মশা সমাচার !!


পৃথিবীতে সবচেয়ে নিষ্পাপ আর নিরীহ প্রানী  গুলোর কথা যদি উঠে তাহলে আমি মশার কথা বলবো ।  এরা আমাদের যা উপকার করে তা আমরা ঘূর্ণাক্ষরেও টের পাইনা।
মশা সমন্ধে বিস্তর জানার জন্য আপনাকে অবশ্যই  এই আর্টিকেল টা পুরোটা পড়তে হবে ।
প্রথমেই মশার ক্ষতিকারক দিক গুলো তুলে ধরা হলোঃ
পৃথিবীতে মানবজাতি ধ্বংস হওয়ার জন্য যে সকল প্রধান কারণ ধারণা করা হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম কারণ হচ্ছে মশা দ্বারা মানব জাতি ধ্বংস। বর্তমানে গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর পরিমাণ বাড়ছে। সেই সাথে বরফ গলে বাড়ছে পানির পরিমাণ । আর এটাই মশাদের বংশবৃদ্ধির জন্য অনুকূল পরিবেশ। খুব বেশি দিন নেই অচিরেই দেখা যাবে মশাদের বংশবৃদ্ধির হার পূর্বের থেকে বহু গুণে বেড়ে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ের ডেংগু আর চিকুনগুনিয়ার এরই ফল।  কি সাংঘাতিক !!  তাইনা! ছোট্ট একটা প্রাণী, অথচ কি পাওয়ার তাদের। অবশ্য কারণ আছে ।

মশা আর্থোপোডা পর্বের প্রাণী। আর এই পর্বের প্রাণীর সংখ্যা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি।
COMMON NAME    : Mosquitoes
SCIENTIFIC NAME : Culicidae
TYPE                        : Invertebrates
Diet                           : Carnivore
Group Name             : Swarm
জীবনকাল                  :  2 weeks to 6 months
                                    (প্রজাতিভেদে)।
                                   প্রচলিত ধারণা ৩ দিন।
Size                          : 0.125 to 0.75 inches
Weight                      : 0.000088 Ounces

সারা পৃথিবীতে মশার প্রজাতি আছে প্রায় ৩৫০০। তবে ন্যাশনাল জিওগ্রাফির মতে, এই সংখ্যাটা ৩০০০। এই এত প্রজাতির মধ্যে মানুষের রক্ত খায় গুটি কয়েক প্রজাতি। সাধারনত স্ত্রী মশারা তাদের ডিম ফোটানোর সময় আমিষ এর জন্য মানবদেহে থেকে রক্ত শোষণ করে । কারণ মানুষের রক্ত আমিষের অন্যতম সোর্স।
রক্ত শোষণ করা মশাদের সংখ্যা 200 বা তারও কম। অন্য মশাগুলো পাখি অথবা অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রানীদের থেকে রক্ত পান করে এমনকি কিছু মশা আছে যারা মাছের রক্তও খায়। তারা গাছ, ফল প্রভৃতির নেক্টার বা রস , কান্ডের রস খেয়ে বেঁচে থাকে ।অনেক মশা রয়েছে যারা মানুষের রক্ত পছন্দ করে না। যেসব মশা মানুষের রক্ত পান করে তারা সবাই মানুষের রোগ জীবাণু বহন করে না। প্রাথমিক ভাবে ৩ প্রজাতির মশাকে রোগ জীবাণু বহন করার জন্য দায়ী করা হয়। মশার কারণে বিভিন্ন ধরনের রোগ জীবানু ছড়ায়। ম্যালেরিয়া, হলুদ জ্বর, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস, জিকা ভাইরাস এগুলো মশার মাধ্যমে ছড়ায়। এগুলোর কারণে যে  মৃত্যু হয় তা মানুষ কর্তৃক হত্যার চেয়েও বেশি। এই রোগ জীবাণু গুলো প্রতিহত করতে পারলে লক্ষাধিক মানুষ বিভিন্ন রোগবালাই থেকে মুক্তি পেত।
যে সকল মশা গুলো সাধারনত ভাইরাস বহন করে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো এডিস, কুলেক্স,এনোফিলিস, হেমাগোগাস প্রভূতি। উদাহরণস্বরূপ, প্লাজমোডিয়াম, ম্যালেরিয়া সৃষ্টিকারী প্রোটোজোয়ান পরজীবী, আনোফিলস বংশোদ্ভূত মশা দ্বারা ছড়িয়ে পড়ে। আনোফিলস মশার প্রায় 460 টি প্রজাতির মধ্যে কেবল একশত বা তারও বেশি প্লাজমোডিয়ামের পাঁচটি প্রজাতি বহন করতে পারে যা মানুষকে সংক্রমিত করে। এই শত শত প্রজাতির মধ্যে মাত্র কয়েক ডজন মশাই মানুষের ক্ষতির কারণ । Plasmodium falciparum , ম্যালেরিয়ার একটি প্রজাতি। এটি সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর জন্য দায়ী। ম্যালেরিয়া কে ধ্বংস করার জন্য শুধুমাত্র কয়েকটি প্রজাতির মশাকে ধ্বংস করলেই হবে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফির মতে সারা পৃথিবীতে প্রতিবছর প্রায় ২৪৭ মিলিয়ন মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়। আর প্রতি বছর প্রায় ২ মিলিওয়নেরও অধিক মানুষ মারা যায় এই ম্যালেরিয়ার প্রোকোপে । শুধুমাত্র gambiae প্রজাতির মশা মারলেই  লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচানো যাবে।
এখন আসি যদি পৃথিবীতে কোন মশা না থাকে কেমন হবে আমাদের পৃথিবী। ভাবছেন হয়তো আমাদের চির শত্রু না থাকলে আমরা চির শান্তিতে বসবাস করবো। তাহলে জেনে রাখুন পৃথিবীতে যদি মশা না থাকে তাহলে এর পরবর্তী কয়েক দশকে কি কি সমস্যা তৈরি হতে পারেঃ
১) পৃথিবীতে পাখির সংখ্যা অর্ধেক হয়ে যাবে।
২) মাছের সংখ্যা প্রথমে অনেক কমে যাবে পরবর্তীতে এরা অভিযোজনের মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব ঠিক রাখতে পারলেও পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসতে পারবে না।
৩) সারা পৃথিবীতে মারাত্মক দূর্ভিক্ষ ঘটার সম্ভাবনা প্রবল।
৪) পাখি ছাড়াও প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরের খাদকদের সংখ্যা কমে যাবে।
৫) যদি দূর্ভিক্ষ না হয় তাহলে অন্যান্য প্রাণি ছাড়াও মানুষের জনসংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়বে।


যদিও মশার কারণে আমরা এমনিতেই অনেক দুর্ভোগে পরি কিন্তু আমাদের সকলের অগোচোরে এটি প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ ভাবে আমাদের উপকার করে চলে যা আমরা টের পাইনা। মশাকে আসলে আমরা এখনো সেভাবে ব্যবহার করতে শিখিনি। সারা পৃথিবী ব্যাপী এই মশাদের বিচরন ক্ষেত্র। আর এটাই সবচেয়ে বড় সুবিধা। আমরা যদি কোন জিনিস কে সহজে ছড়াতে চাই তাহলে মশা ছাড়া আর সবচেয়ে ভালো বাহক আর কে হতে পারে। তবে অবশ্যই ভালো জিনিস ছড়াতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় আমরা যদি সারা পৃথিবীতে কোন একটি গাছের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে চাই তাহলে কিন্তু আমরা মশাকে বাহক হিসেবে ব্যাবহার করতে পারি।আবার ভাইরাস বাহী মশাকে ধ্বংস কিন্তু আমরা এই মশা দিয়েই করতে পারি। তবে বলে রাখি এ ক্ষেত্রে কিছু অসাধু ঔষধ কোম্পানি রয়েছে যারা নিজেদের ব্যাবসা বৃদ্ধির জন্য মশাকে ভাইরাসের বাহক হিসেবে ব্যাবহার করে। মশার মাধ্যমে সকলের মাঝে ভাইরাস ঢুকিয়ে দেয়। যত মানুষ আক্রান্ত হবে কোম্পানি গুলোর তত ঔষধ বিক্রি হবে। কিছুদিন আগে আমাদের দেশে ঘটে যাওয়া ডেঙ্গু আর চিকুনগুনিয়া যে মহামারী আকার ধরাণ করেছিলো তার পিছনে অনেক ঔষধ কোম্পানি কে দায়ী করা হয়।
জেনেটিক গবেষণায় অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার হচ্ছে ড্রসোফিলা (Drosophila melanogaster), যা এক প্রজাতির মাছি। রোগ সৃষ্টিকারী এই মাছি যে মানুষের উপকারে আসবে তা আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম কি কল্পনা করতে পেরেছিল? তাই মশাকে ব্যাবহারের আরো অনেক ক্ষেত্র এখনো আবিকৃত হয় নি। মশার মাধ্যমে যে সকল রোগ গুলো হয় তার জন্য কিন্তু প্রকৃত পক্ষে মশারাও দায়ী নয়। একেক মশা একেক ভাইরাস বহন করে, আবার একটি মশা একাধিক ভাইরাসও বহন করতে পারে। কোন ভাইরাসবিহীন মশা যখন কোন ভাইরাস আক্রান্ত ব্যাক্তিকে কামড় দেয় তখন উক্ত ভাইরাস মশার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। মশকীর ক্রপে ভাইরাস দমন করার জন্য নির্দিষ্ট এনজাইম থাকে, যদি উক্ত ভাইরাস কে দমন করার জন্য যদি নির্দিষ্ট এনজাইম না থাকে তাহলে উক্ত ভাইরাস বিনষ্ট হবে নাহ। আর পরবর্তিতে মশকী যখন অন্য কোন সুস্থ ব্যাক্তিকে আক্রমণ করবে তখন ঐ সুস্থ ব্যাক্তি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হবে। আপাত দৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে মশার মাধ্যমেই উক্ত রোগ গুলো ছড়াচ্ছে, কিন্তু তাদেরও অধিকার আছে বংশ বৃদ্ধি করার(মশারা নিজেদের ডিম ফোটানোর ক্ষেত্রে আমিষের জন্য মানুষের রক্ত শুষে )। সুতরাং এই দিক দিয়ে তারা কিন্তু সম্পূর্ণ নির্দোষ। আবার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও মশার অনেক ভূমিকা আছে। শুধুমাত্র মশা নিধনের জন্য সারা পৃথিবীতে যত কোম্পানি রয়েছে সেখানে লাখ লাখ মানুষের জীবিকা নির্বাহের কাজ চলছে। সরকার টেক্স পাচ্ছে,দেশের উন্নতিতে এই ক্ষাত অবদান রাখছে। ঔষধ কোম্পানি গুলো তো হাজার হাজার কোটি টাকা ইনকাম করে, কয়েকশ কোটি টাকা সরকার কে টেক্স দেয়, আবার যেই সকল হাসপাতালে চিকিৎসা চলে সেখান থেকেও সরকার টেক্স পাচ্ছে। এই সকল দিক বিবেচনায় আনলেও কিন্তু বুঝা যায় মশার অর্থনৈতিক গুরুত্ব কত।

মশার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি দিকঃ
১। খুব কম লোক আছে যারা মশার পরাগায়ন নিয়ে লিখে। মশার প্রায় ৩৫০০ প্রজাতির মাঝে মাত্র রক্ত খেকো মশা আছে ২০০ এর কাছাকাছি। কিন্তু বাকি ৩৩০০ প্রজাতির মশারা কি করে? তারা গাছ, ফল প্রভৃতির নেক্টার বা রস খেয়ে বেঁচে থাকে। যারা কান্ডের রস খেয়ে বেঁচে থাকে তারা উদ্ভিদ পরাগ সংযোগে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । এই ৩৩০০ প্রজাতির মশারা কিন্তু উদ্ভিদের পরাগায়নে ব্যাপক ভুমিকা রেখে চলেছে। বিশেষ করে অর্কিড গাছে এইভাবে পরাগমিলন হয়ে থাকে।
২। মশারা মানুষের জনসংখ্যা কমাতে সাহায্য করে।আর এটাই মশার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক। প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ এবং প্রাণী মারা যায় শুধুমাত্র মশা বাহীত রোগের কারণে। এতে পরিবেশের উপর চাপ কমে। কথাটা শুনতে খারাপ লাগলেও কিছু করার নেই। এটিই প্রকৃতির নিয়ম। প্রকৃতি কোন না কোন ভাবে নিজের স্বাভাবিক অবস্থানে ফিরে আসতে চাইবে। যেমন গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর ফলে সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে যাবে। অনেক দেশ ডুবে যাবে। সেই সাথে কোটি কোটি মানুষ মারা যাবে। প্রকৃতি আবার তার পূর্বের অবস্থানে ফিরে আসবে। কিন্তু মশারা কখনো ধ্বংস হবে নাহ। এরা হাজার হাজার বছর ধরে টিকে আছে, সেই ডায়নোসরের আমল থেকে। এদের অভিযোজন ক্ষমতা অনেক,দিনের পর দিন এদের প্রজাতি গুলোর শুধু উন্নতিই হচ্ছে।গোটা ডাইনোসর জাতি ধ্বংস হয়ে গেলেও প্রকৃতি এদের বাচিয়ে রেখেছে, আসলেই এদের দরকার আছে। এতক্ষন যাবত মশার অনেক গুণকীর্তন করলাম।

এখন উপরোক্ত যে ৫টি সমস্যার কথা বলেছিলাম তার কারণ নিয়ে কথা বলি।
১। পৃথিবীতে পাখির সংখ্যা অর্ধেক হয়ে যাবে। এর কারণ বেশির ভাগ পাখির খাবার হচ্ছে মশা জাতীয় কীট। আর গোটা মশাকূল যদি ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে এরা প্রচুর খাদ্যাভাবে পরবে। আর এতে পাখির সংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে ( একটি গবেষণা মতে)।
২। মাছের সংখ্যা কমে যাবে। কারণ অনেক মাছ আছে যারা মশার লার্ভা খেয়ে বেচে থাকে। এই কারনে মাছের সংখ্যা প্রথমে অনেক কমে যাবে পরবর্তীতে এরা অভিযোজনের মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব ঠিক রাখতে পারলেও পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসতে পারবে না।
৩। মশারা পরাগায়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। আর এজন্যই এরা ধ্বংস হয়ে গেলে পরাগায়ণ কমে যাবে আর ফসল উৎপাদনের পরিমান কমে যাবে, এ ক্ষেত্রে দূর্ভিক্ষ ঘটার সম্ভাবনা থেকে যায় (নাও ঘটতে পারে, এটি শুধু সম্ভাবনা)।
৪। প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরের খাদকদের সংখ্যা কমে যাবে। কারণ এই স্তরের অনেক প্রাণী মশা জাতীয় কীট খেয়ে বেচে থাকে।
৫। যদি দূর্ভিক্ষ না হয় তাহলে অন্যান্য প্রাণি ছাড়াও মানুষের জনসংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়বে। কেন বাড়বে তা যদি পুরো আর্টিকেল টা পড়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই বুঝেছেন।

মশা এমন একটি প্রাণী যা একই সাথে আমাদের পরম শত্রু আবার পরম বন্ধুও বটে। তাই অযথা মশাকে দোষারোপ করে লাভ নেই। দোষারোপ যদি করতেই হয় তাহলে ভাইরাস ব্যাক্টেরিয়া নিয়ে করুন, কারণ আসল রোগের কারণ এরাই। মাশা বাহক মাত্র।
পুরো আর্টিকেল টি কেমন লাগলো। গঠনমূলক আলোচনা সমালোচনা করুন। ধন্যবাদ এতক্ষন সময় নিয়ে পড়ার জন্য।

সৌরভ আহমেদ
মেম্বার, ব্যাঙের ছাতার বিজ্ঞান  

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form