নিঃসঙ্গ নিউটন ও তার অদ্ভুত দর্শন



১৬৬৫ সাল, পুরো বিশ্বটা মহামারীতে আক্রান্ত। এই ভয়াবহ মহামারীর কারণ হলো ছোট ছোট ইদুর, যার কামড়ে হয় প্লেগ!

কত কত মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। এই সময় নিউটন নামে এক তরুণ ছাত্র ট্রিনিটি কলেজ থেকে ফিরে আসে তার গ্রামে। কিছুদিন আগেই এই ছেলেটা দ্বিপদী উপপাদ্যকে নতুন রূপ দিয়েছে। নিউটনের আগে এই উপপাদ্য নিয়ে অনেকেই কাজ করেছে। নিউটন সেই উপপাদ্যকে পরিপূর্ণতা দিয়েছে। দ্বিপদী বিস্তৃতী নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ব্লেস প্যাসকেল দ্বিপদী বিস্তৃতীর সহগগুলোকে একটা ত্রিভুজে রূপ দেন*। কিন্তু এইভাবে কাজ করাটা অনেক সময় ও কষ্টসাধ্য ব্যাপার। নিউটন তাই তার উপপাদ্যে দ্বিপদী বিস্তৃতীর সহগগুলোকে সমাবেশের মাধ্যমে প্রকাশ করলেন। আর দ্বিপদী বিস্তৃতীকে পূর্ণতা দিলেন।

গণিতবিদরা দ্বিপদী বিস্তৃতীর কয়েকটা বৈশিষ্ট্য আগে থেকেই জানতেন। এর মধ্যে একটা হলো যদি পদ দুইটাকে a ও b ধরি। তাহলে a এর ঘাত বাড়তে থাকলে b এর ঘাত কমে আবার a এর ঘাত কমলে b এর ঘাত বাড়ে। এটা আসলে বিস্তৃতী থেকেই বোঝা যায়ঃ
(a+b)^0= 1
(a+b)^1= a+b
(a+b)^2= a^2 + 2ab + b^2
(a+b)^3= a^3 + 3a^2b+3ab^2+b^3
(a+b)^4= a^4+ 4a^3b+ 6a^2b^2+
4ab^3+ a^4
এখান থেকে দেখা যায়, a এর ঘাত বাড়লে b এর ঘাত কমে। আবার b এর ঘাত বাড়লে a এর ঘাত কমে। এখান থেকে আরো কিছু বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। যেমনঃ-

রাশিটার ঘাত যখন ৩ তখন বিস্তৃতীতে রাশির পদসংখ্যা ৪। যখন ঘাত ৪ বিস্তৃতীতে পদসংখ্যা ৫। মানে ঘাত যত পদসংখ্যা তার চেয়ে ১ বেশি। তাহলে এটাকে বীজগাণিতিকভাবে লেখা যায়, ঘাত n হলে পদসংখ্যা n+1 টি হবে।
আবার বীজগাণিতিক রূপ থেকে আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করা যায় যে, ঘাতের সহগগুলো যেই প্যাটার্নে বাড়তে থাকে নির্দিষ্ট একটা সংখ্যায় গিয়ে ঠিক সেইভাবে কমতে থাকে।

তাহলে যদি আমরা কোন দ্বিপদী রাশি বিস্তৃত করতে যাই তাহলে আমাদের শুধু সহগ নির্ণয় করতে হবে। আর রাশি দুটো কিভাবে বসবে সেটা তো বৈশিষ্ট্য থেকেই দেখলাম। a এর ঘাত বাড়তে থাকলে b এর ঘাত কমে আবার a এর ঘাত কমলে b এর ঘাত বাড়ে।
কিন্তু একটা প্রশ্ন আছে, উপরে যে সূত্রগুলো দেখলাম এগুলো কিভাবে এলো? এটা খুবই সহজ। (a+b)^2 মানে ২ বার a+b গুণ করলেই সূত্র পেয়ে যাব। ৩ বার গুণ করলে ঘনের সূত্র, চারবার গুণ করলে ঘাতের সূত্র পেয়ে যাব। এখন কি বোঝা যাচ্ছে কেন দ্বিপদী বিস্তৃতীর জন্য একটা উপপাদ্য দরকার? কারণ যদি ঘাত হয় ১০ তাহলে ১০ বার গুণ করলে আমরা সূত্র পাব। কিংবা ৯ এর ঘাতের সূত্র বের করে সেটার সাথে a+b গুণ দিলেই হবে। কি কষ্টসাধ্য ব্যাপার!

এই অনেকেই কাজ করে গেছেন, এমনি একজন ছিলেন প্যাসকেল। তিনি সহগগুলোর মধ্যে একটা প্যাটার্ন দেখতে পান, আর সেগুলোকে ত্রিভুজে রূপ দেন। কিন্তু প্যাটার্নের মধ্যে তো অবশ্যই গণিত আছে। কি সেই গণিত? তা নিয়ে পরিশিষ্টে আলোচনা থাকবে। এখানে আরো একটা প্রশ্ন চলে আসে। যেহেতু প্যাসকেল একটা প্যাটার্ন দেখিয়ে ছিলেন তাহলে নিউটনের উপপাদ্য কি প্রয়োজন? একটু আগে আমরা দেখলাম না, যে ১০ ঘাতের বিস্তৃতীর জন্য ৯ ঘাতের বিস্তৃতী প্রয়োজন। প্যাসক্যালের ত্রিভুজ সূত্রেও ঠিক এই সমস্যা দেখা দিয়েছিল। তাই এমন একটা উপপাদ্য দরকার ছিল যেটা সহজেই অন্য ঘাতের সাহায্য ছাড়া একটা ঘাতের বিস্তৃতি বের করতে পারে। নিউটন সেই কাজটাই করেছিলেন।

নিউটন সহগগুলোকে প্রকাশ করেছেন, সমাবেশের মাধ্যমে। সেটা কিভাবে?
(a+b)^5 এটাকে বিস্তৃত করার ক্ষেত্রে সমাবেশের ধারণাটা হলো মনে কর, ৫ টা ঝুড়ি আছে যেখানে ১টা a আর ১টা b আছে। এখন আমি প্রতিটা ঝুড়ি থেকে একটা করে উপাদান তুলে দেখব আমি কি রাশি পেলাম আর সেই রাশিগুলো কতবার পেতে পারি। আমি ঝুড়িগুলোকে এভাবে সাজাই–
১(a+b)
২(a+b)
৩(a+b)
৪(a+b)
৫(a+b)
এখন চিন্তা করো, আমি যদি ৫টা a নিতে চাই। তাহলে আমি ১ বারই নিতে পারব। সমাবেশের ভাষায় 5C0 উপায়ে। ৫ টা b নিতে চাইলেও ১ বারই নিতে পারব।

যদি আমি চিন্তা করি যে, আমি এমনভাবে উপাদানগুলো তুলব। যাতে সেই রাশিতে অন্তত ১টা b থাকে। সেটা নেওয়া যাবে 5C1 উপায়ে।

আবার যদি চাই ২টা b রাখতে সেটা নেওয়া যাবে ১০ বার। যেমন
(১,২);(১,৩);(১,৪);(১,৫)
(২,৩);(২,৪);(২,৫)
(৩,৪);(৩,৫)
(৪,৫)

৩টা b নেওয়া যাবে ১০ বার, ৪টা b নেওয়া যাবে ৫ বার।
এখানে কৌশলটা কি ধরতে পারছ? আমরা জানি a এর ঘাত বাড়তে থাকলে b এর ঘাত কমে আবার a এর ঘাত কমলে b এর ঘাত বাড়ে। তাই আমি আগে b এর ঘাত প্রথম ০ ধরে, আস্তে আস্তে b এর ঘাত বাড়িয়েছি। যাতে বিস্তৃতীর সাথে মিল থাকে। এভাবে সবগুলো সমাবেশ করলে আমরা সহগসহ বিভিন্ন পদ পেয়ে যাব। সেটা হবে।
(a+b)^5
=a^5+ 5a^4b+ 10a^3b^3+ 10a^2b^3+ 5ab^5+ b^5
=(5C0) a^5+ (5C1) a^4b+ (5C2)
a^3b^2+ (5C3) a^2b^3 +(5C4) ab^4 + (5C5) b^5

এখন এটাকে যদি বীজগাণিতিক রূপ দেই তাহলেই দ্বিপদী উপপাদ্য পাওয়া যাবে।
(a+b)^n
=a^n +nC1 a^(n-1)b +nC2 a^(n-2)b^2 +.......+ b^n
এভাবে যখন দ্বিপদী উপপাদ্যকে ব্যাখ্যা করা গেল তখন আর কোন সমস্যা থাকল না। এভাবে ব্যাখ্যা করার আকেরটা মজার দিকও আছে। এভাবে ব্যাখ্যা করলে আমরা বিস্তৃতি ছাড়াই একটা ঘাতের বিস্তৃতির নির্দিষ্ট পদ বের করতে পারব! [পরিশিষ্ট]

নিউটন হলেন ক্যালকুলাসের একজন জনক। এই ক্যালকুলাসের একটা বিশেষ ধারা হলো ম্যাকলরনির ধারা। এই ম্যাকলরনির ধারা নির্দিষ্ট কিছু নিয়মে দ্বিপদী উপপাদ্যতে রূপ নেয়! আর এই দ্বিপদী উপপাদ্য তৈরি করতে বেচারা নিউটন কি কষ্টই না ভোগ করলো!



| ২ |

প্লেগে ট্রিনিটি কলেজ বন্ধ হয়ে গেল। নিউটন চলে এলেন নিজের গ্রামের বাড়িতে। দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। তার মনে অজস্র প্রশ্ন, সেইসব প্রশ্নের উত্তরও তার হাতে চলে আসছে।
গভীর রাত মোমবাতির নিভু নিভু আলোয় নিউটন একমনে কাজ করে যাচ্ছেন। মোমবাতির আলোয় তার চোখগুলো ভয়ংকর মনে হচ্ছে। তার এতো বছরের সব জ্ঞান একত্রিত করছেন তিনি। তিনি তার ছোটবেলার ডায়েরিটা বের করলেন।
সেখানে লেখা–

চাঁদ কেন পৃথিবীর গায়ে ছিটকে পড়ছে না?
এর উত্তর নিউটন এখন ভালো করেই জানেন। প্রতিটা বস্তু একে অপরকে নিজের দিকে টানে। এই টানের কারণে বহু বছর ধরে চাঁদ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে পারে। তাই সে পৃথিবিকে কেন্দ্র করে ঘুরে। কিন্তু চাঁদ সবসময় এই মায়া ত্যাগ করে দূরে সরে যেতে চায়। তাই চাঁদ পৃথিবীর বুকে ধসে পড়ে না। আর পৃথিবী যতটুকু চাঁদকে টানে, চাঁদেও তত জোর পৃথিবীকে ছেড়ে যেতে চায়। তাই এই ঘূর্ণন তৈরি হয়। পৃথিবীর টানকে নিউটন নাম দিলেন অভিকর্ষ। নিউটন এখন এই বিষয় নিয়ে আরো বিস্তারিত গবেষণা করছেন। আর সেগুলো লিখে রাখছেন খাতায়। খাতাটা তার কাছেই আছে।

নিউটন ডায়রি উল্টালেন। সেখানে আরেকটা প্রশ্ন–

রঙধনুর সাত রঙ কেন?
এই প্রশ্ন তাকে বহুদিন ভাবিয়েছে। এর উত্তরও স্পষ্ট। প্রতিটা আলো সাতটা রঙ দিয়ে তৈরি। আর সেই সাতরং সবসময় একত্রে থাকে। তখন দেখা যায় সাদা। প্রচন্ড বৃষ্টির পর যখন রোদ ওঠে তখন সেই রোদের আলো মেঘের ভিতর দিয়ে গিয়ে সাতরঙে ভেঙে যায়। যাকে আমরা রংধনু বলি।

নিউটন তার পায়ের কাছে তাকিয়ে দেখলেন তার পোষা কুকুরটা ঘোরাঘুরি করছে। তিনি আবারও কাজে মন দিলেন। হঠাৎ দরজায় কড়া নড়ার আওয়াজ শুনে নিউটন ঘাবড়ে গেলেন। তিনি দরজা খুলতে যাওয়ার সময় ঘটল সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনাটি! ডায়মন্ড ছোটাছুটি করতে গিয়ে ঝাপিয়ে পড়ল টেবিলের ওপর। আর মোমবাতির মলিন শিখায় জ্বলে উঠলো নিউটনের সব খাতা আর কাগজপত্র। নিউটন দৌড়ে এলেন, ততক্ষণে সব পুড়ে একাকার হয়ে গেছে। নিউটন বিক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে টেবিলে উপর তাকিয়ে দেখলেন, তারপর ডায়মন্ডকে কোলে তুলে বললেন, "ডায়মন্ড এটা তুমি কি করলে? তুমি কি জান তুমি আমার কত বড় ক্ষতি করেছো!"

এই খাতাটাই ছিল নিউটনের অমর কবিতা "প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা"। নিউটন পরবর্তী এক বছরে স্মৃতি রোমন্থন করে আবার লেখলেন সেই বইটি। আর বিজ্ঞান পিছিয়ে পড়ল এক বছর!

| ৩ |

নিউটনের বদস্বভাব হলো কোনো একটা সমস্যার সমাধান পেলে সিগারেট ধরানো। আজকে এই বদ লোকটার বিয়ে। সবাই চার্চে একত্রিত হয়েছে। বিয়ের কাজ শুরু হলো। যিনি বিয়ে পড়াচ্ছেন, নিউটনকে বললেন, মি.নিউটন আপনি কি এই বিবাহে রাজি আছেন?
নিউটন মাথা নাড়ে বললেন, জ্বি আমি রাজি।
তাহলে আপনার ফিওন্সকে আংটিটা পড়িয়ে দিন। মেয়েটা আংটি পড়ার জন্য আঙুল বাড়িয়ে দিল। আর সেইসময় নিউটনের মাথায় চলে এলো সমস্যার সমাধান। আরকি! মেয়েটার আঙুলকে সিগারেট ভেবে জ্বালিয়ে দিলেন। সাথে সাথে মেয়ে রেগেমেগে বিয়ে দিল ভেঙে।
আর নিউটন চিরকুমারের খাতায় স্পষ্টভাবে নিজের নাম লিখে ফেললেন!

রাগী নিউটনঃ-
আমরা সবাই জানি যে নিউটন ছিলেন রাগী মানুষ। কিন্তু তার কারণটা কি আমরা জানি? নিউটনের জন্মের তিন মাস আগেই তার বাবা আইজ্যাক নিউটন মারা যান। নিউটনের জন্মের পর তার মা নতুন সংসার শুরু করেন আরেকজনের সাথে। আর নিউটন মানুষ হতে লাগলেন তার নানির কাছে। প্রচণ্ড মেধাবী ছাত্র নিউটন ছোট বেলায়ই জলঘড়ি, মোমঘড়ি তৈরি করে ফেলেন। পানি তোলার পাম্পের মডেল আঁকেন। এভাবে সুন্দর করেই নিজের জীবন কাঁটাতে থাকলেন তিনি।

কয়েক বছর পর, নিউটনের সৎ বাবা মারা গেলে তার মা তার কাছে চলে আসেন। তারপর এই মেধাবী ছাত্রটার পড়াশোনা বন্ধ করে দেন। তাকে তখন কৃষি কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়। এভাবে নিউটনের জীবন চলতে থাকে। পরবর্তীতে নিউটনের নানি ও তার শিক্ষকের অনুরোধে তাকে ট্রিনিটি কলেজে পাঠানো হয়। এতো মেধাবী ছেলেকে বুঝতে পারলেন না তার মা। হয়তো এই ক্ষোভই নিউটনকে করে তোলে রাগী।
এখনো বাবা-মায়ের মনে করে সন্তান মানুষ করার ভালো উপায় হলো শাসন করা। আর এই কঠোর শাসনের কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তাদের সম্পর্ক। যা পরবর্তীতে ঐ মানুষটাকে করে তোলার উগ্র। এই কঠোর সম্পর্ক অনেক সময় মানুষকে করে তোলে জঙ্গি। আসলে সময় বদলেছে কিন্তু আমাদের চিন্তা ভাবনার কোনো উন্নতি হয় নি। একটুখানি ভালোবাসা যে শত শাসনের চেয়ে অনেক বেশি, সেটা আমরা এখনো বুঝিনা!
Give some love
Spread the feelings,
Stay with all
When indeed!

নিউটনের অর্জন গুলো হলোঃ

১৬৬৭ সালে ট্রিনিটি ফ্যালো
১৬৮৭ সালে প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা
১৭০৩ সালে রয়েল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট
১৭০৫ সালে নাইট উপাধি



পরিশিষ্ট–০১

প্যাসকেলের ত্রিভুজটা হলো-
1
1 1
1 2 1
1 3 3 1
1 4 6 4 1
.............…………………………..
এই ত্রিভুজটি কাজ করে মূলত সহগ নিয়ে। এর প্রায় সারিটা হলো শূন্য ঘাতের সহগের, তারপরের সারিটা একঘাতের সহগ। এই সহগগুলো ১,১। কারণ (a+b)^1=a+b। মানে যা আছে তাই। এইজন্য ১,১। এরপর ধীরে ধীরে দুই ঘাত, তিন ঘাত,চার ঘাত, পাঁচ ঘাতের সহগ। আমি চার ঘাত পর্যন্তই লিখেছি।

এর বৈশিষ্ট্য হলোঃ এটার দুই ধারে সবসময় ১ হবে। কারণ প্রথম পদে a এর ঘাত থাকে সর্বোচ্চ, যা একবারই হতে পারে। এটা উপরেও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এছাড়াও এখানে পাশাপাশি ২ টা সহগ যোগ করে নিচে বসালেই পরের ঘাতের সহগ হয়ে যায়। যেমন–
১+১=২ এটা হলো দ্বিতীয় ঘাতের সহগ।
১+২=৩, ১+২=৩; তৃতীয় ঘাতের সহগ।
১+৩=৪, ৩+৩=৬, ৩+১=৪; এগুলো চতুর্থ ঘাতের সহগ। এভাবে চলতেই থাকবে।

ত্রুটিঃ উপরে দেখলাম যে, প্রতি ঘাতের সহগের জন্য আগের সহগ জানতে হচ্ছে। তাই এটা বড় কোন ঘাতে অনেক কষ্টসাধ্য ও সময় সাপেক্ষ। এইটাই হলো মূল ত্রুটি।

এখন কেন পাশাপাশি দুইটা সহগ যোগ করলে পরবর্তী ঘাত পাওয়া যায় সেটা দেখব। এটা নিয়ে আমার আগের একটা লেখা আছে সেই লেখাটাই সম্পাদিত করে তুলে দিলাম–

প্যাসকেলের ত্রিভুজে পাশাপাশি দুটি সহগ যোগ করলে নতুন সহগ পাওয়া যায়। এই ফর্মুলাটা কেন কাজ করে?
চলো স্বয়ং প্যাসকেল সাহেব থেকে জেনে নেই.....

: প্যাসকেল সাহেব,
প্যাসকেল সাহেব।
: এই তুই কে?তুই জানিস না আমার সময়ের কত দাম! কি চাস?
: না মানে ইয়ে, আপনার নামে যে ত্রিভুজ সেখানে পাশাপাশি দুটি সহগ যোগ করলে নতুন সহগ পাওয়া যায় কেন?
: ও আচ্ছা। ভিতরে আয়, তোদের মতো দু-চারটা কৌতূহলী ছাত্রদের আমার ভালো লাগে। খাতা-কলম নিয়ে আসি, বস এখানে।

: ত্রিভুজটা এমন :
1
1 1
1 2 1
1 3 3 1
তোর প্রশ্ন যে,এখানে 1+1 কেন হলো? 1-1 কেন হলো না। তাই তো?
: জি
: দেখ,ত্রিভুজের প্রথম সহগ 1। এটা বোঝায় (a+b)^0=1,
কেন 1 হলো জানিস?
: জানি,কিন্তু বুঝি না।

: বুঝতে হলে ভাবতে হবে।
পাওয়ার 0 মানে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা কিছু নেই। ডানে -বামে, উপরে - নিচে যাওয়া যাবে না, এমন জিনিস হলো বিন্দু। কিন্তু বিন্দুর তো একটা অস্তিত্ব আছে। সেটা প্রকাশ করা হয় 1 দিয়ে। বুঝতে পারছিস?
: জি।
: এখন পরেরটা দেখ 1, 1। এটা হলো a+b।এখানে a ও b এর সহগ 1।
এখন (a+b)^2 = (a+b)(a+b)।
(a+b)(a+b)

= (1)a+(1)ab
+ (1)ab+(1)b
...................
1a+2ab+1b[যোগ করে ]
এখন সহগ গুলো দেখ, প্রথম লাইনে a এর সহগ 1, ab এর 1।
দ্বিতীয় লাইনে ab এর সহগ 1, b এর 1।
আরেকটি জিনিস দেখ,2য় লাইনটা কিন্তু একঘর ডানে সরিয়ে দিয়েছি। কারণ,
দুই লাইনের ab সমজাতীয় পদ। তাই ab এর নিচে ab আর b চলে গেল ডানে।

এখন a এর সহগ 1, 1 ab ও 1 ab মিলে 2, b এর সহগ 1। এভাবে আরও কয়েকটা করলে দেখা যাবে প্রান্তীয় সহগ হবে 1।আর মাঝখানের সহগ হবে আগের যেই সহগ তাদের যোগফল। তাই লিখা হয়
1 1
1 2 1
আরেকটা উদাহরণ দেই:
(a+b)^3
=(a+b)(a+b)^2
=(a+b)(a^2 + 2ab + b^2)

=a^3 + 2×a^2×b + a×b^2
+ a^2 ×b +2×a×b^2
+ b^3
......................................
a^3+ 3×a^2×b +3ab^2 +b^3
এখানে সহগ গুলো হলো
1 2 1
1 3 3 1
বুঝতে পেরেছিস?

: জি, অনেক মজার জিনিস।

মহান প্যাসকেলের প্রস্থান!


পরিশিষ্ট–০২

নিউটন সমাবেশের মাধ্যমে দ্বিপদী উপপাদ্যটা ব্যাখ্যা করে প্যাসকেলের ত্রুটি দূর করেছেন। এর সাথে তিনি আরেকটা মজার কাজ করেছেন। সেটা হলো সাধারণ পদ। মনে করো, যদি বলা হয় (a + b)¹⁰ কে বিস্তৃত করলে এর ৫নং পদটা কত হবে? [এখানে পদসংখ্যা হবে ১১টা, কারণ ঘাত ১০ তাই পদসংখ্যা ১০ + ১]
তাহলে আমাদের ৫টা পদ বিস্তৃত করে তারপর বলা লাগবে। কিন্তু একটা মজার উপায়ে সেই কাজটা করা যায় এক নিমিষেই। এর জন্য যেটা দরকার সেটা হলো কবিতা আবৃত্তি। তাহলে মনযোগ দিই–
(a + b)ⁿ =
ⁿC₀ aⁿ b⁰ + ⁿC₁ a⁽ⁿ⁻¹⁾ b¹ + ⁿC₂ a⁽ⁿ⁻²⁾ b² + ⁿC₃ a⁽ⁿ⁻³⁾ b³ + .... + ⁿCₙ a⁽ⁿ⁻ⁿ⁾ bⁿ

এখন কবিতা আবৃত্তি করো পুরোটা। আবার করো। করা শেষ হলে মনোযোগ দিয়ে লেখাটা পড়ো। দেখো, এখানে প্রথম পদে ⁿC₀ ছিল তাই a এর ঘাত থেকে 0 বাদ গেছে b এর ঘাত হয়েছে 0 ।
দ্বিতীয় পদে ⁿC₁ ছিল a এর ঘাত, তাই 1 কমে হলো
(n – 1), b এর ঘাত হলো 1, এভাবে চলতে চলতে শেষ পদে মানে (n + 1) তম পদে এসে ⁿCₙ হলো a এর ঘাত হলো (n – n), b এর ঘাত হলো n ।
ব্যাপারটা বুঝতে পারছ? যত তম পদ ⁿC—এর সাথের সংখ্যাটা তার চেয়ে ১ কমেছে। a এর ঘাত থেকেও ১ কমেছে। আর ⁿC এর সাথে যেই সংখ্যা হয়েছে b এর ঘাত হয়েছে তত।

এতটুকু বুঝতে পারলেই পাঠকের কাজ শেষ। বাকিটা আমার উপর ছেড়ে দাও।
এখন আমরা যেকোনো ঘাতের যেকোনো পদ নির্ণয়ের একটা বীজগাণিতিক রূপ দিব। তার জন্য ঐ আগের (a + b)ⁿ এর সূত্র ব্যাবহার করব। কারণ এটা দ্বিপদী উপপাদ্যের বীজগাণিতিক রূপ।
এখন আমরা যদি যেকোনো ঘাতের বিস্তৃতীর যেকোনো পদ (ধরি r তম পদ) বের করতে চাই তাহলে সেটা হবেঃ-

r তম পদ = ⁿCᵣ₋₁ aⁿ⁻⁽ʳ⁻¹⁾ b⁽ʳ⁻¹⁾

যেহেতু ধরেছি r তম পদ, তাই সব জায়গায় ১ করে কমেছে। এটাকেই সাধারণ পদ বলা যেত কিন্তু অনেক মাইনাস চিহ্নের কারণে এটার বদলে (r + 1)তম পদকে সাধারণ পদ বলে। কারণ (r + 1) হলে মাইনাস আর প্লাস চিহ্ন বাদ হয়ে সুন্দর রূপ হবে। আমি সেই রূপটা তুলে ধরছি। (পাঠক চাইলে বিস্তারিত অঙ্ক কষে দেখতে পারেন)।

সাধারণ পদ, অর্থাৎ r + 1 তম পদ
= ⁿCᵣ a⁽ⁿ⁻ʳ⁾ bʳ

সমস্যাঃ
১. (a + b)²⁰ এর বিস্তৃতীতে ১১ তম পদ কত?
২. (a + b)¹¹ এর বিস্তৃতীতে ১৩ তম পদ কত?
3.(a + b)¹² এর বিস্তৃতী করো প্যাসক্যালের ত্রিভুজের সাহায্যে।

বি.দ্রঃ প্রশ্নের সমাধান করলে মজা পাবেন…!


পরিশিষ্ট-০৩

দ্বিপদী বিস্তৃতী শিখে কি লাভ?

এতক্ষণ আমরা দ্বিপদী উপপাদ্য নিয়ে আলোচনা করলাম। দ্বিপদী উপপাদ্য প্যাসকেলের ত্রিভুজ, সাধারণ পদ দেখলাম। এইগুলো দেখার পর আমাদের মনে প্রশ্ন জাগবে–
দ্বিপদী বিস্তৃতী শিখে কি লাভ?

প্রশ্ন জাগবে কারণ আমরা সবকিছুতে লাভ খুজি। আর এই কারণে আমাদের শিক্ষার উদ্দেশ্যটাও অনেক সময় ঠুনকো হয়ে যায়। কারণ লাভ ছাড়া আসলে আমরা কোনো কিছু করি না। আমরা শিক্ষা অর্জনের পিছনে লাভ খুজি। কিন্তু শিক্ষা যেভাবে আমাদের ভাবনার উন্নতি করে সেটা কি আমরা জাগতিক কিছু দিয়ে বিচার করতে পারব! গণিত নিয়ে জি. এইচ হার্ডি বলেন–

"যা মানুষের প্রয়োজনীয় বা দরকারি তা গৌণ গণিত। এর বিপরীতে যা জ্ঞানের বিভিন্ন শাখাকে সংযুক্ত করে, যা গুরুত্বপূর্ণ ধারণাকে সংযুক্ত করতে পারে, সর্বোপরি যা একজন খাঁটি গণিতবিদকে আনন্দ দেয় তাই উচ্চতর গণিত"
এখন মূলত এই গণিতের আনন্দ নিয়েই কথা বলব। কিন্তু একটা কথা বলে রাখি, বাস্তব জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্বিপদী বিস্তৃতীর প্রয়োগ আছে। যেমনঃ অর্থনীতিবিদরা প্রায়ই এই গণিতের দ্বারস্থ হন। আর্কিটেক্টরা বিভিন্ন ডিজাইন বানানোর সময় এই দ্বিপদী বিস্তৃতী ব্যবহার করে থাকেন।

দ্বিপদী বিস্তৃতী নিয়ে অনেকে গণিতবিদই ভাবতেন। এর মধ্যে ইউক্লিডের কাজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি দুইটি সংখ্যার বর্গ নিয়ে তার এলিমেন্টসে জ্যামিতিক প্রমাণ করেছেন। যেটা (a+b)^2 এর সূত্রের জ্যামিতিক রূপ। তখন তো আর বীজগণিত ছিল না, তাই তিনি এই সূত্রকে একটা দ্বিমাত্রিক বর্গের সাথে চিন্তা করে কাজটা করেছেন। এই যে চিন্তাটা, এটা দিয়ে কিন্তু সুন্দর আরো কিছু চিন্তা করা যায়!

যেমন আমরা এই চিন্তার সূত্র ধরে অন্যান্য মাত্রার কাঠামো কেমন হবে সেটা চিন্তা করতে পারি। (a+b)^0 কে শূন্য মাত্রা (বিন্দু) হিসেবে চিন্তা করতে পারি, (a+b)^1 কে একমাত্রা(একটা রেখা) হিসেবে চিন্তা করতে পারি ,(a+b)^2 কে দ্বিমাত্রিক (যেমন ইউক্লিড চিন্তা করেছিলেন, দ্বিমাত্রা হবে শুধু একটা সার্ফেস। এটার কোনো উচ্চতা হবে না।)হিসেবে ভাবতে পারি, (a+b)^3 ত্রিমাত্রিক(আমাদের পরিচিত জগৎ) ধরতে পারি। (a+b)^4 কে? এখানেই আসলে মজা। এটাকে আমরা ভাবতে পারি চতুর্মাত্রিক কাঠামো হিসেবে হিসাবে! সাধারণত কোনো প্রাণী যেই মাত্রায় বসবাস করে সে তার উপরের মাত্রা সম্পর্কে চিন্তা করতে পারে না। দ্বিমাত্রিক প্রাণী যদি থাকত তাহলে তারা আমাদের সম্পর্কে চিন্তা করতে পারত না। আর গণিতের মাহত্ম এখানেই। আমরা আমাদের উপরের মাত্রার কাঠামো সম্পর্কে চিন্তা করতে পারছি। তাহলে দেখি চতুর্মাত্রিক কাঠামো কেমন হয়–
আমরা এই কল্পনাটা করবো বিন্দু দিয়ে। কেউ চাইলে কোণ দিয়েও করতে পারেন। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে চিন্তাটা যেনো শুধু কোণ দিয়ে হয়। হ-য-ব-র-ল না হয়ে যায়। আর আরেকটা কনফিউশান থাকতে পারে, সেটা হলো আইন্সটাইন তো বলেছেন, এই মহাবিশ্ব চতুর্মাত্রিক তাহলে কেন আমরা চতুর্মাত্রা নিয়ে চিন্তা করতে পারব না। আইন্সটাইন আমাদের যেই ত্রিমাত্রিক কাঠামো দৈর্ঘ্য, প্রস্থ আর উচ্চতা এটাকে কিন্তু চতুর্মাত্রিক বলেন নি। তিনি এই কাঠামোর সাথে যোগ করেছেন সময়। তাই চতুর্মাত্রিক বলেছেন। কেন সময়? কারণ আজকে আমি যেই ঘরে বসে লিখছি কয়েক বছর পর এর অস্তিত্ব নাই থাকতে পারে, কিংবা হয়তো অতীতে এর অস্তিত্ব ছিল না। এখন আছে। এইভাবে চিহ্নিত করার জন্য সময় ধরেছেন।
আমরা এখন চতুর্থ মাত্রার সন্ধান করি–

আমরা জানি যে একটা বিন্দু দিয়ে বোঝায় শূন্য মাত্রা। কারণ এটা ডানে বামে উপরে কোথাও যেতে পারে না। এর জীবনের বৈচিত্র্য শেষ!
আবার দুইটা বিন্দু যদি পাশাপাশি বসানো হয় তাহলে এক মাত্রায় থাকে দুইটা বিন্দু। (আমরা চিন্তা কিন্তু প্রান্ত বিন্দু দিয়ে করছি। সাবধান!)
একটা রেখার সাথে যদি আরো কয়েকটা রেখা লাগিয়ে দেই, তাহলে হয়ে যাবে দ্বিমাত্রিক তল। যেমন, বর্গ। আর সেখানে ৪টা প্রান্ত বিন্দু।
ঐ বর্গটার উপরে যদি আরো কয়েকটা বর্গ রেখে দেই হয়ে যাবে ত্রিমাত্রিক কাঠামো। যার ৮ টা প্রান্ত বিন্দু। তাহলে চার মাত্রায়?
পুরোচিত্রটা আবার দেখি,

শূন্য মাত্রা — ১ টা প্রান্তবিন্দু
এক মাত্রা — ২ টা প্রান্তবিন্দু
দ্বিমাত্রায় — ৪ টা প্রান্তবিন্দু
ত্রিমাত্রায় — ৮ টা প্রান্তবিন্দু

দেখ মাত্রা বাড়ার সাথে সাথে প্রান্তবিন্দু ২ এর গুণিতক আকারে বাড়ছে এটা 2^n হিসেবে লেখা যায়। তাহলে চতুর্থ মাত্রার কাঠামোতে ১৬ টা প্রান্তবিন্দু থাকবে। আমরা যদি এমন কোনো কাঠামো আঁকতে পারে যাতে ১৬ টা প্রান্তবিন্দু তাহলে সেটা হবে চতুর্থ মাত্রার কাঠামো। এখন দেখেছো কিভাবে গণিত আমাদের চিন্তার সীমাবদ্ধতা দূর করেছে! অথচ আমরা পড়ে থাকি স্বার্থ আর লাভ নিয়ে।


Writer: Oyahidur Rahman Mohin

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form