জ্যামিতির গল্প : প্রমাণের ভিত্তি

শুরু করা যাক একটা সমস্যা দিয়ে। আপনাকে কেউ সামনাসামনি বা ফোন করে বা মেসেজ দিয়ে বা ফেসবুকে মেসেজ দিয়ে বা ইমেইলে বা গুপ্তসংকেতে বা কবুতরের পায়ে চিঠি পাঠিয়ে(!) জিজ্ঞেস করলো -
"বন্ধু, মনে করো একটা ত্রিভুজ আছে, ABC. এর BC বাহুর সাথে সমান্তরাল করে একটা রেখা আঁকা হলো যা এই ত্রিভুজের অপর দুই বাহু ( AB ও AC) কে যথাক্রমে D ও E বিন্দুতে ছেদ করলো। এখন প্রমাণ করতে হবে, ত্রিভুজের যেকোনো বাহুর সমান্তরাল সরল রেখা ঐ ত্রিভুজের অপর বাহুদ্বয়কে সমান অনুপাতে বিভক্ত করে৷ অর্থ্যাৎ, প্রমাণ করতে হবে, AD:DB = AC:CE.

তো, এই সমস্যা সমাধানের জন্য আপনি চিন্তা করা শুরু করলেন। আপনি দেখলেন চিত্রে ২ টা ত্রিভুজের মতো হয়েছে। ত্রিভুজ ABC আর ত্রিভুজ ADE. ADE ত্রিভুজের DE বাহু আবার ABC ত্রিভুজের BC বাহুর সমান্তরাল। তাহলে কী দাঁড়ালো? ∠B = ∠D, ∠C = ∠E. মানে কী! মানে হলো ত্রিভুজ দুইটা পরস্পর সদৃশ। তাহলে বলা যায় - AB:AD = AC:CE. ( যেহেতু, " আমরা জানি" সদৃশ ত্রিভুজদ্বয়ের অনুরূপ বাহুগুলোর অনুপাত সমান। এখান থেকে আপনি পেয়ে গেলেন আপনার কাংখিত প্রমাণ! ( চিত্র ১)
কিন্তু এখানেই আছে টুইস্ট। অত্যন্ত চুলচেরা ভাবে এই প্রমাণকে যদি আমরা অপারেশন থিয়েটরের আলোর নিচে ধরে(!) পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখি, তাহলেই একটু ফাঁকি চোখে পড়বে! এই ফাঁকি নিয়েই চলুন আলোচনা করা যাক!

এই আলোচনা শুরু করার আগে আমাদের একটা বিষয় সম্পর্কে জানতে হবে। সেটা হলো - জ্যামিতিতে কোণের পরিমাণ। তো সেটা সম্পর্কে আগে আলোচনা করা যাক।
জ্যামিতির কোণের সাথে ব্যাবিলনের সময়কার একটা সম্পর্ক আছে। আমাদের সংখ্যার ভিত্তি হচ্ছে ১০, আমরা ১০ ভিত্তিক সংখ্যা প্রায় সব কিছুতে ব্যবহার করি। সেই ব্যাবিলনীয় যুগে তাদের সংখ্যার ভিত্তি ছিল ৬০। এর কারণ হিসেবে ভাবা হয় যে ৬০ সংখ্যাটি ২,৩,৪,৫,৬ দ্বারা বিভাজ্য বলে তারা এটাকে তাদের সংখ্যার ভিত্তি হিসেবে ভাবতো। তো তারা একই সাথে ত্রিভুজ নিয়েও চিন্তা করেছিলো৷ একটা ত্রিভুজ সবচেয়ে ভালো(!) দেখায় যখন এটা সুষম ত্রিভুজের আকৃতিতে থাকে, অর্থ্যাৎ এর ৩ টি বাহু ও ৩ টি কোণ পরস্পর সমান হয়। তো এই প্রত্যেকটি কোণকে তারা ৬০ হিসেবে চিন্তা করতো। এভাবে তারা দেখেছিলো ৬ টা ত্রিভুজ বিশেষভাবে বসালে ( চিত্র ২) একটা বৃত্তাকার অংশকে সম্পূর্ণভাবে কভার করা যায়। এভাবে তারা বৃত্তের অভ্যন্তরের সম্পুর্ণ কোণকে ৩৬০° (৬০*৬) হিসেবে চিন্তা করতো।


এই ৩৬০° কোণের বৃত্তকে সমান ৪ ভাগে ভাগ করলে প্রতি ভাগে পাওয়া যাবে ৯০° করে, যেটাকে বলা হয় ১ সমকোণ। এবং ৩৬০° কোণের বৃত্তকে সমান ২ ভাগে ভাগ করলে পাওয়া যাবে ১৮০° করে, যেটাকে বলা হয় ১ সরলকোণ।
তো কোণের ধারণা আমরা মোটামুটিভাবে পেলাম৷ এবার আমাদের মূল আলোচনায় যাওয়া যায়। আমরা মূলত যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো, সেটা হলো জ্যামিতিতে প্রমাণ করার "ভিত্তি" টা কী। একটা উপপাদ্য প্রমাণে যে জিনিসগুলো স্বীকার করে নেওয়া হয় বা সত্য হিসেবে ধরে নেওয়া হয় সেগুলো কীভাবে পাওয়া যায়। তো শুরু করা যাক।

১) আপনি দুটো সরলরেখা আঁকলেন। সরলরেখা দুটো আবার সমান্তরাল। এখন একটা ছেদক আঁকলেন, যেটা এই দুই সমান্তরাল সরলরেখাকে ছেদ করবে। রেখা দুটি সমান্তরাল হওয়ার কারণে ছেদক এই রেখা দুটিকে হুবহু একইভাবে ছেদ করবে৷ অর্থ্যাৎ ছেদক দ্বারা উৎপন্ন কোণদ্বয় ( একইপাশের) পরস্পর সমান হবে। এই হলো অনুরূপ কোণদ্বয়ের পরস্পর সমান হওয়ার কারণ। অনুরূপ কোণদ্বয় পরস্পর সমান - এর একদম "গাণিতিক প্রমাণ" আছে কিনা আমার জানা নেই ( আমি পাইনি). তবে এটাকে এইভাবে চিন্তা করলে আসলে প্রমাণ পাওয়া যায় যে অনুরূপ কোণদ্বয় পরস্পর সমান হবে। ( চিত্র ৩ দ্রষ্টব্য)

২) অনুরূপ কোণদ্বয় যে পরস্পর সমান তা আমরা মেনে নিলাম (!). এবার বিপ্রতীপ কোণদ্বয় যে পরস্পর সমান তার প্রমাণ দেখুন। ( চিত্র ৪)

অনুরূপ কোণদ্বয় পরস্পর সমান এবং বিপ্রতীপ কোণদ্বয় পরস্পর সমান - এই দুটি "প্রমাণিত সত্যের" ওপর ভিত্তি করে এবার আমরা প্রমাণ করে ফেলতে পারি যে একান্তর কোণদ্বয় পরস্পর সমান! ( কীভাবে প্রমাণ করতে পারি তা আপনারা ৩ নং চিত্র দেখে বুঝতে চেষ্টা করুন।

৩) তো এখন আমরা ৩ টি বিষয় কে "প্রমাণিত সত্য" বলতে পারি। সেগুলো হলো -
i) অনুরূপ কোণদ্বয় পরস্পর সমান।
ii) বিপ্রতীপ কোণদ্বয় পরস্পর সমাণ ও
iii) একান্তর কোণদ্বয় পরস্পর সমান।
তো আমাদের এই ৩ টি "প্রমাণিত সত্য" কে ব্যবহার করে আমরা পরবর্তী জ্যামিতিক প্রমাণ গুলো শুরু করবো।

প্রথমে আমরা প্রমাণ করবো -
ক) ত্রিভুজের বহিঃস্থ কোণ, বিপরীত অন্তঃস্থ কোণ দ্বয়ের সমষ্টির সমান।
খ) ক ব্যবহার করে প্রমাণ করবো, ত্রিভুজের ৩ কোণের সমষ্টি ১৮০°.
৫ নং চিত্রে বিষয়টি দেখিয়েছি।

৪) ত্রিভুজের ৩ কোণের সমষ্টি ১৮০° এটি এখন আমাদের জন্য একটি "প্রমাণিত সত্য". এই সত্যকে ব্যবহার করে আমরা এখন প্রমাণ করবো চতুর্ভুজের ৪ কোণের সমষ্টি ৩৬০°.
৬ নং চিত্রে এটি প্রমাণ করা হয়েছে৷

৫) এবার আমরা যাবো ক্ষেত্রফলের দিকে। ক্ষেত্রফল কী, এটি যদি সহজভাবে বলতে হয়, তাহলে বলা যায় যে - ক্ষেত্রফল বলতে বোঝায় কোনো একটি জিনিস " ভূমির ওপরে" কতটুকু জায়গা দখল করবে! কোনো জিনিসের পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল ১ বর্গমিটার অর্থ হলো এর উক্ত পৃষ্ঠ মাটিতে রাখলে এটি মাটিতে ১ বর্গমিটার জায়গা দখল করবে।

এখন জানা যাক বর্গ মিটার জিনিসটি আসলে কী মিন করে!
১ টা বর্গ, যার প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ ১ একক। সেটি মাটিতে রাখলে যে জায়গাটুকু দখল করবে সেই পরিমাণকে নাম দেয়া হয়েছেলো - ১ বর্গ একক। ২ বর্গ একক - এর অর্থ হলো এই জায়গাটুকুর ভেতরে ১ বর্গএকক আকারের ২ টি বর্গক্ষেত্র রাখা যাবে৷ ৭ নং চিত্রে এ বিষয়টি দেখনো হয়েছে। চিত্র থেকে বোঝা যায় যে কোনো আয়তক্ষেত্রের দৈর্ঘ এবং প্রস্থ কে গুণ করলে যে গুণফল পাওয়া যাবে তার সমানসংখ্যক ১ বর্গএকক আকারের বর্গক্ষেত্র উক্ত আয়তক্ষেত্রের ভেতরে রাখা যাবে৷

এ কারণে বলা যায়,
আয়তক্ষেত্রের ক্ষেত্রফল = ভূমি*উচ্চতা
বর্গক্ষেত্রে যেহেতু ভূমি আর উচ্চতা সমান,
তাই বর্গক্ষেত্রের ক্ষেত্রফলকে লেখা যায় = বাহু^২
ট্রাপিজিয়ামের ক্ষেত্রে ভূমি হলো ২ টা। তাই এর ভূমি হিসেবে দুটোর গড় মানকে নেয়া হয়।
তাই, ট্রাপিজিয়ামের ক্ষেত্রফল = ১/২ * ( দুটি ভূমির যোগফল) * উচ্চতা।

এটাকেই আমরা এভাবে লিখি, ট্রাপিজিয়ামের ক্ষেত্রফল = ১/২ * সমান্তরাল বাহুদ্বয়ের যোগফল * মধ্যবর্তী দূরত্ব।

৬) এবার দেখা যাক সামান্তরিক আর ত্রিভুজের ক্ষেত্রফল!
৮ নং চিত্রে দেখুন, "কৌশল করে" একটি সামান্তরিককে আয়তের আকার দিয়ে দেয়া হয়েছে৷ এতে কিন্তু এর ক্ষেত্রফলের কোনো পরিবর্তন হয় নাই! ( কারণ দখলকৃত জায়গার পরিমাণ এখনো একই)

তাহলে, সামান্তরিকের ক্ষেত্রফল = ভূমি*উচ্চতা
একটা সামান্তরিককে ২ ভাগ করলে পাওয়া যাবে ত্রিভুজ!
ত্রিভুজের ক্ষেত্রফল তাই = ১/২ * ভূমি * উচ্চতা
( চিত্র ৯)

৭) আগের ধাপে দেখলাম, ত্রিভুজের ক্ষেত্রফল = ১/২ * ভূমি * উচ্চতা।
এখন মনে করুন ২ টা ত্রিভুজ আছে। দুইটার ভূমি সমান৷ তাহলে কি আমরা বলতে পারি যে ত্রিভুজদ্বয়ের ক্ষেত্রফল এদের উচ্চতার সমানুপাতিক। হ্যাঁ, ভূমি সমান হলে বলা যায় যে ত্রিভুজের ক্ষেত্রফল এদের উচ্চতার সমানুপাতিক।
এটাও আমরা এখন " প্রমাণিত সত্য"(!) হিসেবে গ্রহণ করতে পারি। এই "প্রমাণিত সত্য" কে ব্যবহার করে ১০ নং চিত্রে দেখানো হয়েছে, যে ত্রিভুজের কোনো বাহুর সমান্তরাল সরলরেখা অপর বাহুদ্বয়কে সমান অনুপাতে বিভক্ত করে৷ ( যেটি আর্টিকেলের শুরুতে উল্লেখ করেছিলাম।)

৮) এবার আমরা আরেকটি "প্রমাণিত সত্য" পেয়েছি৷ সেটি হলো- ত্রিভুজের কোনো বাহুর সমান্তরাল সরলরেখা অপর বাহুদ্বয়কে সমান অনুপাতে বিভক্ত করে৷ এটি ব্যবহার করে ১১ নং চিত্রে প্রমাণ করে দেখানো হয়েছে যে দুটি ত্রিভুজ সদৃশ হলে এদের অনুরূপ বাহুগুলোর অনুপাত সমান হবে।

এ থেকে বোঝা যায় - "ত্রিভুজের কোনো বাহুর সমান্তরাল সরলরেখা অপর বাহুদ্বয়কে সমান অনুপাতে বিভক্ত করে৷" এই প্রমাণের ওপর ভিত্তি করেই প্রমাণ করা হয়েছে যে সদৃশ ত্রিভুজদ্বয়ের অনুরূপ বাহুগুলোর অনুপাত সমান।
তাই প্রথম উপপাদ্য টি প্রমাণ করার জন্য যদি "সদৃশ ত্রিভুজদ্বয়ের অনুরূপ বাহুগুলোর অনুপাত সমান" এই ধারণাকে ব্যবহার করা হয়, তাহলে তা এক প্রকার ফাঁকি! যেটি আর্টিকেলের শুরুতে লিখেছিলাম!

দ্রষ্টব্য-
*কোণের ধারণা আলোচনার অংশটির তথ্য লেখক চমক হাসানের "অঙ্ক ভাইয়া" বই থেকে নেয়া হয়েছে।
*জ্যামিতিক চিত্রগুলো আঁকার জন্য "Sketch" app টি ব্যবহার করা হয়েছে।
*জ্যামিতিক চিহ্ন ( যেমন- ∠,Δ) দেয়ার জন্য "Engineering Keyboard" নামের একটি app ব্যবহার করা হয়েছে।


Fahim Munaim
সদস্য, ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান    

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form