১.
আমি একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করলাম আর আপনি আমার ব্যাংকে 1 টাকা জমা রাখলেন। নতুন ব্যাংক হিসেবে উদারমনা (!) আমি আপনাকে 100% হারে মুনাফা দেওয়ার ঘোষণা দিলাম। এবার আমার ব্যাংক থেকে আপনি কত টাকার মালিক হতে পারেন সেটা একটু হিসেব করে দেখা যাক।
মুনাফা, আসলের অংক তো আমরা সেই অষ্টম শ্রেণিতেই করেছি। তাই চক্রবৃদ্ধি মূলধনের সূত্রটাও জানা থাকার কথা।
চক্রবৃদ্ধি মূলধন = P(1+r)^n
[এখানে p=আসল, r=মুনাফার হার, n=সময়]
আমাদের হিসাবে p=1 টাকা, r=100%=1 ।
তাহলে 1 বছর পর আপনার অ্যাকাউন্টে মোট টাকার পরিমাণ হবে = 1*(1+1)^1=2 টাকা।
আচ্ছা শুধু বছরান্তে এক বার মুনাফা হিসাব করব কেন? 6 মাস অন্তর করে বছরে 2 বার মুনাফা বের করে দেখা যাক। 1 বছরে 2 বার মুনাফা হিসেব করলে মুনাফার হার আর 100% থাকবে না, অর্ধেক হয়ে যাবে। অর্থাৎ তখন মুনাফার হার হবে 100%/2=½ । আর 1 বছরে 2 বার মুনাফা হিসেব হওয়ায় n=2 হবে।
সেক্ষেত্রে চক্রবৃদ্ধি মূলধন = (1 + 1/2)^2=2.25 টাকা।
6 মাস অন্তর হিসেব না করে 3 মাস পর পর করে বছরে 4 বার হিসাব করলে বছর শেষে চক্রবৃদ্ধি মূলধন হবে=(1 + 1/4)^4 = 2.44140 টাকা।
প্রতিমাসে মুনাফা প্রদান করলে বছর শেষে চক্রবৃদ্ধি মূলধন হবে : (1 + 1/12)^12=2.61303 টাকা।
আর প্রতিদিন মুনাফা হিসেব করা হলে বছরান্তে চক্রবৃদ্ধি মুনাফার পরিমাণ
= (1 + 1/365)^365=2.71457 টাকা।
এভাবে বছরে n বার মুনাফা প্রদান করলে এক বছর পর আপনার একাউন্টে টাকার পরিমাণ দাঁড়াবে
(1 + 1/n)^n টাকা।
এখানে n এর মান যত বাড়তে থাকবে ততই
(1 + 1/n)^n এর মান ততই একটা ধ্রুব সংখ্যার নিকটবর্তী হবে। আর n➩∞ হলে আমরা সেই সংখ্যাটা পেয়ে যাব যার মান 2.71828...। গণিতের যেসব জাদুকরী ধ্রুবক তাদের অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্য দ্বারা যুগ যুগ ধরে গণিতপ্রেমীদের মুগ্ধ করে আসছে তাদের মধ্যে একটা হল এই সংখ্যাটা। এটি অয়লার নাম্বার নামে সমধিক পরিচিত। দোর্দণ্ডপ্রতাপ গণিতবিদ লিওনার্দ অয়লার সর্বপ্রথম এই ধ্রুব সংখ্যাটিকে e দিয়ে প্রকাশ করেন।
আর উপরের যে থট এক্সপেরিমেন্টটার মাধ্যমে e এর মান বের করার একটা ফর্মূলা পেয়েছি সেটা বেরিয়েছিল সুইজারল্যান্ডের গণিতবিদ জ্যাকব বার্নোলির মাথা থেকে। তবে এই ধ্রুবকটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেছিলেন অয়লার কিংবা বার্নোলি না,স্কটল্যান্ডের গণিতবিদ জন নেপিয়ার। তিনি ১৬১৮ সালে e কে ব্যবহার করেন ন্যাচারাল লগারিদমের ভিত্তি হিসেবে, যদিও তখন এই ধ্রুবকের মান জানা ছিল না।
২.
গণিতের অত্যন্ত কার্যকরী একটা হাতিয়ার হচ্ছে ধারা বা সিরিজ। e কে যদি একটা সিরিজের যোগফল আকারে প্রকাশ করা যায় তাহলে বেশ ভালো হয়, তাই না? চেষ্টা করা যাক।
e এর উপর x পাওয়ার চড়িয়ে একটা ফাংশন পাওয়া যায়- f(x)=e^x। এখন আমাদের কাজ হচ্ছে f(x)=e^x এর সমান একটা বহুপদী P(x) খুঁজে বের করা। তার জন্য আগে f(x)=e^x ফাংশনটির দুইটা বৈশিষ্ট্য বলে নিই:
(১) ফাংশনটার গ্রাফ স্পষ্টতই (0,1) বিন্দুগামী।
(২) e^x কে যতবারই ডিফারেন্সিয়েট করা হোক না কেন, ফলাফল সবসময় e^x -ই হবে। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে- "শকুনের অভিশাপে গরু মরে না।" এখানে বলা যেতে পারে ডিফারেন্সিয়েশন হল শকুন আর e^x হল গরু! মজা করলাম। যাইহোক, এটা এই ফাংশনের স্বতন্ত্র একটা বৈশিষ্ট্য আছে যেটা অন্য কোনো ফাংশনের নেই।
এখন প্রশ্ন হল P(x) বহুপদীটার কত মাত্রার হবে? প্রথমে এক মাত্রার বহুপদী নিয়ে চেষ্টা করা যাক। মনে করি,
P(x) = a₀+a₁x হল সেই এক মাত্রার বহুপদীটি। তাহলে, f(x)=e^x=P(x) = a₀+a₁x
বা, e^x = a₀+a₁x-----(1)
এখানে a₀ ও a₁ হল ধ্রুবক, এই দুটোর মান বের করতে হবে।
(1)এর ডানপাশে দুইটা পদ রয়েছে। দুইটা পদ নিয়ে একসাথে কাজ করলে সুবিধা হবে না, তাই একটা গায়েব করে দিব। লক্ষ্য করুন, x=0 বসালে a₁x পদটা 0 হয়ে যায়। তাছাড়া e^0 এর মান যে 1 তা-ও তো সর্বজনবিদিত। তাই (1) নং এ x=0 বসিয়ে পাই,
e^0 = a₀+a₁*0
=> a₀=1
এরপর a₁ বের করার জন্য (1) নং এর উভয়পাশে ডিফারেন্সিয়েট করে পাই,
d(e^x)/dx = d(a₀+a₁x)/dx
=>e^x = a₁
এখানে আবার x=0 বসিয়ে পাই
a₁=e^0=1
a₀ আর a₁ এর মান পেয়ে গেছি। তাহলে
P(x) = 1 + x = 1+(x/1!)
কিন্তু f(x)=e^x এবং P(x)=1+x এর মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক রয়েছে, গ্রাফ দেখেই তা বুঝা যায় (১ম চিত্র)। মিল হচ্ছে শুধু একটাই, উভয়ের গ্রাফ (0.1) বিন্দুগামী।
এদের মধ্যে আরেকটু মিল আনার জন্য P(x) -এ আরেকটা পদ যোগ করে এটিকে দুই মাত্রার বহুপদী বানিয়ে ফেলি। তাহলে
f(x)=e^x=P(x)=a₀+a₁x+a₂x²
=>e^x=a₀+a₁x+a₂x²
a₀ আর a₁ এর মান এর মান তো আগেই বের করেছি।
a₂ এর মান বের করার জন্য P(x) এর দ্বিতীয় ডেরিভেটিভ বের করব। কারণ P(x) কে দুইবার ডিফারেন্সিয়েট করলে প্রথম পদ দুটো ভ্যানিশ হয়ে যাবে, কেবল a₂ সম্বলিত পদটা অবশিষ্ট থাকবে। তাহলে,
d²(e^x)/dx = d²(a₀+a₁x+a₂x²)/dx
=> e^x = 2a₂
x=0 বসিয়ে পাই,
a₂=e^0/2
=>a₂=½
তাহলে P(x) =1+ x +x²/2= 1+(x/1!)+(x²/2!)
এখন f(x)=e^x এবং P(x) = 1+ x +x²/2 উভয়ের গ্রাফে আরো একটা মিল পাওয়া গেল, (0,1) বিন্দুতে দুটি গ্রাফেরই ঢাল বা slope একই। (২য় চিত্র)
এখন P(x) বহুপদীতে আরো একটি পদ যুক্ত করি এবং বহুপদীটিকে তিন মাত্রার বানিয়ে ফেলে দেখা যাক কী
হয়।
f(x)=e^x=P(x)=a₀+a₁x+a₂x²+a₃x³
=> e^x=a₀+a₁x+a₂x²+a₃x³
a₀, a₁ এবং a₂ এর মান তো জানা আছে। এখন P(x) এর তৃতীয় ডেরিভেটিভ বের করে a₃ এর মান বের করা যায় 1/6।
তখন
P(x)=1+ x+ x²/2+x³/6=1+(x/1!)+(x²/2!)+x³/3!
এখন f(x) এবং P(x) এর গ্রাফ লক্ষ্য করলে দেখা যায় এদের মাঝে মিল পূর্বের চেয়ে বেড়েছে। (৩য় চিত্র)
P(x) এর মাত্রা আরো এক বৃদ্ধি করা হলে বহুপদীটি হয় P(x)=a₀+a₁x+a₂x²+a₃x³+a₄x⁴
উপরের পদ্ধতিতে বের করা যায়, a₄=1/24
অতএব, P(x)=1+ x+ x²/2+x³/6+x⁴/24
=1+(x/1!)+(x²/2!)+(x³/3!)+(x⁴/4!)
এবার P(x) এর গ্রাফ f(x) এর গ্রাফের আরো নিকটবর্তী হয়েছে। (চিত্র ৪)
লক্ষ্য করুন, P(x) এর পদসংখ্যা যত বাড়ছে ততই বহুপদীটি f(x)=e^x এর নিকটবর্তী হচ্ছে। তাহলে P(x) এর পদসংখ্যা যদি অসীম হয় তাহলে নিশ্চয় P(x) আর f(x)=e^x পুরোপুরি মিলে যাবে!
তাহলে
e^x=1+(x/1!)+(x²/2!)+(x³/3!)+(x⁴/4!)+(x⁵/5!)+.....
এখানে x=1 বসালে পাই,
e=1+(1/1!)+(1/2!)+(1/3!)+(1/4!)+(1/5!)+.....
আমরা যেটা খুঁজছিলাম সেটা পেয়ে গেছি! e কে একটি অসীম ধারার যোগফল আকারে প্রকাশ করতে পেরেছি।
৩.
মূলদ সংখ্যা আর অমূলদ সংখ্যা তো সবার কাছেই অতি পরিচিত। যেসব সংখ্যাকে দুইটা পরস্পর সহমৌলিক পূর্ণসংখ্যার অনুপাত আকারে প্রকাশ যায় তারা মূলদ সংখ্যা। আর যাদেরকে এভাবে দুইটি সহমৌলিক পূর্ণসংখ্যার অনুপাত আকারে লেখা যায় না তারা অমূলদ সংখ্যা। e এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি একটি অমূলদ সংখ্যা। এই ব্যাপারটা প্রমাণ করা যাক।
প্রমাণটা কন্ট্রাডিকশন দিয়ে করব। এজন্য প্রথমেই ধরে নিই যে, e একটি মূলদ সংখ্যা। আর e মূলদ সংখ্যা হলে এটাকে অবশ্যই দুইটা পরস্পর সহমৌলিক পূর্ণসংখ্যা p আর q এর অনুপাত আকারে প্রকাশ করা যায়। (এটি আমাদের ধরে নেওয়া স্টেটমেন্ট)
অর্থাৎ, e=p/q
=> p=qe
একটু আগেই প্রমাণ করলাম যে,
e=1+(1/1!)+(1/2!)+(1/3!)+.....
এটার উভয় পাশে q! গুণ করে পাই,
=>q!e=q!+(q!/1!)+(q!/2!)+...+(q!/q!)+q!/(q+1)!+...
=>(q-1)!*qe=q!+(q!/1!)+(q!/2!)+...+(q!/q!)+q!/(q+1)!+...
এখন বামপক্ষে qe=p বসালে হয়:
(q-1)!*p=q!+(q!/1!)+(q!/2!)+...+(q!/q!)+q!/(q+1)!+...
এখানে বামপক্ষের রাশিটি একটি পূর্ণসংখ্যা, কারণ p,q উভয়েই পূর্ণসংখ্যা। তাই ডানপক্ষও অবশ্যই একটি পূর্ণসংখ্যা হবে। খেয়াল করুন, ডানপক্ষে
q!+(q!/1!)+(q!/2!)+...+(q!/q!) এই অংশটা স্পষ্টতই একটা পূর্ণসংখ্যা। তাহলে এরপরের অংশটুকুও একটা পূর্ণসংখ্যা হতে হবে। কারণ এরপরের অংশটা পূর্ণসংখ্যা না হলে ডানপক্ষটাও আর পূর্ণসংখ্যা থাকবে
না।
এরপরের অংশটুকুকে X ধরে নিই।
তাহলে,
X= q!/(q+1)! + q!/(q+2)!+ q!/(q+3)!+.....
এখানে ডানপক্ষে হর আর লবে কিছু কাটাকুটি করে পাই:
=> X= 1/(q+1) +1/(q+1)(q+2)+ 1/(q+1)(q+2)(q+3)+.....
এবার আমরা একটা অসমতা আনার চেষ্টা করব।
যেহেতু (q+1)(q+2)>(q+1)(q+1)
তাই, 1/(q+1)(q+2) < 1/(q+1)(q+1)
=> 1/(q+1)(q+2) < 1/(q+1)²
একইভাবে, 1/(q+1)(q+2)(q+3)< 1/(q+1)³
এখন মনে করি, Y=1/(q+1)+1/(q+1)²+1/(q+1)³+...
এটি কিন্তু একটি গুণোত্তর ধারা। তাই গুণোত্তর ধারার সমষ্টির সূত্র ব্যবহার করে পাই:
Y=1/q
যেহেতু q একটি পূর্ণসংখ্যা তাই Y=1/q কোনো পূর্ণসংখ্যা হতে পারে না এবং 1/q,1 এর চেয়ে ছোট।
তাই Y=1/q <1
উপরের অসমতাগুলো ব্যবহার করে আমরা X এর জন্য একটা অসমতা তৈরী করতে পারি। যেহেতু X এর প্রত্যেকটা পদ Y এর প্রত্যেকটা corresponding পদ থেকে ছোট, তাই বলতে পারি যে,
X<Y<1
=>1/(q+1)+1/(q+1)(q+2)+1/(q+1)(q+2)(q+3)+.....
< 1/(q+1)+1/(q+1)²+1/(q+1)³+..... <1
=> X < 1/q<1-----(i)
আবার, X= 1/(q+1) +1/(q+1)(q+2)+ 1/(q+1)(q+2)(q+3)+..... এর সবগুলো পদ ধনাত্মক হওয়ায় X, 0 থেকে বড়।
অর্থাৎ 0<X -------(ii)
এখন (i) আর (ii) এর সমন্বয়ে বলতে পারি,
0<X<1/q<1
এখান থেকে দেখা যাচ্ছে, X হল 0 আর 1 এর মধ্যবর্তী কোনো সংখ্যা। কিন্তু 0 আর 1 মাঝে কোনো পূর্ণসংখ্যা নেই। তাই X কখনোই কোনো পূর্ণসংখ্যা হতে পারে না।
কিন্তু একটু আগেই তো বলেছিলাম যে,
X= q!/(q+1)! + q!/(q+2)!+ q!/(q+3)!+.....
একটি পূর্ণসংখ্যা হতে হবে। এখন দেখা যাচ্ছে সেটি সত্যি না। তার মানে আমরা শুরুতে যে স্টেটমেন্টটা ধরে নিয়েছিলাম সেটি ভুল। অর্থাৎ, e≠p/q।
তাই e একটি অমূলদ সংখ্যা। কন্ট্রাডিকশন!
Writer: Jobayet Hasan