নদীর গতিপথ এবং জীববৈচিত্র্য



আমাজন অববাহিকা, নামটি শুনলেই কেমন যেন রোমাঞ্চ লাগে। ঘন জঙ্গল, নদী-উপনদীর বিস্তার, আশ্চর্যজনক জীব বৈচিত্র্য, অনাবিষ্কৃত প্রাণের উপস্থিতি, অপরিচিত বা স্বল্পপরিচিত জনজাতি, এখনো পর্যন্ত মানুষের পা না-পড়া জায়গার অস্তিত্বের সম্ভাবনা ইত্যাদি সবকিছু মিলিয়ে সে যেন একটা আলাদা পৃথিবী। আমাজন নদী অববাহিকার ঘন অরণ্য পৃথিবীর সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় বাস্তুতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত, এই স্থানে পৃথিবীর মোট ভূমি পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফলের মাত্র 0.5% অংশে আমাদের সকল জানা প্রজাতির 10℅ ঘন সন্নিবেশিত হয়ে রয়েছে, আর নিঃসন্দেহে অনাবিষ্কৃত প্রজাতিতো রয়েছেই। এই অঞ্চলের প্রাণভোমরা হলো বিশাল নদী এবং তার শাখা-প্রশাখা দিয়ে তৈরি বিরাট বড়ো নেটওয়ার্ক। এই নদীগুলি স্থির পথে গতিশীল নয়। এরা হাজার হাজার বছর ধরে ক্রমাগত নিজেদের পুনর্বিন্যাস করছে, নতুন পথ আঁকছে এবং পুরানোগুলি মুছে দিচ্ছে। নদীগুলি জঙ্গলকে ক্রমাগত বিভক্ত আর উপবিভক্ত করে। এখানে ঘন অরণ্যের মধ্যে স্থলভূমির সীমানা সময়ের সঙ্গে সর্বদা পরিবর্তনশীল।

Science Advances জার্নালে প্রকাশিত একটি নতুন গবেষণাপত্রে বিজ্ঞানী Lukas J. Musher এবং তাঁর সহযোগীরা জানিয়েছেন যে নদীর এই ধরনের অবিরাম রদবদল আমাজনের ঘন বৃষ্টি-অরণ্যের অদ্ভুত সুন্দর পাখিদের জীববৈচিত্র্যকে বাড়িয়ে তোলে। আমাজনের জঙ্গলকে এই গ্রহের সবচেয়ে জীববৈচিত্র্যপূর্ণ স্থানগুলির মধ্যে একটিতে পরিণত করার ক্ষেত্রে এই "স্থানান্তরিত" নদীগুলির ভূমিকা অপরিসীম।

1960 এর দশক থেকেই বিজ্ঞানী মহলে এই ধারণাটি প্রচলিত ছিলো যে, নদীর স্থানান্তরিত হওয়া পাখিদের (বা স্তন্যপায়ী প্রাণীদের) জীববৈচিত্র্যের উপর (বা আরও ভালোভাবে বললে তাদের নতুন অথবা স্বতন্ত্র প্রজাতির গঠনের প্রক্রিয়ার উপর) প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু তা নিয়ে বিশদ গবেষণা সেভাবে হয় নি। কিন্তু সম্প্রতি, জীববিজ্ঞানীরা ভূতাত্ত্বিকদের সঙ্গে একযোগে এই বিষয়ে গবেষণা করতে শুরু করেছেন। বিবর্তন সংক্রান্ত জীববিজ্ঞানের একটি অন্যতম বিষয় হলো ভৌগোলিক পরিবর্তন এবং জীববৈচিত্র্যের মধ্যে সম্পর্ক। 

আমাজনে নদীর পুনর্বিন্যাস কীভাবে পাখিদের উপর কিভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারে তা বোঝার জন্য, আমেরিকান মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রি এবং লুইসিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটির মুশার এবং তার সহযোগীরা 2018 সালের জুন মাসে ব্রাজিলের কেন্দ্রস্থলে প্রবাহিত নদীগুলিতে একটি অভিযান সংগঠিত করেছিলেন৷ তাঁরা দুটি নদীর উভয় পাশে একাধিক স্থান থেকে পাখির তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। সেই নদী দুটো হলো The Aripuanã River এবং The Roosevelt River. তা ছাড়াও তাঁরা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের দ্বারা সংগৃহীত আমাজনের অন্যান্য নদীর কাছাকাছি এলাকা থেকে প্রাপ্ত নমুনাগুলিও সংগ্রহ করেন।

তাঁরা খুব ভালো উড়নক্ষমতা সম্পন্ন নয় এরকম ছয়টি গ্রুপের পাখির প্রজাতির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিলেন। এ সম্পর্কে বিজ্ঞানী মুশারের বক্তব্য ছিলো, “If you want to know how the river affects birds, you have to pick the birds that the rivers are going to affect." এই পাখিগুলির মধ্যে রয়েছে নীল গলার জ্যাকামার পাখি (Galbula cyanicolliscyanicollis) এবং কালো দাগযুক্ত চোখ বিশিষ্ট Phlegopsis nigromaculata. এরা দক্ষিণ আমাজনীয় নিম্নভূমির জঙ্গলে তাদের বেশিরভাগ সময় জঙ্গলের ছাউনির (canopy) নীচে কাটায় এবং সেখানে তারা পিঁপড়ার ঝাঁককে অনুসরণ করে এবং পিঁপড়ারা যে পোকামাকড় খায় সেগুলোকে খায়।

গবেষকরা সেই পাখিদের জিনগুলির সিকোয়েন্স তৈরী করে সময়ের সাথে সাথে তারা কীভাবে বিচ্ছিন্ন হয়েছে তা নির্ণয় করেছিলেন। এরপর তাঁরা সেই জিনোমিক পরিবর্তনগুলিকে যে নদীর কাছাকাছি পাখিরা বাস করতো সেই নদীর ভূতাত্ত্বিক ইতিহাসের তথ্যের সঙ্গে মিশ্রিত করেন। তাঁরা প্রজাতিগুলির মিউটেশনের সংখ্যা ব্যবহার করে একটি মডেল তৈরী করেছিলেন যেটি প্রজাতিগুলি কতদিন আগে একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে সে সম্পর্কে তথ্য প্রদান করে। তাঁরা প্রত্যাশিত হিসাব অনুযায়ী দেখেছিলেন যে নদীগুলি এই পাখিদের জন্য বাধা স্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। যখন নদীগুলি সরে যায়, তখন এদের পপুলেশন একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এমনকি অপেক্ষাকৃত ছোট নদীগুলিও তাদের পপুলেশনকে আলাদা রাখতে পারে এবং তাদের জিনোমে ভিন্নতা আনতে পারে।

কিন্তু গবেষকরা এটাও দেখেছেন যে নদীগুলো তাদের জন্য কোনো স্থির বাধা নয়, সেগুলো গতিশীল প্রতিবন্ধক। যে নদীগুলি বিভক্ত হয়ে যায় সেগুলি প্রায়শই একত্রে ফিরে আসে, যার ফলে বিচ্ছিন্ন জনসংখ্যা আবার মিশে যায়। এক্ষেত্রে কখনও কখনও দেখা যায়, এই বিচ্ছিন্ন পপুলেশন এতোটাই আলাদা হয়ে যায় যে তাদের মধ্যে আন্তঃপ্রজনন সম্ভব হয়ে ওঠে না। তারা পৃথক প্রজাতি হিসেবে থেকে যায়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, এই পুনর্মিলনগুলি  তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব অর্জিত নতুন জিনগুলির সেই পুনরায় মিশ্রিত পপুলেশনের মধ্যে বিনিময় করার সুযোগ করে দেয়। এই "জিন প্রবাহ" (gene flow) প্রতিবার প্রক্রিয়াটি পুনরাবৃত্তি করার সময় জিনোমে জিনের নতুন সংমিশ্রণের সুযোগ করে দেয়। [পপুলেশন জীনবিদ্যায় "জিন প্রবাহ" মানে হলো এক পপুলেশন থেকে অন্য পপুলেশনে জেনেটিক উপাদান স্থানান্তর।] সম্ভবত এই ঘটনা সময়ের সাথে সাথে প্রচুর নতুন পাখির প্রজাতির উৎপত্তিতে অবদান রাখে। এই সকল বিভিন্ন প্রজাতির বৈচিত্র্যের ধরণগুলি সেখানে নদীগুলি কোন সময়ে কীভাবে পরিবর্তিত হয় তার উপর নির্ভর করে।  প্রকৃতপক্ষে আমাজনের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করা এই নদীগুলি অরণ্যকে কয়েকটি microenvironments বা 'ক্ষুদ্র পরিবেশে' বিভক্ত করে। যেহেতু নদীগুলি পরিবর্তনশীল, এই ক্ষুদ্র পরিবেশগুলি ভূতাত্ত্বিক স্কেলে অস্থায়ী। 

তাঁরা আরও দেখেছেন যে, পূর্ব আমাজনীয় অঞ্চলের তুলনায় পশ্চিম আমাজনীয় অঞ্চলে ভৌগোলিক পরিবর্তন বেশি জিনের প্রবাহ ঘটায়। এর কারণ হিসেবে তাঁরা দেখিয়েছেন পশ্চিম আমাজনীয় অঞ্চলে ভূপ্রকৃতি সমতল। সেখানে নদীগুলি তাদের তীরভূমি ক্ষয় করার এবং গতিপথ পরিবর্তন করার সম্ভাবনা অনেক বেশি হওয়ার কারণে নদীগুলি অনেক বেশি বাঁক নিতে পারে। অন্যদিকে, পূর্ব আমাজনীয় অঞ্চলের ভূপ্রকৃতিতে কোথাও কোথাও উঁচুনিচু পাহাড় বর্তমান। সেখানে নদী পাথুরে জমির উপর প্রবাহিত bedrock নদীতে পরিণত হয় এবং অনেক বেশি স্থিতিশীল হয়ে ওঠে, তারা যখন খুশি গতিপথ পরিবর্তন করতে পারে না।

তাঁরা দেখেছেন সমসাময়িক নদীগুলি তাদের পরিবেশগত অবস্থার তুলনায় পাখিদের জিনোমিক বিচ্যুতিকে ভালো ভাবে নির্দেশ করতে পারে। তাই সেই নদীগুলি পাখিদের প্রজাতির মধ্যে জীনগত দূরত্বকে ফুটিয়ে তোলে। ফলে তাঁরা মনে করেন যেহেতু নদীগুলির কারণে বিচ্যুতি ঘটে, তাই জিন প্রবাহের জন্য আবশ্যিক স্থলভাগের যোগাযোগের জন্য নদীগুলির গতিপথের পরিবর্তন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদিও অন্যান্য কারণগুলিও প্রভাব বিস্তার করে তবুও পৃথিবীর ভূপ্রকৃতির গতিশীলতা এবং জীববৈচিত্র্য পরস্পরের সাথে সংযুক্ত।

'উড়ন্ত পাখিগুলি নদী দ্বারা সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে' - এই ধারণাটি অদ্ভুত শোনাতে পারে, তবে সত্যিই এখানে অনেক পাখি রয়েছে যারা নদীর উপর দিয়ে উড়তে পারে না। যে পাখিরা খুব বেশি দূরত্বে যাওয়ার উড়ে যাওয়ার জন্য প্রবণতা সম্পন্ন নয়, তাদের ক্ষেত্রে নদী একটা বিরাট বাধা উৎপন্ন করে। এর সঙ্গে অন্ধকার বনের মেঝেতে বসবাসের জন্য অভিযোজিত অনেক পাখি সূর্যালোকের ফাঁকগুলি অতিক্রম করতে পছন্দ করে না, তাই তারা তাদের বনভূমি থেকে তাদের আবাসস্থল ছেড়ে যেতে দৃঢ়ভাবে অনুপ্রাণিত নাও হতে পারে। আমাজনে মাছের মতো জলজ প্রাণীর বৈচিত্র্য আনার জন্য নদী পুনর্বিন্যাস ইতিমধ্যেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে পরিচিত। এই একই নিদর্শন কিছু প্রাইমেট এবং প্রজাপতিদের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। গবেষকরা জীববৈচিত্র্যের এই মৌলিক নিদর্শনগুলি সম্পর্কে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাই আমাজনের এই পরিবর্তনশীল ভূতত্ত্ব এবং এর প্রজাতির মধ্যে সম্পর্ক বোঝার আগে এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। এই পৃথিবীর অন্য কোথাও নদীর পুনর্বিন্যাস বা অন্যান্য পরিবর্তনের সাথে জড়িত একইরকম ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়াগুলি সেখানকার স্থানীয় জীববৈচিত্র্যকেও পরিচালিত করতে পারে। সেগুলো আমাদের সন্ধান করতে হবে।

লিখাঃ সরোজ নাগ 

তথ্য সূত্র - https://www.science.org/doi/10.1126/sciadv.abn1099


চিত্র পরিচিতি -

আমাজন অববাহিকার জঙ্গলে নদীর গতিপথের আরও একটি চিত্র। সৌজন্যে - Uwe Bergwitz.


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম