স্বাভাবিক ব্রেইন ডেভেলপমেন্ট ও অটিজম



ধরেন, আপনি আমার খুব ভালো বন্ধু। একদিন দুপুরে তপ্ত রোদে একঘন্টা হেঁটে আমি আপনার বাসায় গেলাম আড্ডা দিতে। আপনি দেখলেন আমি অনেক টায়ার্ড। হাঁপাচ্ছি, ঘামছি, ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছি। আপনাকে বললাম, দোস্ত, আমার অনেক খারাপ লাগতেছে, বাইরে যা গরম, ঘেমে অবস্থা খারাপ।
আপনি তখন কি করবেন?
আমাকে বসতে দিবেন। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি বের করে দিবেন। ব্যবস্থা থাকলে এক গ্লাস লেবুর শরবত করে দিবেন। পারলে একটা লুঙ্গী দিয়ে বলবেন, "যা,গোসল করে নে, ভালো লাগবে।"
করবেন না এমন? ধরে নিলাম উত্তর হ্যাঁ। আপনি আমাকে লেবুর শরবত খেতে দিয়েছেন।
আচ্ছা, আমি কি আপনার কাছে পানি/ শরবত খেতে চেয়েছি? না, আমি চাইনি। আমি শুধু বলেছি, আমার খারাপ লাগছে, ঘামছি,হাঁপাচ্ছি। পানি তো চাইনি। তাহলে আপনি দিলেন কেন? কারণ, আপনি বুঝেন, জানেন আমি পানি না চাইলেও এই মুহুর্তে আমার পানি খাওয়া উচিত। আপনি ধরেই নিয়েছেন, 'আমি ঘামছি' কথা দিয়ে ইনডিরেক্টলি বুঝিয়েছি, 'আমাকে এক গ্লাস পানি দে।'
অথবা ধরুন, আপনার আম্মু কিচেনে রান্না করছে। আপনি সোফায় বসে টিভি দেখছেন। হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজ হল। আপনি টের পান নি। আপনি টিভি দেখায় মগ্ন। আপনার আম্মু কিচেন থেকে বলল, 'তোর আব্বু আসছে বোধ হয় '। এটুকু বলেই আপনার আম্মু কাজে মন দিলেন। বাসায় আপনি ছাড়া আর কেউ নেই। আপনি তখন কি করবেন? সোফা থেকে উঠে দরজা খুলবেন। আপনার বাবাকে ঢুকতে দিবেন। তাই না?
আপনি কেন দরজা খুললেন? আপনার আম্মু তো দরজা খুলতে বলেনি। শুধু বলেছে, তোর আব্বু আসছে বোধ হয়। আপনি দরজা খুলেছেন কারণ আপনি আপনার আম্মুর না বলা কথা বুঝে নিয়েছেন। উনি এই কথা দিয়েই বুঝিয়েছেন, 'তাড়াতাড়ি যা, দরজা খোল।'
এইযে আমি না বলতেও আমাকে পানি দিয়েছেন, আম্মু না বলতেও দরজা খুলেছেন এসব আপনাকে কেউ বলে দেয় নি। আপনার সাবকনসাইস মাইন্ড নিজেই বুঝে নিয়েছে আপনার কি করা উচিত। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের ব্রেইন ডেভেলপ হয়। ভালো -মন্দ, উচিত -অনুচিত সবকিছু বুঝে নেয়। সে অনুযায়ী কাজ করে। এখন আমি বলতেই পারি আপনার ব্রেইন ডেভেলপমেন্ট ভালো। আপনি ম্যাচিউরড হচ্ছেন।
কিন্তু অনেকেই আছে যাদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে চিন্তাভাবনা, বুদ্ধির বিকাশ ঘটে না। আপনি যে কাজটা না বলে দিলেও করেছেন তারা তা ভাবতেও পারেনা। তাদের ব্রেইনের ডেভেলপমেন্ট আপনার আমার মত দ্রুত হয়না। তাদের ছোটবেলার কাজকর্ম দেখেই বুঝা যায়, তারা বড় হয়ে কি রকমের হবেন। কিন্তু আপনি আমি জানিনা বিধায় তাদের সনাক্ত করতে পারিনা। এইসব শিশুদের বলা হয় অটিস্টিক শিশু।

বিশ্বে প্রতি ৫৮ জনে ১ জন অটিস্টিক শিশুর জন্ম হয়। বাংলাদেশে অটিস্টিক শিশুকে বাবা মায়ের পাপের ফসল, সংসারের বোঝা, অমংগল বলা হয়। কিন্তু আসলেই কি তাই?
এ ব্যাপারে জানার আগে আমাদের জানা উচিত কোন বয়সের শিশু কি কি কাজ করতে পারে। তাহলেই আমরা বুঝব, তার ব্রেইনের ডেভেলপমেন্ট ভালো হচ্ছে কিনা।


★বয়স যখন ৬ সপ্তাহ - এদের কোল থেকে বিছানায় শুয়ালে পা ভাঁজ করতে পারবে। মাথার উপর বল/ খেলনা নড়াচড়া করলে ওরাও মাথা নাড়াবে। অল্প শব্দ শুনলেই ভয় পাবে।

৩ মাস - ঘাড় নাড়াতে পারবে। খেলনা দিলে ধরতে চাইবে। একা একা শব্দ করবে। নিজের মা কে চিনবে।

৬-৮ মাস - কোনকিছুর সাপোর্ট ছাড়া বসতে পারবে। খেলনা দিলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরাতে পারবে। নিজে নিজেই খাওয়ার চেষ্টা করবে।

৯-১০ মাস - চেয়ার / ফার্ণিচার ধরে দাঁড়াবে। যেকোন জিনিস দিলে ধরার চেষ্টা করবে। বাবা, দাদা, মামা ডাকবে।

১২ মাস - অল্প অল্প হাঁটবে। পড়ে গেলে আবার উঠবে। জিনিস ছুঁড়ে মারতে পারবে।নাম ধরে ডাকলে সাড়া দিবে। গ্লাস/ মগ থেকে পানি খেতে পারবে।

১৫-১৮ মাস -- একা একা হাঁটবে। কলম দিয়ে খাতায় দাগাদাগি করবে। ১২-১৫ টা শব্দ উচ্চারণ করতে পারবে। আঙুল দিয়ে দেখাবে সে কি চায়।

১৮-২০ মাস -- সামনে পিছনে সব দিকেই হাঁটতে পারবে। 'চোখ দেখাও, নাক দেখাও' বললে দেখাতে পারবে। চামচ দিয়ে খেতে পারবে।

★উপরে কোন বয়সে কি কি করতে পারবে তা জানা হল। এর একটু হেরফের হলেই কি শিশু অটিস্টিক?
না। অটিস্টিক শিশুদের কিছু বৈশিষ্ঠ্য থাকে।

এরা একা থাকতে পছন্দ করে। অনেকেই ৩-৪ বছর হয়ে গেলেও কথা বলতে পারে না। অনেকে কথা বলতে পারে কিন্তু তা অসম্পূর্ণ। দেখা যায় এরা এক ই শব্দ বারবার বলে। একটা বাক্য শেষ করতে পারে না। এদের ডাকলে কখনো সাড়া দিবে না। চোখে চোখ রাখবে না। সমবয়সী বাচ্চাদের সাথে মিশবে না। কেউ কোলে নিলেই কান্না করবে। এরা আদর অপছন্দ করে। কাউকেই আদর করতে দেয় না।
আপনি একটা বাচ্চাকে খেলনার বল দিলেন। সে কি করবে? খুশি হবে। সবাইকে দেখাবে। খেলার চেষ্টা করবে। কিন্তু অটিস্টিক শিশু তা করবে না। তারা খেলনা টা দেখবে, এবং তা রেখে দিবে। তার মুডের কোন রকম পরিবর্তন হবে না। বাসায় যতদিন থাকে অনেকেই এই ব্যাপারটা বুঝতে পারে না। যখন ই স্কুলে ভর্তি করায় তখন ই দেখা যায়, তারা একটু অস্বাভাবিক। কারো সাথে মিশে না, ক্লাসের কোণে বসে থাকে, সবাই যা করে তা করে না, খেলে না, দৌড়ে না। তখন বাবা মা ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। আর তখন ই রোগটা ডায়াগনোসিস হয়।


ধরেন বাবা মা দুজন ই চাকরিজীবী। সকালে অফিসে যান। বিকেলে ফিরেন। বাসায় কাজের মেয়ের কাছে বাচ্চা রেখে যান। একদিন সকালে খাটের ওপর বসিয়ে গিয়েছিল। হাতে একটা বল ছিল। উনারা অফিস থেকে ফিরে দেখল ঠিক এই অবস্থাতেই বসে আছে। উনারা তো অনেক খুশি! বাচ্চা কত লক্ষী। উনাদের একটুও বিরক্ত করে না। আশেপাশের সব বাসায় বলে বেড়ান, এমন লক্ষী বাচ্চা আগে কখনো দেখেন নি। কিন্তু আসল কাহিনী কি আপনি ধরতে পারছেন? আশা করি, এখন বুঝেছেন।


★এটা কেন হয়?

সঠিক কারণ এখনো অস্পষ্ট। তবে ধারণা করা হয় ক্রোমোজম এর অস্বাভাবিকতা, মস্তিষ্কে সেরোটনিন ও অন্যান্য নিউরোট্রান্সমিটার এর অস্বাভাবিকতার জন্য অটিজম হয়।

★এরা কি মানসিক প্রতিবন্ধী??

অটিস্টিক শিশুদের কেউ কেউ মানসিক প্রতিবন্ধী বলে থাকেন। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এ ধরনের কথার সাথে একমত নন। তারা বলেন, অটিজমে আক্রান্ত কোনো কোনো শিশু বা অটিস্টিক শিশু কখনো কখনো বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অত্যন্ত পারদর্শিতা প্রদর্শন করতে পারে। তবে এই পারদর্শিতা প্রদর্শনের জন্য তাদের বিশেষ শিক্ষার একান্ত প্রয়োজন। আর এ কারণে অটিজমে আক্রান্ত শিশুকে বিশেষ প্রয়োজন সম্পন্ন শিশু বা বুদ্ধিবৃত্তিক চাহিদাসম্পন্ন বলা হয়।


★বিখ্যাত কিছু ব্যাক্তি যারা অটিজমে ভুগেছিলেন বলে ধারণা করা হয়।
১) চার্লস ডারউইন - বিবর্তনবাদের জনক। ছোট বেলা থেকেই চার্লস একলা থাকতে পছন্দ করতেন এবং বিভিন্ন জিনিস সংগ্রহ করা ও তাদের যথারীতি তালিকা প্রস্তুত করতেন
২) আলবার্ট আইনস্টাইন - 'থিওরী অব রিলেটিভিটি' এবং অনুবিজ্ঞানের জনক। বলা হয়ে থাকে ৭ বছর বয়েস থেকেই তার মাঝে এস্পারগারের লক্ষণ দেখা যায়। তিনি ক্রমাগত একই বাক্য বারবার বলতেন এবং বড় হবার পরও অনেক ওলট-পালট ভাষন দিয়েছেন।
৩) আইজাক নিউটন - নিউটন চুপচাপ এবং একাকী থাকতেন এবং অন্যের সাথে মিশতে পারতেন না। অনেক সময় দেখা গেছে যে ঘরে কোন দর্শক-শ্রোতা নেই - কিন্তু তিনি একাকী ভাষন দিয়ে চলেছেন।
৪) এমিলি ডিকিন্সন - কবি এবং লেখিকা ডিকিন্সন অটিস্টিক ছিলেন বলে অনেকের ধারনা।
এছাড়াও সক্রেটিসের মাঝেও ছোটবেলায় অটিজমের লক্ষণ দেখা যায়। চিকিৎসা এবং কাউন্সিলিং এর মাধ্যমে যার সমাধান হয়।

অটিজমের চিকিৎসা বলতে শিশুর সাথে বাবা মা কি রকম ব্যবহার করবেন তাই শিখিয়ে দেওয়া হয়। অনেক বাবা মা'ই ব্যস্ততার জন্য বাচ্চাকে সময় দিতে পারেন না। তাদের কাউন্সিলিং করা হয় যাতে বাচ্চাদের সাথে বেশি সময় কাটান। এছাড়া, সমস্যা গুরুতর হলে সাইকোথেরাপি দেওয়া হয়। ঢাকায় একটি সংগঠন আছে। নাম প্যারেন্টস ফর ডিফারেন্টলিএবল। ১০০০+ অটিস্টিক শিশুর বাবা মা মিলে এই সংগঠন চালান। কিভাবে এই ধরনের শিশু সনাক্ত করবে এবং কেমন আচরণ করবে তারা তাই আলোচনা করেন।
যারা আরও জানতে চান তারা ডাস্টিন হফম্যানের 'রেইন ম্যান' ছবিটি দেখবেন।
অটিস্টিক শিশু সমাজের বোঝা নয়, পরিবারের বোঝা নয়, তারা মানসিক প্রতিবন্ধী নয়। তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করুন।


লেখকঃ জহিরুল হক জাবেদ
US-Bangla Medical College Hospital

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form