নাগরিক জীবন ছল-চাতুরীতে ভরা। এই ছল চাতুরী বুঝতে বেশী কিছু করতে হয় না। কোনো বেকার বিকেলে রাজধানীর ব্যস্ত কোনো মোড়ে একলা বিশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলেই অভিজ্ঞ হয়ে যাওয়া যাবে। সিগারেটের দাম নিয়ে দু-পক্ষের সরগরম তর্ক, রিকশাচালকের সাথে দরদাম বিষয়ক মৌখিক হানাহানি, অনুসন্ধানী পকেটমারের অনুসন্ধান কিংবা প্রেমিকাকে রিকশায় তুলে দিয়ে প্রেমিকের অন্য এক অভিসার। এসব ছল চাতুরীর অংশ। ছল চাতুরী করে একটু লাভবান হওয়া, একটু আরাম করে চলা- এই যা!
নগরে হাজার হাজার মানুষের মাঝে কেউ কেউ থাকে দর্শক, আমি তাদের নাম দিয়েছি নগর খাদক। কী বিকেল, কী মাঝরাত, কী সিটি কর্পোরেশনের ময়লার ভেঁপু বাজানো সকাল, শালারা ঘড়ি বিকল করে নগর খায়। আমার ঘড়ি আপাতত বিকল, বিকল ঘড়ির যারা মালিক তাদেরকে ঈশ্বর সময়ের উপর বোনাস দিয়ে থাকেন। টেলিকমিউনিকেশনের অফারের মত। ২০ টাকা রিচার্জেই ৫০০ পার্সেন্ট বোনাস। রিকশার প্যাডেলে পরিশ্রম ছাড়া কিছু নেই, তবুও আমি প্যাডেলের দিকে তাকিয়ে পার করে দিতে পারি গোটা দিন। নোংরা ডাস্টবিনের পাশ দিয়ে যেতে এখন আর সমস্যা হয় না। নগর খেতে খেতে আবিস্কার করে ফেলেছি ডাস্টবিন থেকে নাক নিয়ন্ত্রনের উপায়। নিজের হাতের চামড়া শুঁকুন, নিঃশ্বাসও ফেলুন চামড়াতে। ডাস্টবিন আপনার নাকের একটি চুলও ছিড়তে পারবে না!
-তুমি অনেক বড় বিজ্ঞানী, অনেক বড় দার্শনিক
-ডাস্টবিনটা তারচে’ বড়
-মামা একটু দ্রুত চালান প্লিজ, উফ কী গন্ধ! আমি এই রাস্তা দিয়ে আর যাবো না!
-অবশ্যই, আমি মেয়রকে বলে এই রাস্তা ব্যান করে দিবো, থাকবে না এই রাস্তা।
-ওয়ার্ড কমিশনারকে বলে ডাস্টবিনটা সরাতে বললেই উপকার হয় মশাই!
-অবশ্যই, ডাস্টবিন কেন এই এলাকার মানুষের খাবার গ্রহণ নিষিদ্ধ করে দিবো। সব সমস্যা এই খাওয়া দাওয়া নিয়েই।কিনো, ছিলো, রাঁধো, ময়লাগুলো খোলা জায়গায় ফেলে ডাস্টবিন বানিয়ে ফেলো আর বাসায় গিয়ে উদাস হয়ে হাগো !
-এসব কী কথা!
-তুমি জানো এই ডাস্টবিনটাই কারো কারো অফিস?
-ওমা সে কী? কীভাবে?
-ধরো যে ভদ্রলোক ময়লার গাড়ী চালিয়ে এখানে এসে ময়লা ফেলেন সে তার বউকে সকালে বের হবার আগে কি বলবে?
-কি বলবে?
-বলবে বউ তাড়াতাড়ি ভাত দাও, কালেকশন শেষে অফিসে যাইতে হইবো
-হা হা হা হা
হা হা হা স্নিগ্ধা। জীবনের বহুল অংশের রিকশার সহযাত্রী, কবিতার একমাত্র পাঠক, নগর ভ্রমনের সহযাত্রী, রুদ্ধশ্বাস জ্যামের একমাত্র দুঃবোধের পার্টনার, জীবনের উপর্যপুরি ছুরির আঘাতের একমাত্র দর্শক, আমার নাগরিক প্রেমিকা! জেলা খুলনা, ডুমুরিয়া উপজেলা। মফস্বল শহর থেকে উচ্চ শিক্ষার্থে রাজধানীতে আসা তরুণীদের একটা অংশ রাস্তা পার হতে ভয় পায়, চোখ রাঙানো উজ্জল আলোয় ইতস্ততবোধ করে আর সোডিয়াম লাইট দেখলেই কয়েকশো মিটার উচ্চতায় চাঁদ দেখার উল্লাস করে উঠে! বড় ভালো লাগে এসব দৃশ্য।
-এত জ্যাম, এ শহর জাহান্নাম। বিয়ের পর গ্রামে ফিরে যাবো।
-ফুলার রোডের ফুটপাথে গতকাল বেশ বাতাস ছিলো
-হুম, তবে আজকে থাকবে কিনা কে জানে? শহরে আজ মানুষ মনে হয় একটু বেশীই
-হুম তাইতো, চাকরীর পরীক্ষা দিতে এসেছে। বেঁচে থাকার দায়। ঢাকার বাইরে থেকে চাকরীর পরীক্ষা দিতে আসা পরীক্ষার্থীরা সারারাত জার্নি করে এসে প্রথমে পরীক্ষা দেয়। তারপর বসুন্ধরাতে গিয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং বিকেলটা টিএসসি, ফুলার রোড, শহীদ মিনারেই কাটিয়ে দেয়। আজ শহরের খবর আছে।
-তাই বলে ছুটির দিনে এমন জ্যাম থাকবে?
-জ্যাম আজকে ছুটি নেয়নি, আজও তারা অফিস করছে।
-চল না, তাহলে আজ আমরা নৌকায় চড়ি
-হুম পছন্দ হয়েছে, সড়ক পথে আজ অবরোধ, নৌকায় হোক ভালোবাসা মহারথ
খুব ইচ্ছে ছিলো গত সাতটি বছরের নগর খাদক অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে একটা নাগরিক প্রেম করি। একটা প্রেমিকা, শহরের পে পু, বাঁকা হাসি দিয়ে রিকশাওয়ালার পিছনে তাকানো, সিট না পাওয়া যাত্রীদের বাঁকা ইশারা এসবে চাক্ষুস টার্গেট হতে চেয়েছিলাম। অন্য কোন নগর খাদকের গবেষনা হবার লোভও ছিলো। ভাবতে ভাল্লাগতো কথা বলতে বলতে কবিতা বলছি, সোডিয়াম লাইটে গায়ের রঙ পাল্টে যাওয়া বিষয়ক আলোচনায় হেরে কেউ রেগে আছে বা ফুলার রোডে একদম কাছ ঘেষে সুরেলা কন্ঠে কেউ আমার জন্য রবীন্দ্র সংগীত গাইছে।
-ওয়ান মোর প্রিয়তমা
-এটা ডাকবা না
-কেন?
-অনেকেই তো অনেককে ডেকেছে, ধার করে না!
-আচ্ছা, তুমি বরং আমার নাগরিকতমা
-এটা কেমন?
-বাঁশি বাজাতে দেখেছো? ঐ একদম বুক থেকে ফু দিয়ে সুর তোলে?
-হুম, কতওও!
-আমি বুক থেকে দৃষ্টি দিয়ে শহর দেখি, ভালোবাসি। নগর আমার খুব প্রিয়। সাথে তুমি তুমি তুমি। বোধহয় তুমি আর নগর মিলে একজন আমি!
কথা শেষ বিনাবাক্যে শোনা যায় “না চাহিলে যারে পাওয়া যায়,তেয়াগিলে আসে হাতে, দিবসে সে ধন হারায়েছি আমি—পেয়েছি আঁধার রাতে”
যার প্রেমিকা রবীন্দ্রসংগীত গাইতে জানে প্রেমিক দু এক বেলা না খেয়েও কাটিয়ে দিতে পারে। এই যে আমি না খেয়ে নগর খাচ্ছি, পেট না জানুক মন কিন্তু সন্তুষ্ট। রীবন্দ্রসংগীত গাইতে পারা নাগরিকতমার কপালে টিএসসির ফুটপাথের টিপ, চারুকলার সামনে কয়েকজন খালা বসেন। সেখানকার চুড়িগুলোর শব্দ পৃথিবীর সবচে সুন্দর। ঢাকা শহরে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে আসা একজন তরুণী ধুপ করে আমার হয়ে গেলো! বলা নেই কওয়া নেই। একলা রিকশায় কানে হেডফোন গুজে শিরোনামহীনে বুদ হয়ে থাকতে হয় না। মাঝে মাঝে কানে হেডফোন থাকে বটে, তবে সেটা এক কানে। হেডফোনও ভাগাভাগি হয় এই নাগরিক প্রেমের সংসারে।
-শহরে এত কৃষ্ণচূড়া আমি আগে দেখিনি!
-এটা কৃষ্ণচূড়া না এটাকে বলে রাধাচূড়া, নিজেকে আবার নখর খাদক দাবি করো!
-কৃষ্ণচূড়া হোক রাধাচূড়া হোক তারা তুমি আমার নাগরিকতমা হবার পরই ফুটেছে!
-মিথ্যে বলছো কেন? নিয়ম অনুযায়ী ফোটে
-তুমি এ শহরে কৃষ্ণচূড়াকে দেখেছো আগে?
-নাহ!
-হা হা হা আমিও দেখিনি!
-তুমি পারোও বটে! শহরে আমি প্রথম কৃষ্ণচূড়ার বছর কাটাচ্ছি।
-আমিও! দ্যাখো ঐ কৃষ্ণচূড়া গাছটি তোমাকে বোধহয় ধন্যবাদ দিচ্ছে, নইলে ওমন করে ফুটে হাসবে কেন?
-কেন?
-আমার পাশে বসে তাদের চিনিয়েছো বলে।
সত্যিই সেবারের আগে আমি শহরে কৃষ্ণচূড়া খেয়াল করিনি। হালের বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রের ডানপাশ জুড়ে সারি সারি কৃষ্ণচূড়া। পাশের রাস্তাতে ল্যাম্পপোস্ট, একটি রিকশার ছায়া গান গেয়ে ঘুরে বেড়ায়। রিকশায় স্নিগ্ধা আমার পাশে। মাঝে মাঝে মনে হয় সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং বোধহয় ঢাকার মেয়র!
মানুষের যাবার জায়গা নেই, সংসদ ভবনের সামনের সামান্য জায়গা যেন মানুষের হাঁট বাজার। হৈ হট্টোগোল চটিপটি ফুসকাওয়ালাদের ঝাল বিষয়ক দৌরত্ন একদম লাটে উঠে যায় সান্ধ্যকালীন রোমাঞ্চ। তাছাড়া এখানে মিনারেল ওয়াটারের নামে আজে বাজে পানিও বিক্রি হয়। ভেজালে নগর ছেয়ে গেছে। নাগরিকতমার হাত আমার হাতে, ফুটপাথ আজ আমাদের নিয়ে যাক যেখানে খুশী।
-আচ্ছা ধরো ফুটপাথ চলবে!
-মানে?
-এসকেলেটর যেভাবে চলে, সেভাবে ফুটপাথ চলছে। কেউ বাসে উঠছে না, ফুটপাথে দাঁড়িয়েই পৌছে যাচ্ছে অফিস, বিশ্ববিদ্যালয় কারখানায়!
-কী বলো, ফুসকার দোকানগুলো বসবে কোথায়? ঐ যে যে মামা থেকে চুলের ক্লিপ কিনি উনি বসবেন কোথায়?
-বড় সমস্যা! ফুটপাথ চলবে না তাহলে।এভাবেই থেমে থাকুক। বরং আমরাই হেঁটে যাই।
আমার দীর্ঘ নগর খাদক জীবনে ফুটপাথে পড়ে থাকা সিগারেটের ফিল্টারদের ইতিহাস বিষয়ক ভাবনা ভেবেছি। মানুষের পায়ের তলে থেতলে যাওয়া প্রতিটি সিগারেটের ফিল্টার এক একটি গল্প, একটি পুড়ে যাওয়া ইতিহাস। ইতিহাস মাঝে মাঝে মুছে যায়। নগর কতৃপক্ষ এসব সিগারেটের ফিল্টার সরানোর কোন ব্যবস্থা করেননি। ঝাড়ু দিয়ে কেবল এদিক ওদিক নিয়ে যাওয়া হয়। সৃষ্টিকর্তা তাই বৃস্টির ব্যবস্থা করেছেন। বৃস্টি এসব ইতিহাস মাঝে মাঝেই মুছে দেন। আজ খুব বৃষ্টি।
-বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে চা খাবার একটা সুবিধা আছে
-কী?
-চা সহজে শেষ হবে না!
-আমার একটা গোলাপী ছাতা ছিলো।
-এখন নেই?
-বাড়ীতে ফেলে এসেছি, আমি জানতাম শহরে বৃষ্টি হয় না।
-শহরের বৃষ্টি পরিবারের অবাধ্য সন্তানের মত, কখন আসে কখন যায় বাদ বাকিরা জানেনা! শুধু রিকশা চালক আর প্রেমিক প্রেমিকারা ছাড়া।
-চলো বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে চা খাই, তুমি কিন্তু সিগারেট খাবে না। আজকে চারটা হয়ে গেছে।
-কেবল তোমার শাসনের জন্য আমি আজীবন সিগারেট ছাড়বো না। হা হা হা
চা দোকনটার বয়স হয়ে গেছে। কাপ ফেটে চা বের হবার জোগাড়। ঝরঝর করে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির জন্য তীর্থের কাকের মত অপেক্ষা করে শহরের প্রেমিক-প্রেমিকা এবং রিকশাওয়ালারা। বৃষ্টি হলে পরস্পর আলাদাভাবে লাভবান। মাঝে মাঝে নিজেকে ঢাকার টুরিস্ট গাইড মনে হতো, মুস্তাকিমের চাপ, ছবির হাঁটের গুড় চা, ফুলার রোডে জোড়া বৈঠক, ধানমন্ডি ছয় নম্বরের ফুসকা, কার্জন হলের পুকুরে নির্জন দুপুরের সাথে স্নিগ্ধার পরিচয় আমি হাতে ধরে করিয়েছি।
-রোমেল
-হ্যাঁ
- আমরা একটা চটপটির দোকান দিবো
-আচ্ছা
-আমি চটপটি বানিয়ে দিবো, তুমি সার্ভ করবা।
-ভেরী গুড, নাম হবে স্নিগ্ধ চাট হাউজ
-ছিঃ
-ছিঃ হবার কিছু নেই সংসদ ভবনের সামনে একটা চটপটির দোকান নাম চাঁদপুর চাট হাউজ। নামটা সুন্দর।
-কক্ষনো না, এই নাম হবে না।
-তাহলে নগরতমা চটপটি?
-হা হা হা হা
নগরে কিছু বাছাই করা চটপটি ফুসকার দোকান থাকে। এমনকি ঝাল মুড়ির দোকানও থাকে। আজকাল গরুর মাংশ, মুরগীর মাংশ দিয়েও ঝাল মুড়ি বানানো হয়। প্রেমিক-প্রেমিকারা সন্ধ্যা হলে এসব দোকানে লাইন দেয়। চটপটি খাবার নাম করে নাগরিক প্রেম পকেটে নিয়ে ঘোরে। তিনমাসের নাগরিক প্রেম পাঁচমাসে ঠেকতেই বিপত্তি। বিপত্তির ইতিহাস রাষ্ট্রের কূটনৈতিক ঝামেলা থেকে কোন অংশে কম নয়। কোন এক কারফিউর দিনে শহর চষে বেড়াবার গোপন ইচ্ছেও ছিলো। শহর উত্তাল হবার সম্ভাবনা থাকলেও বিরোধী দলের দুর্বলতায় তা আর হল না। ভেবেছিলাম শহর উত্তাল হবে, হরতালে নগর থেমে যাবে আর আমরা ফাঁকা নগরে বসতবাড়ী করে উড়ে বেড়াবো। হৃদয়ের বিস্ফোরনটা থেমে গেলো, হরতাল আন্দোলন থেমে যাওয়া সবকিছু কেবল নাগরিক প্রেমেই আঁটকে গেলো। শিরোনামহীন গেয়ে যায় বুলেট কিংবা কবিতা, ভাবছি বুলেট কিংবা নাগরিকতমাহীনতা!
-তুমি কিন্তু চিঠি লিখবে, হু বলে দিলাম
-আমি স্বভাব চিঠি লেখক!
-দেখি লিখো তো এক্ষুনি
-প্রিয়
নাগরিকতমা
রিকশার হুড না তুলে ফাঁকা রাস্তা দেখেও চুমু দেয়া যায়!
ইতি
তোমার একান্তই নাগরিকতম
স্নিগ্ধার চিঠি লেখবার অভ্যাস শেষ পর্যন্ত ধরে রেখেছিলো। আনুষ্ঠানিক শেষ চিঠিতে তার চলে যাবার যথাযথ কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। চিঠি শেষে নিজেকে নগর নগর মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এইমাত্র নগর কৃতপক্ষের নির্দেশে সকল নাগরিক নগর ছেড়ে চলে গেছে! আমি বিষন্ণ নগর হয়ে বসে থাকি ডিভাইডারে, ব্যস্ত মোড়ের চা দোকানে, লোকাল বাসের হাতলে।
নগর প্রেমের ইতিবৃত্ত ভাবতে ভাবতে নগর খেতে থাকি। কোন মোড়ে দাঁড়িয়ে দৈনিক নাগরিক ছল-চাতুরী দেখতে দেখতে চোখে ধুলি পড়ার নাম করে পানি পড়ে। ঠিক তখন হয়ত রিকশা চেপে চুমু খেতে খেতে বাড়ী ফিরছে কারা যেন! এসব ছল চাতুরী নাকি একটু ভালো থাকার উপায়। তবে সে সার্টিফিকেট মেয়র সাহেব দিবেন না। আমি তো সস্তায় বেঁচে থাকা নাগরিক। সম্প্রতি যার নাগরিকতমা হারিয়ে গেছে। বিকেল দুপুরে কত কবিতা জন্মেছিলো স্নিগ্ধার চোখে সে হিসেব কেউ জানেনা। কবিতাদের বার্থ সার্টিফিকেট এর প্রচলন করা দরকার। অমুক কবিতা অমুক সময়ে অমুকের চোখ দেখে জন্ম নিয়েছে এমন প্রমাণ লেখা থাকবে সেখানে। শেষ কিছুদিন স্নিগ্ধা কবিতা নিয়ে বেশ মেতেছিলো। নেশার মত কবিতা পড়তো, কবিতা লেখাও শুরু করেছিলো। পৃথিবীতে খুব কম সংখ্যক প্রেমিক তার প্রেমিকার কবিতা হতে পারে। আমি কম সংখ্যাকদের একজন হয়েছিলাম। কবিতা হবার দীর্ঘ বছর কেটে গেলো। কে জানে স্নিগ্ধা কবিতা লিখছে কিনা! হয়ত কোন এক নগর খাবার বিকেলে হুট করে দেখা হয়ে যাবে। চিনেও না চেনার ভান করে উদাস হয়ে চলেও যাবে। আমি বসে বসে নগর খাবো।
আমার ভাব গম্ভীর নগর খাবার সময় শেষ হয়ে গেলো। বেঁচে থাকার দায়ে কবিতা, নগর ছেড়ে সকাল সাতটায় মতিঝিলের বাস ধরা নাগরিক গাধা হয়ে গেছি। নাগরিকতমাও ছেড়ে গেছে বছর দুয়েক । অফিসে যাবার আগে নানা কসরত করে ঘুম ভাঙ্গাতে হয়। নিজের ঘুম নিজে ভাঙ্গানোর মত পরিশ্রমের কাজ করার অর্থ হল আমি শুদ্ধ অসহায় গাধা। বাসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে পত্রিকা পড়াটাও অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আজকের পত্রিকাটা রঙচঙে, দেশে ভালো কিছু ঘটছে বোধহয়। চমকে যাবার মত সাহিত্যপাতাতে স্নিগ্ধার বিশাল ছবি দেখতে পেলাম। নিচে বড় হরফের শিরোনাম
“নাগরিক প্রেম নিয়ে আরও অনেক কিছু করার ইচ্ছে আছে”।
“তরুণীদের কবি হওয়ার হার এ দেশে একদম কম। স্নিগ্ধা রহমান গত এক বছর দেশের পরিচিত নতুন কবিদের একজন। মূলত নাগরিক কবিতা লিখে নিজেকে পরিচত করানো তরুণী কবি স্নিগ্ধা দৈনন্দিন নাগরিক প্রেম তুলে আনেন কবিতায়...এমন বৈচিত্রময় বিষয়ের জন্য তিনি অনেকেরই প্রিয় কবি”
পত্রিকা বন্ধ করে সিগারেট ধরালাম। না ঠিক পারছি না নিতে। বরং ফিল্টারটা ফুটপাথে ফেলে থেতলে দিই। থেতলে দেবার আগেই বাস এসে হাজির। ফুটপাথে রেখে গেলাম আমার আধখাওয়া সিগারেট। বেচারা ফিল্টার অপেক্ষা করছে কোন নাগরিকের পায়ে পিষ্ট হবার জন্য। বাস ছুটছে জীবনের পথে...নাগরিক জীবন ছল-চাতুরীতে ভরা। ছল চাতুরী করে একটু লাভবান হওয়া, একটু আরাম করে চলা- এই যা!
["অদ্ভুত তুমিহীনতায় ভুগছি"
অমর একুশে গ্রন্থমেলা, ২০১৫
(কাসাফাদ্দৌজা নোমান)]
লেখক, কবি
নগরে হাজার হাজার মানুষের মাঝে কেউ কেউ থাকে দর্শক, আমি তাদের নাম দিয়েছি নগর খাদক। কী বিকেল, কী মাঝরাত, কী সিটি কর্পোরেশনের ময়লার ভেঁপু বাজানো সকাল, শালারা ঘড়ি বিকল করে নগর খায়। আমার ঘড়ি আপাতত বিকল, বিকল ঘড়ির যারা মালিক তাদেরকে ঈশ্বর সময়ের উপর বোনাস দিয়ে থাকেন। টেলিকমিউনিকেশনের অফারের মত। ২০ টাকা রিচার্জেই ৫০০ পার্সেন্ট বোনাস। রিকশার প্যাডেলে পরিশ্রম ছাড়া কিছু নেই, তবুও আমি প্যাডেলের দিকে তাকিয়ে পার করে দিতে পারি গোটা দিন। নোংরা ডাস্টবিনের পাশ দিয়ে যেতে এখন আর সমস্যা হয় না। নগর খেতে খেতে আবিস্কার করে ফেলেছি ডাস্টবিন থেকে নাক নিয়ন্ত্রনের উপায়। নিজের হাতের চামড়া শুঁকুন, নিঃশ্বাসও ফেলুন চামড়াতে। ডাস্টবিন আপনার নাকের একটি চুলও ছিড়তে পারবে না!
-তুমি অনেক বড় বিজ্ঞানী, অনেক বড় দার্শনিক
-ডাস্টবিনটা তারচে’ বড়
-মামা একটু দ্রুত চালান প্লিজ, উফ কী গন্ধ! আমি এই রাস্তা দিয়ে আর যাবো না!
-অবশ্যই, আমি মেয়রকে বলে এই রাস্তা ব্যান করে দিবো, থাকবে না এই রাস্তা।
-ওয়ার্ড কমিশনারকে বলে ডাস্টবিনটা সরাতে বললেই উপকার হয় মশাই!
-অবশ্যই, ডাস্টবিন কেন এই এলাকার মানুষের খাবার গ্রহণ নিষিদ্ধ করে দিবো। সব সমস্যা এই খাওয়া দাওয়া নিয়েই।কিনো, ছিলো, রাঁধো, ময়লাগুলো খোলা জায়গায় ফেলে ডাস্টবিন বানিয়ে ফেলো আর বাসায় গিয়ে উদাস হয়ে হাগো !
-এসব কী কথা!
-তুমি জানো এই ডাস্টবিনটাই কারো কারো অফিস?
-ওমা সে কী? কীভাবে?
-ধরো যে ভদ্রলোক ময়লার গাড়ী চালিয়ে এখানে এসে ময়লা ফেলেন সে তার বউকে সকালে বের হবার আগে কি বলবে?
-কি বলবে?
-বলবে বউ তাড়াতাড়ি ভাত দাও, কালেকশন শেষে অফিসে যাইতে হইবো
-হা হা হা হা
হা হা হা স্নিগ্ধা। জীবনের বহুল অংশের রিকশার সহযাত্রী, কবিতার একমাত্র পাঠক, নগর ভ্রমনের সহযাত্রী, রুদ্ধশ্বাস জ্যামের একমাত্র দুঃবোধের পার্টনার, জীবনের উপর্যপুরি ছুরির আঘাতের একমাত্র দর্শক, আমার নাগরিক প্রেমিকা! জেলা খুলনা, ডুমুরিয়া উপজেলা। মফস্বল শহর থেকে উচ্চ শিক্ষার্থে রাজধানীতে আসা তরুণীদের একটা অংশ রাস্তা পার হতে ভয় পায়, চোখ রাঙানো উজ্জল আলোয় ইতস্ততবোধ করে আর সোডিয়াম লাইট দেখলেই কয়েকশো মিটার উচ্চতায় চাঁদ দেখার উল্লাস করে উঠে! বড় ভালো লাগে এসব দৃশ্য।
-এত জ্যাম, এ শহর জাহান্নাম। বিয়ের পর গ্রামে ফিরে যাবো।
-ফুলার রোডের ফুটপাথে গতকাল বেশ বাতাস ছিলো
-হুম, তবে আজকে থাকবে কিনা কে জানে? শহরে আজ মানুষ মনে হয় একটু বেশীই
-হুম তাইতো, চাকরীর পরীক্ষা দিতে এসেছে। বেঁচে থাকার দায়। ঢাকার বাইরে থেকে চাকরীর পরীক্ষা দিতে আসা পরীক্ষার্থীরা সারারাত জার্নি করে এসে প্রথমে পরীক্ষা দেয়। তারপর বসুন্ধরাতে গিয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং বিকেলটা টিএসসি, ফুলার রোড, শহীদ মিনারেই কাটিয়ে দেয়। আজ শহরের খবর আছে।
-তাই বলে ছুটির দিনে এমন জ্যাম থাকবে?
-জ্যাম আজকে ছুটি নেয়নি, আজও তারা অফিস করছে।
-চল না, তাহলে আজ আমরা নৌকায় চড়ি
-হুম পছন্দ হয়েছে, সড়ক পথে আজ অবরোধ, নৌকায় হোক ভালোবাসা মহারথ
খুব ইচ্ছে ছিলো গত সাতটি বছরের নগর খাদক অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে একটা নাগরিক প্রেম করি। একটা প্রেমিকা, শহরের পে পু, বাঁকা হাসি দিয়ে রিকশাওয়ালার পিছনে তাকানো, সিট না পাওয়া যাত্রীদের বাঁকা ইশারা এসবে চাক্ষুস টার্গেট হতে চেয়েছিলাম। অন্য কোন নগর খাদকের গবেষনা হবার লোভও ছিলো। ভাবতে ভাল্লাগতো কথা বলতে বলতে কবিতা বলছি, সোডিয়াম লাইটে গায়ের রঙ পাল্টে যাওয়া বিষয়ক আলোচনায় হেরে কেউ রেগে আছে বা ফুলার রোডে একদম কাছ ঘেষে সুরেলা কন্ঠে কেউ আমার জন্য রবীন্দ্র সংগীত গাইছে।
-ওয়ান মোর প্রিয়তমা
-এটা ডাকবা না
-কেন?
-অনেকেই তো অনেককে ডেকেছে, ধার করে না!
-আচ্ছা, তুমি বরং আমার নাগরিকতমা
-এটা কেমন?
-বাঁশি বাজাতে দেখেছো? ঐ একদম বুক থেকে ফু দিয়ে সুর তোলে?
-হুম, কতওও!
-আমি বুক থেকে দৃষ্টি দিয়ে শহর দেখি, ভালোবাসি। নগর আমার খুব প্রিয়। সাথে তুমি তুমি তুমি। বোধহয় তুমি আর নগর মিলে একজন আমি!
কথা শেষ বিনাবাক্যে শোনা যায় “না চাহিলে যারে পাওয়া যায়,তেয়াগিলে আসে হাতে, দিবসে সে ধন হারায়েছি আমি—পেয়েছি আঁধার রাতে”
যার প্রেমিকা রবীন্দ্রসংগীত গাইতে জানে প্রেমিক দু এক বেলা না খেয়েও কাটিয়ে দিতে পারে। এই যে আমি না খেয়ে নগর খাচ্ছি, পেট না জানুক মন কিন্তু সন্তুষ্ট। রীবন্দ্রসংগীত গাইতে পারা নাগরিকতমার কপালে টিএসসির ফুটপাথের টিপ, চারুকলার সামনে কয়েকজন খালা বসেন। সেখানকার চুড়িগুলোর শব্দ পৃথিবীর সবচে সুন্দর। ঢাকা শহরে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে আসা একজন তরুণী ধুপ করে আমার হয়ে গেলো! বলা নেই কওয়া নেই। একলা রিকশায় কানে হেডফোন গুজে শিরোনামহীনে বুদ হয়ে থাকতে হয় না। মাঝে মাঝে কানে হেডফোন থাকে বটে, তবে সেটা এক কানে। হেডফোনও ভাগাভাগি হয় এই নাগরিক প্রেমের সংসারে।
-শহরে এত কৃষ্ণচূড়া আমি আগে দেখিনি!
-এটা কৃষ্ণচূড়া না এটাকে বলে রাধাচূড়া, নিজেকে আবার নখর খাদক দাবি করো!
-কৃষ্ণচূড়া হোক রাধাচূড়া হোক তারা তুমি আমার নাগরিকতমা হবার পরই ফুটেছে!
-মিথ্যে বলছো কেন? নিয়ম অনুযায়ী ফোটে
-তুমি এ শহরে কৃষ্ণচূড়াকে দেখেছো আগে?
-নাহ!
-হা হা হা আমিও দেখিনি!
-তুমি পারোও বটে! শহরে আমি প্রথম কৃষ্ণচূড়ার বছর কাটাচ্ছি।
-আমিও! দ্যাখো ঐ কৃষ্ণচূড়া গাছটি তোমাকে বোধহয় ধন্যবাদ দিচ্ছে, নইলে ওমন করে ফুটে হাসবে কেন?
-কেন?
-আমার পাশে বসে তাদের চিনিয়েছো বলে।
সত্যিই সেবারের আগে আমি শহরে কৃষ্ণচূড়া খেয়াল করিনি। হালের বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রের ডানপাশ জুড়ে সারি সারি কৃষ্ণচূড়া। পাশের রাস্তাতে ল্যাম্পপোস্ট, একটি রিকশার ছায়া গান গেয়ে ঘুরে বেড়ায়। রিকশায় স্নিগ্ধা আমার পাশে। মাঝে মাঝে মনে হয় সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং বোধহয় ঢাকার মেয়র!
মানুষের যাবার জায়গা নেই, সংসদ ভবনের সামনের সামান্য জায়গা যেন মানুষের হাঁট বাজার। হৈ হট্টোগোল চটিপটি ফুসকাওয়ালাদের ঝাল বিষয়ক দৌরত্ন একদম লাটে উঠে যায় সান্ধ্যকালীন রোমাঞ্চ। তাছাড়া এখানে মিনারেল ওয়াটারের নামে আজে বাজে পানিও বিক্রি হয়। ভেজালে নগর ছেয়ে গেছে। নাগরিকতমার হাত আমার হাতে, ফুটপাথ আজ আমাদের নিয়ে যাক যেখানে খুশী।
-আচ্ছা ধরো ফুটপাথ চলবে!
-মানে?
-এসকেলেটর যেভাবে চলে, সেভাবে ফুটপাথ চলছে। কেউ বাসে উঠছে না, ফুটপাথে দাঁড়িয়েই পৌছে যাচ্ছে অফিস, বিশ্ববিদ্যালয় কারখানায়!
-কী বলো, ফুসকার দোকানগুলো বসবে কোথায়? ঐ যে যে মামা থেকে চুলের ক্লিপ কিনি উনি বসবেন কোথায়?
-বড় সমস্যা! ফুটপাথ চলবে না তাহলে।এভাবেই থেমে থাকুক। বরং আমরাই হেঁটে যাই।
আমার দীর্ঘ নগর খাদক জীবনে ফুটপাথে পড়ে থাকা সিগারেটের ফিল্টারদের ইতিহাস বিষয়ক ভাবনা ভেবেছি। মানুষের পায়ের তলে থেতলে যাওয়া প্রতিটি সিগারেটের ফিল্টার এক একটি গল্প, একটি পুড়ে যাওয়া ইতিহাস। ইতিহাস মাঝে মাঝে মুছে যায়। নগর কতৃপক্ষ এসব সিগারেটের ফিল্টার সরানোর কোন ব্যবস্থা করেননি। ঝাড়ু দিয়ে কেবল এদিক ওদিক নিয়ে যাওয়া হয়। সৃষ্টিকর্তা তাই বৃস্টির ব্যবস্থা করেছেন। বৃস্টি এসব ইতিহাস মাঝে মাঝেই মুছে দেন। আজ খুব বৃষ্টি।
-বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে চা খাবার একটা সুবিধা আছে
-কী?
-চা সহজে শেষ হবে না!
-আমার একটা গোলাপী ছাতা ছিলো।
-এখন নেই?
-বাড়ীতে ফেলে এসেছি, আমি জানতাম শহরে বৃষ্টি হয় না।
-শহরের বৃষ্টি পরিবারের অবাধ্য সন্তানের মত, কখন আসে কখন যায় বাদ বাকিরা জানেনা! শুধু রিকশা চালক আর প্রেমিক প্রেমিকারা ছাড়া।
-চলো বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে চা খাই, তুমি কিন্তু সিগারেট খাবে না। আজকে চারটা হয়ে গেছে।
-কেবল তোমার শাসনের জন্য আমি আজীবন সিগারেট ছাড়বো না। হা হা হা
চা দোকনটার বয়স হয়ে গেছে। কাপ ফেটে চা বের হবার জোগাড়। ঝরঝর করে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির জন্য তীর্থের কাকের মত অপেক্ষা করে শহরের প্রেমিক-প্রেমিকা এবং রিকশাওয়ালারা। বৃষ্টি হলে পরস্পর আলাদাভাবে লাভবান। মাঝে মাঝে নিজেকে ঢাকার টুরিস্ট গাইড মনে হতো, মুস্তাকিমের চাপ, ছবির হাঁটের গুড় চা, ফুলার রোডে জোড়া বৈঠক, ধানমন্ডি ছয় নম্বরের ফুসকা, কার্জন হলের পুকুরে নির্জন দুপুরের সাথে স্নিগ্ধার পরিচয় আমি হাতে ধরে করিয়েছি।
-রোমেল
-হ্যাঁ
- আমরা একটা চটপটির দোকান দিবো
-আচ্ছা
-আমি চটপটি বানিয়ে দিবো, তুমি সার্ভ করবা।
-ভেরী গুড, নাম হবে স্নিগ্ধ চাট হাউজ
-ছিঃ
-ছিঃ হবার কিছু নেই সংসদ ভবনের সামনে একটা চটপটির দোকান নাম চাঁদপুর চাট হাউজ। নামটা সুন্দর।
-কক্ষনো না, এই নাম হবে না।
-তাহলে নগরতমা চটপটি?
-হা হা হা হা
নগরে কিছু বাছাই করা চটপটি ফুসকার দোকান থাকে। এমনকি ঝাল মুড়ির দোকানও থাকে। আজকাল গরুর মাংশ, মুরগীর মাংশ দিয়েও ঝাল মুড়ি বানানো হয়। প্রেমিক-প্রেমিকারা সন্ধ্যা হলে এসব দোকানে লাইন দেয়। চটপটি খাবার নাম করে নাগরিক প্রেম পকেটে নিয়ে ঘোরে। তিনমাসের নাগরিক প্রেম পাঁচমাসে ঠেকতেই বিপত্তি। বিপত্তির ইতিহাস রাষ্ট্রের কূটনৈতিক ঝামেলা থেকে কোন অংশে কম নয়। কোন এক কারফিউর দিনে শহর চষে বেড়াবার গোপন ইচ্ছেও ছিলো। শহর উত্তাল হবার সম্ভাবনা থাকলেও বিরোধী দলের দুর্বলতায় তা আর হল না। ভেবেছিলাম শহর উত্তাল হবে, হরতালে নগর থেমে যাবে আর আমরা ফাঁকা নগরে বসতবাড়ী করে উড়ে বেড়াবো। হৃদয়ের বিস্ফোরনটা থেমে গেলো, হরতাল আন্দোলন থেমে যাওয়া সবকিছু কেবল নাগরিক প্রেমেই আঁটকে গেলো। শিরোনামহীন গেয়ে যায় বুলেট কিংবা কবিতা, ভাবছি বুলেট কিংবা নাগরিকতমাহীনতা!
-তুমি কিন্তু চিঠি লিখবে, হু বলে দিলাম
-আমি স্বভাব চিঠি লেখক!
-দেখি লিখো তো এক্ষুনি
-প্রিয়
নাগরিকতমা
রিকশার হুড না তুলে ফাঁকা রাস্তা দেখেও চুমু দেয়া যায়!
ইতি
তোমার একান্তই নাগরিকতম
স্নিগ্ধার চিঠি লেখবার অভ্যাস শেষ পর্যন্ত ধরে রেখেছিলো। আনুষ্ঠানিক শেষ চিঠিতে তার চলে যাবার যথাযথ কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। চিঠি শেষে নিজেকে নগর নগর মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এইমাত্র নগর কৃতপক্ষের নির্দেশে সকল নাগরিক নগর ছেড়ে চলে গেছে! আমি বিষন্ণ নগর হয়ে বসে থাকি ডিভাইডারে, ব্যস্ত মোড়ের চা দোকানে, লোকাল বাসের হাতলে।
নগর প্রেমের ইতিবৃত্ত ভাবতে ভাবতে নগর খেতে থাকি। কোন মোড়ে দাঁড়িয়ে দৈনিক নাগরিক ছল-চাতুরী দেখতে দেখতে চোখে ধুলি পড়ার নাম করে পানি পড়ে। ঠিক তখন হয়ত রিকশা চেপে চুমু খেতে খেতে বাড়ী ফিরছে কারা যেন! এসব ছল চাতুরী নাকি একটু ভালো থাকার উপায়। তবে সে সার্টিফিকেট মেয়র সাহেব দিবেন না। আমি তো সস্তায় বেঁচে থাকা নাগরিক। সম্প্রতি যার নাগরিকতমা হারিয়ে গেছে। বিকেল দুপুরে কত কবিতা জন্মেছিলো স্নিগ্ধার চোখে সে হিসেব কেউ জানেনা। কবিতাদের বার্থ সার্টিফিকেট এর প্রচলন করা দরকার। অমুক কবিতা অমুক সময়ে অমুকের চোখ দেখে জন্ম নিয়েছে এমন প্রমাণ লেখা থাকবে সেখানে। শেষ কিছুদিন স্নিগ্ধা কবিতা নিয়ে বেশ মেতেছিলো। নেশার মত কবিতা পড়তো, কবিতা লেখাও শুরু করেছিলো। পৃথিবীতে খুব কম সংখ্যক প্রেমিক তার প্রেমিকার কবিতা হতে পারে। আমি কম সংখ্যাকদের একজন হয়েছিলাম। কবিতা হবার দীর্ঘ বছর কেটে গেলো। কে জানে স্নিগ্ধা কবিতা লিখছে কিনা! হয়ত কোন এক নগর খাবার বিকেলে হুট করে দেখা হয়ে যাবে। চিনেও না চেনার ভান করে উদাস হয়ে চলেও যাবে। আমি বসে বসে নগর খাবো।
আমার ভাব গম্ভীর নগর খাবার সময় শেষ হয়ে গেলো। বেঁচে থাকার দায়ে কবিতা, নগর ছেড়ে সকাল সাতটায় মতিঝিলের বাস ধরা নাগরিক গাধা হয়ে গেছি। নাগরিকতমাও ছেড়ে গেছে বছর দুয়েক । অফিসে যাবার আগে নানা কসরত করে ঘুম ভাঙ্গাতে হয়। নিজের ঘুম নিজে ভাঙ্গানোর মত পরিশ্রমের কাজ করার অর্থ হল আমি শুদ্ধ অসহায় গাধা। বাসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে পত্রিকা পড়াটাও অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আজকের পত্রিকাটা রঙচঙে, দেশে ভালো কিছু ঘটছে বোধহয়। চমকে যাবার মত সাহিত্যপাতাতে স্নিগ্ধার বিশাল ছবি দেখতে পেলাম। নিচে বড় হরফের শিরোনাম
“নাগরিক প্রেম নিয়ে আরও অনেক কিছু করার ইচ্ছে আছে”।
“তরুণীদের কবি হওয়ার হার এ দেশে একদম কম। স্নিগ্ধা রহমান গত এক বছর দেশের পরিচিত নতুন কবিদের একজন। মূলত নাগরিক কবিতা লিখে নিজেকে পরিচত করানো তরুণী কবি স্নিগ্ধা দৈনন্দিন নাগরিক প্রেম তুলে আনেন কবিতায়...এমন বৈচিত্রময় বিষয়ের জন্য তিনি অনেকেরই প্রিয় কবি”
পত্রিকা বন্ধ করে সিগারেট ধরালাম। না ঠিক পারছি না নিতে। বরং ফিল্টারটা ফুটপাথে ফেলে থেতলে দিই। থেতলে দেবার আগেই বাস এসে হাজির। ফুটপাথে রেখে গেলাম আমার আধখাওয়া সিগারেট। বেচারা ফিল্টার অপেক্ষা করছে কোন নাগরিকের পায়ে পিষ্ট হবার জন্য। বাস ছুটছে জীবনের পথে...নাগরিক জীবন ছল-চাতুরীতে ভরা। ছল চাতুরী করে একটু লাভবান হওয়া, একটু আরাম করে চলা- এই যা!
["অদ্ভুত তুমিহীনতায় ভুগছি"
অমর একুশে গ্রন্থমেলা, ২০১৫
(কাসাফাদ্দৌজা নোমান)]
লেখক, কবি