সপ্তর্ষিমণ্ডল (Ursa Major)





রাতের আকাশে তাকালেই আমরা দেখতে পাই অগণিত তারার মেলা। আর সহজ ভাষায় এই আকাশের একেকটি দিকের একেকটি অঞ্চল বা কিছু তারা নিয়ে কল্পনা করা আকৃতিকে বলা হয় Constellation বা নক্ষত্রপুঞ্জ বা তারামণ্ডল। যেমনঃ সিংহ, কাঁকড়াবিছা, ষাঁড়, ভালুক, ধনুক, মাছ ইত্যাদি আকৃতির।

আমাদের কাছে সবচেয়ে পরিচিত তারা হলো ধ্রুবতারা যেটা কিনা সবসময় একই জায়গায় অর্থাৎ উত্তর আকাশে থাকে। মানে তারাটিকে দিনে কিংবা রাতে যখনই পর্যবেক্ষণ করা হোক না কেন, এটি উত্তর আকাশেই অবস্থান করে। আর এই উত্তর আকাশে তাকালেই একটি প্রশ্নবোধক (?) চিহ্নের আকৃতিতে সাতটি তারাকে জ্বলজ্বল করতে দেখা যায়। গ্রিকে এর নাম **Ursa Major**, যার শাব্দিক অর্থ হলো **‘Great Bear’** বা বড় ভালুক। আর এই সাতটি তারা এই ভালুকেরই লেজের অংশ।

দ্বিতীয় শতকের জ্যোতির্বিদ টলেমি কর্তৃক প্রণীত ৪৮টি তারামণ্ডলের একটি এবং ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়নের প্রণয়ন করা ৮৮টি তারামণ্ডলের উল্লেখযোগ্য একটি হলো এই Ursa Major তারামণ্ডল। ১৩৫টি তারা নিয়ে গঠিত এই তারামণ্ডলের বিষুবাংশ ১০.৬৭ ঘন্টা, বিষুবলম্ব +৫৫.৩৩° এবং আয়তন ১২৮০ বর্গডিগ্রী। এটি সবচেয়ে বেশি পরিচিত এবং তৃতীয় বৃহত্তম তারামণ্ডল।

**ভাবনাতে আসতেই পারে যে, ১৩৫টি তারা থাকা সত্ত্বেও এর নাম সপ্তর্ষিমণ্ডল কেন হলো? কেন ভালুকের লেজের অংশের সাতটি তারাকেই প্রাধান্য দেয়া হলো?**

গ্রিকরা যখন এই বিশাল ভালুকের মতো আকৃতির তারামণ্ডলকে শনাক্ত করেন, তখন অনেকগুলো তারাকে নিয়েই Ursa Major নাম দেন তারামণ্ডলটির। উপমহাদেশীয় জ্যোতির্বিদগণ এই তারামণ্ডলীতে প্রশ্নবোধক চিহ্নের আকৃতিতে অবস্থান করা উজ্জ্বল সাতটি তারাই পর্যবেক্ষণ করেন এবং হিন্দু পুরাণে উল্লিখিত সাতজন বিশিষ্ট মহর্ষির নামে এই নক্ষত্রমণ্ডল বা তারামণ্ডলের নামকরণ করেন। সাতজন ঋষি অর্থাৎ সপ্ত ঋষির নামে নামকরণ করায় এই তারামণ্ডলটি সপ্তর্ষিমণ্ডল নামে পরিচিতি লাভ করে।

প্রশ্নবোধক (?) চিহ্নের শুরু থেকে ( দ্বিতীয় ছবিতে ডান দিক থেকে) প্রথম তারাটির নাম ক্রতু, এর পরেরটি পুলহ। এরপর পুলস্ত্য, অত্রি, অঙ্গিরা, বশিষ্ঠ, মরীচি। বশিষ্ঠের পাশে যে ছোট তারাটি দেখা যাচ্ছে, তার নাম অরুন্ধতী। সনাতন ধর্মাবলম্বী নববিবাহিত জুটিকে আগে তারা দুটো দেখানো হতো, তাঁদের একসঙ্গে জীবন কাটানোর কামনা করে। কিন্তু অরুন্ধতী বেশ অনুজ্জ্বল। পুলহ থেকে ক্রতুর দিকে যদি একটা সরলরেখা টানা হয়, সেটি সোজা সামনে বাড়লেই পাওয়া যাবে একটি নিঃসঙ্গ তারা। সেটিই হলো উত্তর আকাশের সেই ধ্রুবতারা। ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যায় এই পুরো ভালুককে বলা হয়েছে একটা ময়ূর। এর নাম সংস্কৃত ভাষায় চিত্রশিখণ্ডী।

এরপর আসি পাশ্চাত্যের মানুষের কাছে। তারাও এই উজ্জ্বল সাতটি তারকাকেই পর্যবেক্ষণ করে, তবে এটিকে তারামণ্ডল হিসেবে গণ্য না করে তারামণ্ডলের মাঝে অবস্থিত একটি ক্ষুদ্র তারাগুচ্ছ বা Asterism বলে গণ্য করে এবং নাম দেয় **The Big Dipper**, যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘বড় পেয়ালা’ যা The Plough (লাঙ্গল) নামেও পরিচিত। এই Big Dipper এর তারা সাতটি হলো -

**α Ursae Majoris (ক্রতু):** এটি **Dubhe** নামে পরিচিত যার শাব্দিক অর্থ ‘ভালুক’। এটি Ursa Major-এর দ্বিতীয় উজ্জ্বল তারা।

**β Ursae Majoris (পুলহ):** এটি **Meerak** নামে পরিচিত যার শাব্দিক অর্থ ‘ভালুকের কটিদেশ’।

**γ Ursae Majoris (পুলস্ত্য):** এটি **Phecda** নামে পরিচিত যার শাব্দিক অর্থ ‘ভালুকের উরুদেশ’।

**δ Ursae Majoris (অত্রি):** এটি **Megrez** নামে পরিচিত যার শাব্দিক অর্থ ‘ ভালুকের পুচ্ছমূল’।

**ε Ursae Majoris (অঙ্গিরা):** এটি **Alioth** নামে পরিচিত। Ursa Major এর সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং আকাশের ৩৩তম উজ্জ্বল তারা হলো Alioth.

**ζ Ursae Majoris (বশিষ্ঠ):** এটি **Mizar** নামে পরিচিত। এর শাব্দিক অর্থ হলো ‘কটিবন্ধ’। এটি Ursa Major এর চতুর্থ উজ্জ্বল তারা। Alcor (অরুন্ধতী) নামের আরেকটি অনুজ্জ্বল তারার সাথে সন্নিবেশিত হয়ে বিখ্যাত Mizar-Alcor Double Star গঠন করে এবং এটিই প্রথম Double Star যার ছবি তোলা হয়। এই দুই তারাকে কখনো কখনো ‘ঘোড়া এবং ঘোড়সওয়ার’ বলেও অভিহিত করা হয়।

**η Ursae Majoris (মরীচি):** এটি Alkaid নামে পরিচিত যার শাব্দিক অর্থ হলো ‘লেজের শেষভাগ’, আবার এর আরেকটি অর্থ হলো ‘অগ্রণী’। এটি Ursa Major এর তৃতীয় উজ্জ্বল তারা।

সপ্তর্ষিমণ্ডল বা Ursa Major Constellation-এ ৭টি মেসিয়ার বস্তু রয়েছে। যথা: Messier 40, Messier 81 (Bode’s Galaxy), Messier 82 (Cigar Galaxy), Messier 97 (Owl Nebula), Messier 101 (Pinwheel Galaxy), Messier 108, এবং Messier 109.


**Mythologies:**

Ursa Major অনেক সংস্কৃতিতে একটি সুপরিচিত, উল্লেখযোগ্য নক্ষত্রমণ্ডল। এটি আকাশের প্রাচীনতম তারামণ্ডলগুলির মধ্যে একটি, যার ইতিহাস প্রাচীন কালের। হোমার এবং বাইবেলে এই তারামণ্ডলের উল্লেখ রয়েছে। বিশ্বজুড়ে প্রচুর গল্প এবং কিংবদন্তি Ursa Major-কে একটি ভালুকের সাথে সম্পর্কিত করে।

প্রাচীন গ্রীকরা এই নক্ষত্রমণ্ডলটিকে ক্যালিস্টো নামের একজন বনদেবীর পৌরাণিক কাহিনীর সাথে যুক্ত করেছিলো, যিনি দেবী আর্টেমিসের কাছে সারাজীবন সতী থাকার পণ করেছিলেন। জিউস একদিন তাকে দেখে প্রেমে পড়ে যান। তাদের মধ্যে প্রণয় হয় এবং ফলস্বরুপ ক্যালিস্টো গর্ভধারন করেন। পণ ভাঙার কথা জানতে পেরে দেবী আর্টেমিস ক্যালিস্টোকে নির্বাসিত করেন। জিউস ও ক্যালিস্টোর এক পুত্রসন্তানের জন্ম হয়, যার নাম আর্কাস।

জিউসের পত্নী হেরা, তার স্বামীর এহেন বিশ্বাসঘাতকতায় এবং ক্যালিস্টোর অতুলনীয় রূপে ঈর্ষান্বিত হয়ে ক্যালিস্টোকে অভিশাপ দিয়ে ভালুকে পরিণত করেন।

এরপর ১৫ বছর ধরে ক্যালিস্টো বনে ঘুরে বেড়ায় এবং শিকারীদের হাত থেকে বাঁচতে লুকিয়ে থাকে। একদিন তার পুত্র আর্কাস ওই বনেই হেঁটে বেড়াচ্ছিলো এবং তারা হঠাৎ দুজন মুখোমুখি হলো। সামনে ভালুক দেখে আর্কাস ভড়কে গেলো এবং তার বর্শা নিক্ষেপ করলো।

অলিম্পাস থেকে এই দৃশ্য দেখে, জিউস একটি ট্রাজেডি হওয়া থেকে থামাতে ঘূর্ণিঝড় প্রেরণ করেন যা ক্যালিস্টো এবং আর্কাসকে স্বর্গে নিয়ে যায় এবং সে আর্কাসকে Ursa Minor এবং ক্যালিস্টোকে Ursa Major এ পরিণত করেন। এতে হেরা আরো ক্ষুব্ধ হন এবং তার পালক পিতামাতা ওশেনাস এবং টিথাইসকে বলেন কখনো ভালুকটাকে উত্তরের জলে স্নান না করতে দিতে।

অন্য একটি ভার্সনে দেখা যায়, ক্যালিস্টোকে ভালুকে রূপান্তর হেরা নয় বরং দেবী আর্টেমিস করেছিলেন পণ ভাঙার জন্য। অনেক বছর পর ক্যালিস্টো এবং তার ছেলে আর্কাসকে জঙ্গলে বন্দী করা হয় এবং রাজা লাইকনকে তাদের উপহার হিসেবে পাঠানো হয়। মা এবং ছেলে দুজনে জিউসের মন্দিরে শরণ নেয় এবং তাদের রক্ষা করতে জিউস তাদের দুজনকে আকাশে ঠাঁই দেন।

Ursa Major এর সাথে সম্পর্কিত আরেকটা ভিন্ন গ্রিক উপকথা রয়েছে যেটা আদ্রাস্তেয়ার। জিউসের পিতা ক্রোনাস দৈববাণীর মাধ্যমে জানতে পারেন যে তারই এক পুত্র তাকে সিংহাসনচ্যুত করবে। এই দৈববাণীতে আতঙ্কিত হয়ে ক্রোনাস তার সন্তানদের জন্মানোর পরপরই মেরে ফেলতেন। অবশেষে জিউসের জন্ম হয়। জিউসের মা রিহা, তার সন্তানকে দুই বনদেবী আদ্রাদেস্তা এবং ইডার হাতে তুলে দেন এবং ক্রিট দ্বীপে তারা এক বছর জিউসকে লালন-পালন করেন। এই উপকথার ভার্সনটিতে, ইডা Ursa Minor এর সাথে সম্পর্কিত। অ্যামালথিয়া, মানে যে মেষ তার দেখাশোনায় ব্যবহার করা হয়েছিলো, তাকে Auriga বা ব্রহ্মা তারামণ্ডলের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা Capella হিসেবে স্থান দেয়া হয়। দৈববাণী অবশেষে সত্য হয়; জিউস তার পিতা ক্রোনাসকে সিংহাসনচ্যুত করেন এবং তার ভাই হেডিস ও পোসাইডন এবং বোন ডেমিটার, হেরা ও হেস্টিয়াকে মুক্ত করেন।

রোমান মিথোলজিতে উল্লিখিত গল্পের সাথে গ্রিক মিথোলজিতে উল্লিখিত প্রথম গল্পটির কিছুটা মিল আছে। এখানে দেবতা জুপিটার এবং ক্যালিস্টোর আর্কাস নামে সন্তান জন্ম নেয় এবং দেবী জুনো, জুপিটারের পত্নী ক্যালিস্টোকে কুৎসিত ভালুকে রূপান্তর করেন। একদিন ক্যালিস্টো তার পুত্র আর্কাসকে বনে দেখতে পান এবং সে যে ভালুক হয়ে আছে এই কথা ভুলে গিয়ে আর্কাসের দিকে দৌড়ে যান। আর্কাস ভড়কে গিয়ে তীর নিক্ষেপ করে এবং জুপিটার এখানে বাধা দেন। জুনো যাতে আর কোনো ক্ষতি না করতে পারে সেজন্য আর্কাসকে ভালুকে পরিনত করেন এবং ক্যালিস্টো ও আর্কাসকে তাদের লেজ ধরে স্বর্গে নিক্ষেপ করেন যাতে তারা সুখে শান্তিতে নক্ষত্রমন্ডলীর মাঝে বাস করতে পারে। বেশি শক্তি নিয়ে নিক্ষেপ করা হয়েছিলো বলে ভালুকগুলোর মোটা ছোট লেজ দীর্ঘায়িত হয়ে যায়। জুনো আরো ক্ষিপ্ত হয়ে যান এবং সমুদ্র দেবতার কাছে মিনতি করেন যাতে ধ্রুবতারা প্রদক্ষিণের অনন্ত যাত্রায় তাদের জলের কিংবা স্রোতের সংস্পর্শে না যেতে দেয়া হয়।

তো এবার আসি সপ্তর্ষিমণ্ডল কীভাবে দেখবো। উত্তর আকাশে সারাবছরই সপ্তর্ষিমণ্ডলকে দেখা যায়, তবে পরিষ্কারভাবে দেখা যায় এপ্রিল থেকে জুন মাসে, রাত ১১ টার দিকে। উত্তর আকাশের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকলে হঠাৎ করে প্রশ্নবোধক আকৃতির এই সপ্তর্ষিমণ্ডল ধরা দিবেই। এছাড়াও একটা অ্যান্ড্রয়েড কিংবা আইওএস ব্যবহার করে যেকোনো তারার নাম দেখা যায়। সবচেয়ে ইউজার ফ্রেন্ডলি অ্যাপ বলা যায় **Sky Map**-কে। Google Sky Map লিখে প্লে স্টোরে খুঁজলেই পাওয়া যাবে অ্যাপটি। এটিকে লোকেশন পারমিশন দিয়ে মুঠোফোন আকাশের যেদিকটায় তাক করা হবে, সেদিকের তারাগুলোর ম্যাপ দেখাবে এটি। এভাবে উত্তরে একটু খুঁজলেই পেয়ে যাবো আমাদের কাঙ্ক্ষিত সপ্তর্ষিমন্ডল বা Ursa Major।


**তথ্যসূত্র:**

**১. [https://en.wikipedia.org/wiki/Ursa_Major](https://en.wikipedia.org/wiki/Ursa_Major)**

**২. [https://astrobackyard.com/ursa-major-constellation/](https://astrobackyard.com/ursa-major-constellation/)**

**৩. [https://www.constellation-guide.com/constellation-list/ursa-major-constellation/](https://www.constellation-guide.com/constellation-list/ursa-major-constellation/)**

**৪. [https://www.aavso.org/myths-uma](https://www.aavso.org/myths-uma)**

**৫. [https://arabiannightsrum.com/stars/circumpolar-constellations/ursa-major/](https://arabiannightsrum.com/stars/circumpolar-constellations/ursa-major/)**

**SKY MAP PLAYSTORE LINK: [https://play.google.com/store/apps/details?id=com.google.android.stardroid](https://play.google.com/store/apps/details?id=com.google.android.stardroid)**


**লেখকঃ শান্ত কুমার দাস।**

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form