লভক্রফটিয়ান হররের ইতিহাস ও পরিচিতি



প্রথমেই একটা বিষয় পরিষ্কার করি। ট্রাডিশনাল হররের সাথে লভক্রফটিয়ান হররের সবচেয়ে বড় পার্থক্যটা কি লক্ষ করেছেন? ট্রাডিশনাল হররে ভুত প্রেত দৈত্য দানব দিয়ে ভয় দেখানো হয়। কিন্তু লভক্রফটিয়ান হররের ভয়টা তৈরি হয় মানুষের অস্তিত্বের সংকট (Existential Crisis) থেকে। আমি বলছি না লভক্রফটের জগতে দৈত্য দানোর কোনো অভাব আছে। কিন্তু তারা এখানে ভয়ের মুল উৎস না। বরং এই বিস্তৃত মহাজগতে মানুষের অবস্থান কতোটা অসহায় আর অর্থহীন এই উপলব্ধি থেকেই আমরা ভয় পাই। একজন লেখকের জন্যে গল্পের মাধ্যমে সফলভাবে এই অনুভুতি সৃষ্টি করা বেশ কঠিন। ক্ষেত্র বিশেষে লভক্রফট স্বয়ং তার এই প্রিন্সিপাল মেনে চলতে ব্যার্থ হয়েছেন। লভক্রফটিয়ান হরর বুঝার দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে লভক্রফটকে বুঝা। আসুন আমরা কসমিক হররের টোলকিন’কে বুঝার চেষ্টা করি।
লভক্রফটকে নিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন প্রশ্ন, উনার সমস্যা কি?
হাওয়ার্ড ফিলিপ লভক্রফটের সমস্যা একটা দুইটা না, অনেকগুলা।
তার জন্ম উনবিংশ শতাব্দিতে, আমেরিকার একটি ছোট্ট শহর প্রভিডেন্সে। খুব ছোটবেলায় তার বাবা মারা যান। সিফিলিস রোগে। অসুখটা তার ব্রেনকে এফেক্ট করেছিল। মৃত্যুর আগে তার স্থান হয় মানসিক হাসপাতাল। বাবার মৃত্যুর পর লভক্রফট চলে আসেন তার নানুর বাড়িতে। তার নানুরা পয়সাওয়ালা মানুষ ছিলেন। তাদের ছিল আলিশান বাড়ি, সেই বাড়ির নিজস্ব লাইব্রেরি ছিল। তাতে নানান রকম বই ঠাসা। কেউ কেউ ধারনা করেন কচি বয়েসে উলটা পালটা বই পড়েই লভক্রফটের মাথা বিগড়ে যায়। তবে নানুর বাড়িতেই লভক্রফট তার জীবনের সবচেয়ে সুখের সময়টা কাটিয়েছেন।
এই সুখ বেশিদিন স্থায়ি হয় না। তার নানুদের আর্থিক অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। স্টেট বেচে দিয়ে তাদেরকে ছোট একটা বাসায় এসে উঠতে হয়। শুরু হয় লভক্রফটের দরিদ্র জীবন যাপন, যা কিনা তার মৃত্যু পর্যন্ত স্থায়ি হয়েছিল। লভক্রফট এমনিতে ছিলেন বেজায় মুখচোরা প্রকৃতির মানুষ। দেখতে তেমন সুদর্শন ছিলেন না। ভঙুর স্বাস্থ্য, প্রায়ই নানা রকম অসুখে ভুগতেন। আমার ধারনা চেহারা এবং স্বাস্থ্যের কারনে তার আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল। তেমন কোনো মেয়েবন্ধু ছিলো না। থাকবে কি করে, একে তো দেখতে খারাপ, তার উপরে আবার কথাবার্তায় মোটেই পটু নন (যা কিনা উনার গল্পগুলোতে কথোপকথনের আড়ষ্টতা দেখলে সহজেই অনুমান করা যায়)
উনার এই অসামাজিক স্বভাবের কিছুটা দায় উনার মা'এর। মহিলা লভক্রফটকে সর্বোক্ষণ কড়া নজরে রাখতেন। তাকেও দোষ দেয়া যায় না। স্বামির অকাল মৃত্যু আর অপ্রত্যাশিত দারিদ্রের ছোবল তাকে মাত্রাতিরিক্ত সাবধানি করে তুলেছিল। যার বলি হতে হয়েছিল লভক্রফটকে।
ভাগ্যের কি পরিহাস! কোনো এক অজানা কারনে এক সময় লভক্রফটের মায়ের মাথায়ও বিকার দেখা দেয়। তারও শেষ আশ্রয়হয় সেই একই পাগলাগারদ, যেখানে তার স্বামির মৃত্যু হয়েছিলো। একই ভাবে লভক্রফট তার বাবা মা দুইজনকেই হারান। সন্দেহ নেই ব্যাপারটা সদ্য তারুন্যে পা দেয়া লভক্রফটকে দারুন ভাবে প্রভাবিত করে। লভক্রফট ভাবতে বসেন, উন্মাদনা কি? এর উৎস কোথায়? মানুষ দুঃস্বপ্ন কেন দেখে? কে আমাদের দুঃস্বপ্ন দেখায়? শোনা যায় লভক্রফটের বোবায় ধরা অথবা নাইট টেরর অসুখ ছিল। ঘুমের মধ্যে ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করে উঠতেন। উনার গল্পের অনেক বিখ্যাত উপাদান যেমন নেক্রনমিকন, এযাথথ, নাইটগ্যন্ট ইত্যাদি উনি পেয়েছেন স্বপ্নের মাধ্যমে। নিজের অসুস্থতা তিনি নিংড়ে দিয়েছেন তার গল্পের পাতায় পাতায়।
লভক্রফট ছিলেন ভিষণ রকমের রেসিস্ট। কেন বা কিভাবে তার এই রেসিস্ট মনোভাবের উৎপত্তি তা সঠিক জানি না। উনি যে কোনো একটি নির্দিষ্ট ধর্ম বা বর্নের মানুষের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতেন তা নয়। অপরিচিত যে কোনো কিছুর প্রতিই তার ছিলো বেজায় ভয় (এখান থেকেই সম্ভবত তার বিখ্যাত
Fear of the Unkown থিওরির উৎপত্তি)। অভিজাত শেতাঙ ছাড়া তিনি বোধহয় বাদবাকি সবাইকেই সন্দেহের চোখে দেখতেন। এই চরম রেসিজম ফুটে উঠে তার গল্পের মধ্যেও। তার গল্পে আফ্রিকান আর পলেনিশিয়ান মানেই প্যাগান দেবতার পুজারি, এশিয়ান মানেই জাদুটোনা জানে, আরব মানেই সকল গুপ্তবিদ্যার হাড়ি। শুধু তাই না, লভক্রফটের চোখে গ্রাম বা মফস্বল মানেই, অশিক্ষিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, ক্ষয়িষ্ণু জনপদ। বেশির ভাগ আকাম কুকাম হয় ওই অসভ্য বর্বর গ্রামাঞ্চলেই। লেখালিখির সুবিধার জন্যে উনাকে একবার তার সাধের প্রভিডেন্স থেকে নিউইয়র্কে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। অল্প কিছুদিন নিউইয়র্কে থেকেই উনি আবার প্রভিডেন্সে পালিয়ে আসেন। নিউইয়র্কে তার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। কেন? কারন নিউইয়র্ক হল দুনিয়ার সব ইমিগ্র্যান্টদের আড্ডাখানা। আর ইমিগ্র্যান্ট মানেই লভক্রফটের চোখে রহস্যময় শয়তানের পুজারি।
অন্যান অনেক বিখ্যাত মানুষের মত লভক্রফটও নিজের জীবদ্দশায় তেমন নাম করতে পারেননি। উনার লেখা গল্প পড়ে আরাম পাওয়া যায় না, লোকে কিনবে কেন? একটা তথ্য হয়তো অনেকের কাছেই নতুন। লভক্রফট কিন্তু আসলে একটিও উপন্যাস লিখেননি। উনার লেখা বেশ কিছু ছোটগল্প আছে। অল্প কিছু বড় গল্পও আছে (যা হয়তো আজকালকার বাজারে নভেলা বলে চালিয়ে দেয়া যাবে) উনার লেখাগুলো ছাপা হতো তৎকালিন বিভিন্ন পাল্প ম্যাগাজিনে। উনার জীবদ্দশায় তার একটা গল্পই কেবল বই আকারে প্রকাশ পেয়েছিল, The Shadow over Innsmout. বলা বাহুল্য বইটা একেবারে মাঠে মারা গেছে।
পাঠক সমাজে কদর না পেলেও উনার একটা বেশ অনুগত কাল্ট ফলোয়িং ছিলো। এই কাল্টের নাম ছিল লভক্রফটিয়ান সার্কেল। কারা ছিল এই সার্কেলের সদস্য? রবার্ট ব্লক (সাইকো'র লেখক) রবার্ট ই. হাওয়ার্ড (কোনান দ্যা বার্বারিয়ান এর জনক) চার্লস এস্টন স্মিথ, অগাস্ট ডেরেলিথ প্রমুখ। লভক্রফট লম্বা লম্বা চিঠির মাধ্যমে তার সার্কেলের মেম্বারদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন (কথোপকথনে অপটু হলেও লভক্রফট চিঠি লেখার ওস্তাদ ছিলেন) লাভক্রফট বুদ্ধিমানের মতো যে কাজটা করেছিলেন তা হল তিনি নিজের সৃষ্ট ওল্ড গডদেরকে নিজের সম্পত্তি করে রাখেননি। বরং তিনি সমসাময়িক অন্যান্য লেখকদেরকেও তার সৃষ্টি নিয়ে ইচ্ছেমতো কাজ করার উতসাহ দিয়েছেন, অনুরোধ করেছেন। বলা যায় বেস্ট লাভক্রফটিয়ান স্টোরিগুলো এসেছে লভক্রফট দ্বারা অনুপ্রাণিত লেখকদের হাত ধরে।
লভক্রফট একরকম লোকচক্ষুর আড়ালে কপর্দক শূন্য অবস্থায় মারা যান। উনার মৃত্যুর পর লভক্রফটিয়ান সার্কেলের সদস্যরা মিলে প্রতিষ্ঠা করেন আর্কহাম পাব্লিকেশন। এই প্রকাশনী থেকে লভক্রফটের গল্পগুলো একেএকে রিপ্রিন্ট হতে থাকে। অবশেষে মৃত্যুর অনেক বছর পরে ষাটের দশকে এসে এইচ পি লভক্রফট মেইন স্ট্রিম মিডিয়ার নজরে আসেন। প্রতিষ্ঠিত লেখকরা লভক্রফটের কল্পিত ঈশ্বর আর অপদেবতাদের নিয়ে সিরিয়াসলি কাজ শুরু করেন। তাদের হাত ধরেই গড়ে উঠে The Cthulhu Mythos (এমনকি Cthulhu Mythos টার্মটাও অগাস্ট ডেরেলিথ এর সৃষ্টি) হালের স্টিফেন কিং থেকে শুরু করে নিইল গেইম্যান, এল্যান ম্যুরসহ অনেকেই লভক্রফটিয়ান হরর নিয়ে কাজ করেছেন, করছেন।
সত্যি বলতে বর্তমান পপ কালচারে আর হরর মিডিয়ার যেখানে তাকান সেখানেই লভক্রফট। মুভির কথায় আশা যাক। Avenger দেখেছেন? এভেঞ্জার মুভির শেষের দিকে যে আকাশে বিশাল একটা ওয়ার্মহোল খুলে যায়, আর সেই হোল দিয়ে ঝাকে ঝাকে এলিয়েন আর টেন্টাকল মন্সটার বেরিয়ে আসে… এই আইডিয়ার জনক কে? True Detectives দেখেছিলেন কি? মনে আছে ট্রু ডিটেক্টিভের সিরিয়াল কিলারটা The Yellow King বলে এক অপদেবতার পুজা করত? এই ইয়েলো কিং কার আইডয়া? জন কার্পেন্টারের দ্যা থিং আর ইন দ্যা মাউথ অভ ম্যাডনেস, রিডলি স্কটের দ্যা এলিয়েন, গুইলার্মো ডেল টোরো'র হেল বয় আর প্যাসিফিক রিম … এইগুলোর পেছনে মুল ইন্সপারেশন সোর্স কে?
H.P. Lovecraft & his Cthulhu Mythos
বলা যায় আধুনিক হররের শুরু লভক্রফটের হাত ধরে। তিনি হররের সাথে সায়েন্স ফিকশনের মিলমিশ করেছেন। এক্সিস্টেন্সিয়াল হররকে মেইন স্ট্রিমে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। উনার গল্পগুলো যেমন-তেমন কিন্তু তার কথুলহু মিথো একটা নিখাদ সোনার খনি।

(আগামিতে এই কথুলহু মিথো নিয়ে লেখার চেষ্টা করবো… ধন্যবাদ। )
-

আসিফ আব্দুল 

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form