অন্ধের হস্তিদর্শনের গল্পটা তো আপনারা জানেন। দু’লাইনে আরেকবার বলি।
সাত অন্ধের শখ হল তারা হাতির চেহারা কেমন সেটা টিপেটুপে বোঝার চেষ্টা করবে। এই করতে গিয়ে এক অন্ধ হাতির পা ধরে বলল হাতি জিনিসটা খাম্বার মত, আরেকজন শুঁড় ধরে বলল সাপের মত, আরেকজন কানের নাগাল পেয়ে কুলোর মত- ইত্যাদি। এক হতভাগা হাতির নাদা খাবলিয়ে সিদ্ধান্ত নিল- হাতি জিনিসটা নরম এবং ভেজা।
এই গল্পের একটা উল্টোরূপ আছে, অন্ধ হাতির মানুষ দর্শন। সাত অন্ধ হাতি একসাথে হয়ে ঠিক করল, মানুষ জিনিসটা কেমন সেটা তারা একটু টিপেটুপে দেখবে। এর জন্য চোখ থাকা জরুরি নয়, আস্তে করে মানুষের গায়ে একটু পাড়া দিলেই বোঝা যাবে এরা কেমন।
হাতিদের মধ্যে অবশ্য মানুষের আকৃতি বিষয়ে কোনরকম মতানৈক্য দেখা গেল না। তারা সবাই একবাক্যে বলল- মানুষ জিনিসটা চ্যাপ্টা।
এই পর্যন্ত গল্পটা বলে ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ মন্তব্য করেছিলেন- দেখুন, প্রকৃতিকে কিন্তু আমরা সরাসরি দেখি না। দেখি খালি যন্ত্রপাতির মাপ। আমাদের পর্যবেক্ষণ, জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্য-উপাত্ত সবই নির্ভর করে আমরা প্রকৃতিকে কোন প্রশ্ন করি আর কোন গজফিতেয় মাপি তার ওপর। আমাদের পছন্দের থিওরীতে তাই প্রকৃতির স্বরূপ বাঁধা নাও পড়তে পারে।
এই নীতিকথা একদম হারে হারে ফলে যায় জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে।
জীববিজ্ঞান অসম্ভব পিচ্ছিল একটা শাস্ত্র। অ্যারিস্টটলের সময় থেকে পৃথিবীময় দার্শনিক আর বিজ্ঞানীদের চিন্তা হল যে করেই হোক প্রকৃতিকে কয়েকটা নিয়মের মধ্যে আটকে ফেলে সবকিছুর ব্যাখ্যা দিতে হবে। অন্যান্য শাস্ত্রে এই প্রচেষ্টা কতখানি সফল হয়েছে জানি না, কিন্তু সবচেয়ে বেশি ব্যর্থ হয়েছে জীববিজ্ঞানে।
এর কারণ একটাই- জীববিজ্ঞানে সরল বলে কিছু নেই।
ডাক্তারিশাস্ত্রের শারীরতত্ত্ব আর অঙ্গসংস্থানবিদ্
এতখানি পরাজয়ের অবসাদ আর শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনা একই সাথে বিজ্ঞানের আর কোন শাখায় আছে বলে আমার জানা নেই।
আজকের কাহিনীটা বোধহয় এর একটা আদর্শ উদাহরণ।
২।
আপনার দেহ থেকে একটা কোষ নিয়ে সেটাকে একটু শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে কায়দা করে ধরলে দেখা যাবে- এর মধ্যে অজস্র সুতোর মত লম্বা লম্বা কিছু জিনিস কোষময় ছড়িয়ে আছে।
হাতির পায়ের তলে যেরকম মানুষ চ্যাপ্টা মনে হয়, আমাদের আতশকাঁচের নিচেও এই বস্তুগুলোকে সুতোর মত পলকা দেখায়। আসলে এরা বেশ পোক্ত জিনিস। এদেরকে কোষ অনেকটা ছাতার শিকের মত ব্যবহার করে- শিক যেমন ছাতার কাপড়টাকে টানটান করে আটকে রাখে, একই ভাবে এই শিকগুলোও কোষের গঠনটাকে আঁটসাঁট রাখে। বইপুস্তকে যেরকম দেখা যায় কোষ একটা থলথলে দলার মত জিনিস- সেটা পুরোপুরি ঠিক নয়, দলার ভেতরে লোহার রডের মত একটা অন্তর্জাল কোষকে একটা নির্দিষ্ট আকার দেয়।
এই রড-শিক-বাঁশমার্
এই রেললাইনগুলোই তৈরি হয় রড দিয়ে। মানে কোষের মধ্যে যেখানেই একটু শক্ত ইটকাঠপাথরের দরকার হয়, সেখানেই এই রডগুলো কাজে আসে।
কোষের কাঠামো দরকার? রড বসাও। রাস্তা চাই? রডের লাইন পাতো। কোষ দু’ভাগ হওয়ার সময় ডিএনএকে টেনে সমান সমান দু’ভাগ করতে হবে? দু’পাশ থেকে মাকুর মত রডের কাঠামো লাগিয়ে হ্যাঁচকা টান দাও। কোষের বাইরে কী হচ্ছে তা জানার জন্য অ্যান্টেনা দরকার? দেয়ালে রড লাগিয়ে লম্বা করে দাও। এই জিনিসগুলো সরকার থেকে ইস্যু করা ইটের মত- কোষময় ঘোষণা দেওয়া আছে, যাবতীয় অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য এই মাল ব্যবহার করিতে হইবে।
এগুলো সবই আমাদের অনেক আগে থেকেই জানা। জিনিসগুলো চমকপ্রদ সন্দেহ নেই, কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করলে মোটামুটি বাস্তবসম্মত মনে হয়। ঠিকই তো, কোষ যেহেতু দেহের যাবতীয় কাজ করছে, তারও তো কিছু দালানকোঠা রাস্তাঘাট দেয়াল ইত্যাদি দরকার। সেগুলো বানানোর জন্য কোষে বিশেষ ধরণের মালমশলা থাকা এমন কিছু অসম্ভব নয়।
আজ থেকে মোটামুটি বছর দশেক আগে একদল বিজ্ঞানী আবিষ্কার করলেন, কোষের ভেতরে কীরকম নতুন চেহারার একরাশ রড দেখা যাচ্ছে।
তাদের একটু কৌতূহল হল।
বিজ্ঞানীরা অতি চালু প্রাণী। কোষের মধ্যে কী হচ্ছে না হচ্ছে দেখার জন্য তাদের অনেক কায়দা আছে। এর একটা কায়দা হল যে জিনিসটাকে তারা দেখতে চান, তার গায়ে একটা টর্চলাইট বসিয়ে দেওয়া। শুনতে রসিকতার মত মনে হলেও প্রক্রিয়াটা এরকমই। পৃথিবীতে অনেক প্রাণীই আছে যাদের দেহ অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে। যেমন সামুদ্রিক জেলিফিশ। টর্চলাইট লাগানোর জন্য সেই জ্বলজ্বলে আলোর জিনটুকু তাদের দেহ কেটে এনে যেখানে দরকার সেখানে জুড়ে দিলেই হয়। আজকের দিনে এসব নিতান্তই মামুলি ব্যাপার।
তো তারা যেটা করলেন- এই নতুন চেহারার রডগুলোকে ভালভাবে দেখার জন্য এদের সাথে একটা টর্চলাইট জুড়ে দিলেন। এবার কোষগুলোকে কায়দামত একটা অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে ফিট করলেই রডের জ্বলজ্বলানি দেখা যাবে। এতে বোঝা যাবে ব্যাটা কোষের মধ্যে কোথায় আছে কী করছে।
ছবিটার দিকে একবার দেখুন- কালো লম্বা জিনিসগুলো হচ্ছে কোষ। এদের ভেতরের দিকে লাল লাল জ্বলজ্বলে কিছু লম্বাটে জিনিস সেঁটে রয়েছে দেখছেন? এগুলোই সেই রড।
বিজ্ঞানীদের সন্দেহ ঘনীভূত হল। আসলেই এগুলোর সাথে কোষের অন্যান্য রডগুলোর মিল নেই।
অবশ্য তখনও তারা কিছুই দেখেননি।
৩।
সাধারণত জীববিজ্ঞানে নতুন কিছুর সন্ধান পেলে গবেষকেরা ধাপে ধাপে তিনটা কাজ করেন।
প্রথমত, তারা সেটাকে ভালভাবে দেখার চেষ্টা করেন। যত ভালভাবে পারা যায়- তা টর্চলাইট লাগিয়ে হোক বা যেভাবেই হোক। দ্বিতীয়ত, তারা জিনিসটাকে টুকরো করে দেখেন এটা কী দিয়ে কীভাবে তৈরি।তৃতীয়ত, তারা নিজেরা গোড়া থেকে জিনিসটাকে অন্যভাবে বানানোর চেষ্টা করেন। জীবকোষের কোনকিছু সম্পর্কে চলার মত একটা সিদ্ধান্তে আসতে হলে এই তিন ধাপ পার হতেই হয়।
কাজেই অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে যখন বিজ্ঞানীরা ঐ অদ্ভুত চেহারার লাল রডগুলো দেখলেন- তাদের পরের চিন্তা দাঁড়াল এটাকে ভেঙে দেখা ভেতরের গঠনটা কীরকম।
ভাঙার আগে কোষের ভেতরকার জগত সম্পর্কে দু'একটা কথা বলে নেই।
খুব খুব সহজ করে বললে- কোষের মধ্যেকার জিনিস দুইরকম। প্রথমরকম জিনিস যন্ত্রপাতি কিংবা ইলেক্ট্রনিক্সের
আগেই বলে নিয়েছি এটা একটা চূড়ান্ত মাত্রার সরলীকরণ। ডিএনএ এবং কোষের আরো কিছু অংশ আপাতত এই হিসেবের বাইরে থাকছে।
যন্ত্রপাতি-ইলেক্ট্রনিক্সের কাজ হরেকরকম- জিনিসপত্র টানাহেঁচড়া করা, বড় জিনিস ভেঙে টুকরো করা, টুকরো জিনিস জোড়া দিয়ে বড় জিনিস বানানো, মোটরগাড়ির মত এখান থেকে ওখানে যাওয়া, বিভিন্ন প্রক্রিয়ার অন/অফ সুইচ হিসেবে কাজ করা, ইত্যাদি। এমনকি কিছু যন্ত্র দিয়ে মাপামাপি বা গোনাগুনতির কাজও হয়। আসলে কোষের মধ্যকার এইসব যন্ত্রপাতির ইয়ত্তা আপনার-আমার কল্পনায় আদৌ কুলোবে না।
ইট-বালু-সিমেন্টের কাজ বোঝা আরেকটু সহজ, এরা মোটামুটি কোষের দালানকোঠা বানানোর কাজ করে। আপনার মাথার চুল আর পায়ের নখ এরকম ম্যাটম্যাটে কিছু জিনিসে তৈরি। এই গোত্রের আরেকটা উদাহরণ হল কোষের সেই চিরাচরিত রডগুলো- যাদের নানা কাজের উদাহরণ ওপরে দিলাম।
কোষের মধ্যে এরকম একটা মোটা দাগের শ্রম বিভাজনে বিজ্ঞানীরা মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে উঠছিলেন। একজাতের জিনিস কাঠামো বানায়, আরেকজাতের জিনিস অফিসের কাজ করে। একজাত দেওয়াল, আরেকজাত ফটোকপি মেশিন। টেবিল বনাম ল্যাপটপ। বেশ।
কাজেই বিজ্ঞানীরা যখন ঐ অদ্ভুত চেহারার রডগুলো দেখলেন, তাদের হিসেবমতে এগুলো হওয়া উচিত ছিল ইট-বালু-সিমেন্ট
এখানেই জীববিজ্ঞান দিল লেঙ্গি মেরে।
৪।
ব্যাপারটা একটু ঠিক করে বুঝুন- এমন কিন্তু নয় যে কোন একটা যন্ত্র লোহার সাথে লোহা বসিয়ে রডগুলো বানিয়েছে। তা হলে তাও মানা যেত- আমাদের ওয়েল্ডিং মেশিন মোটামুটি সেটাই করে। ঘটনা তা না। ঘটনা হল কোষের মধ্যে যন্ত্রগুলোই ইট হিসেবে কাজ করছে। অর্থাৎ একটার পর একটা যন্ত্র জোড়া লেগে লেগে লম্বা রডের মত এই আশ্চর্য হতবুদ্ধিকর কাঠামোগুলো তৈরি হয়েছে।
তো এই যন্ত্রটা তাহলে কী?
আমি আপনাকে একবাক্স হাতুড়ি বা শাবল দিলে আপনি হয়ত এদেরকে কোনমতে জোড়া দিয়ে বেঁধেছেঁদে একটা লাঠি জাতীয় কিছু বানাতে পারবেন। লাঠিটার চেহারা খুবই বীভৎস হবে, কিন্তু পারবেন তো। কিন্তু এই রডের মধ্যের যন্ত্রগুলো সেরকম মামুলি কিছু নয়- এরা বেশ জটিল বস্তু। ডিএনএর চার বর্ণমালা জানেন তো? সেই চার অক্ষরের এক অক্ষর তৈরি করার দায়িত্ব এই যন্ত্রের ওপর। অর্থাৎ ডিএনএ তৈরির এক চতুর্থাংশ মালমশলা তৈরি করা এর কাজ। এই কাজ থেমে গেলে মোটামুটি তৎক্ষণাৎ কোষের মৃত্যু।
কোন এক বিচিত্র হাস্যকর কারণে আমাদের কোষ এই মহামূল্যবান যন্ত্রগুলোকে ইট হিসেবে ব্যবহার করে এটাসেটা তৈরি করে চলেছে।
বাস্তবজীবনের কোন উপমা দিয়ে এই জিনিস ব্যাখ্যা করা কঠিন। আপনার পড়ার টেবিল বা ঘরের মেঝের কথা চিন্তা করুন। এই জিনিসগুলো যদি কাঠ পারটেক্স কনক্রিট দিয়ে তৈরি না হয়ে একরাশ ল্যাপটপ জোড়া লাগিয়ে তৈরি করা হয়- তাহলে ব্যাপারটা কেমন হত? যদি আপনার দেওয়ালের গঠন ইটের তৈরি না হয়ে ক্যালকুলেটর বা স্মার্টফোনের তৈরি হত?
কল্পনাটায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠার আগে আমাকে আরেকটা প্যাঁচ খেলতে দিন।
আমার মনে হয় আপনারা কল্পনা করছেন- একগাদা নষ্ট ল্যাপটপের ধাতব বডি একের পর এক বসিয়ে টেবিল চেয়ার বানানো হয়েছে। সেটা ভাবলে চলবে না। আসলে ভাবতে হবে যে ল্যাপটপ ঠিকই আছে, এবং সেটা তার মত কাজ করে যাচ্ছে। হয়ত কোন প্রোগ্রাম রান দিচ্ছে। সেই অবস্থায় তাদেরকে একটার ওপর একটা বসিয়ে দেয়াল মেঝে আসবাবপত্র বানানো হয়েছে।
কোষের ভেতরকার এই পরিস্থিতি সত্যিকার অর্থে বুঝতে হলে আপনাদের এরকম হাস্যকর কল্পনাই করতে হবে।
অর্থাৎ আপনার-আমার-সবার
এই হচ্ছে পরিস্থিতি।
৫।
কিন্তু এর মানে কী? কেন এরকম যন্ত্রপাতি দিয়ে কোষ রড তৈরি করে?
এই ব্যাপারটা নিয়ে এখনও ধুমিয়ে গবেষণা চলছে, এবং নিঃসন্দেহে আরো অনেকদিন চলবে। এর কারণ বিজ্ঞানীরা এর মধ্যে মোটামুটি বুঝতে পেরেছেন, এই যন্ত্র-রড বানানোর ব্যাপারটা একটা অত্যন্ত জটিল প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তির একটা কাজ হল যন্ত্রগুলোর কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করা।
কোষের ভেতরে তো আর কোন মানুষ বসে নেই- এর প্রত্যেকটা যন্ত্রই স্বয়ংক্রিয়, আর স্বয়ংক্রিয় বলে এদের বুদ্ধিশুদ্ধি নেই। বুদ্ধি না থাকার প্রধান সমস্যা হল এরা বোঝে না কখন থামতে হয়। একবার কোষের মধ্যে একটা যন্ত্র বানিয়ে ফেললে সেটা চাঁদের বুড়ির চরকার মত দাঁড়িকমা ভুলে কাজ করতেই থাকে, করতেই থাকে। যে যন্ত্রটার কাজ ডিএনএর অক্ষর তৈরি করা, তাকে তার মত চলতে দিলে অক্ষর বানাতে বানাতে একসময় সে কোষ ভাসিয়ে ফেলবে। সেটা কোন কাজের কথা নয়।
এজন্য কোষকে এই যন্ত্রগুলোর কার্যক্রম খুব শক্তহাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়- বিশেষ করে যন্ত্রটা যদি গুরুত্বপূর্ণ হয়।
এই নিয়ন্ত্রণের কয়েকটা প্রক্রিয়া এমনিতে আমরা অনেকদিন ধরেই জানতাম। যেমন- কোষ যখন বুঝতে পারে কোন যন্ত্রের প্রয়োজন ফুরিয়ে আসছে, তখন সে যন্ত্রটা বানানো বন্ধ করে দেয়, বা যন্ত্রের গায়ে একটা সুইচ বসিয়ে তাকে 'অফ' করে দেয়। কিন্তু এগুলো একটু ধীরস্থির পদ্ধতি- এর ফলে চটজলদি অবস্থার নিয়ন্ত্রণ হয় না। একটু সময় লাগে।
দু'হাজার চৌদ্দতে বিজ্ঞানীরা বের করলেন- দ্রুততম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি যন্ত্র দিয়ে রড বানানো।
ব্যাপারটা ঘটে এভাবে।
মনে করুন কোষের মধ্যে কোন এক জাতের যন্ত্র- ছবিতে যেটাকে লাল জ্বলজ্বলে দেখাচ্ছে- সেটা মনের আনন্দে ডিএনএর অক্ষর বুনে চলেছে। একসময় দেখা গেল, কোষে যথেষ্ট অক্ষর আছে, এ বেলা আর যন্ত্রগুলোর দরকার নেই। এটা বোঝার সাথে সাথেই যন্ত্রগুলো পটপট করে একটার সাথে আরেকটা লেগে রডের মত তৈরি হয়ে যায়। টর্চের আলো ফেললে এই রডগুলো অণুবীক্ষণ যন্ত্রে লাল হয়ে ধরে পড়ে।
এই অবস্থায় এরা মোটামুটি নিস্তেজ থাকে, কিন্তু নিভে যায় না। আবার দু'মিনিট পরে যদি কোষের নতুন করে ডিএনএর অক্ষর দরকার হয়, সাথে সাথে এই রডগুলো থেকে যন্ত্রগুলো একে একে বেরিয়ে তৎক্ষণাৎ কাজে লেগে যায়।
ব্যাপারটার সাথে কম্পিউটারের স্লিপ মোডের হালকা সম্পর্ক আছে। কম্পিউটার "শাট ডাউন" করতে বা বন্ধ কম্পিউটার খুলতে কিন্তু অনেকখানি সময় লেগে যায়। কিন্তু কম্পিউটারকে যদি স্লিপ মোডে রাখেন- তাহলে একে নিস্তেজ বানাতেও এক সেকেন্ড, নতুন করে খুলতেও এক সেকেন্ড। কোষ তার যন্ত্রগুলোর ক্ষেত্রে অনেকটা এরকম কিছুই করছে- একেবারে বন্ধ না করে নিস্তেজ করে রাখছে, আর সময় হলেই চট করে আবার চালু করে ফেলছে। নিস্তেজ করার প্রক্রিয়াটাই হল এদেরকে জড়ো করে রডের মত বানানো।
কোষের যেহেতু বুদ্ধির শেষ নেই, কাজেই সে মনে করে- রড যেহেতু বানিয়েছিই, ব্যাটাদেরকে দিয়ে কোষের দেওয়ালটাও এই বেলা একটু শক্ত করি।
এই মোটামুটি ঐ লাল রডগুলোর ব্যাপারস্যাপার।
এখন থেকে মোটামুটি মাসছয়েক আগে একদল গবেষক এই পুরো প্রক্রিয়াটা নিয়ে একটা বিশাল গবেষণাপত্র বের করেছেন। সাধারণত বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রের কলেবর ছয় থেকে বিশ পাতায় বাঁধা থাকে। এনাদের এই গবেষণাপত্র তথ্যসূত্র ছাড়াই ষাট পাতা। বোঝাই যাচ্ছে তারা ব্যাপারটা বোঝার জন্য রীতিমত কোমর বেঁধে লেগেছেন।
এই বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, এখন পর্যন্ত জীববিজ্ঞানে শতাধিক এরকম যন্ত্র পাওয়া গেছে যারা এরকম রড বানায়। এরা কেউই ইট বালু সিমেন্ট জাতীয় কিছু নয়, প্রত্যেকেই হাতুড়ি শাবল ল্যাপটপ ইলেকট্রনিক্স। এদের মধ্যে মোটামুটি দু'ডজন যন্ত্রের কাজকর্ম আকৃতি ইত্যাদি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ শেষে তারা উপসংহারে এসেছেন- এই যন্ত্র-কাঠামোগু
মানে হরেকরকম কাজ- একই জিনিস একই সাথে পানি পয়ঃনিষ্কাশন অবকাঠামো রাজস্ব সবদিকেই কাজে লাগছে।
এরকম আরো বিভিন্ন প্রেক্ষিতে শত শত যন্ত্র-কাঠামো হাজারটা কাজ করে চলেছে। একেকটা একেকরকম, আর পুরো ব্যাপারটাই একটা বিচ্ছিরি রকমের জটিল।
৬।
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একটা বিখ্যাত এবং অদ্ভুত এক্সপেরিমেন্টের
তাই বিজ্ঞানীরা শুধু এদের চেহারা কাজকর্ম বর্ণনা করে যাবেন। আমরা চুপচাপ শুনব। এখন শোনার সময়। আগে আরো কিছুদিন সবকিছু শুনে নেই, তারপর ব্যাখ্যায় যাওয়ার চিন্তা। আগেই ব্যাখ্যায় যেতে গেলে অন্ধ হাতির অবস্থায় পড়তে হবে।
অন্তত আমার নিজের কাছে জীববিজ্ঞান নিয়ে ভাবলে এরকমটাই মনে হয়।
তথ্যসূত্র-
যে যন্ত্রটার কথা বললাম তার নাম সিটিপি সিন্থেজ। এদের রড বানানোর ব্যাপারটার হদিস প্রথম পাওয়া গেছে এখানে- Ingerson-Mahar,
এরা এদের কাজ সম্পর্কে আরো লিখেছেন এই গবেষণাপত্রে- Barry, Rachael M., et al. "Large-scale filament formation inhibits the activity of CTP synthetase." Elife 3 (2014): e03638.
শেষের বড় গবেষণাপত্রটা এই- Park, Chad K., and Nancy C. Horton. "Structures, functions, and mechanisms of filament forming enzymes: a renaissance of enzyme filamentation."