চার্লি গেইম


আমি, মিরন আর জোসেফ আমরা তিনজনে মিলে চার্লি চার্লি গেইম খেলবো বলে ঠিক করলাম। প্ল্যানমাফিক আমরা তিনজনই এখন জোসেফদের বাসায় আছি। ওর বাসা বেছে নেওয়ার কারণ জোসেফ বাসায় একা থাকে, আর আমাদের একটা নির্জন জায়গার দরকার ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা চার্লি চার্লি গেইম শুরু করবো। কিন্তু তার আগে এই গেইম সম্পর্কে কিছু বলে নেওয়া যাক।
চার্লি একটা বাচ্চা ছেলের নাম। ও মেক্সিকোর বাসিন্দা ছিল। খুব ছোট বয়সেই ও বাবা মায়ের সাথে জেদ করে আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যা করার পর ওদের বাসায় অদ্ভুত সব ব্যাপার ঘটতে থাকে। এক পর্যায়ে চার্লির বাবা মা ঐ বাসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু তখনকার সময় থেকেই এই খেলার প্রচলন শুরু হয়ে যায়। একটা কাগজের ওপর দুইদিকে দুইটা পেন্সিল রাখতে হয়। একপাশে Yes অন্যপাশে No লেখা থাকে। তারপর বলতে হয়, Charlie, are you here? তখন Yes অথবা No ঘরের দিকে পেন্সিল ঘুরে যায়। এভাবেই এই খেলা খেলতে হয়।
রাত সাড়ে বারোটা বাজতে চলছে। আমরা খেলার জন্য প্রস্তুত হলাম। তিনজন কাগজের তিনপাশে বসলাম। ঘরের লাইট বন্ধ করে আমরা মোমবাতি জ্বালিয়ে নিয়েছি।
জোসেফ শান্তভাবে বলল, Charlie, Are you here?
কোনো জবাব পাওয়া গেলো না। বেশ কয়েকবার টানা বলে গেলো জোসেফ। কোনো কাজ হলো না। মিরন শব্দ করে হেসে উঠলো। তারপর বলল, আমরা শুধু শুধুই সময় নষ্ট করছি। এভাবে কারো আত্মা ডেকে আনা যায় না। জোসেফ মিরনের ওপর ভয়ানক রেগে গেলো। তারপর আবার ঘুরে বসলো কাগজের দিকে। আবার বলল, Charlie, Are you here?
আমাদের সবাইকে চমকে দিয়ে Yes লেখা অংশের দিকে ঘুরে গেলো পেন্সিলটা। মিরনের হাসি বন্ধ হয়ে গেলো। আমিও আশা করি এমন কিছু সত্যিই হতে পারে। আমরা তিনজনই বেশ ঘাবড়ে গেলাম। মিরন উঠে দৌড়ে গেলো লাইট অন করতে। লাইটের সুইচ চাপলো ঠিকই, কিন্তু লাইট জ্বললো না। মোমবাতিটাও নিভে গেলো। আমরা যে যার মোবাইলের ফ্লাশ জ্বাললাম। একটা বাচ্চা ছেলের হাসির আওয়াজ শোনা গেলো। আমরা তিনজনই ঐ রুম থেকে দৌড়ে বের হয়ে এলাম। তারপর ঐ ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিলাম।
কিছুক্ষণ পর ভেতর থেকে একটা বাচ্চা ছেলের গলার আওয়াজ শোনা গেলো। ও বলল, Do you want to play with me?
জোসেফ তার জবাবে চিৎকার করে বলল, No, Please leave.
জোসেফের কথা শুনে জোরে হাসা শুরু করলো চার্লি। একটা বাচ্চা ছেলের হাসি কতটা ভয়ংকর আর কর্কশ হতে পারে তা সেদিন বুঝতে পারলাম। ঘরের তাপমাত্রা ধীরে ধীরে কমে আসছিলো। আমরা জোসেফের বাসা থেকে বের হয়ে যেতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু আমরা পুরোপুরি ফেঁসে গিয়েছি। দরজা কোনো ভাবেই খোলা যাচ্ছিলো না। টানা অনেক্ক্ষণ ধরে হাসার পর হাসি থামিয়ে চার্লি বলল, If you don't play with me, I'll hurt you.
এটা বলার পরই চারিদিক ধীরে ধীরে শান্ত হতে শুরু করলো। ঘরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক হয়ে গেলো। লাইটগুলো সব আপনাআপনিই জ্বলে উঠলো।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঐ চার্লির আত্মা আমাদের পিছু ছাড়লো না। নানাভাবে আমাদের ক্ষতি করে যেতে লাগলো।

সেদিন রাত তিনটার পর সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যায়। মিরন ওর বাড়ি চলে যায়, কিন্তু জোসেফ ঐ ঘরে একা থাকতে খুব ভয় পাচ্ছিলো। তাই জোসেফ আমার সাথে আমার বাসায় চলে আসে।
পরদিন দুপুরে আমাদের বাসা থেকে যাওয়ার পথে এক্সিডেন্ট করে জোসেফ। খবর পাওয়ার সাথে সাথে হাসপাতালে চলে যাই। মারাত্মক ভাবে আহত হয়েছে জোসেফ। একটা পায়ের হাড় ভেঙ্গে সম্পূর্ণ উল্টো দিকে ঘুরে আছে। জ্ঞান ফেরার পর জোসেফ যা বলল তাতে আমরা অবাক হয়ে গেলাম। জোসেফ চার্লিকে দেখেছে। রাস্তা দিয়ে বাইক চালিয়ে যাওয়ার সময় জোসেফ দেখতে পায় একটা বাচ্চা ছেলে হাসতে হাসতে রাস্তার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দৌড়ে গেলো। বেশ কয়েকবার এমন হলো। শেষবার বেশ নার্ভাস হয়ে গিয়েছিল জোসেফ, তাই এক্সিডেন্ট করে। সে যখন এক্সিডেন্ট করে রাস্তায় রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল তখন সে দেখতে পায় চার্লি রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে জোসেফের দিকে। তারপরই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সে।
আমরা ভেবেছিলাম ঐ রাতেই সব ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু জোসেফের কথা শুনে স্পষ্ট হয়ে গেলাম, চার্লি আমাদের পিছু ছাড়ে নি। মিরনকে ব্যাপারটা জানানোর জন্য ফোন দিলাম। কিন্তু ও ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। হাসপাতাল থেকেই মিরনের বাসায় রওনা দিলাম। বাসায় যাওয়ার পর ওর মা বলল মিরন সকাল থেকে বাসায় নেই, ওর ফোনও বন্ধ।
আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। জোসেফ এক্সিডেন্ট করে হাসপাতালে, মিরন নিখোঁজ। এবার আমার পালা।
আমি আমার এক বন্ধু মায়ানকে নিয়ে এক প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেটরের কাছে গেলাম। তিনি আমাকে কিছু না হওয়ার আশ্বাস দিলেন। তিনি আমাদের এমন এক তথ্য দিলেন যা আমরা জানতাম না। চার্লি এই ধরনের ঘটনা এই প্রথম করছে না। এর আগে আমেরিকান এক দম্পতিকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। তারাও চার্লিকে ডেকে এনেছিল, কিন্তু তার সাথে না খেলে মাঝপথে খেলা বন্ধ করে দেয়।
বেশিরভাগ সময়ই চার্লি এই খেলায় জবাব দেয় না। কিন্তু যাদের জবাব দেয় তাদের খেলা সম্পূর্ণ করতেই হয়। ইনভেস্টিগেটর সোবহান (ছদ্মনাম) আমাকে বললেন, জোসেফকে নিয়ে আবার এই খেলা খেলতে। এবার খেলা সম্পূর্ণ করতে হবে। সোবহান সাহেবও আমাদের সাথে খেলায় অংশ নেওয়ার জন্য রাজি হলো।
সেদিনই হাসপাতাল থেকে ইমার্জেন্সি ইস্যুতে বাসায় নিয়ে আসা হয় জোসেফকে। মাঝরাতে আমি, জোসেফ আর সোবহান সাহেব চার্লি চার্লি গেইম খেলতে বসলাম। তিনজনই মনোযোগ দিয়ে বসার পর সোবহান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, Charlie Charlie, Are you here?
বিন্দুমাত্র সময় অপেক্ষা না করে Yes লেখা ঘরে ঘুরে গেলো পেন্সিল।
তখন ইনভেস্টিগেটর বলল, Please forgive them.
পেন্সিলটা No লেখা অংশে ঘুরে গেলো।
ইনভেস্টিগেটর বলল, Do you want to play with them?
সঙ্গে সঙ্গেই Yes লেখা অংশে ঘুরে গেলো পেন্সিল। ভয়ে পিছিয়ে গেলো জোসেফ। সোবহান সাহেব জোসেফের দিকে তাকিয়ে চেচিয়ে বলে উঠলো, তোমাদের বেঁচে থাকতে হলে এই খেলা সম্পূর্ণ করতেই হবে। জোসেফ অনেক কষ্টে আবার এসে আগের জায়গায় বসলো। জোসেফ ফিসফিস করে সোবহান সাহেবকে বললেন, মিরন কোথায় তা জিজ্ঞেস করতে। সোবহান সাহেব কাগজের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, Is Miron alive?
No লেখা অংশে ঘুরে গেলো পেন্সিল। কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো জোসেফ। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও পাচ্ছিলাম না। আমিও তখন প্রচন্ড শোকে ছিলাম।
সোবহান সাহেব আর চার্লির সাথে বেশকিছুক্ষন কথোপকথন চললো। সোবহান সাহেব চার্লির আত্মাকে শেষ যে প্রশ্নটা করেছিল তা হলো, Can we stop playing now?
Yes লেখা অংশে ঘুরে গেলো পেন্সিল। ইনভেস্টিগেটর সাথে সাথে কাগজটা টেবিল থেকে উঠিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেললেন। তারপর আমাদের দুজনকেই বাড়ি পৌঁছে দিলেন।
আজও আমরা মিরনের খোঁজ পাইনি। অনেক খোজাখুজি করার পর ব্যর্থ হয়ে মিরনের পরিবার চার্লির ঘটনাকে সত্যি হিসেবে মেনে নেয়।
সমাপ্ত।

লেখকঃ পনু প্রান্তিক 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম