দ্বিতীয় পর্ব – (এই পর্বটি অনেকের কাছে হয়তো একটু কঠিন লাগতে পারে, কিন্তু আমি নিরুপায়)
কোপেনহেগেন ব্যাখ্যায় পরিমাপ যন্ত্রকে কোয়ান্টাম সিস্টেম হিসেবে ধরা হয় না এবং তরঙ্গ-ফাংশনের পতনকে (collapse) কোয়ান্টাম স্টেট বিকশিত হওয়ার একটি পৃথক উপায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এভারেট পরে লিখেছিলেন ‘The Copenhagen Interpretation is hopelessly incomplete because of its a priori reliance on classical physics … as well as a philosophic monstrosity with a “reality” concept for the macroscopic world and denial of the same for the microcosm.’
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বহু-বিশ্বের ব্যাখ্যা তরঙ্গ ফাংশনের পরিমাপ প্রক্রিয়া এবং তার পতন সম্পর্কে যে কোনও রহস্য সব মুছে দেয়। একটি পর্যবেক্ষণ করার জন্য আমাদের কোনো বিশেষ নিয়মের প্রয়োজন নেই। আসলে যা ঘটে তা হল যে তরঙ্গ ফাংশনটি শ্রোডিঙ্গার সমীকরণ অনুসারে চলতে থাকে। 'একটি পরিমাপ' বা 'একজন পর্যবেক্ষক' কীভাবে গঠিত তা কোনো বিশেষ কিছু নয়। একটি পরিমাপ হল এমন কোনও মিথস্ক্রিয়া যা একটি কোয়ান্টাম সিস্টেমকে পরিবেশের সাথে এনট্যাঙ্গল করে এবং একটি পৃথক জগতের শাখা (branch) তৈরি করে। পর্যবেক্ষকের, বিশেষ করে "চেতনার" (সে আদতে যাই হোক না কেন) এই প্রক্রিয়ার সাথে বিশেষ কিছু করার নেই। একটি জীব, একটি মাইক্রোস্কোপ বা একটি পাথর, যে কেউই 'পর্যবেক্ষক' হতে পারে। একটি ম্যাক্রোস্কোপিক সিস্টেম (পর্যবেক্ষক) কেবল পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে এনট্যাঙ্গলড হয়। কোয়ান্টাম ডাইনামিক্সের এত শক্তিশালী এবং সহজ ধারণার ফলে তৈরী হয় বিশাল সংখ্যক পৃথক বিশ্বের।
এই বহু বিশ্ব ব্যাখ্যা (many-worlds interpretation বা MWI) বলে যে সর্বজনীন তরঙ্গ ফাংশন একটি বাস্তব ঘটনা এবং কোথাও কোনো তরঙ্গ ফাংশনের কোলাপ্স হয় না। কোয়ান্টাম পরিমাপের সমস্ত সম্ভাব্য ফলাফল ফিজিক্যালি কিছু পৃথক বিশ্বে উপলব্ধি করা হয়। এই ব্যাখ্যায় কোয়ান্টাম তত্ত্ব লোকাল (local), সেখানে কোনো 'action-at-a-distance' নেই। প্রতিটি বিভিন্ন শাখা বিশ্বে (branched universe) প্রতিটি পরিমাপের বিভিন্ন ফলাফল পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। সবগুলোই সমানভাবে সহাবস্থান করছে এবং সমস্তই নির্ধারিত (deterministically), এককভাবে (unitarily), বিকশিত (evolving) সর্বজনীন তরঙ্গ ফাংশন।
বহু-বিশ্বের ব্যাখ্যাটি বোঝায় যে সম্ভবত অগণিত সংখ্যক মহাবিশ্ব রয়েছে। এটি পদার্থবিদ্যা এবং দর্শনের বহুবিশ্বের অনুমান গুলির মধ্যে একটি। সময় একটি বহু শাখা বিশিষ্ট গাছের মতো যেখানে একই সময়ে বিভিন্ন পৃথক শাখায় প্রতিটি সম্ভাব্য কোয়ান্টাম ফলাফল উপলব্ধি করা হয়। একটি কোয়ান্টাম ঘটনার প্রতিটি সম্ভাব্য ফলাফল তার নিজস্ব মহাবিশ্বে বিদ্যমান।
বহু-বিশ্বের ব্যাখ্যার মূল ধারণাটি হল যে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একক গতিবিদ্যা (unitary dynamics) সর্বত্র এবং সর্বদা প্রযোজ্য এবং তাই এটি সমগ্র মহাবিশ্বকে বর্ণনা করে। তরঙ্গ ফাংশনের কোলাপ্স করার ধারণাকে বাদ দিয়ে পর্যবেক্ষক এবং বস্তুর মধ্যে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়াকে বর্ণনা করে এবং পর্যবেক্ষকদেরকে সাধারণ কোয়ান্টাম-মেকানিকাল সিস্টেম হিসাবে ব্যাখ্যা করে। কোপেনহেগেন ব্যাখ্যায় একটি পরিমাপ একটি ধারণা, যাকে একক কোয়ান্টাম মেকানিক্স দ্বারা বর্ণনা করা যায় না। সেখানে মহাবিশ্বকে একটি কোয়ান্টাম এবং একটি ক্লাসিক্যাল অংশে বিভক্ত করা হয়েছে এবং কোলাপ্স করার ধারণাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। MWI-এর প্রধান সিদ্ধান্ত হল যে মহাবিশ্ব (বা এই প্রসঙ্গে মাল্টিভার্স) একটি অসীম ও অনির্ধারিত একটি কোয়ান্টাম সুপারপজিশন দ্বারা গঠিত। সেই ভিন্ন সমান্তরাল মহাবিশ্ব বা কোয়ান্টাম বিশ্বের সংখ্যা অগণিত। এই বিশ্বগুলি পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ বিহীন।
এভারেটের মূল গবেষণাটি একটি আপেক্ষিক দশার ধারণার সূচনা করেছিল। দুটি (বা তার বেশি) সাবসিস্টেম একটি সাধারণ মিথস্ক্রিয়ার ফলে এনট্যাঙ্গলড হয়ে পড়ে। এভারেট উল্লেখ করেছেন যে এই ধরনের এনট্যাঙ্গলড সিস্টেমগুলিকে মূল দশাগুলির যোগফল হিসাবে প্রকাশ করা যেতে পারে, যেখানে দুটি বা ততোধিক সাবসিস্টেম একে অপরের সাথে আপেক্ষিক দশায় থাকে। একটি পরিমাপ বা পর্যবেক্ষণের পরে পর্যবেক্ষণ করা একটি বা একাধিক বস্তু হলো একটি বা একাধিক সাবসিস্টেম এবং অন্য একটি সদস্য হল পরিমাপ যন্ত্র (যাতে একজন পর্যবেক্ষকও থাকতে পারে) যা পরিমাপ করা সিস্টেমের অবস্থা রেকর্ড করেছে, সেও অন্য একটি সাবসিস্টেম।
শ্রোডিঞ্জারের বিড়ালের উদাহরণে এই বিষয়টি ভালোভাবে বোঝা যেতে পারে। সেখানে বাক্সটি খোলার পরে বিড়াল, বিষের শিশি এবং পর্যবেক্ষক - এরা হলো এনট্যাঙ্গলড হয়ে থাকা একটি সিস্টেম। দশা গুলির একটি আপেক্ষিক ট্রিপল (triple অর্থাৎ তিন) হবে জীবিত বিড়াল, না ভাঙ্গা শিশি এবং একটি জীবিত বিড়ালকে দেখার পর্যবেক্ষক। দশা গুলির অন্য একটি আপেক্ষিক ট্রিপল হবে মৃত বিড়াল, ভাঙা শিশি এবং একটি মৃত বিড়াল দেখা পর্যবেক্ষক।
পরিমাপ বা পর্যবেক্ষণের প্রক্রিয়া, বা কোনো পারস্পরিক সম্পর্কের মিথস্ক্রিয়া (যাকে correlation-inducing interaction বলে) সিস্টেমটিকে আপেক্ষিক দশার সেটে বিভক্ত করে। যেখানে আপেক্ষিক দশার প্রতিটি সেট সর্বজনীন তরঙ্গ ফাংশনের একটি শাখা গঠন করে। সেই শাখাটি নিজের মধ্যে সম্পূর্ণ অথবা consistent. সেটি একাধিক পর্যবেক্ষক দ্বারা ভবিষ্যতের পরিমাপেও একই ধর্ম বজায় রাখবে।
এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী একটি পর্যবেক্ষণ সম্মিলিত পর্যবেক্ষক-বস্তু সিস্টেমকে বিভিন্ন আপেক্ষিক দশায় ভাগ করে দেয়। প্রতিটি বিভাজন একটি পর্যবেক্ষণের একাধিক সম্ভাব্য ফলাফলের সাথে সম্পর্কিত। এই বিভাজনগুলি একটি "শাখাযুক্ত গাছ" তৈরি করে, যেখানে প্রতিটি শাখা একে অপরের সাথে সম্পর্কিত সমস্ত দশার একটি সেট। যে কোনো শাখায় সমস্ত পর্যবেক্ষণ বা পরিমাপ একে অপরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
MWI তে শ্রোডিঙ্গার সমীকরণ অথবা কোয়ান্টাম ফিল্ড তত্ত্ব সব সময় সর্বত্র বিরাজমান। প্রতিটি পর্যবেক্ষণ সম্মিলিত পর্যবেক্ষক-বস্তুর ওয়েভ ফাংশনকে দুই বা ততোধিক কোনো মিথস্ক্রিয়া না করা (non-interacting) শাখার কোয়ান্টাম সুপারপজিশনে পরিবর্তিত করে বা অনেক "জগতে (বা বিশ্বে)" বিভক্ত করে। যেহেতু অনেক পর্যবেক্ষণের মতো ঘটনা ঘটেছে এবং ক্রমাগত ঘটছে, তাই একই সাথে বিশাল এবং ক্রমবর্ধমান সংখ্যক বিদ্যমান দশা রয়েছে।
1960 এর দশকে উত্তর ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের Bryce DeWitt বলেছিলেন, "প্রতিটি নক্ষত্রে, প্রতিটি গ্যালাক্সিতে, মহাবিশ্বের প্রতিটি প্রত্যন্ত কোণে সংঘটিত প্রতিটি কোয়ান্টাম রূপান্তর পৃথিবীতে আমাদের স্থানীয় বিশ্বকে নিজের অগণিত প্রতিলিপিতে বিভক্ত করছে।" তারপরে জন হুইলার, যাঁর অধীনে এভারেট গবেষণা করতেন, তিনি MWI থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করেন। 1970-এর দশকে তিনি বলেন “I have reluctantly had to give up my support of that point of view in the end — because I am afraid it carries too great a load of metaphysical baggage.” কিন্তু ঠিক সময়ে বহু-বিশ্বের তত্ত্ব পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছিল এবং কসমোলজি এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এ প্রয়োগের মাধ্যমে রূপান্তরিত করার চেষ্টা শুরু হয়েছিল। বিজ্ঞানী জন স্টুয়ার্ট বেল (John Stewart Bell) যিনি বেল থিয়োরেমের জন্য বিখ্যাত, তিনি কিন্তু স্বীকার করেছিলেন যে এতে কিছু থাকতে পারে। তিনি লিখেছিলেন, The “many worlds interpretation” seems to me an extravagant, and above all an extravagantly vague, hypothesis. I could almost dismiss it as silly. And yet … It may have something distinctive to say in connection with the “Einstein Podolsky Rosen puzzle,” and it would be worthwhile, I think, to formulate some precise version of it to see if this is really so. And the existence of all possible worlds may make us more comfortable about the existence of our own world … which seems to be in some ways a highly improbable one.
MWI এর সুনির্দিষ্ট সংস্করণ আসে বিজ্ঞানী David Deutsch এর কাজ থেকে। Deutsch 1970-এর দশকে DeWitt-এর সাথে কাজ করেছিলেন, এবং 1977 সালে, DeWitt দ্বারা আয়োজিত একটি সম্মেলনে তিনি এভারেটের সাথে দেখা করেছিলেন। এভারেট তার ধারণাগুলি বিশাল শ্রোতাদের কাছে উপস্থাপন করেছিলেন একমাত্র সেখানেই। Deutsch নিশ্চিত হয়েছিলেন যে বহু-বিশ্বের তত্ত্ব কোয়ান্টাম বিশ্বকে বোঝার সঠিক উপায়। তিনি কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের ক্ষেত্রে অগ্রগামী হয়ে ওঠেন। সেটি তাঁর কম্পিউটারের প্রতি আগ্রহের কারণে নয় বরঞ্চ তাঁর বিশ্বাসের কারণে যে শেষ পর্যন্ত একটি কার্যকরী কোয়ান্টাম কম্পিউটারই MWI এর বাস্তবতা প্রমাণ করবে।
এখানে আমরা শ্রোডিঞ্জারের ধারণার একটি সংস্করণে ফিরে যাই। শ্রোডিঞ্জারের বিড়াল পরীক্ষার এভারেট সংস্করণে, ডিভাইসটি ট্রিগার হওয়া পর্যন্ত একটি একক বিড়াল রয়েছে। তারপরেই মহাবিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। DeWitt আগে একই রকম ভাবে বলেছিলেন একটি দূরবর্তী গ্যালাক্সিতে একটি ইলেকট্রন দুটি (বা তার বেশি) কোয়ান্টাম পথের (quantum paths) একটি 'পছন্দের' মুখোমুখি হওয়ার ফলে আমাদের নিজেদের জগৎ সহ সমগ্র মহাবিশ্বকে বিভক্ত হয়ে যায়। Deutsch-Schrödinger সংস্করণ অনুযায়ী, কোয়ান্টাম তরঙ্গ ফাংশনের সমস্ত সম্ভাব্য সমাধানের সাথে সম্পর্কিত মহাবিশ্বের একটি অসীম সংখ্যক বৈচিত্র্য (একটি মাল্টিভার্স) রয়েছে। বিড়াল পরীক্ষার প্রসঙ্গে বলা যায় যে অনেক অভিন্ন মহাবিশ্ব রয়েছে যেখানে অভিন্ন পরীক্ষাকারীরা অভিন্ন ডিভাইস তৈরি করে। এই মহাবিশ্বগুলি সেই বিন্দু পর্যন্ত অভিন্ন যেখানে ডিভাইসটি ট্রিগার হয়। তারপর, কিছু মহাবিশ্বে বিড়াল মারা যায়, কিছুতে এটি বেঁচে থাকে এবং পরবর্তী ইতিহাসগুলি অনুরূপভাবে ভিন্ন। কিন্তু সমান্তরাল বিশ্বগুলি কখনই একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে পারে না।
নাকি তারা পারে?
এরপর পরবর্তী পর্বে...
লিখাঃ সরোজ নাগ।
সঙ্গের ছবিটি উইকিপিডিয়া থেকে পাওয়া।