মহাজাগতিক রশ্মি (Cosmic ray)





যেকোনো গ্যালাক্সির মধ্যে আন্তনক্ষাত্রিক স্থানের প্রতিটি ঘন সেন্টিমিটার এলাকায় মহাজাগতিক রশ্মি বিশাল গতিতে ছুটে চলেছে নানা দিকে। আমাদের পৃথিবীতেও সৌরজগতের বাইরে থেকে সরাসরিভাবে আসা বস্তুদের মধ্যে এরা অন্যতম। মহাজাগতিক রশ্মি নাম হলেও সেগুলো কিন্তু আদপেই কোনো "রশ্মি" নয়। তারা অদৃশ্য, সংখ্যায় প্রচুর এবং মারাত্মক। 1912 সালের আগস্টে, অস্ট্রিয়ান পদার্থবিদ ভিক্টর হেস একটি ঐতিহাসিক বেলুন উড্ডয়ন করেছিলেন যা মহাবিশ্বের পদার্থের উপর একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিল। তিনি যখন 5300 মিটার উচ্চতায় উঠেছিলেন, তিনি বায়ুমণ্ডলে আয়নীকরণের হার পরিমাপ করলেন এবং দেখতে পেলেন যে তা সমুদ্রপৃষ্ঠের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। তিনি এই উপসংহারে পৌঁছেছিলেন যে খুব উচ্চ শক্তির অনুপ্রবেশকারী বিকিরণ উপর থেকে আমাদের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে। তিনি আদতে মহাজাগতিক রশ্মি আবিষ্কার করেছিলেন। তার জন্য তিনি 1936 সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। যদিও পরবর্তী পরীক্ষাগুলি তাদের কণা প্রকৃতি প্রকাশ করেছে, তবুও সেই পুরোনো নামই রয়ে গেছে।


🔹মহাজাগতিক রশ্মি আসলে কি?

মহাকাশ থেকে আগত এই উচ্চ-শক্তির কণাগুলি প্রধানত (89%) প্রোটন, মহাবিশ্বের সবচেয়ে হালকা এবং সবচেয়ে সাধারণ উপাদান হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস। এছাড়াও এই কণাদের 10% হলো হিলিয়ামের নিউক্লিয়াস (আলফা কণা) এবং বাকি 1% হলো অন্যান্য ভারী মৌলের নিউক্লিয়াস যার মধ্যে ইউরেনিয়ামও থাকতে পারে। এর সাথে খুব সামান্য পরিমাণে ইলেকট্রন, নিউট্রন এবং নিউট্রিনো থাকে। যখন তারা পৃথিবীতে পৌঁছায়, তারা উপরের বায়ুমণ্ডলে পরমাণুর নিউক্লিয়াসের সাথে সংঘর্ষ ঘটায় এবং আরও কণা তৈরি করে যাদের মধ্যে প্রধান হলো পাইয়ন (pion) কণা। এদের সেকেন্ডারি কসমিক রশ্মি বলা হয়। চার্জযুক্ত পাইয়নগুলি দ্রুত ক্ষয়িত হয়ে মিউয়ন (muon) নামক কণা নির্গত করতে পারে। এই মিউয়ন কণাগুলি পাইয়ন কণাদের মতো অন্য পদার্থের সাথে মিথস্ক্রিয়া করে না। এরা বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে এসে অবাধে ভূপৃষ্ঠের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে।


🔹মহাজাগতিক রশ্মির শক্তি -

শুন্য মাধ্যমে আলোর গতিবেগের প্রায় কাছাকাছি গতিতে ছুটে চলা এই মহাজাগতিক রশ্মিগুলি অনেক শক্তিশালী। প্রাথমিক মহাজাগতিক রশ্মির শক্তি প্রায় 1 GeV (একটি অপেক্ষাকৃত ছোট কণা ত্বরক যন্ত্র বা particle accelerator এর শক্তি) থেকে শুরু করে 10^8 TeV পর্যন্ত হতে পারে, যা লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের রশ্মির শক্তির চেয়ে কয়েক কোটি গুণ বেশি! এই প্রসঙ্গে বলা যায় এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী কসমিক রশ্মি সনাক্ত করা হয়েছিল 1991 সালে আমেরিকার উটাহতে। এই কণাটির একটি মজার ডাকনাম রয়েছে - Oh-My-God particle. (তথাকথিত God particle বা Goddamn particle, যা প্রকৃতপক্ষে Higgs boson কণা, তার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।) এই কণাটি আসলে একটি প্রোটন কণা বলে ধারণা করা হয়। সেই কণাটির শক্তির পরিমাণ ছিলো প্রায় 3.2 × 10^20 eV. বিজ্ঞানীদের মতে এই কণার মধ্যে মোট শক্তি আমাদের সবচেয়ে শক্তিশালী পার্টিকেল কোলাইডার, LHC এর চেয়ে 10 মিলিয়ন গুণ বেশি শক্তি ধরে!  এই কণাটির গতি ছিলো শুন্য মাধ্যমে আলোর গতিবেগের শতকরা  99.99999999999999999999951 ভাগ! রিলেটিভিস্টিক time dilation এর কারণে সেই গতিতে, OMG কণাটি তার নিজস্ব সময়ের মাপকাঠিতে মাত্র 0.43 মিলিসেকেন্ডে আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী তারকা, প্রক্সিমা সেন্টোরিতে পৌঁছে যেতে পারে। কোনো ভর বিশিষ্ট কণার এই পরিমাণ অকল্পনীয় গতি প্রকৃতপক্ষে  Greisen–Zatsepin–Kuzmin limit (GZK limit) কে লঙ্ঘন করে। এই GZK সীমাটি আসলে কসমিক রশ্মির গতির তত্ত্বগত চরম সীমা বলে ধরা হয়।

তবে বেশিরভাগ মহাজাগতিক রশ্মিতে এমন চরম শক্তি নেই, তা মোটামুটি গড়ে 0.3 Gev এর আশেপাশে থাকে। এই রশ্মিগুলি যে হারে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের শীর্ষে পৌঁছায় তার পরিমাণ তার ক্রমবর্ধমান শক্তির সাথে সাথে কমতে থাকে। 1 GeV শক্তিসম্পন্ন কণাগুলি প্রতি সেকেন্ডে প্রতি বর্গমিটারে প্রায় 10000 টি করে আপতিত হয়। অন্যদিকে সর্বোচ্চ শক্তিসম্পন্ন কণাগুলি আপতিত হওয়ার সংখ্যা প্রতি শতাব্দীতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে একটিরও কম!

🔹মহাজাগতিক রশ্মি কোথা থেকে আসে? 

মোটামুটি চার ধরনের অঞ্চল থেকে এই মহাজাগতিক রশ্মি উৎপাদিত হয়। প্রথমটি হল কম শক্তির যাদেরকে বলা হয় আ্যনোম্যালাস মহাজাগতিক রশ্মি (anomalous cosmic rays)। তারা সম্ভবত সৌরজগতের প্রান্তে heliosheath অঞ্চল থেকে উদ্ভুত হয়। এখানে যেখানে সৌর বায়ুর (solar wind) আর কোনো প্রভাব থাকে না। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মনে করেন যখন হেলিওশিথের বৈদ্যুতিকভাবে নিরপেক্ষ পরমাণুগুলি আয়নিত এবং ত্বরিত হয় তখন এই ধরনের মহাজাগতিক রশ্মির উৎপত্তি ঘটে। 2012 সালে ভয়েজার 1 মহাকাশযান যখন হেলিওশিথ থেকে আন্তঃনাক্ষত্রিক মহাকাশে চলে যায় তখন সেটি আ্যনোম্যালাস কসমিক রশ্মিকে সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল।

দ্বিতীয় প্রকারটি, গ্যালাকটিক মহাজাগতিক রশ্মি (galactic cosmic rays), মিল্কিওয়ের অন্যান্য অংশ থেকে এসে সৌরজগতে প্রবাহিত হয়। বিজ্ঞানীদের মতে সুপারনোভা এই ধরণের বেশিরভাগ মহাজাগতিক রশ্মি তৈরি করে। একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণের পরে, কণাগুলি গ্যাসীয় অবশিষ্টাংশের মধ্যে আটকে থাকা চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে বারবার বাউন্স করে এবং মহাজাগতিক রশ্মিতে ত্বরান্বিত হয়। কোনো কোনো সময়ে, তারা আন্তনক্ষাত্রিক স্থানে পালিয়ে যায়। যদিও সম্প্রতি জানা গেছে যে সুপারনোভা অতিরিক্ত শক্তি সম্পন্ন মহাজাগতিক রশ্মির উৎপত্তি ব্যাখ্যা করতে পারে না। এমনকি আমাদের সমগ্র মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকে আলোকিত করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী একটি সুপারনোভাও মহাজাগতিক রশ্মিকে এমন বিপুল শক্তিতে চালিত করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী নয়! Los Alamos National Laboratory এর বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে অল্প বয়স্ক, অতি উত্তপ্ত, বিশাল নক্ষত্রের ক্লাস্টারগুলি প্রাকৃতিক কণা ত্বরক (particle accelerators) হিসাবে কাজ করে। সেগুলিই সর্বোচ্চ শক্তির মহাজাগতিক রশ্মির জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি স্তরে কণাগুলিকে ত্বরান্বিত করতে সক্ষম।

পৃথিবীতে পাওয়া তৃতীয় প্রকারটি হলো সূর্য থেকে প্রচুর সংখ্যায় উৎপন্ন মহাজাগতিক রশ্মি। এগুলোর বেশিরভাগই প্রোটন, অপেক্ষাকৃত কম শক্তির কণা। সূর্যের পৃষ্ঠের তীব্র চৌম্বক ক্ষেত্র তাদের শক্তি জোগায়।

চতুর্থ ও শেষ প্রকারটি হল অতি-উচ্চ-শক্তির (ultra-high-energy) মহাজাগতিক রশ্মি। এরই একটি উদাহরণ হলো সেই "Oh-My-God" particles. গবেষকরা ঘোষণা করেছেন যে এই অত্যন্ত শক্তিশালী মহাজাগতিক রশ্মিগুলি মিল্কিওয়ের বাইরে থেকে উৎপন্ন হয়েছে। তবে, তাঁরা এখনও তাদের সুনির্দিষ্ট উৎস চিহ্নিত করতে পারেননি। গবেষকরা আশা করছেন যে চলতি বছরে অর্থাৎ 2022 সালে চালু হতে চলা Cherenkov Telescope Array এর মাধ্যমে এই সর্বোচ্চ শক্তিশালী মহাজাগতিক রশ্মিগুলির উৎস সম্পর্কে বিশদে জানা যাবে। 

এখানে বলে রাখা ভালো যে ইউরোপিয়ান অর্গানাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ (CERN) অনুসারে মহাজাগতিক রশ্মি কোথা থেকে আসে তা চিহ্নিত করা একটি কঠিন কাজ। যেহেতু তারা চার্জযুক্ত কণা, তারা চৌম্বক ক্ষেত্রে তাদের প্রতিক্রিয়া জানায়। আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে একটি দুর্বল (কিন্তু বড়) চৌম্বক ক্ষেত্র রয়েছে, যা মহাবিশ্বের বাকি অংশ থেকে প্রবাহিত যেকোনো মহাজাগতিক রশ্মির পথকে বিচ্যুত করে দেয়। গ্যালাক্সির বাইরে থেকে এই মহাজাগতিক রশ্মিগুলি পৃথিবীতে আমাদের ডিটেক্টরগুলিতে পৌঁছানোর সময়, তারা কোন সনাক্তকরণযোগ্য উৎস ছাড়াই এলোমেলো বা random দিক থেকে আসে।

পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের কারণে এর নিজস্ব বিকিরণ বলয়ও রয়েছে। অভ্যন্তরীণ বিকিরণ বেল্ট বা ভ্যান অ্যালেন বেল্ট (Van Allen Belt), খুব শক্তিশালী প্রোটনের আকারে আয়নাইজিং বিকিরণ নিয়ে গঠিত। এই বলয়টি কসমিক রশ্মি এবং পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের পরমাণুর মধ্যে সংঘর্ষের ফলে সৃষ্টি হয়েছে। আর বাইরের বিকিরণ বেল্টে প্রোটন এবং ইলেকট্রন থাকে। 

🔹মহাজাগতিক রশ্মি কি ক্ষতিকর?

সমস্ত শক্তির মহাজাগতিক রশ্মি মানুষ এবং তাদের ব্যবহৃত প্রযুক্তি এবং বস্তুর জন্য ভয়ঙ্কর। তারা যেকোনো ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রকে ব্যাহত করতে পারে, সে কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে শুরু করে ডিজিটাল ক্যামেরা পর্যন্ত সবকিছুতেই বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে। আয়োনাইজিং বিকিরণের একটি রূপ হিসাবে, তারা সমগ্র জীব জগতের স্বাস্থ্যের উপর প্রবল নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। প্রাণী ও উদ্ভিদের দেহের কোষগুলি মরে যেতে পারে, ডিএনএ মিউটেশন প্রবর্তন করতে পারে, ক্যান্সার ও অন্যান্য মারাত্মক রোগের কারণ হতে পারে।

যদিও পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্র এবং আবহমণ্ডল আমাদের চারপাশে সুরক্ষা বলয় তৈরি করে রেখেছে কিন্তু মহাজাগতিক রশ্মি মহাকাশচারীদের জন্য একটি গুরুতর বিপদ তৈরি করে। International Space Station এ বসবাসকারী বিজ্ঞানীদের ক্ষেত্রেও এই রশ্মি সমান বিপদজনক। ভূপৃষ্ঠ থেকে যত দূরে যাওয়া যায় ততই আমরা এর সম্পূর্ণ বিকিরণ বর্ণালী এবং এর ক্ষতিকর প্রভাবের সংস্পর্শে আসতে থাকি। 

যদিও মহাজাগতিক রশ্মি সাধারণত অত্যন্ত ক্ষতিকর তবুও পৃথিবীতে জীবজগতের বিবর্তনে হয়তো এর ভূমিকা রয়েছে।  যেহেতু মহাজাগতিক রশ্মি মিউটেশন ঘটায় এবং তাই মহাজাগতিক রশ্মি বিবর্তিত হওয়ার ক্ষমতার সাথে যুক্ত থাকলেও থাকতে পারে। মহাজাগতিক রশ্মি এবং বিবর্তনের মধ্যে যোগসূত্রটি দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত হয়ে ছিলো, তবে এটি বর্তমানে বিজ্ঞানীদের মধ্যে দ্রুত আগ্রহ অর্জন করছে।


লিখাঃ সরোজ নাগ

তথ্য সূত্র - 1) https://home.cern/science/physics/cosmic-rays-particles-outer-space

2) Article: “Detection of a cosmic ray with measured energy well beyond the expected spectral cutoff due to cosmic microwave radiation”

Authors: D. J. Bird et al.

Reference: https://arxiv.org/abs/astro-ph/9410067 [astro-ph]

3) D. Clery, What's the Source of the Most Energetic Cosmic Rays? Science, 336(6085), 2012, 1096-1097, p.1096

4) আরও কিছু ওয়েবসাইট। 


চিত্র পরিচিতি - 1) কিভাবে একটি মহাজাগতিক রশ্মি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে পৌঁছানোর পর ক্ষয়িত হয়ে একটি 'কণা ঝরনার' সৃষ্টি করতে পারে তার পরিকল্পিত নকশা। সৌজন্যে - Alberto Izquierdo, Francisco Barradas Solas.

2) মহাজাগতিক রশ্মির প্রবহণ (flux) এবং কণার শক্তির লেখচিত্র। মহাজাগতিক রশ্মির শক্তির একটি ফাংশন হিসাবে কণাগুলির প্রবাহ দেখানো হয়েছে। সর্বনিম্ন শক্তির (হলুদ অঞ্চল) প্রবাহ প্রধানত সৌর মহাজাগতিক রশ্মি, মধ্যবর্তী শক্তি (নীল) গ্যালাকটিক মহাজাগতিক রশ্মির জন্য এবং সর্বোচ্চ শক্তি (বেগুনি) বহির্ভূত মহাজাগতিক রশ্মির জন্য দায়ী। সৌজন্যে Sven Lafebre, Wikipedia.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম