কল্পবিজ্ঞানের শাখা-প্রশাখা (পর্ব ২)


“কল্পবিজ্ঞান”-এর নাম শুনলেই আমাদের মনের পর্দায় ভেসে উঠে কল্পনা এবং বিজ্ঞান মিশ্রিত কিছু অভাবনীয় দৃশ্যপট। বাংলাদেশসহ পুরো দুনিয়াতেই রয়েছে কল্পবিজ্ঞানের বিশাল পাঠক এবং ভক্তকুল। তবে কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যভিত্তিক কোন গল্পের কথা উঠলেই সাধারণত অনেকের মনে হয় গল্পটি রোবট নিয়ন্ত্রিত পৃথিবী কিংবা ভিনগ্রহের কোন সত্তাভিত্তিক কোন কাহিনী। কিন্তু কল্পবিজ্ঞানের শাখা-প্রশাখা আরো অনেক গভীরে নিহিত। আর কল্পবিজ্ঞানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ শাখা-প্রশাখা নিয়েই মূলত এই ফিচার।

পাঙ্ক ভিত্তিক কল্পবিজ্ঞান

বর্তমান সময়ে কল্পবিজ্ঞানের অন্যতম উল্লেখযোগ্য এক শাখা হলো পাঙ্ক ভিত্তিক কল্পবিজ্ঞান। সাধারনত এ ধরনের কল্পবিজ্ঞানে একটি নির্দিষ্ট কালের পটভূমিতে নানা ধরনের উত্তরাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের আধিক্য থাকে। আর পাঙ্ক ভিত্তিক কল্পবিজ্ঞানের কথা উঠলেই প্রথমেই আসে স্টিমপাঙ্কের কথা। স্টিমপাঙ্ক কল্পবিজ্ঞানের পটভূমি হয় সাধারণত ভিকটোরিয়ান সময়ের লন্ডন বা ইউরোপের কোন শহর। তবে এ ধরণের গল্পে সেই সময়ের চেয়ে অনেক উন্নত ধরণের প্রযুক্তি পাওয়া যায় যা মূলত স্টিম ইঞ্জিন দিয়ে চালানো হয়। পুরোনো সময় আর আধুনিক প্রযুক্তির মিশেলে সাই-ফাই এর এক অনন্য ধারা হলো স্টিমপাঙ্ক। কাহিনীগত দিক দিয়ে অনেক সময় এই শাখার গল্পের সাথে কল্পবিজ্ঞানের আরেক শাখা “অল্টারনেটিভ হিস্টোরি” এবং ফ্যান্টাসি জনরার শাখা "গ্যাসল্যাম্প ফ্যান্টাসি" এর সাথে বেশ মিল পাওয়া যায় । চেরি প্রিস্ট-এর “বোনশেকার”, গেইল ক্যারিগারের “সোউললেস”, স্কট ওয়েস্টারফিল্ড-এর “লিভায়াথান” এই শাখার উজ্জ্বল উদাহরণ। বাংলা ভাষায় সাম্প্রতিক সময়ে সুমিত বর্ধন এর "অর্থতৃষ্ণা" স্টিমপাঙ্ক ঘরানায় লেখা হয়েছে।এ শাখার অন্যতম এক প্রশাখা হলো ডিজেলপাঙ্ক যেখানে স্টিম ইঞ্জিন এর বদলে ডিজেল চালিত অত্যাধুনিক কোন যন্ত্র থাকে এবং পটভূমি হয় সাধারণত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত । (শন ওয়ালেস-এর “দ্য ম্যামোথ বুক অফ ডিজেলপাঙ্ক”, ক্যারেন কিন্সি এর "শ্যাডোজ অফ এসফোডেল" )
কল্পবিজ্ঞানের আরেক অনন্য শাখা হলো সাইবারপাঙ্ক। আশির দশকে লেখা ব্রুস বেথকে এর ছোটগল্প “সাইবারপাঙ্ক” থেকেই মূলত এ নামের উৎপত্তি।সাইবারপাঙ্ক কল্পবিজ্ঞানের পটভূমি সাধারণত এমন এক পৃথিবীতে হয় যেখানে সব কাজে, সব ক্ষেত্রে মানুষ প্রযুক্তির উপর প্রচণ্ড নির্ভরশীল থাকে। “উন্নত প্রযুক্তি, কিন্তু কমদামি জীবনব্যবস্থা এবং পারস্পরিক সম্পর্ক” এই ধরণের থিম সাইবারপাঙ্কে প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করা হয়। বিশাল বড় ইন্টারনেটভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সাইবার সিকিউরিটি, বিশাল কম্পিটারাইজড ডাটাবেজ, গ্রে এবং হোয়াইট হ্যাকার, চোখ ঝলসানো উন্নত সব শহর যার আকাশে নিয়মিতই উড়ন্ত গাড়ি ঘুরছে এরকম কিছু চিত্র এ ধরণের কল্পবিজ্ঞানের কমন থিম। এই শাখার প্রশাখা হিসেবে প্রস্থেটিক মানুষ, সিকিউরিটি এবং হ্যাকিং, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি নিয়ে পড়ে থাকা মানুষ এ ধরণের নানা কাহিনী পাওয়া যায় যা বেশির ভাগ সময় ডার্ক এবং নয়্যার ঘরানার হয়।
উইলিয়াম গিবসনকে কল্পবিজ্ঞানের এই শাখার অনেকটা ফাদার ফিগার হিসেবে ধরা হয়। তার লেখা “স্প্রল ট্রিলজি” (নিউরোম্যান্সার, কাউন্ট জিরো, মোনা লিসা ওভারড্রাইভ) সাইবারপাঙ্ক ভিত্তিক কল্পবিজ্ঞানের এক দুর্দান্ত উদাহরণ। এছাড়াও রিচার্ড কে. মর্গ্যান-এর “অল্টারড কার্বন”, নীল স্টিফেনসনের “স্নো ক্রাশ”, ফিলিপ কে. ডিকের “ডু অ্যান্ড্রয়েডস ড্রিম অফ ইলেকট্রিক শিপ”, আর্নেস্ট ক্লাইন এর “রেডি প্লেয়ার ওয়ান” কল্পবিজ্ঞানের এই শাখার অন্তর্গত। বিখ্যাত মাঙ্গা সিরিজ “আকিরা” এবং “ঘোস্ট ইন দ্য শেল” ও কল্পবিজ্ঞানের এ শাখার ভিতরে পরে। এ ধরনের কল্পবিজ্ঞানের সেটিংস খুবই দূরবর্তী ভবিষ্যতের হলে তখন সেটিকে “পোস্ট সাইবারপাঙ্ক” ঘরানার বলা হয়।
স্টিমপাঙ্ক এবং সাইবারপাঙ্ক ছাড়াও পাঙ্ক কালচারের আরো যে কয়েকটি শাখা কল্পবিজ্ঞানের সাথে যুক্ত তার ভিতরে অন্যতম জনপ্রিয় ধারা হচ্ছে বায়োপাঙ্ক এবং ন্যানোপাঙ্ক। বায়োপাঙ্ক অনেকটা সাইবারপাঙ্কের মতোই, তবে সেখানে সাইবারনেটিক্সের বদলে ফিউচারিস্টিক বায়ো টেকনোলজি এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর আধিক্য থাকে। বায়োহ্যাকার, মনুষ্যসৃষ্ট বায়ো ভাইরাস, বায়ো ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরণের হাইব্রিড প্রজাতির জন্ম দেয়া ইত্যাদি বায়োপাঙ্ক কল্পবিজ্ঞানের কমন থিম।পাওলো বেসিগালুপীর “দ্য উইন্ডআপ গার্ল”, নীল শুস্টারম্যান-এর “আনওয়াইন্ড”, রুডি রুকার-এর “ওয়েটওয়্যার” বায়োপাঙ্ক কল্পবিজ্ঞানের উদাহরণ। আর ন্যানোপাঙ্কে মূলত মাইক্রো এবং ন্যানো টেকনোলজির ব্যবহার এবং এটির সুবিধা-অসুবিধা প্রচুর পরিমাণে থাকে।যেমন, লিন্ডা নাগাটার “টেক-হ্যাভেন”
এছাড়াও নির্দিষ্ট সময়ের পটভূমিতে সেই সময়ের চেয়ে নানা ধরনের উত্তরাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের আধিক্য এর উপর ভিত্তি করে স্টোনপাঙ্ক (স্টোন এজ এর উপর ভিত্তি করে), স্যান্ডেলপাঙ্ক(ব্রোঞ্জ এজ এর উপর ভিত্তি করে), ক্লকপাঙ্ক(রেনেসাঁ এর সময় এর উপর ভিত্তি করে), রে পাঙ্ক বা রে গান গথিক( বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের বছরগুলোর উপর ভিত্তি করে ), এটমপাঙ্ক( দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে কোল্ড ওয়ার এর সময় এর উপর ভিত্তি করে ), সোলার পাঙ্ক(ইউটোপিয়ান ফিউচার ভিত্তিক) সহ এ শাখার আরো বেশ কিছু প্রশাখা রয়েছে। তাছাড়া ফিউচারিস্টিক কালচার এর উপর ভিত্তি করে ভিক্টোরিয়ান ফিউচারিজম, রেট্রো ফিউচারিজম, ক্যাসেট ফিউচারিজম, আফ্রো ফিউচারিজম, পোস্ট মডার্নিজম ভিত্তিক কল্পবিজ্ঞান গুলো কল্পবিজ্ঞানের এই ধারায় পরে। বাংলা ভাষায় তানজীম রহমানের “আর আমি হবো ধ্বংসতারা” কে পাঙ্ক ভিত্তিক সাই ফাই বলা যায়।


মহাকাশভিত্তিক সাই-ফাই

কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের আদিকাল থেকেই এর এক বড় অংশ জুড়ে রয়েছে মহাকাশভিত্তিক কল্পবিজ্ঞান। এই বিশাল শাখার রয়েছে নানা ধরণের প্রশাখা। তার ভিতরে অন্যতম হলো স্পেস এক্সপ্লোরেশন। এখানে সাধারণত মানুষের বিভিন্ন ধরণের মহাকাশযানে করে চাঁদ, মঙ্গল গ্রহ সহ নানা ধরণের গ্রহে উপগ্রহে পাড়ি জমানো, ভিনগ্রহের বা মহাজাগতিক প্রাণী খোঁজা এবং মহাকাশে কলোনি বিস্তার করা নিয়ে লেখা হয়। অনেক সময় এ ধরণের কল্পবিজ্ঞানের ঘটনাপ্রবাহ বেশিরভাগ সময় মহাকাশযানের ভিতরেই ঘটে। আর্থার সি. ক্লার্কের “রামা সিরিজ”, অ্যান্ডি ওয়্যার-এর “দ্য মার্শিয়ান”, জ্যাক ম্যাকডেভিট-এর “দ্য ইঞ্জিনস অফ গড” এ শাখার ভিতরে পরে। বাংলা ভাষায় মুহম্মদ জাফর ইকবালের “মহাকাশে মহাত্রাস”, ”টাইট্রন একটি গ্রহের নাম”,“মেতসিস” সহ বেশ কিছু সাই-ফাই, নাবিল মুহতাসিমের “বিভং”-ও কল্পবিজ্ঞানের এই শাখার ভিতরে পরে।
মহাকাশভিত্তিক কল্পবিজ্ঞানের আরেক জনপ্রিয় ধারা হলো স্পেস অপেরা। সাধারণত এ ধরণের কল্পবিজ্ঞানের পটভূমি খুবই বড় ক্যানভাসের হয় এবং চরিত্রের সংখ্যাও অনেক বেশি থাকে। বিশাল বিশাল গ্রহ, সেই সব গ্রহের নানা ধরণের প্রাণী এবং সভ্যতা, উন্নত প্রযুক্তি, মহাকাশযান এবং তাদের শাসকদের অন্য গ্রহ বা তাদের প্রযুক্তি দখলের লড়াই, মুক্তিকামী জনগণের রেবেলিয়ন এ ধরণের গল্পের প্রধান উপজীব্য। প্রায় সময়ই এ ধরণের সাই-ফাইতে গ্যালাকটিক এম্পায়ার এবং জেনারেশন শিপের দেখা পাওয়া যায় যা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের বেশ আইকনিক টার্ম। আইজ্যাক আসিমভের কালজয়ী “ফাউন্ডেশন” সিরিজ এই প্রশাখার অংশ। এছাড়াও ফ্রাঙ্ক হার্বার্ট-এর বিখ্যাত সাই-ফাই সিরিজ “ডিউন”, ড্যান সিমন্স-এর “হাইপেরিয়ন”, জেমস এস. এ. কোরির “দ্য লিভায়াথান ওয়েকস”, অরসন স্কটের “এন্ডার্স গেম” সিরিজ , পিয়ার্স ব্রাউনের “রেড রাইজিং” সিরিজ সহ অনেক বিখ্যাত সাই-ফাই উপন্যাস এই প্রশাখার ভিতরে পরে।
এ ছাড়াও মহাকাশভিত্তিক কল্পবিজ্ঞানের উল্লেখযোগ্য শাখার ভিতরে রয়েছে প্লানেটারি রোমান্স যেখানে মানুষ কিংবা ভিনগ্রহের দুই প্রাণীর রোমান্টিক অ্যাঙ্গেলভিত্তিক লেখা থাকে (এডগার রাইজ বারোজ-এর “দ্য প্রিন্সেস অফ মার্স”), সোর্ড এন্ড প্ল্যানেট (রবার্ট ই. হাওয়ার্ড-এর “আলমিউনিক”) এবং স্পেস ওয়েস্টার্ন (জশ হুডেন-এর “সেরেনিটি”)।

লস্ট কলোনি/ওয়ার্ল্ড

কল্পবিজ্ঞানের এই শাখায় সাধারণত কিছু অভিযাত্রীর হারিয়ে যাওয়া প্রযুক্তি বা সভ্যতা (যেমন আটলান্টিস) কিংবা কিংবদন্তী কোন জায়গা (যেমন এল ডোরাডো), প্রাণী (যেমন ডায়নোসর) খোঁজার অ্যাডভেঞ্চারকে কেন্দ্র করে চালিত হয়। কখনো কখনো এটি আন্তঃগ্যালাকটিক ট্রেজার হান্টিং সাই-ফাইতেও পরিণত হয়। এ ধরনের অ্যাডভেঞ্চার কেন্দ্রিক কল্পবিজ্ঞানে মুল চরিত্রের উপর সাধারণত অনেক বেশি ফোকাস দেয়া হয়।
জুল ভার্নের “ভয়েজেস এক্সট্রাঅর্ডিনারিজ” (জার্নি টু দ্য সেন্টার অফ দ্য আর্থ, এরাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেইজ, দ্য মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড, ফাইভ উইকস ইন এ বেলুন, ২০,০০০ লীগস আন্ডার দ্য সী ইত্যাদি) এ শাখার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। আর্থার কোনান ডয়েলের “দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড”, ইয়ান এম. ব্যাঙ্কস-এর “ম্যাটার”-ও কল্পবিজ্ঞানের এই শাখার উদাহরণ, সত্যজিৎ রায়ের প্রফেসর শঙ্কু সিরিজের বেশ কয়েকটি গল্প (উদাহরণ - শঙ্কু এবং এল ডোরাডো) ও এই শাখার ভিতরে পরে।

লিখাঃ জাহিদুল ইসলাম রাজু

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম