এখানে আমরা দেখবো আমাদের শরীরে লুকিয়ে থাকা প্রাচীন ভাইরাসদের ফসিল কিভাবে শিম্পাঞ্জি ও আমাদের সাধারণ পূর্বপুরুষের ইতিহাসকে এক করেছে।
▪️রেট্রোভাইরাস কি?
রেট্রোভাইরাস এক ধরণের বিশেষ ভাইরাস, যেটা অন্য কোষের DNA তে নিজের জিন ইনজেক্ট করানোর মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি ঘটায়। এটাকে বলে, হরাইজন্টাল জিন ট্রান্সফার। ভাইরাস জিনটি পোষক কোষে প্রবেশের করার পর সেই কোষের DNA তে স্থায়ীভাবে থাকা শুরু করে। পোষক কোষ সেই জিনটাকে নিজের কোষের অংশ ধরে নেয়। এই কোষ যখন বিভাজিত হয়, তখন ভাইরাস কোষটিও বিভাজিত হয়। রেট্রোভাইরাস সাধারণত স্তন্যপায়ীদের শ্বেতরক্তকণিকাকে আক্রান্ত করে। এই ভাইরাস আবার শুক্রাণু কিংবা ডিম্বাণুকেও এফেক্ট করতে পারে। আক্রান্ত এই শুক্রাণু বা ডিম্বাণু ফার্টিলাইজড হলে সেই স্তন্যপায়ীর সন্তানের দেহেও ভাইরাসটি স্থানান্তরিত হয়। এমনকি, তার প্রতিটি কোষেই। পরবর্তীতে এই সন্তানও তার নেক্সট জেনারেশনে এই ভাইরাসটি পাস করে। পোষক কোষে এই ভাইরাসের অবস্থানের ফলে ক্ষতিকর মিউটেশন কিংবা রেয়ার কিছু ক্ষেত্রে উপকারী মিউটেশনও ঘটে যেতে পারে।
এই ভাইরাস জিনটি একটা সময় বাড়তি জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল হিসেবে কাজ করে, যা জেনারেশন থেকে জেনারেশন বিবর্তিত হতে থাকে। একটা পর্যায়ে ভাইরাসটির উপর সেই প্রাণিটার পুরো প্রজাতিটিই নির্ভরশীল হয়ে যায়। এটা ছাড়া তার রিপ্রডিউস করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। সেই প্রজাতিটির ডিএনএ-র স্থায়ী অংশ হয়ে যায়৷ মানুষ সহ প্রায় সব প্রাইমেটদেরই দেহে এই ভাইরাস জিন ডিএনএ-র স্থায়ী অংশ। বিজ্ঞানীরা সেটাকে নাম দিলেন, Endogenous Retrovirus। এটাকে Endogenous বলা হয় কারণ এটা আমাদের কোষের অংশ হিসেবে থাকে জন্ম থেকেই। [1]
মানুষের জিনোম হাজার হাজার রেট্রোভাইরাস সেগমেন্ট ধারণ করে। আমাদের ডিএনএ-র ৮% জিনই হচ্ছে রেট্রোভাইরাস ডিএনএ। এটা আজ আমাদের দেহকোষে ঘাটি গেড়ে বসে আছে তার কারণ, আমাদেরই কোনো পূর্বপুরুষ এ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলো। এটাকে এক প্রকার হিস্টোরিকাল রেকর্ডও বলা যায়।
প্রশ্ন আসতেই পারে, আমাদের এই ভাইরাস জিনের ন্যায় সিকোয়েন্স ধারণ করা জিনগুলি কি সত্যি সত্যিই কোনো ভাইরাস থেকেই এসেছিলো? ব্যাপারটা কি প্রমাণিত?
জ্বী, প্রমাণিত।
মানুষের কোষ পেট্রিডিশে রেখে ইনকিউবেট করা হয় এবং খুব অল্প পরিমাণে সেই কোষের Endogenous Retrovirus এর ডিএনএ মিউটেটেড করানো হয়। এই ডিএনএ গুলি প্রাচীন সেই ভাইরাসটাকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে কিনা সেটাই ছিলো দেখার বিষয়। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, বিলুপ্ত এই প্রাচীন ভাইরাসগুলি সত্যি সত্যিই রিভাইভ করে! এমনকি, এদের নাম দেয়া হয়েছে ফিনিক্স। রূপকথার ফিনিক্স পাখি যেভাবে ধ্বংসাবশেষ থেকে আবার জীবিত হয়ে যায়, ঠিক সেভাবে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর পর এই ফসিল পরজীবিটিই ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠতে পেরেছে।[2]
এবার দেখা যাক, এই এন্ডোজেনাস রেট্রোভাইরাস আমাদের আর শিম্পাঞ্জিদের কিভাবে কানেক্ট করেছে।
যদি সত্যি সত্যিই মানুষ আর শিম্পাঞ্জির কমন এনসেস্টর থাকে, আর সেই এনসেস্টর যদি রেট্রোভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়—তাহলে আজকের দিনে মানুষ ও শিম্পাঞ্জির জিনোমে একই লোকেশানে ভাইরাস জিনগুলি থাকার কথা। আবার, তারা একই পূর্বপুরুষ থেকে না আসলে তাদের জিনোমে হুবহু একই জায়গায় ভাইরাস জিনগুলি থাকা পুরোপুরি অসম্ভব।
কেন অসম্ভব?
এর প্রথম কারণ হচ্ছে, রেট্রোভাইরাস কোনো হোস্টকে আক্রমণ করলে সেটা সেই হোস্টের জিনোমের অনেক জায়গায় থাকতে পারে। দেখা গেছে, হিউম্যান জিনোমে রেট্রোভাইরাসের ১০ মিলিয়ন বা ১ কোটি insertion স্পট আছে। [3]
যার ফলে, আলাদা আলাদা ভাবে যদি একটা মানুষ আর শিম্পাঞ্জি এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়, তাহলে তাদের দুজনের জিনোমে একই স্থানে ভাইরাস জিনটির অবস্থান করার সম্ভাবনা ১/১০০০০০০০। এখন ধরা যাক, আলাদাভাবে এই দুই প্রজাতির দুই প্রাণির মধ্যে ১২ টা ভাইরাস জিন প্রবেশ করলো। তাহলে, তাদের দুজনের জিনোমে একই স্থানে এই ভাইরাস জিনগুলির অবস্থানের সম্ভাবনা হচ্ছে, ১/পর্যবেক্ষণশীল মহাবিশ্বের সব পরমাণু!
মানুষ ও শিম্পাঞ্জির জিনোম স্ক্যান করে মানুষের ২১১ টি ও শিম্পাঞ্জির ২০৮ টি Retrovirus insertion পাওয়া গেছে। [4]
দেখা গেলো, ১ না, ২ টা না কিংবা ১২ টাও না— ২০৫ টা রেট্রোভাইরাস জিনের অবস্থান মানুষ আর শিম্পাঞ্জির জিনোমের একই অবস্থানে আছে! [5]
এই নিখুঁত মিলটা তখনই সম্ভব, কেবল যদি তাদের কোনো সাধারণ পূর্বপুরুষ একজনই আক্রান্ত হয়ে থাকে। আলাদা আলাদা ভাবে দুজনের জিনোমে একই স্থানে এই এতো বিশাল সংখ্যক ভাইরাস জিনগুলির অবস্থানের সম্ভাবনা ১/(প্রায় অসীম) অর্থাৎ, শূন্য।
বলা যায়, আমাদের আর শিম্পাঞ্জির সেই কমন এনসেস্টর এর দেহে ২০৫ টা রেট্রোভাইরাস জিনের প্রবেশ ঘটেছিলো। পরবর্তীতে, পূর্ব পুরুষ থেকে আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়ার পর মানুষের ৬ টা বৃদ্ধি পেয়েছে আর শিম্পাঞ্জির ৩ টা।
আমাদের ডিএনএ জুড়েই লিখা আছে শতকোটি বছরের ইতিহাস। বিবর্তনের সবচেয়ে রিগোরাস হিসেব নিকেশ তাই এই স্থানটাতেই পাওয়া যায়। মলিকিউলার লেভেলে বিবর্তনের এ ট্রেইটগুলি কারোরই অস্বীকার করার কোনো রাস্তা নেই, যদি না সত্যিকার অর্থেই আপনার কান্ডজ্ঞান থাকে। [*]
আমাদের ডিএনএ-তে নন-কোডিং জিনগুলিকে বলে এক্সন। এই এক্সনের প্রতিটিই জিন কোনো না কোনো ভাইরাস থেকে এসেছে। এমনকি, মানব জিনোমের ৪০% জিনই হচ্ছে পূণরাবৃত্তিক সিকোয়েন্স বা Interspersed repetitive sequence এর।
এরা হচ্ছে—
1. SINEs (short interspersed repetitive elements)
2. LINEs (long interspersed repetitive elements)
3. LTR (element with long terminal repeat)
4. DNA transposons.
এন্ডোজেনাস রেট্রোভাইরাস এর মতো এরাও ফসিল পরজীবি। এদের বেশিরভাগই প্ল্যাসেনটাল স্তন্যপায়ীদের আলাদা হবার সময়ে আমাদের পূর্বপুরুষদের শরীরে প্রবেশ করেছে হরাইজন্টাল জিন ট্রান্সফারের মাধ্যমে। প্রায় ১২ কোটি ৫ লক্ষ বছর আগে।
সব ইউক্যারিওটিক কোষের প্রাণির জিনোমেই আপনি এই পূণরাবৃত্তিক সিকোয়েন্স খুঁজে পাবেন। এই ফসিল পরজীবীরাও বিবর্তনের বিভিন্ন ধাপের ঐতিহাসিক দলিল।
বিবর্তন স্বীকার না করে যাবেন কোথায়?
তথ্যসূত্রঃ
[1] এব্যাপারে কিছু স্টাডি:
▪️ https://journals.plos.org/plosbiology/article?id=10.1371/journal.pbio.3000028
▪️ https://www.pnas.org/content/112/5/E487
[2]
▪️ https://www.nature.com/articles/news061030-4
▪️ https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC1665638/
[3]
▪️ https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC1933515
▪️ https://pubmed.ncbi.nlm.nih.gov/7926746
▪️ https://www.semanticscholar.org/paper/Retroviral-DNA-Integration%3A-ASLV%2C-HIV%2C-and-MLV-Show-Mitchell-Beitzel/f2c061e75d8ee0ddcf34edf93e9c986cbe854aba
[4]
▪️ https://personal.broadinstitute.org/sfs/personal/Science-1982-Yunis-1525-30.pdf
▪️ https://pubmed.ncbi.nlm.nih.gov/16136131/
[5] https://www.researchgate.net/publication/322608448_HERV-W_group_evolutionary_history_in_non-human_primates_Characterization_of_ERV-W_orthologs_in_Catarrhini_and_related_ERV_groups_in_Platyrrhini
[*] এই ব্যাপারে আরও কিছু স্টাডি দেখতে পারেন...
▪️ https://genome.cshlp.org/content/17/8/1186.long
▪️ https://bmcecolevol.biomedcentral.com/articles/10.1186/s12862-018-1125-1
▪️ https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC509299/?tool=pubmed
▪️ https://pubmed.ncbi.nlm.nih.gov/7926746/
Writer: Mahathir Tusher