"আমি জীবনে মোট তিনবার ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। আপনাকে ভয়ের ঘটনাটা বলতে চাইছি, আপনি কি শুনবেন?"
মোবাইলের পর্দায় ভেসে উঠা লাইনগুলোর দিকে মহাবিরক্তি নিয়ে তাকালেন সাইকিয়াট্রিস্ট জিয়াউল হক। পর্দার উপরে এক কোনে সময় দেখাচ্ছে রাত তিনটা। এতো রাতে কারো ভয়ের ঘটনা শুনতে ইচ্ছে করে না। পাশের কোলবালিশ চেপে ধরে ঘুমাতে ইচ্ছে করে। তারপরেও জিয়াউল হক টাইপ করতে বাধ্য হলেন, "আচ্ছা বলুন শুনি।" একটা অপরিচিত মেয়ে যখন আগ্রহ নিয়ে কোনো গল্প বলতে চায় তখন তাকে মুখের উপর না বলে দেয়া কঠিন কাজ।
"সবচেয়ে আগের ঘটনাটাই প্রথমে বলি। আমার ছেলেবেলা কেটেছে টাঙ্গাইলে। তখন আমার সাত আট বছর বয়েস হবে। ভীষণ দস্যি ছিলাম। ওই বয়েসেই টো টো করে সারা কালিহাতি ঘুরে বেড়াতাম। কিন্তু বড়দের কাছে বকা শুনিনি কখনো। দেখতে ভীষণ কিউট ছিলাম তো। হা হা হা। একমাত্র মার খেয়েছি মায়ের হাতে, খাওয়া নিয়ে খুব যন্ত্রণা করতাম। মারপিট না করে আমাকে কখনো ভাত গেলানো যেতো না। যাই হোক, ভয় পাওয়ার ঘটনায় আসি।
আমি, শিমু আপা, ত্বন্বি… আমাদের কয়েকজনের একটা গ্যাং ছিল, প্রায় সাত আটজন বাচ্চা। একেকজনের একেক বয়েস, শিমু আপা সবার বড়, তখন বোধ হয় উনার বারো হতে চলেছে। দুষ্টুমিতেও সে সবার চেয়ে এগিয়ে। আর আপার যা ভীষণ সাহস। আমাদের সাথে বাজি ধরে উনি ছেলেদের মাথায় ঢিল মেরেছেন। সেদিন আপা বললেন আমাদের আরেকটা কাজ করে দেখাবেন, কিন্তু আমরা মরে গেলও কাউকে বলতে পারব না। আপাকে আমরা সবাই ভালোবাসি, আপার সাথে প্রতিটি মুহুর্তই একেকটা এডভেঞ্চারের মতো। অতয়েব কাউকে কিছু বলার তো প্রশ্নই আসে না।
নিষিদ্ধ কাজটি দেখানোর জন্যে আপা আমাদের নিয়ে গেলেন মধ্য পাড়ার পুরোনো সিনেমা হলটার পেছনে। ওদিকে যেতে হবে শুনেই আমার গা ছমছম করে উঠল। সিনেমা হলের সামনে যেই দীঘিটা, নাম ষোলমোহর, নানা রকম কুখ্যাতি আছে ওই দিঘির। গভীর রাতে ওই পুকুরে একটা কালো নৌকা দেখা যায়। নৌকায় ষোলজন বামুন থাকে। ওরা পাড়ে কাউকে একলা পেলে টেনে নিয়ে যায় দীঘির মাঝখানে। সেই সিনেমা হলটা এখনো আছে, জানেন। এখন আর সিনেমা দেখানো হয় না, গুদাম ঘর করে ফেলা হয়েছে। ষোলমোহর দীঘি এখন শুকিয়ে গেছে হয়তো। যাই না অনেক দিন। আচ্ছা গল্পে ফিরে যাই। সিনেমা হলের পেছনে যেতে হবে শুনেই আমি গাইগুই শুরু করলাম। শিমু আপা অভয় দিয়ে বললেন, 'আরে বোকা দিনের বেলা ভয় কি। আর হলের পেছনে ত ভুত থাকে না। ভুত থাকে ষোলমোহর দীঘিতে।' আপার কথায় ভয় কাটলো না, কিন্তু গাইগুই থামিয়ে দিলাম। আসলে আপার সাথে ওজর আপত্তি করে লাভ নাই।
সিনেমা হলের পেছনে একটা ছোট্ট ডোবা। তাকে ঘিরে কিছু বড় ঝোপঝাড়। দিনের বেলাও এদিকে মানুষ খুব একটা আসে না। হয়তো সেজন্যেই আপা রার নিষিদ্ধ কাজটির জন্যে এই জায়গাটা বেছে নিয়েছিলেন। ঝোপের আড়ালে গিয়ে তিনি ফ্রকের নিচ থেকে জিনিসগুলো বের করলেন।
গোল্ডলিফ সিগারেট!
আমরা পিচ্চিরা এমন চোখ গোলগোল করে তাকালাম যেনো আপার হাতে সিগারেট নয়, বন্দুকের গুলি দেখতে পাচ্ছি। আহা কতো ইনোসেন্ট ছিলাম সেই সময়। তখন আমাদের ধারনা ছিলো সিগারেট হচ্ছে বড়দের, বিশেষ করে মুলত ছেলেদের জিনিস। পাড়ার ঝন্টুকে মাঝে মধ্যে রাস্তায় ফেলে দেয়া আধখাওয়া সিগারেট তুলে টান দিতে দেখেছি, কিন্তু কোনো মেয়ের হাতে এর আগে সিগারেট দেখিনি। ত্বন্বী চাপা উত্তেজনা নিয়ে বলল, আপা তুমি সিগারেট কই পেয়েছো??
শিমু আপা উত্তর না দিয়ে খুব কায়দা করে ঠোঁটে শলাকা পুরল। তারপর একহাতে আড়াল দিয়ে ফস করে দেয়াশলাই জ্বালিয়ে ফেলল। জ্বলন্ত দেয়াশলাই ঠেসে যত্ন করে সিগারেট ধরিয়ে কষে দিলো টান। আপা হয়তো একটু বেশি জোরেই টান দিয়ে ফেলেছিলো, এরপর তো কাশতে কাশতে চোখে পানি এসে একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা। আমার তো ভয় হচ্ছিলো আপা মরেই যায় কিনা। কিন্তু একটু পরেই দেখি কই আপাতো হাসছে। আমাদের দিকে জ্বলন্ত শলাকাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, খাবি?
আমরা সবাই পিছিয়ে গেলাম। আপা ঠোঁট উলটে বলল সবগুলা টিকটিকির ডিম। বলে আবার টান দিলো, তারপর আরেক দফা কাশি। আমরা সবাই হিহি করে উঠলাম। যেনো খুব মজার একটা কান্ড ঘটছে। এরই মধ্যে আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে ত্বন্বী সিগারেট খেতে রাজি হয়ে গেল। কিন্তু একটা টান দেয়ার পর ওর দাপাদাপি দেখে কে, হা হা হা।
জিনিসটা সবার আগে আমার চোখে পড়ল। তখন বিকেল পড়ে এসেছে, সন্ধ্যা হই হই ভাব। ওই মনমরা আলোয় আমি ডোবায় অদ্ভুত কিছু দেখতে পেলাম। কালো পলিথিনের ব্যাগে মোড়ানো একটা কিছু ডোবার মাঝে ভাসছে। হ্যাঁ শুনে হয়তো অদ্ভুত কিছু মনে হচ্ছে না, কিন্তু ব্যাগটার মধ্যে সত্যি অদ্ভুত কিছু ছিলো। আমি বাকিদের ডেকে দেখালাম। ওরা সবাইও উত্তেজিত হয়ে উঠল। গবেষণা শুরু হলো কিভাবে ব্যাগটা মাটিতে টেনে আনা যায়। ডোবাটা খুব বেশি গভীর হবে না, কিন্তু পানির রঙ একেবারে কালো, আর আবর্জনা ভর্তি। এমন কালো পানি গায়ে লাগানোর ইচ্ছে কারুর নেই। অবশেষে খুজে পেতে কিছু বাশের কঞ্চি জোগাড় করা হল, দুটো কঞ্চি একটার সাথে আরেকটা বেধে লম্বা করা হলো। এখন ব্যাগের নাগাল পাওয়া যাচ্ছে।
তবে নাগাল পেলেও কঞ্চি দিয়ে জিনিসটা পারে তুলে আনা সহজ হলো না। টেনে আনতে গেলেই ব্যাগটা টুপ করে পানিতে ডুবে যাচ্ছে, আবার বাশ সরিয়ে নিলেই একটু পর অলস ভাবে ভেসে উঠছে। ব্যাগটা যেনো আমাদের সাথে এক শয়তানি খেলায় মেতে উঠেছে। কিন্তু শিমু আপারও যেনো রোখ চেপে গিয়েছিলো। যেভাবে করেই হোক ব্যাগটা সে পারে এনেই ছাড়বে। আমরা বাকি বাচ্চারা কিছুক্ষণের মাঝেই বিরক্ত হয়ে গেলাম, আপাকে বললাম বাদ দিতে। এদিকে সন্ধ্যাও ঘনিয়ে এসেছে। বাবা ফেরার আগেই বাড়িতে ঢুকে হাত পা ধুয়ে পড়তে বসতে না পারলে কপালে খারাবি আছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা।
অবশেষে শিমু আপারই জয় হলো। বেয়াড়া ব্যাগটাকে একটু একটু করে টেনে টেনে তিনি পাড়ে এনে তুললেন। আমাদের ভাটা পড়া উত্তেজনায় নতুন করে ঘি পড়ল যেনো। কি আছে ব্যাগের ভিতর!! দেখতে আমাদের তর সইছে না।
ব্যাগটা বেশ ভালোভাবে পলিথিন দিয়ে মোড়ানো। আর কিছু না পেয়ে শিমু আপা খালি হাতে টেনে পলিথিন ছিড়ে ফেললেন। ওই নোংরা পানি মাখা পলিথিন তিনি হাত দিয়ে ধরছেন দেখে ঘেন্নায় আমার গা শিউরে উঠল। কিন্তু আপাকে তখন যেনো ভুতে পেয়েছে। পলিথিন সরাতে ভেতরে কাপড়ে জড়ানো একটা পুটুলি দেখা গেল। পুটুলির উপর দিয়ে ভেতরের বস্তুটার অবয়বের হালকা আভাস পাওয়া যাচ্ছিলো। এখন হলে হয়তো এক পলকেই ভেতরের জিনিসটাকে চিনতে পারতাম। হয়তো তখনি সেই ব্যাগ আবার ডোবার পানিতে ছুড়ে ফেলে দিতাম। হয়তো তখনি পালিয়ে যেতাম সেই জায়গা থেকে। কিন্তু সেই অপরিণত বয়সে আমাদের অনভ্যস্ত চোখে কোনো অশুভ ইঙিত ধরা পরেনি। বরং পুটুলির ভেতর কি আছে দেখার জন্যে আমরা শিমু আপার কাধের উপর দিয়ে হুমড়ি খেয়ে পরলাম।
পলিথিনের ব্যাগে হয়তো ফুটো ছিলো। ভেতরের কাপড়ের পুটলিটাও পানিতে ভিজে গেছে। পলিথিন সরাতেই ভক করে একটা বিশ্রি গন্ধ আমাদের নাকে ধাক্কা দিলো। এমনই কুতসিত সেই গন্ধ যে মুহুর্তে আমার গায়ের সবগুলো লোম দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু সেটা আমাদের কৌতুহলকে ছাপিয়ে যেতে যথেষ্ট ছিলো না। দুর্গন্ধ ও পচা পানি উপেক্ষা করে শিমু আপা কাপড়ের ভাজ খুলতে শুরু করলেন। ভেজা পচা কাপড় যেনো ব্যান্ডেজের মতো করে ভেতরের বস্তুটিকে আকড়ে থাকতে চাইছে। যেনো সে কিছুতেই তার ভেতরে লুকানো গুপ্তধনকে সবার চোখের সামনে উন্মুক্ত করতে চায় না। কিন্তু শিমু আপার একরোখা জেদের কাছে তাকে পরাস্ত হতে হলো।
একেবারে শেষ মুহুর্তে কোনো এক অজানা আশংকায় আমার বুক কেপে উঠেছিলো। কিছু একটা যেনো আমার বুকের মধ্যে খামচে ধরেছিলো। মাথার ভেতর কে যেন চিতকার করে উঠল, ওই কাপড়ের কুন্ডুলির ভেতর উকি দেয়া উচিত হবে না। কিছুতেই না। কারন ওর ভেতরে লুকিয়ে আছে অশুভ কিছু। আমি হাত বাড়িয়ে আপাকে বাধা দিতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ততোক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। আপা কাপড়ের শেষ ভাজ সরিয়ে ফেলেছে।
সবাই অস্ফুট শব্দ করে সরে গেল। আমি তখনো তাকিয়ে আছি। কাপড়ের ভেতর শুয়ে থাকা বাকাচোরা আকৃতির বস্তুটা কি আমি তখনো ধরতে পারিনি। দেখতে ছোট্ট একদলা মাংস্পিন্ডের মতো... পানির স্পর্শে ফুলে ফেপে ফ্যাকাসে নীল বর্ণ ধারন করেছে… তার মধ্যে মোটা মোটা কালচে শিরা উপশিরা ফুটে আছে… আর অইটা.. একটা ক্ষুদে হাত… ছোট ছোট আঙুল… একটা শিশুর হাত… ব্যাগের ভেতর একটা সদ্যজাত শিশু.. পচে গলে গেছে… হাত বাড়িয়ে আছে আমার দিকে...
চিতকার করে আমি ছুটতে শুরু করলাম। ঝোপঝাড় ভেঙে চুরে মরিয়া হয়ে ছুটছি। বাকিরাও দৌড়াচ্ছে আমার পেছন পেছন। ভয়ংকর জান্তব এক আতংক যেন আমাদের তাড়া করে ফিরছে। দৌড়ুতে দৌড়ুতে আছড়ে পড়লাম কয়েকবার। হাটুর চামড়া ছিলে গেল। কিন্তু সেদিকে আমার খেয়াল নেই। আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে ছুটছি…
এক দৌড়ে আমাদের বাড়ির উঠোনে এসে পড়লাম সবাই। তখন আমাদের খেয়াল হলো শিমু আপা আমাদের সাথে নেই।
আপাকে যখন উদ্ধার করা হলো তখন সুর্য ডুবে গেছে। আপা নাকি তখনো ডোবার পারে বসেছিলো। আপার চোখ নাকি উলটে গেছিলো। তার হাতে ধরা ছিলো সেই পচাগলা শিশুর লাশ। আপাকে পরের কয়েকদিন আর ঘরের বাইরে দেখা গেলো না। শুনলাম উনার গায়ে ভীষণ জ্বর। প্রায়ই জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছেন। মা আমাকে কড়া করে নিষেধ করে দিলেন শিমু আপাকে যেনো দেখতে না যাই। এতো কড়া ভাবে নিষেধ না করলেও চলত। সেই সন্ধ্যার সেই আতংক আমাকে তখনো জাপটে আছে। নিজেও কয়েক দিন ঘরের বার হইনি। বাচ্চাটাকে নিয়ে কয়েকদিন বেশ কানাঘুষা চলল। বড়রা আমাদের সামনে এই বিষয়ে কোনো আলাপ করত না। ত্বন্বী লুকিয়ে চুরিয়ে যা শুনে এসেছে তা হলো ওটা নষ্ট বাচ্চা। কেউ গোপনে ডোবায় ফেলে গেছে। নষ্ট বাচ্চা জিনিসটা কি তা বুঝার মতো বয়েস আমার তখনো হয়নি। শুধু বুঝলাম নষ্ট বাচ্চা খুব লজ্জার আর নিষিদ্ধ একটা কিছু। শহরে এবোরশন করার অনেক উপায় থাকে, গ্রামদেশে খুব গোপনে ধাই ডেকে এনে করতে হয়… যাই হোক। বাচ্চার মা কে হতে পারে তা নিয়েও বিস্তর গবেষণা হয়েছিলো। সন্দেহের তালিকায় কয়েকজনের নাম উঠলো কিন্তু নিশ্চিত ভাবে কাউকে সনাক্ত করা যায়নি।
শিমু আপা ঘরের বাইরে এলেন আট দিন পর। তাকে দেখে আমরা সবাই চমকে উঠলাম। চুল উস্কু খুশকো, মুখ শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে। আমাকে তিনি কাছে ডেকে ফিসফিস করে বললেন সেই সন্ধ্যায় বাচ্চাটা নাকি তার আঙুল চেপে ধরেছিলো। তিনি এখনো নিজের আঙুলে বাচ্চাটার স্পর্শ অনুভব করেন। অনেক দিন লেগেছিলো আপার স্বাভাবিক হতে। আসলে তিনি কখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে পারেননি। মৃত্যুর একমাস আগেও আমাকে বলেছিলেন বাচ্চাটাকে নাকি তিনি মাঝে মাঝে স্বপ্নে দেখেন। আপাকে বলিনি, বাচ্চাটাকে আমিও প্রায়ই স্বপ্নে দেখি… ভুলতে পারি না কিছুতেই।
আচ্ছা ভোর হতে তো আর খুব বেশি বাকি নেই। আপনি ঘুমাবেন না? সকাল নয়টা থেকে তো আপনার ক্লাস শুরু। স্যরি আপনার রাতের ঘুমটা নষ্ট করে দিলাম। আজ তবে যাই।"
"আপনার মোট তিনটে ভয়ের অভিজ্ঞতা আছে বলেছিলেন... "
"হু… বাকি দুটো আরেকদিন বলব, শুভরাত্রি"
Writer: Ashif Abdul (Studied Finance at University of Dhaka)