পৃথিবীর ইতিহাসে কমপক্ষে পাঁচটি তুষার যুগের সন্ধান পাওয়া যায়। যখন অনেক দীর্ঘ সময় জুড়ে ভূপৃষ্ঠ এবং আবহমন্ডলের উষ্ণতা যথেষ্ট পরিমাণে কম থাকে যার ফলে মহাদেশীয় ও মেরুপ্রদেশের বরফের চাদর বৃদ্ধি পায় এবং ভূপৃষ্ঠের অনেকটা স্থান জুড়ে বিদ্যমান থাকে তখনই হয় তুষার যুগ বা আইস এজ। পৃথিবীতে পর্যায়ক্রমে তুষার যুগ ও উষ্ণ যুগ আসতে থাকে। শেষ যে তুষার যুগটি পৃথিবীতে এসেছিল তার নাম কোয়াটারনারি গ্লেসিয়েশন (Quaternary glaciation) বা প্লেইস্টোসিন গ্লেসিয়েশন (Pleistocene glaciation) । এটি শুরু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় 2.58 মিলিয়ন বছর আগে। বর্তমানে যে দশাটি চলছে তাকে বলা হয় ইন্টার গ্লেসিয়াল পিরিয়ড, যা গত 11,700 বছর আগে থেকে আরম্ভ হয়েছে। এই দশার শেষে আসবে গ্রীনহাউস পৃথিবী যুগ(Greenhouse Earth) বা হটহাউস (hothouse) পৃথিবী। [ এই যুগটি তুষার যুগের সাথে বারবার ঘুরেফিরে আসে, এর সঙ্গে সাধারণ অর্থে মনুষ্য সৃষ্ট গ্লোবাল ওয়ার্মিং বলতে আমরা যা বুঝি - তার কোনো প্রমাণিত সম্পর্ক নেই। ]
প্লেইস্টোসিন গ্লেসিয়েশনের শেষদিকে, অর্থাৎ গত তুষার যুগের শেষে, আজ থেকে প্রায় 20000 বছর আগে যে দশাটি বিদ্যমান ছিলো তাকে Last Glacial Maximum, বা LGM বলা হয়। এই সময়ে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপের অর্ধেক অংশ এবং এশিয়ার অনেকটা অঞ্চল বরফের চাদরের নীচে ঢাকা ছিলো। এই সময়ে পৃথিবী কতটা শীতল ছিলো? আ্যরিজোনা ইউনিভার্সিটির Jessica Tierney, মিশিগান ইউনিভার্সিটির Christopher Poulsen এবং Jiang Zhu এর প্রকাশিত গবেষণা পত্র অনুযায়ী তখন পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ছিলো 7.8° সেন্টিগ্রেড। তুলনামূলক ভাবে বলা যায় বিংশ শতাব্দীর পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ছিলো 14° সেন্টিগ্রেড। বিজ্ঞানীদের মতে মানুষের নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় এটি একটি বড় পার্থক্যের মতো শোনাতে পারে না, কিন্তু, আসলে, এটি একটি বিশাল পরিবর্তন। উচ্চ অক্ষাংশে আজকের তুলনায় এই পার্থক্য ছিলো প্রায় 14° সেন্টিগ্রেড।
পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের মডেলের ধারণার সঙ্গে এই প্রাপ্ত ফলাফল বেশ সুন্দর ভাবে মিলে যায়। প্রকৃতপক্ষে উচ্চ অক্ষাংশগুলি নিম্ন অক্ষাংশের তুলনায় দ্রুত হারে উষ্ণ বা শীতল হয়৷ এই বিষয়টিকে বলা হয় polar amplification. অর্থাৎ উচ্চতর অক্ষাংশগুলি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য তুলনায় বেশি সংবেদনশীল।
টীয়ের্নি এবং তাঁর সঙ্গীদের গণনায় দেখা যায় বায়ুমন্ডলে কার্বনের পরিমান বেড়ে দ্বিগুণ হলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা 3.4° সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধি পায়। তুষার যুগে বায়ুমন্ডলে কার্বনের পরিমান ছিল 180 ppm (parts per million), আঠারো শতকের শিল্প বিপ্লবের সময়ে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় 280 ppm, যা বর্তমান কালে 415 ppm এ পৌঁছেছে।
টীয়ের্নি এবং তাঁর সঙ্গীরা পৃথিবীর অতীতে উষ্ণ সময়গুলির সম্পর্কে ধারণা তৈরি করতে একই কৌশল ব্যবহার করার পরিকল্পনা করছেন। আজকের ক্রমবর্ধমান কার্বন ডাই অক্সাইডের বায়ুমণ্ডলীয় স্তর সারা বিশ্বের গড় তাপমাত্রাকে কীভাবে প্রভাবিত করে, তা নির্ধারণ করতে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের এই মূল্যায়ন খুবই সাহায্য করবে।
লিখাঃ সরোজ নাগ।
চিত্র - শিল্প-বিপ্লবের আগের সময়ের সঙ্গে গত তুষার যুগে ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রার পার্থক্য। চিত্রটি Jessica Tierney, University of Arizona এর সৌজন্যে প্রাপ্ত।
তথ্যসূত্র - Tierney, J.E., Zhu, J., King, J. et al. Glacial cooling and climate sensitivity revisited. Nature 584, 569–573 (2020). https://doi.org/10.1038/s41586-020-2617-x