আমার বিয়ের কথা চলছে। পড়ালেখা শেষ না হতে এরই মাঝে বিয়ে! ছেলেপক্ষের লোক এসেছে কিন্তু ছেলেটিই আসেনি। এটিও বা আজব কম কিসে!
বিয়ের বয়স আমার মোটামুটি হয়েছে। তবু কোথাও যেন ফাঁকা রয়েছে। বিয়ে করতেই ইচ্ছে হচ্ছে না। বিয়ের পর শ্বশুরঘরের লোকগুলো কেমন ঠেকবে এই নিয়ে বড় দুশ্চিন্তা। বাবা বলছেন, ছেলেটির খান্দান মোটামুটি ঠিকই আছে। আমাকে তারা একবার দেখে গিয়েছিল। তবে ছেলেটির ধরনের আভাস কেউ কিঞ্চিত আদৌ পায়নি। তার পরিবারের লোক এই নিয়ে দুইবার এসেছে আমার বাসায়। একবারও ছেলেটি আসেনি। ছেলেটিকে না হয় নাই বা দেখলাম, তবে তার পরিবারের লোকে কোনদিকে যেন খটকা দেখছি বলে মনে হচ্ছে। কিছু লুকাচ্ছে নাকি তারা? ছেলে আরিফের কথা উঠলে, প্রশংসার বন্যা বয়ে যায় তাদের মুখে। তাদের ছেলে এরকম এবং তাদের ছেলে ওরকম, নানান ধাঁচের কথা। এসব অহেতুক ঢাকঢোল পেটানো লোককে আমি হারে হারেই চিনি। একবার ছেলেটিকে দেখেই বুঝব, কী চলছে। কিন্তু সেই তো আসে না। আমরা মেয়েপক্ষের লোক বিধায় বাবারা মুখ ফুটে অধিক মিনতি করতে পারছেন না, ছেলেকে একবার দেখার কথা। বাবা এসবের কারণে নেহাত না করে দিতেন। কিন্তু ওই পরিবারের ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো। তাই তিনি সবই হাতে হাত রেখে দেখে চলেছেন। আমার বংশের দিক থেকে আমার বড় ফুফিরা ব্যতীত ধনী আর কেউ নেই। বাবার ওদেরই বরাবরি করার প্রবল তেষ্টা।
আমার ছবি অনেক আগেই ওই পক্ষে চলে গিয়েছে। আরিফের খালা বলেছেন, ছবি দেখে আমি আগেই বলে দিয়েছি, হীরা পেয়েছি আমাদের ছেলেটির জন্য। কিন্তু ছবি এখনও ছেলেপক্ষেরটা আসেনি। কি অদ্ভুত! আমিও যে আব্বার কথার পিঠে কথা বলতে পারি না। আব্বা যাই বলেন বা করেন তাই আমার মেনে নিতে হয়। যেমনটা এখন মেনে নিতে হচ্ছে। এখনও সবে পড়ালেখা শেষ হয়েছে। নানান দিকে ঘুরব ভেবেছি। তা আর হয়ে উঠল না।
এসব ভাবার সময় সামনের মহিলাটির দিকে বিরক্তিকরভাবে তাকিয়ে রয়েছিলাম। তিনি আরিফের খালা। একটু বেশিই কথা বলার অভ্যাস। আজ দ্বিতীয়বার এসেছেন, আরিফকে আনেননি। এটিই হয়তো ঢাকার জন্য কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে বকবক করে যাচ্ছেন। বলছেন, আরিফ আগামীবার আসবেন। আংটি আজই আমায় পরিয়ে যাবেন। সবাই সহমত হওয়ায় তিনি আমায় আংটি পরিয়ে দিলেন। তারপর সদলবলে চলে গেলেন।
জানালার পাশে আমার পড়ার টেবিল। এধারে বসে ভাবছি, আমি কি এতটাই ফেলনা? কোনো এক অচেনা মানুষের নামে এংগেজমেন্ট হয়ে গেল। অথচ তাকেই দেখলাম না। ছবিটা তো দিতেই পারত।
এমন সময় বাবা রুমে ঢুকলেন। তিনি আমার পাশে চেয়ার পেতে বসলেন। মনে আমার এখন কোনো ভাবনাই নেই। তিনি আমার সাথে যেটুকু অন্যায় করার আছে তা করে ফেলেছেন। আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। নইলে এভাবে বাবা একা এসে আমার পাশে বসলে আমার খুব ভয় করে।
"মা, আমি জানি আমি তোর বিরুদ্ধে এসব কাজ করে অনেকটা অন্যায় করেছি। তবে যা করছি তোর ভালোর জন্যই তো। আরিফের পরিবার খুব ভালো। তোকে অনেক সুখে রাখবে। শুধু একটা বিষয়ে আক্ষেপ রয়ে গেল যে, ছেলেটিকে একবার দেখলাম না। তবে তুই নিশ্চিন্তে থাক। ছেলের কাছে তো আগামীতে আসতে হবেই শত ব্যস্ততার পরও। তখন যদি আমাদের পছন্দ না হয়, তবে ফিরিয়ে দেবো তাদের সবকিছু।"
আব্বা এইটুকু বলে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। আমার ঠোঁটের কোণে হাসির একটি রেখা ফুটে উঠল। তাহলে বিয়ে ভাঙার সম্ভাবনা এখনও আছে। আর বাবাকে যেমন কঠোর ভেবেছি তিনি তেমনটা নন। তাঁর কথাগুলোতে খানিকটা আশ্বাস পেলাম।
বিয়ের কথা শুনতেই খুব খারাপ লাগে। এতদিন আপনজনের সাথে ছিলাম। বিয়ে হলে পরের ঘরে চলে যেতে হবে। ভালবাসবে তো তাঁরা আমাকে? এসব ভেবে বিয়েটা আর করতেই মন চায় না। আবার মিহির ভাইয়ার কথা মনে পড়লে বুকের ব্যথার হাহাকার শতগুনে বেড়ে যায়। তিনি কেমন এক মায়ায় আমাকে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছেন। কিন্তু কখনও মুখ ফুটে তাঁকে কিছুই বলতে পারিনি। খুব ভয় করার দরুন এমনটা হয়েছে।
ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি, তিনি খুব গম্ভীর স্বভাবের। বলতে গেলে ছোটবেলা থেকে তাকে যতটুকু না ভয় করতাম, তার চেয়েও বেশি করতাম ঘৃণা। একবার বড় ফুফা আমাদের বাচ্চা-কাচ্চা সকলকে নিয়ে পার্কে ঘুরতে গিয়েছিলেন। তখন হয়তো বয়স আমার বছর দশেক ছিল। ফুফা মিহির ভাইয়াকে কিছুটা টেনে-হিঁচড়ে আমাদের সাথে করে নিয়েছিলেন। আমি, আমার আপু, ফুফাতো বোন মায়া আপু, মুক্তা সকলেই ছোট ছিলাম বিধায় দেখাশুনা করার জন্য মিহির ভাইয়াকে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেদিন তিনি খুব সুন্দরভাবে পরিপাটি হয়ে গিয়েছিলেন যেমনটা তিনি সদা থাকেন। আমরা সমবয়সীরা সকলে আইসক্রিম হাতে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছিলাম। এমন সময় আমি না দেখেই মিহির ভাইয়ার সাথে ধাক্কা খেলাম। তিনিও অপ্রস্তুত থাকায় আইসক্রিমের অর্ধেক অংশ তাঁর শার্টের কিনারায় লেপ্টে গেল। আমি পূর্বেও এই ধরনের অনেক কাজ করে ভাইয়াকে রাগিয়ে দিয়ে এসেছি। এবারও আমাকে তিনি কম ঝাড়লেন না। অনেক বকা দিয়েছিলেন। দেখে দৌড়াতে পারো না? এভাবে দৌড়াতে হয়? আমার পুরো জামাই যে নষ্ট করে দিলে। এসব কে পরিষ্কার করে দেবে? আজকাল বেশি বেড়ে যাচ্ছ। মামিকে বলতেই হবে তোমার কাণ্ড-কাহিনিগুল
ো।
আমার কাছে বলতে ইচ্ছে হয়েছিল, বকা দিলে তো লেগে যাওয়া দাগ আর ঠিক হয়ে যাবে না! ভয়ে বলতে পারলাম না। দৌড়ে গিয়ে ফুফার কাছে নালিশ দিলাম। ফুফা এসে তাকে আস্ত গিলে খেয়েছেন, আমাকে বকাঝকা করার দায়ে। তিনি আমাকে খুব পছন্দ করেন। তিনি ভাইয়াকে বললেন, "মামাতো বোন তোর। এটুকু তো লজ্জা করতে পারিস। তা না হলে মেয়েটি যে তোর চেয়ে বছর ছয়-সাতেক ছোট হবে এটা তো দেখতে পারতি। এতো ছোট একটা মেয়েকে বকাঝকা করতে লজ্জা করে না? ও তো আর ইচ্ছাকৃতভাবে করেনি।"
ভাইয়া মুখ নিচু করে ফেলতেন। বলা বাহুল্য, আমি আমার বাবাকে যতটা ভয় করি, তিনিও তার বাবাকে তারচেয়ে অধিক ভয় করেন। সেদিন তিনি ফুফার বকুনি খেলেই আমার মনটা ঠান্ডা হলো। খুব মজা পেয়েছিলাম। সেদিন ভাইয়াকে বকা শুনাতে খুব ভালো লেগেছিল। এর পরবর্তী সময়ে ভাইয়া যখন আমাদের বাসায় এসেছিলেন, একপ্রকার লুকিয়ে লুকিয়ে ছিলাম। কিন্তু একসময় তার হাতে ধরা পড়লাম। আমার কারণে ফুফার বকা খাওয়ায় সেদিনের অনুরূপ আমায় কীভাবেই না ঝেড়েছেন! তার এসবের পেছনে তার বয়সের অনুযায়ী কোনো ভাব ছিল না। রাগারাগির দিক থেকে ছোট বাচ্চার মতোই। তাইতো, আমি ছোট, তা তার মাথায় থাকত না।
বয়স বাড়ার পর থেকে তার প্রতি ভয় যতটুকু বেড়েছে, তার চেয়ে অধিক ঘৃণা বেড়েছে। তিনি কেবল নিজেকেই চেনেন। কার মনে কতটা আঘাত লেগেছে বুঝারই চেষ্টা করেন না। নিজেকে যেন অনেক বড় কিছুই ভাবেন। এককথায় সামনের জনকে পাত্তাই দেন না। আমিও ভাইয়ার পেছনে উঠেপড়ে লাগতাম। তবে আমি ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে কখনও রাগাতে যেতাম না। কীভাবে যেন প্রকৃতি আমার বিরুদ্ধে হয়ে ভাইয়ার সাথে প্রতিবার কিছু অঘটন ঘটিয়েই ফেলত। ওই যে, অকস্মাৎ ধাক্কা খেয়ে আইসক্রিম তার কাপড়ে লেগে যাওয়াটাও উৎকৃষ্ট একটি উদাহরণ।
এসএসসি পরীক্ষা শেষে ছুটির সময় একবার ফুফির বাসায় কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে গিয়েছিলাম। বড় হয়েছি বিধায় ভাইয়ার কাছ থেকে দূরে দূরেই ছিলাম। ভাইয়াও আমাকে পছন্দ করতেন না। দেখেই বুঝা যেত। যাওয়ার দুইদিন পর ফুফি আমাকে আর মুক্তাকে নিয়ে কক্সবাজারে গিয়েছিলেন। মুক্তারও আমার ন্যায় পরীক্ষা শেষে ছুটি চলছিল। কক্সবাজারের কিছুটা দূরে ফুফির এক বান্ধবীর বাসা। আমাদের ওখানেও যাওয়ার কথা ছিল। ঘোরাফেরা শেষে যখন ফুফিরা ওখানে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলেন, তখন কী ভেবে যেন ফুফি আমায় যেতে নিষেধ করে দিলেন। আমি হতভম্ব রয়ে গেলাম। আমি একা একটি মেয়ে কোথায় বা যাব? এমনটা জিজ্ঞেস করার আগেই ফুফি বললেন, মিহির আজ বাসায় আছে। আমি ওকে একটু আগে আসতে বলেছি। ও এসে তোকে নিয়ে যাবে। আমি আজ অনেকদিন পর বান্ধবীর বাসায় যাচ্ছি। ফিরতে রাত অনেক হবে। তোকে দেখে ওরা অনেক কিছু ভাববে। তাই নিচ্ছি না।
ফুফি কথাটি সরলভাবে বলে গেলেন। আমার ছোট মস্তিষ্ক কথাগুলোকে খুব সহজেই মেনে নিয়েছিল। পরে ফুফি আমাকে এক বিশ্বস্ত দোকানদারের হাতে সঁপে দিয়ে চলে গেলেন। সন্ধ্যার দিকে মিহির ভাইয়া এলেন। তাকে তখন দেখতে খুব আতঙ্কিত এবং বদমেজাজি দেখাচ্ছিল। এসে নিজ থেকে তিনি অনর্গল বলে যাচ্ছিলেন, তোমার কারণে আমি আর পারলাম না। একা এতো মাইল অতিক্রম করে এলাম কেবল তোমায় নেওয়ার জন্য? অবিশ্বাস্য! আমি যাকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি তাকেই এতদূর নিতে এসেছি? শুনো, মা ধমক দিয়েছিলেন বলে তোমাকে নিতে এসেছি। বাবাকে তো চেনো, আমার কোনো দোষ পেলে আমাকে আর কোনোকূলের জন্য রাখেন না। মায়ের কথা না মানলে বাবার কাছে যে নালিশ দেওয়ার কথা ছিল! একপ্রকার বাধ্য হয়েই আসা। তোমার জন্য আর কত কী করতে হবে বলো? আজ বেঁচে কোনোভাবে এসেছি। বাইকটা বাবা নতুন কিনে দিয়েছেন। সবেই চালানো শিখেছি। ভালো করে না শিখতেই তোমার জন্য মায়ের কড়া হুকুমে এতদূর রিস্ক নিয়ে এলাম। আর হলে না! কখন আমার পিছু ছাড়বে বলো?"
আমি কিছুই বলিনি। ভাইয়া আমাকে বাইকের পেছনে নিলেন। দেখলাম, বাইক ভালোভাবেই চালাচ্ছেন। লাগছিল না রিস্ক নিয়ে চালাচ্ছেন। আমি কিছুক্ষণ ঘৃণার চোখে তার দিকে চেয়ে রইলাম। এটা তিনিও খেয়াল করে বললেন, "কী হয়েছে? এভাবে কী দেখছ?"
আমি কিছুই না বলে মুখ ফিরিয়ে ফেললাম। তিনি সবসময় আমাকে বকা দেওয়ার কেবল সুযোগ খুঁজে এসেছেন। আজও এমনটা করেছেন। আমি কি জানতাম না বাইকটা কখন কিনেছেন? বাইক নতুন চালাচ্ছিল না। আমারই বা দোষ কিসে? আমি কি ফুফিকে বলেছিলাম, আমাকে এখানে রেখে যান? ফুফিই তো অকস্মাৎ রেখে গেলেন।
আর আমি অল্প অভিমানেও কাঁদা শুরু করার মতো মেয়ে। তখনও চোখ খানিকটা ভিজে গেল ভাইয়ার বকাগুলো মনে পড়ায়। এক সময় ভাইয়া বাইক থামিয়ে বললেন, "আইসক্রিম খাবে?"
আমি কিছুই বললাম না। চোখ মুছে একদিকে চেয়ে রইলাম। ভাইয়া কিছুটা জোর করে আমাকে বাইক থেকে নামালেন। আইসক্রিমের দোকানে নিয়ে আমাকে আমার পছন্দের আইসক্রিমটা কিনে দিলেন। খাওয়ার পর্ব শেষে আমরা ফিরে এলাম। সেদিন আমার ভয়ের পরিমাণ খুব বেড়ে গিয়েছিল। বাসায় ভাইয়া ব্যতীত কেউ ছিল না। মিহির ভাইয়ার বড়, মঈন ভাইয়া, কাজের উদ্দেশ্যে বাহিরে গিয়েছিলেন। মায়া আপু শ্বশুর বাড়িতে। সেদিন রুম থেকে বেরই হতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। বলতে গেলে আমি আর মিহির ভাইয়া একাই ছিলাম। আমি কিনা ওই বয়সে সেই যাবৎ প্রথমই একটি ছেলের সাথে একাই ছিলাম। আমি একা একই ঘরে একটি ছেলের সাথে। ভাবতেই বারবার ঘাবড়ে উঠছি। নিজেকে সামলে রাখলাম। আমি মুক্তার রুমে থাকি। তার রুমেই বসে রইল। বাহির থেকে মাঝে মাঝে খুটখুট শব্দ ভেসে আসছে। রাতের খাবার তৈরি করার তো কেউ ছিল না। নিশ্চয় মিহির ভাইয়া রান্নাঘরে কাজ করছেন। আমার কি যাওয়া উচিত? তিনি ছেলেমানুষ। রাঁধতে পারবেন তো? না, আমি এ কি করছি? তিনি আমার ফুফির ছেলে। ছিঃ তার সম্বন্ধে কিরূপ বদখেয়াল মনে আনছি। তাতে কী হয়েছে, মা বললেন ছেলেদের আশেপাশে না ঘেঁষতে?
আপন মনে নিজেকে ধিক্কার দিতে দিতে চলে গেলাম। গিয়ে দেখলাম তিনি রান্নাই করছেন। আমি একপা-দুইপা করে এগিয়ে গিয়ে বললাম, "পারছেন তো করতে? আমি সাহায্য করব?"
"না, আমি করে নিতে পারব।"
"রান্না করতে জানেন?"
তিনি কিছুই বললেন না। তিনি কোনোভাবে দুটো ডিম সিদ্ধ করেছেন আর চাল ধুয়ে রেখেছেন। বাকিটা কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না তা স্পষ্ট দেখছি। আমি ভাতসহ দু'একটা তরকারি রাঁধতে পারি। ভাইয়ার বলার অপেক্ষা না করে ভাত রাঁধতে দিলাম। ফ্রিজ থেকে কিছু সবজি বের করে নিলাম। তারপর যেটুকু পারি কেটে, ধুয়ে রাঁধতে লাগলাম। ভাইয়া তখনও পাশে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। কিছু একটা হয়তো বলতেও চাইছেন বিধায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
"কিছু কি বলবেন?"
"ইয়ে মানে মা কি তোমাকে কিছু বলেছেন, কোথায় যাচ্ছেন সেই ব্যাপারে?"
"কক্সবাজারে তাঁর এক বান্ধবী বাসায়।"
"তা তো আমাকেও বলেছেন। কিন্তু.."
"কিন্তু কী?"
"কিন্তু তোমাকে রেখে যাওয়ার মানে কী? কিছু জিজ্ঞেস করোনি?"
"না, আমার যাওয়াতে হয়তো কোনো সমস্যা হবে। তাই নেননি। এছাড়া আর কিই বা জিজ্ঞেস করব?"
কথাগুলো ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলতে গিয়ে অজান্তেই বৃদ্ধা আঙ্গুলে ছ্যাকা লাগল। পুড়ে গেলাম। ভাইয়া খেয়াল করতেই আঙ্গুল পানিতে দিতে বললেন। আমার সেন্স তখন কাজ করছিল না। অগত্যা ভাইয়া নিজেই চলন্ত পানির ধারার নিচে আমার আঙ্গুল দিয়ে রাখলেন। বেশি পুড়ে যাওয়ায় আঙ্গুলের ডগা লালছে হয়ে গিয়েছিল। ভাইয়া মলম এনে লাগিয়ে দিতে দিতে বললেন, "এই মলমটা অনেক ভালো, ঠিক তোমার মতো। শুধু পুড়ে গেছ ওটা কাউকে বলবে না প্লিজ। বাবা যদি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেন যে, আমি থাকতে তোমার কাছে রান্নাবান্না করতে হয়েছে তবে... আই হোপ বুঝেছ। ব্যথা কমেছে?"
আঙ্গুল জ্বলার সত্ত্বেও কী ভেবে যেন হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ালাম। রান্না প্রায় শেষ দেখে আমাকে তিনি আর কিছুই করতে দিলেন না। রান্না শেষে টেবিলে দুজন খেতে বসলাম। তার রান্না ডিমসহ অতিরিক্ত কেবল একটিই তরকারি। তিনি দীর্ঘক্ষণ চুপচাপ খেয়ে গেলেন। একসময় জিজ্ঞেস করলেন, "মা কখন আসবেন বলেছিল যেন?"
"একটু রাত হবে। তবে চলে আসবেন।"
বাকিটা সময় নিঃশব্দে খেয়ে গেলাম। ফুফা এক ভাইকে দেখতে গিয়েছিলেন। কাল নাগাদ চলে আসবেন। এভাবে ফুফার অনুপস্থিতিতে ফুফি কী করছেন কিছুই বুঝছি না। মিহির ভাইয়া নানা প্রশ্ন করার পর থেকে এই চিন্তাগুলো মাথায় বারবার আসছে। ফুফির আসার পর আমি মুক্তার সাথে শুয়ে পড়লাম। বামপাশে ফিরতেই কানে বাজছে, 'আইসক্রিম খাবে?'
মনে মনেই উত্তর দিলাম, 'হ্যাঁ, খাব তো। কেন খাব না? আপনি দিলে অবশ্যই..' এসব আমি কী ভাবছি? আবার ডানপাশে ফিরলাম।
'এই মলমটা অনেক ভালো, ঠিক তোমার মতো।'
'সত্যিই কি!'
না না, এ কী ভাবছি আমি? ভাইয়াকে ভালো করে চিনি। ফুফাকে কিছু না বলার জন্যই আমার প্রশংসা করেছেন। তবে যাই হোক, আজ তাকে যেভাবে দেখেছি ওভাবে কোনোদিন দেখিনি। আমার মন খারাপে তার আইসক্রিম কিনে দেওয়া, পুড়ে যাওয়াতে মলম লাগিয়ে দেওয়া। আজ যেন অন্য কোনো এক মিহিরকে দেখলাম। আজ যেরূপ নম্রভাবে কথা বলেছেন, তা এইবারের মতো প্রথমই। তার ভেতর নম্রতাও আছে তা সেদিনই জানলাম। সারাটা রাত এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে চলে গেল। বলতে গেলে এরপর থেকেই তাকে ঘৃণা করা ছেড়ে দিয়েছিলাম। সেদিন গভীর রাতে মঈন ভাইয়া অফিসের কাজ শেষে ফিরে এলেন। সকালে ঘুম থেকে উঠলে দেখি আমি ফ্লোরে ঘুমাচ্ছিলাম। এমনটা প্রতিবারই হয়, যদি আমি রাতে উত্তেজিত হয়ে ঘুমাই। ঘুমের ঘোরে রাতের বেলায় নিচে পড়ে যাই। সেদিন পড়ে গিয়ে পাশে টেবিল থাকায় কয়েকদিকে আঁচড় পড়েছে।
সকালে ফুফাও চলে এলেন। বিকেলের দিকে তিনি বারান্দায় বসেছিলেন। আমাকে ডাক দিলেন। কেন ডাক দিয়েছেন তা জেনে তেল নিয়ে চলে গেলাম। ফুফা রীতিমতো আমাকে তাঁর মাথায় তেল দিয়ে ম্যাসেজ করে দিতে বললেন। ফুফা বড় আনন্দের সাথে বললেন, "দুপুরে যা খেলাম না, এমন খাবার এতদিন একবারও খাইনি। এতো মজার খাবার অনেকদিন পর খেলাম। সত্য বলতে এই খাবারটা খেয়ে খুব প্রিয় একজনের কথা মনে পড়ে গেছে।"
"তাই? কোন খাবারের কথা বলছেন ফুফা?"
"ওই যে দুপুরে টমেটো আর শুটকি একসাথে মরিচ-মশলা ঘন করে রান্না করা তরকারি একটা খেলাম না -ওটার কথা বলছি। সেও এভাবে আজব-আজব খাবার নিজের আইডিয়া দিয়ে রাঁধত।"
মুহূর্তেই মনে পড়ে গেল, কালরাত যখন কিছুই বানাতে পারছিলাম না, তখন টমেটোকে শুটকির সাথে ঘন ঝোল দিয়ে নিজ আন্দাজেই রান্না করেছিলাম। ফুফা হয়তো ওটার কথাই বলছেন।
"সে কে ফুফা? কে ওভাবে রাঁধত?"
"কেউ না।" ফুফা ইতস্তত করলেন, "তুই বল, দুপুরে যেটা খেলাম কে রেঁধেছে? নিশ্চয়ই মুক্তার মা নয়।"
কিছুটা ইতস্ততভাবে বললাম, "আমি রেঁধেছি।"
ফুফা আচমকিত হয়ে গেলেন। আমার হাত ধরে আমাকে সামনে এনে বললেন, "তুই রান্না করেছিস?"
"হ্যাঁ, কালরাত রান্না করেছিলাম।"
"কেন? তোর রান্না করার বয়স হয়েছে? তোর ফুফি থাকতে তুই কেন রান্না করেছিস?"
"ফুফি কিছুই রান্না করে যাননি বিধায় রাঁধতে হয়েছে।"
"মানে? কেথায় গিয়েছিল তোর ফুফি?"
"আপনাকে বলেননি?"
"বল, কোথায় গিয়েছিল তোর ফুফি?"
"আমাদের নিয়ে কক্সবাজারে গিয়েছিলেন। এরপর মুক্তাকে নিয়ে তাঁর এক বান্ধবীর বাসায়।"
"বান্ধবীর বাসায়? আমি যেটুকু জানতাম, তোরা কেবল কক্সবাজারে গিয়েছিলি। এরপর কী হলো? তোর কাছে কেন রাঁধতে হয়েছে?"
"আসলে ফুফি আমাকে তাঁর বান্ধবীর বাসায় নিয়ে যাননি। স্রেফ মুক্তাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমাকে এক দোকানদারের কাছে দিয়ে গিয়েছিলেন। ফুফি মিহির ভাইয়াকে বলে রেখেছিলেন আমাকে নিয়ে আসার জন্য। সন্ধ্যার দিকে তিনি গিয়ে আমাকে নিয়ে এলেন।"
আমি কথা শেষ না করতেই তিনি বললেন, "তাহলে কাল বাসায় তুই আর মিহির ছাড়া কেউ ছিল না?"
"না", আমি কানের সামনে আসা চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে কিছুটা নম্রভাবে বলি।
ফুফার চোখ হঠাৎ আমার হাতের আঁচড়ের দিকে পড়ল। এরপর কী ভেবে যেন ফুফা উঠে চলে গেলেন। আমি তেলের কৌটা রেখে ভীত পায়ে ভেতরে গেলাম। ফুফা গর্জে উঠে ফুফিকে ডাকছেন। আমি শুকিয়ে গেলাম। আমার কথায় কিছু হয়ে গেল না তো? আমি তো জানতামই না, ফুফি যে বান্ধবীর বাসায় যাওয়ার কথা ফুফাকে জানাননি। ফুফি এলে ফুফা হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, "কাল কোথায় গিয়েছিলে?"
"কেন? তোমাকে তো বলেছিলামই কক্সবাজারে যাওয়ার কথা।"
"শুধুই কি কক্সবাজারে গিয়েছিলে?"
ফুফি ক্ষেপে গিয়ে আমার দিকে দেখছেন।
"বলো, শুধুই কি কক্সবাজারে গিয়েছিলে? আর কোথাও যাওনি?"
"না, যাইনি।"
"মিথ্যে একদম বলবে না। আমি ভালো করেই জানি তুমি তোমার বান্ধবীর বাসায় গিয়েছিলে।"
"হ্যাঁ, গিয়েছিলাম। কী অপরাধ করেছি আমি?"
"কী করেছ আমি ভালই জানি। সাবিহাকে নাওনি কেন?"
"আমার ইচ্ছা, আমি নিইনি।"
"দেখ, মেজাজ খারাপ করবে না কিন্তু। কক্সবাজারে তোমার কোন বান্ধবী আছে তা আমি কি জানি না? ওই বান্ধবীটাই না, যার ভাইয়ের সাথে মুক্তার বিয়ে দেওয়ার ধান্দা আগেও করেছিলে?"
ফুফি রাগে কটমট করে মুখ নিচু করে ফেললেন।
"জবাব দাও।" ফুফা চিল্লিয়ে উঠায় বাকিরা রুম থেকে বেরিয়ে এলো।
"হ্যাঁ, মুক্তাকে দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। মেয়েটা যে শ্যাম বর্ণের, কোনোদিক থেকে প্রস্তাব কি আসে? আর আগে থেকেই ফাহিমার সাথে আমার কথা হয়ে গিয়েছে। ও কত ধনী নিশ্চয় আপনি জানেন। মুক্তাকে দেখাতে নিয়ে গেলাম ওর ভাইয়ের সাথে। এতে সমস্যা কী?"
"সমস্যা কোথায় তুমি কি জানো না? ষোল বছরের বাচ্চা মেয়েটিকে তুমি বিয়ে দেবে? তাও বয়স্ক, কালো একটা ছেলের সাথে?"
"কালো-ধলো এগুলো দেখে লাভ কি! মেয়ে পরের জীবনে সুখী থাকলেই তো হলো।"
"ওর পরের জীবনের কথা বেশি চিন্তা করতে যেও না। এভাবে বেশি চিন্তা করলে মেয়েটা অসুখীই হবে। আর তোমার কেমন মন-মানসিকতা? একটা বাচ্চা মেয়েকে তুমি এক দোকানদারের কাছে রেখে গিয়েছিলে? কীভাবে পারলে?"
"যার-তার কাছে রেখে যাইনি। লোকটাকে আমি আগে থেকেই চিনি। আর সাবিহাকে রেখে যেতে হয়েছে। কারণ ওকে নিয়ে গেলে মুক্তাকে দেখার স্থলে সবাই সাবিহার রূপকেই দেখত।"
এরপর তাঁদের দুজনের বাড়াবাড়ি তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগল। শেষে ফুফা একদম পরিষ্কার ভাবে বলে দিয়েছেন, মুক্তার জীবনের কোনো সিদ্ধান্তই ফুফি নিতে পারবেন না।
যখন আমি আর মুক্তা ঘুমাতে গেলাম, তখন মুক্তা হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। পরে সে বলল, ফুফি তাকে জোর করেই ছেলেকে দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। ছেলেটিকে তার একদমই ভালো লাগেনি। কিন্তু ফুফির দেওয়া চাপে কিছুই বলতে পারেনি। সে আন্দাজ করেছে, আমার কারণেই কথাগুলো উঠেছে। মুক্তা আমাকে শত ধন্যবাদ জানাচ্ছে, তার জীবনের মোড় পাল্টানোর জন্য। বলছে, আমি কথাটা না তুললে ওকে লুকিয়ে ছেলেকে দেখিয়ে আনার কথা ফুফা জানতে পারতেন না। না জানলে বিয়ে ওই ছেলের সাথে হয়ে যেত। ছেলেটি না জানি কত খারাপ কাজে জড়িত। বিয়ের সম্বন্ধে ফুফা শেষের দিকে জানলে এবং বিয়েটা অস্বীকার করলে গুণ্ডা ভাড়া করে এনে ফুফাকে ধমকাবার কথাও উঠেছিল। ফুফা এখন কথাগুলো সময় থাকতেই জেনে গেছেন। খারাপ কিছু ঘটার পূর্বে ফুফা পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রাখবেন। ফুফারও যে ক্ষমতা কম নয়।
আমি মুক্তাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। ওর কান্না মুছে দিয়ে দুজনই হাসি মুখে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন ফ্লোর থেকে উঠে দেখলাম, বাইরে গোলযোগ বেঁধেছে। ফুফারা একদল লোক আরেকদল লোকের সাথে কথা কাটাকাটি করছেন। মুক্তা ওই ব্যক্তিকে চিনিয়ে দেয়, যার সাথে তার বিয়ের কথাবার্তা ফুফি পাকা করে এসেছিলেন। দু'পক্ষেই বল খুব বেশি। কেউ কাউকে কিছুই করতে পারছে না। পরক্ষণে আশেপাশের সকল মানুষ ফুফার পক্ষে জুটে। যাক, তাঁর বল বেড়েছে। এরপর মারামারিতে না গিয়ে ফুফারা বৈঠক বসলেন। পুরোটা দিন এসব মামলায় কেটে গেল। এরপর মামলা শীতল হয়ে আসে। কোনোভাবে ফুফা মুক্তার বিয়েটা ক্যান্সেল করাতে সক্ষম হলেন। যখন তারা শান্ত হয়ে কথাবার্তা বলছিল তখন চারিদিকে সবাই ভিড় জমিয়েছিল। আমিও ভিড়ে ছিলাম। ঠিক তখনই কে যেন আমার হাতটা শক্তভাবে ধরল। পিছনে ফিরে দেখলাম, আমার হাত মিহির ভাইয়াই ধরেছে। তিনি আমাকে টেনে ছাদে নিয়ে গেলেন। আশেপাশে কেউই ছিল না। তিনি আমার হাত ছাড়েননি। দরজা বন্ধ করে দিয়েই হাত ছাড়লেন। কী হচ্ছে আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
(চলবে...)
লেখা: ফারিয়া কাউছার
কুয়াশা মন (পর্ব ২))
Tags:
Novel