- বাবা রায়হান খুব অসুস্থ, আমরা সবাই হসপিটেল যাচ্ছি। তুমি ফ্রি হয়ে চলে এসো। রায়হানের মা বলল
- ঠিক আছে আমি রাতেই আসবো, আপনারা রায়হানের দিকে খেয়াল রাখুন। ফারাবী বলল
- ঠিক আছে।
টেলিফোন রেখে ফোনে সাবিহাকে বিষয়টি জানিয়ে দিল ফারাবী। তবে সাবিহা মানছে না, এ ক'দিনে যা ঘটছে সব খ্রিষ্টান এলাকার ভেতর। এবং সে হসপিটেলে পৌঁছাতে সেই এলাকা পেরিয়ে যেতে হবে। সাবিহাকে কোনোভাবে বুঝিয়ে রাজি করালো, এবং বলল যেন দরজা জানালা সব ভালো করে লাগিয়ে রাখে। ফোন কেটে টেবিলের উপর রাখে ফারাবী। এমন সময় চোখ পড়লো পাশের দেয়ালে বসানো টিভির দিকে, সেখানে বলছে,
'ব্রেকিং নিউজ, গতকাল রাতে ইন্টারনেশনাল হসপিটেলে ঘটে এক রহস্যময় ঘটনা। হসপিটেল খোলার পর দেখা যায় মর্গের দরজা খোলা এবং সেখানের সিকিউরিটি গার্ডে নিখোঁজ। সাথে মর্গের এক লাশ পড়ে ছিল যার সমস্ত শরীর ছিল রক্তে ভোরা এবং ক্ষতবিক্ষত। অনেকের ধারণা মতে এর পেছনে সিকিউরিটি গার্ডের হাত রয়েছে। তবে এখনো এর মূল রহস্য চানা যায়নি। সাথে আরেকটি খবর, দুদিন আগে অস্বাভাবিক ভাবে মৃত্যু হওয়া ড. হ্যারির লাশ গতকাল রাতে কফিন থেকে নিখোঁজ হয়ে যায়। কে বা কারা এসব করছে সে ব্যাপারে জোড়দার তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ।'
টিভির জার্নালিস্ট মেয়েটির কথা যেন বিশ্বাস করতে পারছে না ফারাবী, কফিন থেকে কিভাবে লাশ গায়েব হচ্ছে! গার্ডটিই বা কোথায়! আবার, লাশের এমন অবস্থাই বা কে করলো! নিউজ শুনেই মাথা ঘুরে ফারাবীর উপর পড়ে গেল লেফটেন্যান্ট সায়মা। তা দেখে ছুটে আসে আশপাশের সবাই।
- সায়মা? কি হয়েছে সায়মা? ফারাবী বলল
- অজ্ঞান হয়ে গেল নাকি! সৈনিক সাব্বির বলল
- তোমরা একে নিয়ে যাও, come on move! ফারাবী বলল
- Sir!
সায়মাকে নিয়ে যায় দুয়েকজন। অবাক হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে টিভির দিকে তাকায় ফারাবী, বুকটা এখনো কাঁপছে। কিভাবে হতে পারে এসব, কে করছে এমন ভয়ানক কাজ! রক্তশূণ্য দেহ, সাথে ঘাড়ের ঠিক পাশে দুটো দাঁতের চিহ্ন! এমনটা ভ্যাম্পায়ার দ্বারাই সম্ভব। যারা রক্ত পিপাসু, যারা ছিঁড়ে ছিড়ে মানুষের মাংস খায়। তাহলে কি এসবের পেছনে... বিভিন্ন প্রশ্ন এসে গ্রাস করে ফারাবীকে। মাথা যেন কাজ করা বন্ধ করে দেয়।
সেদিন রাতে, হসপিটেল থেকে ফেরার পথের ঘটনা। রাত মাত্র ১০:৩২। রাত বেশি না হলেও, মনে হচ্ছে নিশি রাত। নির্জন রাস্তা ধরে হাঁটছে ফারাবী, একটি গাড়িও মিলল না। ভ্যাম্পায়ারের আতঙ্কে সন্ধ্যার পরই সবাই বাড়ি ফিরে দরজা জানালা আটকে গুটিশুটি মেরে বসে থাকে। হঠাৎ পেছনে টেক্সির হর্ন শুনতে পেল ফারাবী, পেছন ঘুরেই তীব্র আলোয় হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নিল। টেক্সিটিকে হাত বাডিয়ে থামতে বললেও ফারাবীকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল টেক্সিটি। ফারাবী হাত নামিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কিছু করার নেই, এভাবেই চলতে হবে। এগিয়ে যাওয়ার জন্য সামনে তাকাতেই এক অদ্ভুত লোকের উপর চোখ পড়লো তার, লোকটি চুপ করে এক ভাঙা খ্রিষ্ট বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এই গরমের মাঝেও লোকটির পরনে অভার কোট, পুরোপুরি কালো পোশাকে ঢেকে রেখেছে নিজেকে। ধীরপায়ে লোকটির কাছে গিয়ে ফারাবী বলল, আপনি এতরাতে এখানে কি করছেন? সব ঠিক আছে তো?
লোকটি চোখ তুলে তাকালো ফারাবীর দিকে। চেহারা স্বাভাবিক, তবুও জ্বলজ্বল করতে থাকা চোখ জোড়া দেখে ফারাবীর এক অন্যরকম অনুভূতি হয়। যেন ওই চোখ থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে আগুনের ফুলকি।
- আমি রাতেই বের হই!
- মানে?
উত্তরটি শুনে ফারাবী বেশ অবাক হয়, অবাকের চেয়ে বেশি ঘাবড়ে যায়। লোকটি উত্তর দেওয়ার কয়েক সেকেন্ড পরই পাশের কবরস্থান থেকে এক অশুভ পেঁচা ডাকতে শুরু করে।
- দিন আমার একদমই পছন্দ নয়। লোকটি বলল
- কেন? এমন অদ্ভুত নিয়ম কেন? ফারাবী বলল
- তা তুমি বুঝবে না। পেঁচার ডাকটি খুব সুন্দর, তাইনা? ওই কবরস্থান থেকে আসছে।
লোকটির কথা শুনে ফারাবী কবরস্থানের গাছ গাছালির দিকে তাকালো, হঠাৎ কুকুরের প্রচন্ড ডাকে সামনে তাকায়। লোকটির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে চলছে কুকুরটি। লোকটি ধীর পায়ে কুকুরটির পাশে বসে কুকুরটির শরীরে হাত বুলাতে থাকে, কুকুরটিও প্রায় শীন্ত হয়ে যায়। যেন লোকটি তাকে জাদু করে নিয়েছে। গেটের পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে ফারাবী। হঠাৎ লোকটি কুকুরটির ঘাড় মোটকে দিল! তা দেখে চমকে উঠল ফারাবী। লোকটি কুকুরটিকে এক হাতে তুলে দূরে ছুড়ে ফেলে দিল! ফারাবী ভাবলো, এখান থেকে চলে যাওয়াই ভালো। লোকটির দিকে তাকিয়ে পিছু হটতে শুরু করলো ফারাবী। যাবার সময় গেটের পাশে ময়লা সাইনবোর্ডটির দিকে চোখ পড়ে তার, সেখানে অস্পষ্ঠ ভাবে লেখা 'ড. রজার্স হার্ন'!
পরদিন সকালে। বেশ বেলা হয়েছে এখন, সূর্যের অবস্থান দেখে যা অনুমান করা যায় তা কমপক্ষে ১০:১৫ এর মতো। সেই পরিত্যক্ত খ্রিষ্ঠ বাড়ির গেটের সামনে এসে দাঁড়ায় ফারাবী। বাড়ির রহস্য তাকে জানতেই হবে। কোমরে গুজে রাখা টাইপ ৯২ পিস্তলটি বের করে ম্যাগজিন দেখে নিল সে। সাবিহাকে বলেছিল অফিসের কাজে বাহিরে যাচ্ছে, গতরাতের ভয়ানক ঘটনা সম্পর্কে সাবিহাকে কিছুই বলা হয়নি। পিস্তলটি ঢুকিয়ে সাইবোর্ডের দিকে তাকালো ফারাবী। সেই ময়লা সাইবোর্ড, লেখাগুলো প্রায় মুছে গিয়েছে। মরিচাও ধরে গিয়েছে এতে। হাত বাড়িয়ে গেট খুলল ফারাবী। এক পা দু পা করে গেটের ভেতরে ঢুকলো। বিরাট সাদা রঙের দুতলা বাড়ি। পিলারগুলোতে পতাপাতা পেচিয়ে আছে, দেয়াল ফেটে বটগাছের জন্ম হয়েছে, রাস্তাও অনেকটা ভাঙা। এর মাঝে সব দরজা জানালা পুরোপুরি বন্ধ, বাতাস ঢোকার মতোও কোনো পথ নেই। ফারাবীর মাথায় একটাই কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল, এমন পরিবেশে কোনো মানুষ বেঁচে থাকতে পারে! ধীর পায়ে হেঁটে দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। দরজায় তালা নেই, অর্থাৎ বাড়িতে কেউ আছে। ফারাবী কড়া নাড়ার জন্য দরজায় হাত দিতেই দরজা সরে গেল। ভেতরে কেউ নেই, হলরুমটি পুরোপুরি নংরা। কেউ আছেন ঘরে?! ভেতরে ঢুকে এদিক ওদিক চেয়ে ডাকতে শুরু করে ফারাবী।
- এসো, ভেতরে এসো!
কথাটি শুনে দুতলার সিড়ির দিকে তাকালো ফারাবী, গতরাতের সেই লোকটা।
- আমি এ বাড়ির মালিকের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। ফারাবী বলল
- উপরে এসো। লোকটি বলল
লোকটি দুতলায় যেতে শুরু করলো, ফারাবী কিছুক্ষণ ভেবে সিড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করে। নড়বড়ে সিড়ি, এক পা দু পা করে দুতলায় উঠে। আভছা আলোতেরুমটিতে ফারাবী যা দেখলো, মোটামুটি একটি একটি টেবিল। তার পাশে এক সারিতে জানালা, সব জানালা বন্ধ। কেমন বিশ্রি এক গন্ধে ছেয়ে আছে রুমটি। লোকটি ধরা গলায় বলল,
- কে তুমি? কোথা থেকে এসেছো?
- আমি ফারাবী, সাভার থেকে এসেছি।
- বসো, কি মনে করে এলে? চা খাও।
- ওসব লাগবে না, আমি ড. রজার্সের সঙ্গে দেখা করতে চাই।
লোকটি খিলখিল করে হেসে উঠলো, যেন কোনো রাক্ষস বহুদিন পর টাটকা মাংস পেয়ে হাসছে।
- এ বাড়িতে কেউ আসে না, আজ এক মেহমান এলো। খালি মুখে কিভাবে ফিরিয়ে দেই!
হাসতে হাসতে ভেতরে চলে গেল লোকটা। ধীরে ধীরে চেয়ারটিতে বসে ফারাবী, আশপাশটা ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করলো। রুমটির প্রতিটি কোণে মাকড়শার জাল, অনেক জালে বসে আছে ছোট বড় মাকড়শা। হঠাৎ তার চোখ পড়লো রুমের এক কোণে রাখা লম্বা এক বক্সের দিকে। বেশ কৌতূহল হলো তার। লোকটি ফিরে আসছে কিনা দেখে চেয়ার ছেড়ে বক্সটির কাছে যায় ফারাবী। কাছে গিয়ে বুঝতে পারে, এটি কোনো সাধারণ বক্স নয় বরং, একটি কফিন! যা খ্রিষ্ট ধর্মের অনুসারীরা কবর দেওয়ার সময় ব্যবহার করে। কি করবে ভেবে পায়না ফারাবী, কফিনটা খুলবে? নাকি চলে যাবে? কিন্তু, এই ভাঙা বাড়িতে কফিনটি এলো কোথা থেকে! মাথায় বিভিন্ন প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে শুরু করে। সাত পাঁচ না ভেবে কফিনের ঢাকনা ধরে সে। বুকটা কেমন যেন ধুকধুক করছে, আগে কখনো এমনটা লাগেনি তার। ধীরে ধীরে ঢাকনাটি তোলার চেষ্টা করে। আর সামান্য তোলা বাকি। কি করছো ওখানে! কারো ধরা কন্ঠ শুনে চমকে গিয়ে উঠে দাঁড়ায় ফারাবী। লোকটি একটি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে।
- কিছু না, কফিনটি একটু নোংরা হয়ে গিয়েছিল। আমতা আমতা করে ফারাবী বলল
- বসো, এখানের কোনো কিছুতে হাত লাগাবে না। এগিয়ে আসতে আসতে লোকটি বলল
- কেন?
- বেশি প্রশ্ন নয়।
লোকটি ফারাবীর সামনে চায়ের কাপটি রেখে টেবিলের অপর প্রান্তের চেয়ারে গিয়ে বসলো। ফারাবী চেয়ারের হাতায় হাত রাখতেই মচ করে হাতাটি ভেঙে গেল, অবাক দৃষ্টিতে তাকালো সে। লোকটি মুচকি হেসে বলল, হেলান দিও না, এ বাড়ির সবকিছুই বেশ পুরনো। উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না ফারাবী। ফারাবীর এমন নীরবতা দেখে লোকটি হেলান দিন, বলল, রজার্স হার্ন কিছুদিন আগেই মারা গিয়েছে! কথাটি শুনে ফারাবী চমকে গেলেও তা প্রকাশ করলো না। লোকটির হাসিটা কেমন যেন বিদঘুটে। হলদে হয়ে আছে দাঁতগুলো।
- আচ্ছা আপনার বাড়িটা এমন কেন? ফারাবী বলল
- কেন বাড়ি পছন্দ হয়নি? লোকটি বলল
- তা নয়, বলছিলাম কারণ এমন বাড়িতে কেউ থাকতে পারিনা।
- আমরা পারি।
- আপনারা মানে?
উত্তর দিল না লোকটা, তার হালকা লালচে চোখ জোড়া দিয়ে চেয়ে রইল ফারাবীর দিকে। চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছে না ফারাবী, মনে হচ্ছে বেশিক্ষণ চেয়ে থাকলেই চোখ জ্বলতে শুরু করবে। চোখ সরিয়ে বলল,
- ড. রজার্স কিভাবে মারা গিয়েছিলেন?
লোকটি একটু চুপ থাকলো, যেন গভির চিন্তায় মগ্ন সে। হঠাৎই অপ্রস্তুত ভাবেই সে বলে উঠলো, রজার্স ছিল এক সাইকোপ্যাথিক খুনি!
- খুনি!
বেশ ঘাবড়ে যায় ফারাবী, কথাটি শুনে যেন নিচ থেকে মাটি সরে গেল। একজন ড. সাইকোপ্যাথিক খুনি! ভাবতেই ঘাম বেরিয়েআসে তার।
(চলবে..)
লিখাঃ ফারহান আহমেদ ফারাবী
দ্যা হন্টেড নাইট (পর্ব ৪)
Tags:
ভৌতিক গল্প