ওয়ার্মথ ইজ দ্যা অনলি ট্রু ফুড

Science fiction bangla

(১)

বরফের শ্বেত আবরণের নিচে লুকিয়ে থাকা শতায়ু পেরোনো ভবনটির দেয়ালে কিছুক্ষণ রড দিয়ে আঘাত করতেই ইট খুলে পড়ল। গাটো তাই কুড়িয়ে নিয়ে কিছুক্ষণ পরখ করে এরপর হাত দিয়ে একটা একটা করে ইট টেনে খুলে আনতে লাগলো।

বেশিক্ষণ কষ্ট করতে হল না, অল্প একটু ফাকা জায়গা হতেই সুড়ুৎ করে এর মাঝে গলে গেল সে। পেছনে মলিন সূর্য বিরস বদনে বিষণ্ণ দিনের দর্শক হয়ে তাই চেয়ে দেখছিল। শত চেষ্টা করেও গাটোর সাথে নিজের রৌদ্রপ্রতাপ ওই ফোকর দিয়ে গলাতে পারল না। তার চাহনি কী ঈষৎ হতাশ ছিল?

শীর্ণ ভবনের ভেতরের অংশ মোটামুটি ঠিকই আছে বলা যায়। যৌবনকালে হয়তো বেশ জমজমাট লাইব্রেরি ছিল, এখন বার্ধক্যে উপনীত হয়ে সৃষ্টিগত পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়ার দিন গুনছে।* Down to just bricks and rubble.*

দেয়ালের গা ঘেষে সারি সারি করে সাজানো তাকভর্তি বই আর বই। সাহিত্য, ভাষা, প্রাণীজগৎ, ইতিহাস, ধর্ম, বিজ্ঞান আরো খটমটে নানান শ্রেণীতে ভাগ করা হাজার হাজার বই।

গাটোর বই অনেক পছন্দ। বই তার কাছে নতুন জগৎ-এর দুয়ার খুলে দেয় যেন। শীতের রাতগুলোতে যখন গা হিম করা বাতাস শরীরের প্রতিটা ইঞ্চিতে সূচের মত বিধে, গাটো তখন হয়তো তার বইয়ের পাতার কোনো জগৎ-এ মজে রয়েছে, যে জগৎ তারুণ্যেপ্লাবী, অরণ্যে ভরপুর, সূর্যের সোনালি উষ্ণতা নীল অম্বর ছুয়ে বিশ্রাম নেয় যে উর্বর-উদার ধরায়।

*উষ্ণতা... প্রাণের একমাত্র পরম খাদ্য!*

এই উষ্ণতার আশায় ইমিনরা পৃথিবী ছেড়ে উড়াল দিয়েছিল বহু আগেই। বসতি স্থাপন করেছে মরচেরঙা মঙ্গলের বুকে। গাটো তার বাবার কাছে শুনেছে মঙ্গলের বুকে নদী নেই, শ্বাস নেয়ার মত বাতাস নেই, কিন্তু উষ্ণতা আছে। স্রেফ এটার ওপর ভরসা করেই গত কয়েকশ' বছর ধরে একটু একটু করে মানুষদের পাঠানো হচ্ছিল। জাপানিজে ইমিন শব্দের অর্থ দেশান্তরী। প্রসঙ্গক্রমে গ্রহান্তরী অর্থটা বেশ মানায়।

আর তাই বইয়ের ভেতর গাটোর সবচেয়ে পছন্দের হল মঙ্গল গ্রহ নিয়ে লেখা কল্পবিজ্ঞান যার মাঝে কিম স্ট্যানলির রেড মার্স সিরিজ তার সর্বাধিক প্রিয়। গত বছর পরিত্যাক্ত কারো বাড়িতে ফুয়েল স্ক্যাভেঞ্জ করার সময় পেয়েছিল বইগুলো।

গাটো আর তার পরিবার হল ফুয়েল স্ক্যাভেঞ্জার্স। অর্থাৎ, তারা সারাদিন ঘুরে ঘুরে জ্বালানী খুজে নিয়ে আসে। বরফের স্তুপের নিচে চাপা পড়ে রয়েছে মৃত অরণ্য, তা খুজে বের করার জন্য চাই শ্যেনচক্ষু এবং বছরের পর বছর ধরে অর্জিত অভিজ্ঞতা। গাটোর বাবা এ বিষয়ে বেশ পারদর্শী।

একবার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারলে সেখানে ছোট একটা পতাকা বসানো হয়। এরপর জোয়ানের দলেরা সারাদিন পরিশ্রম করে জমাট বাধা গাছের ডালপালা উদ্ধার করে। বিশটা ডাল একত্রে বেধে প্যাকেট করে রাখে একজন, আরেকজন সেগুলো নিয়ে দূরে সাজিয়ে রাখে। প্রতিটা পরিবারের জন্য একরাতে তিনটা প্যাকেট নির্ধারণ করে দেয়া। অন্ধকার সম্পূর্ণ গ্রাস করে না ফেলা পর্যন্ত তাদের কাজ আর গান চলতে থাকে। প্রতিবার একই গান অনন্তকাল ধরে পুনরাবৃত্তি করতে থাকে তারা।

"আঁকা আঁকা তো সাইতা হামাবে নো হানা"

সৈকতে পড়ে আছে ফুল, আগুন হয়ে ফুটে আছে যেন

"হি নো হিকারি ও সান সান তো"

সূর্যের কিরণ এত উজ্জ্বল আজ!

"সোরা ইয়ো উমি ইয়ো হানা ইয়ো তাইয়ে ইয়ো"

হে আকাশ, সাগর, ফুল ও সূর্য

"শিমা নো ইনোরি তদোকে"

এই দ্বীপের প্রার্থনার পুনরুত্থান করো!

গানের অর্থ গাটো জানে, কিন্তু সে বোঝেনা এই গানটা চলাকালীন কেউ কোনো শব্দ না করে চুপচাপ কেন শুনতে থাকে। সবাইকে দেখে মনে হয় প্রার্থনায় রত, মৃদু ছন্দে কাজ করতে করতেই যেন সবাই দুলছে।

গাটো অনেক্ষণ ঘুরে ঘুরে দশটা বই বগলদাবা করল। এগুলো সে তাদের ঘরে নিয়ে যাবে।

(২)

গাটো যতক্ষণে ফুজি-সানে (মাউন্ট ফুজি) পৌছাল তখন সূর্যকে আকাশে আর খুজে পাওয়া যাচ্ছিল না, যদিও সন্ধ্যে নামতে এখনও বেশ দেরী। দূর থেকে এই বিশাল পর্বত চিনে নিতে কোনো সমস্যাই হয় না দিনের বেলা। তার অন্যতম কারণ হচ্ছে পাহাড়ের সামনে বিশাল স্থাপনার জন্য। লম্বা, একরোখা কাঠামোর চূড়া ফুজি-সানের চেয়েও ওপরে। আনুমানিক দেড়শ বছর আগে তৈরী করা হয়, শেষ ইমিনও গ্রহান্তর হওয়ার অনেক আগে। এটার কাজ কী গাটো জানে না তবে তাদের বুজোকুর (গোষ্ঠীর) সবচেয়ে বৃদ্ধ মানুষটা বলেন ইমিনরা এটা আমাদের জন্য বানিয়ে রেখেছে। আমরা যারা রেমুনান্তো আছি তাদের যাতে ভবিষ্যতে উপকার করা যায়, অসহায় হয়ে না পড়তে হয় তারই আশায় এটা স্থাপন করা হয়েছে। যদিও বাবা এবিষয়ে দ্বিমত পোষন করেন।

বলাইবাহুল্য ইমিনদের শেষ স্পেসশিপ আজ থেকে আশি বছর আগেই পৃথিবী ছেড়ে গিয়েছে। তাদের নিকট ভবিষ্যতে ফেরৎ আসার সম্ভাবনা একেবারেই নেই, আর প্রতিবছরই আমরা তাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। তারা আমাদের সাহায্য কোনোভাবেই করতে পারবে না। বাবা বলেন, যখন চুড়ান্ত মাইগ্রেশনের জন্য সিলেকশন চলছিল তখন তারা পুরো পৃথিবী থেকে মাত্র আটাশ হাজার দুইশ জনকে বাছাই করে নেয়। এর ফলে পুরো পৃথিবীতে মরে যাওয়ার জন্য ফেলে যাওয়া আশি লক্ষ মানুষ তীব্র প্রতিবাদ করে। আন্দোলন যত তীব্র হয়, উগ্রতা তত বৃদ্ধি পায়। ইমিনরা যাদের মাইগ্রেশনের জন্য নির্বাচিত করেছিল তাদের ওপর সাধারণ মানুষ,মানে অবশিষ্টরা, আক্রমণ করেছিল। ইমিনদের স্পেসশিপেও বোমা ফেলা হয়। মানুষের আক্রোশ, মৃত্যুভয় সবকিছুর বিস্ফোরণ হয়েছিল সে সময়।

তাই পরিস্থিতি ঠান্ডা করতেই ইমিনদের আন্তর্জাতিক সংস্থা, ইউএন পুরো বিশ্বে আগ্নেয়াগিরির কাছে যেখানে মানুষেরা উষ্ণতার আশায় বসতি গেড়েছিল, সেখানে বিশাল বড় বড় কাঠামো নির্মাণ করে দিয়ে যায়। এই স্তম্ভগুলো ভবিষ্যতে আশি লক্ষ মানুষের শক্তি চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এমন আশ্বাস দিয়েছিল তারা। তাদের বিশ্বজুড়ে এই বিশাল প্রজেক্টের কার্যতৎপরতা দেখে তখনকার সময়ের সাধারণ মানুষ একটু শান্ত হয়েছিল।

তবে বাবার মতে পুরো ব্যাপারটাই একধরণের ধোকাবাজি ছিল। আন্দোলন থামানোর একটা কৌশল মাত্র। নইলে গত দেড়শ বছরে বা আশি বছরে এই স্তম্ভ বা কাঠামোগুলো দিয়ে কোনো কাজ হচ্ছে না কেন? এগুলো কীভাবে শক্তির চাহিদা পূরণ করবে তা কেউ জানে না। যারা জানত তারা হয়তো বহু আগেই মারা গেছে বা আশি বছর আগে মাইগ্রেশনের জন্য নির্ধারিত হয়েছিল। যারা এসবের কার্যপদ্ধতি জানে তারা নিশ্চয়ই বুদ্ধিমান। তাই তাদের মঙ্গলে নেয়া হবে এই স্বাভাবিক ছিল। শুধু গণ্ডমুর্খের দলদের, তাদের মতে, পৃথিবী নামের এই বরফের গোলকের ওপর মরে যাওয়ার জন্য ফেলে যাওয়া হয়েছে। বাবা ওদের 'ককুযাকু ইমিন' বলেন। অর্থাৎ, বেইমান গ্রহান্তরীর দল।

আর আমরা, রেমুনান্তো। ফেলনা, অবশিষ্ট।

-"কীরে, এত দেরী করলি কেন? কোথায় ছিলি?"

-"মা, ওইদিকের পুকুরের পাশে একটা বিশাল বড় দালান আবিষ্কার করেছি। তুমি শুনলে বিশ্বাস করবে না মা! ওটা একটা আস্ত লাইব্রেরি!" গাটোর চোখ খুশিতে ঝলমল করে ওঠে।

গাটোর মায়ের মুখেও হাসির ঝিলিক দেখা যায়। "আচ্ছা তোর বাবাকে জানাস, কাল স্ক্যাভেঞ্জারদের পাঠানো যাবে।" বলেই মা একটু কাশলেন। "নতুন বই এনেছিস, আগেরগুলো পড়া হয়ে গেলে আমাকে দিয়ে দিস।"

-"আচ্ছা মা। তুমি মধু খেয়েছিলে? কাশ বাড়ছে মনে হয়?"

-"খাচ্ছি, চিন্তা করিস না। তুই দেরী করিস না, অন্ধকার হয়ে এল। আগুন জ্বাল তাড়াতাড়ি। মাছগুলোও বসিয়ে দে, যা!"

গাটো সুবোধ বালকের মত কাঠ একট্টা করে আগুন জ্বালিয়ে তার ওপর আজ পুকুর থেকে ধরা মাছ বসিয়ে দিল। অবশ্য আগে মশলা মাখিয়ে নিতে ভুলল না। ফুজি-সানের পাদদেশে খনন করে একটা পুকুর বানানো আছে যার ওপরের অংশ সবসময় বরফ হয়ে থাকে। তবে একটু পুরু বরফ ইনসুলেটরের মত কাজ করে, পুকুরের তাপ ধরে রাখতে সাহায্য করে। পুকুরের তলদেশ নিকষ কালো আধারে ঘেরা, ফ্ল্যাশলাইট নিয়ে গেলেও সুবিধা করা যায় না। গাটো জানে কারণ গতবার একটা ছেলে পানিতে পড়ে গেলে উদ্ধারকাজে সেও অংশ নিয়েছিল।

পুকুরের নিচেই রয়েছে ফুটন্ত লাভা! সেই লাভার কারণে তৈরী হয়েছে কিছু হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট, যেগুলোর উষ্ণতা আর কেমিক্যাল স্যুপ খেয়ে ঘন হচ্ছে এলগি আর ব্যাক্টেরিয়ার দল। সাথে আছে ছোট চিংড়ি, পাবদা আর পাঙ্গাসের সাম্রাজ্য। অত্যাধিক ঠান্ডার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে বিবর্তনের ফলে এখন এদের শরীরে অতিরিক্ত চর্বি আর তেল। এরকম আরো বিশটা পুকুর আছে তাদের, পুরো গোষ্ঠী পুরোপুরি মাছের ওপর নির্ভরশীল।

তবে মাঝে মাঝে ভাগ্য প্রসন্ন হলে তারা শ্বেত ভাল্লুক শিকারের অনুমতি পেয়ে যায়। এসব ভাল্লুকেরা বরফের আচ্ছাদন ভেঙে পুকুরে ডুব দিয়ে ছ'ইঞ্চি ধারালো নখের মাঝে মাছ বিধে ওপরে উঠে আসার সময় গা টান টান করে প্রস্তুত থাকে বর্শাবাজের দল। ভাল্লুকের মুখ পানির ওপরে বের করার সাথে সাথে এফোড় ওফোড় করে বেড়িয়ে যায় চকচকে ফলা যা ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে লোহিতবর্ণ ধারণ করার আগেই জমে যায় রক্তের ধারা।

সে রাতে ভোজ অনুষ্ঠান হয়, গাটোর খুব ভালো লাগে!

(৩)

নিজের ঘরে এসে বইগুলো একপাশে সাজিয়ে রাখল গাটো। তার ঘরের দেয়াল পুরোটাই বিভিন্ন সংখ্যা, চিহ্ন দিয়ে ভর্তি। কাছে থেকে দেখলে বোঝা যায় এগুলো অসংখ্য অমীমাংসিত সমীকরণের ছড়াছড়ি। গাটোর বই পড়ার পাশাপাশি আরেকটা শখ হল তাপ থেকে ইলেক্ট্রিসিটি তৈরি করা। সমস্যা বাধে সার্কিটে। সার্কিটের তারের মাঝে তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিলে ভেতরের এটম বা অণুগুলো বেশি ভাইব্রেশন করে, যার ফলে ফ্রি ইলেকট্রনের চলার পথে বাধা সৃষ্টি করে। অর্থাৎ, তাপমাত্রা বাড়ালে রেজিস্ট্যান্স বেড়ে যায়, ইলেক্ট্রিসিটি কমে যায়।

সেই তাপ যদি হাজারখানেক সেলসিয়াস হয়? তাহলে সার্কিটই পুড়ে যাবে, কারণ এত তাপে ভেতরের কপারের তার অনেক আগেই গলে যাবে। আর যদি এমন কিছু দিয়ে তার বানানো হয় যার থার্মাল স্ট্যাবিলিটি বেশি তারপরেও এরা এত নাচানাচি করবে যে ইলেক্ট্রন আর সার্কিট ঘুরে আসতেই পারবে না। ইফিশিয়েন্সি শূণ্যতে নেমে আসবে!

অথচ এখন এই উচ্চ তাপই ভরসা৷ ফুজি-সানের নিচে পাথর গলানো সমুদ্র রয়েছে, হাজারখানেক সেলসিয়াস তাপমাত্রার ম্যাগমা থাকতে তার গোষ্ঠীকে এনার্জি ক্রাইসিসে ভুগতে হচ্ছে? কোনো না কোনো উপায় তো আছেই!

তাপ বলতে বোঝাই অণুদের ছোটাছুটি, তাদের কাইনেটিক এনার্জি। কাইনেটিক এনার্জিকে ব্যবহার করা এত কঠিন কেন লাগছে তাদের কাছে? ইমিনরা সব নিউক্লিয়ার পাওয়ার স্টেশন থেকে আর পৃথিবীর গর্ভ থেকে সব ইউরেনিয়াম শুষে না নিয়ে অন্তত কিছু রেখে যেতে পারত!

গাটোর মাথায় সোলার প্যানেল ঘোরে৷ টেলুরিয়ামের এক কমপাউন্ডের তৈরি সোলার প্যানেলগুলো সরাসরি সূর্যের আলো থেকে পাওয়া এনার্জি দিয়ে একটা ইলেক্ট্রনকে ধাক্কা মেরে সার্কিটে চলাতে বাধ্য করতে পারে। আর এখানে এটমের কিছু হয় না, তার ভাইব্রেশনও তেমন বাড়ে না। কিন্তু সূর্য থেকে ৬ এস্ট্রোনোমিকাল ইউনিট দুরত্বে সোলার প্যানেল সামান্য ফ্ল্যাশলাইট চার্জ দেয়া ছাড়া আর কোনো কাজে আসে না। অথচ ক্রমশই এ দুরত্ব বেড়েই চলছে। পৃথিবী এখন আকাশগঙ্গায় ছূটে চলা গন্তব্যহীন ভবঘুরে এক গ্রহ!

(*গাটোর দৈনন্দিন জীবনের গল্প শোনার এই পর্যায়ে দৃশ্যপট হুট করে বদলে যাবে। গাটোর ঘর থেকে দৃশ্যটা ওপরে উঠতে থাকবে এবং একপর্যায়ে মাউন্ট ফুজির চেয়েও অনেক ওপরে উঠে যাবে। ওপর থেকে যখন সবকিছু ক্ষুদ্র, নগণ্য লাগবে, ঠিক তখনই এই স্থানের সময় বদলে যাবে এবং আমরা দেড়শ বছর আগের দৃশ্য অবলোকন করব*।)

**************

দেড়শ বছর আগে

মাউন্ট ফুজির কাছে বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে। সূর্য থেকে পৃথিবী মাত্র ১.৫ এস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট দূরে কী সরে গেছে আর গড় তাপমাত্রা হুট করে ১০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে এসেছে! শীতে কাপতে কাপতেই প্রজেক্ট সানরাইজ এর তদারকি করছিলেন নাতিশীতোষ্ণ দেশ থেকে আসা ঔষ্মপ্রিয় মেজর সালমান হক।

মাউন্ট ফুজি জাপানের সবচেয়ে উচু পর্বত এবং একটি আদর্শ আগ্নেয়গিরি। স্থানীয়রা একে ডাকে ফুজি-সান বলে, অনেকটা মানুষের নামের শুরুতে মিস্টার সম্বোধনের মত।

জাপানীদের শ্রদ্ধার চোখে দেখেন সালমান। এরা বেশ কর্মঠ, সৎ ও আশাবাদী হয়ে থাকে, যার প্রমাণ হল পর্বতের সামনে দাড়িয়ে থাকা বিশাল স্তম্ভের অবকাঠামো। এত দ্রুত পৃথিবীর আর কোথাও কাজ এগোয়নি।

-"স্যার", এলোকেশী এক সৈনিক এসে সটান স্যালুট মেরে বলল, "হেডকোয়ার্টার কলড ফর আ মিটিং। দে আর ওয়েটিং অ্যাট ইয়োর পার্সোনাল লাইন, স্যার।"

ইশারায় তাকে চলে যেতে বলে তার নিতম্বের দুলুনির দিকে চেয়ে মিটিং-এ কী বলতে হবে তা ঠিক করে নিলেন মেজর হক। দীর্ঘ ২০ বছরের মিলিটারির জীবনের প্রমাণ লেপ্টে থাকা অনুভূতিশূণ্য চেহারা নিয়ে হাটা দিলেন তার চেম্বারে।

***

-"মেজর হক, আমরা আবারও জানতে চাচ্ছি ঠিক কীভাবে বিক্ষোভকারীরা আপনার তত্ত্বাবধায়নে থাকা প্রজেক্ট সানরাইজের নির্মাণ স্থানে ঢুকে গন্ডগোল বাধাল?"

মেজর হক মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মিটিংএর বিশ মিনিট ইতিমধ্যে পার হয়ে গেছে, সেদিনের ঘটনা পুরোটা ব্রিফও করেছেন তিনি, অথচ এই একই প্রশ্ন এই নিয়ে তিনবার করল তারা। প্রজেক্টের বোর্ড অফ কমিটি।

-"আপনারা যদি সিসি ফুটেজ লক্ষ্য করেন, আপনারা দেখবেন কোথাও তাদের আনাগোনা চোখে পড়বে না। সি-জোনের ভিত্তির কাছে ব্লাস্ট হওয়ার পর সবাই সতর্ক হয় এবং তখন অনেককে ছুটে পালিয়ে যেতে দেখা যায়। আমার সৈনিকরা তাদের ওপর ফায়ার করলে তাদের অনেকে মারা পরে আর বাকিদের আমরা গ্রেফতার করেছি", একটু থেমে আবার শুরু করেন সালমান, "আমার মনে হয় তারা খুব ভালো করেই জানত পুরো সাইটের কোথায় কী রাখা, এবং সিসি ক্যামেরাগুলোর রেঞ্জ কতটুকু। সবকিছু একটা ব্যাপারেই ঈঙ্গিত করে যে ভেতর থেকে তাদের কেউ সাহায্য করেছে।" মেজর থামলেন।

-"আপনার সৈনিকদের ভেতর কাউকে সন্দেহ করেন, মেজর?"

-"ওয়েল, স্যার, প্রজেক্টে শুধু আমার সৈনিকরাই নেই। কিছু বিজ্ঞানী, মেকানিক, কর্মী ও ইঞ্জিনিয়ারও কিন্তু রয়েছে।"

-"কিন্তু শুধুমাত্র আপনার সৈনিকরাই পুরো সাইটে অবাধে চলাফেরা করতে পারে মেজর। বাকিদের সে সুযোগ বা অনুমতি কোনোটাই নেই।"

-"রাইট, স্যার।" মেজর চুপ করে রইলেন।

-"আপনি হয়তো ব্যাপারটার গুরুত্ব ভুলে যাচ্ছেন মেজর। পুরো পৃথিবীতে আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করেছে। আজ সকালে যেই মাইগ্রেশন শিপের ৫০২ জন মানুষ নিয়ে মঙ্গলে রওনা হওয়ার কথা ছিল তা এই উগ্রপন্থীর দল গত মাসে বোমা মেরে ব্য[পক ক্ষতিসাধন করেছে। এর উপর যদি আপনার নাকের ডগা থেকে কনসেন্ট্রেটেড টেলুরাইড সেল চুরি হয়ে যায় তাহলে তো সমস্যা। সাধারণ মানুষদের জন্য আমাদের যে প্রজেক্ট সানরাইজ তার ক্ষতি করার জন্য আমাদের দায়িত্ব দেয়া হয়নি, মেজর। পুরো পৃথিবীর রাষ্ট্রপ্রধানেরা জবাবদিহিতা চায়, একটা চেহারা চায়। আপনি বুঝতে পেরেছেন?"

-"জ্বী, স্যার।"

-"তাহলে আবার প্রশ্ন করি, মেজর। আপনি কাউকে সন্দেহ করেন?"

-"একটা মেয়ে সৈনিকের আচরণ আমার কাছে সন্দেহজনক মনে হয়", মেজর হক শান্ত দৃষ্টিতে বোর্ড অফ কমিটির দিকে চেয়ে বললেন, "এলোকেশী, এস-৩৬৫।"

-"গুড, মেজর। বোর্ড অফ কমিটি চাইবে শীঘ্রই এই ব্যাপারটা বিহিত করে টেলুরাইড সেল খুজে বের করুন। নতুন করে আর সেল বানানোর মত টেলুরিয়াম গ্রহে অবশিষ্ট নেই। দ্যাট উইল বি অল।"

স্ক্রিন বন্ধ হতেই বোতল থেকে কিছুটা তরল গ্লাসে ঢেলে নিয়ে জানালার পাশে দাড়ালেন মেজর হক। নট অল ক্যান বি আ সার্ভাইভার বাট অল মাস্ট ফাইট দ্যা সেম।

(৪)

সবারই কমবেশি খুক খুক কাশি হচ্ছে। মায়ের কাশির সাথে রক্তও বের হতে দেখেছে গাটো। বেশিদিন হয়নি তামারা-সান কাশতে কাশতে একপর্যায়ে মারা যায়। শেষদিন তার চেহারায় ছোট ছোট অসংখ্য দাগে ভরা ছিল। সবাই বলাবলি করছে এটা কোনো জীবাণু। মায়ের দেখভালে কোনো কমতি রাখছে না সে। পুকুর থেকে গরম পানি কষ্ট করে তুলতে পারলে মাকে এনে দিচ্ছে, গরম আবহাওয়ায় থাকলে উপশম মেলে।

এজন্যেই গাটো আরো দ্রুত তার সমীকরণ দাড় করাতে চায়। সেটা না হলেও অন্তত কোনো ডিভাইস তৈরী করতে চায় যেটায় তাপশক্তি সহজেই ইলেক্ট্রিসিটিতে পরিনত করা যাবে।

এটমের ভাইব্রেশন কীভাবে স্থির রাখা যায় তাই ভাবছিল গাটো। কোনো লেজার ব্যবহার করা সম্ভব যেই লেজারের ফ্রিকোয়েন্সি এমন হবে, আর লেজার নিজেও এতটা সূক্ষ হবে যে একটা এটমের দু পাশ দিয়ে সেটাকে জায়গামত ধরে রাখবে? কিন্তু যেটার ফ্রিকোয়েন্সি এমন বড় হবে যা ইলেক্ট্রনের সাথে কোনো মিথস্ক্রিয়া করবে না। এমন কিছু সে এখন বানাতে পারবে না, তবে যদি কোনোভাবে এই লেজারের বৈশিষ্ট্যগুলো অংকে বের করতে পারত, কতই না ভাল হত। হয়তো কেউ বানিয়েও দিত।

এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে কুমা কুইকিতে চলে এসেছিল খেয়াল করেনি। হঠাৎ দাড়াতেই চারপাশ কেমন আরো বেশি নির্জন লাগতে শুরু করল। থমথমে পরিবেশ আরো গম্ভীর করতেই যেন বাতাসের শো শো শব্দ কমে এল। একটুখান শব্দের জন্য কান দুটো টান টান করে বাড়িয়ে দিল গাটো, কানে কী কোনো শব্দ শোনা গেল?

চারিদিকে ধূ ধূ সাদা তুষারে ঢাকা ভূদৃশ্যে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখ ধাধিয়ে যায়, ছোট্ট তুষারকণা চোখ ফুটা করে ঢুকে যেতে চায় যেন, কিন্তু তাও গাটো যতটা পারে চোখ মেলে মরিয়া হয়ে চারিদিকে তাকাতে লাগল। কারণ তার কান কিছু একটা শুনেছে। কিছু একটা।

অমনি চোখের ডান পাশের প্রান্তদৃষ্টে কিছু একটার নড়াচড়া লক্ষ্য করল সে। সাথে সাথে ঘুরে তাকাতেই দেখে পুরো সাদা ভারীক্কী একটা শরীর তার দিকে ধেয়ে আসছে, মাথার জায়গায় শুধু দুটি কালো গর্তই যেন দৃশ্যমান!

কালবিলম্ব না ভেবে উল্টোদিকে দৌড় দিল গাটো, একবার ডাইয়ে মোড় নেয় একবার বায়ে। সে খুব ভাল করেই জানে সোজা দৌড়ালে কখনোই এর সাথে পেরে উঠবে না। সামনে পাথরের চাই দেখে সেদিকে যাওয়ারই মনস্থির করল সে।

'*কুমা কুইকি*', ভাল্লুকের আস্তানায় এসে পড়েছে সে!

*********************

দেড়শ বছর আগে

পূর্ণিমার চাঁদ ঠিক কতটা ক্ষীণ হয়ে গেছে তা বোঝা না গেলেও এর উপস্থিতিতে যে আরসা মেজর নক্ষত্রমণ্ডল দেখা যাচ্ছে তাতেই ধারণা করে নেয়া যায় কতটা দুর্বল এর আলো।

আরসা মেজর অর্থাৎ বড় স্ত্রী ভাল্লুক। খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকেও এটা কীভাবে একটা ভাল্লুকের সাথে তুলনা করা যায় তা ভেবে পেলেন না মেজর হক। রক্তাক্ত হাতের মুঠো রুমাল দিয়ে মুছে নিয়ে সামনে পাথরের চাই এর দিকে এগোলেন। ছোট্ট একটা গুহার মুখে এক বেটে আকৃতির মানুষ দাঁড়ানো।

-"এনেছ?" কোনো সূচনায় না গিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন মেজর।

-"আপনি এনেছেন?" পাল্টা প্রশ্ন করে লোকটা।

সাথে সাথে কলার চেপে ধরে দেয়ালের সাথে ঠেসে ধরে তাকে মেজর হল। "বানচোত, আমার সাথে স্মার্টগিরি দেখাস?" খাস বাংলায় উচ্চারণ করা কথা কিছু না বুঝলেও এর ভাবার্থ বুঝতে কোনো সমস্যা হল না লোকটার। আঙুল দিয়ে গুহার ভেতরের দিকে নির্দেশ করল সে।

মেজর সেদিকে তাকাল। একটা কালো কাপড়ে ঢাকা দুটো কাঠের বাক্স এনে রাখা। ইশারা করলেন মেজর। লোকটা ভারী কাঠের বাক্স তুলে মেজর হকের গাড়ির ডেকচিতে রাখা শাবল আর কোদালের পাশে উঠিয়ে দিল।

লোকটার দিকে ফিরে পকেট থেকে একটা স্পেশাল পাস বের করে দিলেন তিনি। "তোমার পরিবারের জন্য। এতে তোমার আর তোমার স্ত্রীর নামসহ রেজিস্টার্ড টিকেট রয়েছে। এখন আমার চোখের সামনে থেকে দূর হও। আমরা কেউ কাউকে চিনি না।"

লোকটা ছোঁ মেরে স্পেশাল পাস নিয়ে মাথা নুইয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে গেলে মেজর তার ট্রান্সমিটার বের করলেন। আজ রাতে উগ্রবাদীদের এমবুশ করার জন্য নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় অপারেশন হবে, তারই নির্দেশনা দিলেন ।

ক্ষয়িঞ্চু আলোর চাঁদ লজ্জা পেয়ে শেষে কুয়াশার আড়ালে হারিয়ে যাওয়ার খানিক পরেই মেজর হক তার গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন। যেকোনো মিশনেই তার টান টান উত্তেজনা অনুভব হয়, এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। বিশেষ করে যেখানে মিশনের ওপর নির্ভর করছে তার পরিবারের বেচে থাকা!

******

বারবার দিক পরিবর্তন করে ছুটে চলছে গাটো। প্রতিবার টার্ন নেয়ার সময় মনে হয় এই বুঝি ভাল্লুকের থাবায় তার শরীর দু'ভাগ হয়ে যায় মাঝবরাবর। আর সামনে উচু নিচু কিচ্ছু তেমন বোঝা যাচ্ছে না। চারিদিক অসহ্যরকম সাদা! একবার হোচট খেলেই হয়েছে। পেছনে তাকানোর সাহসটা পর্যন্ত পাচ্ছে না।

পাথরের চাইয়ের ওপর কয়েক লাফে উঠে গেল গাটো। দাঁড়িয়ে একটু ব্যালেন্স হওয়ার জন্য মুহুর্তখানেক সময় নিতেই ভাল্লুকটা নিচে এসে দু'পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। গাটো পায়ের কাছে একটা গর্তে মত দেখে সেখানে লাথি মারতেই মুখটা আরেকটু বড় হল। কোনোরকমে কষ্ট করে সেখান দিয়েই ঢুকে পড়ল।

গাটো নিচে পড়াতে ধপ করে শব্দ হল, এবং সাথে সাথেই সেটার প্রতিধ্বনি হল। চারপাশে ভাল করে তাকিয়ে গাটো বুঝল এটা একটা প্রাচীন গুহা। বরফের স্তরের নিচে চাপা পড়ে গেছে এর প্রবেশদ্বার। ওপরের উচু অংশের সামান্যই দৃশ্যমান ছিল।

গুহার মুখের সামনে বরফের পর্দা। তার গায়ে ওপাশের ভাল্লুকের অস্পষ্ট ছায়া দেখতে পেল গাটো। ঘুরে ঘুরে গন্ধ শুঁকছে। এটা ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত গাটো বের হতে পারবে না।

গুহার ভেতরে বরফের তীব্রতা তেমন নেই। হয়তো ফুজি-সানের এত কাছে বলেই এর নিচেও ম্যাগমা আছে যা গুহার ভেতর তাপমাত্রা হালকা উষ্ণ রেখেছে। অন্ধকারে হাতরে একটা জায়গা খুজে নিয়ে বসে পড়ল সে। হাত পা গুটিসুটি করে বসে কাপতে কাপতে নিচে খোচা অনুভব করল। হাত দিয়ে আন্দাজে যা বুঝল কিছু তীক্ষ্ণ জিনিস আছে এখানে। পকেট থেকে পেন্সিল টর্চ বের করে অল্প আলোতে দেখার চেষ্টা করল গাটো।

নাক লাগিয়ে দেখে তার পিলে চমকে ওঠার মত অবস্থা হল। কঙ্কাল! এটাতো মানুষের কঙ্কাল! কত পুরোনো এটা?! মনে মনে পাহাড়ের দেবতা ইয়ামাকোর কাছে প্রার্থনা করল সে। মৃত লাশের কাছে ক্ষমা চেয়ে অনেক কষ্টে বুকের নিচের অংশের একটা ফলস রিব ভেঙে নিল। হাতে একটা হাতিয়ার থাকলে মনে বল আসে। এরপর জায়গা পরিবর্তন করে পুরো গুহাটা আরো একবার খুজে দেখা শুরু করল। টর্চের আলো ছয় ইঞ্চির বেশি জায়গা দেখাচ্ছে না।

পুরো গুহার মাটি চষতে চষতে একপর্যায়ে ঠুক করে আওয়াজ হয়। গাটো হাত দিয়ে মাটি সরিয়ে খুড়তে থাকে সেখানে। একপর্যায়ে পুরো বাক্স উদ্ধার করে আনে সেখান থেকে।

প্রায় পচে যাওয়া কাঠের বাক্স, ভেতরে একটা বড় কুচকুচে কালো সিলিন্ডার।

(৫)

আনুমানিক ছয়শ বছর আগে

সন ২০২০

ইউরোপীয়ান স্পেস এজেন্সির মহাকাশে অবস্থিত অবজার্ভেটরি, গায়া, বেশ অনেক বছর ধরেই বিভিন্ন এস্ট্রোনমিক্যাল বডির ওপর নজর রাখছিল। টানা সাত বছর ডাটা এনালাইসিস করার পর বেশ বড় একটা ধাক্কা খায় পৃথিবীর সবাই।

Gliese 710 নামের সূর্যটি লাল দানবে পরিণত হয়েছিল বহু আগেই। সূর্যের ভরের মাত্র ২৯% আর আকারে ছোট্ট এই নক্ষত্রটি প্রবল বেগে ধেয়ে আসছে পৃথিবীর দিকে! আগামী পাচশ বছরের মধ্যে এটা পৃথিবী ও মঙ্গলের কক্ষপথের পাশ কেটে চলে যাবে। সে সময় মঙ্গল আমাদের সূর্যের অপর পাশে থাকলেও পৃথিবী থাকবে ওই লাল দানবের খুবই কাছে।

তার মাধ্যাকর্ষণের ফলে পৃথিবীর কক্ষপথ সূর্য থেকে দূরে সরে এসে অনেকটা সোজা পথ তৈরী করে দেবে। আর সেটার কাছ থেকে গ্র্যাভিটিশনাল স্লিং শটের মত পৃথিবীর গতি আরো বেড়ে গিয়ে সহজেই সৌরজগৎ থেকে বের হয়ে যাবে, যাযাবরের মত ঘুরে বেড়াবে অনির্দিষ্টকাল।

তার আগে থেকেই শুরু হবে উল্কাপাতের বিপর্যয়। আনুমানিক দেড়শ বছরের মাঝেই সেটা শনি গ্রহ পার করে ফেলবে, এবং উল্কার কক্ষপথ বদলে দেবে। স্বাভাবিকভাবেই সেগুলোর অনেকগুলোই পৃথিবীতে আছড়ে পড়বে।

অবধারিত এই বিপর্যয় ঠেকানোর জন্য বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ দেশ একত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলেন। মানবজাতিকে রক্ষার জন্য তারা শুরু করলেন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় প্রজেক্ট। সবাইকে মঙ্গলে স্থানান্তর করার কাজ শুরু হল। অধিকাংশ ডিপার্ট্মেন্ট থেকে ফান্ড সরিয়ে সব টাকা পয়সা আর রিসোর্স খরচ হল স্পেস মিশনগুলোতে। স্পেস ফার্মিং, আয়ন ইঞ্জিন, বিশাল বড় বড় স্পেসশিপের তৈরী করা সবকিছুই দ্রুততার সাথে চলতে থাকল। প্রতি দশ বছর পর পর অনেক মানুষকে পাঠানো শুরু হল।

এরপর পৃথিবী আর কখনোই স্থির ছিল না।

************************

মেজর হক তার স্ত্রী আর সন্তানের সাথে একত্রে ডিনার করছিলেন। উল্কাপাত ইদানীং বেশ বেড়ে গেছে। সবাই আতঙ্ক নিয়ে থাকে কবে কোথায় হুট করে উল্কা পড়ে তাদের মৃত্যুবরণ করতে হয়। তাদের সন্তানদের জন্য অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এর কথা চিন্তা করে সবার মাঝেই একধরনের উগ্রতা বেড়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ প্রতিহিংসাবশত মানুষদের স্থানান্তর করার কাজে বাধা পর্যন্ত দিচ্ছে। পৃথিবীর জনসংখ্যা মাত্র ১০০ মিলিয়নে নেমে এসেছে। আগামী একশ বছরে এটা মাত্র ৮ মিলিয়নে নেমে আসবে এমনটাই ধারণা করেছেন বিজ্ঞানীরা।

বিদ্রোহীরা মনে করে শুধুমাত্র সুবিধাপ্রাপ্ত যারা তাদেরকেই মাইগ্রেশন প্রজেক্টের জন্য নির্ধারণ করা হয়। ব্যাপারটা সেরকম না, নইলে তিনিও স্পেশাল পাস পেয়ে যেতেন। তিনি বা তার পরিবার কেউই স্পেসশিপে ওঠার জন্য মনোনীত হননি। অর্থাৎ, মেজর হক তার সন্তান আর স্ত্রীর ভবিষ্যৎ যারপরনাই অনিশ্চয়তার পেন্ডুলামে দুলছে। তাদের দিকে তাকিয়ে কী যেন চিন্তা করেন তিনি।

হঠাৎই একটা মেসেজ আসে। অপরিচিত। সেখানে তার আর ওই জাপানীজ লোকটার সাথে কী কথাবার্তা হয়েছে তার রেকর্ডিং আছে। মেসেজে আরো লেখা, "একই জায়গা, একই সময়।”

কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন সালমান। তাকে নিয়ে কেউ খেলতে চাচ্ছে। কে হতে পারে?

রাতে আবারও সে জায়গায় গেলে দেখতে পান গুহার সামনে একটা মহিলা দাঁড়ানো।

-”কে?”

-”মিলিটারির লোক বলেই সময়মতো এসেছেন নাকি প্রাণের ভয়ে?” মহিলা বলে।

-”কথা খরচ না করে কাজের কথায় আসা যাক।” মেজর দ্রুত কাজ সারতে চাচ্ছেন। “কী চাই আমার কাছে?”

-”আপনার কাছে সেটাই চাই মেজর যেটা আমার স্বামীকে দেয়ার কথা ছিল। তা না করে তাকে মিথ্যা পাস দিয়ে বিদেয় করেছেন। এরপর আপনার কুত্তাদের লেলিয়ে তাকে মেরে ফেলেছেন। যে চুরির দায় তাকে দেয়া হয়েছে সেটা আপনিই করিয়েছেন!” মহিলার গলা ধরে আসে।

বিরক্ত হলেন মেজর। এটাকেও সরিয়ে ফেলা উচিৎ ছিল। শালীর লাশটা এখানে ফেলে রাখলে কারো খুজে পাওয়ার কথা না।

-”আমি স্পেশাল পাস ইস্যু করার ক্ষমতা রাখি না। আর ভিডিও ফাস করার হুমকি দিয়েও লাভ নেই।”

-”তা হয়তো সত্যি, কিন্তু কোনো আন্তর্জাতিক উগ্রপন্থী আতঙ্কবাদীর পুরো দল ধরিয়ে দিলে নিশ্চয়ই রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাওয়া যায়? অর্থাৎ স্পেশাল পাস!” মহিলা বলে।

-”তো?”

-”আপনার প্ল্যান আমি জানি মেজর। গত মাসে স্পেসশিপে বোমা বিস্ফোরণকারী আতঙ্কবাদী আপনিই সৃষ্টি করেছেন। বিভিন্ন সময় বিচ্ছিন্নভাবে মানুষদের উস্কে দিয়েছেন, তাদের দিয়ে বিভিন্ন কাজ করিয়েছেন। গত দু বছরে যতগুলো ঘটনা ঘটেছে সব আপনার উস্কানিতে। এসব মানুষ একে অপরকে সেভাবে চেনেও না। সাধারণ মানুষদের স্পেশাল পাসের লোভ দেখিয়ে একটা অস্থিরতা তৈরী করেছেন আপনি। প্রজেক্ট থেকেও টেলুরিয়াম সেল আপনিই চুরি করিয়েছেন। যার বাক্স নিজের বাসায় নিয়ে যেতে আপনার গার্ড দেখেছে, সে সাক্ষী দেবে। আপনার প্ল্যান ছিল এ সংগঠনের লোকদের ধরিয়ে দিয়ে নিজের স্পেশাল পাস নিশ্চিত করা। ভাবেননি হয়তো এভাবে ধরা পড়ে যাবেন।”

-”কে তুই?”

মহিলা মাথায় পরচুলো লাগিয়ে তাকাল মেজর হকের দিকে।*** **এলোকেশী!*

-”চিনতে পারছেন? অবশ্য চেহারায় কী যায় আসে, সারাক্ষণ তো আমার কোমড়েই চোখ আটকে রইত আপনার। আমি এজেন্ট ইলোরা। গত বছর আমাকে রিক্রুট করা হয় প্রজেক্টে কোনো গাদ্দার আছে কীনা খুজে বের করতে। বেশ অনেকদিন ধরেই ইন্টেল কালেক্ট করতে যেয়ে দেখি কীভাবে যে আপনার হস্তক্ষেপ সব জায়গায়। এরপর আপনার ওপর বিশেষ নজর রাখা হয়। সেদিন বোর্ড অফ কমিটিকে আমার নাম সন্দেহের তালিকায় দেয়ার সময় তারা কত কষ্টে হাসি আটকে রেখেছিল তাই ভাবছি!”

মেজরের পায়ের তলায় হুট করে মাটি সরে যেতে থাকে। এতদিন ধরে গড়ে তোলা প্ল্যান এই পুচকে এজেন্টের জন্য কিছুতেই নষ্ট হতে দেয়া যাবে না। পকেট থেকে পিস্তলটা বের করতে করতে এক হাতে জোরে ধাক্কা দিলেন ইলোরাকে।

ইলোরা ট্রেইন্ড কমব্যাটেন্টের মত সামলে নিয়ে মেজর সালমানের হাত ধরে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দিল। মট করে আওয়াজ হতেই মেজরের মুখ ব্যাথায় বিকৃত হয়ে গেল। অস্ফুট শব্দ করে পা ভাজ করে পেছন দিকে একটা লাত্থি ছুড়লেন তিনি, সরাসরি ইলোরার তলপেটে গিয়ে লাগল সেটা। হাতে ধরা পিস্তল ইলোরার দিকে তাক করতেই সাথে সাথে হাতে তাইকওন্ডু কিক পড়ল। হাত থেকে পিস্তল নিচে পড়ে গেলে ইলোরা সেদিকে হাত বাড়াল। পা দিয়ে পিস্তলে লাত্থি মেরে গুহার ভেতরের দিকে পাঠিয়ে দিলেন মেজর।

এই অন্যমনস্কতার ফলে ইলোরা মেজরের হাটুতে কষে একটা লাত্থি মারতে পেরেছিল, কিন্তু ব্যালেন্স না রাখতে পারায় মেজর তার গলা চেপে ধরে রাখে। মেজর জানে বেশিক্ষণ এভাবে ধরে রাখলে ইলোরা আবার বেজায়গায় আঘাত করে বসবে তাই তাকে দু হাতের শক্তি এক করে গুহার ভেতরের দেয়ালে ছুড়ে মারলেন। ইলোরা প্রচন্ড জোরে ধাক্কা খেল।

মেজর কালবিলম্ব না করে ইলোরার দিকে প্রচন্ড গতিতে ছুট দিলেন। উদ্দেশ্য তাকে ধাক্কা দিয়ে মাথাটা পাথুরে দেয়ালে ঠেসে ধরা। কিন্তু ইলোরা একেবারে শেষ মুহুর্তে ডান পাশে ডাইভ দিয়ে সরে গেল। মেজর অল্পের জন্য দেয়ালে ধাক্কা খেলেন না। ঘুরে তাকাতেই দেখেন ইলোরা উঠে দাড়িয়েছে, হাতে পিস্তল ধরে রাখা।

*শিট! দেয়ালের কাছেই তো পিস্তলটা ছিল।*

কিছু বলার আগেই ইলোরা ট্রিগার টেনে দিল। পরপর দুটো বুলেট এসে বিধে রইল মেজরের বুকে। ধুপ করে মাটিতে পড়ে গেলেন তিনি।

শান্ত ভঙ্গিতে ইলোরা হেটে কাছে এসে মেজরের কপালে পিস্তলের নল ছুইয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকল। এরপর উঠে যাওয়ার সময় বলল, “ডাই স্লোলি মেজর, নো নিড টু রাশ।”

***

ইলোরা যখন তার হেডকোয়ার্টারে খবর দিতে ব্যস্ত তখন মেজর হক তার জীবনের শেষ প্রাণবায়ু খরচ করে পকেট থেকে ফোন বের করে একটা নির্দিষ্ট এপ্লিকেশনে কিছু কাজ করলেন। এরপর তার স্ত্রী-সন্তানের ছবি দিকে তাকিয়ে রইলেন, মুখে স্মিত হাসি। *দিস ইজ দ্যা লাস্ট থিং হি ওয়ান্টস টু সি, এন্ড দ্যা লাস্ট টাইম হি উইল ফিল ওয়ার্ম অ্যাট হার্ট।*

(৬)

গাটোর মায়ের শেষকৃত্যানুষ্ঠান বেশ সাদামাটা হল। গোষ্ঠীর লোকেরা এক এক করে এসে প্রার্থনার কিছু বাক্য বলে গেল। এরপর কী হবে গাটো জানে। মহিলারা এসে বিশেষ গোসল দিবেন মা কে। এরপর তার শরীর জমে শক্ত হওয়ার আগেই টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলা হবে। কঙ্কাল আলাদা করে সমাধি গুহায় ঝুলিয়ে রাখা হবে। আর মাংস বিতরন করা হবে সবার মাঝে। ইয়ামাকোর অনুসারীরা মনে করেন এতে মৃতের উষ্ণতা তাদের শরীরে টিকে রইবে। মৃতকে স্মরণ করার জন্য নিজের মাঝে আত্মভূত করার চাইতে আর উত্তম উপায় কী?

আচার অনুযায়ী গাটো অনেক কষ্টে একটুকরো মাংস মুখে নিয়েই ঘরে ফিরে গেল। বেশ অনেক্ষণ তার বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাদতে লাগল। তার মায়ের জন্য কিছুই করতে পারল না সে। শীতে যাতে কষ্ট না হয় তার জন্য কিছু তৈরীও করে দিতে পারল না। চারপাশে একে রাখা বিভিন্ন সমীকরণ সে দুঃখে মুছে ফেলত?

লিখাঃ মনিফ শাহ চৌধুরী

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form