙ্গামা সামলানো। এদের মধ্যে নেপালী একটা গ্রুপ পেটে কলেরার জীবাণু নিয়ে গিয়েছিল, আর তাদের ক্যাম্প থেকেই নর্দমার পাইপ লিক হয়ে কলেরা বাবাজী নদীতে গিয়ে পড়েছে। আর যাবে কোথায়, সেই নদীর পানি ব্যবহারের সূত্র ধরে মহামারীর আগুন ছড়িয়ে গেল।
এসব দুর্ঘটনার নীতিকথা হল, প্রকৃতির সাথে সমঝে চলার একটা ব্যাপার আছে। বিশেষ করে প্রকৃতির এই অদেখা বাসিন্দাদের সাথে। এদের সাথে বেমক্কা ঠোকাঠুকি লাগলে প্রলয় ঘটে যেতে পারে। সেই ঠোকাঠুকিটা যাতে না লাগে, এজন্য আসলে জানতে হবে এদের জীবনধারা ঠিক কেমন। এরা কোথায় থাকে না থাকে, কী খায়, কীভাবে ছড়ায়, স্বপ্নে কী দেখে।
খুব সহজ করে বললে- এই বিষয়ক বিজ্ঞানটাকেই বলা হয় অণুজীব বিজ্ঞান।
এই অণুজীব বিজ্ঞান গবেষকদের একটা প্রাথমিক কাজ হল অসুখ-বাঁধানো জীবাণুগুলোর বসতবাড়ি খোঁজা। মৌচাকে ঢিল যাতে না পড়ে, সেটা নিশ্চিত করতে গেলে আগে জানতে হবে মৌচাকটা ঠিক কোথায়। এই কাজটা সবচেয়ে কঠিন হচ্ছে মাটি-পানিতে যে জীবাণুগুলো থাকে তাদের ক্ষেত্রে। মাটির কোথায় জীবাণু থাকে সেটা বের করার জন্য আপনি কী করবেন? শহরময় ধূলো নিয়ে চালনি দিয়ে চালতে বসবেন? সেটা তো কোন কথা হতে পারে না। যেটা করতে পারেন সেটা হল শহরের জায়গা জায়গা থেকে ধূলোর নমুনা নিয়ে তারপর সেখানে কী জীবাণু আছে সেটা খতিয়ে দেখা।
এই স্যাম্পলিং বা নমুনা সংগ্রহ অণুজীব বিজ্ঞানীদের মাথাব্যাথার একটা বড় কারণ। খুব কম নমুনা নিলে কোথায় কী জীবাণু আছে সেটা ঠিকমত বোঝা যায় না। আবার খুব বেশি নমুনা নিতে গেলে টাকাপয়সায় টান পড়ে। এটা বিজ্ঞানীদের শ্বাশ্বত জেহাদগুলোর একটা। তারা তাই সবসময় ধান্ধায় থাকেন, কীভাবে কম পয়সা-পরিশ্রমে বেশি বেশি নমুনা সংগ্রহ করা যেতে পারে।
এরকম এক উদাহরণের গল্প করতে বসেছি।
ক্যাম্পাইলোব্যা ক্টার বলে একটা জীবাণু আছে- এই লাইনের গবেষকেরা একে আদর করে ক্যাম্পি বলেন। উন্নত বিশ্বে ডায়রিয়ার মূল কারণগুলোর একটা হচ্ছে এই জীবাণু। ইংল্যান্ডের একদল বিজ্ঞানীর মনে হল, মাটিতে এই জীবাণু কতখানি করে থাকে সেটা বের করা দরকার। জীবাণুর আদি বসত না জানলে এর ছড়ানোর গতিপথও বোঝা যাবে না। এর জন্য তারা একটা চমৎকার বুদ্ধি বের করলেন।
প্রাতভ্রমণ জিনিসটা পশ্চিমের একটা স্বাভাবিক দৃশ্য। প্রত্যেক সকালে প্রচুর মানুষ বাইরে হাঁটতে বেরোয়। বিজ্ঞানীরা চিন্তা করলেন, এই যে এত মানুষ প্রতিদিন মাইলকে মাইল হাঁটছে, হাঁটতে হাঁটতে তো এদের প্রত্যেকের জুতো ধূলোকাদায় ছেয়ে যাচ্ছে। সেই ধূলোকাদায় যদি ক্যাম্পি জীবাণু লুকিয়ে থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই তাদের জুতোর সাথেও সে লেপ্টে যাচ্ছে।
রবিঠাকুরের জুতা আবিষ্কার কবিতা তো পড়েছেন। পায়ে ধূলো লাগার সমাধান জমিনময় চামড়া লেপে দেওয়া নয়, শুধু নিজের পায়ে চামড়া জড়ানোই যথেষ্ট। বিজ্ঞানীরা সেই বুদ্ধিটাই করলেন- ক্যাম্পির নমুনা সংগ্রহের জন্য এলাকাময় মাটি না হাতিয়ে বরং এই প্রাতভ্রমণকারীদের জুতো হাতানো হোক।
এই বুদ্ধি নিয়ে তারা হাঁটনেঅলাদের দ্বারস্থ হলেন- আমরা একটু আপনাদের পায়ের ধূলো চাই, আপনারা দিতে রাজি আছেন?
প্রায় ষাটজন হাঁটনেঅলা খুশি হয়েই রাজি হলেন। তাদের আয়োজন করে শিখিয়ে দেওয়া হল, কাজের পদ্ধতিটা কীরকম হবে। প্রত্যেকে হাঁটতে বেরোনোর আগে প্রথমে জুতোটাকে প্লাস্টিক দিয়ে পেঁচিয়ে নেবেন, তারপর তার বাইরে ছবির মত একটা কাপড়ের আবরণী বা শু কাভার লাগাবেন। এতে জুতোর ময়লা শু কাভারে লাগবে না। হাঁটার সময় ফোনের জিপিএসটা চালু রাখতে ভুলবেন না, যাতে বিজ্ঞানীরা ল্যাবে বসেই প্রত্যেকটা জুতোর ইতিহাস জানতে পারেন- কোন জুতোতে প্রত্যেকদিন কোন জায়গার মাটি কতক্ষণ ধরে লেগেছে।
হাঁটা শেষ হলে কাভারটা সন্তর্পণে খুলে একটা বিশেষ কমলা ব্যাগে রাখতে হবে- কমলা মানে বিপজ্জনক, অর্থাৎ ভেতরে জীবাণু থাকতে পারে। তারপর সেটাকে একটা খামে ভরে বিজ্ঞানীদের ল্যাবরেটরি মারফত পাঠিয়ে দেবেন। জুতোর আবরণী, খাম, ব্যাগ, ইত্যাদি সাজসরঞ্জাম বিজ্ঞানীরাই দিয়ে দিলেন।
অর্থাৎ এখানে শুধু জুতোর ওপর মোজা পড়া ছাড়া নমুনা সংগ্রহের জন্য আলাদা করে কারোই আর তেমন হ্যাপা নেই।
ল্যাবরেটরিতে খামগুলো পৌঁছনোর পর বাকি কাজ বিজ্ঞানীদের- তারা একটা বিশেষ রাসায়নিক দিয়ে জুতোর কাভারগুলোকে কায়দা করে ধুয়ে ফেলেন, যাতে জীবাণু থাকলে সেটা পানিতে চলে আসে। তারপর সেই পানি নিয়ে পরীক্ষা করলেই বোঝা গেল, কার জুতোয় কীরকম জীবাণু এসেছে।
এই গবেষণা থেকে বিজ্ঞানীরা প্রকৃতিতে ক্যাম্পির বসতবাড়ি সম্পর্কে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার জানতে পারলেন, যেমন- যে জায়গাগুলোতে বন্য পাখিদের আনাগোনা বেশি, সেখানে এক ধরণের ক্যাম্পি বেশি পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, ঋতুর সাথে মাটিতে ক্যাম্পির কমবেশির একটা যোগ আছে। কম তাপমাত্রা আর বেশি বৃষ্টিপাতের সময়টাতে দেখা গেল ক্যাম্পিঅলা জুতোর কাভারের পরিমাণ বেশি।
এখান থেকে রোগ ছড়ানোর প্রক্রিয়া, সময়কাল ইত্যাদি সম্পর্কে অন্তত কিছু ধারণা করা গেল।
নমুনা সংগ্রহের মজার মজার পদ্ধতির উদাহরণ আরো আছে। জীবাণুর উপস্থিতি বোঝার জনপ্রিয় আরেকটা উপায় এরকম- বসতবাড়িতে ছোট বাচ্চাদের খেলার জন্য প্লাস্টিকের বল দিয়ে বলা হয়, এই বলটা তোমার, তুমি সারাদিন এটা নিয়ে যেভাবে ইচ্ছা খেলবে। পিচ্চি তো খেলনা পেয়ে মহাখুশি, সে সারাদিন বলটা নিয়ে উঠানে আহ্লাদ করে। চব্বিশ ঘন্টা পর আবার কর্মীরা সেই বাসাতে উপস্থিত হয়ে বলটা ফেরত নেন। বল ব্যাটা তো মাটি আর দেয়ালে আছড়াপাছড়ি করে বাড়ির যেখানে যত জীবাণু আছে সব কুড়িয়েছে। সেটাকে এবার ল্যাবে নিয়ে অনুসন্ধান করলেই বেরিয়ে আসে, এই বাড়ির উঠানের মাটিতে কীরকম জীবাণু আছে।
এই শু কাভার সিস্টেমের বিশেষত্ব হল, এখানে নমুনা সংগ্রহে বিজ্ঞানীদের সেরকম হাত নেই- পুরো ব্যাপারটাই সাধারণ মানুষ করছেন। বিজ্ঞানীদের দায়িত্ব তাদের কাজকর্ম দেখভাল করা, শু কাভার ছিঁড়ে টিড়ে গেল কিনা নজর রাখা, কেউ জিপিএস অন করতে গেলে ফোন করে হম্বিতম্বি করা- ইত্যাদি। এগুলো মোটামুটি মাছি মারা পর্যায়ের কাজ, আসল কাজের কাজী হচ্ছেন সকালবেলার হাঁটনেঅলারা।
এই ধরণের বিজ্ঞান- যেখানে তথ্য সংগ্রহের কাজটা করেন সাধারণ মানুষ- একে বলা হয় সিটিজেন সায়েন্স।
আমাদের দেশে সিটিজেন সায়েন্সের কী ধরণের সম্ভাবনা থাকতে পারে বলুন তো?
অসম্ভব ছোট ছোট কিছু বস্তু আমাদের সমস্ত পরিবেশ ছেয়ে আছে- ভাতের প্লেট থেকে সাগর মহাসাগর পর্যন্ত। এমনিতে এদের সাথে আমাদের সখ্যতাই থাকে। কিন্তু অসাবধানে আমরা যদি তাদের পাতা সংসারে হাত দেই- তাহলে বিপদ। নতুন করোনাভাইরাস এতদিন বনেবাদাড়ে বাদুড় আর বনরুইয়ের পেটে ছিল, তাতে সমস্যা ছিল না। সমস্যাটা বাঁধল যখন একদল অতি বুদ্ধিমান মানুষ মনে করল- বনরুইগুলো ধরে ধরে এদের গায়ের আঁশগুলো ছ্যাঁচা দরকার। সেই গুঁড়ো দিয়ে ওষুধ বানানো যাবে। এরকম বনের জীবকে নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া ব্ল্যাকমার্কেট করলে ভাইরাসের হুল গায়ে বিঁধবেই।
যত জায়গায় অণুজীব সংক্রান্ত যতরকম বিপদ ঘটে, সবকিছুর পেছনেই আমাদের কোন না কোন বেআক্কেলেপনা থাকে।
দক্ষিণ আমেরিকায় হাইতি বলে একটা দেশ আছে। আজ থেকে বছর দশেক আগে সেখানে ভয়াবহ এক কলেরা প্রাদুর্ভাব হয়। কলেরা জানেন তো? এই রোগে ধরলে শরীরের যাবতীয় পানি স্রোতের মত সামনে পেছনে দিয়ে বেরিয়ে আসে- কেউ যেন দেহের ফ্লাশ টেনে দিয়েছে। আমাদের দেশে এটা নিতান্তই পরিচিত ব্যাপারে, বছরে বার দু'য়েক করে কলেরার ধাক্কা আসে। কিন্তু হাইতিতে বিগত এক শতকে এই জিনিস এই প্রথম- রীতিমত চোখের পলকে এসে সে হাইতির দু'লাখ মানুষকে শুইয়ে দিল, আরো দশলাখকে শরণার্থী বানিয়ে ছাড়ল।
তো এই মহাবিপদটার সূত্রপাত কোথায়? এখন বিজ্ঞানীরা এর উত্তর জানেন।
দু'হাজার চারের দিকে হাইতিতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর জমায়েত শুরু হয়। উদ্দেশ্য ছিল দেশটার রাজনৈতিক দাঙ্গাহাঙ্গামা সামলানো। এদের মধ্যে নেপালী একটা গ্রুপ পেটে কলেরার জীবাণু নিয়ে গিয়েছিল, আর তাদের ক্যাম্প থেকেই নর্দমার পাইপ লিক হয়ে কলেরা বাবাজী নদীতে গিয়ে পড়েছে। আর যাবে কোথায়, সেই নদীর পানি ব্যবহারের সূত্র ধরে মহামারীর আগুন ছড়িয়ে গেল।
এসব দুর্ঘটনার নীতিকথা হল, প্রকৃতির সাথে সমঝে চলার একটা ব্যাপার আছে। বিশেষ করে প্রকৃতির এই অদেখা বাসিন্দাদের সাথে। এদের সাথে বেমক্কা ঠোকাঠুকি লাগলে প্রলয় ঘটে যেতে পারে। সেই ঠোকাঠুকিটা যাতে না লাগে, এজন্য আসলে জানতে হবে এদের জীবনধারা ঠিক কেমন। এরা কোথায় থাকে না থাকে, কী খায়, কীভাবে ছড়ায়, স্বপ্নে কী দেখে।
খুব সহজ করে বললে- এই বিষয়ক বিজ্ঞানটাকেই বলা হয় অণুজীব বিজ্ঞান।
এই অণুজীব বিজ্ঞান গবেষকদের একটা প্রাথমিক কাজ হল অসুখ-বাঁধানো জীবাণুগুলোর বসতবাড়ি খোঁজা। মৌচাকে ঢিল যাতে না পড়ে, সেটা নিশ্চিত করতে গেলে আগে জানতে হবে মৌচাকটা ঠিক কোথায়। এই কাজটা সবচেয়ে কঠিন হচ্ছে মাটি-পানিতে যে জীবাণুগুলো থাকে তাদের ক্ষেত্রে। মাটির কোথায় জীবাণু থাকে সেটা বের করার জন্য আপনি কী করবেন? শহরময় ধূলো নিয়ে চালনি দিয়ে চালতে বসবেন? সেটা তো কোন কথা হতে পারে না। যেটা করতে পারেন সেটা হল শহরের জায়গা জায়গা থেকে ধূলোর নমুনা নিয়ে তারপর সেখানে কী জীবাণু আছে সেটা খতিয়ে দেখা।
এই স্যাম্পলিং বা নমুনা সংগ্রহ অণুজীব বিজ্ঞানীদের মাথাব্যাথার একটা বড় কারণ। খুব কম নমুনা নিলে কোথায় কী জীবাণু আছে সেটা ঠিকমত বোঝা যায় না। আবার খুব বেশি নমুনা নিতে গেলে টাকাপয়সায় টান পড়ে। এটা বিজ্ঞানীদের শ্বাশ্বত জেহাদগুলোর একটা। তারা তাই সবসময় ধান্ধায় থাকেন, কীভাবে কম পয়সা-পরিশ্রমে বেশি বেশি নমুনা সংগ্রহ করা যেতে পারে।
এরকম এক উদাহরণের গল্প করতে বসেছি।
ক্যাম্পাইলোব্যা
প্রাতভ্রমণ জিনিসটা পশ্চিমের একটা স্বাভাবিক দৃশ্য। প্রত্যেক সকালে প্রচুর মানুষ বাইরে হাঁটতে বেরোয়। বিজ্ঞানীরা চিন্তা করলেন, এই যে এত মানুষ প্রতিদিন মাইলকে মাইল হাঁটছে, হাঁটতে হাঁটতে তো এদের প্রত্যেকের জুতো ধূলোকাদায় ছেয়ে যাচ্ছে। সেই ধূলোকাদায় যদি ক্যাম্পি জীবাণু লুকিয়ে থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই তাদের জুতোর সাথেও সে লেপ্টে যাচ্ছে।
রবিঠাকুরের জুতা আবিষ্কার কবিতা তো পড়েছেন। পায়ে ধূলো লাগার সমাধান জমিনময় চামড়া লেপে দেওয়া নয়, শুধু নিজের পায়ে চামড়া জড়ানোই যথেষ্ট। বিজ্ঞানীরা সেই বুদ্ধিটাই করলেন- ক্যাম্পির নমুনা সংগ্রহের জন্য এলাকাময় মাটি না হাতিয়ে বরং এই প্রাতভ্রমণকারীদের জুতো হাতানো হোক।
এই বুদ্ধি নিয়ে তারা হাঁটনেঅলাদের দ্বারস্থ হলেন- আমরা একটু আপনাদের পায়ের ধূলো চাই, আপনারা দিতে রাজি আছেন?
প্রায় ষাটজন হাঁটনেঅলা খুশি হয়েই রাজি হলেন। তাদের আয়োজন করে শিখিয়ে দেওয়া হল, কাজের পদ্ধতিটা কীরকম হবে। প্রত্যেকে হাঁটতে বেরোনোর আগে প্রথমে জুতোটাকে প্লাস্টিক দিয়ে পেঁচিয়ে নেবেন, তারপর তার বাইরে ছবির মত একটা কাপড়ের আবরণী বা শু কাভার লাগাবেন। এতে জুতোর ময়লা শু কাভারে লাগবে না। হাঁটার সময় ফোনের জিপিএসটা চালু রাখতে ভুলবেন না, যাতে বিজ্ঞানীরা ল্যাবে বসেই প্রত্যেকটা জুতোর ইতিহাস জানতে পারেন- কোন জুতোতে প্রত্যেকদিন কোন জায়গার মাটি কতক্ষণ ধরে লেগেছে।
হাঁটা শেষ হলে কাভারটা সন্তর্পণে খুলে একটা বিশেষ কমলা ব্যাগে রাখতে হবে- কমলা মানে বিপজ্জনক, অর্থাৎ ভেতরে জীবাণু থাকতে পারে। তারপর সেটাকে একটা খামে ভরে বিজ্ঞানীদের ল্যাবরেটরি মারফত পাঠিয়ে দেবেন। জুতোর আবরণী, খাম, ব্যাগ, ইত্যাদি সাজসরঞ্জাম বিজ্ঞানীরাই দিয়ে দিলেন।
অর্থাৎ এখানে শুধু জুতোর ওপর মোজা পড়া ছাড়া নমুনা সংগ্রহের জন্য আলাদা করে কারোই আর তেমন হ্যাপা নেই।
ল্যাবরেটরিতে খামগুলো পৌঁছনোর পর বাকি কাজ বিজ্ঞানীদের- তারা একটা বিশেষ রাসায়নিক দিয়ে জুতোর কাভারগুলোকে কায়দা করে ধুয়ে ফেলেন, যাতে জীবাণু থাকলে সেটা পানিতে চলে আসে। তারপর সেই পানি নিয়ে পরীক্ষা করলেই বোঝা গেল, কার জুতোয় কীরকম জীবাণু এসেছে।
এই গবেষণা থেকে বিজ্ঞানীরা প্রকৃতিতে ক্যাম্পির বসতবাড়ি সম্পর্কে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার জানতে পারলেন, যেমন- যে জায়গাগুলোতে বন্য পাখিদের আনাগোনা বেশি, সেখানে এক ধরণের ক্যাম্পি বেশি পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, ঋতুর সাথে মাটিতে ক্যাম্পির কমবেশির একটা যোগ আছে। কম তাপমাত্রা আর বেশি বৃষ্টিপাতের সময়টাতে দেখা গেল ক্যাম্পিঅলা জুতোর কাভারের পরিমাণ বেশি।
এখান থেকে রোগ ছড়ানোর প্রক্রিয়া, সময়কাল ইত্যাদি সম্পর্কে অন্তত কিছু ধারণা করা গেল।
নমুনা সংগ্রহের মজার মজার পদ্ধতির উদাহরণ আরো আছে। জীবাণুর উপস্থিতি বোঝার জনপ্রিয় আরেকটা উপায় এরকম- বসতবাড়িতে ছোট বাচ্চাদের খেলার জন্য প্লাস্টিকের বল দিয়ে বলা হয়, এই বলটা তোমার, তুমি সারাদিন এটা নিয়ে যেভাবে ইচ্ছা খেলবে। পিচ্চি তো খেলনা পেয়ে মহাখুশি, সে সারাদিন বলটা নিয়ে উঠানে আহ্লাদ করে। চব্বিশ ঘন্টা পর আবার কর্মীরা সেই বাসাতে উপস্থিত হয়ে বলটা ফেরত নেন। বল ব্যাটা তো মাটি আর দেয়ালে আছড়াপাছড়ি করে বাড়ির যেখানে যত জীবাণু আছে সব কুড়িয়েছে। সেটাকে এবার ল্যাবে নিয়ে অনুসন্ধান করলেই বেরিয়ে আসে, এই বাড়ির উঠানের মাটিতে কীরকম জীবাণু আছে।
এই শু কাভার সিস্টেমের বিশেষত্ব হল, এখানে নমুনা সংগ্রহে বিজ্ঞানীদের সেরকম হাত নেই- পুরো ব্যাপারটাই সাধারণ মানুষ করছেন। বিজ্ঞানীদের দায়িত্ব তাদের কাজকর্ম দেখভাল করা, শু কাভার ছিঁড়ে টিড়ে গেল কিনা নজর রাখা, কেউ জিপিএস অন করতে গেলে ফোন করে হম্বিতম্বি করা- ইত্যাদি। এগুলো মোটামুটি মাছি মারা পর্যায়ের কাজ, আসল কাজের কাজী হচ্ছেন সকালবেলার হাঁটনেঅলারা।
এই ধরণের বিজ্ঞান- যেখানে তথ্য সংগ্রহের কাজটা করেন সাধারণ মানুষ- একে বলা হয় সিটিজেন সায়েন্স।
আমাদের দেশে সিটিজেন সায়েন্সের কী ধরণের সম্ভাবনা থাকতে পারে বলুন তো?
Writer: Hassan Uz Zaman Shamol
Tags:
প্রবন্ধ