কল্পবিজ্ঞান”-এর
হার্ড / সফট সাই-ফাই
কল্পবিজ্ঞানের ভিতরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তি ক তথ্যের পরিমাণ, নির্ভুলতা এবং বাস্তবসম্মতার উপর ভিত্তি করে যে দুইটি শাখা তৈরী হয়েছে সে দুইটি শাখা হলো হার্ড এবং সফট সাই-ফাই। সাধারণত হার্ড সাই-ফাইতে বাস্তবসম্মত বিজ্ঞান সম্পর্কিত তথ্য থাকে প্রচুর। এ ধরণের কল্পবিজ্ঞানে চরিত্রের চেয়ে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিকে ঘিরে গল্পের কাহিনী আবর্তিত হয়। অ্যান্ডি ওয়্যার-এর “দ্য মার্শিয়ান”, জেমস এস. এ. কোরির “দ্য লিভায়াথান ওয়েকস”, কিম স্ট্যানলি রবিনসন-এর “মার্স” সিরিজ, লিউ সিশিন-এর “দ্য থ্রি-বডি প্রবলেম” কল্পবিজ্ঞানের এ শাখার ভিতরে পড়ে। বাংলা ভাষায় দীপেন ভট্টাচার্য এর “দিতার ঘড়ি”, ”নক্ষত্রের ঝড়” এই শাখার ভিতরে পড়ে।
অপরদিকে, সফট সাই-ফাই গল্পে বিজ্ঞান থাকলেও বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির চেয়ে গল্পের চরিত্র এবং সমাজ ব্যবস্থার নানা দিক (রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কিংবা ঐতিহাসিক)-এর উপরে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। এজন্য এ ধারাকে সোশ্যাল সাই-ফাইও বলা হয়। সাধারণত এ ধরণের গল্পে বাস্তবসম্মত বিজ্ঞানের পাশাপাশি অনেক ধরণের কল্পনাপ্রসূত ধ্যান-ধারণা থাকে। জর্জ অরওয়েল-এর “নাইন্টিন-এইটি- ফোর”, ফ্রাঙ্ক হার্বার্ট-এর “ডিউন”, রবার্ট এ. হেইনলেইন-এর “স্ট্রেন্জার ইন এ স্ট্রেন্জার ল্যান্ড”, অলডাস হাক্সলির “ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড” এই শাখার উদাহরণ।
অ্যাপোক্যালিপ্ট িক / পোস্ট অ্যাপোক্যালিপ্টিক সাই-ফাই
নানা ধরণের কল্পবিজ্ঞানের গল্পে অনেক সময়ই দেখা যায় আমাদের এ পৃথিবী নানা ধরণের প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট দুর্যোগে বিপর্যস্ত কিংবা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। ঠিক এই ধরণের সেটিং-এর কল্পবিজ্ঞানকে ধরা হয় অ্যাপোক্যালিপ্ট িক সাই-ফাই। বিপর্যয়ের কারণের উপর ভিত্তি করে এই শাখার বেশ কিছু প্রশাখা রয়েছে। তার ভিতরে প্রধানগুলো হলো ভয়াবহ কোন যুদ্ধ কিংবা নিউক্লিয়ার হলোকাস্ট (উইলিয়াম আর. ফর্সচেন-এর “ওয়ান সেকেন্ড আফটার”), উল্কাপিণ্ডের আঘাত (ল্যারি নিভেন-এর “লুসিফার’স হ্যামার”), জোম্বি ব্রেক আউট (এম. আর. ক্যারের “দ্য বয় অন দ্য ব্রিজ”), ইকোলজিক্যাল/ এনভায়রনমেন্টাল ইমব্যালেন্স (মার্গারেট অ্যাটউড-এর “অরিক্স এন্ড ক্রেক”) কিংবা ভিনগ্রহের কোন প্রাণীর আক্রমণ (এইচ.জি.ওয়েলস- এর “ওয়ার অফ দ্য ওয়ার্ল্ডস”)।
প্রায় সময়ই পৃথিবীর জনসংখ্যা মাত্রাতিরিক্তভা বে কমে যায় এ ধরণের দুর্যোগের কারণে। কখনো কখনো পৃথিবীকে কোনভাবেই বাঁচানো যায় না, সে ধরণের কল্পবিজ্ঞানকে বলা হয় “ডায়িং আর্থ” সাই-ফাই। (জিন উলফির “দ্য বুক অফ দ্য নিউ সান”)
তবে এ ধরণের দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে পারলে দুর্যোগ পরবর্তী অবস্থার পটভূমির কল্পবিজ্ঞানের গল্পগুলোকে ধরা হয় পোস্ট অ্যাপোক্যালিপ্ট িক সাই-ফাই হিসেবে। বর্তমান সময়ে এ ধরণের লেখা প্রচুর পরিমানে বের হবার কারণে কল্পবিজ্ঞানের এই শাখার স্বর্ণালী সময় যাচ্ছে বলে ধরা যায়। উইলিয়াম এম. মিলার জুনিয়র-এর ক্লাসিক সাই-ফাই “অ্যা ক্যান্টিকল ফর লিবোইৎজ”, সুজান কলিন্সের “হাঙ্গার গেমস” সিরিজ, জেমস ড্যাশনারের “দ্য মেইজ রানার” সিরিজ, ম্যাক্স ব্রুক্স-এর “ওয়ার্ল্ড ওয়ার জেড”, করম্যাক ম্যাকার্থির “দ্য রোড” কল্পবিজ্ঞানের এই শাখার অন্তর্গত। বাংলা ভাষায় মুহম্মদ জাফর ইকবালের "ক্রেনিয়াল" সহ এই শাখায় প্রচুর বই রয়েছে।
ইউটোপিয়ান/ ডিস্টোপিয়ান সাই-ফাই
ভবিষ্যতের গল্প বা উপন্যাসের সমাজ ব্যবস্থা এবং এর নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধার উপর ভিত্তি করে কল্পবিজ্ঞানকে মোটামুটিভাবে দুই ভাগে বিভক্ত করা যায় - ইউটোপিয়ান এবং ডিস্টোপিয়ান সাই-ফাই। ইউটোপিয়ান ভিত্তিক কল্পবিজ্ঞানের গল্পগুলো মূলত এক ধরণের আদর্শ সমাজ ভিত্তিক ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে গঠিত। সাধারণত এ ধরণের গল্প এমন এক সমাজ ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে হয় যা অভাব অনটন থেকে মুক্ত, জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিগত দিক থেকে উন্নতির শিখরে পৌঁছানো এক আদর্শ সভ্যতা, যেমন লুইস লোরির বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস “দ্য গিভার”, ইয়ান এম. ব্যাঙ্কস-এর “প্লেয়ার অফ গেমস”, উরসুলা কে. লে গুইন-এর “দ্য ডিস্পজেসড”।
আর এর ঠিক বিপরীত শাখা হলো ডিস্টোপিয়ান সাই-ফাইয়ের গল্পগুলো। লেখক এই শাখার গল্পগুলোতে প্রায়সময়ই একনায়ককেন্দ্রিক এক সমাজ ব্যবস্থা তুলে ধরেন, যেখানে সবসময় কিছু না কিছুর অভাব অনটন লেগেই থাকে, তা হতে পারে পানীয়জল থেকে বাকস্বাধীনতা পর্যন্ত। সাধারণত এ ধরণের গল্পের পটভূমি বেশ ডার্ক এবং ডিপ্রেসিং হয়। এ ধরণের গল্পে সাধারণত প্রযুক্তিগত তথ্যের চেয়ে গল্পের মুখ্য চরিত্র গুলোর উপর কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। কল্পবিজ্ঞানের এ শাখাটিও বেশ জনপ্রিয়। জর্জ অরওয়েলের কালজয়ী কল্পবিজ্ঞান “নাইন্টিন-এইটি- ফোর” ডিস্টোপিয়ান কল্পবিজ্ঞানের এক আদর্শ উদাহরণ। এছাড়াও অলডাস হাক্সলির “ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড”, রে ব্র্যাডবেরির “ফারেনফাইট ৪৫১”, মার্গারেট অ্যাটউড-এর “দ্য হ্যান্ডমেইড’স টেল” এ শাখার অন্তর্গত।
রোবট/ অ্যান্ড্রয়েড ভিত্তিক সাই-ফাই
বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব প্রান্তেই কল্পবিজ্ঞানের এই শাখা অত্যন্ত জনপ্রিয়। সাধারণত কল্পবিজ্ঞানের এ শাখা রোবট, অ্যান্ড্রয়েড, সাইবর্গ তথা রোবোটিক্স এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্সকে কেন্দ্র করে চালিত হয় , তাই এ ধরণের গল্পে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার থাকে। প্রায় সময়ই এ ধরণের গল্পে “মানুষ বনাম যন্ত্র” কিংবা “মানুষ বনাম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা” অবস্থার সৃষ্টি হয় কিংবা মেশিনকে মানবসভ্যতার চেয়ে উন্নত এক প্রজাতি হিসেবে দেখানো হয়। তবে কখনো কখনো রোবটকে মানুষের ভৃত্য রূপেও দেখানো হয় আবার কখনো দেখা যায় রোবট এবং মানুষ একইসাথে এক সমাজ ব্যবস্থার অংশ হিসেবে বসবাস করছে।
আইজ্যাক আসিমভের বিখ্যাত “রোবট” সিরিজ কল্পবিজ্ঞানের এই শাখার পথিকৃৎ। ফিলিপ কে. ডিকের “ডু অ্যান্ড্রয়েডস ড্রিম অফ ইলেকট্রিক শিপ”, মেরিসা মেয়ারের “সিন্ডার”, মাইকেল ক্রাইটন-এর “প্রে”, ড্যানিয়েল এইচ. উইলসন-এর “রোবোক্যালিপ্স”, মার্থা ওয়েলসের “অল সিস্টেমস রেড” এ শাখার অন্তর্গত। বাংলা ভাষায় মুহম্মদ জাফর ইকবালের “কপোট্রনিক সুখ দুঃখ”, “যারা বায়োবট”, সজল চৌধুরীর "পলাতক " সহ প্রচুর লেখা আছে কল্পবিজ্ঞানের এ শাখায়।
এলিয়েনভিত্তিক সাই-ফাই
আমাদের দেশের সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় কল্পবিজ্ঞানের ধারা হলো এলিয়েন বা ভিনগ্রহের প্রাণীভিত্তিক কল্পবিজ্ঞান। বিভিন্ন ধরণের কল্পবিজ্ঞানে ভিনগ্রহের বা মহাজাগতিক এসব প্রাণীকে বিভিন্নভাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে। তাই এলিয়েনভিত্তিক সাই-ফাই ধারার ভিতরে পড়ে ভিনগ্রহের প্রাণী আবিষ্কার বা ভিনগ্রহের প্রাণীদের সভ্যতার আবিষ্কার থেকে শুরু করে তাদের পৃথিবীতে আক্রমণ অথবা সহাবস্থানসহ ভিনগ্রহের প্রাণীভিত্তিক সব কিছু।
এ বিশাল শাখার উল্লেখযোগ্য প্রশাখা হিসেবে রয়েছে ফার্স্ট কন্ট্যাক্ট (স্ট্যানিসওয়াফ লেম-এর “সোলারিস”), এলিয়েন কন্সপিরেসি (ফ্রাঙ্ক হার্বার্ট-এর “দ্য ডোসাডি এক্সপেরিমেন্ট”), এলিয়েন ইনভেশন (এইচ. জি. ওয়েলসের “ওয়ার অফ দ্য ওয়ার্ল্ডস”), এলিয়েনভিত্তিক জেনোফিকশন (অরসন স্কটের “স্পিকার ফর দ্য ডেড”), এলিয়েন কলোনাইজেশন (উরসুলা কে. লে গুইন-এর “দ্য লেফট হ্যান্ড অফ ডার্কনেস”) ইত্যাদি।
আর্থার সি. ক্লার্কের বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান “দ্য চাইল্ডহুডস এন্ড”, স্টেফানি মেয়ারের “দ্য হোস্ট”, অরসন স্কটের জনপ্রিয় “এন্ডার্স সাগা” সিরিজ, জেফ ভ্যান্ডারমিয়ারে র “এরিয়া এক্স ট্রিলজি”, লিউ সিশিন-এর আলোড়ন তোলা “দ্য থ্রি-বডি প্রবলেম” সহ অনেক বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান কাহিনী কল্পবিজ্ঞানের এ শাখার অন্তর্গত। বাংলা ভাষায় সত্যজিৎ রায় “বঙ্কু বাবুর বন্ধু” এ ধারার লেখা। এছাড়াও হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল সহ অনেক বাঙালি লেখক কল্পবিজ্ঞানের এ শাখায় লিখেছে এবং লিখছে।
অল্টারনেটিভ হিস্টোরি/ অল্টারনেটিভ ইউনিভার্স
“যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার জয়ী হতো তাহলে ভবিষ্যতের পৃথিবী কি রকম হতো?” এরকম ইতিহাসের নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো যদি অন্যরকম ফলাফল বয়ে আনতো তাহলে সমাজ ব্যবস্থা কী রকম হতো এ নিয়ে লেখা কল্পবিজ্ঞানের গল্পগুলো সাধারণত “অল্টারনেটিভ হিস্টোরি” ভিত্তিক সাই-ফাই শাখার অন্তর্গত। বেশিরভাগ সময় এ ধরণের গল্পের প্লট খুব জটিল হয়।
ফিলিপ কে. ডিকের “দ্য ম্যান হু লিভড ইন দ্য হাই ক্যাসল” এই শাখার সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় বই। এছাড়াও নাওমি নভিকের “হিজ ম্যাজেস্ট্রি’স ড্রাগনস”, রবার্ট হ্যারিস-এর “ফাদারল্যান্ড” এই শাখার অন্তর্গত।
কখনো কখনো কল্পবিজ্ঞানের ঘটনাগুলোর কিছু অংশ কিংবা সম্পূর্ণ অংশই একেবারেই আলাদা এক পৃথিবীতে সংঘটিত হয়, এ ধরণের কল্পবিজ্ঞানকে অল্টারনেটিভ ইউনিভার্সের অন্তর্গত ধরা হয়। কোন কোন সময় এ ধরণের কল্পবিজ্ঞানে সেকেন্ডারি ইউনিভার্স, মাল্টিভার্স, প্যারালাল ইউনিভার্সেরও দেখা পাওয়া যায় এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ফ্যান্টাসি সাহিত্যের কিছু এলিমেন্টও পাওয়া যায়।
স্টিফেন কিং-এর বিখ্যাত “দ্য ডার্ক টাওয়ার” সিরিজ, ফিলিপ পুলম্যান-এর “হিজ ডার্ক ম্যাটেরিয়ালস” সিরিজ, আইজ্যাক আসিমভের “দ্য গডস দেমসেল্ভস” এই শাখার অন্তর্গত।বাংলা ভাষায় হুমায়ুন আহমেদের "অনন্ত নক্ষত্র বীথি" সহ বেশ কিছু গল্প এ শাখায় রয়েছে।
লিখাঃ জাহিদুল ইসলাম রাজু
লিখাঃ জাহিদুল ইসলাম রাজু
Tags:
Science Fiction