(নৌম চমস্কির The Chomsky Reader বইয়ের কিছু অংশের সম্পাদিত ভাবানুবাদ)
আজকাল রেডিও চালু করলেই যে জিনিসটা কানে আসে সেটা হল খেলাধূলার অনুষ্ঠান। ইদানীং এগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়েছে- অনেক শ্রোতাই অনুষ্ঠানে ফোন করে তাদের মতামত জানান। তো তাদের সেই আলোচনা শোনার সময় আমি একটা ব্যাপার খেয়াল করি। অধিকাংশ সময়ই এই আলোচনাগুলো হয় অতি উচ্চমানের, এবং শ্রোতারা প্রায়ই খেলাধূলা বিষয়ে গভীর চিন্তাভাবনা পর্যালোচনার পরিচয় দেন।
দুঃখজনক ব্যাপার হল এই মানুষগুলোকেই যখন আমি অন্য কোন অনুষ্ঠানে রাজনীতি সমাজনীতি ধর্ম ইত্যাদি নিয়ে কথা বলতে শুনি, সেই আলোচনা মান বা গভীরতার দিকে দিয়ে নিতান্তই হাস্যস্পদ শোনায়।
এই পার্থক্যের কারণ কী?
অনেকে হয়ত বলবেন, খেলাধূলা জিনিসটা জানাবোঝা বেশ সহজ, কিন্তু সমাজ রাষ্ট্র বোঝা অতটা সহজ নয়। কিন্তু আমি মনে করি ঘটনা অন্য। সেই অন্য ঘটনা বোঝার জন্য চলুন এতক্ষণের আলোচনা থেকে আরেকটু দূরের একটা উদাহরণের দিকে তাকাই।
অনেক আদিম নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী সংস্কৃতিতে এমন জটিল কিছু শাস্ত্র আছে যার মাথামুণ্ডু আমরা কিছুই বুঝব না। যেমন আত্মীয়তা বা জ্ঞাতি সম্পর্কিত বিভিন্ন রীতিনীতি বা কায়দাকানুন। এই রীতিগুলো ক্ষেত্রবিশেষে এতই জটিল যে এই লাইনের পাঁড় বিশেষজ্ঞও সেগুলো পুরোপুরি সামলে উঠতে পারেন না। তো জ্ঞাতিশাস্ত্রের
একটা ব্যাখ্যা এরকম। আমরা যেমন গণিত বিজ্ঞান ইত্যাদিকে একটা কাঠামোগত উপায়ে শাস্ত্র বানিয়ে নিয়েছি, এই আদিবাসীরা হয়ত সেরকম জ্ঞাতিসম্পর্ক নিয়ে তেমনটা করেছেন। তাদের সমাজে জটিল গণিত হয়ত নেই, কিন্তু তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে এইসব রীতিনীতি। তারা এসব নিয়ে চিন্তা গবেষণা করতে করতে এগুলোকে একটা গভীর শাস্ত্রের রূপ দিয়েছেন। আজ থেকে দেড়হাজার বছর আগে আরবের বেদুঈন গণিত চিনত না, কিন্তু বংশ বা কুলজীশাস্ত্রে সে ছিল ওস্তাদ- তার আটাশপুরুষের নাম ধাম কৃতিত্ব, কে কাকে বিয়ে করেছে, কে কবে কেন যুদ্ধে গেছে, ইত্যাদি রীতিমত চার্টের মত করে এঁকে সে বুঝিয়ে দিতে পারত।
অর্থাৎ মানুষ তার স্রষ্টাপ্রদত্ত জ্ঞানবুদ্ধি কোন না কোনভাবে ব্যবহার করবেই- সেটা হোক গণিতে বা কুলজীশাস্ত্রে। কোন না কোন একটা খাদে তার মগজ তাকে খাটাতেই হবে।
আমি মনে করি এর কাছাকাছি একটা কিছু আমাদের সমাজে হয়েছে। কোন একটা কারণে সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যে বেছে বেছে খেলাধূলাটাকেই একটা জটিল শাস্ত্রের রূপ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে যেমনটা বললাম, সত্যিকারের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সম্পর্কে আমাদের আলোচনা বা 'ডিসকোর্স' এর মান শোচনীয়। এই আলোচনাগুলোর মধ্যে এক বিন্দু জ্ঞানগভীরতা নেই। অথচ আমি মনে করি না সমাজনীতি রাষ্ট্রনীতি ধর্ম বিজ্ঞান ইত্যাদি খেলাধূলার চেয়ে এমন কিছু জটিল বিষয়। মানুষ চাইলেই এসব বিষয়ে তার আক্কেল খাটাতে পারে, কিন্তু আসলে খাটাচ্ছে খেলাধূলায়।
আমাকে ভুল বুঝবেন না- আমি বলছি না জগতের কোন বিষয়ই কঠিন নয়। কঠিন প্রশ্ন অবশ্যই আছে, এবং সেগুলোর জন্য আসলেই বিশেষজ্ঞের জ্ঞান প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞ শ্রেণীর বিরুদ্ধে আমার কোন রোষ নেই। কিন্তু খেলাধূলার উদাহরণটা থেকে আমাদের যে শিক্ষাটা নেওয়া উচিত, সেটা হল- অনেক বিষয়ে বিশেষজ্ঞের দ্বারস্থ না হয়েও সাধারণ মানুষের পক্ষেই অনেকখানি জ্ঞানলাভ সম্ভব। খেলাধূলার মত বিষয়ের ক্ষেত্রে কিন্তু মানুষ সেটা বোঝেও। কারণ খেলাধূলা-শাস্ত্
একদিক থেকে দেখলে খেলাধূলা গানবাজনা চলচ্চিত্র এ ধরণের বিষয়ে এরকম মনযোগের যথেষ্ট কারণ আছে। আমাদের সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থা
আমাদের কাঠামো বা সিস্টেম যদি অন্যরকম হত, যদি এতে মানুষ অংশগ্রহণে উৎসাহ পেত, তাদের কাজকর্ম চিন্তাভাবনা দিয়ে আসলেই যদি বাস্তবতার মধ্যে পরিবর্তন আনা যেত- তাহলে হয়ত তারা রাষ্ট্র সমাজ ধর্ম বিজ্ঞান নিয়েও খেলাধূলা পর্যায়ের গভীর আলোচনা করত।
Hassan Uz Zaman Shamol