ভাইরাসের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত


বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে পৃথিবীর বেশির ভাগ ভাইরাসই আমাদের অজানা। বর্তমান অনুমান অনুযায়ী পৃথিবীতে ১ এর পর ৩২ টি শূন্য বসলে যে সংখ্যাটি পাওয়া যায়, সেই সংখ্যক ভাইরাস আছে। অর্থাৎ এই মহাবিশ্বে যত নক্ষত্র আছে, পৃথিবীতে ভাইরাসের সংখ্যা তার ১০ লক্ষ গুন। বিভিন্ন ভাইরাস বিভিন্ন প্রাণীকে আক্রমণ করে, এবং বেশির ভাগ ভাইরাস আক্রমণ করে ব্যাক্টেরিয়াদের। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের immune সিস্টেম আমাদের যে সব ভাইরাস আক্রমণ করে, তাদের প্রতিরোধ করতে শেখে। বিপদ হয় যখন অন্য প্রাণীর ভাইরাস হঠাৎ আমাদের আক্রমন করে, যে কোনো কারণেই হোক। এই নতুন ভাইরাস আমাদের immune সিস্টেমের অজানা এবং তার ফলে আমাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে না, বা গড়ে উঠতে সময় লাগে, যেমন হয়েছে এই নতুন করণাভাইরাসের ক্ষেত্রে, বা আগে, HIV, এবোলা, বার্ড ফ্লু ইত্যাদির ক্ষেত্রে। আজ আমরা ভাইরাস সম্বন্ধে সংক্ষেপে বুঝতে চেষ্টা করবো, বিশেষ করে এখনকার করণাভাইরাস এর জন্য বিশ্বব্যাপী ভীতির পরিপ্রেক্ষিতে। ভাইরাস দের বুঝতে গেলে আমাদের প্রথমে বুঝতে হবে তারা কিভাবে আমাদের ক্ষতি করে, কিভাবে বংশ বৃদ্ধি করে, এবং তাদের প্রতিরোধের উপায় কি।

আমাদের শরীর লক্ষ কোটি কোষ দিয়ে তৈরী, এবং প্রতিটি কোষের মধ্যে সর্বক্ষণ অনেক রাসায়নিক বিক্রিয়া হয়, এইসব বিক্রিয়ার মূল লক্ষ্য খাদ্য থেকে শক্তি বার করা, কিন্তু আরো অজস্র লক্ষ্য আছে, এই সব রাসায়নিক বিক্রিয়ার সমন্বয়েই জীবন, এবং আমাদের কার্য্যকলাপ জীবিত অবস্থায়। একটি মুশকিল হলো যে বেশির ভাগ রাসায়নিক বিক্রিয়ার জন্য শক্তি বা উত্তাপের প্রয়োজন। অথচ আমাদের শরীর বেশি গরম হলে আমরা অসুস্থ হয়ে যাই। রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটানোর বা দ্রুত ঘটানোর আর একটি পদ্ধতি আছে, যার জন্য প্রয়োজন অন্য একধরনের অনু যাদের বলে ক্যাটালিস্ট। যেসব অনু একটি রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করে, ক্যাটালিস্টরা তাদের কাছাকাছি আনে অনেক কম উত্তাপে বা শক্তিতে। আমাদের কোষে ক্যাটালিস্টরা মূলতঃ প্রোটিন অনু। সুতরাং একটি কোষ ঠিক ভাবে কাজ করতে হলে, সেই কোষে সঠিক পরিমানে এবং সঠিক প্রকারের প্রোটিন অনু উৎপাদন হতে হবে। নতুন কোনো প্রোটিন অনু তৈরী হলে, বা প্রয়োজনীয় প্রোটিন গুলি সঠিক পরিমানে তৈরী না হলে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি, কারণ আমরা তো বহু কোষের সমন্বয় ছাড়া আর কিছু না। ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়ারা আমাদের কোষের প্রোটিন অনুর সামঞ্জস্য ব্যাহত করে আমাদের অসুস্থ করে দেয়। ভাইরাসরা নতুন ক্ষতিকারক প্রোটিন তৈরী করে, যার ফলে আমাদের কোষে ক্ষতিকারক রাসায়নিক বিক্রিয়া হয়, আবার অনেক প্রোটিন তৈরী করে যারা আমাদের প্রয়োজনীয় প্রোটিনের কাজে বাধার সৃষ্টি করে।

কি ভাবে আমাদের কোষে প্রোটিন তৈরী হয়?
আমাদের কোষের নিউক্লিয়াসে থাকে DNA অনু, এই DNA তৈরী হয় A,T,C,G এই চাররকমের base থেকে (এদের পুরো নাম আমাদের আলোচনার পক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নয়), DNA র মধ্যে বিশেষ বিশেষ অংশ আছে, তাদের বলে gene। আমরা আলোচনা সহজ রাখার জন্যে বলবো যে gene থেকে তৈরী হয় একধরণের অনু, যাকে বলে মেসেঞ্জার RNA বা mRNA (এই প্রক্রিয়া খুবই জটিল এবং অনেক প্রোটিন ও অন্য ধরণের অনু এই transcription পদ্ধতিতে অংশ নেয়)। এই mRNA তারপর নিউক্লিয়াস থেকে কোষের বাইরের অংশ, যাকে বলে cytoplasm. সেখানে বেরিয়ে আসে, প্রোটিন তৈরী শুরু হয় mRNA থেকে এরপর। আর একটি পরিবর্তন হয়, DNAর T base টি mRNA তে U base এ বদলে যায়।
cytoplasm এ একটি অংশ আছে, যাকে বলে ribosome (এই ribosome এর গঠন বিশ্লেষণ করে ভেঙ্কি রামকৃষ্ণন আরো দুজনের সঙ্গে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন)। জীব এবং উদ্ভিদ জগতের সব প্রোটিন ২০টি অ্যামিনো অ্যাসিড থেকে তৈরী হয়। mRNA অণুটি ribosome এর মধ্যে দিয়ে সরে সরে যেতে থাকে, এবং একটি একটি করে অ্যামিনো অ্যাসিড প্রোটিন অণুতে জোড়া লাগে। এই পদ্ধতিটি প্রকৃতির একটি অত্যাশ্চর্য পদ্ধতি। এক ধরণের RNA অনু আছে, যাদের বলে transfer RNA বা tRNA। তাদের কাজ হলো mRNA র তিনটি করে base পড়া, বোঝা, এবং সেই অনুযায়ী একটি অ্যামিনো অ্যাসিড ধরে এনে প্রোটিন অণুতে জুড়ে দেওয়া। যেমন UUA পড়লে, এরা leucine বলে একটি অ্যামিনো অ্যাসিড ধরে আনবে। কিছু কিছু তিন অক্ষরের সমন্বয় কে বলা হয় stop codon, যেমন UGA. প্রোটিন তৈরী শেষ হয় এই রকম stop codon এ পৌঁছুলে।
ভাইরাস দের মোটামুটি দু ভাগে ভাগ করা যায়, DNA ভাইরাস এবং RNA ভাইরাস। করোনাভাইরাস একটি RNA ভাইরাস। ভাইরাস রা সম্পূর্ণ কোষ না, এদের শুধু একটি DNA বা RNA অনু থাকে, কোনো নিউক্লিয়াস বা ribosome থাকে না। এরা host cell, যেমন আমাদের cell এর সাহায্য নেয় প্রোটিন তৈরী করতে। অর্থাৎ আমাদের cell এদের RNA পড়ে প্রোটিন তৈরী করে, যা আমাদের পক্ষ্যে ক্ষতিকর। সব ভাইরাস ই আমাদের সেল কে ঘিরে যে মেমব্রেন থাকে, সেখানে গিয়ে লাগে, এবং তাদের DNA বা RNA আমাদের সেলের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। DNA ভাইরাস হলে ভাইরাসের DNA আমাদের সেলের নিউক্লিয়াস এ গিয়ে ঠিক আমাদের জিন এর মতো তার থেকে mRNA ও প্রোটিন তৈরী হয়, আর RNA ভাইরাস হলে সেই RNA থেকে সরাসরি প্রোটিন তৈরী হয়। কোনো কোনো ভাইরাস এর একটি সেল মেমব্রেন থাকে, আবার বেশির ভাগ ভাইরাসই শুধুমাত্র DNA বা RNA একটি প্রোটিনের মোড়কের মধ্যে, যাকে বলে capsid। আমাদের cell এই প্রোটিনের মোড়কের জন্যে যা যা প্রোটিন প্রয়োজন সেগুলি ভাইরাসের DNA বা RNA থেকে তৈরী করে দেয়, সেই প্রোটিন গুলি আবার নতুন ভাইরাসের জন্ম দেয়। নতুন ভাইরাসগুলো সেল থেকে বেরিয়ে এসে অন্য সুস্থ সেলে ঢোকে।
ভাইরাস দের DNA বা RNA তে দুরকমের জিন থাকে, প্রথম ধরণের জিন নতুন ভাইরাস তৈরিতে সাহায্য করে। আর দ্বিতীয় ধরণের জিন এমন সব প্রোটিন তৈরী করে যা আমাদের সেলের পক্ষ্যে ক্ষতিকর, আমাদের অসুস্থ করে দেয়। আরো একটি বিপজ্জনক বিষয় এই যে, ভাইরাসের জিন গুলি খুব দ্রুত পরিবর্তিত হয়। আমাদের কোষে এমন এক ধরণের প্রোটিন থাকে, যাদের কাজ DNA র কোনো পরিবর্তন রোধ করা (DNA repair machinery)। ভাইরাস দের এই ধরণের DNA বা RNA repair করার ক্ষমতা নেই। ফলে যে কোনো ওষুধ যদি আজ কোনো একটি ভাইরাস কে প্রতিরোধ করার জন্যে গবেষণা করে বার করা হলো, কিছুদিন পরে সেই ওষুধ আর কাজ করে না, কারণ ভাইরাস পরিবর্তিত হয়ে গেছে বলে।
বিজ্ঞানীরা ভাইরাস এর ওষুধ অনেক ভাবে বার করার চেষ্টা করেন। যেমন এক ধরণের ওষুধ ভাইরাস এর আমাদের সেলে ঢোকা বন্ধ করতে চেষ্টা করে। ভাইরাস রা, সেলের যেখানে গিয়ে জুড়ে যায়, এইসব ওষুধ সেই সব জায়গায় গিয়ে জুড়ে যায়, ফলে ভাইরাস আর সেলের মধ্যে DNA বা RNA ঢুকিয়ে দিতে পারে না। আবার অন্য একধরণের ওষুধ ভাইরাস এর জিন গুলোকে নিষ্ক্রিয় করে দিতে চেষ্টা করে, সেই জিন গুলোতে সংযুক্ত হয়ে। তবে ভাইরাস এর সঙ্গে যুদ্ধে জয় খুবই শক্ত, সেই জয় লাভে হয়তো ভাইরাস রাই আমাদের সাহায্য করে অনেক সময়, তাদের পরিবর্তন হতে হতে এক সময় তারা আর আমাদের ক্ষতি করে না।

Writer: Amitavo Datto
সদস্য, বিজ্ঞান কথা  

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form