রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মৃতের স্তূপ



সিন্ধি শব্দ মহেঞ্জোদারোর অর্থ মৃতের স্তূপ। শতবর্ষ আগে ১৯২২ সালে বাঙালী প্রত্নতাত্ত্বিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় আবিষ্কার করেছিলেন এই সুপ্রাচীন প্রত্ননগর। পাঞ্জাবের হরপ্পা এবং সিন্ধুপ্রদেশের মহেঞ্জোদারোর আবিষ্কারের মাধ্যমে ভারতেতিহাস পৌঁছে যায় পাঁচ হাজার বছরের সীমায়। এর মধ্যে দিয়ে প্রাচীন মিশর ও মেসোপটেমিয়ার সাথে প্রাচীন ভারতীয় সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতা সমকক্ষতা অর্জন করে। মানুষের নির্বিচার লোভের কারণে হরপ্পা নগরটিতে খুব বেশি কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু মহেঞ্জোদারো তার বিপুল প্রত্ন সম্পদ নিয়ে ইতিহাসের দিশা পরিবর্তনে পুনরাবিষ্কারের প্রতীক্ষায় ছিল প্রায় চার হাজার বছর ধরে। অবশেষে এক বঙ্গসন্তানের মাধ্যমে মহেঞ্জোদারোর সেই মহানিদ্রার অবসান ঘটেছিল। 

পুরাতাত্ত্বিক রাখালদাস সম্পর্কে খাঁটি মন্তব্য করেছেন ইতিহাসবিদ রমাপ্রসাদ চন্দ; তিনি লিখেছেন, 

"একটি ল্যাটিন প্রবাদ আছে যাহার অর্থ --- 'Poet is born, not made', কবি তৈয়ারি করা যায় না, কবিত্ব জন্মগত। প্রকৃত পুরাতত্ত্ববিদও কোনো শিক্ষাদীক্ষার দ্বারা তৈয়ারি করা যায় না, শিক্ষাদীক্ষার মূলে জন্মগত প্রবৃত্তি, জন্মগত প্রতিভা থাকা চাই। রাখালদাস এই রূপ প্রবৃত্তি, এইরূপ প্রতিভা লইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন।" শ্রী চন্দের এই মন্তব্য শুধুমাত্র প্রশংসা বাক্য নয়, এ হলো বাস্তব সত্য। রাখালদাস তাঁর জীবন ও কর্মের মাধ্যমে তার প্রমাণ রেখে গেছেন। এরই সূত্র ধরে বলা যায়, মহেঞ্জোদারোর পুনরাবিষ্কারের প্রাথমিক কাজ সুযোগ্য ব্যক্তির দ্বারাই সম্পন্ন হয়েছিল। 

মহেঞ্জোদারোর ভগ্নস্তূপ আবিষ্কার ছাড়াও রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় জীবনে অনেক বড় কাজ করে গেছেন। বিশেষ করে ইতিহাস রচনায় এবং সাহিত্যে। মহারাষ্ট্র, গুজরাট ও বাংলার বহু পুরাকীর্তির আবিষ্কার ও সংরক্ষণের সাথে জড়িয়ে আছে তাঁর নাম। বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলে পাহাড়পুর (সোমপুর মহাবিহার) প্রত্নস্থল উৎখনন তাঁর পুরাতাত্ত্বিক জীবনের অন্যতম একটি কীর্তি। তবে ভাষাচার্য্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে রাখালদাসের সবচেয়ে বড় কীর্তি মহেঞ্জোদারোর আবিষ্কার। তিনি লিখেছেন, 

"প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের আলোচনায় "রাখাল" অনেক নতুন কথা বলে গিয়েছেন। আর তাঁর গবেষণা এক একটা মনোগ্রাফ বা নিবন্ধরূপে প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলি প্রত্যকটি মূল্যবান। প্রাচীন তাম্রপট্ট ও শিলালেখের নষ্টকোষ্ঠি উদ্ধার, প্রাচীন সংস্কৃত ফার্সি পুঁথিপুস্তক ঘেঁটে ঐতিহাসিক তথ্য নিষ্কাশন, রাজনৈতিক ইতিহাস, সামাজিক ইতিহাস, শিল্পকলার কথা এসব তাঁর নখদর্পণগত ছিল; ইতিহাসের উপাদানকে নিয়ে তিনি যেন ছিনিমিনি খেলতে পারতেন। ... তাঁর প্রতিভা ছিল একাধারে ভাবয়িত্রি অর্থাৎ Critical আর কারয়িত্রি অর্থাৎ Creative। তাঁর সবচেয়ে বড় কীর্তি মহেন-জো-দড়োর ভগ্নাবশেষের আবিষ্কার। আর এই আবিষ্কারের জন্য তাঁর নাম ভারতবর্ষে ইতিহাস আলোচনা ক্ষেত্রে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।  ... ভারতের প্রাচীন লিপি উদ্ধারের চেষ্টা তাঁর জীবনের শেষ কয় বছরের প্রধান কর্ম হয়ে উঠেছিল।"  

অনেক আগে ভাষাচার্য্য সুনীতিকুমার একথা লিখে গেছেন। আজ আমরা অনেকেই তাঁর সম্পর্কে আর কিছু না জানলেও শুধুমাত্র মহেঞ্জোদারোর আবিষ্কর্তা হিসেবে তাঁকে জানি। তবে মহেঞ্জোদারোর আবিষ্কারক এই পরিচয় এতো সহজে তিনি লাভ করতে পারেননি। প্রথম 

দিকে এ নিয়ে তাঁকে অনেক ঝামেলায় জড়াতে হয়েছে। অনেক তর্ক-বিতর্ক, ষড়যন্ত্র, ধোঁয়াশার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল রাখালদাসকে। তাঁর নিজেরও এক্ষেত্রে ভুল ছিল অনেক। 

১৯১৭-২৩ এই কালখণ্ড রাখালদাসের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। তিনি ১৯১৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে "কারমাইকেল অধ্যাপক" পদে যোগ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর পরিবর্তে দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকর এই পদ লাভ করেন। ধারনা করা হয়, দেবদত্ত ভাণ্ডারকর তাঁর পিতা পন্ডিত রামকৃষ্ণ গোপাল ভাণ্ডারকরের (পুনের ভান্ডারকর ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা) প্রভাবে এই পদ লাভ করেছিলেন। কারমাইকেল অধ্যাপকের পদ না পেয়ে রাখালদাস খুব বিমর্ষ হয়ে পড়েন। তিনি নিজেকে বঞ্চিত বলে ভাবতে থাকেন। এসময় থেকেই Archaeological Survey of India (ASI) তে তাঁর পূর্বতন সহকর্মী দেবদত্ত ভান্ডারকরের প্রতি তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। মহেঞ্জোদারো আবিষ্কার পরবর্তী রাখালদাসের লেখায় ভাণ্ডারকরকে পরোক্ষ ভাবে আক্রমণ করে প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। কারমাইকেল অধ্যাপকের পদ না পাওয়া তাঁর জন্য শাপে বর হয়েছিল। এর মাধ্যমে তাঁর জীবন ও ভারতেতিহাসের মোড় ঘুরে যায়। সেদিন যদি তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজটি পেয়ে যেতেন, তাহলে ASI এর পশ্চিম সার্কেলের প্রধান হয়ে সিন্ধুনদের খাত পরিদর্শনে তাঁর যাওয়া হতো না। আর মহেঞ্জোদারোর ভগ্নাবশেষ আবিষ্কারও হয়তো সম্ভব হতো না। 

রাখালদাস ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণের পশ্চিম সার্কেলের অধিকর্তা হিসেবে পুনেতে চলে যান। মহারাষ্ট্র, গুজরাট, সিন্ধুপ্রদেশ, রাজপুতানা ও মধ্য ভারতের কিছু অংশসহ বম্বে প্রেসিডেন্সীর বিশাল এক অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে ছিল রাখালদাসের নতুন কর্মক্ষেত্র। পুনে শহরের নিজের কার্যালয়ে তিনি কমই থাকতেন। ক্ষেত্রসমীক্ষায় ঘুরে বেড়াতেন নানা স্থানে। এ সময় তিনি ঐতিহাসিক স্থাপনার যথাযথ সংরক্ষণে প্রচুর কাজ করেছেন। তাঁর কাজ সরকারের আস্থা অর্জন করেছিল। সরকারি পর্যায়ে তিনি তাঁর কর্মদক্ষতার জন্য প্রশংসিত হয়েছিলেন। 

১৯১৭ সালে ASI পশ্চিমাঞ্চলের দায়িত্ব গ্রহণের পর ১৯১৮ এর ডিসেম্বর মাস থেকে রাখালদাস সিন্ধুনদের পুরাতন খাদ অন্বেষণ করতে শুরু করেছিলেন। এভাবে কয়েক বছর ধরে তিনি সিন্ধুপ্রদেশের সক্কর, লারকানা, মীরপুরখাস, মহম্মদখাসে জরিপ চালিয়ে যান। ১৯২১ সালে আকস্মিক ভাবে লারকানা জেলায় মহেঞ্জোদারোর ভগ্নাবশেষ দেখে একে বৌদ্ধযুগেরও প্রাচীন বলে চিনতে পারেন। তিনি তাঁর 'মুহেন-জো-দড়ো' প্রবন্ধে লিখেছেন, "১৯২১ খ্রিস্টাব্দের লাড়কাণা জিলার পশ্চিমাংশে গৈচিডেরো নামক স্থান পরিদর্শনকালে দেখিয়ে পাওয়া গেল যে, একটি বড় বাড়ি ভাঙিয়া অনেক বড় বড় মাটির জালা বাহির হইয়া পড়িয়াছে। তাহার মধ্যে একটি জালার ভিতরে হাত দিতেই আমার একটু আঙ্গুল কাটিয়া গেল। সকলেই বলিল যে, উহার ভিতরে সাপ আছে এবং তোমাকে সাপে কামড়াইয়াছে। হাত বাঁধিয়া সাপ মারিবার জন্য জালা ভাঙ্গিয়া দেখা গেল যে, সাপের পরিবর্তে জালার ভিতরে ১০টি মাটির ভাঁড় তিন থাকে সাজানো আছে। উপরের থাকের একটি মাটির ভাঁড়ের মুখে একটি ছোট পাথরের ছুরি আছে, সেই ছুরিতে লাগিয়া আঙ্গুল কাটিয়া গিয়াছিল।" এভাবে রাখালদাসের আঙ্গুল কেটে মহেঞ্জোদারোর নাটকীয় পুনরাবিষ্কার হয়েছিল। অবশ্য এই আবিষ্কারের কথা বিশ্ব জেনেছিল আরো অনেক পরে। আবিষ্কারের সময় স্বয়ং আবিষ্কর্তা এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন। সংশয়ে থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ এতো প্রাচীন একটি সভ্যতার অস্তিত্ব যে ভারতবর্ষে ছিল, তাই এক বিস্ময়কর ব্যাপার। এর আগে পর্যন্ত মৌর্যযুগকে পাথুরে প্রমাণের উপর ভিত্তি করে ভারতের ধারাবাহিক ইতিহাসের উর্দ্ধসীমা ধরা হতো। মৌর্য পূর্ববর্তী বৌদ্ধ ও বৈদিক কাল ইতিহাসের দুটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো ছিল। পাঞ্জাবের হরপ্পা এবং সিন্ধুপ্রদেশের মহেঞ্জোদারোর আবিষ্কার ভারতেতিহাসকে এক লাফে অনেকটা পেছনে সুপ্রাচীনত্বের দিকে নিয়ে গিয়েছিল। 

রাখালদাসের আগে ডি.আর.ভাণ্ডারকর ১৯১২ সালে মহেঞ্জোদারোর ভগ্নাবশেষ পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। তিনি একে প্রাচীন বলে চিনতে না পেরে বলেছিলেন আন্দাজ দু-তিন'শ বছরের পুরনো। কিন্তু রাখালদাস মহেঞ্জোদারো দেখে একে বৌদ্ধযুগেরও আগের বলে চিনতে পারেন। পুরনো শত্রুতার জের ধরে তিনি এ নিয়ে ভাণ্ডারকরকে খোঁচা দিতে ছাড়েননি। নিজের প্রবন্ধে অধ্যাপক ভাণ্ডারকরকে উদ্দেশ্য করে একহাত নিয়েছিলেন। অনাবশ্যক বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু রাখালদাস তা করেননি। কর্মস্থলে তাঁর অনেক শত্রুর সৃষ্টি হয়েছিল। যার জন্য তিনি নিজেই অনেক ক্ষেত্রে দায়ী ছিলেন। পুরনো কথা প্রকাশ্যে লিখে তিনি অহেতুক বিতর্কের সৃষ্টি করেছেন। যার ফলে পেশাগত ক্ষেত্রে তাঁকে এ নিয়ে অনেক ভুগতে হয়েছিল। অধ্যাপক রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর লেখায় রাখালদাসের এই অসংযমী মনোভাব নিয়ে আলোচনা করেছেন। 

১৯২২ এ রাখালদাস মহেঞ্জোদারোতে খননকার্য শুরু করেন। ভগ্নাবশেষের উচ্চতম স্তরে তাঁর দলকে দু'ভাগে বিভক্ত করে খনন করেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে খননকারী দলের একটি অংশ ভগ্নাবশেষের উপরিভাগে অবস্থিত বৌদ্ধস্তূপে (এটি প্রায় দু'হাজার বছরের পুরনো) এবং অন্যদল নিচের ইটের প্রাচীরে উৎখনন চালায়। খননকারীদের একজন একটি সিলমোহর খুঁজে পায়। রাখালদাস সিলমোহরটি দেখেই বুঝতে পারেন, কয়েক দশক আগে হরপ্পা থেকে পাওয়া আলেকজান্ডার ক্যানিংহামের সিলমোহরটির সাথে মহেঞ্জোদারোর সিলমোহরের মিল রয়েছে। দুটোই প্রায় একই। কয়েকশো মাইলের ব্যবধানে থাকা দুটো প্রাচীন নগরের ভগ্নাবশেষ যে একই সভ্যতার প্রতিনিধি তা রাখালদাসই সর্বপ্রথম অনুধাবন করেন। 

১৯২৩ এর মার্চ মাসে রাখালদাস একটি বিখ্যাত চিঠি লিখেছিলেন বড়কর্তা (DG ASI) স্যার জন মার্শালকে। মার্শাল সাহেব তখন বিলেত থেকে ছুটি শেষে ফিরে এসে তক্ষশিলায় উৎখননের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। রাখালদাস মহেঞ্জোদারোর খনন ও হরপ্পার সাথে এর মিলের প্রমাণ পাওয়ার কথা বিস্তারিত ভাবে চিঠিতে জানালেন। ভূমধ্যসাগর অঞ্চল, ক্রীট ও সুমেরীয় সভ্যতার সাথে এর সম্পর্ক থাকার কথাও বললেন। চিঠি পড়ে মার্শাল রাখালদাসের প্রশংসা করেছিলেন। এ ব্যাপারে তিনি নিজেও উৎসাহী হয়ে ওঠেন। মার্শাল অফিসিয়ালি ঘোষণার আগে এ ব্যাপারে কোন কিছু প্রচার করতে নিষেধ করেন। ২৩ এর প্রথম দিকে রাখালদাস মহেঞ্জোদারোর প্রথম ধাপের প্রাথমিক পর্যায়ের খনন শেষ করেছিলেন এবং চিহ্নিত ঢিবিগুলোকে পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণের অধীনে নিয়ে আসেন। সিন্ধুপ্রদেশের শুষ্ক মরু অঞ্চলের আবহাওয়ায় রাখালদাসের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে। তিনি পূর্বাঞ্চলে বদলির জন্য আবেদন করেন। 

অসুস্থতার কারণে দীর্ঘ ছুটি নিয়ে রাখালদাস কলকাতায় ফিরে আসেন। অবশেষে ১৯২৪ এ ASI এর পক্ষ থেকে মার্শাল হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করেন। রাখালদাসের মনে হতে থাকে যে, তাঁকে মহেঞ্জোদারো আবিষ্কারের জন্য যথাযথ স্বীকৃতি দেয়া হলো না। অমৃতবাজার ও কলকাতার অন্য কয়েকটি পত্রিকা এ ব্যাপারে রাখালদাসের পক্ষ নিয়ে মার্শালের সমালোচনা করতে শুরু করে। রাখালদাসও তাঁর নীরবতা ভেঙে মহেঞ্জোদারোর আবিষ্কার নিয়ে মাসিক বসুমতীতে একটি প্রবন্ধ লেখেন। যার একটি বড় অংশ জুড়ে ছিল মহেঞ্জোদারোয় ভাণ্ডারকরের ব্যর্থতা ও রাখালদাসের সাফল্যের কথা। যদিও মার্শালকে নিয়ে তিনি কিছু লেখেননি। এত সব দেখে মার্শাল এবার ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। রাখালদাসকে বাদ দিয়েই তিনি মহেঞ্জোদারোয় দ্বিতীয় পর্বের খননকার্য শুরু করেন। রাখালদাসকে স্থায়ী ভাবে ASI এর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান হিসেবে বদলির আদেশ দেয়া হয়। সুনীতিকুমার এ বিষয়ে লিখেছেন, "রাখালের হাত থেকে এই এতবড় আবিষ্কারটা খনন কার্যের দ্বারা সম্পূর্ণ করবার ভার তিনি নিজেই নিলেন এবং রাখালদাসের প্রাথমিক কৃতিত্বের কথাটা একটু সংক্ষেপে নমো নমো করেই সেরে দিলেন। রাখালের যে আশা ছিল, এই আবিষ্কার নিজে সম্পূর্ণ করবেন, সেটার যোগাযোগ হ'ল না---তিনি পশ্চিম ভারত থেকে পূর্বভারতে বদলি হলেন তবে স্যর জন মার্শাল-এর মত লোকের হাতে পড়ায় মহেন-জো-দড়োর প্রত্নকথা খুব পাণ্ডিত্যের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে আলোচনা করেন। ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের নিয়ম ছিল যে কর্তৃপক্ষের হুকুম না হলে কোনও অধস্তন কর্মচারী কোনও আবিষ্কার বা গবেষণা তাঁর নিজের কৃতিত্ব হলেও প্রকাশ করতে পারতেন না। সুতারাং এই নিয়মে রাখালদাসের মুখবন্ধ হ'ল, এই গবেষণা সম্বন্ধে তাঁর যা বক্তব্য তা বলবারও তাঁর পথ রইল না।"

সুনীতিকুমারের এই বিশ্লেষণ থেকে পরিস্কার বোঝা যায় যে, রাখালদাস তৎকালীন পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন। এক প্রকার বাধ্য হয়েই তাঁকে মহেঞ্জোদারো নিয়ে পরবর্তী গবেষণা থেকে সরে যেতে হয়েছিল। যদিও মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সিন্ধু লিপির পাঠোদ্ধার করা নিয়ে তাঁর প্রবল আগ্রহ ছিল। জীবনের শেষ দিকে তিনি এ নিয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে গবেষণার কাজ শুরু করেছিলেন। দ্রাবিড়ীয় ও সুমেরীয় লিপির সাথে সিন্ধুলিপির মিল খুঁজে পেয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৩০ সালের ২৩শে মে তাঁর অকাল প্রয়াণ এতে যবনিকা টেনে দেয়। সিন্ধুলিপির সেই রহস্য আজও উন্মোচিত হয়নি। 

দ্বিতীয় পর্বের উৎখনন শেষে স্যার জন মার্শাল সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কার ও গবেষণার কথা গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন। গ্রন্থের ভূমিকায় মার্শাল মহেঞ্জোদারোর আবিষ্কারে রাখালদাসের অবদানকে স্বীকার করেছিলেন। যদিও এ নিয়ে অধিক বাক্য ব্যয় করেননি। মহেঞ্জোদারো থেকে রাখালদাসের বদলি হওয়ার কারণ হিসেবে স্বাস্থ্যের অবনতিকে নির্দেশ করেছেন। বিশ্ব জানল মহেঞ্জোদারো এককভাবে আবিস্কৃত নয়। এই আবিষ্কারক বিতর্ক প্রসঙ্গে পি কে মিশ্র তাঁর 'Rakhal Das Banerji: The Forgotten Archaeologist'গ্রন্থে লিখেছেন, ১৯২৪ সালের আগে মার্শালের মহেঞ্জোদারোর ব্যাপারে পরিস্কার ধারণাই ছিল না। তাঁর মতে, 'Marshall took direct charge of the 

excavation from winter 1925-26. By that time Banerji had done all the work a discover should have done.' এক্ষেত্রে রাখালদাসের নিজের অবস্থান পরিস্কার নয়। রাখালদাসের খ্যাতি চুরির অভিযোগে অমৃতবাজার পত্রিকায় মার্শালের বিরুদ্ধে সমালোচনা প্রকাশিত হলে রাখালদাস পত্রিকার কাছে চিঠি লিখে এর প্রতিবাদ জানান। চিঠিতে লেখেন, স্বেচ্ছায় তিনি বদলি ও পরে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। এতে তাঁর ইংরেজ বড়কর্তার কোনো দোষ নেই। এমন প্রতিবাদ পত্রের পর পত্রিকার তরফে তাঁকে বিদ্রুপ করে 'কর্তাভজা' আখ্যা দেয়া হয়। 

স্যার জন মার্শাল সম্পর্কে বলা যায় যে, তিনিই প্রথম ভারতীয়দের ASI এর আঞ্চলিক প্রধানের পদে নিয়োগ করেছিলেন। পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের মহানির্দেশক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় তাঁর দুই প্রধান সহযোগী ছিলেন দয়ারাম সাহনি ও রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। কাজের ক্ষেত্রে এঁদের তিনি খুব ভরসা করতেন। অর্থের অপচয় ও অসংযমী আচরণের জন্য তিনি রাখালদাসকে বেশ কয়েকবার ক্ষমা করেছিলেন। তাঁকে যোগ্যতার ভিত্তিতে উচ্চপদে নিয়োগ করতে দ্বিধা করেননি। কিন্তু মহেঞ্জোদারোর আবিষ্কারের পর রাখালের ভুলত্রুটি তাঁর কাছে কেন এতো অমার্জনীয় হয়ে উঠেছিল, তা রহস্যাবৃত। প্রথমে পশ্চিমাঞ্চলের দায়িত্ব থেকে পূর্বে বদলি এবং পরে চাকরি থেকে হঠাৎ অবসরে যাওয়ার পেছনে মার্শালের ভূমিকা যে ছিল না তা বলা যায় না। ডিজি হিসেবে মার্শালের অবসরের পর মহেঞ্জোদারোর আবিষ্কারক আর. ডি. ব্যানার্জিই যে এই পদের প্রবল দাবিদার তা তিনি জানতেন। হয়তো তা জেনেই সেই মতো ব্যবস্থা গ্রহণ! 

পাকিস্তানের করাচি সংগ্রহালয়ের গ্যালারিতে রাখালদাসের একটি ছবি রয়েছে। ছবিতে তাঁর নাম বা পরিচিতি কিছুই লেখা নেই। তবু বেনামে হলেও মহেঞ্জোদারোর আবিষ্কারকের স্মৃতি সিন্ধুপ্রদেশে রয়ে গেছে। 

রমাপ্রসাদ চন্দ, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও রমেশচন্দ্র মজুমদার এক বাক্যে রাখালদাসের জীবনের সবচেয়ে বড় কীর্তি রূপে মহেঞ্জোদারোর প্রত্নস্থল আবিষ্কারকে নির্দেশ করেছেন। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সল্পায়ু এই মানুষটির নানাক্ষেত্রে তাঁর অনন্য প্রতিভার সৃজনশীল স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তবে সবচেয়ে অবিস্মরণীয় হলো -মৃতের স্তূপের আবিষ্কার। তাই মহেঞ্জোদারোর সাথে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামটি অভিন্ন ভাবে যুক্ত হয়ে গেছে। 

জন্মদিনে (১২ এপ্রিল, ১৮৮৫, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ)  তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই।


তথ্যসূত্র: 

* রাখালদাস বন্দ্যোপাধায় - রমেশচন্দ্র মজুমদার,

* রাখালদাস বন্দ্যোপাধায় এক বিস্মৃত অধ্যায় - রজত পাল, 

* ইতিহাস চিন্তা - রাখালদাস বন্দ্যোপাধায়, 

* প্রত্নতথ্য - প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত।

Post a Comment

Previous Post Next Post

Contact Form