চোরাবালি

রুমে আয়নার সামনে বউ সাজে অরণি বসে আছে। কোনো সাজসজ্জা নেই রুম'টায়। সাজসজ্জা আগে ছিল না এমনটাও নয়। অরণির রুম এটি। সে যেখানে বিদ্যমান, ওখানে সাদামাটা কিছু পাওয়াই যায় না। একদা ছিল এই রুমে নানান কিছুর বাহার। দেয়ালে সাজানো ছিল তার হাতের বানানো রং-বেরঙের ফুল। টেবিলে ছিল ইসলামিকসহ নানান ধাঁচের বই। এবং একটি ডায়েরিও ছিল, যার মলাট দেখে কেউই বুঝত না যে, এটি একটি ডায়েরি। কারণ মলাটও অরণি খুব সুন্দর করে সাজিয়েছিল। এখন সেই টেবিলে কিছুই নেই। সর্বদা নানা কিছু বানানোর জন্য থাকত এখানে কাঁচি, ছুরিসহ নানান সরঞ্জাম। এখন সবদিকটাই সাদামাটা। বিয়ের আয়োজনের ফলে কেউ এইদিকটা লক্ষ করেইনি। কেউ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেনি তার রুমের ডাস্টবিন-এর দিকে। সেখানে ছেঁড়া পড়ে আছে দেয়ালে সাজানো ফুলগুলো টুকরো হয়ে। আছে ডায়েরিটির ছেঁড়া পাতা। তার একটি অর্ধছেঁড়া পৃষ্টায় লেখা আছে, আমাকে বিয়ে দেয়া হলে আমি বেঁচে তো থাকব, কিন্তু আমার মানসিক মৃত্যু ঘটবে।
টেবিলের যাবতীয় বই পড়ে আছে খাটের নিচের অন্ধকার জায়গায়। আর নানা কিছু বানানোর কাগজের বাণ্ডিলটা তার রুমের জানালার বাহিরের লেবু গাছের নিচ হতে ছাই হিসেবে ধীরে ধীরে উড়ে যাচ্ছে বাতাস এলে।
মেকাপ-এর নিচের আবরণে যে অরণির চোখ ফুলে একাকার, তা কেউই লক্ষ করছে না। বান্ধবীরা কেবল মশকারা করছে বিয়ে নিয়ে। কেউ জিজ্ঞেস করেনি, তোর বিয়ের প্রতি অনীহা ছিল, কেন আজ বিয়ে করতে নিজেকে লাল শাড়িতে আবৃত করলি?
অরণি নিজেকে একনাগাড়ে আয়নায় চেয়ে রয়েছে। তার মাঝে আর কোনো ত্রুটি নেই তো? রূপে, ফিগার-এ কোনোদিকে ঘাটতি নেই তো? সেদিন তো বোরকার উপর থেকে কেবল তাঁরা উচ্চতাই মাপতে পেরেছে। পরে আবার কোনো ঘাটতির জন্য মাকেই তাঁরা দোষারোপ করবে। তা সহ্য হবে না। একমাত্র সে মাকেই যে অধিক ভালোবাসে! আজ তার মন রক্ষার খাতিরেই যে নিজের সকল আশার জলাঞ্জলি দেয়া!
সেদিন ছেলেটি জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। অল্প কিছুক্ষণ কথা বলে মানুষের মন সম্বন্ধে জেনে ফেলার অদ্ভুত এক কলা আছে অরণির মাঝে। ছেলেটির সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে বুঝে ফেলেছিল, সে কথা বেশ বলে না, আবার কমও নয়। পড়ালেখা সে তেমন একটা করেনি। নিশ্চিত আগামীতে অরণির পড়া চালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম দেবে। তারপর ছেলেটির সাথে দাঁড় করিয়ে তার উচ্চতা দেখা হল। রেস্টুরেন্ট থেকে চলে আসার সময় অরণিকে আরেকবার ছেলেটির মা তার জায়ের পাশে অরণিকে দাঁড় করিয়ে মাপ দেখেছে। সে কিছুই বলেনি। গ্রামীণ মেয়েদের স্বভাবত ছেলেপক্ষের সামনে কিছু বলতে নেই। অরণি বাস্তববাদী একজন হলেও দাবিয়ে রেখেছে সব ক্ষোভ। বলতে চেয়েছে, আপনাদের ছেলেও লম্বা কোথায়? ছোট লোক হওয়ার দায়ে মুখ ফোটে বলা হয়নি। মা তাকে বুঝিয়েছে, "আমাদের সংসার এখন পানিতে ডুবছে। তোর বাবা বিগত হয়েছে বছর চারেক। এই অবধি তোর চাচাই আমাদের চালিয়েছে। এরচেয়ে বেশি চালাতে পারছেন না তিনি। ছেলেটির সম্পত্তি আছে। কাজেই তোকে বিয়ে দিলে সে আমাদের একটু দেখবে।"
"কিন্তু ছেলেটির কথাবার্তায় বোধ হয়েছিল, লেখাপড়া তাঁর পছন্দ নয়।" অরণি বলেছিল, "আমাকে বিয়ের পর পড়তে দেবেন না।"
"পড়ালেখা বিয়ের পর কেমনে হয়! সংসার নিয়েই ব্যস্ত হয়ে যেতে হয়। তোকে বিয়ে দিলে একটু স্বচ্ছলতা আসবে। বোঝ্ না একটু!"
অরণি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। চেয়েছিল সে, আজীবন অবিবাহিতাই থাকবে। প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু এই পাত্রের সম্বন্ধ আসার পর থেকে ক্ষয়ে যাচ্ছে অরণির স্বপ্ন। এসব আর বাস্তবায়ন হবে না। পড়ালেখার মাধ্যমে জগতকে জানা যায়। অরণির মতো জ্ঞান পিপাসু এবং অভিজ্ঞতা পিয়ারীর আর এই জগতকে চেনা হবে না।
বিয়ের কথা পাক্কা হয়ে গেল। মুখ ফোটে অরণি বলতে পারল না, মা, একটু কষ্ট হবে লেখাপড়া করতে। আমি হাতের কাজ যতটুকু জানি তা দিয়ে সংসারের ভার কাঁধে নেয়ার চেষ্টা করব। সর্বাত্মক চেষ্টা করব নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবার। একবার সুযোগ দিন। ধারালো সময়টা কেটে যাবে। তখন সবাই সুখে থাকব। কথাগুলো তার অশ্রু হয়ে টপটপ করে গড়িয়ে পড়ল কেবল। সারারাত একা বসে সে কেঁদেছে। এখন আর কিছুই করার নেই। কালই বিয়ে। কালই নতুন এক জায়গায় পা রাখতে হবে, যেখানে তার ইচ্ছার কোনো গুরুত্ব দেয়া হবে না বা বাবার বাড়িতে থাকার মতো স্বাধীনভাবে থাকতে পারবে না। এই রাতে সে তার মৃত বাবাকে খুব করে ধিক্কার জানিয়েছে। কেন গেলেন বাবা? আপনি তো বলেছিলেন, আমাকে অনেক বড় করবেন। আমার মেয়েকে আমি কখনও বিয়ে দেব না। আজ আপনি কোথায়? আমার সাথে এত বড় অন্যায় হচ্ছে। আপনি থাকলে নিশ্চিত আমাকে এই বিয়ে করতে হত না। উচ্চতা পরখ করে এমন পরিবারের দিকে আপনি চোখ তুলেও তাকাতে দিতেন না। কোথায় হারিয়ে গেলেন আপনি?
পরক্ষণে সে নিজেকেই ধিক্কার জানায়। এত নিষ্ঠুর তো সে নয়! পরিবারের খাতিরে নিজের ইচ্ছার আহুতি দেয়াই যায়! সে স্থির করল নিজেকে সে প্রস্তুত করবে। সে তার আশেপাশের জিনিস যতই দেখছে, বেদনা ততই বাড়ছে। সে উঠে দাঁড়ালো। চেয়ারে উঠে দেয়ালের সাজসজ্জাগুলো ছিঁড়ল, সবগুলো বই বস্তায় ঢুকিয়ে খাটের নিচে রেখে দিল, প্রিয় কী প্রয়োজনীয় সকল জিনিসই সে সামনে থেকে সরিয়ে দিল যেগুলো দেখে তার ইচ্ছাগুলো জাগ্রত হয়। অবশেষে ক্ষান্ত হয়ে সে ফোলা চোখজোড়া বেঁধে ফ্লোরেই ঘুমিয়ে পড়ল।
.
অরণিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যথাসময়ে ছেলেপক্ষ উপস্থিত হলে আক্দ পড়িয়ে তার বিয়ে দেয়া হলো। বিয়েতে সে কাউকেই আসতে বলেনি বলে বান্ধবীরা বিদায়ের সময় মেলা বকুনি দিচ্ছে, "তোর হলোটা কী? স্বামী পাবার খুশিতে আমাদেরই আসতে বলতে ভুলে গেলি। ও তো আন্টি'ই আসতে বলেছে।"
"আমার বিয়ে হচ্ছে, এতে বিশেষ কিছু নেই।" অরণি চোখের কোণ মুছে বলল, "তাই আসতে বলিনি।"
"বাঃ!"
"তোরা ভার্সিটি'তে একসাথে লেখাপড়া করিস। খুব ভাল লাগবে জীবনটাকে। এর কাছে তখন কোনো অভিযোগ থাকবে না।"
অরণিকে জড়িয়ে ধরতে কাছিয়ে এলো চাচাতো বোন। সে বছর দুয়েক বড় অরণির চেয়ে। তার বাবার ইনকাম কম। তবু তাকে পরিবারের সকলে লেখাপড়া চালিয়ে যাবার অনুপ্রেরণা জুগাচ্ছে। অথচ একই ঘরের মানুষ। কিন্তু অরণি বঞ্চিত। অরণি তাকে বলল, "আমি তোমাকে একবার মজার ছলে বলেছিলাম, আমি ছোট হলেও তোমার আগে আমার বিয়ে হয়ে যাবে। দেখো, আমার বিয়ে হয়ে গেল। দোয়া রইল, আমি যেসব সুযোগ পাইনি, সবই যেন পাও।"
ছলছল চোখে অরণি দেখছে কিছু দূরে কৌশিক দাঁড়িয়ে আছে। কত স্বপ্নই না বুনেছিল অরণি এই অন্তরঙ্গ বন্ধুর সাথে!
কৌশিক মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সে সহসা দেখতে পাচ্ছে না অরণিকে বিবাহিতা হিসেবে। সেও চেয়েছিল অরণি আজীবন অবিবাহিতা থাকুক। কখনও বেখেয়ালি মনটা হাহাকার করে উঠত তার। না, অবিবাহিতা রাখবে না। একদিন এই পাগলীকে নিজ হৃদয় গহীনেই ঠাঁই দেবে। অরণি জানেই না এই ছেলের মনের কথা। কৌশিক কোনোকিছুতেই এই বন্ধুত্ব ভাঙতে চায় না। সে কারণেই আজ অন্যের স্ত্রী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অরণি তার সামনে।
.
"এভাবে মুখ কেন নিচু করে আছো?" অরণি বলল, "একসময় তো গলা ফাটিয়ে বলতে, ধুমধাম করে আমায় বিয়ে দেবে?"
"তখন তো জানতাম না, জীবনটা খেলা নয়। বরং সে-ই খেলোয়াড়। এভাবে মোড় পাল্টে যাবে তা অজানাই ছিল। আমিও যে বিরাগী থাকতে চেয়েছিলাম! আমার সঙ্গীটাই চলে যাচ্ছে।"
"চিন্তা করো না। আমাকে কথা দাও, কখনও প্রতিষ্ঠিত হলে আমার পরিবর্তে আমার মতো অসহায় শৌখিন এক মেয়ের সব ইচ্ছে পূরণ করে দেবে। তাকে কখনও সাংসারিক কাজে বেশি ঝুঁকিয়ে দেবে না। সর্বোপরি তাকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেবে। তোমার সাথে তো ওয়ার্ল্ড ট্যুর করতে পারলাম না। এই জীবনে আর সম্ভবও নয়। সেই ওয়ার্ল্ড ট্যুর তুমি ওই মেয়ের সাথে করবে। ওকে পৃথিবীর সব জায়গার অলি-গলি ঘুরাবে। কখনও কিছুর জন্য তার ওপর জোর খাটাবে না।"
অরণিকে চলে যাবার জন্য বারবার তাদের কথায় বিরোধিতা করছে সকলে। তবু শেষবারের মতো অরণি তাকে বলল, "তুমি ওই মেয়ের ইচ্ছাকে কখনও শেষ করে দেবে না। নাহলে তার মনের অকালমৃত্যু হবে।"
কথাটা শুনে কৌশিকের বুকটা ফেটেই গেল যেন। সত্যিকার ভালোবাসলে, ভালোবাসার দুঃখে কতই না দুঃখ লাগে! অরণির কান্নার ছোঁয়া যেন কৌশিক পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে। একবার ইচ্ছে করলো প্রথমবার আর শেষবারের মতো তার হাতটা যেন ধরে একটু। তা সম্ভবই নয়। নিয়ে যাচ্ছে তার অরণিকে তার সামনে দিয়ে।
অরণির মা ভ্যাবাচ্যাকায় আছেন। অন্তরঙ্গ বন্ধু কৌশিককে বলা অরণির শেষ কথাটি যেন কাঁটার ন্যায় বিঁধেছে। কারো মনের অকালমৃত্যু ঘটেনি তো? বুকটাই ধক্ করে উঠলো অরণির মায়ের। মেয়েকে বিদায় দেবার পরও তার চোখ হতে অশ্রু পড়ল না। বড় একটা ধাক্কা সামলে নিতে পারছেন না। শৌখিন মেয়েটির সাথে তিনি অন্যায় করে ফেললেন না তো? কিন্তু সে তো হাসিখুশিতে ছিল। নাকি তা লোক দেখানো বহিরাবরণ ছিল?
কৌশিকের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙায় তাঁকে বলে দিল, "অনেক বড় অন্যায় করেছেন। অরণিকে হারিয়ে ফেলেছেন আপনি। সে কখনও প্রকৃত সুখের ছোঁয়া পাবে না। ওর শরীরকে তো দেখবেন, কিন্তু তার মনকে কখনও জীবিত করতে পারবেন না।"
বাস্তববাদী বলে কৌশিকের সাথে বন্ধুত্ব করেছিল অরণি। সেই বাস্তববাদী ছেলের চোখেও আজ পানি। তা মুছতে মুছতে কৌশিক বেরিয়ে পড়ল আর কখনও এই জায়গায় না ফেরার উদ্দেশ্যে। ফিরে করবে কী? কাঙ্ক্ষিত জন কখনই যে আসবে না।
.
অরণি পরিবারের বড় বউ। দেবরের বিয়ে আদৌ হয়নি। অরণির শ্বশুর-শাশুড়ির বয়স হয়েছে। বিয়ের পর অরণির জীবনের একটি বছর কেটে গেল এই পরিবারেরই দেখাশোনা করতে। যৌবনটা বারবার আসে না বলে স্বামী অরণিকে মা হতে জোর দিচ্ছে না। তবু তার প্রতিটা মুহূর্ত দ্রুত কেটে যায়। ঘুম হতে উঠা থেকে নিয়ে শুরু করে সাংসারিক কাজকাম, শ্বশুর-শাশুড়ির দেখাশোনা, ইবাদত বন্দেগী ইত্যাদি শেষে নিজের এটুকু সময় মেলে না তার। স্বামীও খুব আয়েসি এক লোক। অতিরিক্ত খাটতে হয় অরণির কাছে। এসবের নিচেই চাপা পড়েছে অরণির ইচ্ছে। জায়গা-সম্পত্তি স্বামীর দেয়া সবই আছে। তবে কী যেন নেই!
আবার এই অবেলায় এসেছে অরণির মা তাকে দেখতে। বাবার বাড়িতে তার যাওয়াই হয়ে উঠে না। সে কাজের ফাঁকে সময় করে রুমে এলো মায়ের সাথে দেখা করতে। মাস চারেক পর তাদের সাক্ষাৎ।
.
"কেমন আছেন মা?"
"আমি এসেছি ঘণ্টাখানেক পার হয়ে গেল।" তিনি যেন হতবাক, "তুই..."
"একটু কাপড় ধুচ্ছিলাম।"
"তোর এই কী অবস্থা! বিয়ের পর মেয়েরা স্বাস্থ্যবান, সুন্দরী হয়ে যায়..."
"আমি তো আছিই আগে থেকে শ্যাম।"
"না, এত বেশি তো ছিলি না। হাতগুলো দেখ, কেমন মেটে হয়ে গেছে, চোখগুলোও তো বুজে গেছে। কী হয়েছে? ওরা কি সুখে রাখে না?"
"রাখে তো। সময়ের কারণেই আমার পরিবর্তন হলো।"
"অবনতি তো হওয়ার জন্য দিইনি এই ছেলের কাছে তোকে বিয়ে!"
"অবনতি-সবনতি ও কিছুই না। উপর হতে নিচ পর্যন্ত আমিই আমার ভাগ্য। কেবল চোরাবালিতে পা রেখেছি।" অরণি মুচকি হেসে বলল, "আমি চুলায় ভাত দিয়ে এসেছি মা। ওদিকে একটু যাই। আপনি বসুন।"
অরণি ঘাম মুছতে মুছতে বেরিয়ে পড়ল। নির্বাক হয়ে মা চেয়ে রইলেন তাঁর নতুন অচেনা মেয়ে অরণির দিকে।
(সমাপ্ত...)


লেখা: ফারিয়া কাউছার

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form